• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • নুব্রা উপত্যকায় দু'রাত্রি : সুব্রত সরকার



    দশ বছরের ব্যবধানে আমার দ্বিতীয় বার এই লাদাখ ভ্রমণ। লেহ্, লাদাখ সারা ভারতবর্ষের মধ্যে একদম একটা আলাদা স্বাদের ভ্রমণ। অন্য চোখে, ভিন্ন মনে এই ভ্রমণকে উপভোগ করতে হয়। কষ্টকে স্বীকার করে আনন্দকে সঙ্গী করে দিগ্‌বিদিক ঘুরে বেড়িয়ে মুগ্ধ হওয়ার দারুণ সব দর্শনীয় পাহাড়, নদী, গুম্ফা, সরোবর দেখার বিপুল আয়োজন। এই মরু রাজ্যে পা দিলেই মন মোর মেঘের সঙ্গী হবেই হবে। উজ্বল ঝলমলে রোদ্দুরে নীল আকাশে শুধুই সাদা মেঘের ভেলা। এই সাদা মেঘের ভেলা দেখার আনন্দ অভিজ্ঞতা সব সময়ই অপূর্ব, অসাধারণ!

    এবারের সফর শুরু হয়েছিল শ্রীনগর থেকে দ্রাস, কার্গিল হয়ে লেহ্। লেহতে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই শরীর ও মন খানিকটা এই মরু রাজ্যের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে। তবু লেহ শহরে পৌঁছে একটা গোটা দিন অ্যাক্লাইমেটাইজেশন-এর জন্য রাখতে পারলে ভালো হয়। আমরা পর পর তিন রাত লেহ শহরে ছিলাম। লেহর আশপাশের সব কিছু দেখলাম। নিজেদের মানিয়ে নিলাম রুক্ষ কঠিন মরু রাজ্যের সঙ্গে। তারপর চললাম এক অপরূপ সুন্দর উপত্যকা - নুব্রাতে।

    লেহ থেকে নু্ব্রা ভ্যালি দু' রাত তিনদিনের সফর ছিল। কিন্তু আমাদের পরে মনে হয়েছে, আরও একটা রাত বেশি থাকতে পারলে নুব্রা ভ্যালির সবটুকু সৌন্দর্য শুষে নেওয়া সম্ভব হত! নুব্রা বিশাল বিস্তীর্ণ এক উপত্যকা। সায়ক নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই উপত্যকাকে অনেকটা ইংরেজি Y এর মত মনে হয়। এই উপত্যকার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ সায়ক নদী। এই নদীর জল স্বচ্ছ সবুজ - নীল নয়। কেমন ঘোলাটে, মাটি ও পাথরে মিশে ঘোলা জল নিয়ে দামাল স্রোতে বয়ে চলেছে সায়ক। রিমো হিমবাহ থেকে সায়কের উৎপত্তি। উত্তরের সিয়াচেন হিমবাহ থেকে বয়ে আসা এক ধারা নুব্রা এসে মিশেছে সায়কের সঙ্গে। এই মিলিত ধারা সায়ক নামেই প্রবাহিত হয়েছে সমগ্র নুব্রা উপত্যকা জুড়ে। সায়ক বইতে বইতে একসময় প্যাংগং পর্বতমালায় বাধা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে খালসারে। তারপর নুব্রা উপত্যকা দিয়ে বয়ে যেতে যেতে সায়ক চলে গেছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের দিকে এবং বালতিস্তানে খাপালু ও স্কার্দুর মধ্যবর্তী স্থানে গিয়ে মিলিয়ে গেছে সিন্ধুর বুকে। সুদূর অতীতে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে মধ্য-এশিয়ার বিশাল বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল এই নুব্রা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। সেই লেনদেন যে পথগুলো দিয়ে হত সেই পথকে বলা হয় রেশম পথ বা Silk route. বর্তমানে এই পথগুলো রাজনৈতিক কারণে বন্ধ আছে।

    তুরতুক থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরত্বে ভারতের শেষ গ্রাম থাং । তারপরই পাকিস্তান। ওদেশের শেষ গ্রামের নাম হল ফারনু। সায়ককে ফারনুর দিকে বয়ে চলে যেতে দেখেছি কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা থাং-এ দাঁড়িয়ে।

    এই কাঁটাতারের সীমান্তে দাঁড়িয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম হয় মনে। হৃদয়ে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কোনও দিনই খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ হল না। আমরা এক অপরের বন্ধু হতে পারি নি। তাই সীমান্তে দাঁড়িয়ে সেই অবিশ্বাস ও ভয়ের একটা শীতল অনুভব মনে জন্ম নেয়। দুই সীমান্তে কাঁটাতার ও গোপন বাঙ্কার দেখার মধ্যে দিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, তাও এই ভ্রমণের এক পরম পাওয়া!

