• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গল্প
    Share
  • শহিদের রূপকার شہید ساز : সাদাত হাসান মান্টো
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়




    দেশভাগের পরে লেখা ‘শহিদশাজ়’-এ পাওয়া যাবে যে দেশকে মান্টো আপন করে নিয়েছিলেন, সেখানকার নৈতিক আর সামাজিক দ্বিচারিতার কলঙ্কের প্রখর উদ্‌ঘাটন। ইসলাম ধর্মে শহিদ হওয়ার যে উচ্চ আদর্শ, তাকে ঘিরে সাদাত হাসান মান্টো বুনেছেন তমসাচ্ছন্ন, বিদ্রূপাত্মক এক কাহিনি।


    মূল উর্দু গল্পটি নেওয়া হয়েছে দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত ‘কুল্লিয়াত-এ-মান্টো (মান্টো কে আফসানে)’-র দ্বিতীয় খণ্ড (পৃ ১৩১৪ – ১৩১৯) থেকে।


    আমি গুজরাতের কাথিয়াওয়াড়ের বাসিন্দা। জাতে বেনে। গত বছর যখন হিন্দুস্থান ভাগাভাগি নিয়ে টান্‌টা শুরু হল, তখন আমি একদম বেকার। মাফ করবেন। আমি টান্‌টা শব্দটা ব্যবহার করলাম। কিন্তু তাতে ক্ষতিই বা কী? উর্দু ভাষায় বাইরের শব্দ তো আসাই উচিত, তা গুজরাতি থেকে ধার করা হলেও।


    জি হাঁ, আমি একেবারে বেকার ছিলাম। তবে কোকেনের ছোটখাটো কারবার চালাতাম। কিছু আমদানি হয়েই যেত। যখন ভাগ-বাঁটোয়ারা হল আর হাজার হাজার মানুষ এদিক থেকে ওদিক আর ওদিক থেকে এদিকে আসা-যাওয়া শুরু করল, তখন ভাবলাম ‘চলো, পাকিস্তান চলেঁ’। কোকেন না হোক অন্য কোনও কারবার শুরু করে দেওয়া যাবে। তাই রওনা হয়ে রাস্তায় ছোটখাটো ধান্দা করতে করতে পাকিস্তানে পৌঁছে গেলাম।


    আমি তো এই ভেবেই এসেছিলাম যে কোনও বড়সড় ব্যবসা শুরু করব। পাকিস্তানে পৌঁছেই এখানকার পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা চালালাম। আর অ্যালটমেণ্টের কাজকর্ম শুরু করে দিলাম। তেল মারতে ভালোই পারতাম। তোষামোদ আর আমড়াগাছি করে, দু-একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ছোটখাটো একটা বাড়ি আমার নামে অ্যালট করিয়ে নিলাম। সে বাড়ি বেচে প্রচুর মুনাফা হওয়ায় বিভিন্ন শহরে ঘোরাঘুরি করে বাড়ি আর দোকান অ্যালটের ধান্দা শুরু করে দিলাম।


    যে কাজই হোক না কেন মানুষকে খাটতে হয়। অ্যালটমেণ্টের জন্য আমাকেও অনেক দৌড়োদৌড়ি করতে হত। কারও খোশামোদ, কারও সঙ্গে মিঠে বা গরম বুলি, কাউকে খানাপিনার দাওয়াত দেওয়া, আবার কাউকে নাচাগানার আসরে নিয়ে যাওয়া। মোট কথা, অসংখ্য ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পোহাতে হত। দিনভর শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়ে এমন একটা বড়সড় বাড়ির খোঁজ করতাম যেটা অ্যালট করাতে পারলে বেশি মুনাফা হবে। পরিশ্রম কখনও বৃথা যায় না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই লাখ টাকার মালিক হলাম। এখন তো খোদার কৃপায় আমার সবই আছে। থাকার জন্য দারুণ কুঠিবাড়ি, ব্যাংকে অগুনতি মাল-পানি... মাফ করবেন। আমি কাথিয়াওয়াড়ের রোজকার ভাষা ব্যবহার করে ফেললাম। তবে ক্ষতি নেই। উর্দু ভাষায় বাইরের শব্দের ব্যবহার হওয়াই উচিত।


    জি হাঁ, আল্লাহ্‌র দেওয়া সবই ছিল। সুন্দর বাড়ি, নোকর-চাকর, প্যাকার্ড মোটরগাড়ি, ব্যাংকে আড়াই লাখ টাকা। এছাড়াও আলাদা কতগুলো কারখানা আর দোকান। এসবই ছিল। তবুও, জানি না আমার মনের শান্তিটা যেন কোথাও উড়ে চলে গিয়েছিল। কোকেনের ব্যবসা করার সময়ও মাঝে মাঝে মানসিক চাপে পড়তাম। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে মন বলে আমার কিছুই নেই। বা বলতে পারেন চাপের বোঝা এমনই এসে পড়েছিল যে হৃদয় তার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই বোঝাটা কীসের?


    আমি বুদ্ধিমান মানুষ। মনে কোনও প্রশ্ন এলে তার জবাব খুঁজে বার করবই। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা শুরু করলাম যে এই গড়বড় ঘোটালার কারণটা কী?


    কোনও মহিলা? হতে পারে। আমার নিজের বলে তো কেউ ছিল না। যে ছিল তাকে গুজরাতের কাথিয়াওয়াড়েই আল্লাহ্‌ নিজের কাছে ডেকে নিলেন। কিন্তু অন্য মহিলা -- অন্যদের বউরা তো ছিল। যেমন আমার মালির বউই ছিল। প্রত্যেকের নিজস্ব টেস্ট আছে। সত্যি যদি বলেন, তাহলে আওরত জোয়ান হওয়া চাই। পড়াশুনো অথবা ডান্স জানতেই হবে এমন কথা নেই। আপন কো তো সারি জোয়ান আওরতেঁ চলতি হ্যাঁয় (কাথিয়াওয়াড়. গুজরাতের প্রবাদ, উর্দুতে যার ভালো প্রতিরূপ কিছু নেই)।


    আমার বুদ্ধি তো আছে! তেমন কোনও বিষয় সামনে এলে তার মূলে পৌঁছোনোর চেষ্টা করি। কারখানাগুলো চলছিল। দোকানগুলোও তাই। টাকা যেন নিজেই কামাই হয়ে এসে যাচ্ছিল। আমি এই সব থেকে দূরে গিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। আর শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে আমার মনের গড়বড় হওয়ার কারণ হল জীবনে ভালো কাজ কিছু করিনি।


    কাথিয়াওয়াড়, গুজরাতে তো অনেকই ভালো কাজ করেছিলাম। যেমন যখন আমার বন্ধু পাণ্ডুরঙ্গ মরে গেল, তখন তার রাঁড়টাকে নিজের ঘরে এনে রেখেছিলাম। আর দুবছর তাকে অন্য কোনও ধান্দা করতে দিইনি। বিনায়কের কাঠের পা যখন ভেঙে গিয়েছিল, তখন নতুন কিনে দিয়েছিলাম। প্রায় চল্লিশটা টাকা খরচ হয়েছিল। আর যখন যমুনা বাইয়ের যৌন রোগ হল (শালীটাকে মাফ করবেন), তখন সে তো কিছু বোঝেইনি যে তার কী হয়েছে! আমিই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। ছমাস ধরে তার চিকিৎসা করিয়েছিলাম। ...কিন্তু পাকিস্তানে এসে ভালো কাজ কিছুই করিনি। আমার দিল গড়বড়ের কারণ সেটাই -- না হলে বাকি সব কিছু ঠিক চলছিল।


    ভাবলাম কী করা যায়? দান-খয়রাতের কথা মাথায় এল। কিন্তু একদিন শহর ঘুরে বুঝলাম যে প্রায় সবাই ভিখিরি। কেউ ভুখা, কেউবা নাঙ্গা! কার পেট ভরাব? কার লজ্জা ঢাকব? চিন্তা করলাম -- একটা লঙ্গরখানাই নাহয় খুলে দিই। কিন্তু একটা লঙ্গরখানায় আর কীই বা হবে? চাল-গমই বা আনব কোত্থেকে? ব্ল্যাক মার্কেট থেকে কেনার কথা ভাবলেও মনে হল এক দিকে পাপ করে অন্য দিকে পুণ্য করেই বা কী হবে?


    ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনতাম। সত্যি কথা বলতে কি সকলেই তো দুখী! যারা রাস্তার পাশে দোকানদারের তক্তার ওপর শোয় তারাও যেমন দুখী, যারা উঁচু হাভেলিতে রাত কাটায় তারাও তেমনি। যারা পায়ে হাঁটে তাদের দুঃখ কাজ চালানো যায় এমন একটা জুতো নেই। যারা মোটরে সওয়ার তাদের দুঃখ নতুন মডেলের গাড়ি নেই। নিজের নিজের জায়গায় সকলেই ঠিক – তাদের নালিশের কারণ আছে। প্রত্যেকের প্রয়োজনের পেছনেই যুক্তি আছে।


    শোলাপুরের আমিনা বাই চিতলেকরের গলায় – আল্লাহ্‌ তাঁকে কৃপা করুন – গালিবের একটা গজ়ল শুনেছিলাম। একটা শের মনে থেকে গেছে: কিস্‌ কি হাজর রওয়া করে কোই (কার প্রয়োজন মেটাব?) – মাফ করবেন, এটা শেরের দ্বিতীয়... বা হয়ত প্রথম লাইনও হতে পারে।


    জি হাঁ, আমি কার প্রয়োজন মেটাই যখন একশোর মধ্যে একশো জনই অভাবী? এমনও ভাবলাম যে ভিক্ষে দেওয়া এমন কিছু ভালো কাজ নয়। হতে পারে আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন না। তবে আমি শরণার্থীদের ক্যাম্পে গিয়ে পরিস্থিতি ভালো ভাবেই যাচাই করেছি। দেখেছি যে দান-খয়রাতের পরিণামে অনেক শরণার্থীই একেবারে অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। সারা দিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকে। তাস খেলে, জগার চলতে থাকে (মাফ করবেন, জগার-এর মানে ওই জুয়া খেলা), গালি দিতে থাকে আর ফোকটে অর্থাৎ মুফতে পাওয়া রুটি ছিঁড়ে খায়! এ ধরনের মানুষরা পাকিস্তানকে মজবুত করতে কীভাবে সহায়ক হতে পারে? তাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে ভিক্ষে দেওয়া হারগিজ্‌ হারগিজ্‌ ঠিক কাজ নয়! তা হলে পুণ্যকর্মের জন্য আর কোন্‌ রাস্তা ধরা যায়?


    ক্যাম্পগুলোতে ধড়াদ্ধড় লোক মরছে। এই কলেরা তো এই মহামারি। হাসপাতালগুলোতে তিলধারণের জায়গা নেই। এইসব দেখে আমার বড় ভয় হল। ভাবলাম একটা হাসপাতাল বানিয়ে দিই। কিন্তু আবার ভাবার পর সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। পুরো স্কিম যদিও তৈরি করে ফেলেছিলাম। ইমারতের জন্য টেন্ডার তলব করলেই লোকে ফি-র টাকা জমা দেবে। নিজেরই একটা নির্মাণ কোম্পানি খাড়া করে দিতাম আর তার নামে টেন্ডার ছাড়তাম। মনে করেছিলাম এক লাখ টাকা বাড়ি তৈরির জন্য রাখব। সত্তর হাজারেই বিল্ডিং তৈরি করে ফেললে তিরিশ হাজার বেঁচে যাবে। কিন্তু আমার ওই স্কিম অধরাই রয়ে গেল যখন ভাবলাম যে যদি মুমূর্ষুদের বাঁচিয়ে তুলি, তা হলে এই জনবহুল দেশে লোকসংখ্যা কমবে কীভাবে?


    গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে এই সারা লফড়ার কারণ হল দেশটা লোকে গিজগিজ করছে। লফড়ার মানে হল ঝগড়া-বিবাদ যার মধ্যে এক ধরনের কেলেঙ্কারির গন্ধ থাকে – কিন্তু এ সত্ত্বেও হয়ত শব্দটার পুরো মানে আমি আপনাদের বোঝাতে পারলাম না।


    জি হাঁ, পুরো লফড়ার পেছনে আছে জনবাহুল্য। লোকসংখ্যা বাড়ার অর্থ এই নয় যে সঙ্গে সঙ্গে জমির পরিমাণও বাড়বে। আকাশও আরও প্রসারিত হবে। বৃষ্টিও বেশি হবে। খাদ্যশস্যের ফলনও বাড়বে। তাই আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোলাম যে হাসপাতাল বানানো হারগিজ্‌ হারগিজ্‌ ভালো কাজ নয়।


    আবার ভাবলাম একটা মসজিদ বানিয়ে দিই। ভাবতেই শোলাপুরের আমিনা বাই চিতলেকরের – আল্লাহ্‌ তাঁকে আশীর্বাদ করুন – গাওয়া একটা শের মনে এল: নাম মনজ়ুর হ্যায় তো ফয়েজ় কে আসবাব বনা – উনি মনজ়ুর কে মঞ্জুর আর ফয়েজ়-কে ফয়েজ বলতেন – ‘নাম মনজ়ুর হ্যায় তো ফয়েজ়কে আসবাব বনা / পুল বনা, চাহ্‌ বনা, মসজিদ ও তালাও বনা’


    কোন্‌ কমবখত নাম বা খ্যাতি চায়? যে নাম করার জন্য পুল তৈরি করে দেয় সে কি ভালো কাজ করছে? কখনই না! আমি বললাম না, এই মসজিদ বানানোর চিন্তা একদম ভুল। আলাদা আলাদা অনেক মসজিদ নির্মাণ রাষ্ট্রের পক্ষে কখনই মঙ্গলের হতে পারে না। এর ফলে জনগণ বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।


    থকে গিয়ে, হেরে গিয়ে আমি যখন হজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, তখন আল্লাহ্‌ মিয়াঁ নিজেই আমাকে একটা রাস্তা দেখালেন। শহরে একটা জনসভা হল। সভা শেষ হওয়ার পর অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ল। এমন ধাক্কাধাক্কি শুরু হল যে তিরিশ জন পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল। পরদিন এই দুর্ঘটনার খবর কাগজে ছাপা হলে জানা গেল যে ওই মানুষগুলোর মৃত্যু হয়নি, ওরা শহিদ হয়েছে।


    আমি ভাবতে শুরু করলাম। ভাবনাচিন্তা করা ছাড়া কয়েকজন মৌলবির সঙ্গে সাক্ষাতও করলাম। জানলাম যে যারা হঠাৎ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তাদের এখন শহিদের সম্মান দেওয়া হচ্ছে। এটা এমন সম্মান যার থেকে বড় কিছুই নেই। আমি চিন্তা করলাম যে যদি মরার বদলে শহিদ হওয়া যায়, তা হলে তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! যাদের সাধারণ মৃত্যু হয়, তাদের মরণ তো বৃথা যায়! শহিদ হতে পারলে অবশ্য অন্য কথা।


    আমি এই সূক্ষ্ম বিষয়টা নিয়ে আরও গভীর চিন্তাভাবনা শুরু করলাম।


    চারদিকে যেখানেই তাকান মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। ফ্যাকাশে মুখ, রোজগার নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের পিষে ফেলেছে। গর্তে ঢোকা চোখ, নিষ্প্রাণ নড়াচড়া। কাপড়জামা ছিন্নভিন্ন। রেলগাড়ির কনডম মালের মত হয় কোনও ভাঙাচোরা ঝুপড়িতে পড়ে আছে। অথবা বেমালিক গরুমোষের মত লক্ষ্যহীনভাবে মুখটা তুলে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেন বেঁচে আছে, কীসের জন্য বেঁচে আছে আর কীভাবে বেঁচে আছে সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই। মহামারি ছড়াল তো কয়েক হাজার মরে গেল। তেমন কিছুই হল না তো খিদে-তেষ্টায়, ঠান্ডায় জমে গিয়ে বা গরমে শুকিয়ে মরল। কারও মৃত্যুর পর হয়ত দু-ফোঁটা চোখের জল পড়ল। অধিকাংশের জন্য তাও পড়ল না।


    ঠিক আছে, জীবনকে হয়ত বোঝা গেল না। তাকে উপভোগ করা গেল না তাও মানা যায়। কে জানে কার শের যেটা শোলাপুরের আমিনা বাই চিতলেকর – আল্লাহ্‌ তাঁর মঙ্গল করুন – বেদনাভরা গলায় গাইতেন: মর কে ভি চৈন না পায়া তো কিধর জায়েঙ্গে -- বলতে চাইছি যে মরার পরেও যদি জীবন না শুধরোয়, তা হলে সে জীবন গোল্লায় যাক!


    আমি ভাবলাম যে এই বেচারিরা, যারা দরজায় দরজায় তাড়া খেয়ে ফেরে, যারা এই দুনিয়ার সব ভালো জিনিস পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে – তারা যদি অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে এমন প্রতিষ্ঠা পায় যাতে এখানে যারা তাদের দিকে আড়চোখে চাওয়াও পছন্দ করত না, তারাও তাদের দেখে ঈর্ষা করবে – তা হলে বেশ হয়! সাধারণ মৃত্যু না হয়ে তারা যদি শহিদ হয়ে মরতে পারে, তা হলে এটা সম্ভব হতে পারে।


    এখন প্রশ্ন হল এরা কি শহিদ হতে রাজি হবে? ভাবলাম অবশ্যই হবে। এমন কোন্‌ মুসলমান আছে যার মধ্যে শহিদ হওয়ার আকুলতা নেই? মুসলমানদের দেখাদেখি তো হিন্দু আর শিখদের মধ্যেও এই উচ্চ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইচ্ছে দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমি খুবই আশাহত হলাম যখন এক মুমূর্ষু মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি, তুমি শহিদ হতে চাও?’ আর সে উত্তর দিল, ‘না!’


    বুঝলাম না ওই মানুষটা আরও বেঁচে কী করবে! তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘দেখো বড়ে মিয়াঁ, খুব বেশি হলে তুমি আর দেড় মাস বাঁচবে। তোমার চলার শক্তি নেই। কাশতে কাশতে তোমার এমন দম আটকে আসে যে মনে হয় প্রাণটাই বুঝি বেরিয়ে গেল। একটা ফুটো কড়িও তোমার কাছে নেই। সারা জীবনে সুখ কাকে বলে জানোনি। ভবিষ্যতে আর তা পাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই। তা হলে আর বেঁচে কী করবে? তুমি ফৌজে নাম লেখাতে পারবে না। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে লড়তে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার স্বপ্ন দেখাও বৃথা। তাই তার থেকে কি এটা ভালো হয় না যে তুমি চেষ্টা করে এখানেই বাজারে অথবা যে ডেরায় গিয়ে রাতে শোও, সেখানে শহিদ হওয়ার বন্দোবস্ত করে নাও? সে বলল, ‘এটা আমি কীভাবে করব?’


    আমি বললাম, ‘সামনে কলার খোসা পড়ে আছে। ধরে নাও তাতে পা পিছলে তুমি পড়ে গেলে। তা হলে অবশ্যই তুমি মারা যাবে। আর মরলেই শহিদ বলে প্রতিষ্ঠা পাবে।’


    কিন্তু আমার এ কথাটা লোকটা বুঝল না। বলল, ‘আমি যে কলার খোসাটা দেখতে পাচ্ছি তার ওপরে পা দেব কোন্‌ দুঃখে? আমার কাছে নিজের জানের কি কোনও মূল্য নেই?’ আল্লাহ্‌...আল্লাহ্‌...কী যে জান! হাড়সর্বস্ব কঙ্কাল, বলিরেখায় ভরা গাঠরি!!


    আমার খুব আফশোস হল। সেই সময় আরও বেশি করে হল যখন জানলাম যে ওই কমবখতটা – যে খুব সহজেই শহিদের মর্যাদা পেতে পারত – কোনও দাতব্য হাসপাতালের লোহার চারপাইয়ের ওপর শুয়ে কাশতে কাশতে মারা গেছে।


    একটা বুড়িও ছিল – বুড়ি থুত্থুড়ি – যেন শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে চলেছে। দেখে খুব দয়া হল আমার। সারা জীবন দারিদ্র্যের দুর্ভোগ আর দুঃখ সহ্য করে কেটে গেছে। আমি তাকে তুলে রেলের পাটার ওপর শুইয়ে দিলাম। (মাফ করবেন, আমাদের এখানে রেল লাইনকে পাটা বলা হয়)। কিন্তু জনাব, যেই রেলগাড়ির হুইস্‌ল শুনেছে, অমনি দম-দেওয়া পুতুলের মত উঠে পালাল!


