রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যাঁরা প্রাত্যহিক জীবনে যাপন করেন, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন যে সবটুকু মানবজীবনও অনন্তের রাগিণীতে বাঁধা একটি সঙ্গীত ছাড়া কিছুই নয়। সৃষ্টির ‘গহন কুসুম মাঝে’ যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রাণকম্পন চলছে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে সেটারই বেদনব্যথা ও আনন্দ আমরা মনে অনুভব করি। যে সত্যদৃষ্টির জন্য মানুষ যুগে যুগে সাধনা করছে সেই সত্যদৃষ্টিই আমরা দেখি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এই সীমায়িত পরিসরে আমরা কবির গানের ভুবনের কয়েকটি ঝলক উপস্থাপন করলাম মাত্র, যা অনিবার্যভাবে আংশিক, সম্পূর্ণ নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পী ও সাহিত্য জীবনের সূচনার কথা জীবন স্মৃতি-তে ব্যক্ত করেছেন। বলছেন, “কবে যে গান গাইতে পারতাম না – সে কথা মনে পড়ে না”। এগারো বছর বয়সে পিতার সঙ্গে প্রথম শান্তিনিকেতন গিয়ে বালক কবি লিখে ফেলেন ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ নামে এক বীররসাত্মক কাব্য নাট্য। এরপর তিনি কয়েকটি গাথাও রচনা করেন। শৈশব সঙ্গীত নামে সেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল।
তেরো বছর বয়সে “হিন্দুমেলার উপহার” নামে একটি কবিতা লিখে তিনি নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলার অধিবেশনে পাঠ করেন। কবির এই প্রথম স্বনামে মুদ্রিত কবিতা। তার প্রথম ক’টি পঙ্ক্তি —
হিমাদ্রি শিখরে শিলাসন ‘পরি,
গান-ব্যাস-ঋষি বীণা হাতে করি’ —
কাঁপায়ে পর্বত শিখর কানন,
কাঁপায়ে নীহার-শীতল বায়।
এই তেরো বছর বয়সেই বিখ্যাত ভজন “গগন সৈ থাল” গানটির বাণী অনুসরণ করে কবি তাঁর প্রথম রচিত, “গগনের থালে রবীচন্দ্র দীপক জ্বলে” গানটি লেখেন।
চোদ্দ বছর বয়সে “বনফুল” নামক আরও একটি কাব্য জ্ঞানাঙ্কুর নামক মাসিক পত্রে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের রচনারাজির মধ্যে ‘কবিকাহিনী’ নামক খণ্ড-কাব্য প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় তাঁর সতেরো বছর বয়সে। আর ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগু্ণ’ গানটি লেখেন জ্যোতিদাদার (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) ‘সরোজিনী’ নাটকের জন্য।
তেরো থেকে চোদ্দ বছরের মধ্যে জ্যোতিদাদার উৎসাহ ও প্রেরণায় শুরু হয় তাঁর সঙ্গীত রচনা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর রচনা করতেন আর কবি তাঁর পাশে খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসে সেই সুরে কথা বসাতেন। সেই কিশোর বয়সের লেখা গানগুলি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে “কৈশোরক” পর্যায়ে সংকলিত হয়েছিল। জ্যোতিদাদার পরিকল্পিত সুর ভিত্তি করে কবির রচিত তেমন ক’টি গান —
১। “খুলে দে তরণী”
২। “না সজনি না”
৩। “বল দেখি সখি লো”
৪। “কে যেতেছিস্ আয়রে হেথা”- ইত্যাদি।
বালককাল থেকেই বৈষ্ণব সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছে তাঁর। বিদ্যাপতি থেকে গোবিন্দ দাস সবার কাব্যই তাঁকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো। পুরোনো পদকর্তাদের অনুসরণ করে ‘ভানুসিংহ’ ছদ্মনামে মাত্র সতেরো বছর বয়সে ব্রজবুলি ভাষায় যে প্রথম পদাবলীগুলি কবি রচনা করেছিলেন তার কৌতুককর কাহিনী তাঁর জীবনস্মৃতিতে নিজেই বর্ণনা করে গেছেন। মোট একুশটি (মতান্তরে বাইশটি) পদের মধ্যে তিনি মাত্র ন’টিকে সুরারোপিত করে গানে রূপায়িত করেন। বাকি পদগুলি কাব্য হিসেবেই তাঁর সাহিত্য ভুবনকে সৌরভ দিয়েছে। সুরারোপিত “গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে”, ‘শাওন গগনে”, “মরণরে তুঁহু মম” ইত্যাদি গানগুলি তাঁর রচিত পদাবলীগুলির উৎকৃষ্ট নিদর্শন, যার জনপ্রিয়তায় কোনও ভাটা পড়েনি।
পনেরো বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেশাত্মবোধক গানটি রচনা করেন। তারপর জীবনের নানা সময়েই দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে (বিশেষত স্বদেশী আন্দোলনের সময়) রচিত গানগুলি দেশবাসীকে নানা ভাবে প্রেরণা দান করেছে, বিশেষত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর সময়। তখন বাংলার আকাশবাতাস মুখরিত হয়েছে ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ প্রভৃতি কবিরচিত গানে। এমন ভাবেই স্বদেশবাসী তাঁর গানে মেতেছিল যে সেই সময় ভারত ভ্রমণরত ব্রিটিশ শ্রমিক দলের নেতা (ও পরবর্তীকালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী) স্যার র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড বলেছিলেন — “Tagore sang Bengal into a nation.” অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ গান গেয়েই বাংলাকে একটি ‘জাতি’তে পরিণত করলেন। বঙ্গভঙ্গের দিন, ১৬ অক্টোবর, ১৯০৫, কবি অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাগবাজার ঘাটে স্নান করে ‘একই সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন’ গানটি গাইতে গাইতে পথ চলতি মানুষদের হাতে একাত্মতার প্রতীক রাখি বেঁধে দেন। পরে তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলি “স্বদেশ” পর্যায়ে সংকলিত হয়েছে। উল্লিখিত গান দুটি ছাড়াও আরও বহু এখনও জনপ্রিয় গান, যেমন, “তোমারি তরে মা”, “তোর আপনজনে”, “রইল বলে রাখলে কারে”, “কেন চেয়ে আছো গো” ইত্যাদি ‘স্বদেশ’ পর্যায় ভুক্ত হয়।
প্রসঙ্গত, ১৮৮৫ সালে যখন ভারতের জাতীয় মহাসভার বা জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পত্তন হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন নবীন যুবক। অগ্রজদের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কংগ্রেসের একজন উৎসাহী সভ্য হলেন। কিন্তু ক্রমে তিনি বুঝতে পারলেন তৎকালীন কংগ্রেসের নীতি হল ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করে কিছু সুবিধা আদায় করা। এই ভিক্ষাবৃত্তি কবির মনঃপুত হল না। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে দিলেন। সেকালে বিশেষ বিশেষ সভা সমিতিতে রবিঠাকুরের উদ্বোধনী গান একটি আবশ্যিক অঙ্গ ছিল। এমনি কংগ্রেস অনুরাগীদের একটি ঘরোয়া আসরে যখন প্রারম্ভিক গান গাইবার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হল, কবি প্রথমে যেতে অরাজি ছিলেন। কিন্তু বিশিষ্ট বন্ধুর অনুরোধে না গিয়ে পারলেন না। যাবার আগে তিনি একটি গান রচনা করে নিয়ে গেলেন এবং আসরে পৌঁছে গানটি গেয়েই আসর ছেড়ে চলে গেলেন। এই গানের পরে সেদিনকার সেই সভা তো জমেইনি – উপরন্তু কিছু পরে সভা ভঙ্গ হয়। সেই শ্লেষাত্মক গানটি হল- “আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না”।
সতেরো বছর বয়সে কবি প্রথমবার বিলেত যান। বিলেত যাবার আগে মহর্ষির আদেশে কিছুকালের জন্য তাঁকে মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আমেদাবাদে থাকতে হয়। এখানে থাকাকালীন তাঁর প্রথম সুরারোপিত গানগুলি রচনা হয়েছিল। এখানকার এক নিঃসঙ্গ প্রাসাদের রহস্য তাঁর কবি চিত্তকে নানাভাবে উদ্বেলিত করেছিল। এই প্রাসাদকে অবলম্বন করেই তিনি লিখেছিলেন— “ক্ষুধিত পাষাণ”, যার ভিত্তিতে তপন সিংহ বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদে বসেই রচিত হয় “নীরব রজনী দেখ মগ্ন জোছনায়”।
মাত্র সতেরো বছর বয়েসে কবির প্রথম বিলেত যাত্রা। আমেদাবাদ থাকাকালীন ও বিলেত থেকে ফিরে আসার সময়ের মধ্যে তিনি বেশ কিছু গান, কবিতা, নাটক রচনা করেন। সেই সময় তিনি আইরিশ, স্কচ প্রভৃতি অন্যান্য বিদেশী সঙ্গীত চর্চা করেন। সেই সময় অক্ষয় চৌধুরী ও জ্যোতিদাদাও ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে বিলিতি গানের সুরের মিশ্রণে নানারূপ সুর উদ্ভাবনার চেষ্টায় উৎসাহী। কবি ফিরে এসে এই মেলবন্ধনে সহায়তা করলেন।
তিনি এই সময় জার্মান কবি হ্বাগনার-এর “মিউজিক ড্রামা” অনুসরণ করে বাল্মীকি প্রতিভা ও কালমৃগয়া নামে দু'খানি গীতিনাট্য রচনা করেন। এই দু’খানি নাটকেই বেশ কিছু গান আছে যা মূল বিলিতি গানের সুরে রচিত। কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী বিলিতি সুরে প্রভাবিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে বাল্মীকি প্রতিভার দুটি বিখ্যাত গান হল —
কালী কালী (‘Nancey Lee’)
সকলি ফুরালো (‘Robin Adir’)
আর কালমৃগয়ারও দুটি অতি জনপ্রিয় গানে নিম্নোক্ত ব্রিটিশ গান দুটির প্রভাব লক্ষণীয়।
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে (‘Ye Banks and Braes of Bonnie Doon’)
তুই আয়রে কাছে আয় (‘The British Grenadiers’)
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে এক বিশেষ শ্রেণির রাগাশ্রয়ী গানকেই বলা হয় ‘ভাঙা গান’ বা ‘গান ভাঙা'। এখানে ভাঙা অর্থে খণ্ডিত, বা, ইংরেজিতে split. এখানে 'ভাঙা’র অর্থ, এর অন্তর্গত শিল্পশৈলিকে বিশ্লিষ্ট, বিভাজিত করা। এককথায়, মূল গানের কাব্য-অবয়ব সংলগ্ন সুর ও ছন্দকে ‘মডেল’ রূপে ব্যবহার করে প্রয়োজনানুসারে গানের মূল ‘বন্দীশ’টির ভাব ও বাণীতে সামান্য পরিবর্তন সাধন করে ব্যবহার করা। এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন ড. আশিস বসুমল্লিক। তাঁর রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান গ্রন্থে দেওয়া তথ্য থেকে জানতে পারি যে এ-পর্যন্ত সংগৃহীত মোট ২২৩২টি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে ২৮০টি অর্থাৎ প্রায় ১২.৫ শতাংশ হল ‘ভাঙা গান’।
কবি প্রথম কৈশোরে জ্যোতিদাদার সাহচর্যে যেসব গান রচনা করেন তার বেশিরভাগই আদিরসাত্মক প্রেমের লঘু রচনা। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব, পিতার ও অগ্রজদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা এবং গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকন্ঠ সিংহ, যদু ভট্ট প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের শিক্ষা ও সাহচর্য তাঁকে যৌবনের প্রারম্ভেই ধর্মসংগীত তথা ব্রহ্মসংগীত রচনায় অনুপ্রাণিত করে। এইসব ধর্মসংগীত রচনায়ও তিনি স্বাধীনভাবে সুরসংযোজনা করেননি। হিন্দুস্থানী রাগসংগীতকে মূল ভিত্তি করেই তিনি অধিকাংশ গান রচনা করেন। একুশ বছর থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি এই গানগুলি রচনা করেন। যেমন —
বাজাও তুমি কবি (আয়ে ঋতুপতি)
বাণী তব ধায় (বেণী নিরখত)
মন জাগো মঙ্গললোকে (জাগো মোহন)
মহারাজ একি সাজে (মেরে দুন্দ দুল)
আনন্দধারা বহিছে (লাগি মেরে ঠুমক)
জাগে নাথ জোছনা (আজু রঙ্গ খেলত)
কার মিলন চাও (তনু মিলনদে)
আজি মম মন চাহে (ফুলি বন ঘন মোর)
ভারতীয় রাগসংগীতের বিভিন্ন ধারাকে রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর সংগীত রচনায় গ্রহণ করেছেন বাঙলা দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ আঞ্চলিক সঙ্গীত কীর্তন গানের সুরকেও তেমনি গ্রহণ করেছেন তাঁর সংগীত রচনায়, পদাবলী কীর্তন গানের পরিবেশন রীতি অনুযায়ী প্রথমে তিনি কয়েকটি আখরযুক্ত কীর্তন রচনা করেন। এই সময়ের সব কীর্তন গানই ব্রাহ্ম সমাজের প্রয়োজনে রচিত। যেমন, “ওহে জীবন বল্লভ”, “আমি সংসারে মন দিয়েছিনু”, “আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি”, ইত্যাদি। কীর্তন গানের সুরপ্রয়োগ ও পরিবেশনপদ্ধতিকে অক্ষুন্ন রেখে পরবর্তীকালে নিজস্ব ঐতিহ্যপূর্ণ অনেক কীর্তন অঙ্গের গান রচনা করেছেন। তেমনি কয়েকটি গান “প্রভু আজি তোমার দক্ষিণ হাত”, “ওই আসনতলের”, “তোমরা যা বল তাই বল”, “রোদন ভরা এ বসন্ত” ইত্যাদি।
১৮৮৮ সালে কবি তাঁর সাতাশ বছর বয়সে আর একখানি গীতিনাট্য রচনা করেন — মায়ার খেলা। স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত “সখিসমিতি”র মেয়েদের অভিনয়ের প্রয়োজনে এর জন্ম। বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হচ্ছে বাল্মীকি প্রতিভায় যেমন অভিনয়টা মুখ্য, মায়ার খেলায় তেমনই সঙ্গীতই প্রধান। অর্থাৎ, নাট্যের সূত্রে গানের মালা। ‘বিদায় করেছ যারে’, ‘এরা সুখের লাগি’, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’ এই গীতিনাট্যের কয়েকটি গান।
তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে গীতাঞ্জলির গানগুলি একটা যুগ সৃষ্টি করেছে। গীতাঞ্জলির গীতিকবিতাগুলোই একদিন সমস্ত পৃথিবীর কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছিল। তাই এই যুগকে আমরা গীতাঞ্জলির যুগ বলছি। এই যুগের সঙ্গীত রচনার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয় ১৮৮০ সালে, কল্পনা কাব্যপুস্তক প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে। এই যুগের সময়কাল কবির তিপ্পান্ন বছর পর্যন্ত বিস্তৃত।
কল্পনা কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ যেখানে কবিতা ও গীতিকবিতার মিশ্র সংকলন প্রকাশ পেয়েছে। এরপরে ১৯০৯ সালে নৈবেদ্য, ১৯০৩ সালে উৎসর্গ সংকলন। গীতাঞ্জলির প্রস্ততিপর্ব থেকে শুরু করে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হবার কিছুকাল পরে পর্যন্ত এই যুগকে আমরা পর্যায়বদ্ধ করেছি। এই যুগের সব কাব্যগ্রন্থেই কবিতার সঙ্গে গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে।
এর পাশাপাশি, গানের ‘তাল’ নিয়েও ভেবেছেন তিনি। চালিয়েছেন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। তাঁর গানগুলিকে নতুন নতুন ছন্দে বিভক্ত করে বেশ কিছু নতুন তালের উদ্ভাবন করেছেন। রবীন্দ্রসৃষ্ট এই তালগুলিকে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের নবতম সংযোজন বলা যায়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এতপ্রকার শাস্ত্রীয় তালের প্রচলন থাকা সত্ত্বেও নতুন তাল উদ্ভাবনের সার্থকতা কোথায়? এ প্রসঙ্গে দুটি কারণ নির্ণয় করা যায়। প্রথমত, কবিতা আবৃত্তির ছন্দকে তিনি গানের সুরে বেঁধেছেন এবং দ্বিতীয়ত, গীতিকবিতার অন্তর্নিহিত ভাবকে অধিকতর মনোগ্রাহী করে প্রকাশ করেছেন। কবিসৃষ্ট নতুন তালগুলির উদাহরণ — ঝম্পক (৫ মাত্রা), রূপকড়া (৮ মাত্রা), নবতাল (৯ মাত্রা), ‘একাদশী’ (১১ মাত্রা) ও ‘নবপঞ্চতাল’ (১৮ মাত্রা)। বাকি তালগুলোর ছন্দোরূপ সংশ্লিষ্ট গানের সঙ্গে বিভিন্ন স্বরলিপির পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে।
শিলাইদহে থাকাকালীন প্রথম কবি পল্লী বাউলদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। বাউলদের রচিত গানের সহজ কথা, সহজ সুর ও সরল ছন্দ তাঁর মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়, বিশেষত, লালন ফকিরের মতো ভুবনখ্যাত বাউলের গান। এইসব সুরের আদর্শে বহু গান তিনি রচনা করেছেন। মূল রচনার সুর নিয়ে তিনি প্রথম কয়েকটি বাউল ও সারিগান রচনা করেন। পরে বাউলের সুরের সঙ্গে কীর্তন অথবা অন্য কোন বিশেষ রাগসংগীতের সুর মিশিয়ে তিনি বাউল গানকে এক অপরূপ সুর বৈশিষ্ট্যে রূপায়ন করেন। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সুরারোপিত এই গানগুলিকে ‘রাবীন্দ্রিক বাউল অঙ্গের গান’ বলা যেতে পারে। যেমন, “ভেঙে মোর ঘরের চাবি”-র পিছনে আছে “দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ” এবং “আমার সোনার বাংলা” গানটি মূল বাউল গান — “আমি কোথায় পাব তারে”-র প্রভাবে রচিত। আবার, মহাত্মা গান্ধীর অতি প্রিয় “যদি তোর ডাক শুনে” গানটি প্রভাবিত “হরি নাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই রে”, নামক জনপ্রিয় বাংলা ঢপকীর্তন দ্বারা। এছাড়া, “মনমাঝি সামাল সামাল” মূল সারি গানের সুর নিয়ে রচনা করেছেন “এবার তোর মরা গাঙে”।
বাউল অঙ্গের গান ছাড়া, “রামপ্রসাদী” সুরের প্রভাবেও তিনি তিনটি গান রচনা করেছেন। “আমরা মিলেছি আজ”, “আমি শুধু রইনু বাকী” এবং “শ্যামা এবার ছেড়ে চলেছি মা”।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিভিন্ন প্রদেশের আঞ্চলিক সুরকে তিনি তাঁর সংগীত রচনায় ধরে রেখেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় রচিত সংগীতের ধারা, মহীশূরী, গুজরাটি ও পাঞ্জাবী ভজনের সুর মারাঠী প্রবন্ধ ও শিখের দোহার সুরকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে রূপায়িত করে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন। দক্ষিণ ভারতীয় আঞ্চলিক সুরে রচিত তিনটি বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত নীচে দেওয়া হল।
বাজে করুণ সুরে (মাদ্রাজী) নিতু চরণ মূলে
বাসন্তী, হে ভুবন মোহিনী (মাদ্রাজী) মীনাক্ষী মে মুদম্
নীলাঞ্জন ছায়া (মাদ্রাজী) বৃন্দাবন লোলা
এছাড়া কানাড়ী ভাষার প্রভাবে রচিত দুটি গান হল —
বড় আশা করে (সখি বা বা)
আজি শুভ দিনে (পূর্ণ চন্দ্রাননে)
এছাড়া মহীশূরী ভজনের সুরে রচনা করেন “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে” ও “একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ”। এছাড়া, গুজরাটি ভজন অনুপ্রাণিত কয়েকটি গান হল — “একি অন্ধকারে এ ভারতভূমি”, “কোথা আছ প্রভু”, “নমি নমি ভারতী”।
কবি রচিত পাঞ্জাবী ভজনাশ্রিত দুটি গান — এ হরি সুন্দর - মূল গান (এ হরি সুন্দর) এবং পূর্বে উল্লেখিত — “গগনের থালে রবিচন্দ্র দীপক জ্বলে” — মূল গান (গগনোমে থাল)। এছাড়াও, শিখ দোহা অনুসরণ করে সুর দেন — “বাজে বাজে রম্যবীণা” — মূল গান (বাদৈ বাদৈ রম্য বীণ)।
প্রথম জীবনে ঠুংরী গান শোনার সুযোগ কবির ঘটেনি। মার্জিত রুচিসম্পন্ন অভিজাত পরিবারে এই গানের প্রচলন কোনও কারণে নিষিদ্ধই ছিল। পরিণত বয়সে কবি একবার লক্ষ্ণৌ বেড়াতে যান। সেখানে অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহাতিশয্যে তিনি এক বিখ্যাত শিল্পীর কন্ঠে ঠুংরী গান শোনেন। এই গানের গীতিরীতি তাঁর মনকে মুগ্ধ করে। এরপর এই গানের গীতিরূপ নিয়ে তিনি অল্প কয়েকটি গান রচনা করেন। তাছাড়া টপ্পা গানের গীতি-রীতির সঙ্গে ঠুংরী গানের চাল মিশিয়ে আর একটি নতুন সঙ্গীত ধারারও তিনি প্রবর্তন করেন। এই রীতিকে “টপ্-ঠুংরি” বা টপ্পা চালের গান আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। ঠুংরী গানের গীতরূপ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন — “তুমি কিছু দিয়ে যাও” (মূল ঠুংরি, ‘কোই কুছু কহ রে’), “কখন দিলে পরায়ে স্বপনে” (মূল ঠুংরি - ‘কিহ্নে দেখা কানহাইয়া প্যার কি বনশীবালা’) ইত্যাদি গানগুলি।
একই গানকে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন সুর ও ছন্দে রূপায়িত করে তিনি বহু গান রচনা করেছেন। সাধারণভাবে দেখতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি গানকে একক কন্ঠে গাইবার জন্য যে সুরটি তিনি প্রয়োগ করেছেন, সেই সুরটি সম্মেলক কন্ঠে গাইবার উপযোগী নয় বলে গানটির সুর ও ছন্দ তিনি বদলে দিয়েছেন। “আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে”, “বসন্তে বসন্তে তোমার”, “ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো”, “আমার নিশীথ রাতের” ইত্যাদি গানগুলিতে এরকমই সুরান্তর ও ছন্দান্তর ঘটেছে।
কবির মার্জিত রসবোধ বিচিত্ররূপে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাহিত্যে ও সঙ্গীতে। সাধারণ কথাবার্তায় তাঁর সরস টীকা-টিপ্পনী সঙ্গীমহলে হাসির বান ছুটাতো। প্রহসনমূলক নাটকগুলিই তার দৃষ্টান্ত। নানা সময়ে হাসির গানও লিখেছেন কয়েকটি — যেমন, “কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানা দেবী/ তাঁরি পদ সেবি, করি তাঁহারই ভজনা”। বা, চিরকুমার সভা নাটকের জন্য লেখা “স্বর্গে তোমায় নিয়ে যাব”, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কী”, “কত কাল রবে, বল ভারত রে” ইত্যাদি।
শান্তিনিকেতনে অধ্যাপকদের একটি চায়ের মজলিস ছিল। কবি ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে চীন ভ্রমণ করে শান্তিনিকেতনে ফিরেছেন। এখানে এই ‘চা’ এর আড্ডাটির কথা তিনি আগেই জানতেন। চীন ভ্রমণ কালে সুসীমো ছিলেন কবির সঙ্গী ও দোভাষী। কবি তাঁর এই চীন দেশীয় বন্ধুটির সৌজন্যে মজলিসটির নাম দিলেন “সুসীমো চা চক্র”। এই চা চক্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি যে গান রচনা করেছিলেন। সেই গানটির রচনার মধ্যে বিভিন্ন বিভাগীয় অধ্যাপকদের পরিচয় বিধৃত। পুরো গানটিই নীচে দেওয়া হল।
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল' চল' চল' হে॥
টগ'বগ'-উচ্ছল কাথলিতল-জল কল'কল'হে।
এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ॥
শ্রাবণবাসরে রস ঝর'ঝর' ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
এস' পুঁথিপরিচারক তদ্ধিতকারক তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস' গণিতধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।
এস' বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।
এস' হিসাবপত্তরত্রস্ত তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত লোচনপ্রান্ত- ছল'ছল' হে।
এস' গীতিবীথিচর তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।
এস' চিত্রী চট'পট' ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস' কন্স্টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।
এস' কমিটিপলাতক বিধানঘাতক এস' দিগভ্রান্ত টল'মল' হে॥
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “কথার যেখানে শেষ গানের সেখানে শুরু। আমরা যখন কথার ভিতর দিয়ে আমাদের হৃদয়াবেগ প্রকাশ করতে যাই— আবেগের তীব্রতা আমাদের ভাষাকে স্তব্ধ করে দেয়। তখনি কন্ঠে আমাদের সুরের ছোঁয়া লাগে।” কবি তাঁর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে, তাঁর পূর্বরচিত বহু কবিতাকে সুরারোপিত করে গানে রূপ দিয়েছেন। কাব্যের ভিতর দিয়ে যে ভাবকে তিনি প্রকাশ করতে পারেননি, সুর দিয়ে তার মর্মবাণীকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই পর্যায়ের গানগুলিকে “কাব্যগীতি” শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
গীতাঞ্জলি যুগে রচিত তাঁর বিখ্যাত “ভারততীর্থ” কবিতাটিকেও তিনি এই সময়ে সঙ্গীতে রূপায়িত করেন। কাব্যের ভিতর দিয়ে যে ভাবকে তিনি প্রকাশ করতে পারেননি, সুর দিয়ে তার মর্মবাণীকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ পর্যায়ের গানগুলিকে “কাব্যগীতি” শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। কবির বিশেষ ইচ্ছায় ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় মহাসভার অধিবেশনে এই গানটি দেশাত্মবোধক গান হিসেবে সম্মেলক কন্ঠে পরিবেশিত হয়। গানটির প্রথম লাইন— “হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে”। দেশাত্মবোধক গান ছাড়া রয়েছে, বলাকা কাব্যগ্রন্থের “তুমি কি কেবলই”, বা, মহুয়া কাব্যগ্রন্থ থেকে সুরারোপিত ‘আমার নয়ন ভুলানো এলে’ ইত্যাদি।
১৯৩৭ সালে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে শান্তিনিকেতনের তৎকালীন সেতার শিক্ষককে অনুরোধ করলেন কয়েকটি বিভিন্ন পর্যায়ের মল্লার রাগের গৎকে সেতারের “ডা-রা ডা-রা” ইত্যাদি শব্দের ছন্দে লিখে দিতে। শিল্পী একটি “দেশ মল্লার” ও অপরটি “গৌড় মল্লার” রাগে দুটি গৎ লিখে দিলেন। কবি সেই গতের ছত্রে ছত্রে কথা বসিয়ে অতি সুন্দর দুটি বর্ষা সংগীত রচনা করেন। দেশমল্লার রাগে রচনা করেন— “এসো শ্যামল সুন্দর” ও গৌড় মল্লার রাগে রচনা করেন— “মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো”। “সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে” গানটিও সেতারের ‘দারা-দিম দারা-দিম’ ছন্দে লেখা।
কবিগুরুর অনেক সঙ্গীত রচনার পেছনে আরও বহু তথ্য লুকিয়ে আছে। সেসব গানের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। ছোট ছোট নানা ঘটনার ও পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেছিলেন— “অয়ি ভুবন মনমোহিনী”, “অনেক কথা যাও যে বলে”, “সে কোন্ বনের হরিণ”, “সংকোচের বিহ্বলতা”, “সর্বখর্বতারে সহে”, “সমুখে শান্তিপারাবার” এবং আরো অনেক গান।
কবির নাতবৌ অমিতা ঠাকুর একজন সুকন্ঠী শিল্পী। একবার শান্তিনিকেতনে রোগশয্যায় শায়িত গুরুদেব মাথার কাছে সেবারতা অমিতাকে দেখে একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। স্বভাবলাজুক অমিতা সলজ্জ কুন্ঠায় সেদিন কিছুতেই গুরুদেবের অনুরোধ রাখতে পারলেন না। কিন্তু পরে হঠাৎ একদিন বিনা অনুরোধে কি ভেবে বারান্দার সিঁড়িতে বসে আপন মনে একটি গান গেয়ে যেতে লাগলেন। গুরুদেব চুপি চুপি এসে পেছনে চেয়ারে বসে, নিস্তব্ধ বিস্ময়ে সেই গান শুনতে শুনতে সুরের রস-সমুদ্রে ডুবে গেলেন। সেই গানটি শুনে কবি রচনা করলেন— “দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে”।
১৩২৪ সালে দিনেন্দ্রনাথের একটি পোষা হরিণ হঠাৎ ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে পালিয়ে যায়, পরে দূরবর্তী এক গ্রামে সাঁওতালরা তাকে মেরে ফেলে। এই খবরে দিনেন্দ্রনাথের পত্নী শ্রীযুক্তা কমলা দেবী অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে পড়েন। এসময় তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কবি ‘সে কোন্ বনের হরিণ’ গানটি রচনা করেন। বুদ্ধগয়া ভ্রমণে গিয়ে একদিন সকালে “এদিন আজি কোন ঘরে গো” গানটি লিখেছিলেন। হয়তো সে সময় বুদ্ধের কথাই তাঁর মনে হয়েছিল।
চিত্রশিল্পী শ্রীযুক্ত অসিতকুমার হালদার মহাশয়ের একটি ছবি দেখে কবি গান বেঁধেছিলেন “একলা বসে একে একে” এবং তাঁরই আঁকা ‘অগ্নিবীণা’ কোলে সরস্বতীর ছবি দেখেই “তুমি যে সুরের আগুন” গানটি লেখেন। আবার, “নিভৃত প্রাণের দেবতা” গানটি শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু মহাশয়ের আঁকা একটি ছবি দেখে লেখা।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পালিতা কন্যা ও রবীন্দ্রনাথের নাতনি, নন্দিনী অতি শৈশবে কবির কাছে নানা গল্প শুনতে ইচ্ছে প্রকাশ করত। নিজেও আপন মনে শিশুসুলভ নানা কথা কবিকে শোনাতেন। কবি সবসময় স্পষ্ট করে তার অর্থ বুঝতেন না, কিন্তু উপভোগ করতেন। সেই সময় তিনি লিখেছিলেন “অনেক কথা যাও যে বলে”। “তুমি উষার সোনার বিন্দু” গানটিও নন্দিনীর উদ্দেশ্যে লেখা। এই নন্দিনীর পরিণয় উপলক্ষ্যেই কবি লিখেছিলেন আরেকটি গান — “সুমঙ্গলী বধূ”।
১৩৩৩ সালে, প্রবাসী পত্রিকার পঁচিশ বছর পূরণের আশীর্বাদস্বরূপ কবি একটি বড় কবিতা লিখেছিলেন। “পরবাসী চলে এসো ঘরে” এই কবিতার প্রথম অংশ দিয়ে দুটি গান তৈরি করেন। প্রথম গানটি হল ইমন কল্যাণ রাগে “পরবাসী চলে এসো” আর দ্বিতীয় অংশটিতে সুর যোজনা করলেন মিশ্র রামকেলীতে। তার প্রথম লাইন “এসো প্রাণের উৎসবে দক্ষিণ বায়ুর বেণুরবে”।
‘মরণ সাগর পারে তোমরা অমর’ গানটি সাধারণভাবে সব মহাপুরুষদের সম্বন্ধে প্রযোজ্য হলেও এটি রচিত হয়েছিল বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের মৃত্যু উপলক্ষ্যে এবং রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু দিবসের কথা ভেবে লিখেছিলেন “কে যায় অমৃতধাম যাত্রী”।
ফাল্গুন মাসে কবি ট্রেনে কোথাও গিয়েছিলেন, ট্রেনের সেই দ্রুত গতি তাঁর মনে একটা বিশেষ আবেগের সৃষ্টি করে, সেই আবেগ থেকেই উৎসারিত দুটি গান — “চলি গো চলি যাই গো চলে” এবং “ওগো নদী আপন বেগে”। গান দুটি স্থান পেয়েছে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে। ফলে, অনেকেরই ধারণা এই নাটকের কথা মনে করেই কবি এটি লিখেছিলেন, তা কিন্তু ঠিক নয়, এর মধ্যে রয়েছে রেলযাত্রার ছন্দ। তবে, ফাল্গুনী নাটকে গানটি যেভাবে স্থান পেয়েছে তাতেই এমন ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে হয়তো।
১৩২৯ সালে কবি সিন্ধু-কাথিয়াবাড় অঞ্চলে ভ্রমণ শেষ করে যখন শান্তিনিকেতনে ফিরলেন, তখন সঙ্গে করে এনেছিলেন কাথিয়াবাড়ের একটি চাষী পরিবারকে। তাদের একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে দুই হাতে দুজোড়া মন্দিরা (করতাল) নিয়ে খুব সুন্দর নাচত। কবির ইচ্ছে হল সেই নাচটি শান্তিনিকেতনে আশ্রমের মেয়েদের দেখানো। চৈত্র মাসের শেষে আম্রকুঞ্জে মেয়েটিকে নিয়ে একটি আসর বসে। এই নাচ দেখার পরে মুগ্ধ কবি গান লিখেছিলেন ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে’।
১৩৩৬ সালে (১৯২৯) যখন স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন দাস লাহোর জেলে অনশন ব্রত অবলম্বন করেন, তখন তাঁর মৃত্যুপণের সংকল্প ভারতবাসীর মনে খুব প্রভাব ফেলেছিল। এই আবহাওয়ার মধ্যে কবির তপতী নাটক লেখার সূত্রপাত। মহড়া চলাকালীন যতীন দাসের মৃত্যুসংবাদে কবি মর্মান্তিক আঘাত পেয়েছিলেন। মহড়া বন্ধ হয়ে যায়। সেই রাতেই তিনি লেখেন “সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধ দাহ” গানটি। পরে তপতী নাটকে এই গানটি জুড়ে দিলেন। এই গানটির প্রেক্ষাপট জানলে আমারা বুঝতে পারব মরমী কবির মনে যতীন দাসের মৃত্যু কত গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল! এর দশ বছর পর, ১৯৩৯ সালে, বড়দিন উপলক্ষ্যে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যুকে নিয়ে লিখেছিলেন — “একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে/ রাজার দোহাই দিয়ে”।
১৯৪০-এর আগস্ট মাসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কবিকে সাম্মানিক ডি. লিট. উপাধির জন্য নির্বাচন করেন। রবীন্দ্রনাথ অশক্ত শরীরে অক্সফোর্ড যাওয়ার অক্ষমতা জানানোয় তাঁরা শান্তিনিকেতন এসে ওই উপাধি প্রদান করেন। এই উপলক্ষ্যে রচিত হয়েছিল “বিশ্ববিদ্যা তীর্থপ্রাঙ্গণ” শীর্ষক গানটি।
১৩৪৬ বঙ্গাব্দে তিনি একবার তিন-চার মাস ধরে ডাকঘর নাটকের মহড়া দিয়েছিলেন। সেই সময় ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটি রচিত হয় এই নাটকের জন্যই। কিন্তু কবি বলেন, যদিও এটি অমলের মৃত্যুর গান কিন্তু এই গান যেন তাঁর মৃত্যুর আগে না গাওয়া হয়। বস্তুত পুরো ডাকঘর নাটকটিই কবি তাঁর নিজের মৃত্যু কল্পনা অবলম্বন করে লিখেছিলেন। প্রসঙ্গত, নাটকটির রচনাকাল ১৯১১ সাল (১৩১৮ বঙ্গাব্দ)। নাটকটি বিমূর্ত প্রতীকী হলেও দেশ ও বিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৩২২ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে কবি সকলের কাছে তাঁর এই নাটকের বিষয়ে ধারাবাহিক কতগুলো বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পৃথিবীর চেনা জগৎ থেকে মৃত্যুর পরে অতি সহজে এক অপরিচিত অন্য-লোকে চলে যাবার অনিবার্যতাই কবিকে শেষ জীবনে আবার ডাকঘর অভিনয়ে উৎসাহ দান করেছিল।
ডাকঘর-এর উৎস কোথায়, তা শ্রীযুক্তা নির্ঝরিণী সরকারকে লেখা একটি চিঠি পড়েও জানা যায়। চিঠিটি এই নাটক রচনার সমসাময়িক, ১৩১৮ সনের ২২ আশ্বিন লেখা —
“মা, আমি দূরদেশে যাবার জন্য প্রস্তত হচ্ছি। আমার সেখানে অন্য কোনো প্রয়োজন নাই, কেবল কিছু দিন থেকে আমার মন এই বলচে যে, যে পৃথিবীতে জন্মেছি সেই পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিয়ে তবে তার কাছ থেকে বিদায় নেব। এরপরে আর তো সময় হবে না। সমস্ত পৃথিবীর নদী গিরি সমুদ্র এবং লোকালয় আমাকে ডাক দিচ্ছে — আমার চারিদিকে ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়বার জন্য মন উৎসুক হয়ে পড়েছে। যেখানে দীর্ঘকাল থেকে কাজ করি সেখানে আমাদের কর্ম ও সংস্কারের আবর্জনা দিনে দিনে জমে উঠে চারিদিকে একটা বেড়া তৈরি করে তোলে। আমরা চিরজীবন আমাদের নিজের সেই বেড়ার মধ্যেই থাকি, জগতের মধ্যে থাকিনে। অন্তত মাঝে মাঝে সেই বেড়া ভেঙে বৃহৎ জগৎটাকে দেখে এলে বুঝতে পারি আমাদের জন্মভূমিটি কত বড়ো — বুঝতে পারি জেলখানাতেই আমাদের জন্ম নয়। তাই আমার সকলের চেয়ে বড়ো যাত্রার পূর্বে এই ছোটো যাত্রা দিয়ে তার ভূমিকা করতে চাচ্ছি — এখন থেকে একটি একটি করে বেড়ি ভাঙতে হবে, তারই আয়োজন।”এই ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ বাইরে লেখার ভিতর দিয়ে এমন ভাবে রূপ নিল যে তখন আর কবির সঙ্গে এর কোনো ব্যক্তিগত যোগ ধরবার সুযোগ থাকল না। প্রসঙ্গত বলি, নিজের স্বজনদের মৃত্যু নিয়েও গান রচেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পিতার মৃত্যু উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন, “কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ” এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গানটি।
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের (১৯৪১) ২৫ বৈশাখে কবির আশি বছরের জন্মোৎসব নিয়ে সমস্ত বাংলাদেশ মেতেছিল। কিন্তু তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাঝপথে। কবি তাঁর অন্তরের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন অদূর ভবিষ্যতে কী ভয়ঙ্কর দিন আসছে! যে-পশ্চিমী সভ্যতার আদর্শকে তিনি ও তাঁর প্রজন্ম বরণ করেছিলেন, সেদিন সেই পশ্চিমের জাতিগুলি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সমগ্র পৃথিবীকে বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে সামিল করেছে। সেই উপলক্ষ্যে, নববর্ষের (১লা বৈশাখ, ১৩৪৮) বাণীর মধ্য দিয়ে তিনি সেই আশাভঙ্গের কথা (‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে) লিখে যান। এই প্রেক্ষিতের সঙ্গে, শান্তিদেব ঘোষের কথায় জানতে পারি, নববর্ষের প্রভাতে বৈতালিকের জন্য তিনি একটি নতুন গান কবিকে লিখতে অনুরোধ করায় কবি লিখেছিলেন “ওই মহামানব আসে”। গানটি পরে যুক্ত হয়েছিল কবির শেষ প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সংকট’-এর শেষে, একটা আশাবাদ জাগিয়ে। এই গান রচনারও একটি প্রেক্ষিত রয়েছে। আসলে, একদিন সকালে শান্তিদেব কবির কাছে গিয়ে বললেন, “আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবিতা লিখেছেন, বক্তৃতা (‘সভ্যতার সংকট’) দিয়েছেন। অথচ গান রচনা করবেন না?” এই অনুরোধেই “ওই মহামানব আসে” (রচনাকাল- জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৮) গানটি রচিত হয়। শান্তিদেবের কথায়, “সেদিন একথা ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি যে এই তাঁর জীবনের সর্বশেষ গান।”
সব শেষে বলি, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যারা প্রাত্যহিক জীবনে যাপন করেন, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন যে সবটুকু মানবজীবনও অনন্তের রাগিণীতে বাঁধা একটি সঙ্গীত ছাড়া কিছুই নয়। সৃষ্টির ‘গহন কুসুম মাঝে’ যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রাণকম্পন চলছে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে সেটারই বেদনব্যথা ও আনন্দ আমরা মনে অনুভব করি। যে সত্যদৃষ্টির জন্য মানুষ যুগে যুগে সাধনা করছে সেই সত্যদৃষ্টিই আমরা দেখি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। এই সীমায়িত পরিসরে আমরা কবির গানের ভুবনের কয়েকটি ঝলক উপস্থাপন করলাম মাত্র, যা অনিবার্যভাবে আংশিক, সম্পূর্ণ নয়।
তাঁর তিরোধান দিবসের প্রাক্কালে পাঠক বন্ধুদের কাছে আমার প্রিয় গানের এই কলি দিয়েই এই সামান্য লেখাটি শেষ করলাম — “শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে...।”
তথ্য সূত্র:
১) রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ - প্রফুল্লকুমার দাস
২) রবীন্দ্রঙ্গীত - শান্তিদেব ঘোষ
৩) যাত্রাপথের আনন্দ গান - শৈলজারঞ্জন মজুমদার
৪) স্মৃতির খেয়া - সাহানা দেবী
৫) গানের লীলার সেই কিনারে – সুধীর চক্রবর্তী
৬) রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান – ড. আশিস বসুমল্লিক