• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩ | ডিসেম্বর ১৯৯৭ | রম্যরচনা
    Share
  • দাঁত-ও-ফটো তোলা-ও-বাঁধাই : রঞ্জন ঘোষাল

    হাতলফাতল থাকে না বলে সোফা-কাম-বেড জিনিশটা সোফা হিশেবে খুব একটা তেমন জুতের হল না, নয়? আবার যে পেড়ে ফেলে বিছানা পাতবেন তাতেও সমান (পড়ুন অসমান) অস্বোয়াস্তি। আমার নিজের সেজোকাকা তাঁর ছেলেবেলা থেকেই নানারকম উদ্ভাবনার কাজ নিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। তবে ওঁর সেফটিরেজর-কাম-রেফ্রিজরেটর এবং মশারি-কাম-সাবান নানা কারণে জনপ্রিয় হতে পারে নি। এখন উনি পেশায় দাঁতের ডাক্তার। আর শখ হল ফটোগ্রাফির। ফলে বহরমপুর শহরে সেজোকাকা যে চেম্বার-কাম-স্টুডিওটি খুলেছেন তার আপাত-সাধারণ সাইনবোর্ডটি এইভাবে লিখিত:

    হাসিমুখ

    এখানে দাঁত-ও-ফটো তোলা-ও-বাঁধাই করা হয়

    মফস্বলের ছেলে, এমনিতেই চাকরিবাকরি জোটানো শক্ত, তার ওপর নিজের সেজোকাকা এরম ফলাও কারবার ধরেছেন, দুগ্‌গা বলে ঝুলে পড়লুম। আমাদের শিলিগুড়ির তুলনায় বহরমপুরটা কিছু-নয় জাতীয় শহর হলেও এর ইতিহাস-আবজানো এমন একটা গন্ধ আছে যে চট করে জায়গাটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। সেজোকাকা বললে, - ঘন্টেশ্বর, আর বাপের অন্ন ধ্বংসানো নয়, এবার এখানেই লেগে পড়। আমি বললুম- তোমার যা স্কীম অভ থিংস সেখানে আমি কিভাবে ফিট করব বুঝতে পারছি না যে। শখের থিয়েটার বা বাহাত্তর ঘন্টা অবিরাম সাইকেল-চালনা ছাড়া কিছুই যে তেমন আসে না। সেজোকাকা বললেন, - তুই হবি আমার ডার্ক-রুম অ্যাসিসটেন্ট-কাম-রিসেপশানিস্ট। আমি অবাক হলুম, - সে কী? ডার্করুমের কাজ তো ঘুপচি একটা বন্ধ ঘরে, সবার চোখের অন্তরালে, আর রিসেপশানিস্টকে তো হাসিমুখে, বাইরে- সেজোকাকা বেড়ালের মত মিহিদানা হাসি হাসলেন একখানি। -রিসেপশনে তোকে বসে থাকতে হবে কে বলল রে পাগল? তুই ডার্করুমে বসে ছবি ডিভেলাপ করবি, কানে হেডফোন। সঙ্গে মাউথ-পীস থাকছে। তুই গমগমে গলায় বলে উঠবি, -বসুন ম্যাডাম, আপনি দাঁতের রুগী হলে আপনার নম্বর চুয়াল্লিশ। এখন তেরো চলছে। আর আপনি যদি পাসপোর্ট ফোটোর কেস হন- বাঁ-দিকের ছোটো ঘরটায় বসুন। এই তো সহজ মামলা- কথা বলে যাচ্ছিস, কান খাড়া রাখছিস, চোখ থাকছে ব্রোমাইড-এর দিকে, হাতে ড্রায়ার, প্রিন্ট শুকুচ্ছিস।

    কাজটা যে খুব সহজ হবে না সেটুকু না বোঝার মত আকাট তো নই। বললুম- আমি কি পারব সেজোকাকা? সেজোকাকা ভ্রু কোঁচকালেন, - এর মধ্যে কঠিন ব্যাপার কী আছে? ওই গম্‌গমে গলা? একটা হাঁড়ি, সেরেফ একটা হাঁড়ির মামলা, মাথায় হেলমেটের মত করে একটা মেটে হাঁড়ি পরে থাকবি, ওটাই একটা রেসোনেন্স বক্সের কাজ করবে, তুই তোর স্বভাবসিদ্ধ ছ্যানছেনে গলায় কথা কইলেও হাঁড়িটি-ই এনে দেবে তোর বাঞ্ছিত হেঁড়েত্বে। নে নে ঘন্টু, আর টালবাহানা করিস নি। কাল থেকে শুরু করে দে। আমি লেগে পড়লাম। বেশ চলছিলও। কিন্তু অবস্থাগতিকে একদিন কাকার তৈরি একটা ওমপান খেয়ে এমন বিচ্ছিরি একটা অম্বলের অসুখ হল যে আমি বহরমপুর ছেড়ে আসতে বাধ্য হলাম। ওমপান হল জর্দাপানের ভেতরে মাপসই একটি পুরুষ্টু ডিমের অমলেট। ওইটি খেলে নাকি পান খাওয়াও হল অথচ পেটও ভরল। ওমপানকে উনি অচিরেই স্ন্যাক্‌-কাম-আফটার-মিন্ট হিসেবে পপ্যুলারাইজ করতে চলেছেন।

