"আমার নিজের জীবন বৃত্তান্ত আমি যথাযথ জানি নে মনেও থাকে না। যারা বাইরে থেকে জানে ও সংগ্রহ করে এই সম্বন্ধে তারাই আলোচনার অধিকারী। প্রশান্ত এই কাজ করে আসছে তার দপ্তরও ভারী। তার নিচেই দ্বিতীয় স্থান দেওয়া যেতে পারে অমিয়কে। তার নিচেই প্রভাতকুমার। চীনের পুরাবৃত্ত ও রবীন্দ্রনাথের ইতিবৃত্ত তার বিশেষ আলোচ্য। সকলের চেয়ে অযোগ্য হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ।"রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল জীবন, বহুমুখী প্রতিভা ও কর্মকাণ্ড, জাতীয় ইতিহাসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তথা তাঁর বিদগ্ধ অনুরাগীমণ্ডলীর কথা চিন্তা করলে ১৯৩৩ সালের আগে বাংলায় তাঁর কোনো প্রামাণ্য জীবনীর রচনা না হওয়াটা বিস্ময়কর মনে হয়। এ ব্যাপারটাও কম বিস্ময়োদ্রেক করে না যে, রবীন্দ্রনাথ নিজে যাঁদের তাঁর জীবনের তথ্যাবলির ভাণ্ডারী মনে করতেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ (বাকি দুজন অমিয় চক্রবর্তী ও প্রশান্ত মহলানবীশ) এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে তেমনভাবে এগিয়ে আসেন নি! এই দু'জন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা কাজ করেছেন, বিভিন্ন দেশে যাঁরা তাঁর ভ্রমণসঙ্গী বা ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন, তাঁদের অনেকেই রবীন্দ্রজীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী হয়েও ভবিষ্যতের জন্য সেসব ঘটনার বিশেষ কোনো প্রণালীবদ্ধ বিবরণ রেখে যান নি! আমরা অবশ্য মনে রেখেছি যে, প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রজীবনের অতি অল্প সময়ের (প্রায় এক-দেড় বছর) বিবরণী তাঁর ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলি আজও ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়নি (দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ তাঁর এই তথ্যগুলি পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী নির্মলকুমারীর ভ্রমণকাহিনীগুলিতে অনেকটা ব্যবহৃত হয়েছে)।
-- বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠি, ৫-১১-১৯৩২
প্রশান্তচন্দ্র অবশ্য রবীন্দ্রজীবনের বিভিন্ন সময়ের কিছু ঘটনা নিয়ে কয়েকটি ছোট প্রবন্ধ নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেছেন এবং একটি ক্ষীণতনু জীবনীও ('রবীন্দ্রনাথ') তিনি লিখেছিলেন, যা প্রকাশিত হয় বহু পরবর্তীকালে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনাবলীর উপকরণ সংগ্রহে তিনি ও অমিয় চক্রবর্তী বিদেশের খবরকাগজগুলির কর্তিকাসংগ্রহ করে মূল্যবান সহায়তা যুগিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালাটিতে গড়ে তোলার কাজে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বা কালিদাস নাগের মতো কেউ কেউ দিনলিপি বা ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে জীবনীর উপাদানের অভাব কিছুটা পূরণ করলেও এঁদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের একটি পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য জীবনী রচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন নি! এমনও হতে পারে, প্রভাতকুমারকে এই প্রযত্নে ব্রতী হতে দেখে এঁরা আর অগ্রসর হননি। এঁদের কেউ কেউ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরবর্তীকালে স্মৃতিকাহিনী লিখেছেন, তার মূল্য যে নেই, এমনও নয়, কিন্তু ততদিনে অনেক সূত্র হারিয়ে গেছে, ফলে ওইসব স্মৃতিকথার প্রামাণ্যতার যে বেশ কিছুটা হানি হয়েছে, একথাও অস্বীকার করা যায় না।
পূর্বসূরীদের এই যৎসামান্য কর্মকৃতির প্রেক্ষিতে প্রভাতকুমারের দায়িত্বসচেতনতা ও তাঁর রচিত রবীন্দ্রজীবনীর গুরুত্ব সশ্রদ্ধভাবে স্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রামাণ্য বাংলা জীবনী রচনায় তাঁর দীর্ঘদিনব্যাপী শ্রম ও আত্মনিবেদনের মূল্যকে লঘু না করেও বলা যায়, তাঁর চার খণ্ডের গ্রন্থটিকে একটি বিশাল ও অসাধারণ কীর্তি বলে মনে হবার একটা কারণ অবশ্যই তাঁর সমসাময়িক রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠদের এ জাতীয় কাজের সংখ্যাল্পতা। এই সূত্রে স্মরণীয় ১৯৪৬ সালে নবসংস্করণ রবীন্দ্রজীবনীর ভূমিকায় তাঁর মন্তব্য:- "চৌদ্দ বৎসর পূর্বে যখন রবীন্দ্রজীবনী লিখিতে আরম্ভ করি তখন কবি সম্পর্কে কি-ই বা তথ্য জানা ছিল!” নতুন করে কাজ শুরু করতে গেলে পথিকৃতের প্রাপ্য অসুবিধা অবশ্যই তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল, সেই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার্য, তিনি যেটুকু দিয়েছিলেন, ক্ষুধার্ত পাঠক তা-ই মাথায় করে নিয়েছিল বলে জীবনীকার হিসেবে তাঁর অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা সহজ হয়েছিল। তাই রবীন্দ্রজীবনী সমসময়ে রবীন্দ্রনাথের প্রামাণ্য জীবনী হিসেবে যেমন ছিল একক, তেমনই ছিল কিছুটা অসম্পূর্ণও।
রবীন্দ্রপ্রয়াণের প্রায় চার দশক পরে (১৯৮২) সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নতুনভাবে একটি বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনকথা রচনায় প্রশান্তকুমার পালের পথ কিন্তু সেই নিরিখে খুব একটা মসৃণ ছিল না। তাঁর সামনে প্রভাতকুমারের পূর্ব কীর্তি ও খ্যাতির প্রাচীর তো খাড়া ছিলই, এ ছাড়াও নিরিবচ্ছিন্নভাবে এই গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করার মতো সুযোগ বা অবসর তিনি পাননি। এই সৌধপ্রতিম কাজটি তাঁকে চালিয়ে যেতে হয়েছিল জীবিকার জন্য চাকরী করার সঙ্গে সঙ্গে। এসব সত্ত্বেও একথা আজ প্রমাণিত যে, রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর রবিজীবনীর ন'টি খণ্ড শুধু যে বহুপ্রতীক্ষিত ছিল তা-ই নয়, এই ক্ষেত্রে ওই মহাগ্রন্থ ছিল এক অসামান্য প্রাপ্তি ও যুগান্তকারী কীর্তি। এর অসামান্যতা ও বিশালতা ছিল শুধু আকারেও নয় প্রকারেও। বহু বছর আগে (১৯৯৭) শিবনারায়ণ রায়ের অনুরোধে তাঁর 'জিজ্ঞাসা' পত্রিকায় রবিজীবনীর প্রথম ছ'টি খণ্ডের আলোচনা করতে গিয়ে আমার এমনটাই মনে হয়েছিল।
রবীন্দ্রজীবনী ও রবিজীবনীর তুলনামূলক গুণাগুণ বিচার করতে গিয়ে সেদিন যা লিখেছিলাম, সেগুলো এখানে সবিস্তারে আলোচনার অবকাশ নেই। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে, রবিজীবনী প্রথমেই যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য বিবুধমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তার কয়েকটি ছিল - সময়পর্ব অনুসারে প্রণালীবদ্ধ অধ্যায়বিন্যাস, আপাততুচ্ছ কোনো তথ্যকেই অবহেলা না করে সেগুলির নিপুণ ব্যবহার, নানা প্ৰচলিত ধারণা ও পূর্বে সংকলিত তথ্যের খণ্ডন/ সম্পূৰ্ণীকরণ ও কিছু সঙ্গত প্রশ্নের উত্থাপন এবং মূল তথ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ও আলাদাভাবে বিস্তারিত সংবাদ সংকলন।
এই গ্রন্থরচনায় তাঁর নানা সমস্যা ও অসুবিধা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রজীবনের পরবর্তী বছরগুলোতে তুলনামূলকভাবে অধিকতর তথ্য-উপাদান পাবার ফলে ক্রমশ গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির সমস্যা ও সেই বিপুল পরিমাণ তথ্যকে লিপিবদ্ধ করার প্রযত্নে এক একটি খণ্ড প্রকাশে অধিকতর বিলম্ব হবার কথা তিনি একবার আমাকে জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘজীবনের বছর-ওয়াড়ি এমন এক সানুপুঙ্খ ধারাবিবরণী রচনার দায়িত্ব যে একটি মরমানুষের জীবনের পক্ষে যথেষ্ট গুরুভার এবং তাঁর এই গ্রন্থের বিভিন্ন খণ্ড পাঠকমহলে যে বিপুল প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে এক জীবনে তিনি হয়তো এই কাজ সম্পূর্ণ করতে পারবেন না, এমন সম্ভাবনা তিনি নিজেও রবিজীবনীর ষষ্ঠ খণ্ডে উল্লেখ করেছিলেন।
কিন্তু মানুষের আশা দুর্মর বলেই আমরা তখন ভাবতে পারিনি বা চাইনি যে, কালান্তক ব্যাধি মাত্র ন'টি খণ্ডের পরেই তাঁর লেখনীকে স্তব্ধ করে দেবে, অসমাপ্ত থেকে যাবে রবীন্দ্রজীবনের আরও পনেরো বছরের তথ্যানুসন্ধান ও পরিবেশনের ব্রত। তাই ২০০৭ সালে তাঁর জীবনাবসানের পর একটি প্রয়াণলেখে ('রবীন্দ্রভাবনা' পত্রিকায় প্রকাশিত) আমি লিখেছিলাম, "রবীন্দ্রজীবনের তথ্যভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংবাদের অপ্রতুলতাজনিত প্রতিবন্ধকের যারা ভুক্তভোগী, তাঁদের কাছে প্রশান্তকুমারের রবিজীবনীর মতো একটি সহায়ক গ্রন্থ যে কতটা অপরিহার্য ছিল, তা তাঁরাই জানেন এবং এই খ্যাতকীর্তি জীবনীকারের অনুপস্থিতির অভিঘাত তাঁরা ভবিষ্যতে আরও উপলব্ধি করবেন, সন্দেহ নেই।"
বস্তুত পরবর্তী দশকাধিক কাল ধরে সেই অভিঘাত আমরা অনুভব করেছি, বিশেষ করে রবীন্দ্রজীবনের উত্তরপর্ব নিয়ে অনুসন্ধানের সময়। এই সময় দুটো প্রশ্ন আমার মনকে অনবরত আলোড়িত করত। প্রথম প্রথম মনে হত, 'রবিজীবনী'র শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হবার (২০০৩) পরও চার বছর প্রশান্তকুমার জীবিত ছিলেন, সেই সময়ে নিশ্চয়ই তিনি গ্রন্থটির পরবর্তী খণ্ডগুলি রচনার কিছুটা কাজ করে রেখেছিলেন, সেটুকু কি আর কখনো আলো দেখতে পারবে না! কিন্তু রবিজীবন-এর ন'টি খণ্ডের প্রকাশকের মতো একটি অগ্রগণ্য সংস্থাও সেই অসমাপ্ত কাজের অপ্রকাশিত অংশটি ছাপার ব্যাপারে এই পনেরো বছরেও আগ্রহী না হওয়ায় যথেষ্ট হতাশ হয়েছিলাম, হতাশার সঙ্গে মিশে ছিল বিস্ময়ও।
এর পর বহু বছর ধরে আমার যে কথাটা মনে হত তা হল, রবীন্দ্রনাথ যে-বাঙালিজাতির জীবনের সঙ্গে আজও অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছেন, তাঁর শেষ জীবনের একটি যথাযথ ও 'রবিজীবনী'র তুল্যমানের জীবনবৃত্ত রচনার যোগ্য গবেষক কি তাদের মধ্যে থেকে কোনোদিন উঠে আসবেন না! হতাশার মধ্যেও মনে হত, প্রশান্ত পালের যোগ্য উত্তরসূরি হয়তো একদিন পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা কি আমাদের জীবনকালেই দেখে যেতে পারব! বলা বাহুল্য, আমার মতো চিন্তা নিশ্চয়ই আরো অগণিত রবীন্দ্র অনুরাগী পাঠক ও লেখক-গবেষকদের মধ্যেও ক্রিয়াশীল ছিল।
এই সব আশা নিরাশার দোলাচলে দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে এইসব রবীন্দ্র-অন্বেষু সুধীজনের জানা ছিল না এমন এক গবেষকের কথা, যিনি নিরলসভাবে এবং একরকম লোকলোচনের অন্তরালে একনিষ্ঠ চিত্তে ও একক প্রয়াসে সংগ্রহ করে চলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের সুবিস্তৃত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যরাজি! এই সুকঠিন ও দুঃসাহসিক কাজের জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন এই গবেষক বিজন ঘোষাল মহাশয় ইতিপূর্বে বেশ কয়েক বছর ধরেই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে নিতান্ত অপরিচিত না হলেও দুর্ভাগ্যবশত নামী প্রকাশকের আনুকূল্য বা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষণার অভাবে তাঁর গ্রন্থগুলি এতদিন উপযুক্ত সমাদর পায় নি।
তাঁর এই পূর্ববর্তী বইগুলিতে বিধৃত বিষয়বস্তু ও গবেষণার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরাই তাঁর তথ্যভাণ্ডারের বিশালতা ও ব্যাপকতা দেখে ও তাঁর সনিষ্ঠ নিমগ্নতা ও একাগ্র অধ্যবসায়ের পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন। অবশ্য এই পাঠকদের জানা ছিল না যে, প্রশান্তকুমারের রবিজীবনীর সর্বশেষ খণ্ডে আলোচিত সময়পর্বের পরবর্তীকালের (১৯২৬-৪১) সম্পূর্ণতর জীবনবৃত্তান্ত রচনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার এই লেখক ইতিপূর্বেই তৈরি করে ফেলেছেন। আজ বিস্মিত আনন্দে আমাদের স্বীকার করতে বাধা নেই যে, রবীন্দ্রনাথের একটি আধুনিক ও যথাযথ জীবনবৃত্তান্তের জন্য দুই দশকের প্রতীক্ষা অবশেষে সমাপ্ত হয়েছে, তাঁর এই তপস্যার ফল আজ আগ্রহী পাঠকের হাতে পৌঁছে গেছে।
'রবিজীবন' গ্রন্থটির প্রথম দুটি খণ্ড হাতে পাওয়ার পর আমাদের আজ একথা বলতেও দ্বিধা নেই যে, প্রভাতকুমার-প্রশান্তকুমারের যোগ্য উত্তরসূরীর হাতেই এবার রবীন্দ্রনাথের আধুনিক জীবনবৃত্তটি সম্পূর্ণ করার সুকঠিন কাজটি ন্যস্ত হয়েছে।
বিজন ঘোষাল প্রণীত রবিজীবন-এর এই দুটি খণ্ডের পূর্বে ও সমকালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থগুলির সঙ্গে যারা পরিচিত নন, তাঁদের কাছে এই লেখকের রবীন্দ্র-গবেষণার আকার প্রকার পরিধি ও বিস্তারের কিছুটা আভাস দেবার জন্য আমরা এখানে তাঁর অতীত রচনাগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থিত করব।
ব্যক্তি হিসেবে বিজনবাবু বহুগুণান্বিত মানুষ, রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে তাঁর গবেষণার পাশাপাশি আবৃত্তিশিল্প বা তথ্যচিত্র নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক বহুবিধ বিষয়ে তাঁর আগ্রহ, চর্চা ও তৎপরতার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেওয়া অবশ্য বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য নয়, তাঁর বইগুলিতে সংলগ্ন সংক্ষিপ্ত পরিচিতি থেকে এসব সংবাদ অল্পবিস্তর পাওয়া যায়। তাঁর রচিত রবীন্দ্রনাথের জীবনীটির আলোচ্য দুটি খণ্ডে তাঁর যে-দুস্তর সাধনার প্রকাশিত রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়, তার সমিধসংগ্রহপর্বে প্রসূত কয়েকটি গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যগুলির যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করলে তাঁর এই নিরলস অনুসন্ধিৎসা ও অধ্যবসায়ের চরিত্রটি বুঝতে কিছুটা সুবিধা হতে পারে। সাধারণভাবে এই গ্রন্থগুলোকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়, একটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের রচনা/পত্রাবলীর সংকলনমূলক, অপরটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মকৃতিভিত্তিক।
যে-বইটির প্রণেতারূপে বিজনবাবুর নাম সর্বপ্রথম আমাদের গোচরে এসেছিল, সেটি হচ্ছে উক্ত প্রথম শ্রেণীভুক্ত -- এযাবৎ (২০১৩-১৫) পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র-পত্রাভিধান। [প্রথম চার খণ্ডের প্রকাশক 'পত্রলেখা' ও পঞ্চম খণ্ডটির 'অবভাস'] তাঁর এই প্রণালীবদ্ধ সটীক পত্র সংকলনটি এমন একটি গ্রন্থ, যে-জাতীয় প্রযত্নে তাঁর কোনো পূর্বসূরি নেই! সন্ধান পাওয়া গেছে, রবীন্দ্রনাথের এমন সমস্ত চিঠিপত্রকে পত্রপ্রাপকের নামানুসারে বর্ণানুক্রমে বিন্যস্ত করে বিস্তারিত টীকা সহ একই গ্রন্থমালায় সংকলন করার এমন ব্যাপক ও সাহসিক প্রকল্প বিশ্বভারতী বা অন্য কোন প্রকাশনই অদ্যাবধি গ্রহণ করেনি। এই সংকলনের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, যে-সব চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়নি, অথচ রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্যদের লেখায় সেগুলির উল্লেখ আছে, সেইসব চিঠিরও উল্লেখ এখানে আনুমানিক রচনাকাল ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সহ করা হয়েছে!
বিজনবাবুর আরো দুটি পত্রসংকলনের কথাও এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যায়। এর একটি হল 'সব ছোটোদের জন্য রবীন্দ্রনাথের চিঠি' [পত্রলেখা, ২০১৪] আর অপরটি 'রবীন্দ্রপত্রসমগ্র কালানুক্রমিক', এ পর্যন্ত যার প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছে [লালমাটি ২০২২]। প্রথম বইটি ক্ষীণতনু, এতে কয়েকজন শিশুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠি সংকলিত হয়েছে। অপরটিতে প্রাপক-নামানুসারে নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্ত সমস্ত চিঠি কালানুক্রমে প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা তাঁর রবীন্দ্র-পত্রাভিধান গ্রন্থমালার সঙ্গে সমান্তরালভাবে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হবে। বাংলা প্রকাশনা-জগতে এখনো এই গ্রন্থগুলির সমতুল্য কোন নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই।
বিজনবাবুর সংকলনমূলক যে-একটি গ্রন্থের উল্লেখ অবশিষ্ট রয়েছে সেটি হল 'ছদ্মনামে রবীন্দ্ররচনা' [লালমাটি, ২০২২]। চোদ্দ বছর থেকে আটাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত (১৮৭৪ -১৯৩৯) কোনো নাম ছাড়া বা কোনো ছদ্মনামের আড়ালে রবীন্দ্রনাথের বহুরকম রচনা নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। দিকশূন্য ভট্টাচার্য, অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর, বাণীবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছদ্মনামের কথা আমাদের কারও কারও জানা থাকলেও এতদিন সেইসব নামে প্রকাশিত রচনাগুলো একসঙ্গে দেখার কোনো উপায় ছিল না। এই বইটির অনন্য প্ৰাসঙ্গিকতা ও প্ৰয়োজনীয়তা এখানেই যে, এর দু'মলাটের মধ্যে অদ্ভুতকর্মা বিজন ঘোষাল সযত্নে সংকলন করেছেন সবগুলি ছদ্মনামে ও বেনামে লেখা রবীন্দ্রনাথের ত্রিশটির বেশি রচনা, যার একটা বড় অংশ বিস্মৃতপ্রায় বা সাধারণ পাঠকের কাছে এতদিন দুষ্প্রাপ্য ছিল। প্রতিটি রচনার শুরুতে সংযোজিত হয়েছে এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
উল্লিখিত দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত অর্থাৎ রবীন্দ্র-জীবনভিত্তিক বইগুলোর উপজীব্য বিষয়ের মধ্যে বহুচর্চিত এবং স্বল্প আলোচিত দু'রকম প্রসঙ্গই রয়েছে। প্রসঙ্গ : রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ [পত্রলেখা ২০১৩] বইটির বিষয়বস্তু আধুনিক বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তে বহুদিন ধরেই একটি আকর্ষণীয় আলোচ্য বিষয়। বাঙালির এই দুই 'ঠাকুর'এর সম্পর্কিত প্রসঙ্গগুলির নানা দিক নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি হলেও বিজনবাবু এখানে সেইসব প্রসঙ্গগুলিকে একটি সামগ্রিক ও সুসংবদ্ধ আকারে উপস্থিত করেছেন। বইটির অন্যতম আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি স্বল্পপরিচিত চিঠি, যাতে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর একবার দূর থেকে দেখার কথা, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতাকে 'আরো ভালো করে' জানার কথা এবং রামকৃষ্ণ ও তাঁর 'কথামৃত' সম্পর্কে তাঁর অকপট মতামত ব্যক্ত করেছেন।
'ক্রুশবিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ' [পুস্তক বিপণি, ২০১৩] গ্রন্থটিও একটি বহ আলোচিত বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত। (অধিকন্তু উল্লেখ্য, এই বিষয়টি অর্থাৎ রবীন্দ্র-বিদূষণ বা রবীন্দ্রবিরোধী সমালোচনার ইতিবৃত্ত বিজন বাবুর পিএইচডি-র গবেষণারও বিষয়বস্তু ছিল)। রবীন্দ্রনাথের জীবনব্যাপী বিস্তৃত এই বিরোধিতার ইতিহাসের একটি অংশ (১৮৮১ থেকে ১৯১৩ সাল) এই গ্রন্থটিতে সাময়িক পত্র থেকে উৎকলিত কিছু নিবন্ধের সঙ্গে তথ্যনিষ্ঠভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রবীন্দ্রবিরোধী নানা সমালোচনা সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও সংক্ষিপ্ত অভিমত।
আমরা সবশেষে উল্লেখ করব রবীন্দ্র-জীবনের একটি স্বল্প আলোচিত ঘটনা নিয়ে বিজনবাবুর একটি বইয়ের কথা, যা নিয়ে এককভাবে কোন গ্রন্থ ইতিপূর্বে রচিত হয়নি। এটি হল 'রবীন্দ্রনাথ, অক্সফোর্ড ও ডি. লিট প্রসঙ্গ' [পত্রলেখা ২০১৫ ]। এই বইটির ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন, তাঁর সংকলিত রবীন্দ্র-পত্রাভিধানের কাজ করার সময় প্রায় আট হাজার চিঠিপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এই বইটি রচনার পরিকল্পনার জন্ম হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট উপাধি প্রদান বিষয়টির ইতিহাস ছাড়াও এই গ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য ব্যক্তিদের শতাধিক প্রকাশিত, অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত চিঠিপত্রের পূর্ণ বয়ান সংকলিত হয়েছে।
প্রশান্তকুমারের রবিজীবনী-কে ভিত্তিগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে তার পরবর্তীকালের ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ করার এক অভিনব ও অনন্য প্রয়াস বিজন ঘোষাল রচিত রবীন্দ্রনাথের এই জীবন কাহিনীর দুটি খণ্ড -'রবিজীবন ১৩৩৩-১৩৩৪' ও 'রবিজীবন ১৩৩৫-১৩৩৬'। এদুটিকে আমরা অতঃপর যথাক্রমে প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড বলে উল্লেখ করব। উল্লেখিত গ্রন্থনাম থেকে বোঝাই যায় প্রথম খণ্ডটিতে বিধৃত হয়েছে রবীন্দ্রজীবনের দু'টি বছরের (১৩৩৩-৩৪ বঙ্গাব্দ, ১৯২৬-২৮ সাধারণাব্দ) সানুপুঙ্খ ইতিহাস। এক একটি বঙ্গাব্দের হিসেবে প্রতিটি অধ্যায়কে চিহ্নিত করে ও বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিক তথ্য ও নির্ঘন্ট ইত্যাদি বিন্যস্ত করে এই গ্রন্থে মোটের ওপর প্রশান্তকুমারের রবিজীবনী-র আদলটিকেই অনুসরণ করা হলেও ওই গ্রন্থের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যকেই এই গ্রন্থে আরো সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে -- গবেষক ও পাঠক-সহায়ক হবার লক্ষ্যে এতে বিজ্ঞানসম্মত ও সুপরিকল্পিতভাবে যে নানা গুণমান সংযোজিত (আধুনিক বিপণনের ভাষায় value addition) হয়েছে, সেগুলির বিশদ বিবরণ দেওয়ার সুযোগ এখানে নেই।
সংক্ষেপে বলতে গেলে এই গ্রন্থটিতে রবীন্দ্রজীবনের বিস্তারিত তথ্য সংকলনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল বছরের প্রতিটি মাসের প্রতিটি দিনের ঘটনাগুলির কালানুক্রমিক বিন্যাস ও উপস্থাপনা এবং সমসময়িক চিঠিপত্র ও দেশীবিদেশী খবরের কাগজের বিবরণ আর পরবর্তীকালে লিখিত বিভিন্ন জনের স্মৃতিকথা ও ভ্রমণ-বিবরণী ইত্যাদির সহায়তায় সেগুলির তথ্যগত যাথার্থ্য নির্ধারণ, সাময়িকপত্রে প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি রচনার বিশদ বিবরণ, মঞ্চস্থ নাটক ইত্যাদির বিজ্ঞাপনের উল্লেখ ও উপস্থাপনা, বিতর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসার প্রয়োজনে রবীন্দ্ররচনার পাণ্ডুলিপির ছবির ব্যবহার ইত্যাদি।
প্রতিটি খণ্ডের শুরুতে একটি সংক্ষিপ্ত সূচিপত্র ছাড়াও 'দিনলিপি ও বিষয়সূচি' শিরোনামে যে আলোচিত ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত দিনানুক্রমিক বিবরণ যুক্ত হয়েছে তা একটি ডায়েরির সঙ্গে তুলনীয়। সহজ ব্যবহারযোগ্যতার নিরিখে সাধারণ পাঠক ও গবেষক সবার কাছেই এটির মূল্য অসামান্য। সমগ্র বইটিতে আলোচিত বিষয়গুলির একটি চুম্বক রূপে এটি সংকলিত হলেও এতে প্রত্যেকটি দিনে লেখা চিঠিপত্র, রচনা ইত্যাদির খুঁটিনাটি বিবরণও বাদ পড়েনি। গবেষক হিসেবে বিজন ঘোষাল এতটাই মূলানুসারী ও তথ্যনিষ্ঠ যে, কোনো সন্দেহ নিরসনের জন্য রবীন্দ্রনাথের কোনো বিশেষ পাণ্ডুলিপির ছবি সংগ্রহের প্রয়োজনে গ্রন্থটির প্রকাশ বিলম্বিত হবারও পরোয়া তিনি করেননি! তাঁর নাছোড় অধ্যবসায় ও তথ্যনিষ্ঠার তাগিদে তিনি প্রতিটি দিনে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্ত প্রতিটি চিঠির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হন নি, সেই চিঠির বিষয়বস্তুর যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত বিবরণও উপস্থিত করেছেন! এমন শ্রমসাধ্য ও বিস্তারিত গবেষণা আমাদের দেশে আর কোনও জীবনীগ্রন্থে হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই।
এই খণ্ডটিতে বিবৃত বিষয়গুলি মুখ্যত রবীন্দ্রনাথের ইউরোপের ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ সম্পর্কিত। এগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু জানা ও অল্প-জানা প্রসঙ্গ হল মুসোলিনির আতিথ্যে রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত ইতালি ভ্রমণ, আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, প্রবাসী পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের লেখা না পাওয়ায় সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ ও অভিযোগ, মডার্ন রিভিউ ও প্রবাসী-তে রবীন্দ্রনাথের বিরোধী সমালোচনা (১৯২৬), মালয়ে রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তৃতা ও সেই সূত্রে বাংলার কথা পত্রিকাতে রবীন্দ্রবিরোধী সমালোচনা, মিস মেয়োর মাদার ইন্ডিয়া বইটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের প্রতিবাদ (১৯২৭), সিটি কলেজ ছাত্রাবাসে সরস্বতী পূজা নিয়ে ছাত্র ধর্মঘট প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা (১৯২৮), আত্মশক্তি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নটরাজ-এর বিরূপ সমালোচনা, রবীন্দ্রনাথকে মধ্যস্থ করে নবীন সাহিত্যিকদের দুই পক্ষের বিতর্কসভা ইত্যাদি।
এ ছাড়াও আনুষঙ্গিক নানা বিষয়ে পাঠকের সঙ্গত কৌতূহল নিরসনের জন্য গ্রন্থকার সমসময়িক নানা ঘটনা, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ইত্যাদি সংকলন করে গ্রন্থের মূল ভাষ্যের অতিরিক্ত যেসব 'প্রাসঙ্গিক তথ্য', 'বিবিধ প্রসঙ্গ' ও 'প্রসঙ্গকথা' বিভাগগুলি প্ৰস্তুত করেছেন, সেগুলিকে নানা অজানা ও স্বল্প-জানা ঘটনার এক একটি খনি বলা চলে।
এই খণ্ডটি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও প্রশান্তকুমার পাল এই দুই পূর্বসূরীকে উৎসর্গীকৃত।
প্রথম খণ্ডে আলোচিত সময়পর্বের পরবর্তী দুই বছরের অর্থাৎ ১৩৩৫-৩৬ বঙ্গাব্দের (১৯২৮ -১৯৩০ সাধারণাব্দ) ঘটনাগুলির বিবরণ নিয়ে রচিত 'রবিজীবন'- এর দ্বিতীয় খণ্ড। এই খণ্ডটির অন্তর্ভুক্ত কালপর্বের প্রধান কিছু ঘটনার মধ্যে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে অতিবাহিত দিনগুলি ছাড়া দেশবিদেশের নানাস্থানে রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণগুলি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে আছে মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, বরোদা থেকে শুরু করে সিংহল, কানাডা, ভাঙ্কুভার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ইত্যাদি স্থান।
এই সময়কার কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল অবতার পত্রিকায় রবীন্দ্র বিরোধী কুৎসা (রবীন্দ্রনাথ মামলা করার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন), আর্ট কলেজের ছাত্র আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব বিতর্ক, হিবার্ট বক্তৃতা (১৯৩০), আমেরিকা সফরে অভিবাসন বিতর্ক, হংকংয়ে আতিথ্য বিড়ম্বনা, ঠাকুরবাড়ির ছবির হস্তান্তর প্রসঙ্গ, রবীন্দ্র অরবিন্দ সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। এই ধরনের কয়েকটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
বিশের দশকে রাজবন্দীদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহের প্রচেষ্টায় কলকাতায় বিচিত্রানুষ্ঠান করে টাকা তোলার একটি উদ্যোগে জড়িত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, দিলীপ রায় প্রমুখ অনেকে। এই অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনের মেয়েরা নৃত্য পরিবেশনা করায় নানা পত্রিকায় রাজবন্দীদের সাহায্যের 'অজুহাতে' বাঙলাদেশের 'কুলমহিলা'দের প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে নামানোর কারণে সঞ্জীবনী, আনন্দবাজার, উদ্বোধন ইত্যাদি নানা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করা হয়েছিল।
আবার ১৯২৮ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি চিঠিতে চরকা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, তা নিয়ে তাঁকে অভিযুক্ত করেছিলেন খাদিপন্থীরা। রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সে একবার আই সি এস পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিলেন ও সেজন্য তাঁর জন্মতারিখের প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে হয়েছিল তাঁর কোষ্ঠী বা জন্মপত্রিকার দলিল। কালিফোর্নিয়ায় বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে আয়োজিত বক্তৃতামালার এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই সভার সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি মেয়ের আচরণে বিরক্ত হয়ে পরবর্তী বক্তৃতাগুলি বাতিল করে দেন। এরকম জানা- অজানা, সামান্য-অসাধারণ ঘটনার ইতিহাস বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর ও তথ্যের ভাণ্ডার হিসেবে এই বইটি মূল্যবান।
পাঠকের তথ্যানুসন্ধানকে সহজসাধ্য করার জন্য এই খণ্ডে প্রথম খণ্ডটির তুলনায় ব্যাপকতরভাবে নানা ধরনের নির্দেশিকা ও বিষয়ভিত্তিক সূচীপত্র ও বিভাগের (গ্রন্থপ্রকাশ প্রসঙ্গ, ভূমিকা বা অন্যান্য রচনা সম্বলিত গ্রন্থের তালিকা ইত্যাদি) সংযোজন করা হয়েছে। বইটির এই খণ্ডে প্রত্যেক ডান পাশের পৃষ্ঠার শীর্ষে বাংলা তারিখের সঙ্গে ইংরেজি সনটি যোগ করা পাঠকদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী হয়েছে। তবে এই খণ্ডটিতে একটি বছরের মূল ঘটনাবলীর বিবরণের আগেই সেই বছরে প্রকাশিত রচনার তালিকা কেন ছাপা হয়েছে সেটা আমরা বুঝতে পারিনি!
এই খণ্ডটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মারি লাগো ও নেপাল মজুমদার--এই চারজন 'রবীন্দ্রচর্চার অগ্রপথিক'কে।
জীবনীকারের নিজস্ব মন্তব্যের প্রাচুর্য রবীন্দ্রজীবনীর একটি বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্র-জীবন সংশ্লিষ্ট সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতকুমার নিজের মতামত বিশদভাবে ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি, প্রভাতকুমার অনেক ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা বা ব্যর্থতা নির্দেশ করার সাহসও দেখিয়েছেন।
রবিজীবনীর লেখক প্রশান্তকুমার অবশ্য মতামত প্রকাশের ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে সংযত, তাঁর জোর তথ্য সংগ্রহে— কিছু অপ্রয়োজনীয় অনুমান বাদ দিলে, তত্ত্বপ্রতিষ্ঠায় তাঁর ঝোঁক কম। রবিজীবন গ্রন্থটির ক্ষেত্রে বিজন ঘোষালের তথ্যভাণ্ডারটি সমৃদ্ধতর হওয়ায় তাঁর এই জাতীয় তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ আরও বেশি থাকলেও সৌভাগ্যবশত তিনি সে পথে যাননি। প্রভাতকুমার ও প্রশান্তকুমারের মতো ব্যক্তিগত মন্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তুলনামূলকভাবে অনেক সংযত। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি হয়তো স্পষ্ট হবে। ১৮৭৫ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে রয়েছেন, তখন জোড়াসাঁকোর থেকে পাওয়া চিঠিপত্র প্রসঙ্গে প্রশান্ত পাল মন্তব্য করেছেন, “অনুমান করা যায়, এই চারটি চিঠির সবগুলি না হোক, বেশির ভাগই নতুন বধূ ঠাকুরাণী কাদম্বরী দেবীর লেখা এবং রবীন্দ্রনাথও মফঃস্বল থেকে অন্ততঃ সমসংখ্যক পত্র লিখেছেন। এইসব চিঠির কোনটিও রক্ষিত হয়নি।” [প্ৰথম খণ্ড, পৃঃ ২৬৫] পাঠক ভাবতেই পারেন যে, চিঠিগুলো যখন পাওয়াই গেল না, তখন কী কারণে গ্রন্থকার উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কটি বিষয়ে এমন অনুমানে প্ররোচিত হলেন। আবার ইংল্যান্ডে যাবার আগে বোম্বাইয়ে যেখানে কিশোর রবীন্দ্রনাথ আশ্রয় নিয়েছিলেন, সে-পরিবারের মেয়ে আন্না তড়খড় প্রসঙ্গে এরকম মন্তব্যের আর একটি দৃষ্টান্ত ‘রবিজীবনী’ থেকে দেওয়া যায়। ১৮৭৯ সালে আন্না ও তার বোনকে নিয়ে তার পিতা কলকাতায় এসেছিলেন, এটুকু সংবাদের ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের ‘অনুরাগিনী' আন্নার ‘হৃদয়দৌর্বল্য’ দেখে তাঁর পিতা হয়তো সেই অনুরাগকে সার্থক করার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তাব নিয়েই কলকাতায় এসেছিলেন।' [প্রাসঙ্গিক তথ্য/দ্বিতীয় খণ্ড,]। এগুলি সবই অপ্রয়োজনীয় অনুমানের দৃষ্টান্ত। এজাতীয় মন্তব্য কোনো আধুনিক জীবনবৃত্তান্তে অবাঞ্ছিত, কারণ অতীতের ঘটনা বা ব্যক্তিত্বকে ঘিরে রচিত রহস্যজাল ছিন্ন করার চেষ্টাই বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসকারের কাজ--- রহস্য সৃষ্টি করা নয়। সৌভাগ্যবশত আলোচ্য রবিজীবন-এর দুটি খণ্ডে জীবনীকার এই জাতীয় অনুমানের ফাঁদে পা দেননি বলে আমাদের মনে হয়েছে। প্রথম খণ্ড থেকে একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ:- “১৬ই শ্রাবণ রবি [1 Aug] কর্মসূচির বিশেষ সংবাদ না পাওয়া গেলেও অনুমান করা যায় রবিবারের সন্ধ্যায় সঙ্গীসহ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন প্রমোদনাথ ও তাঁর বন্ধু-পরিবারের ফ্ল্যাটে। নৈশভোজের বর্ণনা আছে নির্মলকুমারী-র স্মৃতিগ্রন্থে। হিমাংশু রায়ের 'লাইট অব এশিয়া' দেখার পরিকল্পনা হয়তো নেওয়া হয় নৈশভোজের অনুষ্ঠানেই।” [ঐ, পৃ ৬২] অনুমান যে কোনো গবেষণারই একটি অবশ্যস্বীকার্য অঙ্গ। সঙ্গত অনুমান এ জাতীয় জীবনীর মূল্য বাড়ায়। এটি প্রাসঙ্গিক ও সঙ্গত অনুমানের নমুনা। অপ্রয়োজনীয় অনুমান নিঃসন্দেহে অনর্থক কুহেলি সৃষ্টির অনুঘটক। কতটা বলতে হবে বা কী বলা নিষ্প্রয়োজন— সে নিয়ে চাই সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত নীতি।
গবেষণার ন্যূনতা ‘রবীন্দ্রজীবনী’র আধুনিক পাঠকের কাছে অনেক সময়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা শুনেছি, প্রশান্তবাবু নিজেও তাঁর এই পূর্বসূরী সম্পর্কে অভিযোগ করেছিলেন যে, কেন তিনি সমসাময়িক পত্রপত্রিকা বিশেষ ঘাঁটলেন না বা সংশ্লিষ্ট মানুষদের থেকে আরও তথ্যসংগ্রহ করলেন না। তাঁর এই ক্ষোভ সঙ্গত মনে হয় যখন দেখি যে, শুধু নিজের ধারণা বা অনুমানের ভিত্তিতে রবীন্দ্রজীবনীতে গ্রন্থকার অনেক ঢালাও মন্তব্য করেছেন, কিন্তু সুযোগ থাকলেও তথ্যানুসন্ধান করে ঐ ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেননি। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় বিদেশপ্রত্যাগত স্বামী বিবেকানন্দের সংবর্দ্ধনাসভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন, এমন একটি সংবাদ শুধু অমল হোমের মৌখিকোক্তির ভিত্তিতে রবীন্দ্রজীবনীতে পরিবেশিত হয়েছে! প্রশান্তকুমার নিজে ও শঙ্করীপ্রসাদ বসু পরবর্তীকালে এই দাবিটিকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে খণ্ডন করেছেন।
এর পাশাপাশি আমরা কোনো সমালোচকের এমন অভিমতও দেখেছি যে প্রশান্তকুমার পালও নাকি কিছু ক্ষেত্রে সংবাদপত্র থেকে তথ্য যাচাই করেননি [যেমন তৃতীয় খণ্ডে ‘রাজা বসন্ত রায়’ নাটকটির অভিনয় প্রসঙ্গ]। আলোচ্য আধুনিকতম জীবনীগ্রন্থ রবিজীবন প্রকাশিত হবার পরে হয়তো প্রশান্ত পাল সম্পর্কে এই অভিযোগের ভিত্তি আরো সুদৃঢ় হতে পারে।
একথা অবশ্যই অস্বীকার করা যায় না যে, আধুনিক গবেষণায় জীবনবৃত্ত রচনা উপযুক্ত মাল মসলা, খুঁজে ও খুঁড়ে বের করায় শুধু নিষ্ঠা আর পরিশ্রমই নয়, পেশাদারী দক্ষতারও প্রয়োজন। আমাদের উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই, এইসব দিকে বিজন ঘোষাল মহাশয়ের নিরলস প্রয়াস চোখে পড়ার মতো। এ ব্যাপারটি বোঝাবার জন্য অতীতের একটি ঘটনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন গবেষকের প্রয়াসের একটি তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ উপস্থিত করা যেতে পারে।
১৯২৮ সালে সিটি কলেজের ছাত্রাবাসে সরস্বতীপুজো নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় তাদের প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরিণতিতে ছাত্র ধর্মঘট ও তাতে রবীন্দ্রনাথ, এন্ড্রুজ, সুভাষচন্দ্র প্রমুখের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের অনেকের মোটামুটি জানা আছে। এ ব্যাপারে রবীন্দ্র-জীবনী তৃতীয় খণ্ডে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যদিও প্রভাতকুমার তার বিবরণীতে সুভাষচন্দ্রের নামোল্লেখে বিরত থেকেছেন। তবে এই ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের প্রকাশ্য বিবৃতি, চিঠি, এই ধর্মঘটের ফলে উদ্ভূত কলেজের আর্থিক সংকট লাঘব করতে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর তহবিল থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে বেশ কিছু অর্থ ধার দেওয়া ইত্যাদি তথ্য তিনি সংক্ষেপে বিবৃত করেছেন এবং সমাধিক পরিমাণে যুক্ত হয়েছে এই হিন্দু-ব্রাহ্ম বিরোধে একপক্ষকে দায়ী করে গ্রন্থকারের নিজস্ব মন্তব্য। কিন্তু পরবর্তীকালে এই সরস্বতী পূজা শেষ পর্যন্ত হয়েছিল কিনা বা এই ধর্মঘটেরই বা কী পরিণতি হল, এ সব নিয়ে কোন সংবাদ এখানে পাওয়া যায় না।
প্রশান্তকুমার পাল তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র' পুস্তিকাটিতে সংক্ষেপে এই বিরোধ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের কিছুটা উদ্ধৃতি দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের দুটি প্রাসঙ্গিক চিঠি থেকেও কিছু অংশও উদ্ধৃত করেছেন। (রবিজীবনী-তে এ বিষয়ে কোন তথ্য দেবার তিনি সুযোগ পাননি ওই অসমাপ্ত গ্রন্থটির বিবরণী ১৯২৮ সাল পর্যন্ত পৌঁছতে না পারার কারণে।)
এ প্রসঙ্গে আরো দুজন বিশিষ্ট গবেষকের রচনার কথাও উল্লেখ করা যায়। শঙ্করীপ্রসাদ বসু ষাটের দশকে সাপ্তাহিক বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র' রচনাটিতে এই বিরোধের কিছুটা উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্রের ও ছাত্রপক্ষের কাজ সঠিক ছিল না বলে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এই রচনাটি গ্রন্থাকারে ('সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র') প্রকাশিত হবার সময় সিটি কলেজ বিরোধের প্রসঙ্গটি তিনি সম্পূর্ণ বাদ দেন! আবার নেপাল মজুমদার 'রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্র' নামে একটি তথ্যপূর্ণ গোটা বই লিখলেও, এতে এই সিটি কলেজ প্রসঙ্গটির বিন্দুবিসর্গ উল্লেখ না করাটা শুধু বিস্ময়কর নয়, দায়িত্ববোধের অভাব বলেও মনে হয়, কারণ এই বিষয়টির উল্লেখ না করলে রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক বিষয়ক কোন ইতিবৃত্তই সম্পূর্ণ হয় না।
এর পাশাপাশি 'রবিজীবন' প্রথম খণ্ডে বিজন ঘোষাল এই বিতর্কিত ইতিহাসের যথাসাধ্য সম্পূর্ণ উদঘাটন করেছেন এবং আমাদের পূর্বোল্লিখিত সবগুলি জিজ্ঞাসার নিরসন ঘটিয়েছেন। অধিকন্তু সিটি কলেজকে ধার দেওয়া অর্থ ফেরত পাবার চেষ্টায় রবীন্দ্রনাথকে পরে কী বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল ও শেষ পর্যন্ত যে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল, সেই কাহিনীও আমরা প্রথম জানতে পারি বিজনবাবুর গ্রন্থের পরবর্তী খণ্ডটি থেকেই। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয়, বিজন বাবু এই বিরোধে দুই পক্ষের কোন একটির প্রতি পূর্ববর্তী ভাষ্যকারদের মতো সমর্থন বা অসমর্থন জানাননি, নিরপেক্ষভাবে সবগুলি তথ্য উপস্থিত করে সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন।
সামগ্রিক তথ্যানুসন্ধানে এই উৎখননের গভীরতা ও একাগ্রতা, এবং নিষ্পক্ষ ও নিরাবেগ পরিবেশনা বর্তমান গ্রন্থকারের গবেষণার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের পূর্ববর্তী দুটি জীবন বৃত্তান্তের নিরিখে রবিজীবন-এর তথ্য পরিবেশনার আরো কিছু স্বাতন্ত্র্যের কথা সংক্ষেপে বলা যেতে পারে। বিপুল পরিমাণ তথ্য নাড়াচাড়া করতে গিয়ে জীবনীকারের পক্ষে অনেক সময়ে বুঝে ওঠা সহজ হয় না যে, কতটা তিনি বলবেন এবং কোনটা বলার প্রয়োজন নেই। এ ব্যাপারটি ঠাহর করতে না পারলে স্বভাবতই জীবনীতে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য ও অতিকথন ঢুকে পড়ে। রবীন্দ্র-জীবনীর তুলনায় রবিজীবনীতে প্রচুর পরিমাণ তথ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করা হলেও এই দুটি জীবনীতেই অতিকথন ও অনতিপ্রয়োজনীয় তথ্যের কমবেশি সমাবেশ দেখা যায়। কোন তথ্যটি ভবিষ্যৎ গবেষকের কাজে লাগবে এবং কোনটি কাজে লাগবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তা লেখকের পক্ষে গ্রন্থপ্রণয়নের সময় বুঝে ওঠা সত্যিই সহজ নয়। এ কারণে রবিজীবনী-র প্রথম খণ্ডে সংকলিত 'প্রাসঙ্গিক তথ্য'-গুলির অনেকাংশ কাটছাঁট করে প্রশান্ত পাল ওই খণ্ডটির পরের সংস্করণে ও পরবর্তী খণ্ডগুলিতে সংগৃহীত তথ্যগুলিকে আর একটু সংহত রূপ দিয়েছিলেন। সেই তুলনায় রবিজীবনী-র এক একটি অধ্যায়ে ব্যবহৃত তথ্যগুলির কয়েক গুণ বেশি তথ্য পরিবেশন করতে সচেষ্ট হয়েও আলোচ্য গ্রন্থপ্রণেতা রবিজীবন-এ প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলিকে প্রথম থেকেই সুসংবদ্ধ আকার দিয়েছেন।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনা সম্পর্কে নিজস্ব সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন বা ধারণা প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও বলা ও না বলার নীতি সম্পর্কে জীবনীকারের সুস্পষ্ট ও সতর্ক চিন্তা ও নীতি প্রয়োজন। রবীন্দ্র-জীবনী ও রবিজীবনী-তে গ্রন্থকারদ্বয়ের এইরকম ব্যক্তিগত মতামত যথেষ্ট থাকলেও এ ব্যাপারটিতেও রবিজীবন প্রণেতা তুলনামূলকভাবে সংযত ও সতর্ক বলে মনে হয়। ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশের ক্ষেত্রে রবিজীবন প্রথম খণ্ড থেকে একটি মাত্র নমুনা আমরা এখানে উপস্থিত করছি। রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক বিষয়ে বিবিধ প্রসঙ্গ বিভাগে ১৩৩৪ সালে রামানন্দের রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির সূত্রে বিজনবাবু মন্তব্য করেছেন "পত্রগুলিতে এইরকম আরও অনেক বিষয়ের উল্লেখ আছে। ...রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি বা লেখক নন রক্ত মাংসের গড়া একজন মানুষও বটে। 'কবির জীবনচরিত'-এ এই 'কবি'কে খুঁজে পাবার বাসনা ও উৎসাহে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম মাত্র।"(পৃ ৩৫১)
পূর্ববর্তী দুটি জীবনীগ্রন্থের তুলনায় রবিজীবন-এর দুটি খণ্ডে প্রাত্যহিক ঘটনাবলীর বিবরণপ্রসঙ্গে বিভিন্ন উদ্ধৃতির সংখ্যা অনেক বেশি হলেও সেগুলির প্রত্যেকটি খুব সংক্ষিপ্ত ও যথাযথ। আমাদের আশা, গ্রন্থকার পরবর্তী খণ্ডগুলিতেও এই সতর্কতা ও পরিমিতিবোধ বজায় রাখবেন।
রবিজীবনের দুটি খণ্ডেই গ্রন্থকারের অনুসন্ধানের অনুপুঙ্খতা লক্ষ করার মতো। যেমন, তিনি রবীন্দ্রনাথের যে কোনো সফর বা ভ্রমণ সম্পর্কেই যাত্রা বিবরণে ট্রেন মোটর জাহাজ বা বিমান ইত্যাদি বাহনের উল্লেখ করতে ভোলেন নি, এমনকি সংক্ষিপ্ত দিনলিপিতেও এই তথ্যগুলি তিনি বাদ দেননি! এছাড়া বিভিন্ন ঘটনার স্থান ও তারিখ ইত্যাদির ব্যাপারে পূর্ববর্তী লেখকদের প্রাপ্ত সব বিবরণগুলি তিনি খুঁটিয়ে পড়েছেন এবং প্রচুর গরমিল ও অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এগুলি উল্লেখের সময় অত্যন্ত সংযত ও সংক্ষিপ্ত ভাবে মন্তব্য করেছেন যে এই তথ্যগুলি বা এই তারিখটি "সম্ভবত ঠিক নয়"।
এরকম বিপুল পরিমাণ তথ্যসম্বলিত গ্রন্থের পাঠকের ভাগ্যে অনেক কিছু প্রাপ্তি ঘটলেও কিছু আবার হারাতেও হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিশ্বখ্যাতির সিংহাসনে সমাসীন রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিন ঘটনাবলীর ভিড়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথের ছবিটি যেন অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাহচর্যের সুবাদে প্রভাতকুমারের গ্রন্থে এই মানুষ রবীন্দ্রনাথের নানা স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। তথ্যের সম্ভার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে এই হারিয়ে যাওয়ার পরিমাণটাও তেমনই বাড়তে থাকে। এই কারণে স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রজীবনীর তুলনায় রবিজীবনীতে এটি বেশি পরিমাণে দেখা গেছে। তবু প্রশান্ত পাল মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের চিঠি বা কবিতার নিসর্গ বর্ণনা উদ্ধৃত করে ঘরোয়া ও মানুষ রবীন্দ্রনাথের মেজাজ মর্জির ছবিটি তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। ১২৯৭ সালে মানসী কাব্যের 'উপহার' কবিতাটির সূত্রে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য — "স্মৃতি ও বাস্তবের যে দ্বন্দ্ব মানসী-র প্রথম দিকের কবিতাগুলিতে দেখা গেছে, বর্তমান পর্যায়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবৃত্ত গৃহ-জীবনের আস্বাদে সেই দ্বন্দ্ব অনেকটাই অবসিত -- সাজাদপুর থেকে স্ত্রীকে লেখা পূর্বোদ্ধৃত পত্রটিতে এই গৃহী মানুষটিকে চিনে নেওয়া যায়।" ইত্যাদি [রবিজীবনী তৃতীয় খণ্ড]।
এই গ্রন্থের তুলনায় আমাদের আলোচ্য গ্রন্থে তথ্যের ভার ও ভিড় যেহেতু আরো অনেক বেশি সেহেতু এখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে মানবিক মূর্তির জলধারাটিকে খুঁজে পেতে তথ্যের বালিও অনেক বেশি সরাতে হয়। সেরকম অধ্যবসায় থেকে প্রাপ্ত রবিজীবন প্রথম খণ্ডের একটি মন্তব্য — "আলোচ্য সময়ে বৈবাহিক জীবনের অশান্তি ও দুঃখ বুকে নিয়ে মীরা দেবী রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের থেকে দূরে। সম্ভবত নিজের দুঃখের ভারে অন্যকে ভারাক্রান্ত না করাই তার প্রধান কারণ। কিন্তু পিতা রবীন্দ্রনাথ সংবাদ না পেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মীরা দেবীকে লিখছেন, 'তোর জন্য আমার মন দুশ্চিন্তায় পীড়িত হয়ে আছে। রোজ ভাবি একখানা চিঠি আসবে, কোথায় আছিস কেমন আছিস জানতে পাব।'' ইত্যাদি (১১ই মার্চ ১৯২৭ পৃষ্ঠা ১২৮)।
পাঠক সহায়ক আকর গ্রন্থ হিসেবে রবিজীবন-এর দুটি খণ্ডের কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। এখানে পাঠকের কিছু অসুবিধার কথা সংক্ষেপে উল্লেখ ও কিছু প্রস্তাব উপস্থিত করব। বহু খণ্ডে প্রকাশিতব্য কোনও গ্রন্থের নামের সঙ্গে সেই খণ্ডের ক্রমসংখ্যা উল্লেখ না করে আলোচ্য ঘটনাবলির সময়কাল (তাও আবার শুধু বঙ্গাব্দ) উল্লেখ করা যে একটি বেনজির ব্যাপার তাতে কোন সন্দেহ নেই। রবিজীবন-এর প্রথম খণ্ডটিকে শুধুমাত্র '১৩৩৩- ১৩৩৪' বলে চিহ্নিত করা যে ভবিষ্যতে পাঠক, পুস্তক বিপণির বিক্রেতা ও গ্রাহক সকলের জন্যই বইটির সুনির্দিষ্ট উল্লেখের ক্ষেত্রে প্রভূত অসুবিধা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, সম্ভবত একথা উপলব্ধি করে দ্বিতীয় খণ্ডটিতে বইয়ের স্পাইন ও নামপত্রে শুধু '২' সংখ্যাটি মুদ্রিত হয়েছে, এটি একটি স্বস্তিদায়ক ব্যাপার। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে সামনের প্রচ্ছদেও এই প্রণালী অনুসৃত হবে।
প্রশান্ত পালের গ্রন্থে অধ্যায়গুলির নামকরণ প্রণালীর অনুসরণ করতে গিয়ে রবিজীবন বইটিতে আরেকটি বিভ্রান্তিকর ব্যাপার সংক্রমিত হয়েছে। প্রশান্তকুমার যেহেতু রবীন্দ্র জীবনের প্রতিটি বছর ধরে অধ্যায়গুলি সাজিয়েছিলেন ও সেই বছরে রবীন্দ্রনাথের বয়স দিয়ে প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন, সেহেতু রবীন্দ্র-জীবনের প্রথম বছরের বিবরণকে প্রথম অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করায় কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এক্ষেত্রে রবিজীবন প্রণেতা রবিজীবনীর সেই প্রণালী অনুসরণ করার ফলে আলোচ্য গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম অধ্যায়টির ক্রমসংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৬৬! ক্রমসংখ্যার এই প্রণালী অনুসরণ করা খুব জরুরী ছিল বলে আমাদের মনে হয়নি, কারণ এমনিতেই প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনামের নিচেই রবীন্দ্রনাথের বয়স (একেবারে বছর মাস দিনের হিসেব সহ) উল্লিখিত হয়েছে।
গ্রন্থটিতে অনুসৃত দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন নামের (ব্যক্তি, স্থান, সংবাদপত্র, হোটেল ইত্যাদি) উল্লেখের রীতিটি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা আমাদের উল্লেখ করা দরকার মনে হয়। রবিজীবনী-তে প্রশান্ত পাল যে-রীতি অনুসরণ করেছেন তা হল, বিদেশী নামগুলোকে রোমান হরফে এবং দেশী নামগুলোকে বাংলা হরফে উল্লেখ করা। আলোচ্য গ্রন্থটিতেও লেখক মোটামুটি সেই রীতি অনুসরণ করেছেন। এই পদ্ধতির পক্ষে যুক্তিটি হল, বিদেশী নামগুলোর সঠিক উচ্চারণ অনেক সময় বানান থেকে বোঝা যায় না ও বাংলায় প্রতিবর্ণীকরণ করার ফলে সেটি সঠিক উচ্চারণ নির্দেশ নাও করতে পারে। কিন্তু দেশি নামগুলোর ক্ষেত্রে সেকথা প্রযোজ্য নয়।
আলোচ্য গ্রন্থটিতে আমরা দেখতে পাই, অনেক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির সঙ্গতি রক্ষিত হয়নি। যেমন একই সঙ্গে হোটেলের নাম রোমান হরফে ও ব্যক্তিনাম বাংলা হরফে (খণ্ড ১, পৃ. ৫৫- 'সাল্ ভাদোরি', ঐ পৃ ৮৩- Eucken ও 'আইনস্টাইন' ইত্যাদি)। আবার কোথাও দেখা যায় একই ভারতীয় পদবী একই পৃষ্ঠায় পাশাপাশি দু রকম হরফে উল্লিখিত হয়েছে (খণ্ড ২, পৃ ৫৫- 'গান্ধির আন্দোলন পর্বের দীর্ঘদিনের সঙ্গী Gandhi, Khushalchand Moganlal...')। বিদেশী ব্যক্তিনামগুলির ক্ষেত্রেও পদবীটি নামের আগে উল্লেখ্য, না পরে, সে ব্যাপারেও কোথাও কোথাও সঙ্গতি রক্ষা হয়নি।
এই জাতীয় বৃহৎ আকরগ্রন্থে অল্পস্বল্প মুদ্রণ প্রমাদ অস্বাভাবিক নয়, এই আলোচ্য দুটি খণ্ডেও অল্প বিস্তার আছে, যা উল্লেখযোগ্য নয়। তবে সৌম্যেন্দ্রনাথ নামটি প্রথম খণ্ডে বারবার 'সৌমেন্দ্রনাথ' ছাপা হওয়াতে মনে হয় এটি নিছক মুদ্রণপ্রমাদ নয়, সম্ভবত প্রুফ সংশোধনের প্রমাদজনিত বিপত্তি (দ্বিতীয় খণ্ডে অবশ্য বানানটি সঠিকভাবেই ছাপা হয়েছে)। আবার বিভিন্ন বই বা চিঠিপত্রের উদ্ধৃত অংশগুলির উল্লেখপঞ্জিতে বিভিন্ন বইয়ের প্রকাশক ও প্রকাশকালের উল্লেখের ক্রমটিতেও অসংগতি চোখে পড়ে (উদাহরণ প্রথম খণ্ডে ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের উল্লেখপঞ্জির ১, ৬, ৮, ১৫ ও ৩০ সংখ্যক উল্লেখগুলি, পৃ ২৫১)।
জীবনবৃত্তান্ত রচনায় বিভিন্ন লেখকের বই থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে অনেক সময় মূল বিবরণের মধ্যে কেবলমাত্র লেখকের নামটি উল্লেখ করে সেখানে উদ্ধৃতির মূল উৎসটির (বই/পত্রিকা) উল্লেখ না করে শুধু একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে অধ্যায়ের শেষে আলাদাভাবে উল্লেখসূত্রের তালিকার মধ্যে বইটির নাম ও অন্যান্য বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে (সেখানে আবার লেখকের নাম অনুপস্থিত)। শুধু প্রশান্ত পালের রবিজীবনীতেই নয়, আরো অনেক গ্রন্থে অনেক দিন ধরেই এটি একটি অনুসৃত প্রথা হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, গ্রন্থটি পড়ার সময় যখন পাঠকের উদ্ধৃতির উৎসটি জানার ইচ্ছে হবে, তখন বারবার পাতা উল্টিয়ে অধ্যায় শেষে নির্দিষ্ট উল্লেখপঞ্জীর পৃষ্ঠায় গিয়ে বইটি সম্পর্কে জানতে হবে, এই পদ্ধতি নিবিষ্ট পাঠে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে বলে মনোযোগী পাঠকের পক্ষে অসুবিধাজনক। এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব, কোনো অধ্যায়ে কোনো বইয়ের উদ্ধৃতি প্রথমবার ব্যবহৃত হবার সময় লেখকের নাম ছাড়া উল্লেখবাচক সংখ্যা সহ বইটির নামও দেওয়া হোক (আলোচ্য বইটির ক্ষেত্রে অবশ্য দু একবার তা দেওয়া হয়েছে)। একই উৎসের পরবর্তী উল্লেখের সময় উদ্ধৃতির শেষে সেটির সংক্ষিপ্ত নাম বা 'পূর্বোক্ত' বা 'ঐ'/'তদেব' এই জাতীয় কোন সংকেত ব্যবহার করা যেতে পারে। অধিকন্তু গবেষকদের জন্য সংখ্যা নির্দেশসহ উল্লেখপঞ্জীতে বইটির বিস্তারিত বিবরণ (প্রকাশক, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি) দেওয়া যেতেই পারে। সাধারণ পাঠকের, সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রচলিত রীতি বা প্রথার এইটুকু পরিবর্তন বর্তমান গ্রন্থকারের কাছে আশা করা যেতেই পারে, কারণ অন্যান্য নানা বিষয়ে তিনি প্রচলিত প্রথা ভাঙার সাহস দেখিয়েছেন।
আমরা এতক্ষণ যে সব কথা আলোচনা করেছি ও আলোচিত গ্রন্থটির অসাধারণ স্বাতন্ত্র্যের যেসব নিদর্শন তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, তাতে হয়তো পাঠকের কাছে এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়েছে যে রবিজীবন বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠতম পুরুষটির জন্য একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী জীবনীগ্রন্থ হিসেবে উঠে আসায় এক বিপুল প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। এই গ্রন্থের পরবর্তী খণ্ডগুলি যাতে বাধাহীন ভাবে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হতে পারে-- প্রকাশক ও পাঠকসমাজের দিক থেকে এরকম উপযুক্ত এক পরিবেশ ও আনুকূল্য বজায় থাকুক -- বর্তমান পর্যালোচকের এই ভাবনার সঙ্গে আশা করি রবীন্দ্র-অনুরাগী বাঙালিমাত্রই একমত হবেন। আমরা এই ব্যাপারে আশাবাদী এ কারণে যে, একটি যথার্থ আধুনিক জীবনবৃত্তান্ত হয়ে ওঠার পক্ষে সব রকম যোগ্যতা ও সম্ভাবনাই এই গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের মধ্যে রয়েছে।
আমাদের এই প্রত্যাশার সপক্ষে আরো দু'টি প্রধান কারণ উল্লেখ করব। প্রথমত কম্পিউটার প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে পারঙ্গম এই লেখক উপযুক্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে বহুমূল্য ও দুষ্প্রাপ্য নানা সংবাদ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করেছেন ও অদ্যাবধি করে চলেছেন। দ্বিতীয়ত রবীন্দ্র-জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন কাহিনী প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলির তথ্যভিত্তি তিনি ইতিপূর্বেই তৈরি করে রেখেছেন। তাই প্রকাশক ও পাঠকের প্রয়োজনীয় আনুকূল্য লাভ করলে আমাদের উপরোক্ত আশা পরিপূর্ণ হতে হয়তো খুব দেরি হবে না। তাই সবশেষে আমাদের এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করব যে, ''রবিজীবন' খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হয়ে রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসুদের দীর্ঘদিনের একটি অভাবই শুধু পূরণ করবে না, কালক্রমে বাংলায় প্রামাণ্য জীবনবৃত্তান্ত রচনার ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাইলফলকও স্থাপন করবে। আমাদের এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশার সবচেয়ে বড় কারণ, এই অসামান্য গবেষকের বিভিন্ন প্রকাশিত গ্রন্থের যে-বিবরণ আমরা উপস্থিত করেছি, তার মধ্যে লক্ষ করা যায় তাঁর এই নিরুচ্চার ও দৃঢ় প্রত্যয় — "আমার যেটুকু সাধ্য, করিব তা আমি!"
রবীন্দ্র-গবেষণায় এই লেখকের একাগ্র দৃষ্টি সমাগত নতুন শতক ও তার নবীন প্রজন্মের অভিমুখে প্রসারিত, তাই তাঁর বলিষ্ঠ আশাবাদ আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ লক্ষ করে একদা লিখেছিলেন, "কাল প্রসন্ন...—সুপবন বহিতেছে দেখিয়া, জাতীয় পতাকা উড়াইয়া দাও—তাহাতে নাম লেখ 'শ্রীমধুসূদন'।” আজ আমরাও যেন অনুভব করছি, বাঙালির রবীন্দ্রচর্চার জগতে সনিষ্ঠ সারস্বতচর্চার সুপবন বইছে। বিজন ঘোষাল রচিত এই গ্রন্থগুলির প্রকাশের মাধ্যমে যেন এক নতুন সময়ের আবির্ভাবের সূচনা দেখা যাচ্ছে! রবীন্দ্র-গবেষণা ও রবীন্দ্রচর্চার এই নবীন পর্বে যে-পতাকা উত্তোলিত হবে তাতে নিশ্চয়ই সর্বাগ্রে লেখা হবে রবিজীবন প্রণেতার নাম।