একঘেয়েমির মধ্যে একটা মাদকতা থাকে। আর তা থাকে বলেই সেই নেশায় জড়িয়ে যায় মানুষ। হেমিংওয়ের বৃদ্ধ সান্টিয়াগো কে মনে পড়ে? দিনের পর দিন সমুদ্রের টানে ভেসে থাকতেন। মার্লিন ধরা যেন তার এক উপলক্ষ মাত্র। কিংবা সেই কর্নেল। মার্কেজ যাকে অনন্ত অপেক্ষার প্রতীক হিসেবে গড়েছিলেন। দিন যায়, মাস গড়িয়ে বছর হয়, তবু 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল'। প্রেক্ষাপট হয়তো আলাদা। সাত্যকি হালদারের 'কৃষ্ণগহ্বর' পাঠককে এমনই নিস্তরঙ্গতার মায়াজালে জড়িয়ে ফেলে। রাঢ়বাংলার এক পাহাড়ি গ্রাম। সেখানে সময়ের ছন্দ ভারি ঢিমে তালে বাঁধা। কিন্তু হঠাৎ একদিন যখন ঢেউ আছড়ে পড়ে, শান্ত উপত্যকার উথাল পাথাল পাঠককে দিশেহারা করে।
উপন্যাসের নায়ক ডাক্তার অরূপ। সদ্য ডাক্তারি পাশ করা শহুরে যুবক প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে যায়। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম হিরবাঁধ। তার চেনা ম্যাপের বাইরে। মেডিকেল কলেজ হস্টেলের দাদারা বলে রেখেছে, “ছ মাস তোর বেড রাখা থাকবে”। এক পা কলকাতায় রেখে অরূপ আরেক পা বাড়ায় হিরবাঁধের উদ্দেশে। নেহাতই অ্যাডভেঞ্চার। বাঁকুড়ার জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে আরো অনেক মালপত্তরের সঙ্গে অরূপকেও তুলে নেয় ভ্যান। ডিসেম্বরের কনকনে রাতে গন্তব্যে পৌঁছোনোর আগেই তাকে নামিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় সে ভ্যান। এই প্রথম শহুরে কোলাহলের বাইরে নিকষ অন্ধকারে নিজেকে একলা হতে দেখে অরূপ। ঢালু এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসে পৌঁছোয় হিরবাঁধ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। গাছপালায় ঘেরা হাসপাতালটিকে চারপাশের পাহাড় যেন জগতের সব ব্যস্ততা থেকে আগলে রেখেছে। আদিমতার প্রলেপ সবখানে। পরিচয় হয় হাসপাতালের গুটিকয় কর্মী এবং স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে। আসে বৃদ্ধ দুর্যোধন, খাটো ময়লা ধুতি, ফতুয়ার ওপর চাদর জড়ানো, “লতুন ডাক্তার আইছেন মোদের হিরবাঁধে, তাই টুকু দেখা কর্যা গেলম...”। এ যেন তার গৃহকর্তাসুলভ দায়িত্ব। লালমাটির দেশে মানুষজনের ব্যবহারে আন্তরিকতার উষ্ণতা মিশে থাকে শীতসকালের মিঠে রোদ্দুরের মতো। পাঠকও সেই উষ্ণতার আমেজ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।
মাথার ওপর কলেজের স্যাররা নেই। নেই সিনিয়ররাও। সদ্য পাশ করা অরূপ তার বই পড়া বিদ্যে দিয়ে সব রোগের হদিশ পায় না। সে উপলব্ধি করে, রোগীরাই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। দোলাচল তার মনে, কবে ফিরবে কলকাতায়, আলিপুরদুয়ারেই বা কবে যাবে। তার অপেক্ষায় আছে জয়িতা। ডিমা নদীর বাঁকে কবে তাদের দেখা হবে! এক জীবন ধরে আলিপুরদুয়ারে বসে মানুষের নিরাময়ের চেষ্টা করে চলেছেন ডাক্তার গুহ রায়, জয়িতার বাবা। নিভৃত পৃথিবীর কোণায়। জয়িতার সাথে অরূপকেও হয়তো সেই চিকিৎসালয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। অরূপের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্বের তল পেতে শুরু করে পাঠক।
হিরবাঁধের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সুপার ডাক্তার সুখচাঁদ মুন্ডা, একঘেয়েমির মাদকতা একদিন যাকে কব্জা করে ফেলেছিল। আচমকা মনে হবে ‘আরোগ্যনিকেতন’-এর জীবনমশায় নাকি? না, তা নয়। নতুন প্রজন্মের চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসককে জায়গা ছেড়ে দিতে তাঁর মনে ক্ষণিকের দ্বিধা নেই। কেরালায় পড়াশোনা করে এসে ডাক্তার মুন্ডার প্রথম পোস্টিং হিরবাঁধে। পঁচিশ বছর আগে। আর তাঁর ফেরা হয়নি কোনোদিন। লালমাটির টান বড়ো অমোঘ। জীবনকে সহজভাবে যাপন করার সুখ যিনি পেয়েছেন, সেই সুখচাঁদকে জাগতিক কোনো প্রলোভন যেন স্পর্শ করতে পারেনা। এবার তিনি চাকরির পাট চুকিয়ে পুরোনো জায়গায় ফিরতে চান। হয়তো কয়েক হাজার বছর আগের ঠিকানায়। প্রকৃতির কোলে, আদিমতার শান্ত ছায়ায়। তাঁর জীবনদর্শন আকর্ষণ করে অরূপকে। তার শহরে ফেরার অস্থিরতা কমতে থাকে, বাড়তে থাকে হিরবাঁধকে নিবিড়ভাবে চেনার ইচ্ছে। মায়া পড়ে যায় গ্রামের অভিযোগহীন, সরল মানুষগুলোর ওপর। সবকিছুর মধ্যে যেন এক অন্য পৃথিবীর হদিশ পাচ্ছে অরূপ।
গুটিকয় বাইকের গুট গুট আওয়াজ কাছে আসে, দূরে চলে যায়। রোজ। একই সময়ে। শনের ছাউনি দেওয়া কাঠের ছাতা মাথায় দিয়ে ভেড়ার পাল নিয়ে রোজ সকালে পাহাড়ের মাথা টপকে অদৃশ্য হয়ে যায় বুড়ো দুর্যোধন। ঠিক তেমনি খোলা ছাতা কাঁধে ফেলে ফিরে আসে সন্ধ্যের গা ছুঁয়ে। আসতে যেতে দুটো কথা কয়ে যায়। আপনজনের মতো। যেন ভেড়া না, সময়কেই ঠেলে পাহাড়ের মাথায় তোলে সে রোজ। অরূপের মনে হয় সূর্যকে প্রতিদিন দুর্যোধনের ছাতা টপকে পুব থেকে পশ্চিমে যেতে হয়।
নিস্তরঙ্গ হিরবাঁধের জীবনে ডাক্তার মুন্ডা যেন এক দমকা হাওয়া। ডাক্তার মুন্ডা অরূপকে পাহাড়ের ওপারে বকডুবি দেখাতে নিয়ে যাবেন কোনো একদিন। কাঁড়া বা মোষের পিঠে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে পাহাড় টপকে বকডুবির ঢাল। শীতের শেষে সেখানে কালচে সবুজ নালিঘাস গজায়। পাহাড়ের ওপর থেকে দেখলে মনে হবে একখানা গর্ত। কৃষ্ণগহ্বর। সেখানে একবার গেলে আর নাকি নাগরিক জীবনে ফেরেনা কেউ। ডাক্তার মুন্ডাও হয়তো সেই কৃষ্ণগহ্বরে আটকে গেছেন। নাদের আলির তিন প্রহরের বিলের মতো বকডুবি দেখার অপেক্ষায় থাকে অরূপ। দিন যায়, ঋতু বদলায়। বুড়ো দুর্যোধন রোজ পাহাড় ডিঙিয়ে ভেড়ার পাল নিয়ে বকডুবির দিকে যায়। কিন্তু অরূপের যাওয়া হয়ে ওঠেনা। পাঠকের মনেও বকডুবির কৃষ্ণগহ্বর দেখার ইচ্ছে গাঢ় হতে থাকে।
এখন আর হিরবাঁধের মানুষদের শহরের হাসপাতালে বিশেষ যেতে হয়না। সাপে কামড়ানো থেকে ছোটোখাটো অপারেশন সবই সামলাতে শিখে গেছে অরূপ। একদিন বিকেলে দুর্যোধন হাসপাতালে আসে, সঙ্গে তার ছোট্ট নাতি, মায়ের কাঁধে মাথা রাখা। চোখে তার খুব যন্ত্রণা। প্রাথমিক পরীক্ষায় তেমন কিছুই ধরতে পারে না সে। শুধু একটা চোখের ড্রপ আর অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে ছেড়ে দেয়। শিশুটি তাতে সাময়িক স্বস্তি পেলেও পরদিন তার সংশয়ী মা জানতে চায়, শহরের বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কিনা। দ্বিধাগ্রস্ত অরূপ বলে, তার দরকার নেই, আরো একটা দিন দেখা যাক। উঠতি ডাক্তার অরূপ চোখের চিকিৎসায় এখনও দড়ো নয়। সঙ্গে কোনো বই নেই, নেই সিনিয়র কারোর পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ। দুশ্চিন্তা হয় তারও। পরদিন জানতে পারে, শিশুটিকে রাতেই সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় এবং সম্ভাব্য মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে তার চোখটি তুলে বাদ দিতে হয়। একদিন আগে আনলে হয়তো চোখটি বাঁচানো যেত। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে ওঠে পাঠক।
এরপর নানা স্রোতে বয়েছে অরূপের জীবন। হিরবাঁধ থেকে কালিম্পং, সরকারি চাকরি ছেড়ে স্বাধীন প্র্যাক্টিস। ফেরা হয়নি ডিমা নদীর কাছে। জয়িতার কাছেও। ডাক্তার গুহ রায় পাড়ি দিয়েছেন না-ফেরার দেশে। তবু হিরবাঁধের ডাক শুনতে পায় অরূপ। ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পায় সব ‘ভালো আছি’র পিছনে দাঁড়িয়ে দুর্যোধনের নাতি। এখন সে যুবক। অন্ধ হাঁ চোখ নিয়ে সে যেন অরূপকে খোঁজে। কৈফিয়ৎ চায়। অরূপের সাময়িক সিদ্ধান্তের ভুলে আজ তার চোখে কৃষ্ণগহ্বর! স্বপ্নের ভিতর হিরবাঁধে ফিরে যেতে চায় অরূপ। শুধু একবার ক্ষমা চাওয়ার জন্যে।
লেখক সাত্যকি হালদার একজন ডাক্তারও। পাঠক যদি অরূপের মধ্যে সাত্যকিকে খোঁজেন, জানিনা তাতে ভুল হবে কিনা। স্থান-কাল-পাত্রের এমন অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুধুই কি চিত্রকল্প! নাকি এ সাত্যকিরই যাপিত জীবনের জলছবি! পাঠককে আগাগোড়া মোহাবিষ্ট করে রাখেন লেখক। রাস্তার মোড়ের দোকানে ‘কুমড়োর বেগুনি’ থেকে পাহাড়তলীর ছায়ামাখা লাল মাটির পথ, ঘোর লাগে যেন। কিন্তু খটকাও লাগে, কৃষ্ণগহ্বর কি কেবলই দুর্যোধনের নাতির হারানো চোখে! নাকি সমগ্র সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাই এক কৃষ্ণগহ্বর! শুধু ডাক্তারের সদিচ্ছায় তো চিকিৎসা হয়না। উপযুক্ত পরিকাঠামোহীন গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত ডাক্তারদের অসহায়তার দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে এই উপন্যাস! অসাধুতার ব্যাপ্তি চিকিৎসার পরিমন্ডলকে ক্রমাগত ছেয়ে ফেলছে। এত আয়োজন তবে কি বৃথা যাবে! কোন কৃষ্ণগহ্বরের দিকে এগিয়ে চলেছি তবে আমরা! ভয়ের সাঁকো পেরিয়ে পাঠক মনে মনে ভরসায় বুক বাঁধে। সে নিজেকে প্রবোধ দিতে চায়, কৃষ্ণগহ্বর কেবল বকডুবির সবুজ নালিঘাসেই আছে। শুধু বকডুবির ঢালেই। তা দেখা হোক বা না হোক।