    শিলিগুড়ি থেকে ফিরে আসব বলে জিনিশপত্র গোছগাছ করছি। সেজোকাকিমা একটু বিষণ্ণ হয়েই বললেন- ঘন্টেশ্বর, যাচ্ছো পেটের এই অবস্থা নিয়ে…? তা তোমার কাকার তৈরি চিরুনি-কাম-ফোল্ডিং বেডপ্যানটাও ভরে নাও না, ট্রেনে যদি ব্যবহার করার দরকার হয়। আমি আর্ত কন্ঠে বললুম- অ্যাঁ? কাকিমা বললেন- হ্যাঁ, আর ওই জগিং-শু-কাম্‌ ঠাকুরের সিংহাসন-কাম-জগঝম্পখানা আমি প্যাক করেই রেখেছি, ওটা দিদিভায়ের হাতে মনে করে দিয়ো কিন্তু।

    সেই থেকে আমি দেশভ্রমণ-কাম-উপার্জনের ধান্দায় শিলিগুড়ি ছেড়ে বেরোনো একেবারে বন্ধই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু খোঁড়ার পা খানায় পড়ে।

    একদিন ভুল করে বেরিয়েই পড়েছিলাম- একটু গাঁ-গঞ্জের হাওয়া গায়ে লাগাতে। নেমে পড়লুম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টপে- মিনিট কুড়ির রাস্তা শহর থেকে। শিক্ষার মত জিনিশ আর নেই- যা খুঁতসন্ধানী ক্ষুদ্রতা আর দৈনন্দিন দৈন্যের ওপরে উঠে যাওয়ার- হয়তো একটু খাড়াই- সিঁড়িপথ। একজন অধ্যাপক, অধ্যাপকই হবেন, নইলে অমন উদ্বিগ্ন আর উদ্‌ভ্রান্ত টাইপের কেন, যথেষ্ট অন্যমনস্কভাবে এসে আমায় পেয়ে খুব আশ্বস্ত বোধ করলেন, বললেন, - এসে গেছ দেখছি। তা চট্‌ করে একটু আফিং-এর জোগাড় করে দিতে পারো? আমি বললুম- আফিং? আফিং কী হবে? উনি বললেন- একটা বেড়াল, বুঝলে, কিছুদিন ধরেই ওটাকে পুষ্যি নেবো নেবো করছি, কিন্তু কিছুতেই সেটা- মানে খালি এবাড়ি সেবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে- তাই ভাবছিলুম দুবেলা দুধের সঙ্গে যদি সর্ষে পরিমাণ করে আফিং খাওয়ানো যায়- আমি উত্তরোত্তর উত্তপ্ত হচ্ছিলুম। আমায় দেখে আফিংচালানকারী মনে হয়? আমি বললুম- আপনি ভুল করছেন স্যার, আমি নেশার জিনিশ সাপ্লাই-টাপ্লাই করি না। উনি বললেন, -আহা নেশা বলছ কেন? এটাকে একটা তির্যক চিত্তপ্রতিব্যবস্থা-তথা-অটো-রেকারিং ইন্ডক্ট্রিনেশান হিসেবে দেখতে পারছ না? আমি থই পেলুম না। প্রোফেসর বুঝিয়ে বললেন, - তুমি শুধু নিজের দিকটাই ভাবছ উত্থানপদ, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝবে- আমি দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে জানালুম- আমার নাম কস্মিনকালেও উত্থানপদ নয়, আমি তো- উনি সস্নেহে বললেন, -দ্যাখো, তাহলে নিজেই দ্যাখো- দ্বৈতবাদের যাবতীয় ডাইকোটমির ঢেঁকি শুধু য়ুনিভারসিটির ক্লাসরুমে নয়, তোমার স্বীয় আইডেনটিটির স্বর্গে গিয়েও বিমূর্তির ধান ভানে। বলেছিলুম কিনা অ্যাঁ?

    আমি বিমূঢ়তর অবস্থায় একপুরিয়া আফিং প্রোফেসরের হাতে যেমন-তেমন করে গুঁজে দিয়ে পয়সার তোয়াক্কা না করেই কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিলুম সেদিন।



    অলংকরণ (Artwork) : ভাস্কর সরকার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments