বুধু মিয়া। নামটা থেকে নামধারী সম্পর্কে দুটি অনুমান করা যায়; এক লোকটি মুসলমান; দুই, লোকটি বাঙালী। কিন্তু যে পাথরের গায়ে নামটা উৎকীর্ণ, তা বাংলা থেকে হাজার ক্রোশ দূরে বৌদ্ধ-শিন্টো ধর্মের দেশ জাপানের ভূমিতে প্রোথিত। পাথরের তলায় মাটিতে মিশে আছে প্রয়াত বুধু মিয়ার দেহাবশেষ। স্বজন-স্বদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন, সম্ভাব্য জিয়ারতকারিদের নাগালের বাইরে। জসীমউদ্দীনের কবিতার বৃদ্ধের মতো কেউ এসে সঙ্গী কিশোরকে বলে না ”এই খানে তোর দাদার কবর”… ।
১৯৯৩-এর শেষের দিকে Daily Yomiuri-র ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটা খবর চোখে পড়েছিল। উদ্ধৃতি দিতে পারবো না, তবে খবরের সারাংশ ছিল মোটামুটি এরকম: কানাগাওয়া বিভাগের হেদোগায়া Commonwealth War Country-তে যোগ্য মর্যাদার সাথে দ্বিতীয় মহাসমরে নিহত Commonwealth-ভুক্ত দেশসমূহের যোদ্ধাদের জন্য স্মরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। খবর পড়ে আরো জানা গেল এই অনুষ্ঠানটি প্রতি বছরই পালিত হয়।
সমর সমাধি ক্ষেত্র সম্পর্কে আমার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে। কুমিল্লার সমর সমাধিস্থলে গিয়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছিল। যত্নে লালিত সবুজ ঘাসের গালিচায় ছাওয়া মৃদু ঢালু ভূমিতে ভারত (তৎকালীন), অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, কানাডা সহ বিভিন্ন দেশের নিহত যোদ্ধাদের সুবিন্যস্ত সমাধি। মৌন নিথর গাছের সারি দিনভর ছায়া যুগিয়ে চলেছে। কখনও কখনও নিঃশব্দতা ভেঙে ঝির ঝির বাতাসে মধ্যাহ্নের খরতাপ কিছুটা সহনীয় করে তুলেছে।
যুদ্ধকালে কুমিল্লা ছিল মিত্র বাহিনীর আঞ্চলিক ঘাঁটি। চট্টগ্রামেও এরকমের একটা সমাধিস্থল আছে। সেটা শুনেছি আরো বড়, তবে গিয়ে দেখা হয়নি কখনো। বৃটিশ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান James Finlay Co এগুলোর দেখাশুনা করে।
ইচ্ছা জাগলো আগামিতে হেদোগায়া সমাধিক্ষেত্রের অনুষ্ঠান একবার দেখতে যাবার। পরের বছর অনুষ্ঠানের সময় দেশে বেড়াতে যাওয়ায় সে সুযোগ হয়নি। তার পরের বছর, ১৯৯৫ সনে সে সুযোগ হল। এ বছরের অনুষ্ঠান একটা আলাদা তাৎপর্য মণ্ডিত। কারণ যুদ্ধ শেষের ৫০ বছর পূর্তি। নভেম্বর মাসের বারো তারিখের খুব ভোরে আমি বাসা থেকে বেরোলাম আমার সেই ইচ্ছা পূরণার্থে। তার আগেই কানাডার দূতাবাসে ফোন করে পথ নির্দেশ ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। প্রতি বছর এক-একটি অংশগ্রহণকারী দেশ অনুষ্ঠানটি আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। এবার দায়িত্ব পড়েছে কানাডার দূতাবাসের উপর। হেদোগায়া টোকিয়োর বাইরে দক্ষিণে, আর আমার বাসা উত্তরে। অনেক দূরের পথ। এজন্যই অন্ধকার থাকতে থাকতেই বাসা থেকে বেরিয়েছি। ন’টার মধ্যে টোকিয়ো পার হয়ে হেদোগায়া পৌঁছুতে হবে।
হেদোগায়া সমাধিক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত জায়গা বটে। টোকিয়ো থেকে খুব দূরে নয়, কিন্তু টোকিয়োর কোলাহলমুখর লোকারণ্য থেকে মুক্ত। হেদোগায়ার সাথে বিদেশিদের সম্পর্ক বেশ পুরনো। ভারতে যখন ১০০ বছর ইংরেজ শাসনের পর প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু ও পদানত হয়েছে, তখনো জাপানে বিদেশীদের প্রবেশ ও চলাচলের উপর কড়া বিধিনিষেধ ছিল। কয়েক’’টি নির্দ্দিষ্ট জায়গায় কেবল বিদেশীরা বসবাস করতে পারতো। হেদোগায়ায় ছিল সেরকম একটি ফিরিঙ্গী বসতি। যাঁরা James Clavell-এর Gaijin উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁরা জানেন নিশ্চয়।
বার তিনেক ট্রেন পালটিয়ে আর য়োকোহামাতে থেকে প্রাতঃরাশ সেরে যখন হেদোগায়া স্টেশনে পৌঁছুলাম, তখনো বেলা বেশি হয়নি। এত আগে না বেরুলেও চলতো। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সহজেই বাস স্ট্যান্ডটা পেয়ে গেলাম। সেখানে একটা সময়সূচী ঝুলানো আছে; মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে।
আমার সাথে আরো তিনজন সেখানে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছে। তিনজন পরস্পর পরিচিত বৃদ্ধ জাপানী। এদের গন্তব্যও কি অভিন্ন-কমনওয়েল্থ সমাধিক্ষেত্র? বয়েস দেখে মনে হয় এরা প্রাক্তন যোদ্ধা হতে পারে। অলস চিন্তায় ছেদ পড়লো যখন তাঁদের একজন পরিষ্কার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো আমি ভারতীয় কিনা। আমার বাংলাদেশী নাগরিকত্বের পরিচয় দিয়ে পরবর্তী প্রায় অবধারিত প্রশ্নের অপেক্ষায় রইলাম, “বাংলাদেশের বন্যা খুব শোচনীয়, তাই না?”
কিন্তু না। দু’জন প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো যে তাঁরা বাংলাদেশের খুব কাছ পর্যন্ত গিয়েছেন। “বেড়াতে, না কাজে?” আমি জিজ্ঞেস করি। “যুদ্ধে”, তাঁরা সংক্ষেপে জবাব দেন।
আলাপ করে জানা গেল তাঁরা দু’জনই বার্মা ফ্রন্টে ছিলেন। তিন জনের মধ্যে যিনি দেখতে সবচেয়ে বয়স্ক, তাঁর নাম গোতো। কক্সের বাজার, চিটাগাঙ, ইত্যাদি নামগুলো গড়গড়িয়ে আউড়ে গেলেন। যুদ্ধে তিনি কক্সের বাজারের কাছে তাঁর বৈমানিক বন্ধুকে হারিয়েছিলেন। আমার প্রশ্নকর্তা নিজের পরিচয় দিলেন তাকাহাশি বলে। তিনি সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন দোভাষী হিসেবে। যুদ্ধের সময় তিনি নেতাজীকে দেখেছেন। দু’চারটে হিন্দী শব্দ এখনো মনে আছে। “খানা, খানা; ঠিক হ্যায়?”
ঠিক হ্যায়। একা ছিলাম, এখন কিছু সঙ্গী জুটলো।
সমাধিক্ষেত্রে যখন গিয়ে পৌঁছুলাম, তখন অনেক লোক এসে পড়েছে, যদিও অনুষ্ঠান শুরু হতে বেশ দেরী। সময় কাটাতে সমাধিক্ষেত্রটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিপাটি, যত্নে সাজানো জায়গা, বলা বাহুল্য। মাঝখানের মূল বেদীর সামনে ইংরেজ সৈনিকদের সমাধি। অন্যান্য দিকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর ভারতীয়দের সমাধিস্থল। আয়ারল্যান্ডের troubles সম্পর্কে ফিল কলিন্সের একটি সুন্দর গান আছে। সেখানে দুই পক্ষের মৃতদের সম্পর্কে বলা হয়েছে united in defeat. এখানে যাঁরা শায়িত, তাঁরা একই পক্ষের, কিন্তু separated in victory.
বিশেষ উৎসাহ নিয়ে ভারতীয় অংশটি দেখলাম। তখন-ই চোখে পড়লো বুধু মিয়ার নাম উৎকীর্ণ সমাধিপ্রস্তরটি। ভারতের অংশে প্রায় প্রতিটি নামই মুসলমানের। কেন? হিন্দুরা কি যুদ্ধ করেনি? মুহূর্ত খানেক পর মনে পড়লো, হিন্দুদের গোর হয় না; মনে মনে খুব লজ্জা পেলাম। “ওদের” সম্পর্কে এত সাধারণ একটি ব্যাপার ভুলে যাই কি করে?
ধীরে ধীরে লোক সমাগম বাড়ছে। বেশীর ভাগই শ্বেতাঙ্গ অথবা প্রাক্তন জাপানী সৈনিক। নিজ নিজ কমনওয়েলথ দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আফ্রিকা-এশিয়ার কিছু কূটনীতিবিদ এবং স্থানীয় কিছু জাপানীও এসেছেন। যুদ্ধ সমাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিলেত থেকে এক দল ইংরেজ প্রাক্তন সেনা মেডাল-সজ্জিত হয়ে এসেছেন। তাঁদের সাথে এক কালের শত্রু জাপানী প্রাক্তন সেনাদের পুনর্মিলনের দৃশ্য ছিল দেখার মতন। সে আমলের অনেক ইংরেজ-অস্ট্রেলীয় এখনো জাপানিদের ক্ষমা করতে পারেনি। জাপান ও কমনওয়েলথ দেশের বাইরে অনুষ্ঠানে আরো ছিলেন দু’জন প্রাক্তন আমেরিকান সৈনিক।
অপেক্ষাকৃত দীর্ঘাঙ্গের মার্কিনিটির সাথে তাকাহাশি-সান কথা বলেছিলেন। আমি এগিয়ে তাঁদের সাথে যোগ দিলাম। তাকাহাশি মার্কিনির বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। “New York,” জবাব দেন সাহেব। “New York, না Jew Work?” বলে এক খ্যা খ্যা করে হাসলেন তাকাহাশি। সাহেবের ফর্সা মুখ মুহূর্তে লাল হয়ে গেল। সাহেবি টানের জাপানীতে ভদ্র কিন্তু শক্তভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে রসিকতাটি মোটেও ভদ্রজনোচিত না। বৃদ্ধ জাপানী তাকাহাশি না বর্ণবাদ না রাজনৈতিক শুদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। তিনি অপ্রস্তুত হয়ে বিড় বিড় করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। “ওই যে দেখেছো আমাদের সংগঠনের নেতা”, কিছু দূরে দাঁড়ানো অপর মার্কিনিকে দেখিয়ে সাহেব বললেন, “তিনিও ইহুদি।”
সেখানে থেকে সরে যেতেই গিয়ে পড়লাম একদল আফ্রিকান কূটনীতিবিদদের মধ্যে। পরিচয় দেওয়া-নেওয়ার পর একজন বললেন “আমরা কেন এসব অনুষ্ঠানে আসি? আমাদের কি পালন করার আছে এখানে? এটা ওই সাদাদের অনুষ্ঠান। যুদ্ধ করেছে তারা, মরেছে তারা, মেরেছেও তারা। তারা তো আমাদের মিত্র না, শত্রু। আমাদের উপর কম অত্যাচার করেছে তারা?” <>/প> ইহুদি মার্কিনি কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বিপ্লবী বক্তৃতায় ছেদ ঘটালেন। বললেন, “আজকের দিনে ওসব অতীত তিক্ততা ভুলে যাও, আজ মিলনের দিন। দেখো সেদিনের ঘোর শত্রু জাপানীই আর বৃটিশ যোদ্ধারা গলাগালি করছে।”
এর মধ্যে মূল অনুষ্ঠানের সময় হয়ে গেল। বেদীর উপর থেকে একজন কানাডীয় বাজখাঁই গলায় মাইক ছাড়া সবাইকে সেখানে সমবেত হতে বললেন। প্রাক্তন সৈনিক, কুচকাওয়াজে হুকুম হেঁকে অভ্যস্ত, বোঝা গেল। নামাজের জামাতের মত সবাই সার বেঁধে দাঁড়ালাম। এখানে দেখা হল বাংলাদেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সাথে। তিনি ফার্স্ট সেক্রেটারি। দূত মহোদয়ের আসবার কথা থাকলেও কার্যোপলক্ষে টোকিয়োর বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি এসেছেন।
শুরুর দিকের গুঞ্জন আর পায়ের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে গম্ভীর একটা স্তব্ধতা নেমে এল এক সময়। আমার সামনের সারির এক অপ্রকৃতিস্থ ইংরেজ বৃদ্ধ কতক্ষণ পর পর উচ্চস্বরে দুর্বোধ্য প্রলাপ বকে soundscape-এ কিছু বৈচিত্র্য যোগাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে শান্ত রাখতে গলদঘর্ম।
এক এক করে ছয়টি ধর্মের পাদ্রী-পুরোহিত-মোল্লা-রাবাই বেদীতে উঠে প্রার্থনা করলেন—অ্যাংলিকান, ক্যাথলিক, মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু আর ইহুদি। এর পর পুষ্পস্তবক অর্পণের পালা। এক একটা দেশের প্রতিনিধির পরিচিতির বাজখাঁই ঘোষণার পর তিনি বেদীতে উঠে ফুলের স্তবক রেখে আসছেন। বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি যার যার দেশের সর্বোচ্চ কূটনীতিক। অন্যান্য দূতাবাস থেকে এসেছেন নিম্নতর কর্মকর্তা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে এশীয় দেশগুলো কাউকেই পাঠায় নি। তাঁদের হয়ে ফুল দিলেন উন্নত দেশগুলোর লোকজন।
অনুষ্ঠান শেষে ফটকের কাছে ছোট একটি ঘর ও তার আঙ্গিনায় আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন হোস্ট কানাডার দূতাবাস। ছোট ঘরের ভিড় ঠেলে খাবারের টেবিলে পৌঁছে আবার আমাদের প্রথম সচিবের সাথে দেখা হল। আমি “old Japan hand” হিসেবে তাঁকে পর্ক-যুক্ত খাবারগুলো চিহ্নিত করে দিলাম। তিনি নীরবে আমার উপদেশ শুনলেন, কিছু বললেন না।
ঘুরে ঘুরে অনেকের সাথে কথা হল। তাকাহাশি-সান প্রায় সর্বক্ষণ আমার পাশে। কথা বলছেন ইংরেজিতে যতটা সম্ভব হিন্দী শব্দের প্রয়োগ করে। হাতে ধরা “চাই”-এর কাপ। দীর্ঘকায় এক ইংরেজ নিজে থেকে যেচে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। যাবার সময় তাঁর ভিজিটিং কার্ড দিয়ে গেলেন। Her Royal Britannic Majesty-র দূত মহাশয়। তাকাহাশি-সান অভিভূত। বললেন জাপানের “vertical society”-তে এধরনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি সাধারণ মানুষের সাথে এভাবে সহজ ভাবে হেসে-খেলে কথা বলবে, তা চিন্তার বাইরে।
ফিরবার সময় হয়ে আসছে। তাকাহাশি-সান বললেন তাঁর ইংরেজ বন্ধু গাড়িতে টোকিয়ো পর্যন্ত লিফ্ট দেবেন। প্রথম সচিবের কাছে গেলাম বিদায় নেবার জন্য। তিনি তখন আফ্রিকার কূটনীতিবিদদের সাথে কথা বলছেন।
“In Bangladesh there is perfect communal harmony,” বলে চলেছেন তিনি। তাঁর শ্রোতাদের মুখে অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দৃশ্যমান। উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি টার্মটির সাথে তাঁরা পরিচিত নন। আর এরকম একটি কথা এভাবে জোর গলায় শুনানোর কারণও তাঁরা সম্ভবত বুঝছেন না।
প্রথম সচিব আমাকে তাঁর বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ জানালেন। এতক্ষণ তাঁর নাম জানা হয় নি। বিদায়ের মুহূর্তে তাঁর কার্ড পেয়ে দেখি লেখা আছে “সুবীর ভট্টাচার্য”। পর্ক সম্পর্কে আমার সযত্নে দেওয়া পরামর্শ বৃথা গেল। আরেক দফা লজ্জা পেলাম। বাংলাদেশের কর্মকর্তা জেনে ধরেই নিয়েছিলাম মুসলমান হবেন।
তাকাহাশি-সানের বন্ধুকে দেখে তাঁর গাড়িতে চড়ার ইচ্ছে সম্পূর্ণ লোপ পেল, যদিও এখন না চড়েও উপায় নেই। অশীতিপর বৃদ্ধ। কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছেন। তবে চোখে চশমা নেই। হাতে লাঠি নেই। এখনো কাজ করে চলেছেন জাপানের বৃহত্তম বিজ্ঞাপণী সংস্থা দেন্ৎসুতে। আমাকে পেছনে বসিয়ে দু’ বন্ধু সামনে বসে গল্প করতে করতে রওনা হলেন টোকিয়োর পথে। দু’ জনের মধ্যে পরিচয় কাকতলীয় ভাবে এক হাসপাতালে দেখা হবার পর। একই রোগের চিকিৎসার জন্য তাঁরা গিয়েছিলেন। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ে তাঁরা দুজনেই বার্মা ফ্রন্টের প্রাক্তন সৈনিক।
পথে অবশ্য কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না। নিরাপদে টোকিয়ো পৌঁছানো গেল। টোকিয়ো স্টেশনের সামনে আমরা দুজনে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। চেয়ার টেনে বসতে বসতে তাকাহাশি-সান বললেন, “এই বোধহয় আমার শেষ এ ধরণের অনুষ্ঠানে যাওয়া। বয়স হয়েছে। কত দিন বাঁচি কে জানে?” অর্ডার দেবার জন্য তিনি একটু বিরতি নিলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, “ভালো লাগলো পুরাতন শত্রুর নতুন বন্ধু হবার দৃশ্য দেখে।” বৃদ্ধের দৃষ্টি আমাকে পেরিয়ে দূরের কিছুতে নিবদ্ধ। পাশের বইয়ের দোকানের শেল্ফে বৈচিত্র্যময় বর্ণ-বিষয়-বিন্যাসের বই থরে থরে সাজানো। “আমরা সবাই তো মানুষ। ভেদ-বিভেদ ভুলে যদি সদা- সর্বত্র এভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারতাম।”
এরকম ‘বাতচিত’ করতে করতে এক সময় আমাদের ‘খানা’ আর ‘চাই’ চলে এলো।