• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২ | সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ | গল্প
    Share
  • বিবর্ণ মারীচ : বিনয়েন্দ্র নাথ রায়

    এখন একা। এঘর ওঘর সবখানে শূন্যতা। বিছানার ওপর এলোমেলো ছড়ানো বই। সুদীপ পড়ছিল। ওর স্বভাব বরাবর একই রকম থেকে গেল। প্রথম প্রথম রাগ হত দীপার। ধমক লাগাত: ‘এ কি রকম পড়ার ছিরি তোমার, টেবিল-চেয়ারে বসে পড়তে পারো না?’ সুদীপ নিরুত্তর। ‘আর কোনোদিন এভাবে বইপত্র ছিটিয়ে নিয়ে বিছানায় বসবে না।’ এবার কথা বলে সুদীপ। শান্ত ভঙ্গীতে জানায়: ‘চেষ্টা করব ম্যাডাম।’

    ঐ পর্যন্ত। আবার সব এলোমেলো। ছড়ানো ছেটানো। বাপের স্বভাব পেয়েছে নীল। শুয়ে শুয়ে পড়ব। সোজা হয়ে বসে পড়তে বসলেই বলবে, ‘কি মাথা ধরেছে বাবা’। একফোঁটা বয়স থেকেই ওর নাকি মাথা ধরে। দু’ঘরের বিছানা তাই বিন্যস্ত থাকে না একটু সময়। কিছুই কি বিন্যস্ত থাকে? হয়ত থাকে না। স্বপ্নে থাকে হয়ত বা। জীবনে এলোমেলো।

    সুদীপ কলেজে চলে গেল একটু আগে। নীল স্কুলে। ওরা ফিরবে সেই বিকেলবেলা। এখন এগারোটা। টানা চারপাঁচ ঘন্টা একা। নীল দুপুরে স্কুলে যাবার পর থেকেই এই দ্বিপ্রাহরিক একাকীত্বের সূচনা। সত্যিই কি তাই? একাকীত্ব কি কোনো বিশেষ দিনক্ষণ থেকে শুরু হয়? একাকীত্ব থাকে। গভীর পুকুরের স্তব্ধতার মত। জোৎস্নায় বৃক্ষের ছায়ার মত। যে ছায়া ছোটবড় হয়। একেবারে যায় না কখনো।

    বারান্দায় ছোটো ছোটো টবে ফুলগাছ। এসব নীলের শখ। কতবার মরে যায়। আবার লাগানো। বেল, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা। বেলের মৃদু গন্ধ ভাসে বাতাসে। বিকেল, সন্ধ্যায়। চাঁদের আলোর রাতে ঐ গন্ধ দীপার চেতনার স্তর বেয়ে কোন নির্জন অতলে নেমে যায়। চুপ করে সে বসে থাকে ছোট বারান্দার এক কোনায়। একা। নীল ভেতরের ঘরে বসে পড়ে। সুদীপ ছাত্রছাত্রী পড়ায় ওর পড়ার ঘরে। কীটস্‌-এর নাইটিঙ্গল্‌ কেমন করে নির্বাসিত রুথের গহন মনে সুরের বেদনা ছড়ায়, মায়াময় জানালায় কোন বিষণ্ণ, বন্দিনী রাজকন্যা শোনে সেই গান। কখনো শেলীর ঝড় আকাশ-সমুদ্র-পৃথিবী আলোড়িত করে কবির চেতনায়--শীতের শেষে বসন্তের প্রত্যাশা নিয়ে আসে। ছাত্রছাত্রীরা বোঝে কিনা কে জানে। তবে দীপা বারান্দায় বসে শোনে। কলেজে পড়ার সময় এসব শুনতে হয়েছে ক্লাসরুমে। তখন এত ভাল লাগেনি। এখন লাগে। সে কি সুদীপের পড়ানোর গুণে? নাকি এত সময় পেরিয়ে আসা পরিশ্রুত চেতনার ফলে? রুথের নির্জন ছবিটি বড় করুণ হয়ে ফোটে। ইন ফেয়েরী ল্যান্ডস ফর্লর্ন। চাঁদের আলোয় থৈ থৈ চরাচর। ঠিকানা হারানো বিদেশীর মত এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায় চৈত্রের বাউণ্ডুলে বাতাস। চুপচাপ বসে থাকে দীপা। শতাব্দীর ওপার থেকে রুথের বেদনা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামে ওর চেতনায়। ফর্লর্ন। এমন হয়। বহুকাল থেকে দীপার এমন হয়। সুদীপ এত কাছে—নীল-গভীর কালো চোখের স্বপ্নময় নীল--তবু দুরত্ব থেকে যায়। সংসারের কাজ, ব্যস্ততা, কখনো অতিথি, শীতের সেলাই--তবু এক দূরত্ব গভীর।

    -- দীপা, হিসেব মিলছে না, না?

    চমকে ওঠে সুদীপের প্রশ্নে। -- কিছু বললে?

    নাঃ।

    আবার স্তব্ধতা। সুদীপ আর অভিমানী নয়। খানিকটা নিঃসাড়, উদাসীন। দাবী নেই ওর। প্রত্যাশাও। অথচ এমন ছিল না ও। দীপার নিঃশব্দ সরে যাবার ব্যাখ্যা খুঁজতে চায় না সুদীপ। মেনে নেয়। অনেক কিছু মেনে নেবার নাম বেঁচে থাকা। মেনে নেয় দীপাও। তবু যেন মানতে চায় না, মোচড় লাগে কোথাও। আগে দীপাকে ব্যস্ত রাখতো নীল। এখন ও সাবলম্বী। সবকিছু নিজে নিজে করবে। ওর অবসর কাটে খেলাধূলায় আর গল্পের বই নিয়ে। দেদার বই কিনে দেয় সুদীপ। কতকিছু শিখছে নীল। অফুরন্ত কৌতূহল। বাবার সঙ্গে নীলের কি সহজ বন্ধুত্ব। কত গভীর বিষয়ে কথা বলে ওরা। চোদ্দ বছরের নীল কত সময় ডিঙিয়ে চলে যায় সুদীপের কত কাছাকাছি। যেতে চায় দীপাও। যায় না। অথচ বাইরে কোনো কুঞ্চন নেই। মসৃণ, পরিমিত, ছন্দোময়। সুখ স্বচ্ছলতার উজ্জ্বল ঝিলিক দেয়ালে, পর্দায়, মুখ-দেখা মেঝেতে। চারটের কাছাকাছি সুদীপ ফেরে। ব্যতিক্রম হয় না বললেই চলে। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম--বিছানায় শুয়ে। দুটো একটা প্রশ্ন--শেওলা পুকুরে, নুড়ি পড়ার মত।

    -- চিঠি এসেছে?

    কোনদিন-- হ্যাঁ, কোনোদিন-- না

    -- নীল সাঁতারে যাবে তো?

    যাবে।

    দুপুরে আবার মাথা ধরে নি তো তোমার?

    নাঃ।

    ইচ্ছে হলে কলেজের দু’একটা কথার টুকরো। অভ্যস্ত হয়ে গেছে দীপা। নতুন কোনো কথা নেই। নতুন কিছু হয় না কোথাও।

    সামনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এল দীপা। নীলের ছড়ানো বইখাতা গুছিয়ে রাখলো টেবিলে। বিছানার চাদর টানটান করে দিল। নিমপাতা ঝরে যাচ্ছে হাওয়ায়। কেমন ঘুরে ঘুরে সময় নিয়ে নাচের ভঙ্গীতে পড়ে পাতাগুলো। চোখ তুলে দেখে দীপা। ঘুলঘুলিতে চড়ুই বাসা বেঁধেছে। কিচিরমিচির। দুধ-সাদা দেয়ালের এককোণে ছাদের কাছটায় মিহি মাকড়সার জাল। একটুখানি হালকা ঝুল। বিলাসীকে বলে বলে হয়রান। কখনো একটা কাজ কি নিজে থেকে করবে?

    বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ছাদের দিকে চোখ মেলে রাখে। চাপা যন্ত্রণায় ভরে যায় মন। কেন এমন হয় ভাববার চেষ্টা করে। আর তক্ষুনি বুকের ভেতর থেকে কে যেন হঠাৎ বলে ওঠে: কেউ আসবে, কেউ আসবে আজ। এরকম ভাবনা প্রায়ই ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কেউ আসবে। কে আসবে জানে না। তবু মনে হয়, প্রতি মুহূর্তে মনে হয়: কেউ নিশ্চয়ই আসবে আজ। কেউ আসেনি কোনোদিন। তবু কারো পায়ের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে থাকে দীপা। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। গোয়ালিনী বুড়ি। বাড়তি টাকা চাইতে এসেছে কিছু। হতাশ দীপা রেগে যায়। অথচ রাগের কিছু নেই। এমন আগেও নিয়েছে বুড়ি। দুধ দিয়ে শোধ করে দেয় পরে। টাকা দেয় দীপা। বুড়ি চলে যায়।

    আবার সব চুপচাপ। নিমগাছে কাক ডাকে। কাঠবেড়ালী ছুটে বেড়ায় চঞ্চল পায়ে। রোদের স্বচ্ছ উজ্জ্বলতায় ডুবে আছে সাজানো ঘরবাড়ী। দীপার বুক ভারী হয়ে আসে অভিমানে। কে যেন কথা রাখে নি। কী যেন ঘটবে কথা ছিল। ঘটেনি। মনের মধ্যে হাতড়ে বেড়ায় দীপা। স্মৃতিতে কেউ নেই। সুদীপ প্রথম পুরুষ এবং শেষ। অনুপস্থিত সুদীপকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায় দীপা। খুব বেশী চেনা। ওর ডান ভ্রুর প্রান্তে লাল জড়ুল। সব ছাপিয়ে কেন যেন ওটাই বড় হয়ে ওঠে। কথা বলার সময় সুদীপ বারবার বাঁ হাতের চেটো দিয়ে কপালের চুল মাথায় তুলে দেয়। মধ্যমা তর্জ্জনীর দুপ্রান্ত নিকোটিনে হলুদ। গভীরভাবে কিছু চিন্তা করার সময় নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে সুদীপ। সব চেনা। খুব বেশী জানা। প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি অভ্যেস। আগে সুদীপ বেশ হাসতো। ছেলেমানুষী করত অনেক কিছু নিয়ে। এখন করে না। এখন বড় বেশী ঠাণ্ডা, গম্ভীর। ছুটির দিনগুলোতে সারাক্ষণ শুয়ে শুয়ে বই পড়া। নিজে থেকে কোনো কথা বলে না আর। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে বেশীদূর যেতে পারে না কেউ আজকাল। বাইরে গ্রীলগেটে শব্দ হয়। বাবার চিঠি। অপ্রমেয় চাকরী পেয়েছে। খুশী হওয়া উচিত। দেরাদুনে পোস্টিং। এই তথ্যটুকু খুশী করে দেয় দীপাকে। কতদূরে দেরাদুন? ভাই যাবার আগে একবার দেখা করে আসতে হবে। সুদীপ যাবে কি?

    স্নান সেরে নেয় এক সময়। একা একা খেতে ভালো লাগে না। তবু খেতে হয়। এবার ঘুম। ঘুম এলে স্বপ্ন। কেউ ডাকে স্বপ্নে। তাকে দেখা যায় না। শব্দহীন কন্ঠ কোথাও যাবার কথা বলে। অস্থির দীপা উঠে দাঁড়ায়। কান পেতে শোনে সেই ডাক। চলো দূরে চলো। মোহময়, স্পষ্ট বুক-তোলপাড়-করা উচ্চারণ। সাজগোজ শুরু করে দেয় দীপা। চঞ্চল পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিশোরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ আয়নার ওপারে। পাউডার বুলিয়ে নেয়। কাজল টানে। মৃদু হাসে। দরজা খুলতে গিয়ে দেখে বাইরে থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ টানাটানি করে খোলে না। দুমদাম ধাক্কা লাগায়। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। শূন্যতা চেপে বসে বুক জুড়ে। চোখের পাতায় ভেজা বিষণ্ণতা। দরজায় আবার ধাক্কা মারে কেউ। স্বপ্নের শব্দের সঙ্গে মিশে যায় সেই শব্দ। অনিচ্ছুক পায়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। বিলাসী--কি ঘুম তোমার বৌদি। আমি ডেকে ডেকে হয়রান। কথা বলে না দীপা। সাড়ে তিনটে বাজে। একটু বাদেই নীল ফিরবে। তারপর সুদীপ। তারপর?

    কত দিন নিঃসঙ্গ দুপুরে দীপা ভাবে এবার কেউ নিজ হাতে দরজা খুলে সোজা কাছে এসে বলবে--‘চলো আমার সঙ্গে’।

    গভীর অন্ধকার রাতে ছোট্ট বারান্দায় বসে বেলফুলের গন্ধের ভেতর কারো অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনতে পায় দীপা। কখনো জ্যোৎস্নায় নিঃশব্দ পায়ে কেউ এসে দাঁড়ায় ওর পাশে।

    কোনো এক দুপুরের নির্জনতায় দরজায় যেন অচেনা হাতের শব্দ শুনতে পায়। ভালো করে শোনে দীপা। ভুল হচ্ছে না তো! কে আসবে এ সময়? সুদীপ নয়, বিলাসী নয়, নীলও নয়। ঝোড়ো প্রত্যাশায় দুরুদুরু কাঁপে বুক। দরজায় অস্থির হাত প্রবলতর হয়ে ওঠে। উত্তেজনায় ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয় দীপা। সুদীপ।

    অন্য কেউ নয়। অন্য কেউ আসে না কখনো।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments