মুখে যাই বলি, আসলে এই তিনটেই যে মানুষের প্রধান কাজ এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
খ্যাল করে দেখুন, সব দেবতাকেই ভোগ চড়াতে হয়। কোন দেবতাই ভক্তের হাতের নৈবেদ্য আহার না করে বর দেন না। এবার তো মানবেন যে আহার-নিদ্রা-মৈথুন হল মানবজীবনের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, আমাদের সবার হোলি ট্রিনিটি?
আমার মনে এই ত্রিমূর্তির মধ্যে কে আগে, কে পরে নিয়ে একটু সন্দেহ আছে।
তবে ‘আহার’ যে এদের মধ্যে সিনিয়র এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়। কারণ আহার না জুটলে নিদ্রা আসে না, আর খালি পেটে সেক্স? হাসালেন মশাই। আর নিদ্রা আসে চুপিসাড়ে, শরমে জড়িত চরণে। ভরপেট আহারের পর এবং দেহের ভরা জোয়ারে ডুবসাঁতারের পর।
এবার ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়। অর্ডার বদলে দিলাম—আহার-মৈথুন-নিদ্রা। এ নিয়ে আর কোন কথা হবে না।
এত সব কূটকচালি শোভা শুনতে চায় নি। তাই ছ’মাস আগে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ওকে দোষ দিই নে। বিয়ের পর যে পাঁচ বছর সঙ্গে ছিল, তাই অনেক। কারণ আমি খালি মুখেন-মারিতং জগত, কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। সে আহার বিহার দুটো ব্যাপারেই। আর নিদ্রা? আমার সহজে আসে না। অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হয়। আমার কাজকম্ম ইদানীং এমন যে আহার ব্যাপারটা বাকি দশজনের মত নিয়মিত জোটে না।
ফুলশয্যার রাতে চুমো খেতে গিয়ে আমার চোয়াল লক হয়ে গেছল, যেন আড়াল থেকে অমিতাভ বচ্চন বলেছেন—কম্পিউটার মহাশয়, তালা লাগা দিয়া জায়ে।
ব্যস্, সেদিন থেকেই আমার হাতে হ্যারিকেন কেস। পাশ ফিরে কেতরে গিয়ে দুহাতের কায়দায় মুখের তালা খুললাম বটে, কিন্তু চোয়াল আটকানো অবস্থায় আমার ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ, লালা ঝরা মুখ শোভার মনে এমন আতংকের বীজ পুঁতল যে পাশে শুলেই ও বলে—আলো নেভাও, নিভিয়ে দাও বলছি।
বিশ্বাস করুন, আমি জন্ম থেকে এমন ছিলাম না। মানে, ওই চোয়ালে তালা লাগার ব্যাপারটার কথা বলছি। একটা ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম যৌবনে।
তখন আমার আঠেরো বছর বয়েস। রাজ্যে বাম সরকার। আমরা মানে নাকতলা স্কুলের বন্ধুরা সবাই বামাচারী। বিশ্বাস করি যে প্রথমে বঙ্গে, তারপর খেপে খেপে গোটা দেশে আঠেরো নেমে আসবে। কলেজ থেকে বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় এক সন্ধ্যেয় ঢাকুরিয়ার মোড়ে বাস থেমেছে। এক বামা হররমা নামছেন, পেছনে একটি লোক। হঠাৎ এক বিবাদী স্বর। একজন বয়স্ক লোক চেঁচিয়ে উঠেছেন –এই স্টুপিড, ওই মহিলাকে বিরক্ত করছ কেন?
লোকটি পালটা চিৎকার করে ওঠে—কোন শ্লা ফালতু কথা বলে?
— ফালতু কথা? তখন থেকে দেখছি।
লোকটি বেশ স্খলিত জড়িত স্বরে মহিলাকে বলে—বৌদি, আমি কি আপনাকে বিরক্ত করেছি?
মহিলা পাদানি থেকে নামতে নামতে কঠিন স্বরে বললেন—হ্যাঁ, করেছেন।
বয়স্ক লোকটির চিৎকারে বাসের কিছু লোকজন জড়ো হল। ব্যাপার গুরুতর দেখে অপরাধী ফ্রন্টফুটে খেলার স্ট্র্যাটেজি নিল। সোজা বয়স্ক লোকটির কলার চেপে মারতে শুরু করে দিল। সবাই হতভম্ব।
আমি নিশ্চিত, যে জনগণ ন্যায়ের পক্ষে। মহিলার সোজাসুজি অপরাধী শনাক্তকরণ ও অপরাধের স্বীকৃতির পর দোষীকে শাস্তি দিতে সমবেত ন্যায়ের হাত এগিয়ে আসবে। দরকার শুধু একটু উদ্যোগ, একজন পাইওনিয়ারের। তা সে কাজ তো বয়স্ক ভদ্রলোকটি করেই দিয়েছেন। এখন ওঁর গায়ে হাত উঠছে। উনি অসহায়ভাবে সাহায্যের জন্যে ইতিউতি তাকাচ্ছেন। কেউ এগোচ্ছে না।
কিছু বোঝার আগেই আমি গিয়ে গুন্ডাটির হাত চেপে ধরেছি।
—ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন বলছি। বাপের বয়সী লোকের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না?
—এই বুড়ো তোর বাপ? ক’টা বাপ তোর?
আমার ঘুঁষিতে লোকটা আঁক করে মুখ চেপে বসে পড়ল। আমি জানি আমি ন্যায়ের পক্ষে, জানি জনগণ আমার সঙ্গে। আর এও জানি যে লোকটা মাতাল, ভেতরে দম বেশি নেই।
কিন্তু কোথা থেকে রে-রে করে গোটা ছয়েক ছেলে ছুটে এল।
ওদের সমবেত রণধ্বনি—আমরা থাকতে পাড়ার মধ্যে কেউ খোকাদার গায়ে হাত তুলবে!
একটা ফৌলাদি মুক্কা আমার গালে। ছেলেটার হাতে বোধহয় স্টিলের আঙটি ছিল।
সে যাক গে, জনগণ এগিয়ে এল না। দু’একজন উলটে আমাকে বলল—কেন খোকাদার গায়ে হাত তুলেছি?
আমি আনুপূর্বিক ঘটনাটি বলার চেষ্টা করতেই খোকা বলল—মিথ্যে কথা, সব বানানো। কোথায় সেই মহিলা? কোথায় বাপের বয়সী ভদ্রলোক?
সত্যিই তো, তাঁরা কোথায়!
জনগণ অসহায়। আমার পক্ষে এভিডেন্স নেই। আসামী প্রমাণের অভাবে খালাস।
অভিযোগী পক্ষ আসামীর অপরাধ প্রমাণ করিতে ব্যর্থ। সাক্ষ্য অপ্রতুল। কিছু সাক্ষী হোস্টাইল, ইহা কি আসামীর দায়িত্ব?
হক কথা। যেখানে গুজরাতের দাঙ্গা, ফলস এনকাউন্টার, শিখ দাঙ্গা, মুজফফরপুর — সব কেসেই প্রচুর অপরাধী বেকসুর খালাস পেয়ে যায় সেখানে এ তো পাতি ব্যাপার।
বিদ্বান ন্যায়াধীশের দল অসহায়। প্রমাণ চাই, সাক্ষ্য চাই, সাক্ষী চাই।
তাই রায় শুনলে মনে হবে আসলে কিছুই ঘটে নি। কেউ মারা যায় নি, ধর্ষিতা হয় নি, কাউকে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নি। ঈশ্বরের ভারতবর্ষে সব ঠিকই চলছে।
আমাকে চারদিন অ্যানালজিন খেতে হল, দিনে তিনটে করে।
ব্যথা গেল, কিন্তু একটা ছাপ রেখে গেল। কোন কারণে উত্তেজিত হলে আমার চোয়াল লক হয়ে যায়, মুখ দিয়ে ছোট বাচ্চার মত নাল গড়ায়। তার দণ্ড দিতে হল ফুলশয্যার রাতে।
হাসবেন না মাইরি। জীবনে কোন মেয়ের এত কাছাকাছি আসি নি। আরে আমাদের সময়ে এটাই দস্তুর ছিল। আমি যে ভাল ছেলে। বাড়িতে পাড়ায় স্কুলে।
যাক গে, ফিরে আসি আহার পর্বে।
ছোটবেলায় খাওয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা ছিল। এটা খাব না, সেটা খাব না। ওটায় গন্ধ লাগে, সেটায় বমি পায়। কত নখরা! শেষকালে একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিষ্টকে দেখানো হল।
উনি ওষুধ দিলেন।
অব্যর্থ ওষুধ। তবে সব ওষুধেরই সাইড এফেক্ট আছে। একটা সারালে আর একটা হয়। পেইন কিলার বেশি খেলে পেটে ঘা হয়।
আমারও আর একটা রোগ শুরু হল। বাড়ির খাওয়ায় পেট ভরলেও মন ভরত না। পাড়ার মোড়ে রোল, ফুচকা, ধোসা এসব খেতে খুব ইচ্ছে করত। কিন্তু আমাদের বাঙালবাড়ি একটু পিউরিটান, একটু বেহ্মজ্ঞানী ভাব। হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া মানা, সিনেমার গান গাওয়া মানা, হিন্দি সিনেমা দেখা মানা।
তার ফলে হাতটানের অভ্যাস হল। কাকুর টেবিলের ড্রয়ার, মায়ের শাড়ির ভাঁজের নীচে লুকিয়ে রাখা টাকা, সবকিছুর দিকে আমার নজর গেল।
ভুল বুঝবেন না। আমি আদ্যোপান্ত নৈতিক, আমার নীতিবোধ বেশ টনটনে। এসব করতে প্রথম প্রথম বেশ খারাপ লাগত, একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খেত। কিন্তু কিছুদিন পরে আর খারাপ লাগত না। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাতাম যে মার শাড়ির নীচে টাকা কোত্থেকে এল? নিঘঘাৎ বাবার ওয়ালেট থেকে। তাহলে পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তে যাক।
ছোটকাকুর ড্রয়ারের টাকা যায় সিগ্রেটের দোকানে। সিগ্রেট খাওয়া কি ভাল? এতে কি ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায় না? তাহলে আমি ড্রয়ারের টাকার বোঝা কমিয়ে কাকুর সিগ্রেট খাওয়া কমাচ্ছি কি না? মানে কাকুর স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে আমার কাজটাকে কি খারাপ বলা যায়?
ভেবে দেখুন, এটা একেবারে খাপে খাপ পঞ্চার বাপ ডি-মনিটাইজেশন যুক্তি। লোকের নগদ কেড়ে নাও, বাধ্য হয়ে সবাই অনলাইন বা চেকে লেনদেন করবে আর গোটা সমাজ ক্যাশলেস ডিজিটাল সমাজ হয়ে যাবে।
এহ বাহ্য, আগে কহ আর।
বটেই তো, বটেই তো!
এবার তাহলে সেই কমলাকান্ত-প্রসন্ন গোয়ালিনী কেস—ঠাকুর, বলি খাও কী করিয়া?
হক কথা; পেট ভরাতে হলে আগে পকেট ভরাতে হবে। তা বাড়ির লোকজনের পকেট কেটে ওই ফুচকা-রোল-আইস্ক্রিম অব্দি চলে; তারপর?
এই সত্যিটা আগেই বুঝে গেছলাম, তাই স্কুলের বেড়া টপকানোর পর আর কলেজের পড়ায় মন দিই নি। বিএ পাস করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরি? সে সব শ্রীবংকিমচন্দ্রের আমলে জুটত, এখন নয়। এখন তো এমবিবিএস করেও ডাক্তারদের পশার হয় না; হয় এম ডি নয় এম এস বা ওইরকম কিছু একটা হওয়া চাই।
তাই আমি কলেজ পাড়ায় দুটো বছর কোনরকমে কাটিয়ে নিজের পাড়ায় সিটি কেবল লাগানোর লাইনে পচাদার চ্যালা হয়ে ঢুকে গেলাম। অর্থাৎ, ফোন পেলে গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে ফটাফট টিভির তার টানাটানি, পয়সার হিসেব আর মাসে মাসে টাকা আদায় করা, মানে এ লাইনের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করি, একটা বাদে।
সেটা হল অন্য কেবল কোম্পানির ছেলেদের সঙ্গে গ্রাহক নিয়ে বাতেলাবাজি হাতাহাতি খিস্তাখিস্তি এইসব। এ ব্যাপারে আমি এক্কেবারে ভীতুর ডিম। ঝামেলা দেখলে আগেই নও-দো -গ্যারহ।
ফলে আমার মাসিক রোজগার কিছুদিন একজায়গায় থেমে রইল।
বাড়িতে অশান্তি শুরু হল। গোড়ায় কেউ আমার কেবলের লাইনে ঢোকাটা সিরিয়াসলি নেয় নি। আমাদের বাড়িতে সবাই ইউনিভার্সিটির মুখ দেখেছে। দুই দাদা রাজ্য সরকারে ইউ ডি সি। বড়বৌদি টেলিফোন বিভাগে, ছোটবৌদি আলিপুর কোর্টের কোন নামকরা উকিলবাবুর মুহুরি।
ছোট বোন এপাড়া-ওপাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মত নতুন গজিয়ে ওঠা অসংখ্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কোন একটাতে পড়ায়। ফলে ওকে বেশ সমীহ করে চলতে হয়।
আমিই একটি শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের কালোভেড়া!
আমাদের বাড়িতে অনেক বই, অনেকগুলো র্যাকে ডাঁই করে রাখা। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ওই র্যাকের গায়ে ছোট ছোট পেরেক ঠুকে তার থেকে পুরনো শাড়ি কেটে পর্দা লাগানো হত, সেগুলো মাসে মাসে ক্ষার দিয়ে কাচা হত।
সেই বাড়ির ছেলে আমি বই নেড়েচেড়ে বড় হয়েছি। বিশেষ করে পড়েছি শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, ছোটদের উপনিষদ, ছোটদের বিবেকানন্দ আর বাংলা নভেল। শরৎচন্দ্র ভালো লাগেনি—কেমন যেন বাংলা সিনেমার মত; রবিঠাকুরের শেষের কবিতায় কোন গল্প নেই। ঘ্যামা লেগেছে বঙ্কিমচন্দ্র, এক্কেবারে বলিউডি সিনেমা—দিল গার্ডেন গার্ডেন হয়ে যায়। তবে কিছুদিন পরে তিন বাঁড়ুজ্জে, সমরেশ বসু, সুনীল গাঙ্গুলী সবই ভালো লাগত।
কিন্তু সবাই আমাকে যা তা বলতে লাগল। আমি নাকি বখে গেছি। পড়াশুনো শেষ না করে বাজে লাইনে গেছি। এমন কথাও উঠল যে কেবলের কাজ নিয়েছি এই জন্যে যাতে খালি সময়ে পচাদার দোকানে বসে ব্লু ফিল্ম দেখতে পারি। কী করব, আমার খালি বাংলায় ভাল নম্বর, অংক, বিজ্ঞান আর ইংরেজি সব বড্ড কঠিন। অন্য ছেলেমেয়েগুলো কী করে টপাটপ পাশ করে যায় কে জানে!
মায়ের হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্যে নাকি আমিই দায়ী।
যখন বুকে ব্যথা উঠেছিল তখন বাড়িতে কেউ ছিল না, বাবা মাত্র বাজার করে ফিরেছে আর ট্যাক্সি ডাকার জন্যে আমার খোঁজ পড়ল। কিন্তু আমি তখন অন্য পাড়ায় কারও বাড়িতে কেবল টিভির তার নিয়ে টানাটানিতে ব্যস্ত।
এখন মাসে মাসে একহাজার টাকা বড়বৌদির হাতে গুণে গুণে তুলে দিই। কিন্তু বৌদিমণির মন গলে না। একে তো এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে এই টাকায় কিছুই হয় না। তায় এমন কাজ করি যে পরিবারের লজ্জায় মাথা কাটা যায়! তাই রাত্তিরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকি। বেশিরভাগ দিন বাইরে খেয়ে আসি।
কিন্তু এসব করেও শেষরক্ষা হল না।
ছোটবোনের বিয়ে ঠিক হল। বিয়ে হবে ওর স্কুলের মালিকের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি এমএসসি, বি এড, এবং বাপের স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। ঘ্যাম বাড়ি, ছেলেটি ভাল। কোন এদিক সেদিক টুং-টাং-ফুং-ফাং নেই। আমি জানি, কেননা ওদের বাড়িতে কেবল নেটওয়ার্ক আমাদের, মাসে মাসে টাকা আনতে আমিই যাই।
বাড়িতে আনন্দের বন্যা। আমি একদিন বোনকে সিঁড়ির বাঁকে ধরে বললাম-–তুই কী নিবি বল?
বোন হেসে ফেলল। বলল— ছোড়দা, তোকে কিছু দিতে হবে না।
—কেন?
—আমি যা চাইব তা তুই দিতে পারবি না।
—বলেই দেখ।
এবার ও হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে একটি ছবি দেখিয়ে বলল—এই চাইনিজ হ্যান্ডসেটটা; এর ক্যামেরাটা দারুণ।
আমি দমে গেলাম। ওই সেটটার দাম পনেরো হাজার টাকা।
আমার মুখের ভাব দেখে ও হুঁঃ করে নাক দিয়ে একটা আওয়াজ বের করে গটগটিয়ে নেমে গেল।
বিয়ের দু’দিন আগে আমাকে বড়দা আলাদা করে ডেকে বলল যে বিয়ের দিন আমার বন্ধুর বাড়ি গিয়ে থাকা উচিত। বিয়েবাড়িতে ছেলের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন আমাকে কেবল লাগানোর ছেলে হিসেবে চিনে ফেলবে, সেটা কি ঠিক?
আমি মাথা নীচু করে বের হয়ে এলাম।
রামগড় এলাকায় একটা ঘর ভাড়া করে আমাদের কেবল কোম্পানির চারটে ছেলে থাকে। ওখানে আর একটা বিছানা পাতা হল। আমি হিসেব করে দেখলাম, ওদের সঙ্গে থাকলে আমার ভাগে বাড়িভাড়া ইলেক্ট্রিক বিল ও খাইখরচা মিলিয়ে এক হাজার টাকার বেশি পড়বে না। আর বড়বৌদির হাতে এক হাজার তুলে দিয়েও রাত্তিরের খাওয়াটা তো বেশিরভাগ বাইরেই সারতাম। তাই পাকাপাকি এদের সঙ্গে থাকলে আমার লাভ। এমনকি মাসে এক-দু’ হাজার করে ব্যাংকে জমাতেও পারব। যেই ভাবা সেই কাজ। আমার সামান্য জিনিসপত্র একটা স্যুটকেসেই ধরে গেল।
তবে আর একটা কাজ করলাম। পচাদার কাছে পনেরো হাজার টাকা ধার চাইলাম, মাসে মাসে এক হাজার করে কাটিয়ে দেব। পচাদার মুখ হাঁ হয়ে গেল। কী কেস? জুয়োতে হেরেছিস, নাকি ঘোড়ার লেজ ধরে? ব্যাপারটা খুলে বললাম। দাদা গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, তারপর আলমারি খুলে টাকাটা গুণে দিয়ে বলল—ষোল কিস্তিতে শোধ দিবি, ওই এক হাজার করে; শেষ এক হাজার আমার সুদ।
তাই সই। বিয়ের প্যান্ডেলে স্টেজে উঠে যখন সবাই বর-বৌকে আশীর্বাদ করছে আর বাচ্চা ভাইঝিটা একটা খাতায় সব লিখে রাখছে— কে কী গিফট দিল, তার নাম-ঠিকানা এইসব; তখন আমি গিয়ে হাজির হয়ে হাসিমুখে স্টেজে উঠে নতুন হ্যান্ডসেটটা ওর হাতে তুলে দিলাম। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল, ভিডিওর হলদে আলো আমার মুখে। অপ্রস্তুত বোন বলতে গেল—উনি আমার, উনি আমার—!
—-পাড়ার দাদা।
বলে সেখান থেকে নেমে বেরিয়ে এলাম। আর বাড়ি যাই নি।
এই হল আমার ‘আহার’ পর্ব।
এবার দ্বিতীয় পর্ব।
(২)
এর মধ্যে একদিন শোভার সংগে আমার বিয়েও হয়ে গেল। ভুল বললাম, বলা উচিত শোভা আমাকে বিয়ে করল।
শোভাকে ছোটবেলা থেকে চিনতাম, যেমন খেলার মাঠের গোলপোস্টের পেছনে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাছাগুলো একে অপরকে চেনে। আমি পড়তাম নাকতলা স্কুলে, ও মাঠের ওপারে বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ে। রোগা রুখুসুখু চুলের মেয়েটা—হাতে-কাচা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসত। ও’রকম অনেক মেয়ে কাপড়ের ব্যাগে করে বইখাতা নিয়ে আশপাশের কলোনি থেকে—বিদ্যাসাগর, রামগড়, রায়পুর, বাঁশদ্রোণী – পড়তে আসত। এ মেয়েটা আমাদের পাশের পাড়ার। কিন্তু একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। ও নাকি ইছামতী নদীর ওপারে বাংলাদেশ থেকে বাবার হাত ধরে এদেশে এসেছে। মা নেই, এখানে মামাবাড়িতে উঠেছে। মামাদের বড়সড় মুদি দোকান। ওর বাবা সেখানে কাজ করছে। আর একে মামীর কথামত ঘরের সব কাজ করতে হয়। তারপর পড়াশুনো।
তখন এগারো ক্লাসে উঠেছি। সরস্বতী পুজোর সময় বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনটে মেয়ে এল আমাদের স্কুলে ওদের পুজোর নেমন্তন্ন কার্ড দিতে। আমাদের কী উৎসাহ! ওরা হেডস্যারের ঘরে গিয়ে প্রণাম করে টেবিলে কার্ড রেখে বলল –আসবেন কিন্তু স্যার! সন্ধ্যে বেলা আরতি হবে, তারপর কালচারাল প্রোগ্রাম।
তারপর করিডর ধরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে দেখল স্কুলের কোল্যাপসিবল গেটে তালা লাগানো। ওরা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। স্বপন আর সুধাংশু ঠোঁটে দুষ্টু হাসি চেপে আড়াল ছেড়ে এগিয়ে এল। কী হয়েছে? মামণিদের কোন প্রবলেম?
ওরা কথা না বলে বন্ধ তালার দিকে আঙুল দেখাল।
স্বপন হাত উলটে শ্রাগ করে বলল—সে কী! কে লাগিয়েছে?
দলের একটু এলিট দেখতে মেয়েটি বলল—আচ্ছা, আপনি দেখছি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না!
সঙ্গের দেখনসুন্দরীটি গালে হাত দিয়ে টেনে টেনে বলল—ওমা, কী হবে তাহলে! আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে যে!
সুধাংশু ওর সুরে সুর মিলিয়ে বলল—নাই বা গেলেন! আমাদের গেস্ট হয়ে এখানেই থেকে যান না!
ওদের মুখ গোলাপি হয়ে গেল। আমার একটু খারাপ লাগছিল, আবার এই ইঁদুর বেড়াল খেলাটায় মজা পাচ্ছিলাম।
একটা খ্যানখেনে চড়া আওয়াজে চমকে উঠলাম।
—কী রে শালা! বাপের বিয়ে দেখবি নাকি?
তিননম্বর সরস্বতীকে আগে আমরা খেয়াল করি নি। একটু চেনা চেনা লাগছে, তবে নতুন নতুন শাড়ি পরেছে, ঠিকমত সামলাতে পারছে না। কোন ম্যাগাজিনে পড়া একটা ছ্যাবলা লাইন মনে পড়ছে—খাজুরাহো কোণারক বুকের উঠানে।
সুধাংশু মিনমিনে গলায় বলল—এ কী ভাষা! একটু ভদ্রভাবে বললে—
—যে লোক যে ভাষায় বোঝে!
তালা খুলে দিলে ওরা চলে গেল।
আমি জানতে চাইলাম—সরস্বতীদের মধ্যে ওই ডাকিনী-যোগিনী কে রে?
—চিনিস নে? শোভা। তোদের পাশের পাড়ার হরিকাকার মেয়ে। ওর মামার দোকান থেকেই তো তোদের মাসের জিনিসপত্র আসে। এখন দ্যাখ, বাঁশগাছে ফুল ফুটেছে।
কিন্তু মেয়েটা যা হয়েছে না! খিস্তি দিয়ে সবার ভুত ভাগিয়ে দেয়। কেউ কাছে ঘেঁষে না। বহ্নি ক্লাবের পটলা একদিন পুজো প্যান্ডেলের ভিড়ের মধ্যে ওর কোমরে হাত দিয়েছিল, গালে পড়ল একটা থাপ্পড়—ঠাঁটিয়ে। মামাবাড়ির বাসন মেজে মেজে ওর হাত যা হয়েছে!
ওরে বাবা! আমি তারপর থেকে রাস্তায় শোভাকে দেখলেই রাস্তার একধারে সরে যেতাম।
কয়েক বছর পেরিয়ে আমি এখন দস্তুরমত কেবলের কাজে পোক্ত; নতুন নতুন খদ্দের ধরি। শুধু তার টেনে চলে আসি না, খদ্দেরদের সঙ্গে ওদের পছন্দমত প্যাকেজ বেছে নিতে সাহায্য করি। এ ব্যাপারে আমি আমার নভেলপড়া বিদ্যের কিছু কিছু কাজে লাগাই। বিশেষ করে কলোনি এলাকায় বৌদি, মাসিমা, কাকিমাদের সঙ্গে ডিল করার সময়।
আমি প্রত্যেক তিনমাসে কনেকশন বাড়ানোর টার্গেট পুরো করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে দু’জন পচাদার কাজ ছেড়ে অন্য পাড়ায় কেবলের কাজে চলে গেছে। ফলে আমার আস্তানার মাসিক শেয়ার বেড়ে গেছে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। পচাদা খুব খুশি, আমার মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে অন্য কেবলওয়ালারা আমার জন্যে চার ফেলেছিল। আমি টোপ গিলি নি। জানতাম, যাই করি না কেন পচাদা ঠিক খবর পেয়ে যাবে।
আবার ভাট বকছি? ভাবছেন বেলাইনে যাচ্ছি। আদৌ না, আগে আহারের ব্যাপারটা পোক্ত হলে তবে তো পরের দুটো। স্বামীজি কি বলে যান নি যে ক্ষুধার্তের কাছে ভগবান রুটিরূপ ধরে আসেন? উনি ওটা হাড়ে হাড়ে জানতেন; গ্র্যাজুয়েট হবার পর বিধবা মা আর ভাইবোনের সংসার সামলাতে কম ভুগেছেন? সাধে লিখেছেন “অসহায় ছিন্নবাস পরে দ্বারে দ্বারে উদরপূরণ, ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে কী ধন করিনু আয়োজন!”
তা আমার আহারের ব্যবস্থা পাকা হওয়ার পর বিয়ের জোগাড় হল, যেমন সব মধ্যবিত্ত ঘরে হয়। কিন্তু আমার জন্যে আমার বাপ-দাদা কেউ মেয়ে দেখে নি, সম্বন্ধ আনে নি। আসলে বাঙালিরা মেয়ের জন্যে সরকারি চাকুরে খোঁজে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরে কেরানি, না পেলে পার্মানেন্ট চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি, ওই বেয়ারা আর কি!
কিন্তু দোকানদার চলে না। ব্রাহ্মণ হলেও না। কন্যেটি নাক সিঁটকে বলে-–দোকানি-ই-ই?
আর কেবল লাগানোর ছোকরা? সিলেবাসের বাইরে। আমি স্বপ্নেও ভাবি নি যে আমার সঙ্গে জোড় বাঁধতে কোন মেয়ে জুটবে। বলিউডি সিনেমার মেঘ মেঘ ধোঁয়া ধোঁয়া নায়িকাই যথেষ্ট। এমন সময় ঘটল একটা অ্যাকসিডেন্ট, শোভার সঙ্গে কলিশন।
শীতকালের সন্ধ্যে। সেদিনের মত আমার কাজ শেষ। ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এক রাউন্ড নারুর দোকানের ফুটন্ত চা মেরে আস্তানায় ফেরার জন্যে শর্টকাট রাস্তা ধরেছি। দুটো সিগ্রেট আস্তে আস্তে টানলে রাস্তাটা প্রায় মেরে আনা যায়। এই সময় আকাশটা কেমন ময়লা ময়লা লাগে। রাস্তার ধারে কুয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলো দেখলে মনে হয় ঘোমটায় মুখ ঢেকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এ’রম হলে আমার মায়ের কথা খুব মনে হয়।
নবোদয় ক্লাবের পাশে মজা পুকুরের পাড় দিয়ে একটু এগিয়েছি কি সিগ্রেটটা নিভে গেল। কনকনে হাওয়া। মাফলার দিয়ে মাথা কান জড়িয়েছি। একটা গাবগাছের নিচে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে বাঁহাত দিয়ে দেশলাই বের করে আবার ধরাতে যাব, কানে এল একটা গোঙানির শব্দ। ভূত-টুত নিয়ে কখনও ভাবি নি, কিন্তু বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।
আমার পায়ের থেকে দশ ফুট দূরে একটা লোক মাটিতে পড়ে আছে, আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে। তাহলে লোকটা বেঁচে আছে।
আমার প্রথম রি-অ্যাকশনঃ কেটে পড়, নিঘঘাৎ কোন মারামারি, কোন বড় ঝামেলা। এসবে না জড়ানোই ভাল।
দ্বিতীয় রি-অ্যাকশনঃ কোন এ্যাকসিডেন্ট কেস হতে পারে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়ত বেঁচে যাবে। এখন চলে গেলে পরে মনটা খিঁচখিঁচ করবে।
দোনোমোনো করে ঠিক হল আগে চেহারাটা তো দেখি।
কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে দেশলাই জ্বালালাম। আরে, এ তো হরিকাকা। মাসের জিনিসপত্র কেনার সময় ওঁর শালার দোকানে চাল ডাল নুন তেল ওজন করে প্যাক করে দিতেন। বাড়ি ছেড়ে আসার পর আর অনেকদিন ওদিকে যাই নি। গলায় বুকে হাত দিলাম। নাঃ কোথাও কোন চোট আছে এমন তো মনে হচ্ছে না। অস্ফুট গলায় বিড়বিড় করছেন—বাড়ি যাব, বাড়ি যাব।
পিঠের পেছনে হাত দিয়ে তুলতে যাব নাকে ভক করে লাগল ধেনো মদের গন্ধ। ও শালা! একগাদা গিলে টল্লি হয়ে রাস্তার পাশে কেতরে পড়ে ‘বাড়ি যাব’ হচ্ছে! থাক শালা, আমার কী দায় পড়েছে। আপন পথে চল মুসাফির।
নাঃ, দায় একটা আছে। ওর মেয়ে শোভা যে আমার সংগে নাকতলার পাঠশালায় পড়েছে। এই শর্টকাট রাস্তায় লোকচলাচল বিশেষ নেই। রাত্তিরে পড়ে পড়ে ঠান্ডায় যদি টেঁসে যায়! তা এখান থেকে ওদের বাড়ি এক কিলোমিটার হবে। আমার আস্তানায় ফেরার পথের উল্টো দিকে।
টেনে-হিঁচড়ে তুলে জড়িয়ে ধরে যখন ওদের বাড়ির সামনে এলাম তখন আমার জামা সোয়েটারের নিচে ঘামে চিট চিট করছে।
এই পাড়ার সব বাড়িগুলোয় টালির চাল। সবকটাই চল্লিশ বছর আগে জবরদখল কলোনির সময় তৈরি, পরে বাম সরকারের সময় পাট্টা দেওয়া হয়েছে। সব বাড়িগুলোর চারপাশে আকন্দের বেড়া। সব বাড়িগুলোতেই অন্তত একটা করে হলদে বালব জ্বলছে। শুধু ওদের বাড়িতে একটা টিমটিমে টেমি।
আমি দরজায় ঠক ঠক করতেই দরজাটা খুলে গেল। দরজার ফ্রেমে টেমি হাতে শোভা। কঠিন মুখ, কড়া চোখে আমাকে জরিপ করছে। দু’সেকেন্ড। তারপর এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে নিজের বাবাকে যেন ছিনিয়ে নিল। অভ্যস্ত হাতে ধরে নিয়ে তক্তপোষে বিছানায় শুইয়ে দিল। একটা মাটির হাঁড়ি থেকে গেলাসে করে জল নিয়ে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে মুখ মুছিয়ে আবার শুইয়ে দিল।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত সব দেখছিলাম। এবার আমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু একটা কিছু না বলে যাই কী করে? বললাম—আমি যাই।
—দাঁড়া।
তারপর উঠে এসে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আগুন চোখে বলল – বাবাকে কোথায় পেলি?
—নবারুণ সংঘের কাছের পুকুরপাড়ে, মাটিতে শুয়ে ছিলেন।
হিসহিসিয়ে উঠল শোভা।
—মিথ্যে কথা। শালা, তোর মতন বালেদের আমার চেনা আছে। তুইও ভাটিখানায় ছিলি। একসাথে মদ গিলেছিস।
এ কী ঝামেলা! আমি ককিয়ে উঠে দিব্যি গালি। আমি তো আজ অব্দি এক ফোঁটাও চেখে দেখি নি।
—কাছে আয়। সত্যি মিথ্যে আমি বুঝে নেব। হাঁ কর।
আমি অসহায়। ছোট বাচ্চার মত হাঁ করি। শোভার মুখ এগিয়ে আসে। ওর নাকের পাটা ফুলে ওঠে। শ্বাস টানে। চোখ কুঁচকে যায়। শ্বাস টানে, এবার চোখের তারা বড় হয়। আমি আবার নিঃশ্বাস টানি, শ্বাস ছাড়ি। শোভার মুখ আমার কাছে, অনেক কাছে। একটা অন্যরকম বুনো গন্ধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিছু বোঝার আগেই কেমন করে যেন আমার ঠোঁট ওর ঠোঁটে মিশে যায়। আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। আর আস্তে আস্তে চোয়াল লক হতে থাকে।
এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দেয় শোভা। মুখ মুছতে মুছতে বলে—তুই একটা আতাক্যালানে। যা, চলে যা।
সাত দিন কেটে গেছে। কেটেছে ভয়ে ভয়ে। যদি কাউকে বলে দেয়! ও যা মেয়ে, যদি পচাদার অফিসে এসে কোন হাঙ্গামা বাঁধায়? চেঁচিয়ে খিস্তি দিয়ে পাড়া মাথায় করে? আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে? অবশ্যি আমি এখন সবচেয়ে ভাল কর্মচারী। আস্তানার ছেলেদের সাথে জুয়ো খেলি না, মদের নেশা নেই। নেশা বলতে —ঘন ঘন চা খাওয়া, দিনে গোটা পাঁচেক পানামা সিগ্রেট, আর টিভিতে বলিউডি সিনেমা। অবশ্যি পচাদার বাড়ি থেকে মাসিক নবকল্লোল ও পুরোনো পুজোসংখ্যা এনে পড়াটাকেও এর মধ্যে ধরতে হবে।
আট দিনের মাথায় আবার শোভার সঙ্গে দেখা। সন্ধ্যের দিকে ডিউটি প্রায় সেরে এনেছি তখন তিনি হাজির, সোজা পচাদার অফিসে। আমি ব্যস্ত হয়ে ভেতরের ঘরে একটা কনেকশন ঠিক করতে চলে গেলাম। ও আমাকে দেখেও দেখল না।
পচাদার সঙ্গে কথা বলতে লাগল, নীচুগলায়।
আমার তো হয়ে গেছে। একটু পরে পচাদা উঁচু গলায় হাঁক পাড়ল—নীলু, কোথায় গেলি? এদিকে আয়, দরকার আছে।
আমার হাত-পা ঠান্ডা, কেন মরতে মাল খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা হরিকাকাকে তুলতে গিয়েছিলাম? এই জন্যেই লোকের ভাল করতে নেই। পা টেনে টেনে সামনের ঘরে আসি, ওর দিকে না তাকিয়ে পচাদার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই।
—শোন, এ হল শোভা। আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। মেয়েটা বিপদে পড়েছে। ওর বাবা খুব অসুস্থ, বাঙ্গুর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি ডাক্তার সেনের নামে একটা চিঠি শোভার হাতে দিয়েছি। সেটা দেখালে একটা বেড পেয়ে যাবে। তুই সঙ্গে যা, বাবাকে ভর্তি করিয়ে আমাকে একটা খবর দিবি। ট্যাক্সিভাড়া ওষুধপত্তরের জন্যে এই দু’শো টাকা রাখ।
ডাক্তার সেন চিঠি পড়ে আমাকে আলাদা করে বললেন উনি তোমার কে হন?
—পাড়ার কাকা।
— অবস্থা ভাল নয়। বেশি হলে ওয়ান উইক। এখন ভর্তি করে নিচ্ছি। রাত্তিরে একজন কাউকে থাকতে হবে।
— আমিই থাকব।
শোভা অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আমি পচাদাকে ফোন করে সব জানিয়ে দিলাম। পচাদা বলল যে আমাকে আগামী দু’দিন ডিউটিতে আসতে হবে না। আমি যেন হাসপাতালেই ডিউটি করি।
শীতের রাত; কাটতেই চায় না। জেনারেল ওয়ার্ডের বারান্দায় পায়চারি করি। মাঝে মাঝে নীচে ইউরিনালের পাশে গিয়ে ধোঁয়া গিলে আসি। শোভা বাবার বিছানার পাশে একটা টুল জোগাড় করে ঠায় বসে আছে। মাঝে মাঝে নার্সদের সঙ্গে কথা বলছে।
একবার বারান্দায় বেরিয়ে এসে আমাকে বলল বাড়ি চলে যেতে আর কাল সকালে আসতে। আমি ভাবলাম যে আর দু’ তিন ঘন্টা। তারপরে সকাল হয়ে যাবে, তাই বাড়ি যাওয়ার কোন মানে হয় না।
কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই খেজুরে করতে গিয়ে বললাম—তোমাদের বাড়িতে টেমি জ্বলে কেন? আশপাশের সবার ঘরেই তো বালব জ্বলে।
— লাইন কেটে গেছে; বাবা ছ’মাস বিল দেয় নি যে!
—কেন?
শোভা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। কেন আবার কী! পয়সা ছিল না, তাই।
আমার অপ্রস্তুত ভাব দেখে গলার আওয়াজ নিচু হয়। তারপর থেমে থেমে কেটে কেটে বলতে থাকে।
বাবাকে গতমাসে মামার দোকান থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে; ক্যাশবাক্সে গন্ডগোল। চলছিল কিছুদিন থেকেই। ভেবেছিল চুপচাপ ভরে দেবে। পারে নি, ধরা পড়ে যায়। মামাবাড়ি থানাপুলিশ করে নি। ছাড় ওসব কথা।
এইসব আশকথা পাশকথা চলতে চলতে সকাল হল। ক্যান্টিন থেকে চা আর বানরুটি আনিয়ে দু’জনে মিলে খেলাম। তারপর আস্তানায় ফিরে মাথা ধুয়ে বিছানায় ডাইভ মারলাম। ঘুম ভাঙল মোবাইলের সুরেলা আওয়াজে। আমার প্রিয় গানের রিং টোন বাজছে—ইয়ে প্যার কা নগমা হ্যায়।
আধোঘুমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না; কিন্তু ফোন ধরতেই পচাদার গলার চড়া আওয়াজে সমস্ত ঝিমঝিম ভাব কর্পূর হয়ে উবে গেল।
—শালার কুম্ভকর্ণের ঘুম। এ নিয়ে তিন বার কল করলাম। শীগগির বাঙ্গুর হাসপাতালে যা। হরিকাকা টেঁসে গেছে, ঘন্টা দুই হল। বেডখালি করে ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে বডি ক্লাবের সামনে নিয়ে আসতে হবে। সেখান থেকে শ্মশান। ক্লাবের ছেলেরা পৌঁছে গেছে। ফুলটুল সাদা কাপড় সব ওরা দেখে নেবে। তুই খালি কাগজপত্তর ক্লিয়ার করে শোভাকে ঘরে নিয়ে আয়।
শোভাকে দেখে একটু অবাক হলাম। আগের রাতের শাড়িটা পালটায় নি। কিন্তু কিছু একটা বদলে গেছে। আমাকে দেখে বলল—ছেলেগুলোকে বোঝাও, বাবাকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে না। এখান থেকেই সোজা গড়িয়ার শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে।
তাই হল। পচাদা এসে সৎকার সমিতির গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। দুজন ক্লাবের ছেলে একটা হিরো-হোন্ডা বাইকে বসল। পেছনে সৎকার সমিতির গাড়িতে হরিকাকা আর সামনে আমি ও শোভা।
সারারাস্তা শোভা কোন কথা বলে নি। পুরুতের কথা শুনে যন্ত্রের মত কাজ করে গেছে।
ফেরার সময় ছেলেদের বলল, তোমরা যাও, আমি নীলুদার সঙ্গে ফিরছি।
ক্লাবের কাছকাছি পৌঁছে পচাদাকে ফোন করলাম, বলল—ঠিক আছে। তুই ওকে একটু দেখ। আমার বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বাড়ির সামনে গাঢ় অন্ধকার, শীতের সন্ধ্যে নামছে। বাইরে কিছু কৌতূহলী মুখের উঁকিঝুঁকি।
শোভা আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বলে তালা খুলে ভেতরে গিয়ে টেমি জ্বেলে দিয়ে ভেতরে আসতে বলল। আমি অবস্থা দেখে এক প্যাকেট মোমবাতি ও দেশলাই কিনে দিয়ে এলাম। ওর সেকেন্ডহ্যান্ড মান্ধাতার আমলের মোবাইলে পয়সা ভরে দিলাম। খাবার এলে ওকে বললাম—আমি যাচ্ছি। তুই ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দিস। কোনরকম প্রবলেম দেখলে আমাকে কল করিস।
পরের দিন শোভার কথা মাথা থেকে নামিয়ে পচাদার কোম্পানির কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
এই পর্যন্ত গল্পটা ঠিক এগোচ্ছিল। আমার প্রত্যেকটা দিন একইরকমভাবে কাটছিল। স্যাঙাৎদের মুখ দেখে সকালে বিছানা ছাড়ি। মোড়ের চায়ের দোকানে বলা আছে। সেখান থেকে ধিনিকেষ্ট নামের এক হাফপ্যান্ট একটা লোহার জালিমত জিনিসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের গ্লাস নিয়ে আসে, গুণে চারটে। বিমান আগেই উঠে পড়ে ও ধিনিকেষ্টর পকেট বুকে এন্ট্রি করে দেয়। বিমান তক্ষুনি ট্রানজিস্টরে বিবিধ ভারতী লাগিয়ে ভল্যুম বাড়িয়ে দেয়। সীতেশ বিরক্ত মুখে পাশ ফেরে। আওয়াজ আরও বাড়ে। এবার ও উঠে গিয়ে আওয়াজ বন্ধ করে আবার শুতে যায়। আমি ইশারায় চায়ের গেলাস দেখাই। ও নিমপাতা মুখে বিছানায় গিয়ে বসে। বিমান এবার নীরেনের পেছনে লাগে। বিড়ি ধরিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখে ছাড়ে।
সবার ঘুম ভাঙলে আমরা আ-ছোঁচা মুখে চা খাই। ওরা তিনজন বিড়ি ধরায়। আমি রেডিও চালিয়ে খবর শুনি। এবার ঘর ঝাঁট কে দেবে, আজ কার দিন—এইসব নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হয়। দেখা গেল আজকে বিমানের দিন। ও মিটিমিটি হেসে আমাকে দেখে। আমি ইশারায় বলি যে আমি ওর হয়ে ঝাঁট দিয়ে দেব, কিন্তু ও যেন সবার জন্যে আর একবার চা আনিয়ে দেয়।
রোদের ঝাঁঝ টের পাওয়া যায়। আমরা একে একে বাইরে গিয়ে বারোয়ারি পায়খানায় নিত্যকর্ম সেরে আঙিনার বাইরের টিউকল থেকে বালতি ভরে চান সেরে ফটাফট কাজে যাবার জন্যে তৈরি হই।
পচাদার কেবল অফিসে গিয়েও আমরা পালা করে দোকান ঝাঁট দিই, চা আনাই। তারপর যথারীতি মনিটর দেখি। কেবল কনেকশনগুলোর হাল-হকিকত দেখি। কমপ্লেন শুনি, কার্ড দেখে ক্লায়েন্টদের ফোন করি, সাইকেল নিয়ে মাসিক পয়সা আদায়ে যাই। নতুন গ্রাহক জুটলে দুজন দুজন করে কেবল ও কিট নিয়ে কনেকশন দিতে রওনা হই। ঠেকে ফিরতে কারও কারও রাত হয়। মাসের গোড়ার দিকে কেউ কেউ মাল টেনে টল্লি হয়ে ঘরে ফেরে। আমি বই পড়া ছেড়ে নিরাসক্ত মুখে দরজা খুলি। কোন কোন দিন ওরা দলবেঁধে আমার পেছনে লাগে। আমি গায়ে মাখি না।
কিন্তু সে’বছর মহালয়ার দিনে যা ঘটল তার জন্যে মা দুর্গাই দায়ী।
সবে রূপং দেহি, জয়ং দেহি শুনে চায়ের কথা ভাবছি এমন সময় দরজায় নতুন ধরনের কড়া নাড়া। দরজা খুলে আমি অবাক।
পচাদা।
আমি ভয় পেলাম।
—এই নীলু, শোন। তোকে একটা কাজ করতে হবে। বাইরে চ’, কথা আছে।
বাইরে গিয়ে আমি অবাক।
আঙিনার বাইরে একটা সজনে গাছের পাশে শোভা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে একবার দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল।
আমার খেয়াল হল দাঁত মাজা হয় নি।
—পচাদা, তোমরা ভেতরে এসে বসো। আমি তৈরি হয়ে আসছি।
—শোন, একেবারে দাড়ি কেটে চান করে তৈরি হয়ে সোজা আমার বাড়িতে আয়। কথা আছে।
— কী কথা? এখন বলা যাবে না।
—ধুর ল্যাবেন্ডিস; তোকে আজ পিকনিক যেতে হবে।
—ঠিক আছে, বিমানদেরও তৈরি হতে বলছি।
—- না, না। ওদের কিছু বলার দরকার নেই। এটা শুধু তোর আর আমার মধ্যে। আয় তো, তারপর সব জানতে পারবি।
পচাদার বাড়ির দোতলায় বই আর মাসিক পত্রিকা আনতে কতবার গেছি। বৌদির পড়া হয়ে গেলে আমার জন্যে এককোণে ডাঁই করে রাখা থাকে। আজ আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে একটা থালায় ভাল করে সাজিয়ে লুচি তরকারি আর দুটো মিষ্টি দেওয়া হল।
কেস কী, কিছুই বুঝছি না।
একটু পরে বৌদি একটা গামছায় হাত মুছতে মুছতে হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকলেন।
—আরে নীলু, খাচ্ছ না কেন? ভালো করে খাও। লুচি আলুর দম আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।
ব্যাপারটা কী?
আস্তে আস্তে জানলাম যে আজ জন্মদিন। কার? ওই শোভার। এখানে? এ বাড়িতে?
আহা, বৌদির বোন যে! তুতো হলেও বোন বলে কথা। তায় সদ্য পিতৃহারা।
কিন্তু অন্য ছেলেগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু আমাকে খেতে ডাকা! কোথায় কিছু একটা গোলমাল আছে। ভয়ের চোটে আলুর দমে নুন বেশি বলতে পারলাম না। আরও দুটো লুচি চেয়ে নিলে হত, চাইতে পারি নি। সুতরাং আহার অসম্পূর্ণ হইল।
খাওয়ার পরে পচাদা আমায় ছাদে নিয়ে গিয়ে সিগ্রেট ধরিয়ে একটা দিল। আমি না করায় এক ধমক দিয়ে প্রায় মুখে গুঁজে দিল।
আমি অপ্রস্তুত হয়ে টান দিতে ভুলে গেলাম। বুঝলাম এবার সেই গোপন কাজের কথা আসছে।
—শোন নীলু, যে কাজটা বলছিলাম। তোকে বিয়ে করতে হবে।
আমার হাত থেকে পানামা সিগ্রেট পড়ে গেল। এ কী কথা! ঠিক শুনেছি তো?
—অমন হাঁ করে কী দেখছিস?
—মানে কাকে?
— এই তো! লাইনে আয় ব্যাটা ল্যাবেন্ডিস। কাকে আবার, আমার শালীকে। মানে শোভাকে।
এবার আমার মাটিতে পড়ার অবস্থা।
—শোন, ওই পাড়ায় এই বয়সের মেয়ে একা থাকতে পারে না। প্রবলেম আছে। তাই সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে। হাজার হোক, আমার দূরসম্পর্কের শালী; একটা দায়িত্ব আছে না?
— আমাকে কেন?
—তোর কোন সমস্যা আছে?
—না মানে, চালচুলো নেই। রোজগারের ঠিক ঠিকানা নেই। আমি কী করে আর একজনের দায়িত্ব নেব?
পচাদা বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখল। তারপর গম্ভীর হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
আমি পাশের বাড়ির তিনতলা উঁচু ছাদের দিকে তাকালাম। সেখানে একটি মেয়ে টাঙানো তারে একগাদা ভিজে কাপড় মেলতে ব্যস্ত।
—কী হল? কথা হয়েছে?
চমকে পেছনে ফিরে দেখি বৌদি। পচাদা কাঁধ ঝাঁকাল।
—নীলু, সবই তো শুনেছ, তোমার আমার বোনকে পছন্দ হয় নি?
উরিত্তারা! এখন শোভা একধাক্কায় বৌদির মায়ের পেটের বোন হয়ে গেল নাকি!
বৌদি আমার মালিকের বৌ; তার বোনকে অপছন্দ করা মানে মালিকের বৌকে অপমান করা। মেয়েরা কত প্যাঁচই জানে!
আমার কথা শুনে বৌদি এককথায় সব সমস্যা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল।
—- জানি, তুমি আজকালকার ল্যালা ছোকরাদের মত নও। তুমি যে দুম করে রাজি না হয়ে দায়িত্ব নেবার আগে সব দিক ভেবে দেখেছ তাতে নিশ্চিন্ত হলাম যে আমি ভুল করি নি। বোনকে তো আর কোন হাঘরের হাতে তুলে দিতে পারি না।
ঠিক ঠিক; আমিও তো তাই বলছি। আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে এ বিয়ে হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে পচাদার মত পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি সমঝদার।
কিন্তু কে বুঝবে মা তোমার লীলে,
জলে তুমি ভাসাও শিলে।
বৌদি আমার চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে মুচকি হাসল। তারপর জানাল যে এত ভাবার কিছু নেই। শোভা সব জেনেশুনেই রাজি হয়েছে। ওর বাড়ির টালির চাল মেরামত ও বিজলির কনেকশন জুড়ে দেওয়ার কাজ সাতদিনে হয়ে যাচ্ছে। পচাদাই খরচা দিচ্ছে। আর পদ্মশ্রী সিনেমার কাছে টাটা স্কাইয়ের কেবল লাগানোর অফিস খুলেছে। শোভাকে সেখানে পচাদা রিসেপশনিস্ট এবং হিসেব রাখার কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ও কম্পিউটার জানে।
ফলে দুটো পেট আরামসে চলে যাবে। আর ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বাড়লেও—
—এঃ, আমাদের নীলু যে লজ্জায় নীলকমল হয়ে উঠল। আরে তুমি তো লাকি! শোভার কোন ভাইবোন নেই। বাড়িটা যাই হোক, এমন কিছু খারাপ নয়। আর তিনকাঠা জমিটার পাট্টা শোভার কাছে আছে। তুমি তো একসঙ্গে রাজকন্যে আর রাজত্বি—দুটোই পেয়ে গেলে।
তা পেয়ে গেলাম বটে!
বিয়ে হল পচাদার বাড়ির লাগোয়া জঞ্জাল ফেলার ছোট মাঠটায় ম্যারাপ বেঁধে। আমার সঙ্গের তিনজন—সীতেশ, বিমান ও নীরেন—বরযাত্রীর রোল করল। আর চায়ের দোকানের ধিনিকেষ্ট ফুলপ্যান্ট ফুলশার্ট চড়িয়ে খাবার জল, পান আর সিগ্রেটের দায়িত্ব সামলালো।
তিন স্যাঙাৎ আড়ালে বলল—শালা! তোর পেটে পেটে এত? এমন ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিলি যে কেউ টের পেল না?
সীতেশ আরও ফিসফিসিয়ে বলল—কী রে, ফেঁসেটেঁসে গিয়ে বাধ্য হয়ে মালাবদল করছিস না তো!
আমার শক্ত চোয়াল দেখে বিমান বলল—কী যে বলিস! ও’রম পবিত্র প্রেম!
নীরেন সামনে হাত মেলে গেয়ে ওঠে—ইয়ে জো মহব্বত হ্যায়!
শেষে একটা আদ্ধির দাম দিয়ে তবে ছাড়া পেলাম।
অনুষ্ঠানে কোন ত্রুটি ছিল না।
কালরাত্রি, ফুলশয্যা, দ্বিরাগমন সব হয়েছিল। বৌদি জিদ ধরে সব করিয়েছিল। এমনকি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা ও দাদা-বৌদিকে নেমন্তন্ন করতে যেতে চাইছিল।
কিন্তু এই প্রথম আমি পচাদা ও বৌদির অবাধ্য হলাম। একা অন্ধকার রাস্তায় পথ চলতে পেছনে ফিরে তাকাতে নেই, মা শিখিয়েছিল।
ফুলশয্যার সন্ধ্যেয় বৌদি এসে কিছু ফুল আর মিষ্টি দিয়ে গেল। আমি একটা টাঙাইল শাড়ি দিয়ে বৌদিকে প্রণাম করলাম।
রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে শোভাকে বললাম—পচাদা আর বৌদি, মানে তোমার দিদি আর জামাইবাবু খুব ভাল লোক।
শোভা মুচকি হাসল। —পচাদা তোকে ঠিক চিনেছে।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম— হাসছ কেন? এখন তো আমরা বর-বৌ। আগের মত তুই-তোকারি করা কি ঠিক হবে?
শোভা হেসে গড়িয়ে গেল।
—মানে?
—ল্যাবেন্ডিস।
শোভার হাসি থামতে চাইছে না, থামতে চাইছে না। বিষম খেল, আমি তাড়াতাড়ি করে জল গড়িয়ে দিলাম।
তারপর আমার গালে ঠোনা মেরে বলল—শোন ল্যাবেন্ডিস, তোর পচাদা এই বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। শুধু বৌদির জেদের জন্যে হল। আর আমিও রাজি ছিলাম।
আমি হতভম্ব।
—আরে তোর ওই পচাদা আমার বাড়ি সারিয়ে চাকরি জুটিয়ে আমাকেই গিলে নিতে চাইছিল। বৌদি বুঝতে পেরে হন্যে হয়ে লেগে বিয়ে দিল।
— আমাকে কেন?
— ল্যাবেন্ডিস বলে। আমি তাকেই বিয়ে করব, যে আমার চেয়ে অন্তত কুড়ি পার্সেন্ট বেশি বোকা।
প্রথম দিনই কি সুর কেটে গেছল?
ঠিক তা নয় বলেই আমার মনে হয়।
নভেলে যেমন লেখে ‘দিনগুলো একটা ঘোরের মধ্যে’, তেমন কিছুই হয় নি। তবে ফুলশয্যার রাতে সেই চোয়াল আটকে যাওয়া দুর্ঘটনা শোভার মনে একটা স্থায়ী ছাপ রেখেছিল। রাত্রে শুতে গেলেই ও আলো নেভাতে বাধ্য করত, নইলে চেঁচাত।
আমার কথা যদি ধরেন, তবে হ্যাঁ, একটু ভেবলে গেছলাম।
একটা জলজ্যান্ত মেয়ে আমার বৌ? নিজে থেকে রাজি হয়েছে? এ যে শালা জ্যাকপট!
(এই মারকাটারি ডায়লগটা পুরনো দেশ পত্রিকার কোন নামকরা লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, নামটা আজ মনে নেই।)
তবে অনভ্যস্ত হাতে চা বানাতে, ঘর ঝাঁট দিতে প্রথম প্রথম মনে হত ধ্যোর বাল!
কিন্তু মুখ খোলার উপায় নেই, শোভা পালটা মুখ খুললে প্রলয়। ও যে বাকি সব কাজ—রান্নাবান্না, ঘর মোছা, কাপড় কাচা—সব নিজের হাতে করে।
আমার বাজার করা ওর পছন্দ নয়। আমি একটা আতাকাল্যানে, ল্যাবেন্ডিস! আমাকে সবাই ঠকায়। ও ওর স্বর্গত বাবার বাঙাল উপদেশ —“পয়সা দিয়া কানা-ফ্যাদা কিনন নাই”- আমাকে হরদম শোনাত।
এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে আমাদের সংসার চলছিল। পাড়ার বাসুদার ভ্যানরিকশাটার মত।
দুজনেই কাজে বেরিয়ে যাই আর ঘরে ফিরি প্রায় একই সময়ে। দুজনের রোজগার কাছাকাছি, আমার সামান্য বেশি।
তিনটে বছর পেরিয়ে গেল। কোথাও যেন একটু একঘেয়েমি, একটু বেসুর।
শোভার মনে হল আমাদের ঘরে এখন আরেকজন আসলে ভাল হয়।
ভয় পেলাম, খরচা সামালাব কী করে? আর দুজনেই কাজে বেরিয়ে যাই। বাচ্চাকে দেখবে কে?
শোভা নিঃসন্দেহ হল যে আমি একটা আতাক্যালানে।
নাকতলাতেই একটা এনজিও ক্রেশ চালাচ্ছে। নাম দিয়েছে ঝুলাঘর। আর দুজনে মিলে যা ঘরে আনি তার থেকে হয়ে যাবে। এরমধ্যে শোভা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যাংকে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছে।
কিন্তু গোড়ায় গলদ। তিনবছর হয়ে গেছে।
বাঁশরীর ডাকে শাখে কুঁড়ি ধরে নি।
চল, ডাক্তার দেখাই।
ঠিক আছে, তবে দুজনকেই।
পরীক্ষার ফল? শোভা পাস, আমি ল্যাবেন্ডিস।
ছ’মাস গেল। শোভা দিন দিন গম্ভীর হচ্ছে।
আমি একদিন বলি—চল, অনাথ আশ্রম থেকে একটি বাচ্চা দত্তক নিই; পছন্দ তোমার।
শোভা নিরুত্তাপ মুখে জানায় যে ও সব খোঁজ নিয়ে রেখেছে। আইনে অনেক ফ্যাকড়া। হাঘরে-হাভাতেদের দত্তক নেওয়ার অধিকার নেই।
আমরা হাভাতে? আমরা হাঘরে?
আমরা দুজনেই হাভাতে, আর শুধু তুই হাঘরে।
আমার হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
আমাদের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি ঝগড়া হল। সেই প্রথম, তবে সেই শেষবার না।
বোধহয় ভগবানকে ডেকেছিলাম; উনি শুনলেন। আমার হাঘরে দশা ঘুচল।
পচাদা কেবল টিভির লাইন ছেড়ে দিয়ে প্রোমোটার হল। আমাকে নামমাত্র মাসিক ভাড়ায় কেবলের ব্যবসাটা দিয়ে দিল।
ফল হল মারাত্মক।
(৩)
আমি ছমাসের মধ্যে একটা জমি কিনলাম, পাটুলির ওদিকে। শোভাকে রেজিস্ট্রির দলিল দেখিয়ে বললাম—তাহলে আর হাঘরে নই, কী বল?
শোভা বলল—আঙুল ফুলে কলাগাছ!
শোভার কথায় কি অভিশাপ ছিল?
জমি কেনার দু’মাসের মধ্যে সীতেশ, বিমান ও নীরেন আমার কাজ ছেড়ে দিল। বলল আমি নাকি বদলে গেছি। আমার কথাবার্তা জামাকাপড়ে বড্ড মালিক-মালিক গন্ধ। এক্কেবারে পচাদার ভায়রাভাই।
আমি অবাক। আরও অবাক হলাম যখন জানলাম যে ওরা ভিডিওকন, এয়ারটেল এসব বড় কেবলের অফিসে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে আমার গ্রাহক কমতে লাগল। বাজারে কোনদিন দেনা ছিল না, তাও শুরু হল।
আর আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে এ নিয়ে শোভার বিশেষ হেলদোল নেই দেখে।
একদিন এই কথা তোলায় ও বলল – এ নাকি হতই, আজ নয় কাল। আগে ছিল শুধু টাটা স্কাই। এখন ভিডিওকন, এয়ারটেল, রিলায়েন্স। আবার সান টিভি বলেও একটা আসছে। লোক্যাল কেবলের ব্যবসা শহরে চলবে না। পচাদা হাওয়া বুঝেই লাইন ছেড়ে দিয়ে প্রোমোটারি ধরেছে। মরা বেড়ালছানা তোর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। তুইই বুঝতে পারিস নি, ল্যাবেন্ডিস কোথাকার!
আচ্ছা, তবে নিজের শালীকেও তো গছিয়েছে, সেটাকে কী বলবি?
কী বললি?
শোভার চোখ বেড়ালের মত জ্বলে উঠল। আচমকা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে দিল আমার নাক আর গাল।
আমি কিছুই করি নি। বৌয়ের গায়ে হাত তুলব? একটা মেয়েকে মারব? আমার ভেতরে কেউ প্রাণপণে না-না করে উঠল। মাটিতে পড়ে গেলাম। শোভা হাত-পা দুটোই চালালো। তারপর গরগর করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে রাত্তিরে শোভা বাড়ি ফিরল না। পরের দিনও নয়। আমি সকালবেলায় পাড়ার সিনহা ডাক্তারের কম্পাউন্ডারের কাছে গিয়ে মুখের উপর নখের আঁচড় ও অন্য ছড়ে যাওয়া জায়গায় মারকিউরোকম ও একটা ইঞ্জেকশন লাগিয়ে এসে আমার অফিসে বসেছিলাম, বেলার দিকে পচাদা এসে হাজির। বলল, যদ্দিন রাগ না পড়ে শোভা ওর দিদির কাছেই থাকবে। তারপর বলল যে ওর গোড়াতেই এ বিয়েতে মত ছিল না। গিন্নির চাপাচাপিতে রাজি হয়ে বিয়েটা করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে শোভার মত তেজি মেয়ের পক্ষে নীলুর মত মিনমিনে ল্যাবেন্ডিশ ছেলের ঘর করা নামুমকিন।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। কিন্তু পচাদা বসেই রইল। তিন বার চা খেল, এক প্যাকেট সিগ্রেট ফুঁকল। তারপর অফিসের ছেলেরা চলে গেলে যখন শাটার নামাব তখন গলার আওয়াজ পালটে বলল—নীলু, তোর সঙ্গে একটু কথা বলার ছিল। তুই ওই বাড়ি ছেলে চলে আয়।
মানে?
মানে বাড়িটা তো শোভার। তোদের যখন বনিবনা হচ্ছে না তখন এক ছাদের নীচে থাকা ভালো দেখায় না। তুই তোর জিনিসপত্র নিয়ে এসে এই দোকান ঘরেই থাকতে পারিস। পেছনে একটা ঘর আছে। লাগোয়া বাথরুম পায়খানা। আর দু’পা এগোলেই নারুর খাবারের দোকান। জানিস তো, আমি যখন এই কেবলের বিজনেসটা চালাতাম, তখন তোর বৌদির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে এখানেই রাত কাটাতাম।
আমার আস্তানা এখন নিজের দোকানঘর।
নিজের বলছি বটে, কিন্তু আসলে ওটার মালিক তো পচাদা, আমাকে সামান্য ভাড়ায় থাকতে দিয়েছে।
কয়েক মাস হল সেই ভাড়াও মাঝে মাঝে বাকি পড়ে যাচ্ছে। আমার লাইনে মন্দা চলছে। নতুন কনেকশন বিশেষ হচ্ছে না। আবার কিছু কিছু পুরনো গ্রাহক অন্য কনেকশন নিয়ে নিচ্ছে। অনেকগুলো চ্যানেল রেট বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার স্টাফও কমতে কমতে এখন দু’জন মাত্র।
কী করব বুঝে উঠতে আরও কয়েক মাস গেল। এবার দোকানভাড়া তিন মাস ধরে বাকি। পচাদা ডেকে পাঠিয়েছিল। এখন ও ঘ্যাম প্রোমোটার। বড় অফিস, অনেক লোকলস্কর, সেপাইসামন্ত। ওদেরই একজন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। বলল, প্রমথেশস্যার ডাকছেন।
উনি আবার কে?
ছেলেটা এমনভাবে তাকাল যে এটা কোন অঘা? এই এলাকায় কাজ করছে আর প্রমথেশস্যারকে চেনে না!
—দেখ চাঁদু, ক’মাসের ভাড়া বাকি সেটা খ্যাল আছে? দোকানে বসে বলছ বাড়িটার মালিককে চেন না?
ওঃ পচাদা! উনি কবে থেকে প্রমথেশস্যার হলেন?
ছেলেটা আমার কলার মুচড়ে ধরে হিন্দি সিনেমার ভিলেনের চোখে তাকাল।
আমি আস্তে করে বললাম—শোন, তুমি বোধহয় নতুন। এটা জান না যে আমি পচাদার, থুড়ি প্রমথেশস্যারের ভায়রাভাই? কোনো ফোতো ভাড়াটে নই? তোমার স্যার যদি জানতে পারেন যে তুমি ওনার ব্রাদার ইন ল’র গায়ে হাত তুলেছ—
ঢপ দিচ্ছ?
আমি হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে একদিকে ঘাড় কাত করলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বড় করে হাই তুলে বললাম—চলো, তোমার বাইকের পেছনে বসে যাব।
পচাদা বেশ কিছু লোকলস্কর নিয়ে বসেছিল। দুজনকে চিনতে পারলাম। চশমা চোখে ভারি কনফিডেন্ট দেখাচ্ছে যে লোকটা ও হল আর্কিটেক্ট, আর পানখাওয়া ক্ষয়াদাঁতে ফিকফিক করে হাসছে লোকটা অবিনাশ উকিল। ওর টালিগঞ্জ থানায় ভাল লাইন আছে।
পচাদার টেবিলে একটা করপোরেশনের ম্যাপ বিছানো। চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই আমি আম্পায়ারের ওভার বাউন্ডারি সাইনের মত করে হাত তুললাম, তারপর বললাম—তুমি না মাইরি পারো বটে! আমি তোমার ভায়রা, আর তুমি একটা ফালতু চামচাকে পাঠিয়েছ যে ব্যাটা ঠিক করে কথা বলতে জানে না? যদি তোমার গিন্নি জানে যে, যাকগে। ফোন কর নি কেন?
সন্নাটা! সন্নাটা!
পচাদা চোখ কুঁচকে আমাকে দেখল, তারপর হেসে ফেলে আমাকে বসতে বলে সেই সেপাইটাকেই কফি আনতে পাঠাল।
আশকথা পাশকথার পর বলল, দেখ নীলু। তুই একা সামলাতে পারছিস না, ভাড়াও বারবার বাকি পড়ছে। কী ভাবছিস?
আমি হতাশ, বলি—বকেয়া ভাড়ার টাকা শোধ দেব। একটু সময় দাও। কারেন্ট ভাড়া যে করে হোক, দিয়ে দেব।
এভাবে চলতে পারে না। না, না; অন্য কিছু ভাব, রোজগার বাড়াতে হবে।
কী করব বল, আমার মাথায় কিছু আসছে না।
উমম, এক কাজ কর। তুই বিল্লুকে নিয়ে নে।
বিল্লু? কে বিল্লু?
আরে, ওই যে ছোকরাটা তোকে ডেকে নিয়ে এল।
আমার হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। একে তো পয়সা আসছে না, তায় আর একটা লোক লাগাও। আবার ওই ইডিয়টটাকে!
পচাদা, থুড়ি প্রমথেশস্যার মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
শোন, ও তোর ওখানে পার্টটাইম ডিউটি করবে। চা-জলখাবার দিবি। বাকি সময় তো আমার লোক। আর ওকে আন্ডার-এস্টিমেট করিস না, খুব কাজের ছেলে। দেখবি, তোর আয় হু হু করে বেড়ে যাবে।
তা খেল দেখাল বটে বিল্লু। আয় বাড়ল, নতুন কাস্টমার এল, কিছু পুরনো গ্রাহক চলে গেল। যাবার আগে কমপ্লেইন করে গেল। তাতেই জানতে পারলাম ওর রহস্য। শ্রীমান রোজ সন্ধ্যে সাতটায় ও রাত এগারোটায় নিয়ম করে কিছু গ্রাহককে ব্লু-ফিল্ম দেখায়। তাদের আলাদা কার্ড, এবং কিছু আলাদা দক্ষিণা। সেই টাকাটা পচাদাকে পৌঁছে দেওয়া হয়, বকেয়া ভাড়া শোধ না হওয়া অব্দি। গোড়ায় খুব খারাপ লেগেছিল। পচাদার কাছে গিয়ে নালিশ করলাম, বিল্লুকে সরিয়ে নিতে বললাম। পচাদা অম্লানবদনে বলল যে তার আগে আমি যেন ভাড়ার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি, নইলে দোকান খালি করে দিই।
ফিরে এসে গুম হয়ে বসেছিলাম, বিল্লু কফি নিয়ে এসে বলল, রাগ কোর না বস। ভেবে দেখ, তুমি না দেখালে অন্য কোন চ্যানেল দেখাবে। নইলে লোক্যাল চ্যানেল টিঁকতে পারবে না। আর তোমার কলার ধরেছিলাম না বুঝে, তোমাকে চিনতাম না যে! অব গুসসা থুক দো!
তোমার ল্যাপিতে কনেক্ট করে দেব, চুপচাপ রাত্তিরে দেখে গা গরম করে শুয়ে পড়।
আস্পর্দা দেখ!
ঘাড় ধরে দোকান থেকে বের করে দেব?
কিন্তু - -কিন্তু, বকেয়া বাড়ি ভাড়া? অতগুলো টাকা!
আমি উঠে গিয়ে একটা জলের বোতল পুরোটা গলায় ঢাললাম।
মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর।
বিল্লু রয়ে গেছে, আমার দোকানদারি চলছে; আর আমি এখন নিয়মিত আমার ঘরে ঘুমুতে যাবার আগে রোজ একটা নীল ছবির সিডি নিজের কম্পিউটারে লাগাই।
না, আমার সংকোচ কেটে গেছে। কোন অপরাধবোধ নেই। ধীরে ধীরে এটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, ভালো লাগছে। এ একটা অন্য দুনিয়া। এর রাজ্যে আগে আমার প্রবেশ ছিল না, শুধু কিছু ভাসা ভাসা ধারণা ছিল। বলাই বাহুল্য, এই লাইনের সাপ্লায়ার হল বিল্লু; নিয়মিত সিডি এমপিথ্রি’র জোগান দিয়ে যায়। কিন্তু আমরা এ নিয়ে কোন কথা বলি না। ও রোজ দুপুরে একটা নতুন সিডি এনে আমার টেবিলের ডানদিকের ড্রয়ারে রাখে আর সেখান থেকেই আগের দিনেরটা নিয়ে যায়।
হ্যাঁ, শোভা আমার জীবনে আর ফিরে আসেনি। চেষ্টা করেছিলাম, হাঁকিয়ে দিয়েছিল। ওকে দোষ দিই নে, কিন্তু আমার কী দোষ? আমি নিজের মত একরকম ভালই ছিলাম। ওকে কে বলেছিল এই ল্যাবেন্ডিসের জীবনে জবরদস্তি এন্ট্রি নিয়ে সব এলোমেলো করে দিতে?
মা একটা গান গুন গুন করত—মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা।
খবর পাই শোভা এখন টাটা স্কাইয়ের ওই অফিসে বড় দায়িত্ব সামলাচ্ছে। ওর ভাল হোক।
পচাদার কথায় বুঝতে পারি যে শোভা এখন ওর নাগালের বাইরে। ওর কথা উঠলে বিরক্ত হয়। বিড়বিড় করে বলে—অকৃতজ্ঞ!
একদিন পচাদা আবার ডেকে পাঠাল। কী জ্বালা! বিল্লু ম্যাজিকে আমার বাকি ভাড়া ও বাজারের ধার তো কবেই চুকে বুকে গেছে।
আজও অফিসে সেই আর্কিটেক্ট ও দেঁতো উকিল বসে।
আমাকে দেখেই পচাদা চেয়ার থেকে উঠে আয়-আয় করে হাত ধরে টেবিলের একদিকে ওই উকিলব্যাটার পাশে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।
একরাউন্ড চা আর সিগ্রেটের পর পচাদা আসল কথায় এল।
—-বুঝলি নীলু, তোর তো কাজকম্ম ভালই চলছে। বিল্লুর থেকে সব খবরই পাই। এবার তোর একটা ঠাঁই হওয়া দরকার।
আমি কিছুই বুঝলাম না। হঠাৎ এত দরদ!
—আরে ওই দোকানঘরের পেছনে একটা গুদামঘরে সারাজীবন কাটবে নাকি? তোর একটা নিজের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হওয়া দরকার। আর সংসারধর্ম করবি তো?
— কী যে বল! আমার নিজের একটুকরো জমি আছে—পাটুলির ওদিকে। আর আমি তো একবার বিয়ে করেছি।
— শোন, ওই জলাভূমির ধারের ওই জমি কোন কাজের না। ওখানে করপোরেশন একটা বড় বাজার বানাবে, আমি ওদের ম্যাপ দেখেছি। ওখানে কেউ বাড়ি বানাতে পারবে না। তুই পরে কিছু কমপেন্সেশন পেয়ে যাবি, ব্যস।
— খারাপ কি!
— দূর ব্যাটা ল্যাবেন্ডিস! তোর জন্যে আমার একটা প্ল্যান আছে।
উঃ, কবে যে এরা আমার জন্যে প্ল্যান করা বন্ধ করবে!
—শোন, ভাল করে বাঁচতে বাড়ি ও নারী দুটোই দরকার। আমি একটা এপার্টমেন্ট বানাচ্ছি, চারতলা, এই নাকতলার কাছেই। তোকে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট দিয়ে দেব। আর ছাঁদনাতলায় বসার ব্যবস্থাও করব।
—রক্ষে কর। আমার ফ্ল্যাট কেনার মত পয়সা নেই। আর বিয়ে কি রোজ রোজ হয় নাকি?
— আরে, তোদের ওই বিয়ে তো পুতুলখেলা। শোভা খুব ধড়িবাজ মেয়ে। তোকে ডিভোর্স দেয় নি। ওদিকে অফিসের বসের সঙ্গে ইন্টুমিন্টু চলছে।
— পচাদা, যাই হোক ও তোমার শালী, আমার বউ। ওকে নিয়ে এভাবে অফিসে বসে কথা বলা আমার ভাল লাগছে না।
দেঁতো উকিল সরু গলার চড়া আওয়াজে তিড়বিড় করে উঠল।
—নীলুবাবু, ঘাবড়াচ্ছেন কেন? আপনার দাদার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। আমরাই নন-কনজুমেশন অফ ম্যারেজ চার্জ এনে তাড়াতাড়ি আপনার ডিভোর্সের ডিক্রি পাইয়ে দেব। আপনাকে এ্যালিমনি দিতে হবে না। কোন ফীস লাগবে না। আপনি খালি পিটিশন সাইন করে দিন।
আমি ওর দিকে না তাকিয়ে পচাদাকে বললাম – যদি আর কোন কাজ না থাকে তো আমি বাড়ি যাই।
—আরে তোর দেখি এখনও খুব আঠা! বোস, বোস; আসল কথাটাই তো বলা হয় নি।
আমি ভাবলেশহীন মুখে একটা চেয়ার টেনে আবার বসে পড়লাম। কফি এল।
পচাদার ইশারায় আর্কিটেক্ট লোকটি একটা নীলমত কাগজ ব্রিফকেস থেকে বের করে টেবিলের উপর বিছিয়ে দিল। একটা ম্যাপ, তাতে নানারকম নকশা।
আমার হঠাৎ খুব হাসি পেল।
—কী ব্যাপার? কোন গুপ্তধনের খোঁজ পেলে নাকি? সেই ‘পায়ে ধরে সাধা, রা নাহি দেয় রাধা’?
—-আরে কাউকে পায়ে ধরে সাধতে হবে না। শুধু একটা সই করবি, ব্যস।
—মানে?
আর্কিটেক্ট মুখ খুলল।
নাকতলার লাগোয়া এই জমিটায় আমরা একটা চারতলা এপার্টমেন্ট তুলছি, নকশা পাশ হয়ে যাবে, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুমি একটা ফ্ল্যাট পাবে।
কী আবোল তাবোল বকছেন! আমি ফ্ল্যাটকেনার টাকা কোথায় পাব?
ধ্যেৎ, তোমার কোন টাকা দিতে হবে না, তুমি তো এই জমিটার মালিক!
এরা কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছে? আমার এখন খিদে পাচ্ছে। এসব ভাল লাগছে না।
পচাদা, এসব কী? তুমি ফ্ল্যাটবাড়ি তোলো গে যাও, আমি কেন ফ্ল্যাট কিনতে যাব? মিনিমাগনা? আর আমি কিসের জমির মালিক? আমার জমি তো পাটুলিতে।
—ওরে ল্যাবেন্ডিশ, কথাগুলো মন দিয়ে শোন। তুই ফ্ল্যাট কিনবি না, জমিটা কিনবি, আর আমি তোকে জমির মালিক হিসেবে একটা ফ্ল্যাট দেব। বাকি ফ্ল্যাট বেচে দেব। বুঝলি?
— না, বুঝলাম না। আমি খামোকা এই জমি কেন কিনতে যাব? টাকা কোথায় পাব?
তারপর ওরা যা বলল তাতে আমার খিদে লোপ পেল।
এই জমিটার দাম দু’লাখ টাকা। তুই তোর পাটুলির প্লট বেচে দে, আমার আর্কিটেক্টকে। সেটা দিয়ে নাকতলার গায়ে এই জমিটা কিনবি, তাতে আমি ফ্ল্যাট বানাব, তুই কিছু টাকা আর একটা ফ্ল্যাট পাবি। সব একনম্বরে, তোর কোথাও কোন খিঁচখিঁচ থাকবে না।
তুমি হঠাৎ করে এত দয়ালু কেন হলে? জমিটা নিজে কেন কিনছ না? আমার ঘাড়ে বন্দুক রাখবে?
মনে কর তাই। আমার নিজের নামে কেনার প্রব্লেম আছে। আসলে জমিটার আসল দাম পাঁচ লাখ। তিনলাখ আমি জমির মালিককে ক্যাশ দেব। রেজিস্ট্রি হবে তোর নামে, দু’লাখ টাকায়।
তোর লাভ—বিনা ঝামেলায় একটা ফ্ল্যাট পাচ্ছিস। ওই পাটুলির জমির কোন ভবিষ্যৎ নেই; ভেবে দেখ।
আমি নকশা, কাগজপত্র সব দেখব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ সব দেখেশুনে নে। তারপর ভাল লাগলে সাইন করবি। কোন জোরজবরদস্তি নয়।
হ্যাঁ, কাগজপত্র সব তৈরিই ছিল। জনৈক মণীন্দ্রনাথ দাসের নামে জমির চারকাঠার টুকরো। মন দিয়ে ম্যাপ ও নকশাটা দেখতে থাকি। ধীরে ধীরে মাথায় একটা টিউব লাইট জ্বলে ওঠে।
এই জায়গাটা – এটা আমার বউ শোভার বাড়ির কাছে না? মনে হচ্ছে যেন ওর বাড়ির খুব কাছে?
সবাই মন দিয়ে আমাকে দেখছে, কোন কথা বলছে না।
আমি মুখ তুলি—পচাদা?
পচাদা হাত তুলে থামায়। ঠিকই চিনেছিস, এটা শোভাদের বাড়ির লাগোয়া জমিটাই। ওদের বাড়িটা তিনকাঠার, সঙ্গের চারকাঠার জমিটা ওর মণিকাকার।
হ্যাঁ, ওর কাকা এতদিন বাঙলাদেশে ছিল, মানে থাকে। আমরাই খবর দিয়ে এনেছি। ওর টাকার দরকার। তাই অমন জমি পাঁচলাখে ছেড়ে দিচ্ছে। সাতদিনের মধ্যে রেজিস্ট্রি করে ফিরে যাবে। তুই নিবি তো বল, নইলে অনেক লোক লাইনে আছে।
প্রথমে মনে হল না করে দিই, ওইখানে ফ্ল্যাটে থাকলে শোভার সঙ্গে প্রায় রোজ দেখা হবার সম্ভাবনা। কেন ফালতু ঝামেলা বাড়াই!
তারপর মনে হল এই সুযোগ, রোজ শোভার নাকের ডগা দিয়ে নিজের অফিসে যাব। ওকে পাত্তা দেব না। দেখিয়ে দেব যে আমি বেশ আছি। না হাভাতে, না হাঘরে।
আমি কলম খুলে ‘এগ্রিমেন্ট টু সেল’ ডকুমেন্টে সাইন করলাম। সবাই হুররে করে উঠল।
পচাদা একটা হুইস্কির বোতল খুলল।
সব যেন স্বপ্নের মত ঘটছে। জমির সেল ডিড, রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট, করপোরেশন থেকে প্রাথমিক নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট সব রেডি। কাল বেস্পতিবার বাস্তুপুজো হবে। জমিতে পুজো করে পিলার বসিয়ে আমরা প্রসাদ খাব। তারপর রেজিস্ট্রি হবে পরশু শুক্রবার।
নাঃ, উকিলব্যাটা বেশ কাজের, সে যতই চপচপ করে পান চিবোক না কেন!
পচাদা নকশা দেখিয়ে জানতে চাইল যে ফার্স্ট ফ্লোরের কোনদিকের ফ্ল্যাট আমার পছন্দ? প্রথমে দক্ষিণ-পুব খোলা ফ্ল্যাটের ঊপর আঙুল রাখলাম। কিন্তু ওর বারান্দা মনে হল শোভার আঙিনার দিকে খোলে। তাই অন্য ফ্ল্যাট পছন্দ করলাম। পচাদা আমার পিঠ চাপড়ে দিল, অন্যেরা হেসে উঠল। তারপর পচাদা আমাকে বলল যে আমার পুজোয় না গেলেও চলবে। প্রসাদ ওরা দোকানে পৌঁছে দেবে। আমার আসল কাজ হল রেজিস্ট্রির দিনে। সেই ভাল।
সন্ধ্যে বেলা। আমি অফিস বন্ধ করে ভেতরের ঘরে যাব। বিল্লু যথারীতি নতুন সিডি দিয়ে গেছে।
দরজায় কড়া নড়ে উঠল। আমি বিরক্ত মুখে উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছি, তার আগেই কেউ অধৈর্য হাতে চার-পাঁচ বার দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। এসব কী হচ্ছে?
এক ঝটকায় দরজা খুলেই পাথর। দরজার চৌকাঠে শোভা দাঁড়িয়ে, চোখ থেকে ঘেন্না ঝরে পড়ছে।
—তুই এত নীচ?
আমি কোন কথা না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওকে দেখি—একটু মোটা হয়েছে, চেহারায় একটু কমনীয়তা।
—চুপ করে থেকে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? আমাকে চিনিস তো, এত সহজে হার মানব না। সবকটাকে জেলের ঘানি টানাব, তোদের পালের গোদা ওই পচাদা শুদ্ধু।
—কী হয়েছে বলবে?
— জালিয়াতটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাকে আমার ভিটে থেকে উচ্ছেদ করতে চাস? এত বিষ তোর মনে?
আমার পায়ের তলা থেকে যেন জমিন সরে গেছে।
তবু প্রতিবাদ করি।
বলি যে ওর কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাদের রাস্তা আলাদা হয়েছে, কিন্তু ওকে ওর বসতবাটি থেকে উচ্ছেদ করার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি। আমি নকশা দলিল সব দেখে ওর কাকার ভাগের জমিটা কিনছি, তাতে ওর কীসের আপত্তি?
ও আমাকে জানাল যে ওর কোন কাকা নেই। যে জমি আমি কিনছি সেটা আসলে হরিকাকার পাট্টায় নেওয়া জমি, যার ওপরে ওর টালির ঘর দাঁড়িয়ে আছে। ও খবর পেয়েছে যে কাল ও কাজে বেরিয়ে গেলে ভিতপুজোর নাম করে পচাদা দলবল নিয়ে এসে ওর বাড়িটা ভেঙে দিয়ে সেখানে পিলার তুলে বোর্ড লাগিয়ে দেবে। তখন ও যদি আদালতে যায়, তাহলে দশবছর মালিকানা নিয়ে সিভিল কেস চলবে।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ওর অফিসের মালিক নিজের উকিল লাগিয়ে কোর্টে পচাদার বিরুদ্ধে কেস ঠুকছে। করপোরেশনেও কাল নোটিস দেবে। আমি যদি অনেস্ট হই, তাহলে যেন কাল ওই পুজো-ফুজোর সময় ওখানে না যাই। শোভা ওদের ট্র্যাপ করতে অফিসে বেরিয়ে গিয়ে থানায় যাবে। ওরা বাড়িটা খানিকটা ভাঙা শুরু করলে পুলিশ নিয়ে ওদের হাতেনাতে ধরে ফৌজদারি কেসে খাইয়ে ঘানি টানাবে। বরাবরের মত বিষ দাঁত ভেঙে দেবে।
সকাল হল। সারারাত ঘুমোতে পারি নি। পচাদা শোভা – কেউ চায় না যে আমি ভিতপুজোর ওখানে যাই। আমার কোন রোল নেই, সাইড রোলও নয়। আমি ল্যাবেন্ডিস।
শোভার কথা সত্যি হলে পচাদারা আজ সকালে গিয়ে ওর টালির চালা ভেঙে দিয়ে পিলার তুলে পাঁচিল গেঁথে দেবে। আর শোভা মাঝপথে পুলিশ এনে ওদের হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়ে জেল খাটাবে। আমার এসব থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল।
কিন্তু আমি তো এখনও শোভার স্বামী। আমার কি কিছুই করার নেই? আমি যদি পচাদাদের থেকে জমি কিনে শোভাকে দিয়ে দিই? মানে, রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে যদি প্রোমোটারের সঙ্গে চুক্তিটা ক্যানসেল করে দিই? সে রাইট তো আমার আছে। কোন মারদাঙ্গা হবে না। শোভার জমি ওরই থাকবে। ও আমার বউ। ওর জমি যে আমারও জমি।
কিন্তু পচাদা কি আমায় ছেড়ে দেবে?
কী করতে পারে? আমার কাজ বন্ধ করিয়ে দেবে, দোকানটা কেড়ে নেবে। তখন আমি কোথায় যাব, কী করব?
সেটা তখন ভাবব। যে এতদিন ধরে বাড়ির সাহায্য ছাড়াই বিজনেস করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে-–সে কেন এত ভাববে? এত ঘাবড়াবে? কিছু না কিছু ঠিক জুটে যাবে। একটা তো পেট।
আচ্ছা, আমি যদি শোভার জমির বেদখল আটকে দিই, শোভা কি আমাকে এই লাইনে কোথাও লাগিয়ে দিতে পারবে না? ওর বসকে বলে? বা অন্য কোথাও?
সেসব পরে হবে, আগে তো আমি আমার কাজ করি।
মাঠে পৌঁছে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দেরি হয়ে গেছে। অন্তত ছ’জন মুশকো ষন্ডামার্কা লাঠি দিয়ে শোভাদের বাড়ির চালটা প্রায় ভেঙে ফেলেছে। এবার শাবল দিয়ে দেয়ালের গায়ে ঘা দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কোথায়?
আমি দৌড়ুতে থাকি। সোজা গিয়ে লোকগুলোকে বলি—পালাও, পালাও! পুলিশ আসছে। শোভা আর ওর বস পুলিশ নিয়ে আসছে। সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। ওরা অবাক হয়। আমাকে দেখে। থেমে যায়। তারপর মাঠের এককোণায় একটা চেয়ারে বসে থাকা পচাদার দিকে তাকায়।
এবার আমি পচাদাকে দেখতে পাই। আজ একটা সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরেছে। পাশে দাঁড়িয়ে বিল্লু। আমাকে দেখে ওদের ভুরু কুঁচকে গেল।
আমি একদৌড়ে পচাদার কাছে গিয়ে হাঁফাতে থাকি।
—তুই এখানে কেন এসেছিস? বারণ করেছিলাম না!
আমি আবার বলি যে শোভা পুলিশ নিয়ে আসছে, নিজের মুখে বলেছে।
ওরা হেসে ওঠে।
—দূর ব্যাটা ল্যাবেন্ডিস, কোন পুলিশ আসবে না। তার ব্যবস্থা করে এসেছি। শোভা এ জমিতে আর পা রাখতে পারবে না।
আমার মাথা ঘুরে ওঠে। এই পচাদাকে আমি চিনি না।
আমার ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে ওঠে –জমিটা আমার।
—ভাগ, এখনও রেজিস্ট্রি হয় নি। ওটার মালিক শোভার কাকা।
—সব জালি, তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। এই বাড়িটা তো তোমার নকশায় ছিল না।
— তো? এখনও তোর পাটুলির জমি বিক্রি হয় নি। তোর সঙ্গে ডিল ক্যানসেল।
তুই এখান থেকে কেটে পড়। এই, তোরা হাত চালা।
শাবল, গাঁইতি চলতে শুরু করে। ভেঙে পড়ছে দেয়াল। ধুলোর ঝড়।
আমার মাথা কাজ করে না। অন্ধের মত দৌড়ে গিয়ে একটা লোকের পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারি। লোকটা পড়ে যায়। আমি আরেকটা লোকের হাতের শাবল কেড়ে নেওয়ার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয়। আমি মাটিতে পড়ে যাই। একজন আমাকে লাথি মারে। আমি ব্যথার চোটে গড়িয়ে গিয়ে আর একজনের পায়ে কামড়ে দিই।
মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরতে থাকে। আমার বৌয়ের বাড়ি ভাঙতে দেব না।
একটা ভোঁতা কিছু মাথায় এসে লাগে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
আবছা আবছা টের পাচ্ছি। কালো কালো ঢেউ। গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে, চলে যাচ্ছে। কেউ একজন আমার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে। আমার গালে ওর ঠোঁটের স্বাদ, ওর ভারি বুকের চাপ। এই ছোঁয়া, এই গন্ধ আমার চেনা। কতদিন আগে?
কিন্তু এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। আমার আর কিছু চাই না। শুধু ঘুম পাচ্ছে।