প্রচ্ছদের কাগজ থেকে শুরু করে মোটামুটি ১২০ পাতার কাগজ নিষ্ঠার কথা বলে। বিদগ্ধজন হয়তো মেপে জুপেই বলবেন: ১২০ জিএসএম এর কাগজ অর্থাৎ মোটা কাগজ। লেখিকা (না কি লেখক লিখবো?) সদ্য পঞ্চাশোর্ধ্ব গড়পড়তা বাঙালি, অথবা নগর-নন্দিনী: কলকাতারই। অন্ততঃ বইয়ের পরিচিতি তাই বলে। তিনি ঘুরেছেন বেশ, দেখেছেন বেশি; অনেক, ভেবেছেন অনেকটাই বেশি। কাহিনীগুচ্ছ তাই বলে।
শ্রীময়ী চক্রবর্তী যদিও লেখালেখি করছেন ৮/১০ বছর, এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তথ্যানুসন্ধানে জানা যাচ্ছে ফেসবুক এবং অন্য দু তিনটি বৈদ্যুতিন সমাজমাধ্যমে তাঁর পদক্ষেপ প্রাচীন না হলে ও নিতান্ত নবীনও নয়। বইটি হাতে নিয়ে তাই খানিকটা deja vu-র অনুভূতি হল।
কুড়িটি গল্পের প্রতিটিরই দৈর্ঘ্য মোটামুটি চার থেকে আট পৃষ্ঠার মধ্যে। বেশিরভাগই শেষ ৫/৬ বা ৭ এ। কিন্তু ছোটগল্পের প্রথাগত সংজ্ঞানুযায়ী, এক: তারা শেষ হয়ে হইলো না শেষ! দুই: তাদের অধিকাংশের মধ্যেই একটি আকস্মিক, বা অপ্রত্যাশিত মোচড় আছে, যা পাঠককে সময় সময় চমকে দেয়, সময় সময় সামনে টেনে নিয়ে যায়; তাই গল্প সমাপ্তির পরে স্নিগ্ধ একটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
লেখার শৈলী একেবারেই লেখিকার নিজস্ব। যদি বা গল্পের মূল কাঠামো নির্মাণে বন্দ্যো শরদিন্দু বা রায়সাহেব সত্যজিৎ শ্রীময়ী-কে প্রভাবিত করেও থাকেন সেটা অণু পরমাণুতে এমন ভাবে মিশে গিয়েছে, যে রবীন্দ্রনাথের রাগাশ্রয়ী গানের মতো কখনোই রাগ-রূপটিকে প্রধান হয়ে উঠতে দেয়নি; অথচ, নিজস্ব এক ধারার জন্ম দিয়েছে।
বৃহত্তর পাঠকসমাজের জন্য সমালোচনা বা সম্যক আলোচনা যদি করতেই হয় - তাহলে কিছুটা বিশদ্ বিশ্লেষণে যেতেই হয়। গল্পগুলির কট্টর শ্রেণীবিভাগ সম্ভব নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। মূল সুর বা genre-অনুযায়ী আলাদা করা যায় এমনভাবে: পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক, রহস্যমূলক, ভৌতিক এবং সাম্প্রতিক বা সামাজিক। সীমারেখারা প্রায়ই নির্দিষ্ট নয় - বরং জলরঙে আঁকা ছবির মত কিছুটা লেপটে লেপটে আছে; যদিও অতীব উপভোগ্য সেই অস্পষ্ট সীমারেখা।। অধিকাংশ কহিনীতেই যে সুর প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত সেটা এক চিরন্তনী নারীসত্তার। বইয়ের মুখবন্ধটিতে শ্রীময়ীর নিরাভরণ আত্মকথনেও যা পরিস্ফুট।
এই নারী কখনও বিরহিণী বিভা, যার স্বামী এগারো বছর ধরে নিরুদ্দেশ এবং শাস্ত্রবিধি অনুসারে দ্বাদশবর্ষ পরে সেই ব্যক্তির শ্রাদ্ধকর্ম সাঙ্গ হলে যে বিধবা বলে গণ্য হবে। কাহিনীটির (বারো বছর) শেষাংশে যে টুইস্ট বা মোচড় আছে, এক অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ প্রত্যাশিত সত্যোদঘাটনের মধ্যে দিয়ে, সে'টি গল্পটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। সেই অনুভূতি দুঃখের না কি আনন্দের, না কি এক করুণ বিস্ময়ের - তা সম্পূর্ণই পাঠকের বিবেচ্য।
কোনও নির্দিষ্ট ক্রম অনুসরণ না করেই লোভ হচ্ছে সঙ্কলনের দুটি মধুর রসের কাহিনীর কথা বলতে। এ দুটির মধ্যে ‘ সন্ধ্যামালতী’ বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি করে। উপজীব্য অবশ্যই প্রেম, পরিপ্রেক্ষিত সাম্প্রতিক হতেও কোন বাধা নেই। পাত্র-পাত্রীর নির্বাচন আদৌ গতানুগতিক নয়। গার্লস হোস্টেলের প্রেক্ষাপটে রচিত এই গল্পটি পরিশীলিত হাস্যরসের রঙে উজ্জ্বল।
এই প্রেক্ষিতে অব্যবহিত পরেই নাম করতে হয় ‘অপূর্ব প্রেম’ গল্পটির কথা। এই গল্পে প্রেম তো আছেই; অবশ্যই! কিন্তু দাম্পত্য বন্ধনের আকর্ষণ কী করে জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে এক সুখী সংসারে অনুপ্রবেশ করে এক বিরল মধুর সমস্যার সৃষ্টি করে- সেটা না পড়লে বোঝা যাবে না, আন্দাজ করাও কঠিন।
পরের যে গল্পটি বিশেষত্বের উল্লেখ/ দাবি করে, সেটিকে সামাজিক আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটাতে নায়ক নায়িকার ভূমিকা বোধহয় গৌণই। ‘অন্য পৃথিবী’ নামের এই আখ্যানটি হঠাৎ হলেও মনে করিয়ে দেয় ‘ না-মানুষী বিশ্বকোষের কথা’। প্রভাত মুখো:র ‘আদরিনী’ বা শরৎ চট্টো:র ‘মহেশ’, বা সুকুমার দে সরকারের কিছু নির্বাচিত গল্পে আমরা প্রাণিজগতের বৃহত্তর অধিবাসী কারো কারোকে পাই। কিন্তু এই অন্য পৃথিবী একেবারেই অন্য প্রাণীজগৎ। আংশিক ঘৃণা বা বিবমিষার জন্ম দিয়ে গল্পটি শেষ হয় কাঙ্ক্ষিত-কিন্তু-অপ্রত্যাশিত এক পরিণতিতে।
‘পুনর্জন্ম’, ‘হতভাগী’, ‘বেহুলা’ - তিন তিনটি গল্পে বেদেদের উল্লেখ পাই দেখে মনে হচ্ছে বেদে সম্পর্কে লেখিকার খানিকটা আলাদা আগ্রহ এবং কিছুটা গবেষণাও রয়েছে। এই তিনটির মধ্যে ‘বেহুলা’ কাহিনীটি প্রচলিত লখিন্দর-বেহুলা বা মনসামঙ্গলের কাহিনীর পুনর্নির্মাণ- কিন্তু অবশ্যই শ্রীময়ীর আপন মনের মাধুরী মিশায়ে।
তাঁর নারী কেন্দ্রিক কল্পনা বাকি দুটি গল্পকেও প্রত্যাশিত পথেই শেষ করেছে।
‘বিঞ্জলী’ গল্পটির মধ্যে অন্য এক সভ্যতার সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার সূত্র গাঁথা হয়েছে। অরণ্যের দিনরাত্রি হয়তো ফিরে আসেনি কিন্তু বিস্মৃত বা প্রতিহত প্রেমের স্পর্শ মনে করিয়ে দিল মধ্য কৈশোরে পড়া বিভূতিভূষণের ‘মেঘমল্লার’ গল্পটির কথা। সেখানে পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রদ্যুম্ন, আর এখানে বিরহিণী নায়িকা তার প্রত্যাখ্যাত প্রেমের স্মৃতি নিয়ে নীরবে বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।
‘জংলী জামাই’ আখ্যানে শহরের প্রাণচঞ্চল মেয়ে ধিঙ্গির বিবাহোত্তর জীবনের অভিজ্ঞতা নানা রঙে আকর্ষণীয়। এখানেও এক অদ্ভুত মোড় নেয় কাহিনীটি তার স্বামীর অনন্য এক ক্ষমতায়।
‘ভোকাট্টা’ তুলনামূলকভাবে একটু দুর্বল। তমালীদির সাথে অন্তুর প্লেটোনিক প্রেম কোনও পরিণতি না পেলেও সফল চিত্রতারকা অনিরুদ্ধর জীবনে রেখে যায় এক অনপনেয় স্মৃতিগহ্বর।
‘ভীরু’ এবং ‘দ্বিধা’ গল্পদুটিতে রাজনৈতিক যেটুকু রঙ আছে তা দুটিকেই অন্য মর্যাদা দিয়েছে। মানবিক সমস্যার যে স্পর্শ আছে দুটি গল্পেই , তা পাঠক মাত্রকেই নাড়া দিয়ে যায়।
পরিশেষে কিছু অপ্রিয় সত্যের উল্লেখ না করলে সম্ভবত: সমালোচকের ভূমিকার প্রতি অবিচার করা হবে।
যতিচিহ্ন ব্যবহারে লেখিকার কিঞ্চিৎ কার্পণ্য গ্রন্থ-পাঠকে অল্প হলেও ব্যাহত করেছে।
বইটিতে মুদ্রণ প্রমাদ গ্রহণযোগ্যতার কিঞ্চিদধিক সংখ্যায় হবার কারণে মনঃক্ষুণ্ণতার কারণ ঘটেছে।
কিছু কিছু শব্দ-বন্ধও অপরিচিত ঠেকেছে- তাদের সম্পর্কে লেখিকা বা মুদ্রকের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই যায়; যেমন ‘হালকা সূচি’, ‘বিদ্যুতের শব্দ’, ‘রোদ হাওয়ার মত বেড়ে ওঠা’, ‘মজা মারা’ ইত্যাদি। এহ বাহ্য! র/ড় এবং ন/ণ- এর ব্যবহার সম্পর্কেও আরও সচেতনতা কাম্য ছিল।
এত সুন্দর যে গ্রন্থের বহির্সজ্জা, যার অন্দরমহলের জৌলুসও চরম আকর্ষণীয়- প্রথম প্রকাশের অবকাশে তাদের প্রতি আর একটু যত্ন প্রত্যাশিত ছিল।
তবে উপসংহারে এ’কথা বলতেই হবে, যে বানান, মুদ্রণ-প্রমাদ, যতিচিহ্নের শৈথিল্য- এ সব কিছুর জলীয় বাষ্প কিন্তু ফুলঝুরির ঔজ্জ্বল্য হ্রাস করতে পারেনি।
শ্রীময়ীর কলম থেকে আমরা পরের সঙ্কলনের প্রতীক্ষায় রইলাম।।