প্রথম দর্শনে স্মার্টনেসটাই চোখে পড়ে। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের স্বপ্ন, মধ্যবিত্ত বাঙালির কলা গাছ আম গাছ ঘেরা বাসস্থানের বাস্তবায়ন বহুদূরে ফেলে এসেছে এ শহর। মারোয়াড়ি কম্যুনিটি ধীর অথচ সুনিশ্চিত পা ফেলায় মাটি ফুঁড়ে উঠেছে জি প্লাস ফোর/ থ্রি ফ্ল্যাটবাড়ি, যাদের সব কিছুই টাইল বাঁধানো, পাবলিক ফুটপাথও গ্রিল্ড আপ। সবুজ ক্রমশ মুখ লুকাচ্ছে, যদিও এদিক ওদিকে এখনো চোখে পড়ে আম কাঁঠাল বেল ভরা গাছপালা। আগের প্রজন্মের বাঙালির পোঁতা। (আমার রান্না মেয়েই তো এনে দেয় ওর দাদাশ্বশুরের লাগানো গাছ থেকে মিষ্টি আম জাম।) সে যাই হোক আজকের বেশিরভাগ বাঙালিই আধুনিক বিত্তবাসনার সঙ্গে তাল না রাখতে পেরে তার ছোট স্বপ্ন, ক্ষুদ্র উচ্চাশা নিয়ে বাড়ি বেচে খানিক মফস্সলে নাগেরবাজার, বাগুইহাটির দিকে মুখ লুকিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। কোথাও বিদেশে গ্রিন কার্ডধারী সন্তান-সন্ততিদের আর স্বদেশে ফেরার তাগিদ নেই। তাদের ঘরদুয়ারও আধখোলা জানালা আর মরচে ধরা গ্রিল ঘেরা হয়ে থেকে ক্রমশ সেই প্রমোটরের হাতেই যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের হাত ছাড়িয়ে সল্টলেক হয়ে উঠেছে আরও আরও উচ্চবিত্তের ডানা মেলার আকাশ, সিটি সেন্টার, আইনক্স স্মার্টবাজার যার আধার কার্ড।
এতো সবাই যা জানে তাই বলে গেলাম। তাহলে জ্যানাসমুখো আর হ’ল কি করে শহরটা? সেই খোঁজেই তো বেরিয়েছি এ লেখায়, যেমন বাউল গেয়েছেন, ‘সে মানুষ চেয়ে চেয়ে ঘুরতেছি পাগল হইয়ে—'। মাঝে মাঝে ভারি হতাশ লাগে। এখানে আলাপচারিতা মৌখিক পর্যায় ছাপিয়ে যায় না। বেলা বারোটার খটখটে রোদে হাট বাজাররত চড়া মেক-আপে ঢাকা ব্র্যান্ডেড পোশাক বা জমাটি ঢাকাই পরিহিতা মহিলাদের মতই মেকির আস্তরণে লুকোনো আন্তরিকতা। তবু যেন তাকে খুঁজে পেয়েছি, কবি অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের মত বলে উঠেছি ‘আছে আছে প্রাণ আছে’। কি সেই জাদুদণ্ড যা এই প্রাণের খবর দিয়েছে? ওই আমার পুরানো চোখ মেলে দেখার তাগিদ। শহরটার পুরো অন্তরটাই শুকিয়ে গিয়ে থাকলে শুনতে পেতাম কি সকালে হাঁটতে বেরিয়ে ব্যাটারি রিকশ চালক আয়েসে গান শুনছেন, ‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে কতই খেলা—'? আবার কখনো বেলা দশটায় হেঁকে যাওয়া ছুরি কাঁচি লোহার কড়াইওলার ভ্যানে বাজছে ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’। আর কলার টিউন তো আছেই। কুঁড়েমিবশত গ্রসারি দোকানের মালিক শেখরবাবুকে চাল চিনি পাঠাতে বললে টিউন বাজে, ‘ও হংসিনী মেরে হংসিনী কঁহা উড় চলি—’, কিশোর কুমারের এমন দরাজ আওয়াজে সত্তরের দেহকে কলা দেখিয়ে মনটা আমার চনমনিয়ে ওঠে। মিল্ক বুথে দুধ দই এল কিনা জানতে চাইলে ভাইপো বলরামের ফোনে শুনি ‘আমার পরান যাহা চায়—’। সব্জিওয়ালা খোকনদা সদ্য টিউন পাল্টেছেন, বাজে চমৎকার জগ্ননাথ নামগান, কিন্তু দেড়শ টাকার টোমেটো নিয়ে তর্ক করলে বলেন অম্লান বদনে ‘ভোটের পর শুনব’। হয়ত সারা বাংলারই এই ছবি, কিন্ত আমার কথা তো স্মার্ট সিটি সল্টলেককে নিয়ে, সেখানেও এত রোম্যান্টিকতা এত গান; তাই মনে হয় প্রাণ আছে নিশ্চয় আছে। তবে খেটে খাওয়া মানুষের এমন সব গান শোনা আরেক ভাবে স্মার্টনেসেরই পরিচায়ক বলতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে বিনোদ বেণীর মত বিনিয়ে আছে প্রাণের উচ্ছলতা। কখনো সন্ধ্যে বেলা বিনোদ ধোবিকে ইস্ত্রি কাপড় দিতে গিয়ে দেখি সে চোখ বুজে কানে ট্রানজিস্টর ঠেকিয়ে এক মনে শুনে চলেছে দেশোয়ালি ভোজপুরী গান ‘অম্বা কে ডলিয়া পে বোলে কোয়েলিয়া।’ ইস্ত্রি কাপড় দিয়ে ফিরতি পথে অন্নপূর্ণা মিষ্টির দোকানে ছানার জিলাপির আশায় ঢুঁ মারতে গিয়ে দেখেছি পাশেই আলো-আঁধারিতে সিমেন্ট গোদামের মজুর ফুটপাথে তোলা উনানে সেঁকছে ফুলকো রুটি, পাশে ঢাকা কড়াইতে বোধহয় তৈরি সব্জি। (তোলা উনানে লোহার কড়াইতে রাঁধা সব্জির প্রতি আমার ঝোঁক বরাবরের। তাই একটু ঘুরপথে যাচ্ছি—বিডি মার্কেটে হাঁড়িকুড়ির দোকানে বিপত্তারিণীর লাল তাগার খোঁজে গিয়ে দেখি দোকানি বালতি উনানে কড়াই চড়িয়ে টুকটুকে লাল মাছের ঝোল রাঁধছেন। রেসিপি চাইতে দেখলাম আমরা গ্যাস আভেনে যা রাঁধি তাই। তবে কি আর সব কিছুর মত স্থান গুণে রান্নার রং-স্বাদও পালটায়?) এবার আগের কথায় ফিরি—এই ঝকঝকে শহরের মাঝেই মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের এত আনাগোনা, এতেই বোধহয় তার অভিনভত্ব, তার দুমুখিতা।
প্রাণ থাকলে যে শুধু গান থাকে তা তো নয়, কান পাতলে হাহাকারও শোনা যায়। গুমরে ওঠা চাপা বেদনা যেন ঝকঝকে টাইলসুল্ভ স্মার্টনেসে মাখিয়ে দেয় নমনীয়তা। সল্টলেকে রাস্তার কুকুরের সংখ্যা ভালোই। অনেকে তাদের আদরের নামও দিয়েছেন—কালি, চুমকি, ছেঁচকি। রাস্তা পেরিয়ে সি এ মার্কেটে ঢোকার মুখে কখনো শুনি, ‘কালি-ই আয়, মারামারি করবি না কিন্তু—’, বা ‘ছেঁচকি সোনা আমার, এদিক-ওদিক যেয়ো না, আমি ব্রেড নিয়ে এখুনি আসছি—’। মহিলার সঙ্গে আলাপ আছে, নিজেই বলেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব, একা থাকেন মাকে নিয়ে—তাই কি সব মমতা উজাড় করে দিয়েছেন বেবাক পশুগুলোকে?
ওনাকেই দেখেছি পাতায় সাজিয়ে পোষ্যদের ভাত-তরকারি খাওয়াচ্ছেন। সেদিন দেখলাম উসকোখুসকো উদাসীন চেহারার এক বয়স্ক এক ডেকচি ভাত-মাংস কুকুরদের দিচ্ছেন। আবার এক বাড়িতে শুনেছি সাতাশটি বিড়াল। আমার রান্না মেয়ে সেখানে বিড়ালের মাছ ভাজার কাজ পেয়েছে আর গৃহকর্ত্রী সস্প্যান হাতে রোজ সারমেয়দের পঙ্ক্তি ভোজ করান। প্রসঙ্গত শুনেছি উনি অনেকদিন আগে তাঁর এক কন্যাকে হারিয়েছেন। তবে মনে হয় একাকীত্ব, ব্যক্তিগত বিচ্ছেদ ব্যথা না থাকলেও এখানে অনেকেই মানুষী উত্তাপের অভাব বোধ করেন অত্যাধিক ফরম্যালিটির চাপে আর তাই সবটুকু স্নেহ ঢেলে দেন এই সব পথপোষ্যদের। আবার হয়ত এমন হলে বাড়িতে পোষ্য রাখার ঝামেলা থাকে না। কারণ অনেকেই দেখি বিদেশের মত দামি কুকুর রাখেন কিন্তু ওখানকার মত নিয়ম মানেন না। তাই সারমেয় প্রমেনাডিং এর ফলে মিউনিসিপ্যালিটি দ্বারা পরিষ্কৃত পথঘাটে পরমুহূর্তে পোষ্য বিষ্ঠা ছড়ানো থাকে।
গোড়াতে লিখেছিলাম এখানে সবুজ প্রায় মুখ লুকিয়েছে। কিন্তু অনেক ফাঁকা প্লট থাকায় নার্সারির অভাব নেই, আর মজার কথা এই যে কখনো দেখেছি গাছপালনের বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও এখানকার মানুষ গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছেন নানান গাছ আর বাঁচল না বলে অভিযোগ করতে কদিন পরে ফিরেও আসছেন। আবার কেউ বা অত ঝামেলায় না গিয়ে টবসুদ্ধ সিজন ফুলের গাছ কিনে ঘর বারান্দা সাজিয়ে ফেলছেন। আর আমি হরষে একটু ঘুরিয়ে মনে মনে বলছি, ‘কাল ছিল ঘর খালি আজ ফুলে যায় ভরে/ বল দেখি তুই মালি হয় সে কেমন করে—'।
এই স্মার্ট শহরের আনাচে কানাচে আবার লুকিয়ে আছে কিছু পুরনো বিশ্বাস (অন্ধ বিশ্বাস কিনা আমার জানা নেই তাই ও কথা দুটো আর ব্যবহার করলাম না।) বড় রাস্তা হয়ে সি এ পেরিয়ে ডি এ ব্লকে ঢোকার মুখে দেখি অজস্র পায়রা। ভোর বেলা পথের ওপর দানা পেলে ওরা বাড়ির কার্নিশ ছেড়ে উড়ে আসে। (আমার কন্যা ওদের হাততালি দিয়ে ওড়াতে ভারি ভালবাসে)। কিন্তু রাস্তার আইল্যান্ড ডিভাইডরের কাছে পার হওয়া মুস্কিল হয়ে দাঁড়ায়, তার ওপর গাড়ি থেকে নেমে শিবের বাহনদের কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর পালা চলে। মাটির গামলা ভরে জল থাকে গো-মাতার জন্য, জমা জলে ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার ভয়কে তোয়াক্কা না করে।
ডি এ ব্লকের শেষ সীমায় দেখা যায় ফ্লাই ওভার দিয়ে মেট্রো রেলের যাতায়াত। ভোর ছটায় শিয়ালদামুখী খালি ট্রেন বেরিয়ে যায়, বেশ লাগে। ওই ফ্লাই ওভারের নীচে বাঁধা থাকে এক শান্তশিষ্ট খয়েরি রঙের টাট্টু ঘোড়া, নাক থেকে সিঁথি অবধি তিলকের মত সুন্দর সাদা লোম টানা। শীত কালে দেখি এক রাশ বাঁধাকপির পাতা চিবোচ্ছে, বাকি সময় লেজ দিয়ে মাছি তাড়ানোতে মন। ভেবেছিলাম ছোট ছেলেমেয়েদের পিঠে নিয়ে বেড়ানো ওর কাজ। মোটেই কিন্তু তা নয়। আশে পাশে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওর ঘাড়ের চুলের মাদুলি তাবিজ চড়া দামে বিকোয়, সত্যিই অল্প কিছু লোম বাদে ওর ঘাড়ের সব চুল ছোট করে ছাঁটা। গলায় ফাঁস, এক খুরেও দড়ি বাঁধা, এ জন্মের মত নেচেকুঁদে ছুটে বেড়ানো কাকে বলে ওর আর জানা হল না।
সে যাহোক, এবার মনভারটা একটু কমিয়ে ফেলতে পারলে মন্দ কি। কিছুদিন আগেই রথযাত্রা হয়ে গেল। সি এ-তে খুব ঘটা করে মারোয়াড়িরা রথ করেন। রথের ফাঁকে ফাঁকে থাকে বড় বড় ট্রাকে কৃষ্ণলীলার ব্যবস্থা। খিচুড়ি ভোগের আশায় দুনম্বর জলাধার থেকে সি এ বাস স্টপ অবধি (বেশ অনেকটা পথই) লাইন দিয়ে এত গরমে মানুষ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিকালে নানান অনুষ্ঠান হয় সাতদিন ব্যাপী। সেই খুশির জোয়ারে আমরাও সামিল হই। সাজসজ্জার মওকা ছাড়ে কে? তাই যথাসম্ভব সেজে বেরিয়ে পড়ি রথ টানতে।
পরিশেষে বলি এ লেখায় আমি যাদের কথা লিখলাম তারা অজান্তেই আমাকে দিয়েছেন প্রাণের রসদ। ঝকঝকে বাঁধানো আস্তরণের তলে আন্তরিকতার খোঁজ ওরাই দিয়েছেন আর সল্টলেক যথার্থভাবে হয়ে উঠেছে জ্যানাসমুখী এক আধুনিক দেবতা।