• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গল্প
    Share
  • পোজ্‌ پوز : আনোয়ার খান
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়



    আনোয়ার খানের (১৯৪২ - ২০০১) জন্ম বোম্বেতে। উর্দু আর ফারসিতে ডবল এম.এ. নিয়ে তিনি বোম্বে পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি জীবন শুরু করেন। তাঁর লেখা ছোট গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ, যার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনি গদ্যসাহিত্য রচনা করে চলেন। এই শতাব্দের দ্বিতীয় বছরটিতে অকালমৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর চারটি ছোট গল্পের সংকলন আর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। আনোয়ারের গল্পে উঠে এসেছে নিজের শহরের চলমান জীবনের বিচিত্র সব চিত্র – বিশেষত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবন এবং উপসংস্কৃতির ছবি। শহুরে জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষক হিসেবে এই কথাসাহিত্যিকের রচনা সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছে।

    অনূদিত গল্পটি তখ্‌লিককার পাবলিকেশনস্‌, দিল্লি থেকে ১৯৯০-এ প্রকাশিত লেখকের ‘ইয়াদ বসেরে’ শীর্ষক গল্প সংকলন থেকে সংগৃহীত।........অনুবাদক

    চলতে চলতে কী যে পাগলামি তার মাথায় চড়ে বসল! শানদার ক্লথ স্টোর্স-এ ঢুকে পড়ে শোকেসের দরজা খুলে তার মধ্যে রাখা প্লাস্টিকের সুন্দর মডেলটিকে সরিয়ে সে নিজেই ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল অনুরূপ ভঙ্গিমায়।

    সন্ধ্যেবেলা। রাস্তায় ভিড় খুব, কিন্তু সকলেই নিজের নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে হেঁটে চলেছিল বলেই বোধহয় সে যে এক্ষুনি কী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসল তা সকলের নজর এড়িয়ে গেল।

    কেন এটা করল? হয়ত ঘটনাটা ঘটানোর সময় প্রশ্ন করলে সে নিজেই এর উত্তর দিতে পারত না। ছোটবেলায় এ ধরনের দুঃসাহসিক কাজ অনেক করলেও এখন তো সে ভদ্র-সভ্য এক কলেজ স্টুডেন্ট যার সঙ্গে কথা বলতে কলেজের ছেলেরাও ভয় পায়। সে একটু আগে যা করে ফেলল, তা হঠাৎই হয়ে গেল।

    শোকেসে দাঁড়িয়ে কিন্তু বেশ স্বস্তি হল। এখন তো সে বাস্তবিকই সেই ব্যস্তসমস্ত বাজারের একটা অংশ! এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গোটা বাজারটাকেই দেখতে পাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে নানারকম কেনাকাটা করার সময় কখনও মনে হয়নি যে আশপাশের এই ভরপুর প্রাণোচ্ছল আর ঝকমকে জীবনের অংশ সেও। শরীরটা এতক্ষণ যে চাপ অনুভব করছিল তা কমতে কমতে প্রায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ উছলে ওঠা হাসির আভাস ফুটল মুখে। একটা পা একটু আগে বাড়িয়ে শাড়ির আঁচলটাকে মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ডান কনুইয়ের কাছে জড়িয়ে বেশ একটু মনোমোহিনী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে তার নিজেরই ভালো লাগছিল। এইভাবে তো সারা জীবনই দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তাৎক্ষণিক আনন্দে এটা ভাবল বটে, তবে হাঁটুদুটো যেন এর মধ্যেই ব্যথা ব্যথা করছে।

    পা দুটোকে আরাম দেওয়ার কথা যখন ভাবছে ঠিক সেই সময় এক দেহাতি ভিড় থেকে ছিটকে আলাদা হয়ে শোকেসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। লোলুপ আর বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে লোকটা তাকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখে চলেছে। তার চোখ যেন বলছে যে এই কারিগরও কামাল করেছে! এমন মূর্তি বানিয়েছে যেন একেবারে আসল মানুষ!

    তাদের মধ্যে কাচের দেওয়াল একটা ছিল ভাগ্যিস! না হলে এই গোঁয়ারটা নিশ্চয়ই তাকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করত।

    দেহাতি লোকটির ইচ্ছে হয়ত ছিল আরেকটু দাঁড়ানোর, কিন্তু আশপাশের পথচারীদের তীব্র চাহনির উত্তাপ বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পরে সে কেটে পড়ল। দেহাতি সরে যেতেই সে পা দুটোকে একটু ঢিলে দিল। তাদের একবার একটু নাড়ালোও বোধহয়। কিন্তু এবারে ঠোঁটটা যেন শুকিয়ে আসছে। কে জানে কেন। ‘আরেকটু সময়’ – সে শ্বাস চেপে রেখে ঠোঁট দুটোকে বলল। ‘তারপরে আমরা খুব জলদি কোনও হোটেলে গিয়ে জল আর চা সহযোগে তোমাদের আপ্যায়ন করব!’ তেষ্টার অনুভূতিটা একটু কমতেই সে আবার তার আগের পোজ্‌ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও ইচ্ছে আসলে ছিল না। এরকম একটা চিন্তাও তার মনে কখনও আসেনি। সে শুধু এই কথা ভেবেই খুশি যে এখন চারপাশের জীবনটা সম্পূর্ণভাবে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এমন এক অনুভূতি যা এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি।

    ‘ও গড!’ দুই কলেজ ছাত্রী হঠাৎ তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। ‘হাউ লাইফ লাইক!’

    মেয়েদের কণ্ঠস্বর কাচের প্যানেল আর তার চারধারের লোহার পাতের ফুটোর মধ্যে দিয়ে খুবই অস্পষ্টভাবে তার কানে পৌঁছোল। যেন আওয়াজটা অনেক দূর থেকে আসছে।

    মেয়েদুটো কিছুক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারা নিজেদের মধ্যে কত কথাই যে বলে গেল! আর সে সেই রকম মিষ্টি ভালোবাসার চাউনি নিয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। সে খুশি। খুব খুশি। এইভাবে এর আগে কেউ তাকে দেখেনি, অন্তত তার সামনে দাঁড়িয়ে তো নয়ই। সে কোনও সৌভাগ্যবতী রানির মত সেখানে দাঁড়িয়ে – যেন প্রজাদের তোষামোদি দৃষ্টি উপভোগ করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না কলেজের মেয়েদুটো আবার ভিড়ের মধ্যে মিশে নজরের বাইরে চলে গেল।

    ‘এবারে কার আসার পালা?’ সে ভাবে।

    পা দুটো আবার যেন নালিশ জানাচ্ছে। তবে এবারে সে তাদের কাছে কঠোর সতর্কবার্তা পাঠাল: ‘কমবখ্‌ত, সিধে খাড়ে রহো! তোমাদের কি একটুই ধৈর্য নেই?’ এবার আর তাদের নালিশে কান দেবে না বলে সে সিদ্ধান্ত নিল।

    নিজের এই সিদ্ধান্তে স্বস্তি পেয়ে সে দেখল যে এক সেপাই ভিড় থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে ডিবে থেকে খৈনি বার করে হাতের তেলোয় নিয়ে আঙুল দিয়ে ডলছে। সেপাইয়ের চোখ হঠাৎ তার দিকে পড়তেই খৈনি ডলা আঙুলগুলো থেমে গেল, মুখটা খোলাই রয়ে গেল আর বিস্ফারিত চোখে হাঁ করে সেপাইটা তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে খুব মিষ্টি করে সেপাইয়ের দিকে তাকাতেই সেপাই ঘন ঘন চোখ পিট পিট করতে করতে আরও জোরে খৈনি ডলতে শুরু করল। তারপরে নিচের ঠোঁট আর দাঁতের মধ্যে খৈনিটা গুঁজে দিয়ে শোকেসের কাচে চোখ দুটো প্রায় চেপে ধরে আর কী!

    খুব হাসি পেলেও অনেক কষ্টে সে হাসি চেপে রাখল। পা দুটো ভীষণ চুলকোচ্ছে। না চাইলেও শরীরটা একটু যেন কেঁপে উঠল। সেটা সেপাইয়ের চোখে পড়লেও সে হয়ত ভাবল যে ওটা তার দেখার ভুল অথবা খৈনির নেশার ফল।

    সেপাই অনেকক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকে নিরীক্ষণ করে চলল। ঘোরাফেরা করতে করতেই লোকটা বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। এটা এতক্ষণ ধরে চলতে থাকল যে ক্লান্তি এসে গেল। মানুষটা এখান থেকে যাবে তো, নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? তার পক্ষেও অনেকক্ষণ একই পোজ্‌-এ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ছিল। তবে সে যে শোকেসের মধ্যে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে এ ব্যাপারটা অবশ্যই স্বস্তির।

    শেষ পর্যন্ত তো খুদা খুদা করতে করতে সেপাইটা সেখান থেকে হঠে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। হাত আর পা দুটোকে একটু মুক্তি দেওয়া গেল। কোমর সোজা হল। দুহাতে কোমর মালিশ করে আরামও মিলল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। লোকের ভিড়ও কমে আসছিল। শুধু এক-আধজন দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরছে। খুব তাড়াতাড়িই অন্ধকার হয়ে যাবে। তার আগেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। স্টোরেও হয়ত এখন ভিড় কমে গেছে। সে বাইরে বেরোনোর সময় কেউ দেখে ফেলতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু শোকেসের ভেতরে কী আরামই যে ছিল, কী ভালোই না লাগছিল! আর দশ মিনিট!

    এই সব চিন্তাভাবনা করতে করতে হঠাৎই নজরে এল তার সহেলি শ্যামা ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছে। শ্যামাকে দেখেই সে দ্রুত তার আগের পোজ্‌ নিয়ে নিল। নিঃশ্বাসটা বোধহয় বন্ধই হয়ে এসেছিল! অন্যমনস্কভাবে একবার তার দিকে তাকালেও শ্যামার মন তখন হয়ত আর কোথাও ছিল। তাই সেই বিপজ্জনক মুহূর্তটাও পেরিয়ে আসা গেল। এই চিন্তা এর আগে তার মনে আসেনি যে পরিচিত কেউ তাকে এখানে দেখে ফেলতে পারে। দাদাও তো এই সময় অফিস থেকে ফেরে। তার তো আবার হার্টের অসুখ। যদি দেখতে পায় যে ঘরের ইজ্জত এইভাবে বাজারে-হাটে ধুলোয় লুটোচ্ছে, তা হলে তো সে মরেই যাবে!

    স্কুল-ফেরত দুটো বাচ্চা এবার তার ফোকাসের মধ্যে ধরা পড়ল। স্কুলের ব্যাগগুলো পিঠের সঙ্গে সাপটে লেগে আছে। বাচ্চারা খুব আগ্রহের সঙ্গে তাকে দেখেই চোখ-কান-মুখ শোকেসের কাচের জানলায় চেপে ধরল।

    ‘আরে, একদম আসল, দেখ,’ একটা বাচ্চার কথা খুব ক্ষীণভাবে তার কানে পৌঁছোল। কথাটা শুনে আবার হাসি পেল।

    ‘এটা প্লাস্টিকের – এই বুদ্ধু!’ দ্বিতীয় ছেলেটা বলল। ‘আসল মডেল কোথাও রাখে নাকি?’

    ‘কিন্তু ইয়ার, দেখে তো একদম আসল বলেই মনে হচ্ছে। এই যেন কথা বলে উঠল বলে!’

    ‘সন্ধ্যে বলেই অমন লাগছে।’ অন্য ছেলেটা বলল। ‘আলো থাকলে এখনই মালুম হয়ে যেত।’

    ‘হ্যালো,’ বাচ্চারা তার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল।

    দ্বিতীয় ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর সেও তার দিকে হাত নেড়ে ‘টা-টা’ বলে দুজনেই তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

    ছেলেদুটো চলে যেতেই সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপরে হঠাৎই নার্ভাস হয়ে গেল।

    কাচের বাইরে এক নওজোয়ান বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি মিলতেই যুবক হেসে ফেলল। নিজের নার্ভাস ভাব লুকোনোর জন্য সেও হেসে দিল। তারপরে তাড়াতাড়ি মডেলটাকে উঠিয়ে তার জায়গায় দাঁড় করিয়ে পোজ়িশনটা ঠিক করে দিল। এমন ভাব যেন সে স্টোরেই চাকরি করে।

    যুবক তখনও তাকে দেখে চলেছে।

    মডেলের শাড়ির ভাঁজ ঠিক করতে করতেই সে আড়চোখে যুবকের দিকে চাইল। উদ্দেশ্য যুবক ঠিক কাকে দেখছে তা বোঝা! যুবকের নজর প্লাস্টিকের মূর্তির ওপর কয়েক লহমার জন্য আটকে গেলেও পর মুহূর্তেই তা লাফিয়ে তার ওপরে পড়ে যেন জমে গেল।

    সে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পিছু হটে শোকেসের দরজা খুলে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল।

    স্টোরের কোনও কর্মী তাকে দেখেনি। আর যদি দেখেও থাকে, তাহলেও সে এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছিল যে তারা হয়ত কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। দরোয়ানের মনোযোগ তখন অন্যদিকে। সে কোনও সেলস্‌ম্যানের সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত।

    সে গটমট করে দ্রুত অথচ হালকা পায়ে হেটে চলল। খুব খুশি খুশি লাগছে। শরীর আর মনের সমস্ত বোঝা যেন হালকা হয়ে গেছে। বেশ অনেকটা যাওয়ার পরে সে ঘুরে পেছনের দিকে তাকাল। নওজোয়ান তখনও তাকে দেখছে – হয়ত অবাক হয়েই।

    সে দ্রুত মোড় ঘুরে অন্য রাস্তা ধরল।



    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments