কৈলাস পর্বতের সানুদেশে একটি বৃহৎ অরণ্য আছে। আষাঢ় মাসে মত্ত হস্তীর মত মেঘের দল সেখানে গর্জন করতে করতে উপস্থিত হয়। সেই বিপুল অরণ্যময় অঞ্চলে এক সন্ধ্যায় একটি সত্যিকারের শ্বেত হস্তীকেও লঘুপায়ে প্রবেশ করতে দেখা গেল। শিথিল সন্ধ্যার্ক পর্বতের পিছনে অস্ত যাবার আগেই অরণ্য রাত্রির ছায়ায় নিমজ্জিত হয়। তখন একটি পুষ্করিণীর ধারে এক দিব্যাঙ্গ পুরুষ পদচারণা করছিলেন। কিয়দ্দূরে এক বৃদ্ধ ঋষি একটি ঢেঁকির উপর শুয়ে নিদ্রার সাধনায় যত্নবান।
দিব্যাঙ্গ পুরুষের কান্তিমান মুখশ্রী ও পাশে উপলখণ্ডের উপর রাখা চক্র ও গদা দেখে আর বুঝতে বিলম্ব হয় না যে ইনিই লোকপাল বিষ্ণু। দূরের ঋষি তাহলে নারদই হবেন। অনুমান করা যায় কৈলাসাধীশ শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করে এঁরা ফেরার পথে বিশ্রাম নিচ্ছেন অথবা কাল প্রত্যুষে সাক্ষাৎকারের জন্য যাত্রা করবেন।
পদচারণা করতে করতে একসময় বিষ্ণু থমকে দাঁড়ালেন। অরণ্যের মধ্যে কারো পদশব্দ। এখানে তাঁর অবতরণের কথা কম লোকেরই জানার কথা। চক্রধর সকৌতুকে অরণ্যের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েই বুঝলেন শমীগাছের নীচে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। বিষ্ণু একটুক্ষণ অপেক্ষা করলেন, তারপর সবিস্ময়ে বললেন – দেবরাজ, তুমি!
ছায়ামূর্তিটি শমীগাছের অন্তরাল থেকে এবার ধীর পায়ে নিষ্ক্রান্ত হল। আস্তে আস্তে এগিয়ে এল লোকপালের দিকে। শমীগাছের পিছনে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেত হস্তীটির কান দুবার আন্দোলিত হয়েই আবার স্থির। চাঁদের আলোয় দেখা গেল তীক্ষ্ণনাসা এক বলিষ্ঠ যুবা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে বিষ্ণুর দিকে চলেছে। তার সমস্ত গায়ে ক্ষত চিহ্ন, খয়েরী কেশ অবিন্যস্ত, বুকের বর্মের একাধিক স্থানে শস্ত্রাঘাতের ছিদ্র, কপালের একটি দিক ফুলে হরিতকীর আকার ধারণ করেছে। লোকটি দুকাঁধ ঝুলিয়ে ক্লান্ত পায়ে বিষ্ণুর কাছে গিয়ে অভিবাদন করলো ও হাত থেকে উজ্জ্বল সাদা রঙের একটি বিচিত্র যন্ত্র ভূমিতে ফেলে দিল।
বিষ্ণুর একটি ভুরু উপরে উঠে গেলেও কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বললেন – স্বাগতম্ দেবরাজ স্বাগতম্। আবার পরাজয় – তাই তো?
যুবা পুরুষটি মাথা নেড়ে সায় দিল। – শুধু তাই নয়, এবার ওরা চারজন আমায় ধরে ফেলে ভীষণ মেরেছে। শেষপর্যন্ত মাতলি পিছন থেকে কশাঘাত করতে শুরু না করলে আজ…
বিষ্ণুর ক্ষমাসুন্দর দুই চোখ ব্যথায় কুঁচকে গেল।
– লেগেছে বেশ, তাই না?
– নাঃ, এ আর এমন কি? প্রাণটা বেঁচে যাওয়াই তো আসল। তবে বজ্রটা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। সেটা ওই চার গুন্ডার হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে গিয়েই বিপদ। মাতলি বজ্রাঘাতে শয্যাশায়ী আর আমার কপালে এই– এই যে এখানে দেখুন… দেখতে পাচ্ছেন? কদ্বেলের মত?
– একটু ফুলেছে।
– একটু? যুবা পুরুষটি মনঃক্ষুন্ন হয় তার আঘাতের গুরুত্ব খাটো করা হয়েছে ভেবে। কোদণ্ডের মত ওই হেড়ো দধীচির হাড় দিয়ে কেউ আপনাকে দু ঘা দিলে বুঝতেন। এই বর্বর অসুরদের হাতে প্রাণ যাওয়ার চেয়ে যা নিদারুণ কষ্ট তা হল ওদের মধ্যে যে ভাড়াটে নিরক্ষর গুণ্ডাগুলো আছে তাদের অপটু হাতের অস্ত্রাঘাত। ওরা বজ্রকে লাঠির মত ব্যবহার করে আর শত্রুকে শুধু আছাড় মেরে মেরে বধ করায় বীরত্ব বোঝে, জানেন?
বিষ্ণু মুখ বেজার করেন। – এই ধরণেরই সংবাদ পাচ্ছি আজকাল। ছি ছি। শুক্রাচার্য কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন?
যুবা পুরুষটি শুনে দুকাঁধ ঝাঁকিয়ে এমন একটি ভঙ্গী করে যার অর্থ– কোথায় তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন তিনি নিজেই জানেন।
মুখে সে বলে– শুক্রদেব এখন দেবতাদের প্রতি অসম্ভব বিরূপ। দেবযানীর একটা হিল্লে না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এরকমই চলবে মনে হয়।
চক্রপাণী গম্ভীর হয়ে যান। সামনে দাঁড়ানো যুবকের মার খাওয়া শরীরের দিকে চেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। যুবকটি কিন্তু বক্রহাস্য করে বলে– তবে অসুরাচার্যকেই বা শুধু দোষ দিয়ে কি হবে? দেবলোকে কি সবার মন পরিষ্কার? আমার তো সন্দেহ হয়।
দূরে ঢেঁকির উপর শয়ান মূর্তিটি একবার পাশ ফেরে। বিষ্ণু সেদিকে তাকিয়ে গলা খাটো করে বলেন– কিসের সন্দেহ দেবরাজ?
অন্ধকারে তেমনই খাটো গলায় উত্তর আসে, অনিশ্চিত কিন্তু নিষ্ক্রম্প কন্ঠে। পুষ্করিণীর মাছেদেরও গায়ে কাঁটা দেয় সেই উত্তর শুনে।
– গুপ্তচর। দেবলোকের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বিপুল ষড়যন্ত্রের আভাস পান না আপনি?
কিছুক্ষণের জন্য ত্রিলোক ও সর্বচরাচর স্তব্ধ। লোকপাল নিজেই হতবাক। সংবিৎ ফিরে আসতেই কৃত্রিম উল্লাস দেখিয়ে হৈ হৈ করে পর্যুদস্ত যুবকের কাঁধে একটি হাত রেখে বললেন– ছাড়ো ওসব কথা। এসো একটু বিশ্রাম করবে আগে। জয় পরাজয় দুইই মদ্যপানের উপযুক্ত কারণ। দুই কুম্ভ আছে আমার সঙ্গে। আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে– কি বলো?
পুষ্করিণীর জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। তার উপর চাঁদের আলোর চিকচিক। একটি বৃহৎ ও মসৃণ উপলখণ্ডের উপর আসীন দুই পুরুষ। আসব পানের আসরে ধৈর্য ও আত্মসংযম কুলমর্যাদার পরিচায়ক। উপস্থিত দুজনের যে কেউই অন্ত্যজ জনের মত হুড়হুড় করে তা গিলছেন না তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। দেবরাজের সুরাসক্তি কিম্বদন্তীপ্রতিম হলেও এই যুবকের রাজোচিত আচার ব্যবহারে সমান দক্ষতার কথা অনেকেরই স্মরণ থাকে না।
একসময়ে বিষ্ণু বললেন – রাত অনেক হল দেবরাজ। এবার একটু ঘুমিয়ে নাও।
যুবক বললো – আপনি?
– আমি জিতনিদ্র। ঘুমের প্রয়োজন নেই। চতুর্মুখ ব্রহ্মা বহু রাতের জীবও সৃষ্টি করে রেখেছেন। তাদের দিকেও একটু দৃষ্টি রাখতে হয়।
– তবে যে সবাই বলে আপনি সাপের ফণার উপর যখন নিদ্রামগ্ন হন তখন যুগ যুগ অতিক্রান্ত হয়?
– সে আমার যোগনিদ্রা। বিষ্ণু তড়িঘড়ি উত্তর দেন। তার মধ্যেই দু-দশ বার অবতার হয়ে নেমে দুষ্ট ঠেঙাতে হয়। তিনলোকের প্রতিটি খেলায়, বন্দুক-ক্রীড়ার সময় নিয়মানিয়মের বিচারের জন্য যেমন একজন থাকে তেমনই থাকতে হয় আমায়।
আসবে সামান্য চুমুক দিয়ে বিষ্ণুর যুবক সঙ্গী বলে – বেশ তাৎপর্যময় উপমা, তাই না? বিচারকের মত আপনিও কোনও দলেরই পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন না, অ্যাঁ?
বিষ্ণু কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে গেছেন মনে হল। দেবরাজ বলে যায় – আজ্ঞা করেন তো ঘুমোতে যাবার আগে কয়েকটা কাজের কথা সেরে নিই। আশা করি বুঝতেই পারছেন যে আসব পানের নিমিত্ত আমি এতদূর ছুটে আসি নি। ত্রিলোকের অধিকাংশ এখন অসুরদের কবলে। স্বর্গের এক তৃতীয়াংশ ও মর্ত্যের এক পঞ্চমাংশ নিয়ে আমাদের বাহিনী কোনমতে টিকে আছে। এই অবস্থায় গুপ্তপথে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে আসতে হয়েছে এখানে। এসব তো আপনিও অবগত আছেন।
বিষ্ণু দু-তিনবার মাথা নেড়ে বললেন – আমিও তাই বলতে যাচ্ছিলাম দেবরাজ। এত ঝুঁকি নিয়ে তোমার আসা উচিত হয় নি।
দেবরাজ কথার মাঝখানেই বিষ্ণুকে থামিয়ে দিয়ে বললো – উপায় ছিলো না। দেবলোকের প্রয়োজনের সময়ই আপনি হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান বলেই এই অবস্থা। তিন চারটি স্থানে সন্ধান করে তবে এখানে পৌঁছেছি। প্রতিবারই কেন এরকম হয় কে জানে!
বিষ্ণু বললেন – চক্রের মত ভাগ্যের দশা ঘুরছে। এখন তোমাদের একটু সময় মন্দা যাচ্ছে। কিন্তু ভয় নেই, অন্য দিনও আসবে। এখন তোমার জন্য কি করতে পারি বলো।
দেবরাজ বললো – ভালো প্রশ্ন। আমার সারথি মৃতপ্রায়, উচ্চৈঃশ্রবার লেজে আগুন দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল – তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য অশ্বিনীকুমাররা নিয়ে গিয়েছেন – অন্তত তিনমাস বিশ্রাম ছাই। গত কৃষ্ণ পক্ষে অসুরাধীপতি ককুদ্মী হানা দেবার পর আমার সমস্ত বাহিনী ছত্রভঙ্গ, পুরনারীরা পলায়ন করেছে না অপহৃতা জানা যাচ্ছে না। অপ্সরারা স্বেচ্ছায় অসুরদের অনুগমন করেছে বা শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। রাজমহিষীর উদ্যান বিনষ্ট হবার ফলে গভীর আঘাত ও শোকে তাঁর বাক্শক্তি লোপ পেয়েছে, সেটা অবশ্য তেমন কষ্টদায়ক কিছু নয়। কিন্তু দেবলোক বলতে আর যেটুকু অবশিষ্ট আছে তার রাজা হবার বাসনা আমার নেই। আজ এক কুম্ভ সুরা পানের পরও আমার সারা শরীরে প্রহারের বেদনা টনটন করছে। এই অবস্থায় আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমার জন্য কি করতে পারেন?
বিষ্ণু বেশ অপ্রতিভ হয়ে গেছেন দেবরাজের এই আকস্মিক আক্রমণে। তাড়াতাড়ি বললেন – গায়ে একটু গরম ঘী লাগিয়ে টিপে দেবো?
দেবরাজ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে – রাখুন ঢের সহানুভূতি দেখেছি। আমি এসেছি অন্য অভিপ্রায়ে, কার্যসিদ্ধ হয়েই যাবো।
বিষ্ণু চুপ করে রইলেন।
দেবরাজ বললো – অসুরদের এবার একেবারে ঝাড়ে বংশে শেষ করে দিতে হবে। আমাদের পুরোন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না। নতুন কিছু অস্ত্র চাই।
বিষ্ণু হাঁফ ছেড়ে বললেন – এই কথা? আগে বললেই হত। চলো কাল প্রত্যুষে মহেশ্বরের আখড়ায় গিয়ে ধরনা দিই। সারাদিন-ই শূলবল্লম নিয়ে পড়ে আছেন। কিছু তেজস্কর বাণ তোমার তোমার তূণীরে ভরে নেবে।
দেবরাজ হাত তুলে বললো – দু একটা তেজস্কর বাণের কর্ম নয়। সেরকম তো আগেও আপনি বহুবার গছিয়েছেন, তরুণ বয়েসে তাই পেয়েই নিজেকে অপরাজেয় মনে হত। সদলবলে বারবার যুদ্ধে গিয়ে শক্তিক্ষয় করতাম। একবারও বুঝিনি যে দেবতাদের বিনাশ আপনার কাছে কন্দুকক্রীড়ার সাময়িক পশ্চাদপসরণ ছাড়া কিছুই নয়।
বিষ্ণু মুখ বেজার করে বললেন – এটা কি বল্লে দেবরাজ? তোমাদের আমি কখনো শূন্য হাতে ফিরিয়েছি? কতবার যে যুদ্ধে জয়ী হবার উপায় বলে দিয়েছি তার লেখাজোখা নেই। নিজে একাধিকবার বিভিন্ন রূপে – এমন কি নারীর বেশেও দুষ্টের দমন কার্যে নিরত হয়েছি। কখনো বরাহ, কখনো মৎস্য হয়ে সৃষ্টি রক্ষা করেছি। হাস্যকর ত্রিপাদ বামন হয়েছি দৈত্যরাজ বলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। বিদ্ঘুটে জীব হয়ে হিরণ্যকশিপুর রক্ত পান করেছি। এসব অদ্ভুত কাণ্ড করার জন্য কমলাসনা লক্ষ্মীর কাছে কম গঞ্জনা সইতে হয় নি। তার কিরকম শূচিবায় সে কি তোমরা জানো না? এত করার পরেও এরকম অভিযোগ তুমি করবে এ কল্পনার অতীত। হয়তো তোমার সুরাপান অত্যধিক হয়ে গেছে। বরং কাল সকালেই কথা হোক।
দেবরাজ আবার কথার মাঝখানেই বিষ্ণুকে থামিয়ে বললো – হে গদাধর, আপনি শ্রেষ্ঠ ঐন্দ্রজালিক। কিন্তু আপনার কথার জালে আজ পা দিতে পারবো না। আমি আর সেই ছোকরাটি নেই যাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঐরাবতে চাপিয়ে দিলেই প্রসন্ন চিত্তে ফিরে যাবে। সেনাপতিরা অনেক ভেবেচিন্তে আমাকে একটি তালিকা করে দিয়েছেন। সেই মত রণসরঞ্জাম না নিয়ে এবার আর নড়ছি না।
এই বলে দেবরাজ উষ্ণীষের ভাঁজ থেকে একটি ভূর্জপত্র বের করে বিষ্ণুর হাতে ধরিয়ে দিল। চাঁদের আলোয় তা পাঠ করা অসাধ্য হত, কিন্তু বিষ্ণু নিজের মুকুটের আলোয় তা অল্প আয়াসে পড়ে ফেললেন। তালিকাটি এরকম –
১) দুই শত ব্রহ্মাস্ত্র
২) এক শত নারায়ণী বাণ
৩) বিংশতি বজ্র
৪) একটি বামন অবতার (না পাওয়া গেলে গোটা তিনেক কল্কি)
পড়তে পড়তেই বিষ্ণুর মুখশ্রীতে অনেক রকম ভঙ্গীর আসা-যাওয়া টের পাওয়া গেল। কাঁধের উপর মুখ বাড়িয়ে দেবরাজ উৎসুক হয়ে বললো – কি বুঝছেন?
বিষ্ণু বললেন – এটা কি ধরনের রসিকতা ঠিক ধরতে পারছি না। দুই শত ব্রহ্মাস্ত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন কোন হস্তিমূর্খ সেনাপতি? তিনি কি জানেন না যে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহারে সৃষ্টি রসাতলে যেতে পারে? এই যুগেই সাকুল্যে দুই কি তিনবার ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। দুইশত ব্রহ্মাস্ত্র ব্রহ্মা নিজেই একসঙ্গে দেখেন নি, আমি তো দূরের কথা।
দেবরাজ বললো – সেই জন্যই আজ দেবলোক ককুদ্মির হাতে। আপনি চিন্তা করবেন না গদাধর, প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু দিনকাল এমন দাঁড়িয়েছে যে একটি দুটি ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে আর সমরে যাওয়া সম্ভব নয়। লোকে হাসে। মর্ত্যবাসীদেরই অনেকে একটি করে ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করে বসে আছে। দেবলোকে যে একটু বেশী লাগবে তাতে আর আশ্চর্য কি? নারায়ণী বাণগুলো তো আপনার হাতেই?
বিষ্ণু তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললেন – ছেলেমানুষী কোরো না দেবরাজ। আমার হাতে মানেই কি যখন ইচ্ছে নির্মাণ করতে পারি? ইদানীং মারণাস্ত্রের প্রতি তোমাদের কোন শ্রদ্ধাই নেই দেখছি। আগে লোকে কালেভদ্রে এসব অস্ত্র ব্যবহার করতো। দু-পাঁচটি বরিষ্ঠজন অনুরোধ করলে তা সংবরণও করে নিতো। এখন সেসব সংযমের বালাই নেই। মর্ত্যলোকে আধকুড়ি উচ্চতম শ্রেণীর মারণাস্ত্র দিয়ে রেখেছিলাম। এখন শুনছি তার মধ্যে তিনটি অসুরেরা যুদ্ধে কেড়ে নিয়েছে আর পাঁচটি নাকি হারিয়ে গেছে। ভাবতে পারো? যত্নের অভাবে নারায়ণী অস্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে। সেগুলি কোথায় কার হাতে পড়েছে তাই জানতে আমার অনুচররা গত একবৎসর ধরে হিমশিম খাচ্ছে। এরকম অবস্থায় আমি তোমাদের হাতে আরো একশত বিপজ্জনক খেলনা তুলে দেবো তা স্বপ্নেও ভেবো না। আগেই অনেক দিয়েছি। সেগুলির কি হল কোন গণনা আছে? কটি ককুদ্মির হাতে পড়েছে তার সংবাদ রাখো?
দেবরাজ কিছু বলতে গিয়ে দুবার খকখক করে কাশলো। বিষ্ণু সেদিকে তা্কিয়ে একবার মুখ বিকৃত করে আরো বলে চললেন। – আর এ সব কি? একটি বামন অবতার, বিকল্পে গোটা তিনেক কল্কি? চক্রপাণীর সঙ্গে রসিকতা করার এই নতুন শৈলী কবে প্রণয়ন করলে তোমরা? তোমাদের ইচ্ছানুসারে আমাকে এবার নেচে বেড়াতে হবে নাকি? বলো তো এখনই তিনপায়ে হেঁটে দেখাই।
চক্রধরের মুখ থেকে কদাচিৎ এরকম শ্লেষ নির্গত হয়। দেবতারা চিরকাল স্নেহ পেতেই অভ্যস্ত। দেবরাজের বিষম খাওয়া মুখ আরো লাল হল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে বললো – আপনার সঙ্গে কথায় পারবো না প্রভু। কিন্তু এখন আমাদের নিদারুণ সংকটকাল। দেবতাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের হাতে তালিকার অন্তত কিছু সামগ্রী দিতে না পারলে নেতৃত্বের উপর আর আস্থা থাকবে না। বিদ্রোহ হয়ে যেতে পারে, সেকথা একবার ভেবেছেন?
চক্রধর বললেন – কি চাও বলো তাহলে।
দেবরাজ বললো – বজ্র গোটাকতক বেশী দিন। দুই কুড়ি পেলে আমরা কাজ চালিয়ে নেবো।
বিষ্ণু দেবরাজের করুণ আবেদনে হেসে ফেললেন। – আরে আকাশে কটা সূর্য আছে গোনো। কটা চন্দ্র? বজ্রও সেরকম। একটির বেশী হবার উপায় নেই। দধীচির মত মুনি একটার বেশী হয় না। তাঁর প্রাণ নিতে হল অস্ত্রটি নির্মাণের জন্য। এ বস্তু কি গণ্ডা গণ্ডা হয়?
দেবরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো – কেন, তেজস্বী মুনির আর অভাব কি? মর্ত্যে কশ্যপ, ভরদ্বাজ, গর্গ ইত্যাদি পুরোনোরা আছেন। নতুনদের মধ্যে ললিত, ললাট প্রভৃতি কিছু উগ্রজাতদের নাম শুনেছি। ইন্দ্রত্ব লাভের জন্য কঠোর তপ করে করে সমস্ত মাংস শুকিয়েছে, এখন হাড়গুলো একটু অন্যরকম ভাবে জুড়ে নিলেই হল। তাছাড়া সঙ্গেই তো আছেন মহামুনি নারদ। ওনাকেও যদি বুঝিয়ে বলা যায়…
বিষ্ণু তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে বললেন – আরে করো কি, করো কি? ধীরে বলো ধীরে। শুনতে পেলে কি হবে? কেন অযথা ভালো মানুষটার পিছনে লেগেছো? এদের দধীচির মত সাহস আছে, না তেজ? এসব হাড়গোড় তো অসুর বালকেরা হাসতে হাসতে ভেঙে ফেলবে। এ দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না দেবরাজ। তুমি অন্য কোন উপায় ভাবো।
নারদমুনির শয়ান আকৃতির দিকে তাকিয়ে বিষ্ণু কোমল একটু হাসি দিয়েছেন। দেবরাজের আর ধৈর্য থাকে না। একটু উত্তেজিত হয়ে সে বলে – তাহলে আর কি অবশিষ্ট রইলো? শূন্য হাতেই যদি ফিরতে হয় তবে নারদমুনিকেই পাঠান রাজ্যভার দিয়ে। উনিই বজ্র চালান, আমি ঢেঁকিতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করি।
বিষ্ণু হাসতে হাসতেই বললেন – সে গুড়েও বালি। বজ্র, যতই হোক একটি আমিষ গোছের দ্রব্য। নারদ তা কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দিয়েও স্পর্শ করবেন না। কিন্তু তুমি এত নিরাশ হয়ো না দেবরাজ। চলো কাল ভোর ভোর মহেশ্বরের সঙ্গে আলোচনা করি। পাশুপতের কাছে আর কোন অস্ত্র দাঁড়ায় না। বুদ্ধি করে দু-চারখানা যদি বাগাতে পারো তাহলে তাই দিয়েই কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে। এখন ঘুমোবে যাও।
কিন্তু বিষ্ণুর প্রবোধবাক্য শুনেও দেবরাজ নড়ছে না। ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে বটবৃক্ষের মত।
বিষ্ণু বললেন – কি হল? আর একটু সুরাপান হবে নাকি?
দেবরাজ গম্ভীর হয়ে বললো – এই কি আপনার শেষ কথা?
বিষ্ণু বললেন – এর অর্থ?
দেবরাজ বললো – তালিকাটি স্বেচ্ছায় মাত্র চল্লিশটি বজ্রে নামিয়েছিলাম। তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে আমার রাজত্বের প্রয়োজন নেই। আমি ইন্দ্রত্ব ত্যাগ করছি। আপনারা আরেকটি দেবরাজের সন্ধান করে নিন।
এই ভীষণ কথায় বিস্মিত হয়ে বিষ্ণু বললেন – সে কি? এত ক্ষমতা, এত ঐশ্বর্য, ঊর্বশী প্রমুখ অপ্সরাদের সঙ্গ – এসব তুমি এক কথায় ত্যাগ করবে? এ হয় নাকি?
কপালের ফোলা অংশটায় একবার হাত বুলিয়ে দেবরাজ অবিচল কন্ঠে বললো – এবার হবে। পোষাচ্ছে না আর।
দেবরাজের গলায় এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে বিষ্ণুও আর তর্ক বাড়াবার সাহস পান না।
একটু ভেবে বিষ্ণু বললেন – তবে একটা কথা রাখো। আজ রাতটা বিশ্রাম করে নাও। কাল সকালে আরেকটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা যাবে। কথা দিচ্ছি তোমার উপর কোন চাপ সৃষ্টি করবো না।
পরদিন প্রত্যুষে পুষ্করিণীর তীরে তর্পণ করে গিয়ে নারদমুনি দেখলেন পদ্মনাভ বিমর্ষমুখে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। একটু দূরে একটা সাদা হাতী জল ঘোলা করার তালে আছে। নারদ একটা আঙ্গুল তুলে সরোষে তাকে পরে আসতে বললেন। তার পর বিষ্ণুর কাছে গিয়ে উবু হয়ে বসে ফিসফিস করে বললেন – দেবরাজ ওঠেনি?
বিষ্ণু বললেন – না ঘুমোচ্ছে। কাল রাতের কথাবার্তা সবই শুনেছেন মনে হচ্ছে।
নারদ হাসিমুখে বললেন – কি করবো? ঘুমের মধ্যেও একটা কান জেগে থাকে। কিছু উপায় স্থির করলেন?
বিষ্ণু বললেন – দেবরাজের একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। একটি এমন লোক চাই যে সাময়িকভাবে ইন্দ্রত্বের ভার নেবে।
নারদ বললেন – দেবরাজের হাবভাব সুবিধের মনে হল না। সে কি সন্দেহ করছে?
বিষ্ণু এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন – মনে হয় না। ককুদ্মি আবার গত পূর্ণিমায় এসে একটি শক্তিশালী নারায়ণী আস্ত্রের বায়না করে গেছে। আগেই কথা দেওয়া ছিল। পরে দেবো পরে দেবো করে চালাচ্ছি। ঠেলা বোঝো, অস্ত্রটি আমার শয্যার নীচেই আছে। সেটা আবার দেবরাজের নজরে না পড়ে।
নারদ দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন – আপনার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখলাম প্রভু। কিন্তু আজও এই খেলার অভিপ্রায় ধরতে পারলাম না, এদিকে বলে যে আপনি সর্বজ্ঞ। ভবিষ্যতের কিছুই অজানা নয়। আবার ওদিকে দেবাসুরের জাগতিক সংগ্রামে এমন ভাবে লিপ্ত হয়ে আছেন যেন এই লৌকিক লীলায় আপনিও একজন সাধারণ ক্রীড়নক মাত্র।
বিষ্ণু মুচকি হেসে বললেন – ওটাই তো মজা। বড় গভীর তত্ত্ব মুনিবর। যে নিয়ম রচনা করে সেই আবার নিয়মে বাঁধা পড়ে যায়। ত্রিকালজ্ঞ হয়েও যেমন আমি ভবিষ্যতের জন্য উৎসুক। কর্তা ও কর্মী উভয়ই আমি। স্বেচ্ছায় আত্মবিস্মৃত। লৌকিক ভাষায় এ বোঝানো অসম্ভব, যদিও ব্যাসদেব যে গ্রন্থটি প্রণয়ন করেছেন তার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়।
নারদ বললেন – অন্তত এটুকু বলুন যে দেবতারা অসুরদের শেষ করে দেবে, না অসুররা দেবতাদের বিনাশে সক্ষম হবে?
বিষ্ণু বললেন – হে রাজর্ষি, তাহলে শুনুন। এই যুদ্ধের আদি বা অন্ত নেই। তেত্রিশ লক্ষ বছর পরে কলিযুগ অতিক্রান্ত হলে আবার সত্য যুগ আরম্ভ হবে। ঘাত প্রতিঘাতের শক্তি দিয়েই মহাকালের চাকা ঘুরছে। সেই শক্তির উৎস কোনদিন রুদ্ধ হবে না। সাময়িকভাবে একটি পক্ষের জয় হতে পারে।
নারদ বললেন – তাহলে তো যথার্থ চিন্তার কথা। এসব তত্ত্ব দেবগণ বা অসুরগণের কর্ণগোচর হলে তারা উভয়ই আপনাকে “মার মার” বলে তেড়ে আসবে না?
লোকপাল হাসতে হাসতে বললেন – সেই ভয় নিয়ে এই ব্যবসায় নামা যায়? চিন্তা করবেন না মুনিবর। আমার মধ্যে থেকেই তারা উদ্ভূত। সুতরাং তারা থাকলেই আমিও থাকবো।
নারদ পুষ্করিণীর জল মুখে দিয়ে কুলকুচো করে বললেন – শুনে বাঁচলাম। কিন্তু বর্তমান সমস্যার কি সমাধান করলেন? দেবরাজকে কি বলা হবে?
বিষ্ণু বললেন – আচ্ছা মুনিবর, আপনার মতে দেবরাজ ব্যতীত আর কার ইন্দ্র হবার যোগ্যতা আছে?
নারদ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন – সঠিক যোগ্যতা কারোই আছে বলে মনে হয় না। তবে অসুরাধীশ ককুদ্মি, পিশাচপতি গির্গিট এবং ললিত ঋষির কথা স্মরণে আসছে। ককুদ্মির যোগ্যতাই সর্বাধিক, তবে তার হাতে দেবলোক তুলে দিলে তো দ্বন্দ্বের মূলই বিনষ্ট হয়। আপনার মহাকালের চাকাও বোধকরি আর ঘুরবে না। ললিত ঋষি সম্প্রতি অনেক তপতাপ করেছেন ইন্দ্রত্ব লাভের প্রত্যাশায়। তাই তাঁকে একটি সুযোগ দিলে অন্যায় হয় না। ওদিকে মর্ত্যলোকে মহারাজ তড়িৎবর্মা অল্পবয়েসেই একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সুসম্পন্ন করে নামযশ করেছেন। তাঁর কথাও ভেবে দেখা যেতে পারে।
বিষ্ণু এক হাত তুলে বললেন – যথেষ্ট, যথেষ্ট। এদের মধ্যেই একজনকে নির্বাচিত করার ভার আপনার উপর দিলাম মুনিবর। চলুন দেবরাজকে জাগাই। মনে হচ্ছে আগামী তিনদিনের মধ্যেই সমস্যার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
স্থান, পাত্র ও পটভূমিকার একটি তুমুল পরিবর্তন এবার আবশ্যক। কেননা দেবরাজ যখন লোকপালের সন্ধানে স্বর্গ মর্ত্য এক করে ফিরছিল তখন এই কাহিনীর অপর নায়ক-চরিত্র ককুদ্মি চুপ করে বসে ছিল না। দেবতারা যে সবসময়ই ফন্দি আঁটছে সে কথা এই মরা কলির দিনে অন্তত অসুরদের অজানা নয়। সমুদ্রমন্থনের দিন থেকেই তারা নিজেদের সরলতার সমধিক মূল্য দিয়ে এসেছে। সৌভাগ্যক্রমে ককুদ্মি এসব বিষয়ে অতিশয় সতর্ক।
কয়েকটি যুদ্ধে পরপর সহজ জয়লাভ করেই সেই সতর্কতা হ্রাস পায় নি। ককুদ্মি চতুর্দিকে গুপ্তচর নিযুক্ত করে দেবলোকের সমস্ত সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করে চলছিল। পুরো একদিন ধরে দেবরাজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না বলে দুশ্চিন্তার চাপ পড়েছিল ককুদ্মির কপালে। এমন সময় বেলা দ্বিপ্রহরে একটি দূত ছুটতে ছুটতে এসে সংবাদ দিল – দেবরাজকে পাওয়া গেছে।
ককুদ্মি নিজের সিংহাসনে একটি দ্বীপিচর্ম পরে বসে সোনালী দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিল। ধনুকের ছিলার মত টান হয়ে সে বললো – কোথায়?
দূত হাঁপাতে হাঁপাতে বললো – এইমাত্র পিশাচরাজ্য মল্লমুদ্গর থেকে চর এই সংবাদ পাঠিয়েছে যে দেবরাজ মহামুনি নারদকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে।
ককুদ্মি বিস্মিত হয়ে বললো – মল্লমুদ্গরে? কি আশ্চর্য! দেবরাজ একা?
দূত বললো – সেরকমই মনে হচ্ছে। আরো আশ্চর্য হল এর পরের সংবাদটি। মহামুনি নারদ ঘোষণা করেছেন যে দেবরাজ সাময়িক ভাবে ইন্দ্রত্বের ভার অন্য কারো হাতে দিতে চায়। সেইজন্য কাল প্রত্যুষে একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধের সভার আয়োজন করা হবে। পিশাচপতি গির্গিটকে যে হারাতে পারবে সেই ইন্দ্রত্ব লাভ করবে। কেউ যদি না পারে তাহলে দিনান্তে গির্গিট নিজেই দেবলোকের সিংহাসনে বসবে।
স্বয়ং দেবরাজ একটি বজ্র নিক্ষেপ করলেও ককুদ্মির সভা এরকম স্তম্ভিত হয়ে যেত না। ককুদ্মির মুষ্টিবদ্ধ হাতের পীড়নে পিঙ্গল দাড়ি প্রায় ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। সেনাপতি উদ্দণ্ড কিছু একটা বলতে গিয়ে হাঁ করে বসে রইল। শেষে ককুদ্মিই চড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বললো – তাহলে কি বিজয় আমাদের হাতের মুঠোয়? এ কি সুসমাচার না অন্য কিছু?
উদ্দণ্ড এতক্ষণে বাক্শক্তি ফিরে পেয়েছে। সে বললো – দেবলোকে অরাজকতার সূচনা হয়েছে। আমাদের উচিত এই মুহূর্তেই ইন্দ্রপুরী আক্রমণ করে বৈজয়ন্ত অবরোধ করা।
ককুদ্মি একটা হাত তুলে বললো – রোসো হে, রোসো। অত শীঘ্র নয়। এই দেবরাজ অত্যন্ত ধূর্ত। তার নিশ্চয়ই কোন অভিসন্ধি আছে। কেন সে ইন্দ্রপুরী অরক্ষিত রেখে বেরোবে? কিসের প্রয়োজনে?
উদ্দণ্ড ঘাড় নেড়ে বললো – ইন্দ্রত্ব ত্যাগের বাসনাই বা কেন? তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে নি তো? দুদিন আগে আমার চারটি বিশিষ্ট যোদ্ধা তাকে প্রচণ্ড প্রহার করেছে। মাথায় আঘাত লাগার সংবাদও পেয়েছি।
ককুদ্মি বললো – রাখো তোমার বিশিষ্ট যোদ্ধা। তারা একমেবাদ্বিতীয়ম বজ্রের মত অস্ত্র হাতে পায়েও তা চালাতে পারে নি। দণ্ডের মত ব্যবহার করতে গিয়ে দেবরাজের হাতেই সম্যক প্রহার খেয়ে ফিরেছে। ওরকম যোদ্ধা আরো গুটিকতক থাকলেই হয়েছে আমাদের। চিন্তা করো উদ্দণ্ড। ভাবো। অরক্ষিত কে? ইন্দ্রপুরী না স্বয়ং ইন্দ্র?
উদ্দণ্ড মাথা চুলকে বললো – পিশাচদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে যাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মল্লমুদ্গর নিরপেক্ষ রাজ্য। সেখানে দেবসেনাও প্রবেশ করবে না। ইত্যবসরে আমরা যদি দেবরাজকে তার বজ্র সমেত গোপনে ঘিরে ফেলতে পারি তাহলে কেমন হয়? পুরো একটা রাত আছে তো আমাদের হাতে।
উদ্দণ্ড বললো – কিন্তু কালকে তো ইন্দ্রত্ব লাভ করে সিংহাসনে বসবে অন্য কেউ! দেবরাজকে বন্দী করে লাভ?
ককুদ্মি বললো – উদ্দণ্ড, তুমি দেবরাজকে এখনো চেনো নি। সে ইন্দ্রের আসনে থাকুক আর নাই থাকুক – তার কাছ থেকে সবচেয়ে বিপদ। তাকে পথ থেকে সরাতে পারলে এবং বজ্রাস্ত্রটি হস্তাগত করতে পারলে অল্পসময়ের মধ্যে দেবলোকেও আমাদের করতলগত হবে। কাল গির্গিটের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে কে কে আসছে সেটা অবশ্য জানতে পারলে হত।
দুত অভিবাদন করে বললো – সে সংবাদও আছে। বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে উগ্রতেজা ঋষী ললিত এবং চক্রবর্তী রাজা তড়িৎবর্মাকে। এছাড়াও ছোটখাটো তপস্বী ও রাজা যে কজন কাছাকাছি আছেন তাঁরাও কুম্ভক, ব্যায়াম ইত্যাদি করতে আরম্ভ করেছেন নাকি।
ককুদ্মি দূতকে থামিয়ে বললো – কি নাম বললে? তড়িৎবর্মা? এই সেই অল্পবয়েসী ছোকরা যে উৎকোচ দিয়ে দিয়ে একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ফেলেছে?
উদ্দণ্ড এক গাল হেসে বললো – এ-ই সে। এরকম অল্প বয়সে এত কুবুদ্ধি হয় কি করে কে জানে। তবে নাম করে ফেলেছে প্রচুর।
ককুদ্মি হাতে হাত ঘষে বললো – তাহলে তো একেই চাই। যে উৎকোচ দিতে প্রস্তুত সে উৎকোচ নিতেও পিছপা হবে না। এই দণ্ডে লোক পাঠাও তড়িৎবর্মার কাছে। বলো সে যেন আজই মল্লমুদ্গরে চলে যায় দ্বন্দ্বের নিমন্ত্রণ রাখতে।
উদ্দণ্ড বললো – কিন্তু দ্বন্দ্বযুদ্ধে তড়িৎবর্মা গির্গিটের কাছে শিশু। সে কি সম্মত হবে যেতে?
ককুদ্মি বক্রহাসি হেসে বলো – বালাই ষাট – লড়বে কেন সে? তার কাজ অন্য। শোনো তাহলে।
অতঃপর গলা নামিয়ে অসুরাধিপতি নিজের বিস্মিত প্রধান সেনাপতি ও ঘনিষ্ঠ অমাত্যদের কাছে একটি গৃঢ় কূটনৈতিক পরিকল্পনা খুলে বলতে থাকে।
অসুররাজ ককুদ্মি যখন দেবরাজকে বন্দী করার জঘন্য পরিকল্পনায় লিপ্ত তখন তার করিৎকর্মা গুপ্তচর পিশাচ শিবা একটি শৃগাল সেজে ঝোপের আড়াল থেকে দেবরাজের উপর দৃষ্টি রাখছিলো। মল্লমুদ্গর আসলে একটি অনতিঘন অরণ্য বিশেষ। গাছ কেটে ফাঁকা করে মাটি ও বাঁশের কুটিরে পিশাচদের বসতি। সকালে নারদ ও দেবরাজ এসে পড়ার পর শিবা একবার মল্লমুদ্গরের সমস্ত সংবাদ পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। বিকেলের মধ্যেই অনেকগুলি নতুন ঘটনার সূচনা হয়েছে অবশ্য। নারদ তাঁর ঢেঁকি পাঠিয়ে তড়িৎবর্মা ও ঋষি ললিতকে আনাবার ব্যবস্থা করেছেন। আগামীকালের প্রতিযোগিতায় এঁরা দুজনেই প্রধান প্রতিদ্বন্দী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
দেবরাজের উপর গুপ্তঘাতকের আক্রমণ হবার সম্ভাবনা। গোটা আষ্টেক বলিষ্ঠ পিশাচ দেহরক্ষী তার ডাইনে বাঁয়ে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে। তাই শিবা বড় একটা কাছে যেতে সাহস পেল না। দূর থেকে সে দেখলো দেবরাজ শাদা ও লম্বা কি একটা যন্ত্র হাতে নিয়ে নেমেই সেটা তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে লুকিয়ে ফেললো। পিশাচেরা তার শ্বেত হস্তীটিকে নীলগাই ভেবে পাকশালায় প্রেরণ করার তালে ছিল, দেবরাজ তাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে নিবৃত্ত করেছে। হাতিটি সেই থেকে দেবরাজের কুটিরের পিছনে জম্বুবৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করে আছে।
শিবা চোখ কান উদার করে যা দেখছে ও শুনছে সবই প্রখর স্মৃতিতে ধারণ করে রাখে।
বিকেলের দিকে ঢেঁকিতে চেপে এসে নামলেন তড়িৎবর্মা। সেজেগুজে সুঘ্রাণ পোষাক পরে এসেছেন। পিশাচপতি গির্গিটের সাথে কোলাকুলি করার পর গোঁফে তা দেবার ছলে নাকে একটু সুগন্ধ পুষ্পরেণু মেখে নিয়ে বললেন – গির্গিট, আমি শুধু তোমার অভিষেক দেখতে এলাম। কিন্তু দেবরাজের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তার কি হলো বলো তো?
গির্গিট উদ্গার তুলে বললো – চিন্তা কোরো না তড়িৎলাল, ললিত ঋষি থাকতে ইন্দ্রত্ব আর কারো হাতে যাবার যো নেই। তপ করে করে এমন তেজ হয়েছে যে বাঁশের খাটিয়া যাতে পুড়ে না যায় সেজন্য সারাক্ষণের একটা লোক রাখতে হয়েছে তা জল ঢেলে সিক্ত করার জন্য। রজোগুণের অনুশীলনও আজ থেকেই প্রারম্ভ করবেন বলে বরাহের মাংস ও ঘৃত চেয়ে পাঠিয়েছেন। সঙ্গে কয়েকটি সুলক্ষণা দাসীও চাই।
একটু থেমে গলা নামিয়ে গির্গিট বলে – তবে দেবরাজের হাবভাব চিন্তাজনক। তার এরকম অকাল বৈরাগ্য কেন এল কে জানে?
তড়িৎবর্মা দেবরাজের বিষয়ে আরো কিছু প্রশ্নাদি করে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন।
সাধারণত কারো কুটিরে প্রবেশ করার আগে দুবার দ্বারে করাঘাত করাই শিষ্টাচার। দ্বারপালরা রাজপোশাক পরা তড়িৎবর্মাকে বলাই বাহুল্য আটকায় নি। তড়িৎবর্মা কিন্তু দেবরাজের কুটিরের সামনে একমহূর্ত থেমে কোন করাঘাত না করেই – “ভো ভো দেবরাজ, ব্যাপার কি, শুনলাম তুমি ঋষি হয়ে যাচ্ছো?” বলে এক ধাক্কায় দ্বার খুলে ঢুকে পড়লেন। পলকের জন্য দেখা গেল দেবরাজ শয্যার উপর একপাশে ফিরে শাদা ও লম্বা কিছু একটা বিদ্যুৎগতিতে খাটিয়ার নীচে লুকিয়ে ফেলছে। তড়িৎবর্মা মনে মনে একটি চতুর হাসি হাসলেন। মুখে বললেন – এই শেষবেলায় শুয়ে কেন? শরীর ভালো নেই?
দেবরাজের অর্ধেক শরীর আলোকিত। তাতে কিছু কিছু ক্ষতচিহ্ন তখনও বিদ্যমান।
দেবরাজ বললো – আরে স্বাগতম তড়িৎবর্মা। ভাগ্যিস এসে পড়েছো। মর্ত্যের যে অংশটা অসুর ব্যাটারা ছেড়ে রেখেছে সে তো তোমার। এবার স্বর্গের দায়িত্ব নিয়ে তিনলোকের একটা অশ্বমেধ করে ফ্যালো দেখি। তোমার হাতেই ইন্দ্রত্ব দিতে পারলে বাঁচি।
মনে মনে দেবরাজ বললো – ককুদ্মির হাতে পড়লে ওই হাসি আর পুষ্পরেণু কোথায় গুঁজবে ঠাহর পাবে না। এখন যত ইচ্ছে হাসো বাছাধন।
তড়িৎবর্মা হাতজোড় করে বললেন – রক্ষে করো। গির্গিটের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই আমার। তার এক একটি উদ্গার সহ্য করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমি শুধু এলাম রগড় দেখার জন্য। তা ললিতঋষির কোনো গোপন মারণাস্ত্র আছে নাকি? লড়বেন কি দিয়ে?
দেবরাজ বললো – খড়ম পেটা করবেন বোধহয়। বলছেন তপোবলে সব ভস্ম করে দেবেন।
তড়িৎবর্মা বললেন – তোমার উপর আবার পুরনো রাগ। লোকে বলে ঊর্বশীর ভাগ চেয়েছিলেন নাকি! তুমি দিতে রাজি হও নি বলে পুরো ইন্দ্রত্বই কেড়ে নেবেন পণ করে বসে আছেন।
দেবরাজ ম্লান হেসে বললো – এসব ফ্যাকড়া তো লেগেই আছে ভাই। আমি কি ঊর্বশীকে বেঁধে রেখেছি? কিন্তু ললিত ঋষির ওই পিঙ্গল দন্ত আর তার ফাঁক দিয়ে কথায় কথায় যে তেজস্কর থুতু ছিটকে বেরোয় তাই দেখে ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভা মায় পদ্ম বলে সেই নতুন ট্যারা মেয়েটাও নাক সিঁটকে বললো – “লল্তের কথায় হ্যাঁ বলে দিলে মর্ত্যে গিয়ে সবকটা ঋষির শ্রাদ্ধ করে দিয়ে আসবো”। ইন্দ্রত্বের গেরো দ্যাখো, যাদের বাঁচাতে ললিতের কোপানলে পড়লাম, তারাই আমার নামে কুকথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে।
তড়িৎবর্মা সুদর্শন দন্তপঙ্ক্তি বের করে বললেন – অর্থই অনর্থের মূল হে। রাত্রে এখানেই থাকছো খাচ্ছো তো?
দেবরাজ কাষ্ঠহাসি হেসে বললো – আর উপায়? কালকের মধ্যে একটা ইন্দ্র পাওয়া গেলে সস্ত্রীক পম্পা সরোবরে গিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম করবো।
আরেকটু শিষ্টাচারবাক্যের আদানপ্রদানের পর তড়িৎবর্মা বিদায় নিলেন। দেবরাজের কুটির থেকে বেরিয়ে আসার পথে অদূরে সেবন্তীগুল্মের পাশে দাঁড়ানো একটি শৃগালের কৌতূহল-ভরা চোখের সাথে চোখাচোখি হল। তড়িৎবর্মা চোখ টিপে দিলেন। শৃগালবেশী শিবা চমকে উঠে দু পা পিছিয়ে গেল। তড়িৎবর্মা আলগোছে এক হাত তুলে অভয় দিলেন। – ভয় নেই শিবা। আমরা এসে পড়েছি তো।
কয়েকটি অনুচর তড়িৎবর্মার কুটির বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করছিল। তড়িৎ নিজে দাঁড়িয়ে পরিদর্শন করছিলেন। এমন সময় কিছু দূরে একটা কলরব উঠেছে। বেশ ক্ষুব্ধ ও তীক্ষ্ণ গলায় কেউ চেঁচাচ্ছে। পিশাচ ভৃত্য ও দাসীরা তটস্থ হয়ে ছুটছে এদিক ওদিক। তড়িৎ দেখলেন সারি সারি হরিতকী গাছের পিছনে সূর্য অস্তগতপ্রায়। মনে মনে বললেন – আরম্ভ হোক তবে খেলা।
নিজের ভৃত্যদের দাঁড়াতে বলে চেঁচামেচি হচ্ছে যেখানে সেখানে হেঁটে গিয়ে দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। মহাতেজা ললিতঋষি উবু হয়ে মাটিতে বমি করছেন আর এক হাতে পৈতে ধরে সাধারণভাবে সমগ্র পিশাচজাতি ও বিশেষভাবে গির্গিটকে শাপশাপান্ত করছেন। একটু দাঁড়িয়ে থেকে তড়িৎবর্মা বুঝলেন যে ললিতের ধারণা তাঁর আহারে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে।
পিশাচবৈদ্য সুষুম্না একটি ভল্লুক বিশেষ। জাম্ববানের বংশধর বলে শোনা যায়। সে ঋষির নাড়ি ধরতে গেলে ঋষি লাফিয়ে উঠে – “আমাকে ছুঁবি না নরাধম” বলে তার তলপেটে একটি পদাঘাত করেছেন। তারপর নিজেও চলে গেছেন ঝোপের আড়ালে। গির্গিটের ছোটভাই গির্গিল তড়িৎবর্মার কানে কানে বললো – পেট ছেড়ে দিয়েছে। সারাজীবন কচুশাক খাবার পর ঘৃতপক্ক বরাহ কারো সয়? এই নিয়ে দশবার বাহ্যি-বমি হল। এবার চোখ কপালে উঠবে দেখুন।
দূর থেকে গির্গিটকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সঙ্গে নারদ। ঝোপের পিছনে তখন সব নিস্তব্ধ। সামনে মাটিতে শুয়ে সুষুম্না উদর চেপে কাতরাচ্ছে। গির্গিট ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে বললো – মহামুনি, একবার ওদিকে আসতে পারি? কোন উত্তর না আসায় গির্গিট দুজন দেহরক্ষীকে ইঙ্গিত করলো। তারা একটি বাঁশের শয্যা এনে অচেতন ললিতকে তুলে ফেললো তার উপর। ঋষির তেজ একেবারেই প্রশমিত কেননা বাঁশের খাটিয়া একটুও গরম হচ্ছে না। নারদমুনি দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন – এবার উপায়? সুষুম্না কাতরাতে কাতরাতে বললো – কুটিরের ভিতর নিয়ে গিয়ে শোয়াও ঋষিকে। দেখছি আমি। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
তড়িৎবর্মা একটু মুচকি হেসে দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। নাকের কাছে আর একবার পুষ্পরেণু মাখার সময় হয়েছে। ওদিকে পিছনে গাছের আড়াল থেকে পিশাচ ভাষায় একটি শৃগালও কথা বলছে আবার।
– একটা কাজ তো শেষ। শৃগালটি ফিসফিস করে বলে।
তড়িৎবর্মা বললেন – হুম্।
শৃগাল বললো – আর অন্যটা?
তড়িৎবর্মা বললেন – রাতের তৃতীয় প্রহরে। এখানেই পাবে আমাকে।
শৃগালটা একবার হুক্কা বলেই দৌড়ে পালালো।
তড়িৎবর্মা খানিকক্ষণ পায়চারি করে নিজের কুটিরাভিমুখে যাত্রা করার পথে দেখলেন নারদ বিমর্ষ মুখে নিজের ঢেঁকিতে বসে পোঁটলা থেকে সামান্য ছোলা গুড় বের করে খাচ্ছেন। মনে মনে হাসলেন তড়িৎবর্মা। লুকোনো একটি আততায়ীর হাতকে ভয় পাচ্ছে সবাই। গলার মুক্তোমালার মুক্তো গুনতে গুনতে তড়িৎ এলেন ললিত ঋষির কুটিরের সামনে। আর কোন সাড়া শব্দ নেই। শ্বাস আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কাছাকাছি বেশী লোক দেখা যাচ্ছে না। উঁকি দিয়ে দেখলেন ললিত ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে শুয়ে। প্রাণ ওষ্ঠাগতপ্রায়। পাশে মাটিতে বসে ঝিনুকে করে একটু একটু জল খাওয়াবার চেষ্টা করে চলেছে সুষুম্না। পায়ের কাছে কালো মুখ করে দাঁড়িয়ে গির্গিট।
ক্ষীণ স্বরে কিছু একটা বলছেন ললিত। কান খাড়া করে শোনেন তড়িৎবর্মা। শেষমুহূর্তে ললিত ঋষির মন অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছে বুঝি।
– অনেক পাপ করেছি হে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। দেবরাজকে বোলো আমায় যেন ক্ষমা করে।
গির্গিট হাত তুলে বললো – শান্ত হোন। কাল সকালের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ললিত আবার কষ্ট করে বললেন – দেবরাজকে ডাকো একবার। তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তাহলে একটু শান্তি পাবো।
তড়িৎবর্মা দ্বার থেকে বললেন – আমি ডেকে দিচ্ছি।
ললিত ঋষির কুটির থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে দেবরাজের কুটির পর্যন্ত হেঁটে যান তড়িৎ। বাইরে দুটি দ্বারপাল ঝিমোচ্ছে। দ্বারে দুবার করাঘাত করে ডাকেন তড়িৎবর্মা। – এখনো ঘুমোচ্ছো দেবরাজ। ললিত তোমায় ডাকছেন।
ভিতরে খাটিয়া নড়ার শব্দ। দেবরাজ বলে – কে ডাকছেন?
– ললিত। হেঁকে বলেন তড়িৎবর্মা। – শীঘ্র, শীঘ্র যাও। তাঁর তো হয়ে এলো।
দ্বারপালদের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে চেয়ে এবার দ্রুত নিজের কুটিরের দিকে পা বাড়ান তড়িৎ। মুখ দেখে বোঝা যায় তাঁর মন প্রসন্ন আছে আজ।
প্রথম যামের আগেই হেঁচকি উঠতে থাকে ললিতের। বাতাস পরিষ্কার রাখার জন্য সবাইকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। যে যার কুটিরে ফিরে গেছে শয়নের জন্য। ললিতের কাছে শুধু চিকিৎসক সুষুম্না, গির্গিট এবং দেবরাজ।
চন্দ্রালোকে শিবা দেখলো বৃদ্ধ নারদ একটি ভূর্জপত্রে আগামীকালের দ্বন্দ্বযোদ্ধাদের নামসূচী প্রস্তুত করছেন। সবার উপরে নাম ছিল ললিতের। সেটি বুঝি আর থাকে না।
কুটিরের ভিতর সুষুম্না হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ছিলো। হেঁচকির মধ্যে একটি ছোট অবকাশে ললিত হাত নেড়ে সবাইকে যেতে নির্দেশ করেন। শুধু দেবরাজকে বললেন – তুমি একটু থাকো।
গির্গিট ও সুষুম্না মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলে ললিত কম্প্রমান হাতে দেবরাজের বাহু স্পর্শ করে বললেন – ষড়যন্ত্র!
দেবরাজের কোন ভাবান্তর হয় না। নিরুত্তরভাবে সে ললিতের ক্ষয়ে যাওয়া কৃশকায় শরীরের দিকে চেয়ে।
ললিত বললেন – আমার প্রহর আগত। কিছু বর চাও দেবরাজ।
রাত্রি প্রথম প্রহরে দেবরাজ বেরিয়ে এসে জানায় ললিতের প্রয়াণ ঘটে গেছে। নারদমুনি ক্লিষ্টমুখে তালিকায় একটি ঢ্যাঁড়া ফেলে দ্যান। শিবা অন্ধকারে বুঝতে পারে দেবরাজ একটি কাপড় দিয়ে ললিতের কুটিরের দ্বার ঢেকে দিচ্ছে। কাল পর্যন্ত দেহ এখানেই থাকবে। তারপর ললিতের আশ্রমে নিয়ে যাওয়া হবে সৎকারের জন্য।
আরো কিছুক্ষণ পরে দেবরাজের শাদা হাতিটিকে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখা যায়। দেবরাজ বোধহয় ফিরে গেছে নিজের শয্যায়। একা নারদ একমনে ইষ্টনাম জপ করে চলেছেন। শিবার চোখেও তন্দ্রা লেগে আসে। একটু পরে চট্কা ভাঙলে সে দেখতে পায় হাতিটি আর নেই। লুকিয়ে পড়েছে নির্ঘাত। নারদ উঠে চলে যাচ্ছেন শয়নের জন্য। দূরে তড়িৎবর্মার কুটির থেকে একটি ছোট্ট প্রদীপের আলো টিমটিম করছে দেখে আশ্বস্ত হল শিবা। অন্তত একজন কাজের লোক তার সঙ্গে জাগবে সারা রাত। এখনও দুই প্রহরের অপেক্ষা অবশ্য তাদের।
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে চন্দ্রও অস্তগত। ঘন তমসায় আবৃত চতুর্দিক। কালো কাপড় পরে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় দেবরাজের কুটিরের সামনে। দুটি দ্বারপাল কুটিরগাত্রে হেলান দিয়ে অঘোরে ঘুমন্ত। ছায়ামূর্তি কুশল হাতে কুটিরের দ্বার খুলে ভিতরে প্রবেশ করে।
অন্ধকারে দেবরাজের হাতের আংটিগুলি জ্বলজ্বল করছে শুধু। দেবরাজ উপুড় হয়ে খাটিয়ার উপর শুয়ে ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলছিল। ডান হাতটি ঝুলে আছে মেঝের উপর, যেন খাটিয়ার নীচে গচ্ছিত কোন সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য।
ছায়ামূর্তিটি পায়ের দিক থেকে খাটিয়ার নীচে উঁকি দেয়। উজ্জ্বল সাদা রঙের একটি অদ্ভুতদর্শন দণ্ডবিশেষ পড়ে আছে সেখানে। উবু হয়ে বসে ছায়ামূর্তিটি সেটি ধরে টানে। একটু শব্দ হতেই দেবরাজ ঘুমের ভিতর নড়ে উঠে তন্দ্রাজড়িত কন্ঠে বলে – কে? শ্বাস চেপে বসে থাকে ছায়ামূর্তি। অনেকক্ষণ এইভাবে অপেক্ষা করার পর সে যখন নিশ্চিন্ত হয় যে দেবরাজ আবার গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছে তখন সে লঘু পায়ে উঠে দাঁড়ায়। শাদা যন্ত্রটি কালো কাপড়ের নীচে লুকিয়ে চলে আসে কুটিরের বাইরে। দ্বারপালরা তখনও নাসিকাধ্বনি করে চলেছে। ছায়ামূর্তি এদিক ওদিক তাকিয়ে হেঁটে চলে যায় বনের একদিকে। যেখানে একটি শৃগাল বেরিয়ে এসেছে ঝোপের আড়াল থেকে।
– এনেছেন? সে বলে।
ছায়ামূর্তি কাপড়ের আড়াল থেকে শাদা কিছু তাকে দেয়।
– এই নাও। শীঘ্র যাও এবার। শীঘ্র, শীঘ্র। কেউ যেন দেখে না ফেলে।
শৃগালটি বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুত অন্তর্হিত হয় গভীর অরণ্যে। বিশেষ দিক লক্ষ্য করে ছুটতে থাকে।
ছায়ামূর্তি খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে তারপর ধীরে ধীরে ফিরে আসে কুটিরগুলির কাছে। তড়িৎবর্মার কুটিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় একবার। নিঃশব্দে দ্বার খুলে প্রবেশ করে।
রাত্রি তৃতীয় প্রহর। মল্লমুদ্গরে একটি পেঁচা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে একবার। আর কোন শব্দ নেই কোথাও। চরাচরে।
সকালে দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস তড়িৎবর্মার। আজও উঠে স্নানাদি সেরে এসে দেখলেন দ্বন্দ্বযুদ্ধের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নরম মাটি ছড়িয়ে স্থানটি চিহ্নিত করা হয়েছে। দর্শকবৃন্দ ও পিশাচ পিশাচীরা এক এক করে সমবেত হচ্ছে। বাদ্য গান ইত্যাদি চলছে। ইন্দ্রত্ব লাভের আশায় আর যে কজন নৃপতি, পিশাচপতি ইত্যাদি এসেছিল তাদের দলবল তূরী ভেরী ইত্যাদি বাজিয়ে পরীক্ষা করছে।
পিছন থেকে কে জিজ্ঞেস করলো – রাতে ভালো ঘুম হয় নি বোধহয়?
হাই তুলতে গিয়ে ভীষণ চমকে পিছন ফিরে তড়িৎবর্মা দেখলেন গির্গিটের ভাই গির্গিল। তড়িৎ বললেন – কাল ললিত ঋষির ওই দশা দেখে শরীরটা যুৎ ছিল না। ভালো কথা, গির্গিট কোথায়?
গির্গিল আঙ্গুল তুলে দেখায়। প্রথম দ্বন্দ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে চলেছে। উন্মুক্ত ক্ষেত্রটির একদিকে শ্বেত কটিবস্ত্র পরে দাঁড়িয়েছে লোমশ গির্গিট। তার হাতে একটি লোহার ঘাস কাটার যন্ত্র।
তড়িৎ বললেন – ঘাস কেটে তবে লড়াই হবে।
গির্গিল বললো – আরে না। ওটাই তো দাদার অস্ত্র।
গির্গিটের সম্মুখে বিন্ধ্যাচলের কিরাতরাজ নাম্বুদ একটি প্রকাণ্ড মুষল হাতে দাঁড়িয়ে। তারও কৃষ্ণকায় রোমশ দেহ, রক্তবর্ণ চোখ। আবক্ষ দাড়িও আছে।
নারদমুনি যুদ্ধের নিয়মগুলি দুই পক্ষকে শুনিয়ে দিচ্ছেন। ত্রিলোক রসাতলে যেতে পারে যার ব্যবহারে এমন মারণাস্ত্র, যথা পাশুপত, ব্রহ্মাস্ত্র বা নারায়ণী অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ। অন্য সব অস্ত্রই চলবে। নারদ দুই পক্ষকে অস্ত্র প্রদর্শন করতে বললে একজন কর্তনযন্ত্র ও অন্যজন মুষল তুলে ধরলো। দুই পক্ষের দলবল তূরী-ভেরী বাজিয়ে ও হাততালি দিয়ে দ্বন্দ্বযোদ্ধাদের উৎসাহদান করলো।
তড়িৎ দেখলেন দেবরাজ একদিকে একা দাঁড়িয়ে আছে। কপাল ও ভুরু গভীর চিন্তায় কুঞ্চিত। মনে মনে হেসে সেদিকে হাত নাড়লেন তড়িৎ। প্রত্যুত্তরে ম্লান হাসলো দেবরাজ।
একসঙ্গে অনেক বাদ্য বেজে ওঠার সাথে সাথেই যুদ্ধ আরম্ভ হল। এবং ভূমিকা হতে না হতেই শেষ। কিরাতরাজ নাম্বুদ গির্গিটের প্রতিপত্তি বহুদিন ধরে ঈর্ষা করে আসছিল। এই সুযোগে জন্মের শোধ তুলে নেবে বলে বাঁই বাঁই করে মুষল ঘুরিয়ে সে এগিয়েছিল। গির্গিট নিজের অস্ত্র ভূমিতে রেখে দুহাতে সেই মুষলটি ধরে একটানে নাম্বুদকে শূন্যে তুলে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেললো। তারপর তার দাড়ি ধরে নিজের উরুর উপর তার মাথাটি রেখে কর্তন যন্ত্রটি তুলে তা কুচ্ করে কেটে দিলো। ছিন্নমস্তক নাম্বুদের হাতে তখনও মুষল ধরা। পিশাচদের দল থেকে দামামা বেজে উঠলো। কিরাতদলের লোকজন আতংকে যেন কাঠ হয়ে গেছে। আর অন্য কয়েকটি ছোট দলের লোকজন ও যোদ্ধারা আর্তচিৎকার করে সভা ছেড়ে বেগে পলায়ন করলো।
গির্গিটের জয়জয়কারের মধ্যে নারদমুনি তালিকা ধরে পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাম পড়তে লাগলেন। অনেকগুলি নাম এমনিই চলে গেল। যোদ্ধারা উপস্থিত নেই বা থাকলেও উচ্চবাচ্য করছে না। শেষে গন্ধর্বরাজ চণ্ড একটি তরবারি হাতে উঠে এলেন।
সমবেত দেব দানব ও পিশাচদের মধ্যে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন তড়িৎবর্মা। কেউ কি আছে যে গির্গিটকে হারাতে পারবে?
দুটি দণ্ড গত হয়েছে। মধ্যাহ্নের সূর্যতাপে ঘামছে সবাই। প্রাঙ্গণে ছয় সাতটি মুণ্ড গড়াগড়ি দিচ্ছে। গির্গিট এতগুলি যুদ্ধ জিতে এবার একটু হাঁপাচ্ছে। নারদ তালিকার শেষ নামটি পড়ে কোন উত্তর না পেয়ে বললেন – আর কোন যোদ্ধা নেই। তাহলে গির্গিটই ইন্দ্রত্ব গ্রহণ করুক।
পিশাচরা তুমুল হর্ষধ্বনি দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেছে। মাথার উপর শমীবৃক্ষের শাখা থেকে একটি বিশালাকায় লোক লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে রণাঙ্গনে। তার ভীষণ আকৃতি দেখেই পিশাচদের উল্লাস গলায় আটকে যায়। লোকটি দেব না দানব, যক্ষ না রক্ষ তা বোঝার উপায় নেই। তার মুখে একটি চামড়ার মুখোশ আঁটা, গায়েও কালো চামড়ার বর্ম। সে মেঘের মত গম্ভীর কন্ঠে বলে – অস্ত্র ছেড়ো না গির্গিট। আমি আছি।
নারদ ভুরু কুঁচকে বললেন – তুমি কে হে?
লোকটি বললো – নাম জেনে কি হবে? আমি গির্গিটকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করছি। জিতলে ইন্দ্রত্ব তার।
নারদ মাথা নেড়ে বললেন – অজ্ঞাতকুলশীল কেউ ইন্দ্রত্ব পেতে পারে না। তোমাকে এখানে কেউ চেনে?
মুখোশ পরা লোকটি দর্শকদের দিকে ঘুরে তাকায়। সকলে নির্বাক। দেবরাজ কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন চুপ করে যায়। হঠাৎ দেখা যায় তড়িৎবর্মা একটি হাত তুলে এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে মুখোশধারী লোকটির কাঁধে হাত রেখে তড়িৎ বলেন – একে আমি চিনি। কার্যত এর নাম সরিৎবর্মা ধরা যেতে পারে। আমার ভাই-এর মত। আমন্ত্রণ পেয়েও কোন কারণে নিজে আমি যুদ্ধ করতে আজ অসমর্থ। পরিবর্তে আমার ভাইকেই সুযোগ দেওয়া হোক।
পর পর দুটি অভাবনীয় ঘটনার সংঘাতে নারদ একটু হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। গির্গিট নিজের অস্ত্রটি তুলে ধরেছে আবার। নারদ দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে বুঝবার চেষ্টা করেন কি ঘটছে। প্রথমে যা অতি সহজ এক নির্বাচন পদ্ধতি মনে করে বিষ্ণুর কথায় কাজটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন এখন তার ভিতরেই গভীর ও গৃঢ় কিছু হয়ে চলেছে মনে হয়। দূর থেকে সাহায্যের জন্য দেবরাজের দিকে একবার করুণভাবে চেয়ে দেখেন দেবরাজ তাঁর দিকে না তাকিয়ে গির্গিটের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে চলেছে একমনে।
নারদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন – গির্গিট, তুমি এই নতুন যোদ্ধার সাথে লড়তে প্রস্তুত?
গির্গিট “হ্যাঁ” বলতে যাচ্ছিলো এমন সময় দেবরাজ দূর থেকে চেঁচিয়ে কি যেন বললো। চতুর্দিকের গুঞ্জনের মধ্যে তা ভালো করে শোনা গেল না। গির্গিট ঘুরে বললো – কি বললে দেবরাজ?
দেবরাজ দূর থেকে একটি অস্ত্র চালনার ভঙ্গী করে দেখায়।
গির্গিট বুঝতে না পেরে বলে – কি? কি?
রাজর্ষি নারদ হঠাৎ ভীষণ ভয় পেতে থাকেন। দেবরাজ একটু একটু করে লোকজন ঠেলে এগিয়ে আসতে চাইছে। তার উত্তমাঙ্গ অনাবৃত। কোথাও কোন অস্ত্র দেখা যাচ্ছে না। গলাটা শুকিয়ে যায় নারদের। তিনি ভীষণ আকৃতির পুরুষটিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন – সরিৎবর্মা তুমি কি কোন অস্ত্র এনেছো যুদ্ধের জন্য? এনে থাকলে আগে তা সবাইকে দেখাবার নিয়ম।
ভীষণদর্শন পুরুষটি নিজের কালো চামড়ার বর্মের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে একটি অত্যুজ্জ্বল শাদা রঙের দণ্ডাকৃতি অস্ত্র বের করতে আরম্ভ করে। রোদ পড়ে সেটি ঝকঝক করছে। সমবেত দর্শকবৃন্দের মধ্যে একটি অবিশ্বাসের নীরবতা নেমে এসেছে।
নারদ দাঁতে দাঁত চেপে বলেন – ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র!
দেবরাজ গির্গিটের কাছে আসতে সমর্থ হয়েছে শেষ পর্যন্ত। গির্গিট হাঁ করে একবার এদিক একবার ওদিক তাকিয়ে বললো – দেবরাজ, এই লোকটা বজ্র পেল কি করে?
দেবরাজ বললো – কাল রাতে চুরি হয়েছে। ললিত ঋষির ওই অবস্থা দেখার পর আমি ফল ছাড়া কিছু খাই নি। কিন্তু ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল। দ্বারপাল দুজনকে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছিল মনে হয়। তারা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে এখনও।
গির্গিট মুখ বিকৃত করে বললো – ছি, ছি, এই জঘন্য কাজ করলো কে? আজই তার শিরচ্ছেদ করবো।
দেবরাজ নির্বিকারভাবে বলে – অনুমান করি রাজাধিরাজ তড়িৎবর্মার হাত ছিল কোথাও। প্রমাণ না থাকলেও বোঝা যায় এখন যা ঘটছে সবই এঁদের পূর্বপরিকল্পিত। এমন কপটবুদ্ধি ত্রিলোকে একটি লোকেরই মাথা থেকে বেরোতে পারে অবশ্য। অসুরপতি ককুদ্মি, আপনি নির্ভয়ে মুখোশ খুলে ফেলতে পারেন।
সমবেত দর্শকেরা এবার একটি অস্ফুট রব তুললো। সরিৎবর্মা নামে যে এতক্ষণ নিজের পরিচয় দিচ্ছিল সে একটানে মুখোশ খুলে ফেলতেই তার পিঙ্গল কেশ ও শ্মশ্রু বেরিয়ে পড়েছে। বজ্র হাতে ভীষণাকায় লোকটি যে অসুরাধিপতি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ককুদ্মি হেসে বললো – জানতাম, তুমিই ধরতে পারবে দেবরাজ। কূটবুদ্ধিতে কিছু কম নও। এসব তো তোমাদের কাছ থেকেই শিখেছি আমরা। এবার একটু সরে দাঁড়াও। আমি গির্গিটকে পরাস্ত করে ইন্দ্রত্ব গ্রহণ করি।
নারদমুনি এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দন্ত পেষণ করছিলেন। এবার ক্রুব্ধ হয়ে এগিয়ে এসে বললেন – ওহে ককুদ্মি, তোমার খুব বাড় বেড়েছে দেখছি। এই ধর্মযুদ্ধের আয়োজন আমি করেছি। যাতে সমস্ত নিয়ম রক্ষা করে তা অনুষ্ঠিত হয় তা দেখার দায়িত্বও আমার। চুরি করা অস্ত্র দিয়ে তুমি কোন মুখে এই সজ্জনের আসরে লড়তে এসেছো?
নারদ কথা শেষ করে একটি যষ্টিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। ক্রোধে না উত্তেজনায় তা বোঝা গেল না।
ককুদ্মি হাতজোড় করে প্রণাম করে স্মিত হাস্যে বললো – আর সমুদ্রমন্থনের সময় আপনি কোথায় ছিলেন ঋষিশ্রেষ্ঠ? সেই পুকুরচুরির পর দেবরাজই বা কোন মুখে রাজত্ব করে চলেছে? কিভাবে দেবগণ স্বর্গ অধিকার করে বসে আছেন এতকাল? আপনার কোপানলে ভস্ম হবার ভয় কি এদের নেই? সেই চুরিটি ঘটে সকলের চোখের সামনে। বজ্র তো আমি আজ সকালে একটি শৃগালের কাছ থেকে স্বর্ণমূল্য দিয়ে ক্রয় করেছি। সেই শৃগাল কিভাবে বজ্র পেল তা আমিও জানি না, জানতেও চাই না। আমি শুধু এক যোদ্ধা রূপে এসেছি। সাহস থাকে তো গির্গিট যুদ্ধে যোগদান করুক।
নারদ আঙ্গুল তুলে কি একটা বলতে গিয়ে আর পারলেন না। অতিরিক্ত কাঁপুনির ফলে যষ্টিটি হস্তচ্যূত হল। পড়েই যেতেন। দুটি পিশাচ পরিবাহিকা খপ করে ধরে ফেলে পাঁজাকোলা করে দূরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে ঘাসে শুইয়ে দিল।
গির্গিট বললো – তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে ককুদ্মি। আমার সাথে যুদ্ধের মনস্কাম সিদ্ধ করে দিচ্ছি এখানে। অবশ্য ইন্দ্রত্ব বোধহয় আর পেলে না। সুবিশাল অসুররাজ্যও ভোগ করা হবে না মনে হচ্ছে। কারণ এখনই তোমার পিঙ্গল মস্তক আমি কুচ্ করে কেটে ফেলবো।
গির্গিট তার কর্তন যন্ত্রটি কাঁধে তুলে নিয়ে দাঁড়াতেই ককুদ্মিও বজ্র উত্তোলন করে দাঁড়ালো। ভয়ংকর কিছু একটা লড়াই হবে ভেবে সকলে এক পা এক পা করে দূরে সরে যাচ্ছে। দেবরাজ তাড়াতাড়ি মাঝখানে দাঁড়িয়ে গির্গিটের দিকে দুহাত তুলে বললো – করো কি? করো কি? ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করো গির্গিট।
গির্গিট রক্তচক্ষু করে বললো – এই পাষণ্ড ককুদ্মি আমাকে কাপুরুষ বলতে চায়। আজই এর মস্তক ছেদন করে প্রজাদের আহার করতে দেবো। তারপর ওই নরাধাম তড়িৎবর্মাকেও দেখে নিতে হবে। তুমি সরো দেবরাজ।
দেবরাজ যথাস্থানে দাঁড়িয়েই বললো – আঃ গির্গিট, বুঝছো না, তোমাকে রাগিয়ে যুদ্ধটা লাগাতে পারলেই এদের লাভ? একবার ইন্দ্রত্ব লাভ করলে ককুদ্মি দেবতাদের কি অবস্থা করবেন সেটা ভাবো।
গির্গিট একটু থমকে গিয়ে বললেন – সেসব আগেই ভাবা উচিত ছিল। এখন বিধানমতো আমাকে লড়তেই হচ্ছে।
দূর থেকে তড়িৎবর্মারও গলা পাওয়া গেল – সত্য বলছো গির্গিট। দেবরাজ, তুমি আর গোল বাড়িও না। প্রথমেই আমার নামে অসিদ্ধ অভিযোগ এনে নিজেকে ছোট করেছো। এরপর যদি ককুদ্মিকে তার ন্যায্য যুদ্ধের অধিকার থেকে বঞ্চিত করো তাহলে ভালো হবে না। আমার রাজ্যে যে কজন কাব্য-নাট্যকার আছেন তাঁরা সকলে এই নীতিবিরুদ্ধ ঘটনার কথা দশদিকে প্রচার করে দেবেন সে কথা ভুলো না।
দেবরাজ অবাক হয়ে বললো – ককুদ্মির যুদ্ধের অধিকার তো কেড়ে নিচ্ছি না। যুদ্ধ হবে। তবে গির্গিট নয়, আমিই যুদ্ধে আহ্বান করছি ককুদ্মিকে। সাহস থাকলে উনি এগিয়ে আসুন।
ঘটনা এক নতুন বাঁক নেওয়াতে এবার তড়িৎবর্মা কোন কথা যোগাচ্ছে না। ককুদ্মি বললো – তুমি লড়বে কি সুবাদে দেবরাজ?
দেবরাজ বললো – গির্গিট আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মত। যেমন তুমি তড়িৎবর্মার ভাই হয়ে লড়তে এসেছো তেমনই আমিই গির্গিটের ছোট ভাই হয়ে লড়বো।
এইসব কথা কাটাকাটি যে নারদমুনি শুয়ে শুয়েই শুনছিলেন তা টের পাওয়া গেল অনতিপরেই। দূর থেকে একটি পিশাচ পরিবাহিকা চিৎকার করে বললো – এই বুড়ো মুনি বলছে – হঠাকারিতা কোরো না দেবরাজ। তোমার অস্ত্র নেই।
গির্গিট গলা নামিয়ে ভর্ৎসনা করে বললো – কি যা তা বলছো দেবরাজ? তুমি অতিথি হয়ে এসেছো? দুদিন বিশ্রাম করবে। গায়ের ব্যথাও সারে নি এখনো। এই অবস্থায় তোমাকে এই পাষণ্ডের সাথে লড়তে দেবো নাকি?
দেবরাজ ততোধিক গলা নামিয়ে বলে – পাগলামি কোরো না গির্গিট। বজ্রের বিরুদ্ধে তোমার ওই ঘাসকাটার যন্ত্র এক পলকও টিকবে না। স্বর্গ চিরদিনের জন্যে অসুরদের হাতে চলে যাবে।
গির্গিট বললো – সে তো তুমি পরাজিত হলেও যাবে। বরং তুমি প্রাণে বাঁচলে তা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আছে।
দেবরাজ মাথা নাড়তে থাকে। – বজ্রের বিরুদ্ধে আমাকেই লড়তে দাও গির্গিট। আমার অভিজ্ঞতা আছে। তারপর সে একটু থেমে বলে – তাছাড়া ভুলো না এখনও আমিই ইন্দ্র। দেবলোকের ভবিষ্যৎ আমার হাতেই থাকুক।
গির্গিট চাপা গলায় বললো – শেষ অনুরোধ রাখো দেবরাজ। বজ্র ছাড়া তুমি ককুদ্মিকে পরাস্ত করতে পারবে না। বরং অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করে দেওয়া যাক। ককুদ্মি তো সম্পূর্ণ বিধানসম্মতভাবে লড়ছে না। একটা কোন নিয়মের প্যাঁচে ফেলে নারদ নিশ্চয়ই খেলা ভণ্ডুল করে দিতে পারবেন।
ইত্যবসরে চারদিকে একটা তুমুল হৈচৈ পড়ে গেছে। কি হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যারা একটু দূরে বলে কিছু দেখতে পাচ্ছিলো না তাদের মধ্যে রটে যায় যে গির্গিট ভুল করে নারদের গলাই কেটে ফেলেছেন। এবার বিষ্ণু এসে সব পণ্ড করে দেবেন। ভয়ে, বিস্ময়ে একটা হট্টগোল আরম্ভ হয়েছে।
কোলাহলের মধ্যে দেবরাজ অত্যন্ত মৃদু এবং শীতল গলায় বললো – ককুদ্মিকে আর কখনো হাতের মুঠোয় পাবো না গির্গিট। তুমি কি দেবরাজের উপর ভরসা হারাচ্ছো?
অধৈর্য হয়ে উঠেছেন তড়িৎবর্মা।
– কি ব্যাপার গির্গিট? তোমরা কি পরামর্শ করেই বেলা গড়িয়ে দেবে ভাবছো?
গির্গিট তার থাবার মত হাত তুলে বললো – যা উদ্ভট সব কাণ্ড হচ্ছে। কোনটা বিধেয়, কোনটা নয় কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আমার হয়ে দেবরাজই লড়বে।
ককুদ্মি বজ্রটি বাগিয়ে ধরে বললো – তাহলে আর বিলম্ব কিসের?
গির্গিট আর তড়িৎ যুদ্ধস্থল ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াতে ককুদ্মি হেঁকে বললো – তুমি কি অস্ত্র ব্যবহার করবে দেবরাজ?
দেবরাজ একবার এদিক ওদিক চাইলো। সম্মুখেই একটি জম্বুবৃক্ষের পিছনে আত্মগোপন করে আছে একটি শ্বেত হস্তী। দেবরাজ ওদিক আঙুল তুলে দেখায়।
ওই জম্বু বৃক্ষ থেকে একটা ডাল পেড়ে নিয়ে আসি। দাঁড়ান ককুদ্মি। দেবরাজ এগোয় জম্বুবৃক্ষের দিকে।
একটা ডাল মাত্র? ককুদ্মি আর তড়িৎ মৃদু হাস্য করছে, সেই সঙ্গে পিশাচদেরও কেউ কেউ। মাত্র একটা গাছের ডাল নিয়ে লড়বে দেবরাজ?
নারদমুনি উঠে বসে এসব কাণ্ড দেখে ক্রমাগত বুকে হাত বোলাচ্ছেন। দেবরাজ সবার চোখের সামনেই একলাফে জম্বুবৃক্ষে আরোহণ করেই কি একটা পেড়ে নিল। যখন সে পুনরায় লাফ দিয়ে নামলো নীচে তখন তার হাতে অনেকটা ককুদ্মির হাতের অস্ত্রটির মতই শাদা একটি দণ্ড বিশেষ। তবে আকারে আরো বড় ও ভারী। এবং একটু পুরনো বলে অতটা উজ্জ্বল নয়।
ককুদ্মি চমকে গিয়ে বললো – একী, এ যে বজ্র। কটা বজ্র ছিল তোমার?
দেবরাজ আগের মতই নির্বিকার গলায় বলে – একটাই।
বেগতিক দেখে ককুদ্মি সহসা হুংকার দিয়ে তার হাতের অস্ত্রটি কুশলতার সাথে বজ্রের মত নিক্ষেপ করলো দেবরাজের দিকে। কিন্তু দেবরাজের হাতের অস্ত্রটি সহজেই সে প্রহার সহ্য করে যে প্রতিপ্রহার করলো তাতে ককুদ্মির হাতের অস্ত্রটি ভস্মীভূত হয়ে গেল চোখের পলকে।
নারদ ধড়মড় করে উঠে বললেন – কি হচ্ছে এসব, অ্যাঁ?
এতগুলি অভূতপূর্ব ঘটনা একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করে উপস্থিত পিশাচ নাগরিকরা অভিভূত হয়ে গেছে। ছেলেছোকরারা হর্ষোল্লাসে ফাটিয়ে দিচ্ছে মল্লমুদ্গর।
দেবরাজ আহত ও ভূপতিত ককুদ্মির বুকের উপর বজ্র ঠেকিয়ে বললো – গির্গিট, ককুদ্মিকে প্রাণে না মেরে বন্দী করতে চাই। আশা করি তোমার কোন আপত্তি হবে না।
গির্গিটের আহ্লাদ আর ধরে না। সে বললো – যুদ্ধে যদি সংহার না করো তাহলে বন্দী করবে এতো তোমাদের শাস্ত্রেই লেখা আছে। পিশাচশাস্ত্রে তো ঝলসে খাওয়াও বিধিসম্মত। এতে আর জিজ্ঞেস করার কি আছে দেবরাজ?
সন্ধ্যেবেলা মল্লমুদ্গরে পানভোজনের উন্মাদ উৎসব চলছে। বিশেষ করে নাম্বুদের ধড়মুড়ো দিয়ে একটি অপূর্ব সুখাদ্য তৈরি করে রাজপাচক নাগরিকদের মধ্যে বিতরণ করেছে। গির্গিটের কুটিরের একটি নিরালা কক্ষে বসে দেবরাজ ও গির্গিট সুরাপান করছিল।
দ্বার থেকে গির্গিল টোকা দিয়ে বললো – সুসমাচার আছে।
গির্গিট বললো – ভিতরে চলে আয়।
গির্গিল এসে বলো – অসুররা জানিয়েছে যে ককুদ্মিকে ফিরে পাবার পরিবর্তে তারা স্বর্গ ও মর্ত্যের অধিকৃত অংশ ত্যাগ করতে প্রস্তুত। ইন্দ্রাণীর বিধ্বস্ত উদ্যানটিও তারা পূনরায় সুসজ্জিত করে দেবে। যে সব অপ্সরীরা ভুল করে শত্রুপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন তাদের একটি গোশকটে তুলে দেওয়া হয়েছে। কাল ভোরের মধ্যেই এসে পড়বেন।
গির্গিট দেবরাজের স্কন্ধে চাপড় মেরে বললো – সাধু সাধু। আর কি চাই বলো দেবরাজ? সমস্ত কথাই মেনে নিয়েছে অসুররা। ভুলও করে নি। ককুদ্মি ছাড়া তাদের রাজ্য ছারেখারে যেত।
দেবরাজ একটু প্রসন্ন হাসি উপহার দেয়।
গির্গিল বললো – আমি কিন্তু তড়িৎবর্মাকে ঘুরঘুর করতে দেখেও একবারও বুঝি নি তার কোনো কু-উদ্দেশ্য আছে। তুমি কি করে বুঝলে দেবরাজ?
আসবের পাত্র থেকে মুখ তুলে স্মিত হেসে দেবরাজ বললো – আমিও বুঝি নি হে। কেবল ললিত ঋষির ওই দশার পর কিঞ্চিৎ সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম মাত্র। এমনিতেই চিরকাল একটু সাবধানী স্বভাব আমার তাই বজ্রটা গোপন কোন স্থানে লুকিয়ে ফেলেছিলাম।
গির্গিল বললো – আর অন্য বজ্রটা পেলে কোথায়?
দেবরাজ বলে – সেও এক অদ্ভুত ঘটনা। শুনলে চমৎকৃত হবে। প্রথম যামে ললিত ঋষি প্রাণত্যাগ করার আগে আমায় একটি বর দেবার জন্য পীড়াপীড়ি আরম্ভ করলেন। না নিলে নাকি তাঁর শান্তি হবে না। এদিকে অসুরদের সাথে যুদ্ধে সুবিধে হচ্ছিল না বলে দেবসেনাপতিরা কয়েকদিন ধরে কানে কেবল ফুসমন্তর ঢেলে যাচ্ছে – অস্ত্র চাই অস্ত্র চাই। সেই থেকে রোগাসোগা মুনি ঋষি দেখলেই কেমন লোভ হচ্ছিল। ললিত ঋষি যখন মরেই যাচ্ছেন তখন হাড়গুলো তো তাঁর আর কোন কাজে লাগবে না। উগ্রতেজা বলে খ্যাতিও আছে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে হল যদি ওনার হাড় দিয়ে আরেকটা বজ্র হয় তাহলে মন্দ কি?
গির্গিল চোখ ছানাবড়া করে বললো – তুমি ললিত ঋষির হাড় চেয়ে নিলে?
দেবরাজ বললো – বিশ্বাস করো, ললিত শুনে অত্যন্ত প্রীত হলেন। যারপরনাই শান্তি পেয়েছেন এমন ভাব দেখিয়ে যোগবলে অস্থিচর্ম পৃথক করে ফেললেন তৎক্ষণাৎ। তার কিছুক্ষণ পরেই প্রাণবায়ু নির্গত হল। আমিও হাড়গুলো লুকিয়ে নিজের কুটিরে নিয়ে গিয়ে জুড়ে জুড়ে বজ্রের আকার দিলাম। পরীক্ষা করে দেখার আর সময় হয় নি। সেটাকেই হাতের কাছে নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। সকালে উঠে যখন দেখলাম চুরি গেছে, তখনই বুঝলাম কিছু একটা ঘটবে। কুটিরে একটু পুষ্পরেণুর গন্ধ পেয়ে বুঝেছিলাম কাজটি কার হতে পারে।
গির্গিল বললো – ধন্য তোমার সাহস। শেষ অবধি প্রত্যয়ের অভাব দেখিনি। আচ্ছা, সত্যি যদি বজ্রটি চুরি যেত কাল? তাহলে কি হত ভেবে দেখেছো?
দেবরাজ বললো – বজ্র চুরি গেলে সর্বনাশ হয়ে যেত। ককুদ্মির উদ্দেশ্য ছিল বিষপ্রয়োগে ললিত ও আমাকে পথ থেকে সরানো। তারপর বজ্র হাতে সে তড়িৎবর্মার ভাই হয়ে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে নেমে পড়লে রক্ষা ছিল না। এই ধরনের কূট ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনার কথা ভেবেই ঘুমোবার সময় বজ্রটিকে অতি সুরক্ষিত স্থানে রেখে আসতে হয়।
গির্গিল বললো – আর রহস্য না করে বলোতো ভায়া কোথায় রাখো?
দেবরাজ মৃদু হেসে বললো – দরজারও কান আছে গির্গিল। গুহ্য ব্যাপার। বলা যায় না।
গির্গিট নিজের বিশাল ঊরুতে চাপড় মেরে বললো – আরে রাখো এসব। বরং একটু শূলপক্ক হস্তিশুণ্ড খাওয়া যাক। পাচককে বলে রেখেছি। সে আনলো বলে।
সামান্য একটা খাবারের কথায় দেবরাজের প্রতিক্রিয়া বিস্মিত করে গির্গিটকে। এতক্ষণ যে ঠাণ্ডা মাথায় সব করলো সেই দেবরাজ যেন বজ্রাহত।
– হস্তিশুণ্ড তুমি কোথায় পেলে গির্গিট?
গির্গিট বললো – কেন, তুমিই তো এনেছো। কাল থেকে তোমার ঘরের পিছনে লুকিয়ে ছিল হাতিটা। তার শ্বেত শুণ্ডটি দেখে তখনই আমার বড় লোভ হয়েছে। দধি সহযোগে শূলপক্ক করলে কিরকম হবে ভাবতেই জিভে জল এসে যাচ্ছে।
দেবরাজ তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বললো – গির্গিট তুমি কি আবার খেপেছো? হস্তীটি আমার প্রিয় বাহন। তাকে আমি আহার করবো একথা ভাবলে কি করে? কোথায় তোমার পাকশালা, শীঘ্র চলো। তাকে কি মেরে ফেলেছো নাকি?
গির্গিট অভিমান করে বললো – এ কি বলছো দেবরাজ? এখন সে হস্তী তো আমার। কথা ছিল না যে দিনান্তে অপরাজিত থাকলে ইন্দ্র হবো আমি!
দেবরাজ লাফ দিয়ে কুটিরের বাইরে যেতে যেতে বললো – আগে হাতিটাকে বাঁচাই, তারপর অন্য কথা।
পাকশালার পিছনে তখন একটি নতুন নাটক চলছে। বিপুলকায় দশ বারোটি পিশাচ ঐরাবতের গলায় দড়ি বেঁধে তাকে একটি বড় গাছের গুঁড়ির সামনে এনে বসিয়েছে। শুণ্ডটি গুঁড়ির উপর ফেলে রাখা হয়েছে। পুরো হাতিকে কাটার প্রয়োজন নেই। আপাতত শুণ্ডটি ছেদন করে শূলপক্ক করলেই চলবে। পরে গির্গিটের নির্দেশমত ভুড়ি ফাঁসানো যেতে পারে।
প্রধান পাচক একটি বৃহৎ খড়্গ তুলেছে শুণ্ডছেদনের জন্য। এমন সময় দূর থেকে দেবরাজ, গির্গিট ও গির্গিলকে ছুটে আসতে দেখা গেল। দেবরাজ দু হাত তুলে বলছে – তিষ্ঠ, তিষ্ঠ। মেরো না, মেরো না।
কিন্তু অত ভারী খড়্গ সম্বরণ করতে চেয়েও পারে না পাচক। সে তার বিপুল উদর ও দেহ নিয়ে নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় মাটিতে। খড়্গটি সোজা গিয়ে পড়ে ঐরাবতের শুণ্ডে।
গির্গিট চোখ বুজে সখেদে বলে – যাঃ, গেল।
কিন্তু দেখা যায় ঐরাবতের কিছুই হয় নি। খড়্গটি আঘাত করার সাথে সাথেই বিকট শব্দ করে ভস্মীভূত হয়েছে। সেই শব্দে পাচকরাও একছুটে পগার পার।
চোখ খুলে গির্গিট আরেকটি আশ্চর্য দৃশ্য দেখলো। আঘাত খেয়ে ঐরাবত নড়েচড়ে উঠে বসেছে। তারপর শুণ্ড তুলে যেই বলেছে – হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁচ্চো – ওমনি তার হাঁচির সাথে সাথে শুণ্ডের ভিতর থেকে লম্বা শাদা একটি দণ্ড বেরিয়ে ঠকাস করে গিয়ে পড়েছে পাকশালার চালার উপর।
দেবরাজ তড়িঘড়ি লাফ দিয়ে চালে আরোহণ করে দণ্ডটি কুড়িয়ে নিয়েই খাপে তলোয়ার রাখার মত তা চেপে চুপে ঐরাবতের শুণ্ডে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে দিরে আসে গির্গিট ও গির্গিলের কাছে যারা দুজনেই চোখ ছানাবড়া করে এই বিচিত্র ঘটনাটি নিঃশব্দে প্রত্যক্ষ করছিল। দুজনেই একসাথে বিষম খেয়ে কাশতেও থাকে হঠাৎ।
অবিচলিত দেবরাজ শুধু দুকাঁধ ঝাঁকিয়ে বিরক্তির ভঙ্গী করে বলে – অত আদিখ্যেতার কি আছে হে? আগে কোনদিন হাতি দেখোনি নাকি?
বৈকুন্ঠের সব দিনই সুন্দর। ঝড় নেই, ঝঞ্ঝা নেই, বৃষ্টি নেই, কাদা নেই। ফুরফুর করছে শুধু বসন্তের হাওয়া। কামমোহিত কোকিলরা কোত্থেকে যে এখানে এসে জড়ো হয় কেউ জানে না। বিষ্ণুর পুরনো বসতবাটি এখানেই।
একটি দৌবারিক এসে লক্ষ্মী নারায়ণকে সংবাদ দিল – সেই লোকটা আবার এসেছে। ভিতরে বসাবো না বাইরে?
বিষ্ণু উদাসভাবে বললেন – কোন লোকটা? যে আজ সকালে এসে নারায়ণী অস্ত্র নিয়ে গেল। সে?
দৌবারিক বললো – না, তার তো চুল দাড়ি সোনালী। সে নয়। এ সেই শাদা হাতির পিঠে বসা ছোকরা। কেবল যে ঘ্যানঘ্যান করে।
বিষ্ণু বললেন – হুম্। ভিতরেই পাঠাও একেও।
একটু পরে দেবরাজ প্রবেশ করলো কক্ষে। ভালোই দেখাচ্ছে তাকে। আঘাতের চিহ্নগুলি আর নেই। প্রণাম করে মা লক্ষ্মীর পায়ের ধুলো নিল সে।
বিষ্ণু বললেন – ধন্য দেবরাজ ধন্য। কিভাবে তুমি একবেলার মধ্যে ককুদ্মিকে বন্দী করে সমগ্র স্বর্গলোক উদ্ধার করলে তা শুনে আগাপাশতলা রোমাঞ্চিত হয়েছি। বলো, মা লক্ষ্মীকে গল্পটা আবার বলো।
গতি নেই দেখে নিজের ভূমিকা কমিয়ে এবং গির্গিটের শৌর্যের কথা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবরাজ সংক্ষেপে ঘটনাটি বিবৃত করলো।।
সব শুনে মা লক্ষ্মী বললেন – তাহলে কি গির্গিটই ইন্দ্র হল এখন?
দেবরাজ ম্লান হেসে বললো – ন্-না। তার হাতে আর রাজ্য দিতে ভরসা হল না। সবই ভালো, বুঝলেন, ওই পৈশাচিক খিদের জন্য কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান একেবারেই থাকে না। ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবার কথা ছেড়ে দিলাম। মেনকা, রম্ভা প্রভৃতি বরিষ্ঠা অপ্সরারা একটু স্থূলাঙ্গী হয়েছেন। তাদের দেখেও যে ব্যাটার জিভ সক সক করবে না তা বলা যায় না। সেটাই একটু ঘুরিয়ে বোঝাবার পর হাতে পেতে তাকে দেওয়া ইন্দ্রত্ব আবার নিজেই ভিক্ষা চেয়ে নিলাম। ভাই বলে ডেকেছি তো – তাই বেশ স্নেহ করে আমায়। প্রসন্ন হয়েই দিয়ে দিল।
বিষ্ণু হৈহৈ করে বললেন – সাধু সাধু। সত্যিই মহৎ আর উদার চরিত্রের লোক এই গির্গিট। কিন্তু তোমাকে ছাড়া স্বর্গের সিংহাসনে কাউকে মানাতো না দেবরাজ। কার আছে বিপদে এত ধৈর্য, এত আত্মবিশ্বাস?
দেবরাজ ফিকে হাসি হেসে বললো – অত প্রশংসায় কাজ নেই পদ্মনাভ। বলুন কে আছে যে এত মার খেয়েও সিংহাসন আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারে?
বিষ্ণু গম্ভীর হয়ে বললেন – সেই কারণেই তো তুমি অজেয়, ইন্দ্র। যে কোন পরিস্থিতেই তুমি বজ্রের চেয়েও কঠিন। যে মুকুট তোমার মাথায় তা সহ্যের, সহিষ্ণুতার, ধৈর্যের। এত ঐশ্বর্য ও ভোগের মধ্যে থেকেও তুমি কর্তব্যের পথ থেকে বিচলিত হও না। এই যোগ্যতা ত্রিভুবনে আর কার আছে?
দেবরাজ বললো – ঢের হয়েছে। এবার আমার আসার কারণটা বলি। বহু যুদ্ধ করে এখন আমি সত্যি ক্লান্ত। শচী মাথা খেয়ে নিচ্ছে। তাকে নিয়ে একমাস পম্পায় ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। রাজকার্য নিয়ে এক অনুপলও ভাববো না। ইতিমধ্যে কোন গণ্ডগোল চাই না। আপনার কাছে একটি প্রার্থনা আছে।
বিষ্ণু বললেন – বলো বৎস, বলো।
দেবরাজ বললো – আপনি এখন আর কিছুদিন মুক্তহস্তে অস্ত্র বিলোবেন না। আমাকে যখন রিক্তহস্তে ফিরিয়েছেন তখন অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই করবেন। মারণাস্ত্র হাতে পেলেই, কি দেব, কি অসু্র, ক্ষমতার লোভে উন্মাদ হয়ে যায়। এই প্রত্যহের যুদ্ধ বিগ্রহ আর ভালো লাগছে না মোটে।
বিষ্ণু বললেন – মুখের কথাটা আমার কেড়ে নিয়েছো দেবরাজ। আমিও ঠিক এটাই চাই। নির্ভয়ে ছুটি কাটাতে যাও তুমি।
তারপর একটু গলা নামিয়ে যোগ করলেন – শচীর কি বাচ্চাটাচ্চা হবে?
দেবরাজ একটু অপ্রতিভ হয়ে বলে – ইয়ে, না তো! যাই হোক আপনার কাছ থেকে অভয় পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। এবার আসি তাহলে। আপনাদের জয় হোক।
দেবরাজের প্রস্থানের পর লক্ষ্মী বিষ্ণুকে চোখ পাকিয়ে বললেন – এটা কি হল?
– কি হল মানে? বিষ্ণু যেন আকাশ থেকে পড়েছেন।
লক্ষ্মী ভুরু কুঁচকে বললেন – আজকে সকালেই যে তুমি ককুদ্মিকে একটা বড় অস্তর দিলে সেটা কি আমি দেখিনি?
বিষ্ণু বললেন – ও। এই কথা? দেখেছো দেবরাজ টা কি চতুর? অসুররা স্বর্গ হারিয়ে যে আমার উপর আরো চাপ দেবে অস্ত্রের জন্য সেটা ঠিক ধরতে পেরে বারণ করতে এসেছিল। আসবে জানতাম, তাই তো তার আগেই…..
লক্ষ্মী অপ্রসন্ন মুখে বলেন – তাই তার আগেই ককুদ্মির ঝুলি ভর্তি করে দিলে, অ্যাঁ? কি আক্কেল তোমার বলোতো? এই তো দেবরাজকে যুদ্ধ বিগ্রহ চাও না বলে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারলে। সেগুলো কি সকালে মনে ছিল না? না নিজেই বিশ্বাস করো না?
বিষ্ণু প্রসন্ন হেসে বললেন – প্রিয়ে, এ হল সৃষ্টির খেলা। একটা মায়াজালের আবরণ সৃষ্টি না করলে চলবে কি করে? আজ যদি স্বর্গ মর্ত্য থেকে ঘাত প্রতিঘাতের সম্ভাবনা বন্ধ করে দিই তাহলে দেবরাজের মত যোদ্ধা, গির্গিটের মত উদার লোক, বা ককুদ্মির মত কূটবুদ্ধি আসবে কোথা থেকে? কিভাবে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতরের দিকে অগ্রসর হবে তাদের মেধা? এও এক গভীর তত্ত্ব প্রিয়ে। ক্রমবিবর্তন। সবাই কি বুঝবে? বুঝবে না।
মা লক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বলেন – আমি বুঝবো। একটু বোঝালেই বুঝবো দেখো ঠিক।
বিষ্ণু একটা হাত বাড়িয়ে বললেন – এসো তবে ওই সাপের ফণায় গিয়ে একটু বিশ্রাম করি। দৌবারিককে বলে দাও দ্বার দিয়ে দিতে। আর কারো কোন প্রার্থনা শুনবো না। নারদকে বলে দাও বাইরে একটি বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে বাড়ি চলে যেতে। আজ বৈকুন্ঠধাম বন্ধ।