    লেহ শহর থেকে নুব্রা উপত্যকা কম-বেশি ১৩০ কিমি পথ। এই উপত্যকার দুটো বিখ্যাত জনপদ হল ডেস্কিট ও হুন্ডার। ডেস্কিট বিখ্যাত তার পাহাড়চূড়ায় বিশাল এক গুম্ফা ও অপূর্ব সুন্দর বুদ্ধমূর্তির জন্য। আর হুন্ডার জনপ্রিয় এখানকার দু' কুঁজওয়ালা উটের জন্য। দেশ বিদেশ থেকে দলে দলে পর্যটকরা আসেন এই দু' কুঁজওয়ালা উট দেখতে ও তার পিঠে সওয়ারী হয়ে আনন্দ উপভোগ করতে।

    আমরা নুব্রা উপত্যকার দুটো রাতই ছিলাম ডেস্কিটে। পাহাড়চূড়ার বিখ্যাত সেই গুম্ফার ঠিক পাদদেশে বড় সড়কের ধারে সুন্দর এক পান্থনিবাসে। এখানে এসেই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। পথশ্রমের ক্লান্তি ও রুক্ষ মরু অঞ্চলের কষ্ট সুন্দর এই বাসস্থানে এসে লঘু হয়ে যায়। পাহাড়- জঙ্গল ও নদীর দিকে মুখ করে ছড়ানো এক জায়গা নিয়ে এই পরিচ্ছন্ন হোটেল। পাহাড় বলতে কারাকোরামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর নদী হল সায়ক। হোটেলের লনে বসে দূরের কারাকোরামের পাহাড় জঙ্গল ও সায়ককে দেখার আনন্দ খুব উপভোগ করেছি। রুক্ষ মরুতে সবুজের বড় অভাব। তবু সামান্য কিছু পপলার ও অ্যাপ্রিকট গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখানে। পপলার বেশ লম্বা প্রকৃতির গাছ। সবুজ পাতাগুলো বাতাসে সবসময় দোল খায়। অ্যপ্রিকট একটু ঝাঁকড়া ঝোপময়। এই উপত্যকায় অ্যাপ্রিকট-এর ফলন বেশ ভালো। রুক্ষ মরু অঞ্চল হলেও শাক সব্জির চাষ অনেক চোখে পড়েছে। এই মাটি গ্লেসিয়ারের জলে ও খনিজগুণে সব্জি চাষের জন্য নাকি খুব ভালো।

    লেহ লাদাখ বছরে চারমাস সমস্ত ধরণের পর্যটকদের জন্য সেরা সময়। জুন থেকে সেপ্টেম্বর। তারপর আস্তে আস্তে শীত নেমে আসে। তাপমাত্রা মাইনাস হয়ে পড়ে, বরফ জমা হয় পাহাড়ে, পথে, জনপদে। স্বাভাবিক জীবন ছন্দহীন হয়ে যায়। জীবনকে যুঝতে হয় তখন প্রকৃতির সাথে নিদারুণ লড়াই করে। সেই চরম শীতেও অভিযানপ্রিয় পর্যটকরা আসেন লেহ লাদাখে। চাদর ট্রেক করেন। ঝুঁকি নিয়ে শীতের লাদাখের সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন।

    লেহ থেকে আমরা সকাল সকালই যাত্রা শুরু করলাম নুব্রা ভ্যালির পথে। মূল শহর ছেড়ে পরিচিত জনপদগুলোকে পেছনে রেখে এগিয়ে চললাম। প্রায় ৯ কিমি পেরিয়ে এসে অচেনা এক জনপদ পেলাম--গঙ্গলাস। এখানে অল্প সবুজের ছোঁয়া আছে। গাছ বলতে সেই লম্বা লম্বা পপলার। ঝিরিঝিরি পাতাগুলো বেশ দোল খায়। গঙ্গলাস থেকে অনেকটা প্রায় ১৬ কিমি পেরিয়ে এসে গাড়ি দাঁড়াল এক চেক পোস্টে। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখলাম জায়গাটার নাম সাউথ পলু। আমরা জানি এর পর আসবে সেই বিখ্যাত জায়গা খার্দুং লা। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মোটর পথ। যার উচ্চতা ১৭৯৮২ ফুট। এখানে প্রবল হাওয়া বয়। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে হয়। শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এসব শোনা ও বই পড়া কথা নিয়ে সবাই আলোচনা করছে। তাই বেশ চঞ্চল ও উদগ্রীব হয়ে আছে সবাই কখন খার্দুংলা-তে পৌঁছাবে গাড়ি।

    সাউথ পলু থেকে গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে। সমতল থেকে প্রায় সাড়ে আঠারো হাজার ফুটে উঠে আসা কম নয়! গাড়ির ইঞ্জিন দম নিয়ে নিয়ে উঠছে। লেহ থেকে খার্দুংলা কম বেশি ৪০ কিমি পথ। এই পথটুকু পেরিয়ে খার্দুংলায় এসে আমরা সবাই উল্লসিত, রোমাঞ্চিত। গাড়ি থেকে একে একে সবাই নেমে এলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য আজ সেরকম হাওয়া নেই। আকাশ নির্মল নীল। রোদ ঝকঝক করছে। শীতের দাপটে কেউ বিপর্যস্ত হই নি। সবাই খুব খুশি। মনের আনন্দে ছবি তুলছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ। কেউ কেউ আবার জাতীয় পতাকা সামনে নিয়ে ছবি তুলছে। কেউ আবার তাঁর প্রিয় ক্লাবের পতাকা নিয়েও ছবি তুলছে। এপথে বাইকারদের ভিড় খুব। এইসব অভিযানপ্রিয় বাইকাররাও খার্দুংলার উচ্চতায় পৌঁছাতে পারার সাফল্য উদযাপন করছে। আমি দ্বিতীয়বার এলাম খার্দুংলায়। আগেরবার খুব খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে ঠক ঠক করে কেঁপেছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হয়েছিল। কিন্তু এবার একদম দারুণ আবহাওয়া। তাই একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবার আনন্দ দেখে নিজেও বেশ আনন্দ উপভোগ করেছি।

    খার্দুংলাতে কিছুটা সময় আনন্দ করে এবার ধীরে ধীরে নেমে চললাম পাহাড়ের পাকদণ্ডী পথে। খার্দুংলাতে আমাদের কারোও কোনও শারীরিক সমস্যা বা তীব্র শ্বাসকষ্ট কিছু হয় নি। সবাই বেশ আনন্দ উপভোগ করেছে।আমাদের তেরো জনের টিমের জুনিয়র দুই সদস্য দিয়া ও তোড়া তো প্রচুর ছবি তুলে হৈ হৈ আনন্দ করেছে। খার্দুংলা থেকে নামতে নামতে অনেকটা পথ, প্রায় ২৪ কিমি পেরিয়ে এসে পেলাম এক জনপদ খালসার। খালসারে পৌঁছনের মুখেই হঠাৎ দেখা পেলাম সায়কের। নুব্রা উপত্যকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ এই সায়ক নদী। সায়কের ওপারে একটা ছোট্ট সবুজ গ্রাম সাতি। দূর থেকে দেখতে বেশ লাগছিল এমন ছোট্ট গ্রামটাকে।

    খালসারে আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি।

    তাই সেই সুযোগে পায়ে পায়ে একটু এগিয়ে যাওয়া সায়কের কাছে। সায়কের বুকে দুরন্ত গতিতে বয়ে এসে পড়ছে এক হিমবাহের শীতল জল। অদ্ভুত নীলচে সবুজ সেই জল হাতে নিয়ে খুব আনন্দ পেলাম। নদীর ধারের পাথরে বসে ছবি তোলা হল।

    খালসার থেকেই শুরু হয়েছে কারাকোরাম সংরক্ষিত বনাঞ্চল। খালসার থেকে ১১ কিমি পেরিয়ে এসে পড়ল তিরিৎ। মূল নুব্রা উপত্যকার প্রবেশ পথ বলা হয় তিরিৎকে। এখান থেকে আরও ১১ কিমি পেরিয়ে এসে দেখা পেলাম এক সবুজ সুন্দর গ্রামের, নাম তার সামুর। সামুরে একটি গুম্ফা আছে। কিন্তু আমাদের তা দেখার সুযোগ হয় নি। সামুরের পরের গ্রাম তেগার। এই গ্রামটিতেও সবুজের ছোঁয়া আছে। তেগার থেকে প্রায় ২০ কিমি পার করে এসে পেলাম আরও একটি সুন্দর গ্রাম প্যানামিক।

    এভাবে চলতে চলতে এসে পৌছলাম ডেস্কিট।

    ডেস্কিট নুব্রা ব্লকের সদর দপ্তর। তাই প্রয়োজনীয় সব কিছু ডেস্কিটে আছে। বাজার, বাস স্ট্যান্ড, ওষুধের দোকান, ব্যাঙ্ক, তিব্বতি রেস্তোরাঁ। এবং ডেস্কিটের অন্যতম আকর্ষণ এক প্রাচীন বৃহৎ গুম্ফা এই জনপদকে পর্যটক প্রিয় করে তুলেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমে লামা শেস্রাব জাংপো এই গুম্ফা প্রতিষ্ঠা করেন। এই গুম্ফার উন্মুক্ত চাতাল থেকে ডেস্কিটকে দারুণ সুন্দর দেখতে পাওয়া যায়। গেলুপা সম্প্রদায়ের লামা সন্ন্যাসীরা অনেকেই এই গুম্ফার অভ্যন্তরে থাকেন। এখানকার সুউচ্চ সুষমামণ্ডিত বৌদ্ধ মূর্তিটা খুবই আকর্ষণীয়। তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামা এঁর উদ্বোধন করেছিলেন। একটা পড়ন্ত বিকেলের অনেকটা সময় আমরা এই গুম্ফার প্রাঙ্গণে বসে ডেস্কিটের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। লাদাখ ভ্রমণে অবসর বিনোদন মানেই এই মরু রাজ্যের রুক্ষতার ভাস্কর্যকে দুচোখ ভরে দেখা। রক বিউটি যে কত আশ্চর্য রকমের দৃষ্টিনন্দন হতে পারে তা লাদাখ ভ্রমণে প্রতি পলে পলে উপলব্ধি হয়।

    ডেস্কিটের মায়াবী সন্ধ্যা হোটেলের ছড়ানো লনে বসে সুন্দর কাটালাম। চোখের সামনে কয়েকটা পপলার গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে বাতাস এসে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঝিরিঝিরি সবুজ পাতাগুলোকে। এখানেই আলাপ হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা দুই পর্যটক বন্ধুর সাথে। তাঁরাও লাদাখ ভ্রমণের মুগ্ধতার কথা হাসিমুখে বলল। আমরা কলকাতার পর্যটক শুনে প্রথমেই তাঁরা বললেন, "ও!...সিটি অফ্ গ্যাঙ্গুলী!..". অর্থ্যাৎ সৌরভ গাঙ্গুলী!..তারপর অনেক কথা হল আমাদের। গল্পে গল্পে রাত হল।

    ডিনার করে আরও একবার এই খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুটা সময়। বড় মন কেমন করা এ আকাশ। মিল্কি ওয়ে দেখার আশায় আরও অনেকে এসে জড়ো হলো। তেমন কিছু দেখা হল না বটে, কিন্তু রাতের এই লাদাখী আকাশ দেখার আনন্দও বড় কম নয়!..

    আজ ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। নতুন জায়গা, রোমাঞ্চকর সফর শুরু হবে সাত সকালেই। ওয়ান ডে অ্যাডভেন্চার। প্রথমে যাব আমরা তুরতুক। এ প্রান্তের শেষ গ্রাম। তারপরই সীমান্ত। ওপারে পাকিস্তান। ভারতের এক এক প্রান্তের শেষ গ্রাম এর আগে দু'একটা দেখা হয়েছে। যেমন ছিটকুল। কিন্তু সীমান্তে পাকিস্তান, এমন জায়গায় আগে যাওয়া হয় নি! তুরতুক থেকে ফেরার পথে হুন্ডার ঘুরে ডেস্কিটের হোটেলে চলে আসব। লম্বা সফর। সারাদিন লেগে যাবে।

    নুব্রা উপত্যকার ডেস্কিটে আমরা ছিলাম LHAS- THANG হোটেলে। বড় অপূর্ব ছিল এই হোটেলের অবস্থান। চোখের সামনে কারাকোরাম পর্বতমালা ও ডালপালা মেলে ছড়ানো নুব্রা উপত্যকার সৌন্দর্য আর ঠিক পেছনেই বিশাল গুম্ফা ও সুউচ্চ সুন্দর বৌদ্ধমূর্তি। এখানে সারাদিন শান্ত হৃদয়ে বসে থাকলেই আশ্চর্য সুন্দর একটা অন্য ভ্রমণের মজা উপভোগ করা যায়। হোটেলের ম্যানেজার টি নরবো আজ সকালেই বলছিলেন তুরতুক যাওয়ার পথের কথা। এই পথও খুব সুন্দর। কমবেশি সত্তর কিমি পাহাড়ি পথ। পথে পড়বে ছোট ছোট কিছু গ্রাম ও জনপদ। সেনাবাহিনীর দেখাও মিলবে বারবার। সিয়াচেন এর ফৌজি গাড়ি অনেক দেখলাম এপথে।

    তুরতুকের পথেও আমরা পেয়েছি সায়ককে। এক একটা পাহাড়ি বাঁকে সায়ককে ভয়ংকর সুন্দর লেগেছে। মুগ্ধ হয়ে যেমন দেখেছি, তেমন আবার শরীরের শিরা উপশিরায় রোমাঞ্চ অনুভব করেছি। রুক্ষ ঝকঝকে পাহাড় ও বৃক্ষহীন ন্যাড়া পর্বতগুলো দেখতে দেখতে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের স্বাদ পাওয়া যায়! লাদাখ ভ্রমণ এই কারণেই সব ভ্রমণের থেকে একদম আলাদা। একদম অন্যরকম। লাদাখ অনন্য। লাদাখ অপরূপ।

    তুরতুক পৌঁছাতে আমাদের একটু বেশি সময়ই লেগে গেল। পথে সেতু বিপর্যয়ের দরুণ প্রায় দু'ঘন্টা আটকে থাকতে হয়েছিল। তুরতুক পৌঁছেই সবাই ছুটলাম সীমান্ত দেখতে। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা জায়গায় সবাই জড় হয়ে দেখছি, এই তো পাকিস্তান!.. দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। নাম ফারনু। আমাদের এপাশের গ্রামের নাম থাং। থাং থেকে ফারনুকে দেখার জন্য দূরবীনে চোখ রাখলাম। এই দূরবীন হাতে দাঁড়িয়ে আছেন থাং-এর সাধারণ সব মহিলারা। তাঁরা গাইডের কাজ করছেন। সুন্দর বর্ণনা দিচ্ছেন চোখে ধরা পড়া দূরের জিনিসগুলোর। আবার এই মহিলারাই তাঁবুর নিচে লাইন দিয়ে দোকান করে অ্যাপ্রিকট (খুমানি), কাজু, কিসমিস, মশলা, ফলের রস, জুস সব বিক্রি করছেন। সবই লোকাল, এবং অর্গানিক এই দুটো জাদুশব্দ চিৎকার করে করে পর্যটকদের কানে পৌঁছেও দিচ্ছেন।

    এই সীমান্তে একটা ছোট্ট বোর্ড চোখে পড়ল। ভারতীয় সেনাবাহিনী লিখে রেখেছেন- "Thang village on Indian side and Pharnu village on Pakistan side as both share common relationships, all of a sudden on the intervening night of 16 and 17 December 1971 these villages were separated by the LOC, thereby affecting the relationship between the two villages and now we can find husband living here and wife on the other side, children living here and parents living on the other side of LOC and many other stories of separation are very common here. One can see relatives working in their fields even with naked eyes but can not meet each other. This is the story of separation and this is true here."

    সীমান্তের এই বিষন্নতা মনকে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন উদাসী করে দেয়। যুদ্ধ আর রাজনীতি - এরা কোনও কিছুকেই যেন মানতে চায় না! সাধারণ মানুষের জীবন ও তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের কোনও দাম নেই যুদ্ধবাজদের কাছে। ন্যায়বোধ, আবেগ সব তুচ্ছ, সব অবহেলিত হয় এই যুদ্ধের রাজনীতিতে। তাই এই ক্রন্দনও শেষ পর্যন্ত লিখতে হয়ে সেনাবাহিনীকেই!

    আজ দুপুরের আহার পুরোপুরি নিরামিষ। তার আয়োজন ছিল যেখানে, সেখানে ঢোকার মুখেই দেখলাম লেখা, ভারতের শেষ হোটেল!.. "HINDUSTAN KA AKHRI DUKAN" বেশ মজার একটা অনুভূতি হল। ভারতের শেষ গ্রামে এসে শেষ হোটেলে খেলাম! মজা পাওয়ার আরেকটু বাকি ছিল। ফেরার সময় গাড়ি যখন ছেড়ে প্রথম বাঁক নিয়েছে, সেখানে দেখলাম একটা ছোট্ট বাড়ি, তাতে লেখা ভারতের শেষ হোম স্টে!

    সাবাশ মুসাফির! এই দেখার আনন্দগুলো যেন সারাজীবন সব ভ্রমণে খুঁজে খুঁজে দেখতে পাই!

    এবার চলেছি হুন্ডার। একই পথে ফিরে চলেছি। হুন্ডার ঘুরে ফিরে যাব ডেস্কিট। ডেস্কিট থেকে খুব কাছে হুন্ডার। মাত্র আট কিমি পথ। তাই আজ সারদিন তুরতুক ও হুন্ডার বেড়িয়ে সন্ধ্যায় ডেস্কিটে ফিরে আসব এটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা।

    হুন্ডারে দশ বছর আগে যখন এসেছিলাম, সে হুন্ডারকে দেখে এবার আর চিনতে পারছিলাম না। অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ল। হুন্ডার এখন বেশ বড় জনপদ হয়ে উঠেছে। হোটেল, হোম স্টে ও টেন্টে জমজমাট হুন্ডার। বিদেশী পর্যটকও প্রচুর এসেছে। হুন্ডার-এর প্রধান আকর্ষণ দুই কুঁজওয়ালা উট। আগেও এসে এই উটের পিঠে চড়েছিলাম। এবারও চড়ার মজা নিলাম। আগের বার উটের পিঠে চড়ে ফিসফিস করে বলেছিলাম, "উট, তুমি কি কাঁটা বেছে খাও!.."এবারও ফিস ফিস করে বললাম, "উট, কাঁটা কি চিবিয়ে খাওয়া শিখেছো?"... ও দিব্যি ওর লম্বা গ্রীবা দুলিয়ে দুলিয়ে কী যেন বলল, আমি না বোঝার আনন্দ নিয়েই উট সফরটাকে স্মরণীয় করে রাখলাম আমার স্মৃতিতে!

    হুন্ডারের চারপাশেও একটা বন্য সৌন্দর্য আছে। অনেকটা ছড়ানো একটা বালিয়াড়ি, কাঁটা গাছের ঝোপ, গ্লেসিয়ার গলে যাওয়া জলের সরু নদী আর সেই লাদাখী ঝকঝকে আকাশ সন্ধে নামার মুখে সূর্য়াস্তের রঙের ছটায় যে কী অপূর্ব হয়ে উঠেছিল, তা দেখতে দেখতে ডেস্কিটে ফেরার স্মৃতিটা আজও অমলিন!

    আজই শেষ রাত ডেস্কিটে। দু'রাত তিনদিনের নু্ব্রা উপত্যকা ভ্রমণ মনকে মাতিয়ে রেখেছিল। এই সুন্দর উপত্যকায় আরও একটা দিনরাত্রি কাটানোর সুযোগ পেলে মন তৃপ্ত হত। পিপাসা যেন মেটে না, যত বেড়াই, যত দেখি, দেখার ইচ্ছে ও ক্ষুধা বেড়েই চলে!

    মুসাফির ক্লান্ত হয় না। গানে গানে পথ চলাকে সজীব রাখি, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো..!



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments