মূল উর্দু গল্পটি নেওয়া হয়েছে দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত ‘কুল্লিয়াত-এ-মান্টো’ (মান্টো কে আফসানে)’-র দ্বিতীয় খণ্ড (পৃ ১০৩৩ – ১০৪০) থেকে।
ছারপোকাগুলোকে মেরে ট্রাঙ্কের পুরোনো কাগজগুলো দেখছিলাম। তার মধ্যে পেয়ে গেলাম সঈদ ভাইজানের ছবি। টেবিলের ওপর একটা খালি ফ্রেম পড়ে ছিল। ফ্রেমে ছবিটা পুরে কুর্সিতে বসে ধোপার জন্য রইলাম অপেক্ষায়।
প্রত্যেক রবিবার এমনই অপেক্ষায় থাকতে হয়। কারণ শনিবার সন্ধ্যেয় আমার ধোওয়া কাপড়ের স্টক শেষ হয়ে যায়। স্টক বলাটা তো ঠিক হবে না কারণ অভাবের সে যুগে আমার মেরেকেটে সেই কটা জামাকাপড়ই ছিল যাতে কোনওভাবে সম্মান রক্ষা করা যায়।
শাদির কথাবার্তা চলছিল। আর সেই কাজে গত দু-তিনটে রবিবার আমি মাহিম যাচ্ছিলাম। ধোবি ছিল শরিফ আদমি। অর্থাৎ কাপড় ধোয়ার পয়সা না পেলেও সে নিয়ম করে প্রতি রবিবার ঠিক দশটা বাজলেই আমার কাপড় নিয়ে চলে আসত। তবু খটকা লাগত যে পয়সা না পেয়ে বিরক্ত হয়ে সে হয়ত কোনও দিন আমার জামাকাপড় চোরবাজারে বিক্রি করে দেবে। আর আমাকে শাদির আলোচনার সময় যদি বিনা কাপড়ে হাজির হতে হয়, তা হলে সেটা তো খুবই অসভ্য ব্যাপারে হবে!
খুপরি ঘরটাতে মরা ছারপোকার জঘন্য গন্ধ বেরোচ্ছিল। দুর্গন্ধ কী করে ঢাকি এই ভাবতে ভাবতেই ধোবি এসে উপস্থিত। ‘সাব সালাম!’ বলে সে গাঁঠরি খুলে আমার গোনাগুনতি জামাকাপড় টেবিলের ওপর রাখল। আর কাপড় রাখার সময় তার নজর পড়ল সঈদ ভাইজানের ছবিটার ওপর। চমকে গিয়ে সে যখন খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখছে, তখন একটা অদ্ভুত আওয়াজ তার গলা থেকে বেরিয়ে এল... ‘হে... হে... হে... হ্যাঁয়... ?’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার, ধোবি?’
ধোপার নজর তখনও ছবির ওপর। ‘ইনি তো সায়েদ শালিম বালিষ্টার!’
‘তুমি চেনো ওঁকে?’
ধোবি সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘হাঁ... দো ভাই হোতা... কোবালার ওদিকে ওঁদের কুঠিবাড়ি ছিল...সায়েদ শালিম বালিষ্টার... আমি ওঁদের কাপড় ধোলাই করতাম তো!’
ভাবলাম সে দুবছর আগের কথা বলছে। সঈদ হাসান আর মহম্মদ হাসান ভাইজান ফিজি আইল্যান্ডে যাবার আগে প্রায় এক বছর বোম্বাইতেই প্র্যাক্টিস করত। ধোপাকে বললাম, ‘তুমি দুবছর আগের কথা বলছ।’
ধোবি জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘সায়েদ শালিম বালিষ্টার... যখন চলে গেলেন, আমাকে একটা পাগড়ি দিয়েছিলেন... একটা ধুতি দিয়েছিলেন... একটা কুর্তা দিয়েছিলেন... নতুন... খুব ভালো লোক ছিলেন... .একজনের দাড়ি ছিল... এত বড়!’ সে হাত দিয়ে দেখাল দাড়ি কত লম্বা। তারপরে সঈদ ভাইজানের ছবির দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি ছোট ছিলেন – ওঁদের তিনটে বাচ্চা ছিল ... ছেলে, একটা মেয়ে... আমার সঙ্গে খুব খেলত... কোলাবায় এদের কুঠি ছিল... ইয়া বড়... !’
বললাম, ‘ধোবি, এ আমার ভাই।’
ধোবির গলা থেকে আবার অদ্ভুত একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল, ‘হে... হে... হে... হ্যাঁয়? সায়েদ শালিম বালিষ্টার?’
সে এতই আশ্চর্য হল যে আমি তার ঘোর কাটানোর জন্য বললাম, ‘এই ছবিটা সঈদ হাসান ভাইজানের ... দাড়িওলা হল মহম্মদ হাসান... আমাদের সবার বড়... ’
ধোপা খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে আমার নোংরা খুপরি ঘরটাকে চোখ দিয়ে মাপল। ছোট কুঠরিতে বিজলি বাতিও নেই। একটা টেবিল ছিল। একটা চেয়ার আর চটের দড়ির খাটিয়া ... ছারপোকায় ভর্তি। ধোবির বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি সায়েদ শালিম বালিষ্টারের ভাই হতে পারি। কিন্তু ওই দুই ভাই সম্পর্কে তাকে অনেক কথা বলায় ধোবি অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘সায়েদ শালিম বালিষ্টার কোলাবায় থাকে আর তুমি এই খুপরি ঘরে?’
আমি দার্শনিকের মত বললাম, ‘দুনিয়ার এমনই রং, ধোবি! কোথাও রোদ, কোথাও ছায়া। হাতের পাঁচটা আঙুল এক রকম হয় না।’
‘হাঁ, সাব। তুমি সত্যি কথাই বলেছ।’ ধোবি বেরোবে বলে গাঁঠরি ওঠাল।
এই সময় ধোবির হিসেবের কথা আমার মনে পড়ল। পকেটে পড়ে রয়েছে ঠিক আট আনা যাতে শাদির বাতচিত সারতে মাহিম পর্যন্ত যাতায়াতের খরচ কোনও মতে মিটতে পারে। কিন্তু আমার অভিপ্রায় যে সৎ ধোবিকে শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য তাকে দাঁড় করিয়ে বললাম, ‘ধোবি, কাপড়ের হিসেবটা মনে রেখো। খোদাই জানেন, কত জামাকাপড় তুমি ধোলাই করেছ।’
ধোবি তার ধুতির কুঁচিটা ঠিক করতে করতে বলল, ‘সাব, আমি হিসেব রাখি না। এক বছর সায়েদ শালিম বালিষ্টারের কাজ করেছিলাম।... যা দিয়েছিল, নিয়ে নিয়েছি। হাম হিসাব জানত হি নাহেঁ!’
ধোবি চলে যেতে শাদির কথাবার্তা বলতে মাহিমে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম।
বিয়ের কথাবার্তা ঠিক পথে এগোনোয় আমার শাদি হয়ে গেল। অবস্থাও ফিরল। মাসিক ন’টাকা ভাড়ার সেকেন্ড পির খান স্ট্রিটের খুপরি ঘর ছেড়ে ক্লেয়ার রোডের পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাটে উঠে এলাম। এবারে ধোবিও মাসে মাসে তার কাপড় ধোলাইয়ের পয়সা পেতে শুরু করল।
আমার অবস্থা আগের তুলনায় ভালো হয়েছে দেখে খুশি হওয়ায় ধোবি আমার বিবিকে বলল, ‘বেগম সাব! সাহেবের ভাই সায়েদ শালিম বালিষ্টার খুব বড় আদমি। ইধর কোলাবা মেঁ রহতা হোতা! যব গয়্যা তো হম কো এক পাগড়ি, এক ধোতি, এক কুর্তা দিয়া হোতা... তুমহারা সাব ভি এক দিন বড়া আদমি বনতা হোতা!’
বিবিকে সেই ছবির কিস্সাটা শুনিয়ে রেখেছিলাম। তাকে এও বলেছিলাম যে টানাটানির সময় ধোবির দরাজ দিল আমাকে কতটা সাহায্য করেছিল। যখন দিয়েছি, যাই দিয়েছি – তার কোনও নালিশ ছিল না। কিন্তু বিবির আমার কিছুদিনের মধ্যেই ধোবির বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরি হল যে সে হিসেব রাখে না। আমি বললাম, ‘চার বছর ধরে আমার কাজ করছে। সে কখনও হিসেব রাখেনি।’
জবাব পেলাম, ‘হিসেব কেন রাখতে যাবে? এমনিতেই দ্বিগুণ-চারগুণ উসুল করে নিচ্ছে হয়ত।’
‘সেটা কীভাবে?'
‘আপনি জানে না। যাদের ঘরে বিবি থাকে না, এই সব লোক তাদের বেকুব বানিয়ে রাখে।'
প্রায় মাসেই ধোবির সঙ্গে আমার বিবির খটাখটি লাগত। বিবির নালিশ ধোপা কেন কাপড়ের হিসেব আলাদা করে তার নিজের কাছে রাখে না। ধোবি তার স্বাভাবিক সারল্যে উত্তর দিত: ‘বেগম সাব, হম হিসাব জানত নাহেঁ! তুম ঝুট নাহেঁ বোলেগা। সায়েদ শালিম বালিষ্টার ... যো তুমহারে সাব কা ভাই হোতা... হম এক বরস উস্কা কাম কিয়া হোতা... বেগম সাব বোলতা ধোবি তুমহারা ইতনা পয়সা হুয়া... হম বোলতা ঠিক হ্যায়!'
কোনও এক মাসে আড়াই শো কাপড় ধুতে দেওয়া হয়েছিল। ধোবির সততা পরীক্ষা করে দেখার জন্য বিবি তাকে বলল, ‘ধোবি, এমাসে ষাটটা জামাকাপড় হয়েছে।'
সে বলল, ‘ঠিক আছে... বেগম সাব, তুম ঝুট নাহেঁ বোলেগা।'
আমার বিবি ষাটটা জামাকাপড় কাচার দাম হিসেব করে তার হাতে দিলে ধোপা সেটা মাথায় ছুঁইয়ে সালাম ঠুকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বিবি তাকে থামাল। ‘দাঁড়াও ধোবি, ষাট নয়, আড়াইশো কাপড় ছিল। এই বাকি টাকাটা নাও। আমি তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম।'
ধোবি শুধু বলল, ‘বেগম সাব, তুম ঝুট নাহেঁ বোলেগা!' বাকি টাকাটাও সে মাথায় ছুঁইয়ে বিবিকে সেলাম করে বেরিয়ে গেল।
শাদির দুবছর পর আমি দিল্লি চলে গেলাম। সেখানে দেড় বছর থেকে আবার বোম্বাই ফিরে মাহিমে থাকতে শুরু করলাম। তিন মাসের মধ্যে চার বার ধোবি বদলাতে হল – সব বড় বেইমান আর ঝগড়ুটে। কাপড় ধোলাইয়ের পর প্রত্যেকবার ঝগড়া লেগে যেত। কখনও কাপড় কম আসত, কখনওবা খুব খারাপ ধোলাই হত। আমার পুরোনো ধোবির কথা মনে পড়তে লাগল। এমনি একদিন যখন আমাদের ধোবি ছাড়াই চালাতে হচ্ছে, সেই পুরোনো ধোবি হঠাৎ উদয় হল। বলল, ‘সাব কে তো আমি একদিন বাসে করে যেতে দেখলাম। ভাবলাম এটা কী করে হল! সাব তো দিল্লি চলে গিয়েছিলেন।... আমি বাইকুল্লাতে জিজ্ঞেস করলাম। ছাপাওয়ালা বলল... ওদিকে মাহিমে খোঁজ করে দেখো। পাশেই সাবের বন্ধু থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করে চলে এলাম!’
আমরা খুব খুশি হলাম। আমাদের জামাকাপড়গুলোও খুশিতে দিন কাটাতে লাগল।
কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর শরাব নিষিদ্ধ হওয়ার আইন বলবৎ হল। বিদেশি মদ পাওয়া গেলেও দেশি শরাব তৈরি বা তার বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। নিরানব্বই শতাংশ ধোপা মদে আসক্ত। সারা দিন জলে কাজ করতে করতে সন্ধ্যায় পোয়া-আধপোয়া শরাব না হলে তাদের চলে না। ... আমাদের ধোবি অসুস্থ হয়ে পড়ল। ভালো হওয়ার জন্য সে সেই বিষাক্ত মদ খেল যা বেআইনিভাবে ঘরে তৈরি হয় আর লুকিয়ে-চুরিয়ে বিক্রি হয়। ফলে তার পেটের বিপজ্জনক রোগ হয়ে গেল – ধোবি বাঁচে কি না সেই সন্দেহ।
আমি অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম। ভোর ছটায় ঘর থেকে বেরোতাম। রাত দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরতাম। বিবি ধোবির সেই খারাপ রোগের কথা জানতে পেরে ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়ি চলে গেল। চাকর আর ড্রাইভারের সাহায্যে ধোবিকে গাড়িতে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। বিবির সহানুভূতি দেখে ডাক্তারও অনুপ্রাণিত হলেন। তিনি ফি নিতে না চাইলে আমার বিবি বললেন, ‘ডাক্তার সাব আপনি কি চান এর পুণ্যফল পুরোটাই আপনার ভাগে পড়ুক?'
ডাক্তার হেসে বললেন, ‘তা হলে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ হোক।' তিনি অর্ধেক ফি নিতে রাজি হলেন।
ধোবি সঠিক চিকিৎসায় সেরে উঠল। পেটের সমস্যা কয়েকটা ইঞ্জেকশনেই দূর হল। দুর্বলতা যা ছিল তাও শক্তিবর্ধক ওষুধ খেতে চলে গেল। কয়েক মাসের মধ্যেই সে একদম সুস্থ হয়ে উঠল। আর উঠতে-বসতে আমাদের জন্য প্রার্থনা করত। ভগবান যেন সাবকে সায়েদ শালিম বালিষ্টার বানায়। সাব যেন ওদিকে কোলাবায় গিয়ে থাকতে পারে। তার ছেলেমেয়ে হোক – অনেক পয়সা হোক। বেগম সাব ধোবিকে নিতে এসেছিলেন। মোটরে! ওদিকে কেল্লার কাছে সেই খুব বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন – যার সঙ্গে মেম থাকে। ভগবান যেন বেগম সাবকে খুশি রাখেন!
এরপরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনও হয়ে গেল। ধোবি নিয়মিত রবিবার আসত। তার স্বাস্থ্য এখন খুব ভালো। এতদিন পেরিয়ে গেলেও সে আমাদের ছাড়েনি। হামেশাই আমাদের ভালো চেয়ে প্রার্থনা করত। মদ একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিল। গোড়ার দিকে মাঝে মাঝে শরাবের কথা বললেও এখন আর তা মুখেও আনে না। সারা দিন জলে কাজ করার ক্লান্তি দূর করার জন্য এখন আর তার দারুর প্রয়োজন পড়ে না।
পরিস্থিতি বেশ খারাপ হয়ে উঠল। দেশ ভাগ-বাঁটোয়ারা হতেই গণ্ডগোল লেগে গেল। হিন্দুদের এলাকায় মুসলমানদের আর মুসলমানদের এলাকায় হিন্দুদের দিনের আলোয় বা রাতের অন্ধকারে হত্যা হতে লাগল। আমার বিবি লাহোরে চলে গেল।
অবস্থা যখন আরও অনেক খারাপ হল, তখন আমি একদিন ধোপাকে বললাম, ‘দেখো ধোবি এবার তুমি কাজ বন্ধ করে দাও। এটা মুসলমানদের মহল্লা – এমন না হয় যে কেউ তোমাকেই মেরে দিল।’
ধোবি হেসে বলল, ‘সাব, আপন কো কোই নহিঁ মারতা।’
আমাদের মহল্লাতেও বেশ কয়েকটা খুনের ঘটনা ঘটল। কিন্তু ধোবি নিয়মিত আসা বন্ধ করল না।
এক রবিবার আমি ঘরে বসে কাগজ পড়ছি। খেলার পাতায় ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর দেওয়া ছিল। আর প্রথম পাতায় ছিল দাঙ্গাহাঙ্গামার শিকার হিন্দু আর মুসলমানদের পরিসংখ্যান। আমি ওই দুই পরিসংখ্যানের মধ্যে ভয়ঙ্কর মিল নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ধোবি এসে পড়ল। নোটবইটা বার করে জামাকাপড়ের হিসেব-নিকেশ শুরু করতেই ধোবিও হাসতে হাসতে কথা শুরু করল। ‘সায়েদ শালিম বালিষ্টার বহত আচ্ছা আদমি হোতা – ইহাঁ সে যাতা তো হম কো এক পাগড়ি, এক ধোতি, এক কাপড়া দেতা হোতা।...তোমার বেগম সাবও খুব ভালো মানুষ। বাইরে কোনও কাজে বেরিয়েছে বুঝি? তার দেশে গেছে? তাকে কাগজ লিখলে আমার সালাম জানিও। মোটর নিয়ে এসেছিল আমার খুপরিতে। আমার সে কী পেট খারাপ... ! ডাক্তার ছুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল। একদম ভালো হয়ে গিয়েছিলাম। ওদিকে কাগজ লিখলে আমার সালাম জানাবে। বলবে রাম খিলাওন বলেছে – তাকেও চিঠি পাঠাতে!’
আমি তার কথা কেটে একটু জোরের সঙ্গেই বললাম, ‘ধোবি, দারু শুরু করে দিয়েছ?’
ধোবি হাসল, ‘দারু? মদ কোথায় পাব সাব?’
মনে হল আর কিছু বলা ঠিক হবে না। সে ময়লা কাপড়গুলোর গাঁঠরি বেঁধে আমাকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ল। লাহোর থেকে তারের পর তার আসছে – সব কিছু ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি এক শনিবার সিদ্ধান্ত নিলাম যে রবিবার চলে যাব। কিন্তু তা হলে আমাকে সাতসকালে বেরিয়ে পড়তে হবে। কাপড়জামা ধোবির কাছে আছে। ভাবলাম কারফিউ লাগার আগেই ওর ওখানে গিয়ে সেগুলো নিয়ে আসব। তাই সন্ধেবেলা ভিক্টোরিয়ায় চড়ে মহালক্ষ্মীর দিকে রওনা হলাম।
কারফিউ জারি হওয়ার আরও এক ঘণ্টা বাকি থাকায় যানবাহনের আসা-যাওয়া চলছিল। ট্রামও চলছিল। আমার ভিক্টোরিয়া পুলের কাছে পৌঁছোতেই খুব হইহল্লা লেগে গেল। লোকে যে যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন ষাঁড়ের লড়াই চলছে। ভিড় একটু পাতলা হলে দেখলাম দূরে মোষেদের পাশে অনেক ধোপা হাতে লাঠি নিয়ে নাচছে আর নানা রকম আওয়াজ করছে। আমার ওদিকেই যাবার ছিল, কিন্তু ভিক্টোরিয়ার চালক আরও এগোতে চাইল না। আমি তার ভাড়া মিটিয়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। ধোবিদের কাছাকাছি পৌঁছোলে তারা আমাকে দেখে চুপ করে গেল।
আমি আরও এগিয়ে এক ধোবিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাম খিলাওন কোথায় থাকে?’
আরেক ধোপা যার হাতে লাঠি ছিল, মাথা নাড়াতে নাড়াতে আমি যে ধোপাকে প্রশ্ন করেছিলাম তার পাশে এসে শুধোল, ‘কেয়া পুছত্ হ্যায়?’
‘জিজ্ঞেস করছে রাম খিলাওন কোথায় থাকে।‘
মদে চুর হয়ে থাকা লাঠিধারী ধোবি প্রায় আমার গায়ের কাছে এসে বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমি?... ..রাম খিলাওন আমার ধোবি।’
‘রাম খিলাওন তোর ধোবি? আরে তুই কোন্ ধোবির বাচ্চা?’
আরেক জন চেঁচাল – ‘হিন্দু ধোবির না মুসলমান ধোবির?’
এবারে নেশায় চুর হয়ে থাকা ধোপারা সকলে মুঠো ছুঁড়তে ছুঁড়তে আর লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে আমার আশপাশে এসে জড়ো হল। আমাকে তাদের একটা প্রশ্নেরই জবাব দিতে হবে – ‘মুসলমান না হিন্দু?’
আমি বড়ই ভয় পেয়ে গেলাম। পালানোর কোনও প্রশ্ন নেই কারণ তারা আমাকে ঘিরে রেখেছে। কাছাকাছি কোনও পুলিশও নেই যে সাহায্য চেয়ে ডাকব। আর কিছু যখন মাথায় এল না তখন অসংলগ্নভাবে তাদের সঙ্গে কথা শুরু করলাম – ‘রাম খিলাওন তো হিন্দু... আমি জিজ্ঞেস করছি সে কোন্ দিকে থাকে... তার খুপরিটা কোথায়... ..দশ বছর ধরে সে আমাদের ধোবি... খুব অসুস্থ হয়েছিল... আমরাই তার চিকিৎসা করিয়েছিলাম... আমার বেগম... আমার মেমসাহেব এখানে মোটরগাড়ি নিয়ে এসেছিলেন।' এইটুকু বলার পর আমার নিজের ওপরই করুণা হল। এই ভেবে মনে মনে লজ্জা পেলাম যে প্রাণ বাঁচানোর জন্য মানুষ কত নিচে নামতে পারে। এই অনুভূতি আমাকে সাহস জোগালো। আমি অবশেষে তাদের বলতে পারলাম, ‘আমি মুসলমান!'
‘মার ডালো – মার ডালো,' আওয়াজ ক্রমশ জোরদার হল। যে ধোবি মদের নেশায় চুর হয়ে ছিল, সে একদিকে দেখে নিয়ে চেঁচাল, ‘দাঁড়াও, একে রাম খিলাওন মারবে!'
আমি ঘুরে দেখলাম রাম খিলাওন একটা মোটা ডাণ্ডা হাতে নিয়ে নড়বড়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। সে আমার দিকে একবার তাকিয়েই মুসলমানদের তার নিজের ভাষায় গালি দিতে শুরু করল। ডাণ্ডাটা মাথার ওপর তুলে গালি দিতে দিতে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমি আদেশ করার ভঙ্গিতে চিৎকার করলাম, ‘রাম খিলাওন!'
রাম খিলাওনও বাজখাঁই গলায় চেঁচাল, ‘চুপ কর বে, রাম খিলাওন কে...'
আমার শেষ আশাও ডুবে গেল। যখন সে আমার কাছাকাছি চলে এসেছে তখন আমি শুকনো গলায় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে কি চিনতে পারছ না, রাম খিলাওন?'
মারার জন্য রাম খিলাওন ডাণ্ডা তুলল। তার চোখ একবার সরু একবার বড় হয়ে আবার সরু হল। ডাণ্ডা হাত থেকে ফেলে দিয়ে কাছে এসে গভীর মনোযোগে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাব!' তারপরে সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘এ মুসলমান নয় – এ আমার সাহেব – বেগম সাবের সাহেব – তিনি মোটর নিয়ে এসেছিলেন – ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন – যে ডাক্তার আমার ডায়েরিয়া সারিয়েছিলেন!'
সাথীদের অনেক বোঝালেও তারা রাম খিলাওনের কথা মানল না। সকলেই মদে চুর হয়ে ছিল। তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ ধোবি রাম খিলাওনের পক্ষ নিল – ঝগড়া ক্রমশ মারপিটে পর্যবসিত হল। আমি মওকা পেয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে ভেগে পড়লাম।
পরদিন সকাল নটার মধ্যে জিনিসপত্র সব গোছানো হয়ে গেল। শুধু জাহাজের টিকিটের অপেক্ষায় ছিলাম। এক বন্ধু ব্ল্যাক মার্কেটে টিকিটের খোঁজ করতে গিয়েছিল।
আমি ভীষণ অশান্তিতে ভুগছিলাম। মনের মধ্যে কত রকমের আবেগই যে বুদ্বুদের মত উঠছিল! চাইছিলাম টিকিটটা যাতে তাড়াতাড়ি এসে যায়, আর আমি বন্দরের উদ্দেশে বেড়িয়ে পড়তে পারি। খালি মনে হচ্ছিল দেরি হয়ে গেলে এই ফ্ল্যাটে সারা জীবন বন্দি থেকে যাব।
দরজায় কেউ ধাক্কা দিল। ভাবলাম বুঝি টিকিট এসে গেছে। দরজা খুলে দেখি বাইরে ধোবি দাঁড়িয়ে আছে।
‘সাব সালাম!'
‘সালাম!'
‘ভেতরে আসব?'
‘এসো!'
সে নিঃশব্দে ভেতরে এল। গাঁঠরি খুলে জামাকাপড় খাটের ওপর রাখল। ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন, সাব?'
‘হ্যাঁ।'
ধোবি কাঁদতে লাগল। ‘সাব, মুঝে মাফ কর দো। ইয়ে সব দারু কা কসুর থা।... আর দারু? দারু আজকাল মুফতে মেলে। শেঠ লোগ দারু বিলি করে বলছে খেয়েদেয়ে মুসলমানদের মারো। মুফত কি দারু কৌন ছোড়তা হ্যায় সাব? আমাকে মাফ করে দিন। আমি মদ খেয়েছিলাম। সায়েদ শালিম বালিষ্টার খুব দয়ালু মানুষ... হম কো এক পাগড়ি, এক ধোতি, এক কুর্তা দিয়া হোতা... .বেগম সাব আমার জান বাঁচিয়েছিলেন। না হলে ডায়েরিয়ায় আমি মরেই যেতাম। উনি মোটর নিয়ে এসেছিলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কত পয়সা খরচ করেছিলেন। আপনি দেশে যাচ্ছেন... .বেগম সাবকে খবরদার বলবেন না যে রাম খিলাওন... .'
ধোবির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। গাঁঠরির চাদরটা কাঁধের ওপর ফেলে সে চলতে শুরু করল। চলে যাচ্ছে দেখে আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করলাম। ‘দাঁড়াও, রাম খিলাওন!' কিন্তু সে ধুতির কোঁচা সামলে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল।