‘তুই এখনও এখানে কী করছিস?’ স্বরটা রূঢ় না হলেও খুব সদয় বলেও মনে হল না। সিলভি যেন বিরক্ত। ‘তো আমার কোথায় থাকা উচিত?’ ইরিনা শুধোয়। ‘বাড়িতে!’ ‘বলতে চাইছিস এটা আর আমার বাড়ি নয়?’ সিলভি যে ইরিনাকে ফ্রান্স থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে অথবা বোঝাতে চাইছে সে অবাঞ্ছিত বিদেশি ঠিক তেমনটা না হলেও বলল, ‘তুই জানিস আমি কী বোঝাতে চাইছি!’ ‘হ্যাঁ, জানি। কিন্তু তুই কি ভুলে যাচ্ছিস যে আমি এখানে কাজ করি? আমার অ্যাপার্টমেন্ট, আমার সন্তানেরা এখানে?’মিলান কুন্দেরার উপন্যাস ইগনোরেন্স এর সূচনা হচ্ছে এইভাবে। প্যারিসে গত কুড়ি বছরের বাসিন্দা ইরিনা দেখছে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু সিলভির কাছে সে এখনও বিদেশী। সিলভির প্রতিক্রিয়া তাকে সচেতন করে তুলছে যে নিজেকে যতই ফরাসি নাগরিক বলে মনে করুক না কেন, ফরাসিদের কাছে সে এমন এক অভিবাসী যার সঠিক জায়গা হল তার মাতৃভূমি। নিজের অবস্থার সঙ্গে হোমারের মহাকাব্যের নায়ক অডিসিউসের তুলনা করে তার মনে হচ্ছে ‘ঘরে’ ফেরা উচিত। ক্যালিপসোর দেশে নির্বাসন আর স্মৃতিভারাতুর মনের দোলাচল সত্ত্বেও অডিসিউস বাস্তবিকই আনন্দবিলাসের জীবন (dolce vita) কাটিয়েছিল। সহজ খুশির সে জীবন। কিন্তু তাও তো সে বিদেশে আনন্দের জীবন ছেড়ে স্বগৃহে ঝুঁকির প্রত্যাবর্তনকে বেছে নিয়েছিল। ইরিনার এই সংকট কি ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকা চেক লেখক মিলান কুন্দেরার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয়? ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী মহলে কমিউনিস্ট শাসনকালে চেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের সাহসের কারণে সাদর আমন্ত্রণ পেলেও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার পরে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সাদামাটা চলনসই ফরাসি ভাষায় লেখার জন্য তাঁর সমালোচনাও হয়েছিল। তবু মিলান কুন্দেরা ফরাসি সমাজ-ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে কী ভাবতেন?
‘চেকোস্লোভাকিয়ায় আমার সম্পূর্ণ যৌবনকে যে আত্মিক পরিবেশ ঘিরে ছিল তা হল ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা।’উনিশ শো আটত্রিশে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশবিশেষ নাৎসি জার্মানির দখলে চলে যাওয়া আর সে ব্যাপারে যুক্তরাজ্য আর ইটালি ছাড়াও ফ্রান্সের সম্মতি আছে দেশবাসী এমন মনে করা সত্ত্বেও ফ্রান্সের প্রতি চেক বুদ্ধিজীবীদের প্রীতিমিশ্রিত শ্রদ্ধায় কোনও ভাঁটা পড়েনি। মিলান কুন্দেরার মতে ফরাসি রাষ্ট্রনায়করা কখনও সেই সপ্রশংস মুগ্ধতার হেতু ছিলেন না। ফরাসি সংস্কৃতি – ফরাসিদের চিন্তাভাবনা, সাহিত্য, শিল্পই কুন্দেরার প্রজন্মের চেক বুদ্ধিজীবীদের মন জয় করেছিল। এই কারণেই বোধহয় রভ্যু দে দ্যু মোঁদ (Revue des deux Mondes) পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখক ফ্রান্সকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হিসেবে গণ্য করেছিলেন।
সম্প্রতি প্যারিসে ৯৪ বছর বয়েসে চলে গেলেন যে চেক-ফরাসি লেখক, তিনি প্রায় অর্ধেক জীবন কাটিয়েছিলেন ফ্রান্সে। তার চেয়েও বড় কথা মিলান কুন্দেরা নিশ্চিত ছিলেন পরবাস তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর একেবারে প্রথম দিকের রচনাতেই এই প্রেমের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় যখন তিনি ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিনেরের কবিতা চেক ভাষায় অনুবাদ করছেন। এ ছাড়াও তাঁর উপন্যাসে ফরাসি লেখকদের উল্লেখ আর উদ্ধৃতি যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
এই পারস্পরিক ভালোবাসার মূলে ছিল ষাটের দশকে উভয় দেশের বুদ্ধিজীবীদের কমিউনিজ়মের কতগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকর্ষণ – অথচ সেই আদর্শে পরিচালিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্রব পরিত্যাগ করা। কুন্দেরার প্রথম উপন্যাস দ্য জোক-এর নায়ক এক যুবক যে তার প্রেমিকার উদ্দেশে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছিল বলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ফরাসি পাঠকদের মধ্যে উপন্যাসটি প্রভূত জনপ্রিয়তা পায়। ফরাসি কবি ল্যুই আরাগঁ সে উপন্যাসের ফরাসি সংস্করণের ভূমিকায় লেখেন ‘সেটি শতাব্দের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম’।
ল্যুই আরাগঁ-ই কুন্দেরার সঙ্গে ফরাসি প্রকাশক শার্ল গালিমারের (Charles Gallimard) পরিচয় করিয়ে দেন যিনি শেষমেশ চেক কথাকারকে ফ্রান্সে অভিবাসনের ব্যাপারে বুঝিয়ে রাজি করাবেন। ইতিমধ্যে কুন্দেরাকে চেক কমিউনিস্ট পার্টি বহিষ্কার করেছে। শার্ল গালিমারের যোগাযোগের সূত্রেই তিনি ১৯৭৫-এ ব্রিট্যানির রেন (Rennes) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজ পান। কুন্দেরার ভাষ্যে, ‘আমি ফরাসি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হলেও আমার এখানে আসার কারণ ফরাসিরা আমাকে চেয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে শুধু যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাই নয়, নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে এখানে আসার সব ব্যবস্থা করেছিলেন।’ উনিশ শো চুরাশিতে নিউ ইয়র্ক টাইমস্-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, ‘আর আমি সৌভাগ্যবান যে এখানে আমার ভালো লেগেছে – ধরুন জার্মানিতে আমার যেমন লাগে তার চেয়ে অনেক ভালো।’
লক্ষণীয় কুন্দেরা এ কথা বলছেন ফ্রান্সে আসার ন’বছর পরে। কিন্তু ফরাসি সংবাদপত্র ল্য মোঁদ (Le Monde)-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লেখকের স্ত্রী ভেরা কুন্দেরার কথায় ফ্রান্সে প্রথম পদার্পণের সময় তাঁর স্বামী দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭৫ এর গ্রীষ্মে ৭৩০ দিনের ভিসা নিয়ে প্রাগ শহর ছেড়ে এলেও মিলান কুন্দেরা ভাবতে পারেননি ফ্রান্সে আজীবন থেকে যাবেন। আগমনের কয়েক মাস পরেই জার্মান পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘স্থায়ী অভিবাসীর জীবন আমাকে বিষণ্ণ করে তুলবে।’
অথচ ১৯৮৪-তে মিলান কুন্দেরা ফ্রান্সের নাগরিকত্ব পেলেন। তখন তাঁর সর্বাধিক খ্যাত উপন্যাস দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং (The Unberarable Lightness of Being) সবে বেরিয়েছে। প্রাগ শহরের পটভূমিকায় সে উপন্যাসটি রচিত হয় চেক ভাষায় – পরে প্রথমে ফরাসি এবং তারও পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। আর সেই বছরেই ফরাসি টেলিভিশনকে দেওয়া ইন্টারভিউতে কুন্দেরা বললেন দেশান্তরে বসবাস কথাকার হিসেবে তাঁর রচনাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
আপোস্ত্রফ (Apostrophe)-কে দেওয়া সাহিত্যের টক-শো-তে বললেন, ‘আমার মত কোনও মানুষ সম্পর্কে – যাঁকে দেশ থেকে প্রায় তাড়িয়েই দেওয়া হয়েছে – এমন একটা কথা বলা হয় যা বহুব্যবহারে জীর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা এমন পরিস্থিতিকে ট্র্যাজিক বলি – আর বাস্তবিকই এটা ট্র্যাজিক। কিন্তু সৌভাগ্য যে সব মানবিক পরিস্থিতির মধ্যেই আপাত-স্ববিরোধী একটা ব্যাপার থাকে। আর সেটাই সব সময় আমাদের বাঁচিয়ে দেয়। আমার ক্ষেত্রে এটা হল আমি আমার স্বদেশকে হারালেও ফ্রান্সে এসে আমি ভীষণ, ভীষণ খুশি। ফ্রান্স আমার নির্বাচিত দেশ – আমি তাকে বেছে নিয়েছি।’
সে ভালোবাসা এমনই যে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে মিলান কুন্দেরা ফরাসি ভাষাতেই সৃষ্টিশীল গদ্য রচনা শুরু করলেন। তাঁর এই রূপান্তরকে সাহিত্য-সমালোচকরা দুভাবে নিলেন। কেউ কেউ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন পুনরায় এক ‘অসাধারণ আত্ম-আবিষ্কার’। আবার অনেকে মনে করলেন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তাঁর রচনা হয়ে পড়েছে নিস্তেজ, ম্যাড়মেড়ে।
মিলান কুন্দেরা স্বয়ং বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছিলেন? তাঁর সামনে কোন্ পথ খোলা ছিল? তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন: ‘আমি কি ফ্রান্সে অভিবাসী এক বিদেশী হিসেবে থাকছি – নাকি ফ্রান্সের কোনও সাধারণ নাগরিক হিসেবে আছি যে বইও লেখে? অর্থাৎ ফ্রান্সে আমার জীবনটা কি কোনও প্রতিস্থাপিত জীবন – বিকল্প জীবন? নাকি সত্যিকারের জীবন? আমি কি যেখানে থাকছি সেখানকার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে বাঁচার চেষ্টা করছি?’
নিউ ইয়র্ক টাইমস্-কে লেখক বললেন, 'ফ্রান্স আমার নির্বাচিত দেশ – যার অর্থ আমি চারপাশে ফরাসিদের দ্বারা পরিবৃত, আমার ফরাসি বন্ধুবান্ধব হয়েছে – আমি ফরাসি লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি। এখানকার বৌদ্ধিক জীবন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আর আমাদের কাছে তার অর্থ হল আমরা এমন বন্ধুবান্ধব পরিবৃত হয়ে আছি যারা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে আমাদের বাঁচায়। অর্থাৎ ফ্রান্সে বসবাস করে স্বগৃহে আছি এমন অনুভব করছি কি না তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল এখানে এমন সহৃদয় বন্ধুরা আছেন যেন মনে হয় আমি নিজের দেশেই আছি।’ তিনি আরও বলেছিলেন যে ফরাসি ভাষায় এমন কোনও একটি শব্দ নেই যা ‘গৃহ’ বোঝায়: শেষমেশ আমরা 'গৃহ' বলতে যা বুঝি তা মরীচিকা বা কল্পনা নয়ত?
ফরাসিদের দেশে লেখকের বাহ্যিক জীবন সম্পর্কে উপলব্ধি যাই হোক না কেন, নির্বাসন, অভিবাসন, স্বদেশে বা স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের মত বিষয়গুলো কিন্তু মিলান কুন্দেরার উপন্যাসে ফিরে ফিরে এসেছে। এটা সবচেয়ে প্রথমে স্পষ্ট বোঝা গেল দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস্ অব বিয়িং-এ সাবিনার চরিত্রে। সাবিনা জেনেভায় বসবাসকারী চেক অভিবাসী। নিজস্ব সত্ত্বার ভার আর ভারহীনতা যেন তার অভিবাসী চরিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ, স্বদেশে ফিরে যেতে না পারলে তাকে ভারহীন জীবন বইতে হবে। বস্তুত, যেহেতু সাবিনা আর কোনও দিনই চেকোস্লোভাকিয়ায় ফিরে গেল না, তাই সে নভেলের সবচেয়ে ভারহীন চরিত্র – ব্যক্তি অথবা স্থানের সঙ্গে তার কোনও সংলগ্নতা তৈরি হয়নি, তাদের প্রতি কোনও আনুগত্য গড়ে ওঠেনি।
লেখক নিজে অভিবাসী জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্নভাবে তিনি সেই অভিযোজনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এমনও বলেছেন যে তাঁর কাছে নির্বাসন 'অসহনীয় ভারহীনতা' (unberarable lightness) নয় – তা হয়ত ভারহীন, কিন্তু অসহ্য কখনই নয়। কোনও অভিবাসীর কাছে স্বদেশে ফেরার আকর্ষণ কতটা? তাঁর নবম উপন্যাস ইগনোরেন্স (Ignorance) এর আগে নির্বাসনে থাকা অথবা অভিবাসী মানুষের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিয়ে মিলান কুন্দেরা কখনও সবিস্তারে লেখেননি। কিন্তু ২০০২-তে প্রকাশিত ওই উপন্যাসের গোড়াতেই তিনি হোমারের মহাকাব্য অডিসি-র উল্লেখ করে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। ভ্রমণে ক্লান্ত অডিসিউস বা ইউলিসিসের ঘরে ফেরার আকুতির উল্লেখ করে বলা হল: ‘অজানার (রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের) উদগ্র স্পৃহার বদলে তিনি বেছে নিলেন পরিচিতির (প্রত্যাবর্তন) মহিমাকে।' কুন্দেরার অনেক উপন্যাসের মত এখানেও মূল বিষয়টির নির্মাণে কাজে লাগানো হচ্ছে প্রাগে ফিরে যাচ্ছে এমন দুই চেক অভিবাসীর জীবনকে – যারা নভেলের কেন্দ্রীয় চরিত্রও বটে। ইরিনা, যে ফ্রান্সে বসবাস করছিল, আর তার সঙ্গী জোসেফ, যে ডেনমার্কে থাকত। উপন্যাসের সূচনায় ইরিনার বন্ধু তাকে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। বন্ধুর মতে সেটা হবে ‘মহান প্রত্যাবর্তন’। উপন্যাসে ফিরে ফিরে এসেছে এই মহান প্রত্যাবর্তনের ধারণাটি। কুন্দেরা বলতে চেয়েছেন যে ইথাকায় অডিসিউসের ফিরে যাওয়া যদি মহান প্রত্যাবর্তনের উদাহরণ হয়, তা হলে তেমন ঘরে ফেরা আজকের যুগে আর সম্ভব নয়। তাঁর প্রশ্ন ফিরে যাওয়ার মহাকাব্য কি আজকের যুগে প্রাসঙ্গিক? ইথাকার সমুদ্রতীরে জেগে উঠে অডিসিউস যদি দেখত যে পুরোনো অলিভ গাছটিকে কেটে ফেলা হয়েছে আর চারপাশের কিছুই সে চিনতে পারছে না, তা হলেও কি সে মহান প্রত্যাবর্তনের সঙ্গীত শুনতে পেত? বোধহয় লেখক বলতে চেয়েছেন এ যুগে ভূদৃশ্যের পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটছে যে কয়েক বছর অতিক্রান্ত হলেই প্রত্যাবর্তন আর প্রত্যাবর্তন থাকে না। কারণ যে ফিরে যাচ্ছে তাকে এমন একটা জায়গায় ফিরে যেতে হয় যা তার ফেলে আসা স্থান বা দেশটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তবে শুধু যে বাহ্যিক পরিবর্তনগুলোই এই প্রত্যাবর্তনকে অসম্ভব করে তোলে তা নয়। অন্তরেও পরিবর্তন ঘটে – মনগুলো বদলে যায়। ইরিনা যখন প্রাগে ফিরেছে তখন তার সুইডিশ প্রেমিক ইরিনার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে ইংরেজিতে – এমন একটা ভাষা যা ইরিনা প্রায় বোঝেই না। ‘মহান প্রত্যাবর্তনে কী অদ্ভুত গেরো’! ‘রাস্তায় বেরোলে, চারপাশে চেক স্বদেশীদের সান্নিধ্যে কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরোনো পরিচয়ের আভাস হয়ত তাকে আদরে ছুঁয়ে যায়। সে কটি মুহূর্তের জন্য সে খুশিও হয়। কিন্তু বাড়ি ফিরে এলেই আবার সে নির্বাক বিদেশী।’ মহান প্রত্যাবর্তন যে অসম্ভব তার একটা কারণ নির্বাসিত জীবনে অভিবাসী মানুষটির যে বদল ঘটে, তা দেশে ফেরার পরেও আড়ালে থাকে না। ইরিনার বন্ধু যখন মহান প্রত্যাবর্তনের কথা উত্থাপন করেছিল, তখন তাকে স্থায়ী ঘরে ফেরা বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। কিন্তু উপন্যাস যতই এগিয়েছে, ততই দেখা গেল স্বদেশ থেকে দূরে কিছুদিন নির্বাসনে থাকলেই দেশের সঙ্গে বন্ধন এমন সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়ে যায়, যে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং প্রকাশের অব্যবহিত পরেই ১৯৮৪-তে মিলান কুন্দেরা জানিয়েছিলেন স্বদেশের পাঠকদের সঙ্গে তাঁর সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনকী ব্যক্তিগত পরিধিতে স্বীকারও করেছিলেন যে ‘তা হলেও খুব একটা খারাপ লাগেনি’। তিনি আরও বলেছিলেন, 'ফরাসি জনগণ, অথবা আমার দেশবাসী ছাড়া অন্য যে কোনও দেশের জনগণ সম্পর্কেই আমার ধারণাটা সম্পূর্ণ বিমূর্ত, সম্পূর্ণ অজানা। শুনতে অদ্ভুত হলেও এটা আমাকে বাঁধনহারা করে তুলেছিল – স্বাধীনতা দিয়েছিল। তোমার খুব পরিচিত মানুষের একটা দাবি থাকে, তাদের পছন্দ-অপছন্দ তোমার জানা। খুব সচেতনভাবে না হলেও, এই পরিচিতির একটা প্রভাব তোমার ওপর থাকে। জনগণের সঙ্গে এই অন্তরঙ্গতা বিরক্তির কারণ হতে পারে, বিশেষত যদি দেশটা ছোট হয়। হঠাৎই দেখা যায় তারা সবাই তোমাকে চেনে! সেই কারণেই বোধহয় চেকোস্লোভাকিয়ায় আমার বইপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে আমি যখন দুটি উপন্যাস লিখেছিলাম, তখন দারুণ মুক্তির স্বাদ উপভোগ করেছিলাম।’
লক্ষণীয় যে ফ্রান্সে আসার পরই মিলান কুন্দেরা সেই রচনাশৈলী নির্মাণ করেন যার জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। অত্যন্ত আত্মসচেতন সে লেখার ধরন যেখানে প্রায়ই লেখকের নিজস্ব কণ্ঠস্বরের অনধিকার প্রবেশ টের পাওয়া যায়। কানাডার লেখক এবং সাহিত্য-সমালোচক ফ্রঁসোয়া রিকার (François Ricard ) বলছেন কুন্দেরার রচনা সমগ্রকে তিনটি পৃথক ভাগে ভাগ করা যায়: প্রথম ভাগটি ষাটের দশকে প্রাগে বসবাসকালীন রচিত চারটি উপন্যাস। দ্বিতীয়টি রেন্ আর প্যারিসে থাকাকালীন (সত্তরের দশকের শেষ আর আশির দশকের গোড়ায়) চেক ভাষায় রচিত নভেল। চেকোস্লোভাকিয়ায় থাকার সময়ে রচিত চারটি উপন্যাসের ভৌগোলিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুরূপ। পরের তিনটি রচনায় দেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে দোলাচল লক্ষ করা যায়। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনাগুলো চেক ভাষায় হলেও লিখনশৈলীতে চেক পাঠকদের থেকে কুন্দেরার সদ্য অর্জিত মুক্তির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তৃতীয় পর্যায়ে মিলান কুন্দেরা যখন ফরাসি ভাষায় লিখতে শুরু করলেন, তখন দেখা গেল পশ্চিম ইউরোপ, বিশেষত ফ্রান্স সেখানে প্রত্যক্ষভাবে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ কুন্দেরার লেখক জীবনে তিনটি পরিষ্কার বিবর্তন ঘটেছে। আর যেহেতু লেখক নিজেই বলেছেন যে পাঠকদের প্রত্যক্ষ প্রভাব লেখকের ওপর থাকে তিনি সব সময় সে বিষয়ে সচেতন না হলেও, তাই এমন প্রত্যাশা করাই যায় যে কুন্দেরার শেষের দিকের উপন্যাস ইগনোরেন্স-এ এই ক্রমপরিবর্তন তুলনায় স্পষ্ট হবে। এখানেই আবার বহুদিন পরে চেক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপাদানগুলো ফিরে এসেছে যা দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং এর পরে আর বিশেষ দেখা যায়নি। তবে কুন্দেরা সাহিত্যে তাঁর পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন কি না তা স্পষ্ট নয়। সেদিক থেকে মনে হয় যে এই ক্রমবিবর্তন বাস্তবিকই ইচ্ছাকৃত বা সচেতন নয়। উনিশ শো উনআশির এক সাক্ষাৎকারে লেখক বলেছিলেন, ‘যদিও আমি চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে এসেছি ৪৫ বছর বয়সে, লেখক হিসেবে আমার পেশাগত জীবন আসলে শুরু হয়েছিল তিরিশে। অর্থাৎ বলা যায় আমার সৃষ্টিশীল জীবনের বৃহত্তর অংশ কেটেছে ফ্রান্সে। আমার সঙ্গে ফ্রান্সের বন্ধন যতটা ভাবা হয় তারচেয়ে বেশি।’ এই সম্পর্ক শুধু সাহিত্যের ভাবলে ভুল হবে, কারণ তিনি শেষমেশ ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
তা হলে মিলান কুন্দেরাকে কি ফরাসি লেখক বলে পরিচয় দেওয়া যায়? ফরাসি ভাষায় রচিত তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস, অর্থাৎ স্লোনেস এবং আইডেনটিটি প্রকাশের পরেও চেকোস্লোভাকিয়ার মানুষ আর জীবন তাঁর রচনায় ফিরে ফিরে এসেছে। ইগনোরেন্স এর ইরিনার মতই – যে ফরাসি সমাজের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট যে তার পক্ষে মহান প্রত্যাবর্তন অসম্ভব – কুন্দেরাও ফ্রান্সের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক অনুভব করতেন। এই অর্থে ইগনোরেন্স আত্মজৈবনিক। এমন মনে করা হয়ত ভুল হবে না যে লেখক নিজেই ভেবেছিলেন তাঁর পক্ষে আর চেকোস্লোভাকিয়ায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না কারণ যে দেশটা তিনি ছেড়ে এসেছিলেন, সেটাই তো আর নেই। তবে এটা ঠিক যে ফরাসি ভাষায় রচিত অন্য উপন্যাসের তুলনায়, খুব সচেতনভাবে না হলেও ইগনোরেন্স এর মাধ্যমেই লেখকের চেকোস্লোভাকিয়ায় সাহিত্যিক প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। আর এই সাহিত্যিক প্রত্যাগমনই তাঁকে বুঝিয়েছে যে দেশে তাঁর জন্ম সেখানে সশরীরে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। ইগনোরেন্স-এ চেক অস্তিত্ব বিষয়বস্তুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও এর দৃষ্টিভঙ্গিটা ফরাসি – কারণ সে দেশে অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতার ছবিই উপন্যাসে আঁকা হয়েছে। মিলান কুন্দেরার নির্বাসনের জীবনে যে ধারাবিকাশ ঘটেছিল, তার শ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য বহন করছে এই ফরাসি-চেক মেলবন্ধন।
মিলান কুন্দেরার এই ক্রমবিকাশ যদি ইগনোরেন্স-এ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে, তা হলে একবার তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য জোক (The Joke)-এ ফিরে যাওয়া যাক। ব্যক্তিগত পরিস্থিতি অনুযায়ী কীভাবে তাঁর লেখক জীবনের বিবর্তন ঘটেছে সে বিষয়টি তা হলে স্পষ্ট হবে। দ্য জোক লেখা হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ায় – ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫-র মধ্যে – আর প্রকাশ পেয়েছিল সোভিয়েত আগ্রাসনের ঠিক আগে। সে ঘটনা শেষ পর্যন্ত লেখকের নির্বাসনের কারণ হয়। ইগনোরেন্স-এ আত্মজৈবনিক উপাদান থাকলেও দ্য জোক-এ তা খুঁজে না পাওয়াই অসম্ভব! এখানে লুডভিক নামের যুবকটি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত – এমনকী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো ঘটেছে সে রসিকতা করে তার প্রেমিকাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠানোর পরে। স্পষ্টতই তার রসিকতার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছিল। পোস্টকার্ডে লেখা ছিল, 'আশাবাদ হল জনগণের আফিম! সুস্থ পরিস্থিতিতে বোকামির দুর্গন্ধ পাওয়া যায়! ট্রটস্কি দীর্ঘজীবী হোন!' লুডভিকের প্রেমিকার হাতে পোস্টকার্ডটি পৌঁছোচ্ছে সে কমিউনিস্ট দলের কোনও প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকাকালীন। বার্তাটা যেমন অভিপ্রেত ছিল সে ঠিক সেভাবে পড়ল না। পরিণামে তার প্রেমিক দল থেকে বিতাড়িত হল। অনুরূপ 'পার্টিবিরোধী' কার্যকলাপের জন্য ১৯৫০-এ কুন্দেরাও বিতাড়িত হন। স্টালিন জমানার শেষে ১৯৫৬-তে পার্টি আবার তাঁকে পুনর্বহাল করে। ইগনোরেন্স-এ যে স্বদেশের কথা বলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গ প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল দ্য জোক-এ। সেটি একটি নির্দিষ্ট, বিশেষ স্বদেশ – ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট শক্তির উত্থান-পরবর্তী চেকোস্লোভাকিয়া। উপন্যাসের শুরুতে দল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পনেরো বছর পরে লুডভিক আবার তার নিজের শহরে ফিরে আসছে। এ যেন ইগনোরেন্স-এ অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের অবতরণিকা! গোড়ায় শহরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা কোনও ভাবেই মনোরম নয়। বহির্দৃশ্য বা অন্তর্দৃশ্য কোনওটারই যেন কোনও আকর্ষণ নেই।
‘আমি শেষবারের মত সেই কুৎসিত উন্মুক্ত চত্বরটির দিকে তাকালাম। তারপরে, পেছন ফিরে, হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম।....ঘরটা ম্যাড়মেড়ে। বিছানার লাগোয়া একটা খাট, মাঝে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার। বিছানার পাশে জমকালো দেরাজওয়ালা মেহগনির আলমারি আর আয়না। দরজার পাশে একটা ছোট্ট ফাটা বেসিন।’এই দৃশ্যটি ইগনোরেন্স-এ স্বদেশে ফেরার পরে জোসেফের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয়:
‘হোটেলটি কমিউনিস্ট শাসনের অন্তিম বছরগুলোতে তৈরি। মূল চকের পাশে চকচকে আধুনিক বাড়ি – যেমন বাড়ি বিশ্বময় দেখা যায় – বাড়িটা ভীষণ উঁচু ..... আশপাশের অন্য সব বাড়ির ছাদের অনেক ওপরে গম্বুজের মত দাঁড়িয়ে।’এখানে হোটেলটি পাশের উন্মুক্ত চত্বরটিকে এমন চেপে রেখেছে যে সেটি দ্য জোক-এর চকের মতই কুৎসিত। আর জোসেফের প্রত্যাবর্তন লুডভিকের তুলনায় সামান্য আশার সঞ্চার করলেও লুডভিকের হোটেলের ভেতরের দৃশ্য আর জোসেফের বহির্দৃশ্যের বর্ণনাকে যেন মিশিয়ে দেওয়া যায়। প্রেক্ষাপট ছাড়াও এই দুই চরিত্রের অনুভূতিও অনুরূপ। লুডভিকের নিজের শহরটাকে অরুচিকর ঠেকছে:
‘শহরগুলোর এইরকম অবিকল একে অপরের প্রতিরূপ হয়ে ওঠার ঝোঁক আছে। আর এই দৃশ্যটি (যার সঙ্গে আমি শৈশব থেকে পরিচিত এবং আমার কাছে যা তাৎপর্যবিহীন) হঠাৎ আমাকে অস্ট্রাভার কথা মনে পড়িয়ে দিল – সেই খনি শহরের সাময়িক ডরমিটরি, চারদিকে খালি জনশূন্য ঘরবাড়ি আর নোংরা রাস্তাগুলো যেন কোনও শূন্যের দিকে চলেছে।'অনুরূপভাবে, ইগনোরেন্স-এ জোসেফ যখন তার নিজের শহরে ফিরে আসছে, তখন কুন্দেরার ভাষায় সে 'স্মৃতির মর্ষকামী বিকৃতিতে' ভুগছে: ‘বস্তুত, সে যা স্মরণ করতে পারছে তা শুধু তাই যা তাকে অসুখী করে তুলছে।’ লুডভিকের অবস্থাও তথৈবচ যদিও কুন্দেরা তাঁর লেখক জীবনের সেই সূচনার সময়ে বিষয়টিকে ততটা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। তবে মিলের অর্থ এই নয় ইগনোরেন্স-এ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টা যেমনভাবে প্রতিভাত হয়েছে, দ্য জোক এও ঠিক তাই। যদিও দ্য জোক এর মূল কাহিনীসূত্র কোনও ব্যক্তির নিজের শহরে এবং সেই সূত্রে তার অতীতে ফিরে যাওয়া, কুন্দেরা বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন সেটি প্রেমের কাহিনি। ইগনোরেন্স-এ কিন্তু মূল বিষয়টি হল অজ্ঞতাপ্রসূত বিষণ্ণতা যার সঙ্গে গৃহাকুলকতা আর নস্টালজিয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ‘আমার দেশ অনেক দূরে, আমি জানি না এখন সেখানে কী ঘটছে।’ এই না-জানা যে বিষণ্ণতা আর অনুতাপের জন্ম দেয় হোমারের অডিসি-তে তার থেকে পরিত্রাণের উপায় বলা হয়েছে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এ যুগে তা কি সম্ভব?
ঘরে ফেরার মনোবাঞ্ছার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে অতীত-আর্তি – ঘরের জন্য মনে কেমন করা – নস্টালজিয়া। ইগনোরেন্স এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে মিলান কুন্দেরা ব্যাখ্যা করছেন: ‘গ্রিক ভাষায় প্রত্যাবর্তনকে বলে nostos। আর algos হল যন্ত্রণা। তা হলে ‘nostalgia’ হল ফেরার অভিলাষ পূর্ণ না হওয়ার কারণজনিত বেদনা। অধিকাংশ ইউরোপীয় এই মূল ধারণাটি বোঝাতে গ্রিক থেকে নেওয়া ‘nostalgie, nostalgia’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারেন।’
‘একজন ঔপন্যাসিকের কাছে কোনও একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি নৃতত্ত্বের গবেষণাগার যেখানে তিনি বুনিয়াদি প্রশ্নগুলোর অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকতে পারেন: যেমন মানুষের অস্তিত্ব বলতে আমরা কী বুঝি?’ (‘লাইফ ইজ্ এলস্হোয়্যার’)ফ্রান্সে আসার পরে কুন্দেরার অনেক রচনার প্রেক্ষাপট তাঁর পূর্বতন দেশ অথবা তাতে নির্বাসিত চেক চরিত্ররা অন্তর্ভুক্ত। এই সব নারী পুরুষের জীবনের অগ্রগতি এবং সামাজিক পরিবেশ – তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্মৃতি বা বিস্মরণ – সব কিছুকেই যেন নিয়ন্ত্রণ করছে একটিই বিষয় – যে তারা নির্বাসিত। এর পরিণাম হল আত্মপরিচয় বিস্মৃত হওয়া অথবা বাস্তবের সঙ্গে সংযোগসূত্রটি ছিন্ন হওয়া। উপন্যাসের চরিত্রদের মধ্যে দিয়ে মিলান কুন্দেরা নির্বাসনের ধারণাকে স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা করছেন। তারা না চেক, না ফরাসি – তাদের পরিচয় যেন খণ্ডীভূত হয়েছে, ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ নির্বাসনে সেগুলো জোড়া লাগিয়ে নতুন কোনও পরিচয় তৈরি করার চেষ্টা করছে।
কুড়ি বছরের অনুপস্থিতির পরে এই অভিবাসী (কুন্দেরার পছন্দের পরিভাষা ফরাসিতে émigré) নায়ক-নায়িকা কমিউনিস্ট শাসন পরবর্তী চেকোস্লোভাকিয়ায় ফিরছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জুটছে হতাশা – তাদের মোহভঙ্গ ঘটছে। তারা দেখছে পুরোনো বন্ধুবান্ধব দূরে সরে গেছে, অনেক জায়গাও অপরিচিত ঠেকছে। এমনকী মাতৃভাষাটাও যেন অন্যরকম শোনাচ্ছে। আর নায়ক-নায়িকার নতুন জীবন অথবা নির্বাসনের যন্ত্রণা, নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়ার বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া, বিচ্ছিন্ন জীবন অথবা ঘরের জন্য মন কেমন করা স্মরণবেদনার কাহিনি শুনতে কেউ আগ্রহী নয়। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনার সময় তারা যে দুশ্চিন্তা অনুভব করেছিল তা হলে তাই ছিল যথার্থ! পুরোনো স্বদেশে পূর্বতন সহ নাগরিকদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকেই বিংশ শতাব্দে মহান প্রত্যাবর্তনকে অলীক কল্পনা বলে তাদের মনে হয়েছে।
উপন্যাসের কুশীলবদের সঙ্গে লেখকের নিজের জীবনের যোগ এখানে খুব স্পষ্ট। পার্টিতে যারা ভিন্নমত প্রকাশ করে তাদের হয়রানি বা নিগ্রহ, জোসেফের রাজনৈতিকভাবে ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ, মনস্তাত্ত্বিক ব্ল্যাকমেল, পেশাগত জীবনে অগ্রগতির জন্য দলে যোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং দেশত্যাগজনিত প্রচ্ছন্ন অস্বস্তি বা অপরাধবোধ – এ সবের চিহ্ন লেখকের নিজের জীবনে স্পষ্ট। এই আত্মজৈবনিক প্রতিধ্বনির মাধ্যমে কুন্দেরা যেন অপ্রত্যক্ষভাবে আবার কমিউনিস্ট অতীত আর নির্বাসনের আগে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে চাইছেন। তাঁকে দুবার দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, পড়ানোর চাকরি গিয়েছিল, তাঁর লেখা বই নিষিদ্ধ হয়েছিল, স্বদেশের সাহিত্যের ইতিহাস থেকে নাম মুছে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় চল্লিশ বছর পরে তাঁর চেক নাগরিকত্ব পুনরায় স্বীকার করে নেওয়া হয় যাকে স্বদেশের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে লেখকের প্রতীকী প্রত্যাবর্তন বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
যে কোনও অভিবাসীর জীবনে স্বদেশে ফেরার সুখকল্পনাটি বড় জায়গা দখল করে থাকে। হোমারের অডিসি থেকে শুরু করে পশ্চিমের সাহিত্যে মহান নায়ক আর পর্যটকের মিথকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। বিশ বছরব্যাপী অ্যাডভেঞ্চারের পরে অডিসিউস তাঁর বিশ্বস্ত স্ত্রী পেনিলোপির কাছে – তার গতানুগতিক সাধারণ জীবনে – ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তটি দুর্বোধ্য কারণ সুন্দরী, স্বর্গীয় ক্যালিপসো তাকে অনন্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জীবন দিতে চেয়েছে। ক্যালিপসোকে সে বলছে: ‘যতই বিচক্ষণ সে হোক না কেন আমি জানি মর্যাদা আর সৌন্দর্যে সে তোমার সমকক্ষ নয়।......তা সত্ত্বেও প্রতিদিন আমি চাই সেখানে ফিরে যেতে, নিজগৃহে, আমার প্রত্যাবর্তনের দৃশ্যটি স্বচক্ষে দেখতে!’
অডিসিউসের যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটে ঘরে ফেরায়। কিন্তু কুন্দেরার উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন বেদনা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রাগে ফিরে গেলেও ইরিনা তার পুরোনো পরিচয় আর খুঁজে পায় না। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে না। তার নির্বাসনের জীবন দেশবাসীর কৌতূহল উদ্রেক করে না। পোশাক-আশাক, খাবার-দাবারের রুচিও বদলে গেছে। নিজের শহরটাকেও যেন আর চিনতে পারা যায় না। এ সবই তাকে দূরে সরিয়ে দেয়, বিচ্ছিন্ন করে, সে যেন নিজের দেশে নির্বাসনে আছে বলে মনে হয়। এটা স্পষ্ট বোঝা গেল যখন ইরিনা তার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করছে। সে বরদো (Bordeaux) ওয়াইনের একটা গোটা বাক্স নিয়ে এলেও কেউ তা ছুঁয়েও দেখল না। বন্ধুদের পছন্দ কমদামী ও জনপ্রিয় পানীয় বিয়ার। মদ প্রত্যাখ্যান করাটা যেন ইরিনাকেও দূরে সরিয়ে দেওয়া। সে এত বছর পরে দেশে ফিরে এসেছে – পেছনে পড়ে আছে দুদশকের কষ্টের ইতিহাস যার জন্য সে গর্বিত। গত বিশ বছরের অর্জিত প্রত্যয় আর নতুন ধ্যানধারণা – এ সব সে পুরোনো বন্ধুদের জানাতে চায় – তাদের প্রশংসার প্রত্যাশা করে। বিয়ার কেন তার আর ভালো লাগে না এই ভেবে সে নিজেকে দোষ দেয়। ফ্রান্সে গিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে মুখে অল্প পানীয় নিয়ে খেতে শিখেছে – বিয়ারপ্রেমীদের মত অনেকটা এক ঢোকে গিলে নেওয়ার অভ্যেস আর নেই। এই ঘটনার মাধ্যমে শুধু যে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ব্যবধান স্পষ্টতর হচ্ছে তাই নয় – পশ্চিম বনাম মধ্য ইউরোপের মানুষের মানসিকতার পার্থক্যও পরিষ্কার হচ্ছে। ইরিনার ভাবভঙ্গি বন্ধুদের আঘাত দিচ্ছে – তারা মনে করছে ইরিনার আর্থিক অবস্থার উন্নতিই এর কারণ। সে বুঝতে পারছে না যে ফরাসি ওয়াইনের সঙ্গে তার চেক বন্ধুদের কোনও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ নেই। তার খালি মনে হচ্ছে তারা তার কুড়ি বছরের নির্বাসিত জীবনকে মূল্যহীন বলে মনে করছে। তাদের উৎসাহের অভাব ইরিনাকে আঘাত করছে – সে বুঝছে যে বোহেমিয়া আর তার দেশ নয়।
পরিবার আর স্বদেশের সঙ্গে ইরিনার সঙ্গী জোসেফের মিলনের অভিজ্ঞতা যেন আরও বিস্বাদ। বাড়িতে তার ব্যক্তিগত স্মৃতিবিজড়িত একান্ত নিজস্ব জিনিসগুলো সব বেহাত হয়ে গেছে। জোসেফ বিপত্নীক হলেও পরিবারে সে খবর জানায় না। সে চাপা অস্বস্তিতে ভুগছে। নিজের শহরে ছোটবেলার পরিচিত জায়গাগুলোকে আর চেনা যায় না – কবরস্থানে স্মৃতিসৌধের ওপরে লেখা নামগুলোও যেন অপরিচিত ঠেকছে। জোসেফের এমন কোনও কিছুর সঙ্গে সংযোগ ঘটে না যা তাকে অতীত জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারে। আর মাতৃভাষার সঙ্গে দুদশকের বিচ্ছিন্নতায় চেক ভাষাটাকেও অজানা লাগছে। ভাষাটার হল কী, জোসেফ ভাবে! শব্দের উচ্চারণে যেখানে আগে জোর পড়ত তাও কি বদলে গেল? সে যেন একটা অচেনা ভাষা শুনছে, অথচ সে ভাষার প্রতিটা শব্দের অর্থ তার জানা!
ইরিনা আর জোসেফের এই বিষাদময় ঘরে ফেরা ইথাকায় অডিসিউসের প্রত্যাবর্তনের ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। অডিসিউস দেখছে তার রাজ্য যেমন ছিল তেমনই আছে। ইরিনা আর জোসেফের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্য মেরুর। তাই লেখকের প্রশ্ন: নায়কের ঘরে ফেরার সে মহাকাব্য কি আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক?
রচনাশিল্পের সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আর সমান্তরালভাবে তার সঙ্গে সঙ্গীতের তুলনা টানার সময় দি আর্ট অব দ্য নভেল (The Art of the Novel)-এ মিলান কুন্দেরা বলেছিলেন যে হয়ত সব ঔপন্যাসিকই কোনও একটা বিশেষ বিষয় (theme) নিয়ে লেখেন (তাঁর প্রথম উপন্যাসে), আর তারপরের সব রচনায় থাকে সেই বিষয়টিরই রকমফের! যদি এই ভাবনাটি লেখকের উপন্যাসগুলোর সঙ্গে মেলানো যায়, তা হলে বলতে হয় দ্য জোক-এ কুন্দেরার সাহিত্য-সমগ্রের কেন্দ্রীয় বিষয়টি ধরা রইল – আর তারপরে তিনি যা কিছু লিখলেন তা সেই মূল বিষয়টির প্রকারান্তর। অর্থাৎ পরে লেখা সব রচনায় তিনি কোনও না কোনওভাবে তাঁর প্রথম উপন্যাস আর চেকোস্লোভাকিয়ায় ফিরে গেছেন। কুন্দেরার এই থিসিসকে আক্ষরিক অর্থে না নিলেও এমন প্রত্যাশা করাই যায় যে সব লেখক বারবার সেই সব মূল চিন্তাভাবনার কাছে ফিরে আসেন যেগুলো তাঁদের আকর্ষণ করে – তাঁরা সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন যার সমাধান তাঁদের কাছে জরুরি। ঘরে ফেরা সম্ভব না হলেও একই আইডিয়ার কাছে বারবার ফিরে যাওয়াই হয়ত মিলান কুন্দেরার জীবনে চিরন্তন, শাশ্বত, মহান প্রত্যাবর্তন।
তথ্যসূত্র (ফরাসি ও ইংরেজি):
১) L’ignorance; Milan Kundera; Folio No. 4155 ; Gallimard; 2005
২) Milan Kundera: Ma passion pour la culture de la France; Revue des deux Mondes; Nov 5, 1994
৩) Pour une définition de l’exil d’après Milan Kundera: La nostalgie ou l’ambiguïté de la mémoire d’un réfugié ; Ana M. Alves ; Instituto Politécnico de Bragança
৪) The Great Return: Exile and Homelands in the Work of Milan Kundera and Krzysztof Kieślowski; Alan Ashton-Smith