    আমার মন ভেঙে গেল। তবু সাহস হারালাম না। বনিয়ার বেটা অত সহজে হাল ছাড়ে না। মানুষের ভালো করার যে সিধে রাস্তাটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, তার থেকে নজর সরালাম না।


    মুঘল যুগের একটা খুব বড় ঘেরা প্রাঙ্গণ খালি পড়ে ছিল। তার মধ্যে একশো একান্নটা ছোট ছোট কামরা ছিল খুবই ভাঙাচোরা অবস্থায়। আমার অভিজ্ঞ চোখে মনে হয়েছিল প্রথম জোরদার বর্ষাতেই ছাদ ধসে পড়বে। তাই আমি সেই জায়গাটাকেই সাড়ে দশ হাজার টাকায় কিনে নিলাম। আর সেখানে হাজার খানেক হতদরিদ্র মানুষকে থাকার জায়গা করে দিলাম। মাসে এক টাকা হিসেবে সবার কাছ থেকে দুমাসের ভাড়াও নিয়ে নিলাম। তৃতীয় মাসে – যেমন আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম – প্রথম ভারি বর্ষায় ছাদটা ভেঙে পড়ল। বাচ্চা-বুড়োসহ প্রায় সাত শো লোক সেই ছাদের নিচে চাপা পড়ে শহিদ হয়ে গেল।


    আমি মনের মধ্যে যে গভীর বোঝাটা এতদিন বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, সেটা কিছুটা হালকা হল। লোকসংখ্যা যে শুধু সাতশো কমে গেল তাই নয়, মৃতরা শহিদের মর্যাদাও পেল। লাভের পাল্লা ভারিই রইল।


    তখন থেকে আমি এই কাজই করে চলেছি। প্রতিদিন আমার আল্লাহ্‌-প্রদত্ত দক্ষতা প্রয়োগ করে দু-তিনজনকে শহিদের পেয়ালা হাতে ধরিয়ে দিই। আগেই বলেছি কাজ যেমনই হোক না কেন, সাফল্য পেতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। যেমন, যে লোকটার অস্তিত্ব ছ্যাকরা গাড়ির পাঁচ নম্বর চাকাটার মত নিরর্থক আর বেকার ছিল, তাকে শহিদ-সম্মান পাওয়ানোর জন্য আমাকে পুরো দশ দিন ধরে জায়গায় জায়গায় কলার খোসা ছড়াতে হয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর মত শহিদ হওয়ার জন্যও বোধহয় কোনও একটা দিন ঠিক করা থাকে। দশ দিনের দিন লোকটা কলার খোসায় পা পিছলে পাথুরে জমিতে চিৎ হয়ে পড়ে শহিদ হয়েছিল।


    এখন আমি একটা খুব বড় ইমারত বানাচ্ছি। আমার কোম্পানিই কাজটার ঠিকা নিয়েছে। দু’লাখের চুক্তি। তার থেকে সাফ পঁচাত্তর হাজার তো আমি পকেটে পুরবই। বিমাও করিয়ে নিয়েছি। আমার আন্দাজ মালমশলা এমন দিয়েছি যে যখন তিন তলাটা খাড়া হয়ে যাবে, তখন একদিন গোটা বাড়িটাই ধড়াম করে ভেঙে পড়বে। সেই সময় তিন শো মজদুর অবশ্যই সেখানে কাজ করবে। খোদার ইচ্ছেয়, আমি আশা করব তারা সকলেই শহিদের সম্মান পাবে। আর যদি কেউ বেঁচে যায়, তা হলে ধরতে হবে সে বেটা এমন পাপী যে পরম গৌরবময় আল্লাহ্‌তালা তার শহিদ হওয়া মঞ্জুর করেননি।




    ১ ভারতে মুসলমানদের ছেড়ে যাওয়া সম্পত্তির বিনিময়ে পাকিস্তানে তাঁদের হিন্দু ও শিখদের ফেলে আসা সম্পত্তির মালিকানা বণ্টন


    ২ বিভ্রান্তি


    ৩ যদি নাম করতে চাও, তা হলে দান করো / ব্রিজ, মসজিদ, জলের ট্যাঙ্ক বানাও, কুয়ো খোঁড়ো


    ৪ মরেও যদি শান্তি না পাই তো যাই কোথায়



    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments