• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২ | সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ | প্রবন্ধ
    Share
  • আমেরিকার বাঙালী সমাজ সম্পর্কে কয়েকটি কথা : রজত চন্দ

    দু’ লক্ষ বা তারও বেশী বাঙালীর বাস আমেরিকায়। তাঁদের ঐতিহাসিক পটভূমিকা, জীবনযাত্রা, আশা ও হতাশার কথা আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধটিতে। মার্কিনদেশ কেন আজও বহু মানুষের কাছে আকর্ষণীয় এবং এদেশের সমাজব্যবস্থার প্রধান সমস্যাগুলো কি তার উল্লেখ করা হয়েছে সংক্ষেপে। বাঙালীদের কর্মজীবনে সাফল্য, সাংস্কৃতিক উদ্যম ইত্যাদির সঙ্গে তাঁদের দলাদলি ও উন্নাসিকতার কথাও বলা হয়েছে। সবশেষে আলোচিত হয়েছে বাঙালী সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতের কথা, দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কোনদিকে যাচ্ছে এবং কেন ভারতীয়-আমেরিকানদের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা বিশেষ দরকার সে সম্বন্ধে কিছু ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।

    অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার ও আমেরিকার New England অঞ্চলের মধ্যে পণ্যবস্তুর আদান প্রদান মারফৎ একটা বেসরকারী ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। Massachusetts প্রদেশের Plymouth Museum এর অধ্যক্ষা কয়েক বছর আগে এ সম্বন্ধে আলোকপাত করেছেন। রামমোহন রায় আমেরিকার ও ফরাসী বিপ্লবের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবধারা কিভাবে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকরী হতে পারে তা ভেবেছিলেন এবং আমেরিকার Unitarian সম্প্রদায়ের নেতা W.E. Channing-এর দাসপ্রথা নিবারণের কাজে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের select committee-র কাছে রামমোহন বলিষ্ঠ বক্তব্য, তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সতীদাহ প্রথা নিবারণ ও ভারত শাসন সংস্কার বিষয়ের Reform Bill পাশ করার কাজে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা শিক্ষিত আমেরিকানরা, বিশেষত Unitarian-রা লক্ষ করেছিলেন। রামমোহনের জীবনীকার S.D Collect লিখেছেন যে ১৮৩৩ সালে গ্রীষ্মকালে ফ্রান্স ভ্রমণের পরে তাঁর আমেরিকা যাবার বিশেষ ইচ্ছে ছিল কিন্তু এই পরিকল্পনা কাজে পরিণত হবার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

    রাজনারায়ণ বসুর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বঙালী সমাজ জানতে পারেন যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের (প্রধানত ইয়োরোপের) মানুষ দলে দলে এই নতুন দেশে গিয়ে স্বদেশের আর্থিক ও ধর্মীয় বাধাবিপত্তি ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে জীবন শুরু করেছেন। তখন এ দেশের পশ্চিমদিকে দ্রুত জনবসতি গড়ে উঠছিল এবং পরিশ্রমী মানুষেরা নবোদ্যমে নানা সুযোগ সুবিধাও করে নিচ্ছিলেন। অবশ্য এ কথাও গোপন ছিল না যে বর্ণবিদ্বেষের ফলে এশীয়বাসীরা সে দেশে স্বাগত আগন্তুক হিসেবে গণ্য হতেন না। রেল লাইন তৈরীর কাজে যে বহুসংখ্যক চীনে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এসেছিলেন, তাঁদের দুর্দশার কথাও জানা ছিল।

    ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে শিকাগোর World’s parliament of Religion-এ স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রমুগ্ধকর বক্তৃতামালাই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাংলা ও আমেরিকার মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগসূত্র স্থাপন করে। হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় চিন্তাজগৎ সম্বন্ধে পশ্চিম জগতে যে নির্জীবতার ধারণা প্রচলিত ছিল এই তেজস্বী বাণী তা অনেকটা বদলে দিল। অন্যদিকে সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ আমেরিকায় ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আশাবাদ বিবেকানন্দকে উদ্বুদ্ধ করে। আজও রামকৃষ্ণ মিশন এবং বেদান্ত society এ দেশের অনেক শহরেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এ দেশের কিছু বিদগ্ধ ব্যক্তি ভারতীয় দর্শন ও অধ্যাত্ম বাদের বিষয়ে গভীরভাবে জানেন। উদাহরণ স্বরূপ দূরদর্শনে প্রচারিত Joseph Campbell-এর ‘Power of Myth’ সম্বন্ধে আলোচনার উল্লেখ করা যেতে পারে। কৃষ্ণমূর্তির বক্তৃতা ও লেখার সঙ্গেও কিছু মানুষ পরিচিত। আশা করা যায় মার্কিনদেশ ও ভারতের আন্তরিক পরিচয়ের শতবর্ষ পরে এই দেওয়া ও নেওয়ার মূল্যায়ন হবে নিয়মিতভাবে।

    ১৯১২ সালের শেষভাগে রবীন্দ্রনাথ প্রথম আমেরিকায় আসেন। Rochester-এ Race Conflict সম্বন্ধে বক্তৃতা এবং হাভার্ড ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন তিনি। সেবার মাস ছয়েক কাটান তিনি এ দেশে। এই ভ্রমণের প্রধান ফল হল রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে technical বিভাগ, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থাপনের প্রয়োজন বুঝতে পারেন। ভবিষ্যতে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করেন তিনি এই সময়ে। কবি তাঁর বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও ছোটজামাই নগেন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি পড়াবার জন্য আর্বানায় পাঠিয়েছিলেন যথাক্রমে ১৯০৬ ও ১৯০৭ সালে। ইংল্যান্ড, জার্মানী, ফ্রান্স, জাপান বাদ দিয়ে আমেরিকায় পড়তে আসাটা সে যুগে ছিল খুবই বিরল। রথীন্দ্রনাথ তাঁর “পিতৃস্মৃতি” এবং “On the Edges of Time” বইতে লিখেছেন যে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে আনতে যাননি কেউ, কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন যে নিকটবর্তী Indiana প্রদেশ থেকে উনি আসছেন। সুদূর ও অপরিচিত India থেকে কেউ পড়তে আসছে এটা তাঁদের ঠিক বোধগম্য হয় নি।

    বিশ ও ত্রিশের দশকে শিশু সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় (যিনি জওহরলালের বন্ধু ছিলেন) প্রমুখ অল্পসংখ্যক বাঙালী আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ভারতের স্বাধীনতার পরে স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য ছাত্রসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থনীতিবিদ সুধীর সেনের Wanderings এবং শিল্পী ভূপেন হাজারিকার আমি এক যাযাবর বইতে ঐ সময়ের কথা জানা যায়। ষাট দশকের মাঝে এশিয়ানবাসীদের পক্ষে এ দেশে বসবাস করা সহজ হয়। তখন থেকে মার্কিন দেশে বাঙালীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

    প্রায় দশ লক্ষ ভারতীয় এখন আমেরিকায় বাস করেন। এঁদের মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যা সঠিক জানা নেই; সম্ভবত দু’লক্ষাধিক বাংলাদেশী ও ভারতীয় এখন এদেশে আছেন, অর্থাৎ এ দেশের ২৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বাঙালীরা ০.১ শতাংশেরও কম। এঁদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, অধ্যাপক ইত্যাদি পেশাদারের সংখ্যা অনেক, কিন্তু নানাধরনের অপেশাদারী চাকরী বা ছোটখাট ব্যবসাতে নিযুক্ত আছেন যাঁরা তাঁদের সংখ্যাও কম নয়।

    আমার মনে হয় তথাকথিত তৃতীয় ও প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে রোজকার জীবনযাত্রার প্রধান পার্থক্য হল যে ‘উন্নত’ দেশগুলিতে চাকরিজীবিরা, এমনকি অপেশাদারী কাজে নিযুক্তরাও, উপার্জিত অর্থে অনায়াসেই জীবিকানির্বাহ করতে পারেন যা ‘উন্নয়মান’ দেশগুলিতে বেশ কঠিন কাজ। তবে আমেরিকান ব্যবস্থায় বেশীর ভাগ চাকরীই স্থায়ী নয় এবং সর্বত্র প্রবল প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে চলতে হয় প্রায় সকলকেই, সহযোগিতার ভাগটা অল্প। যথাসাধ্য ভাল করে কাজ করার চাপ রয়েছে সর্বদা, তাই সময়ের অভাব বোধটা বেশ প্রবল। কাজের জগতে বিনয় ও লজ্জা এখানে ভূষণ বলে ধরা হয় না। আত্মপ্রচারের প্রয়োজন যথেষ্ট। Aggressiveness এবং নিজ বক্তব্য জোর গলায় বলাটা প্রশংসনীয় বলে গণ্য করা হয়। মার্কিন জীবনযাত্রায় যৌবনের জয়গান লক্ষ্য করা যায় সর্বত্র। বলা বাহুল্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজের সঙ্গে মার্কিনজীবনের মূল্যবোধের পার্থক্য বিশাল। ইয়োরোপের কয়েকটি দেশের তুলনায় কম হলেও আমেরিকার বেকার ভাতা, foodstamps, medicaid ইত্যাদির সহায়তায় কষ্টেসৃষ্টে জীবনধারণ করা যায় চাকরী না থাকলেও এবং আত্মীয় বা বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য না পেলেও। এ দেশে টেলিফোন ও কম্পিউটার জগতে ঘটছে বৈপ্লবিক উন্নতি যার প্রভাব এসে পড়ছে প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায়। নানা যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার ও নির্ভরযোগ্য সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা থাকায় দৈনন্দিন জীবন চলে সহজ ও স্বচ্ছন্দ গতিতে।

    এ দেশের সাধারণ মানুষের পরিচ্ছন্নতা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্মোদ্যম, আত্মসমালোচনা ইত্যাদি প্রশংসনীয় হলেও সমাজ ব্যবস্থায় বড় বড় ফাঁক রয়েছে এখনও। কারণ অনুসন্ধানের মধ্যে না গিয়ে কয়েকটি সমস্যা উল্লেখ করছি। চিকিৎসা বিজ্ঞান বিশেষ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই, বিশেষত দরিদ্রতর মানুষরা বড় ডাক্তার বা ভাল হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকার সুযোগ পান না, কারণ প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের কোন চিকিৎসা বীমা নেই। এরই অন্যতম ফল হল আমেরিকায় শিশুমৃত্যুর হার, যা অন্যান্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশী। অদূর ভবিষ্যতে বর্ণবৈষম্য দূর হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

    অবশ্য গত কুড়ি বছরে চাকরীর ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়রা বেশ খানিকটা এগিয়েছেন প্রধানত Affirmative Action এবং তৎসংলগ্ন নিয়মাবলীর ফলে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাঙালীদের মধ্যেও বর্ণবৈষম্য বেশ প্রকট। অনেকেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের ঘৃণা ও সন্দেহের চক্ষে দেখে থাকেন কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষদের খুবই ভক্তি করেন। মাদকদ্রব্যের অত্যধিক ব্যবহার, বন্দুকের সংখ্যাধিক্য, যৌনতার অপব্যবহার ইত্যাদি এবং তার ফলাফলের বিস্তারিত আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। সৌভাগ্যক্রমে বাঙালীরা এবং অন্যান্য এশিয়াবাসীরা মোটামুটিভাবে এই সমস্যাগুলি এড়িয়ে চলতে পেরেছেন। এদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিশেষ নেই তাই এইসব সমস্যার আশু সমধানের আশা কম।

    বেশীরভাগ public স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষত অংক ও বিজ্ঞান শিক্ষা, অন্যান্য উন্নত দেশগুলির তুলনায় পিছিয়ে আছে। ভাল public স্কুলগুলো দামী পাড়ায়, যেখানে দরিদ্র পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়ার সুযোগ নেই। কোন কোন অঞ্চলে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। অবশ্য উচ্চশিক্ষার জগতে এদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয় দুনিয়ার সেরা বলে গণ্য হতে পারে। তাই স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসে বিদেশীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

    মার্কিন সমাজব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে এ দেশ আজও পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের কাছেই আকর্ষণীয়। এ দেশের আইনকানুন, বিশেষত “Bill of Rights” দিয়ে রক্ষিত হয়ে ভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাবধারার মানুষরা স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবন যাপন করতে পারেন এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগও পান। মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম হয় অবশ্যই। মোটের ওপর বলা যেতে পারে যে, অভিবাসীদের দিয়েই যেহেতু দেশটা গড়ে উঠেছে তাই, ইউরোপীয় বা এশীয় দেশগুলোর তুলনায় নবাগতরা মার্কিনদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সহজে অভ্যস্ত হতে ও মানিয়ে নিতে পারেন। কথাটা “New World” এর অন্যান্য দেশগুলির, অর্থাৎ কানাডা, লাতিন আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রতিও প্রযোজ্য। কথিত আছে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট তাঁর এক বক্তৃতা শুরু করেছিলেন “My fellow immigrants….” বলে। আমেরিকার বড় শহরগুলোতে, বিশেষত লস এঞ্জেলেসে ও নিউ ইয়র্কের পথে ঘাটে নানা দেশের নানা ভাষার মানুষের ভিড় দেখলে মনে হয় “যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্‌”। বস্তুত multicultural workforce and society আজ শুধু একটা কথার কথা নয়।


    এবারে আজকের দিনের বাঙালী অভিবাসী ও বাঙালী-আমেরিকানদের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে বাঙালীদের সংখ্যা অল্প বলে তাঁরা সামাজিকভাবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে মিশতে বাধ্য হন। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবাঙালী ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, এবং অল্পসংখ্যক মার্কিন ও অন্যান্য দেশীয়, যাঁরা ভারতবর্ষ বা বাংলার বিষয়ে উৎসাহী, তাঁরা আছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে বাঙালীদের ভারতীয় উপমহাদেশের এবং অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটে; তবে তাঁদের অসুবিধে হচ্ছে এই যে ভারতীয় শিল্পী ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা এদেশের বড় শহরগুলিতে আসেন তাঁদের সঙ্গে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের যোগাযোগের তেমন সুযোগ ঘটে না, যার ফলে এঁরা খানিকটা বিচ্ছিন্ন বোধ করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকলা থেকে।

    (আশা করা যায় internet এবং “পরবাস”-এর মত পত্রিকা এঁদের এই অভাব-কে অন্তত কিছুটা পূরণ করতে সাহায্য করবে।) অন্যদিকে এই প্রতিনিধিরাও প্রধানত বড় শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গেই পরিচিত হন এবং এ দেশের সমগ্র রূপটিকে দেখতে পান না।

    নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ইত্যাদি বড় শহরগুলিতে স্বভাবতই বাঙালীদের সংখ্যা বেশী। বছর কুড়ি হল এই শহর ও শহরতলীগুলোতে বাঙালীদের ক্লাব বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এতে দুদিন ব্যাপী দুর্গা পুজো, কালী পুজো, সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্মদিবস ইত্যাদি পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংশ থাকে। সামাজিক অংশটা, অর্থাৎ পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া এবং কিছু নতুন পরিচয় ও আলাপ যথেষ্ট প্রাধান্য পায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীরাই প্রধানত অংশগ্রহণ করে থাকেন। গান, নৃত্যনাট্য, ধ্রুপদী নাচ ও নাটকেরই প্রাধান্য দেখা যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণে এর বৈচিত্র্য বেড়েছে। বাংলাদেশের শহীদ দিবস ও স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় বেশ সমারোহের সঙ্গে। এতে আলোচনাচক্রের ব্যবস্থাও থাকে, যদিও তাতে দর্শকমণ্ডলীর সংখ্যা বেশী থাকে না। বছর দশেক হল গ্রীষ্মের ছুটির অবকাশে প্রতি বছর উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলন এখানকার বাঙালীদের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন। ২/৩ দিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানে নানা বিষয় ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা, উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা, আবৃত্তি, নাটক, নাচ ও গানের ঢালাও ব্যবস্থা থাকে। কয়েক হাজার যোগদানকারীর জন্য ব্যবস্থা করা এক মস্ত ব্যাপার।

    উল্লিখিত অনুষ্ঠানগুলির মধ্য দিয়ে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা নিজেদের কৃষ্টির স্পর্শ পান এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলে প্রাণ খোলা হাসিগল্পের ভিতর দিয়ে বহুদূরের ফেলে আসা দেশের সুখস্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন সেটা অবশ্যই আনন্দের কথা। স্বভাবতই আমরা সবাই নিজ ভাষা ও ঐতিহ্যের গণ্ডির মধ্যে সহজভাবে মেলামেশা করে তৃপ্তি পাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় বড় শহর ও শহরতলীর বাঙালী সমাজ আর কোন সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে মেশেন না। সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে কৃত্রিম বেড়ার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখার অবধারিত ফল হয় ghetto existence. বাংলা ক্লাব জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতাদের তুচ্ছ ক্ষমতা নিয়ে কলহ এবং সবাই মিলে একটা বৃহত্তর গোষ্ঠী গড়ে তুলতে না পারাটা বড়ই দুঃখের ও লজ্জার ব্যাপার। এ ধরণের দলাদলি ভারতের অন্যান্য প্রদেশীয় ও অন্যদেশীয় অভিবাসীদের মধ্যেও রয়েছে, কাজেই এটা শুধু বাঙালীদের সমস্যা নয়। মনের উদারতা বাড়াতে হলে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ও কৃষ্টির মানুষদের সঙ্গে দেওয়া নেওয়া করতেই হবে এবং এর মধ্য দিয়েই নিজেদেরও ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে শিখতে হবে। অজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে সন্দেহ ও অবজ্ঞা। আমাদের আচরণে বর্ণবৈষম্যের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের, বিশেষত ভারতের অন্যান্য প্রাদেশিকদের প্রতি বাঙালীদের একটা উন্নাসিকতা দেখা যায়। মার্কিন দেশে থেকে বন্ধ দিগন্ত বিস্তার করার বহু সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ হারালে পরিতাপের বিষয় হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে, যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালী নেই এবং অনুষ্ঠানগুলি (যেমন দীপাবলী) সর্বভারতীয়, সেখানে এই দলাদলি ও অনুদারতার সমস্যা কম।

    সহজ গতানুগতিক জীবনযাত্রা ও অগভীর সামাজিক আদান প্রদানে অনেকে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। এই divine discontent বা আত্মিক শূন্যতাবোধই মানুষকে অচেনা ও নতুন পথ চলতে প্রেরণা যোগায়। আশা করবো এই অভাববোধ আমেরিকায় প্রতিভাবান বাঙালীদের চিন্তাজগতে বা ব্যবহারিক জগতে নতুন পথ খুঁজে নিতে এবং অভিনব দিক আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে।

    যে সব ছেলেমেয়ে আমেরিকাতে জন্মেছে বা খুব ছোটবেলা থেকে এখানে বড় হয়েছে তাদের অনেকেরই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটা ঝাপসা ধারণা মাত্র থাকে। স্কুল ও বন্ধুমহলে এবং অনেক বাড়ীতে রীতিনীতির ও ভাষার বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। দুই ভিন্ন ধরণের ভাবধারা এবং মূল্যবোধের টানাপোড়েনের মধ্যে খাপ খাইয়ে চলা সহজ নয়। সাধারণত উনিশ কুড়ি বছর বয়স নাগাদ ছেলেমেয়েদের নিজেদের উৎস ও দেশীয় ভাবধারা সম্বন্ধে কৌতূহল জাগে। তখন তাদের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে পড়াশুনা ও আলোচনা করতে উৎসাহ বোধ করে। অল্প বয়স থেকেই যদি নিয়ম করে বাংলাভাষা ও ভারতীয় ঐতিহ্য এরা শিখবার ও জানবার সুযোগ পায় এবং বিশ্বের অন্যান্য ভাষা ও সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক বুঝতে পারে তা হলে এদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে ও বিভ্রান্তি কমবে। ভারতের আধুনিক সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা ও প্রশ্নোত্তর ঐ দেশ সম্বন্ধে ধারণা পরিষ্কার করবে। আমেরিকার স্কুলে পাঠ্য বই থেকে অথবা ক্লাসের শিক্ষায় বিদেশের, ভারতবর্ষের তো বটেই, ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কে বিশেষ খবর মেলে না।

    সুখের বিষয়, এখন বেশ কয়েকটি বড় শহরেই বাংলা স্কুল খোলা হয়েছে বা হচ্ছে। এতে বাংলা ভাষা, ভারতীয় রীতিনীতি, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে সপ্তাহে একদিন ঘন্টাখানেক ক্লাস হয়। মার্কিন জীবনযাত্রায় সময়ের অভাবের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, তাই এর চেয়ে বেশী সময় বের করা কঠিন। নতুন ভাষা শেখা সহজ নয় এটা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। ছোটদের বাংলা সংস্কারের দরকারের কথা বিশেষভাবে অনুভব করেছি। যদিও অনেকেই এ ব্যাপারে চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন তবুও আশা করবো যে বাংলা লেখায় কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার হয়ত লিখিত ভাষাকে যুক্তিপূর্ণ ও সহজ করতে সাহায্য করবে।

    আগেই বলেছি এদেশে বাঙালীদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করছেন। যাঁরা এই দলের মধ্যে পড়েন না এবং অপেক্ষাকৃত কঠিন জীবন যাপন করেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও অনেকেই ভালভাবে পড়াশুনা করে নানা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালী-আমেরিকানরা স্কুল কলেজে সুনাম অর্জন করেছে এবং বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে তাদের অনেকেই যে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেবে তাতে সন্দেহ নেই। এদের নিকট বন্ধুমন্ডলী বাঙালী ও ভারতীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দুই ভাবধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে বড় হবার ফলে এদের পরিণত দৃষ্টিভঙ্গী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে বিশেষ সহায়তা করবে এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে যে দূর দেশ থেকে এদের মা বাবা ভাগ্যান্বেষণে এখানে এসেছিলেন সে দেশের সঙ্গে এরা কতটা সম্পর্ক রাখবে তা অবশ্য বলা কঠিন। অন্যান্য দেশে, যেমন পশ্চিম ভারতীয় দীপপুঞ্জ, গায়ানা, সুরিনাম, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ফিজি ও মরিসাসে ভারতীয় অভিবাসীরা শতাধিক বছর ধরে নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন। মার্কিনদেশে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলেই আমার ধারণা; এর প্রধান কারণ হল এ দেশে ভারতীয়দের সংখ্যাল্পতা এবং প্রথম প্রজন্মের পর থেকে ক্রমে ক্রমে স্বাতন্ত্রের বেড়া ভেঙে পড়া।

    লেখাটি শেষ করার আগে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ভারতীয়-আমেরিকানরা চাকরী ও ব্যবসার জগৎ, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের বাইরে, এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বাইরে বিশেষ কোন দৃষ্টি দেন নি। রাজনীতি থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে চলা এবং কেবল নিজেদের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ থাকার ফল যে ভাল হয় না ইতিহাসে তার বহু উদাহরণ মেলে। ৭০ দশকে পূর্ব আফ্রিকা বিশেষত উগান্ডায়, ভারতীয়দের ওপর যে জুলুম ও অন্যায় চলে তার কোন উপযুক্ত প্রতিবাদ তখন করা যায় নি; এর আসল কারণ ছিল যে সেখানে ভারতীয়দের কোন রাজনৈতিক বল ছিল না। যদিও মার্কিনদেশে ব্যাপকভাবে এ ধরণের ঘটনার সম্ভাবনা কম তবুও একেবারে অকল্পনীয় নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানী আমেরিকানদের উপর অত্যাচার এবং কয়েক বছর আগে জার্সি সিটি ইত্যাদি অঞ্চলে কিছু ভারতীয়দের ওপর হামলার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হলেও বিদেশাগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রোশ বাড়তে পারে। এই সব সম্ভাবনা থেকে নিজেদের বাঁচাতে হলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের সংঘবদ্ধভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে নামা বিশেষ প্রয়োজন। তা হলেই পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের একটা দাবী ও জোর আসবে। আমেরিকাবাসী চীনে, জাপানী, কোরিয়ান, ফিলিপিনো ও ভিয়েতনামীদের মধ্যে সংঘবদ্ধতা ভারতীয়দের চেয়ে বেশী বলে মনে হয় কিন্তু এঁরাও রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন এখনও। অন্যদিকে আমেরিকায় ইহুদি সম্প্রদায় ভারতীয়দের চেয়ে বড় হলেও সংখ্যায় ৫ শতাংশের বেশী নয় এবং উচ্চতম সরকারী পদে তাঁরা নেই বললেও চলে, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক প্রতাপ এতই প্রবল যে কোন নেতাই এঁদের অথবা ইস্রায়েলের স্বার্থে আঘাত করতে সাহস পান না। এ এদেশের বিশাল আইরিশ সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা শতাধিক বছর আগে এখানে এসেছেন এবং এঁদের সঙ্গে আজকের আয়ারল্যান্ডের সম্পর্ক ক্ষীণ। নেতৃত্বস্থানীয়দের মধ্যে এঁদের সংখ্যা অনেক। নবাগত আইরিশদের স্বার্থরক্ষা এবং আয়ারল্যান্ডের আভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর ওপরেও এঁদের প্রভাব প্রবল।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments