একদিকে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ, হিন্দুস্থান কেবল, কুলটি-বার্নপুরের ইসকো। দুর্গাপুরে ডিএসপি অন্যদিকে কয়লা খনি জাতীয়করণ এবং ওপেন কাস্ট প্রজেক্ট, এবং তার ফলে এক একটি গ্রাম পতনের সংবাদ। সর্বত্র যে জমি হারিয়ে সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন এমন নয়। বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের তো সর্বত্র বঞ্চনার ইতিহাস। সর্বত্রই তারা প্রাথমিক এবং শেষতম ভুক্তভোগী। শুধু কী কলকারখানা? তার সঙ্গে টাউনশিপ গড়ে তোলা, শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য তো জায়গা চাই। এই জায়গা তো আর গ্রামের বাইরে অধিক থাকে না অতএব গ্রামকে উচ্ছেদ করতে হয়। একটা গ্রাম উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে হাজার পরিবারের ইতিহাস বদলে যায়। উদয়ন ঘোষ যে ভার্জিন শরীরের কথা বলেছিলেন এই গল্পের প্রেক্ষাপট হিসেবে আমরা অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গল্পে কবিতায় প্রথম শুনতে পাই, রাবণ মাঝির কথা। যার গতর কাঁড়ার মতো। উচ্ছেদের সময় বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে লোহার দাঁতের চাপে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল সেই তাদের কথা এমন সময় আমরা হঠাৎ পেয়ে গেলাম 'দেশ' পত্রিকায় ধারাবাহিক 'কুশ' উপন্যাসের ভিতর, যার লেখক মানব চক্রবর্তী:
"লোকে বলে চোরা খাদান।
জলের রং না সবুজ, না কালো। দূর থেকে চোরা-খাদান দেখলে এক আঁজলা জলও ছুঁতে মন চায় না... কাছে এলে ভ্রম ভাঙে। যত কাছে, তত যেন খোলতাই হয় চোরা খাদানের উদোম বুক। একগলা জলে দাঁড়িয়েও তখন মন ভরে না, ডুবতে সাধ যায়। দিনের আলোয় জলপিপি আঁক কষে, ফুটফুটে হাঁস মেতে ওঠে ডুব-ভাসির খেলায়, তারই মাঝে, সই পাতে সূর্যকিরণ... চোরা খাদানের উদোম বুকে লক্ষ লক্ষ খয়রা-আঁশের ঝিকমিকি।
পেছনে, খানিক দূরে বেলরুইয়ের রায়েদের বিশাল বাগান। বড় বড় গাছ, ঘন বাঁশঝাড়, পাঁচিল ফুঁড়ে চাগাড়মারা ময়ালের লেজের মত খসখসে শিকড়। পাঁচিল কি আর সবখানে আছে? জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে৷ কতকাল আগের শ্যাওলাসবুজ ইট, মাটির বুকে গাঁথনি দেখে এককালের দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচিলের অস্তিত্ব মালুম হয়।
বহুকাল আগে, তখনও সরকার কলিয়ারি অধিগ্রহণ করেনি, এত কড়াকড়ি ছিল না। কারা যেন এইখানে মাটি খুঁড়ে কয়লা পেয়েছিল। গ্রামের লোকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জুটে গেল আশেপাশের দালাল। রাতের অন্ধকারে কয়লা তুলে পাচার শুরু হল। চপ্কা, সীতারামপুর, লছিমপুর, গোলাপপুর, সাতাইশার গ্রাম থেকে দলে দলে খেতে-পরতে না পাওয়া হাড় জিরজিরে কালো কালো মানুষগুলো দুটো পয়সার লোভে ভিড় জমাল।
—তা পয়সা কি এমনি মেলে? খাট... রাতভর গাঁইতা চালা, ঝুড়ি ভরে কয়লা তুলে দে ট্রাকে... ভোর হলে নগদ কড়কড়িয়া নোট।
কয়লার দালালরা নেশা চুরচুর চোখে গাঁইতা-কোদালের ঝপাংঝপ শব্দ শুনতে শুনতে মনে মনে টনপ্রতি লাভের হিসেব করত।
সে বহুদিন আগের কথা। ক্রমে গভীর হল খাদ। চারপাশের মাটি সরিয়ে উঁচু হল পাড়। এরপর একদিন হঠাৎ ঘোষণা হল সরকার কোলিয়ারি জাতীয়করণ করেছে। রাতারাতি প্রাইভেট মালিকেরা টন টন কয়লা জলের দরে বেচে দিল। আর চোরা খাদানের দালালেরা বিপদের গন্ধ পেয়ে হাওয়া। চোরা খাদানের নিচে এখন হাঙ্গরের দাঁতের মত ধারালো বিশাল বিশাল এবড়ো-খেবড়ো কয়লার চাঁই । গ্রীষ্মে যখন টাঁড়মাটির বুক শুকিয়ে ফালাফালা হয়, আশেপাশে গাঁ-গঞ্জের মেয়েরা তিন-কোশ পথ হেঁটে দেন্দুগা ওয়াটার রিজার্ভারের কাছে অনবরত ঝরে যাওয়া পরিশ্রুত জলের উদাত্ত কলকলানির শব্দে পাগল হয়, মাটির হাঁড়ি, কলসী, টিন ভরে আবার তিন-কোশ পথ পায়ে হেঁটে ফিরে আসে অপরিসীম ক্লান্তির বাহনে, তখন ঐ মুখগুলোর ভেতর শহুরে মানুষের প্রতি, যারা কল ঘোরালেই জলের আস্বাদ পায়, গ্রীষ্মের দাবদাহে শরীর জুড়োতে দিনে তিনবার চান সারে… এক তীব্র ঘৃণাবোধ খেলা করে।…”
হঠাৎ শিরোনামে উঠে আসা কুশ নিয়ে লেখা হয়:
'মাটি-খোয়ানো, অতীত-হারানো ও ঠিকানা খুঁজে ফেরা একদল মানুষের বুক-ফাটা যন্ত্রণা-হাহাকার এবং সঙ্ঘবদ্ধ সংকল্প-সংগ্রামের এক হৃদয়স্পর্শী আলেখ্য। এমনই নিখুঁত তাঁর পরিবেশ-রচনা, এমনই জীবন্ত একেকটি চরিত্র, এমনই আকর্ষণীয় এই কাহিনী-বুনন যে, মনেই পড়ে না, ‘কুশ’ই লেখকের প্রথম উপন্যাস। এ-কাহিনীর কেন্দ্র-চরিত্র এক সরল গ্রাম্য মেয়ে—যার নামও সরলা। কীভাবে সেই সরলা হয়ে উঠল মহাজনটুলির আকাশের ক্ষণপ্রভা বিজলী, ক্লেশ ও কামনার আগুনে পুড়ে নিয়ামতপুরের কাঞ্চন, আবার সেই কাঞ্চনই একদিন এসে দাঁড়াল বাথানবাড়ির গুপ্ত বিপ্লবীদের পাশে, তুমুল ঘাত-প্রতিঘাত ও বিপুল ঘটনাপরম্পরাময় সেই কাহিনীর সূত্র ধরেই গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস, কোলিয়ারি ও শিল্পাঞ্চলের এই অজানিত ইতিকথা।'
কুশ সম্পর্কে, গবেষক শুভম চক্রবর্তীর দৃষ্টিপাত: 'বাংলা কথাসাহিত্য যখন অনেকাংশে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার মোহে আচ্ছন্ন তখন মানব লিখলেন বাংলা বিহার (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) সীমান্ত অঞ্চলের স্বস্থানচ্যুত, অতীত হারানো মানুষের মর্মস্পর্শী আখ্যান। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই 'কুশ' পাঠকের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিল।'
'কুশ'-এর পর মানব চক্রবর্তীর উপন্যাস 'স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য'। এর ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট হিসেবে জি টি রোডের উপর একটি কুষ্ঠ হাসপাতালে রোগীদের আস্তানা কল্পনা করা যেতেই পারে। একজন শিক্ষক পারিবারিক প্রধান কুষ্ঠাক্রান্ত, পরিবারের উপর আধিপত্য অনুমেয়, তার কুষ্ঠ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে গেলেও তাকে পরিবার আর আগের স্থানে ফিরিয়ে নেয় না, এরকমই সামাজিক প্রেক্ষাপটে লিখিত উপন্যাস। হয়তো মানব প্রচলিত উপন্যাসের ফর্মুলা ব্যবহার করে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এই কথা গল্প পাঠক সম্প্রদায় সে রকম ভাবে গ্রহণ করেনি। তাই তাকে আবার অফবিট লেখায় ফিরে আসতে হয়।
তার পরবর্তী উপন্যাস ছিল 'সন্তাপ'--বৃহন্নলাদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। পরে কবি ও প্রাবন্ধিক ডঃ আদিত্য মুখোপাধ্যায় তার 'শিখণ্ডী' উপন্যাসের কথা বিজ্ঞাপিত করলেও পরে অনুসন্ধানে স্বীকার করে নেন এটাই বৃহন্নলাদের নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস।
এই সব উপন্যাস মানবের আনন্দবাজার পত্রিকার ঘর থেকে বের হওয়ার পর যে কটি উপন্যাস বের হয় ছোট বড় প্রকাশনা থেকে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য "ঝাড়খণ্ড ও তুতুরির স্বপ্ন"। তখনো ঝাড়খণ্ড সৃষ্টি হয় নি কিন্তু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দাবি, লড়াই ও স্বপ্নাদ্য উপকথা। স্যালামানডার, আগুনের কুয়োতলা ও বিবিধ, ভূমা, প্রীতিকথন অথবা নিম ডাইরি, জুরাং, উজানের পাখি, ঢুণ্ডিয়াপালা, টোটেম, মারসাল হেমব্রম।
এর মধ্যে প্রীতিকথন উপন্যাসটি বস্তুত ভাই বোনের সম্পর্ক, যেটাকে অজাচার বলা হয়, যেভাবে বিধবা মায়ের স্তন্য পান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তে অভ্যস্ত বোধবুদ্ধিহীন যুবক ভাইকে, মায়ের বিছানায় বাবার বন্ধুকে সঙ্গ দেবার অছিলায়, প্রীতির বিছানায় পাঠিয়ে ছিল এবং স্তন্য পানে অভ্যস্ত ভাই দিদির স্তন্য পান করতে করতে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার আখ্যান। আত্মহননের আগে লেখা ডাইরি থেকে উদ্ধার।
মূলত নিজ বাসভূমি থেকে উৎখাত চরিত্র নিয়েই কাজ করে গেছে মানব। গবেষকদের কাছে নৃতত্ত্বমূলক এই সব লেখার মধ্যে 'মারসাল হেমব্রম' বিখ্যাত। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শুভম চক্রবর্তীর অবজারভেশন এই উপন্যাসের জন্য উল্লেখযোগ্য:
"কলকাতাকেন্দ্রিক ড্রয়িংরুমের সাহিত্যের বাইরেও রয়েছে সাহিত্যের সীমাহীন পরিসর। এই কথাটি যে আক্ষরিকভাবেই সত্য, এই প্রতীতি যাঁদের রচনা পাঠ করে জন্ম নেয় মানব চক্রবর্তী তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। মানবের উপন্যাসের পটভূমি মূলত পশ্চিমবঙ্গ-বিহার (ইদানীং ঝাড়খণ্ড) সীমান্ত-অঞ্চল। আর সীমান্ত শব্দটির মধ্যেই রয়েছে প্রান্তের দ্যোতনা। ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা তাঁর The Margins of Philosophy গ্রন্থে প্রান্তের ধারণাকে বিধৃত করেন। অজানা অচেনা 'অন্য'র ধারণাটি শুরু হয় এখান থেকেই। 'অন্য'কে, তার 'ভিন্নতা’ কে আমি অঙ্গীকার করি। এভাবেই 'অন্য'র প্রতি তার ‘ভিন্নতা'র প্রতি আমি দায়বদ্ধ। আর এমন একটা তাগিদেরই প্রচ্ছন্ন প্রকাশ দেখি মানব চক্রবর্তীর রচনায়। 'অন্যকে, সত্তার বাইরে অস্বস্তিকর ভিন্নতা'কে তিনি সযত্নে লালন করেন। তাই মানব চক্রবর্তীর সারাজীবনের রচনায় আমরা প্রত্যক্ষ করব প্রান্তিক, স্বস্থানচ্যুত, সত্তা-খোয়ানো, অতীত-হারানো, দ্বিখণ্ডিত মানুষের সংকট ও সংগ্রামের কাহিনি। তবে এই কাহিনি কোনো একমাত্রিক গল্পকথকের নয়। মিথ, টোটেম, কথ্যভাষা, বিপন্ন ভাষা, স্থানিক রং, মনস্তত্ত্ব ও জীবনদর্শনের প্রগাঢ় প্রকরণে তা বহুমাত্রিকতার বৃহৎ বর্গায়তন
"মানব চক্রবর্তীর 'মারসাল হেমব্রম' উপন্যাসের একটি বাস্তবনিষ্ঠ পটভূমি আছে। কিন্তু সেই বাস্তব শুধু External Reality নয়, তাঁকে অন্তর্বাস্তবতার সাপেক্ষেও আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন। 'মারসাল হেমব্রম' উপন্যাসের মারসাল, রুদাই, সোমরু, তুরামণি প্রভৃতি চরিত্ররা প্রাণবন্ত এবং নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম, যেক্ষেত্রে তাঁরা চিহ্নিতকরণে অক্ষম তাতে তাঁদের প্রগাঢ় অন্তর্বেদনা, যার প্রকাশ বাস্তবনিষ্ঠ। 'মারসাল হেমব্রম' উপন্যাসের অন্যতম সম্পদ লেখকের ইতিহাস চেতনা। আদিম-নিবাসী প্রোটো-অ্যাস্ট্রলয়েড জনজাতিসমষ্টির বাস্তব প্রত্যক্ষ ইতিহাস, মিথ, ভাষিক বৈশিষ্ট্য, নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রভৃতির ভেতরে থাকা পরোক্ষ, বহুস্তরীয় ইতিহাসের অবভাসন আমরা উপন্যাসটিতে প্রত্যক্ষ করি।"
মানব চক্রবর্তীর ছোটগল্পের হাতেখড়ি বিমল কর সম্পাদিত গল্পপত্র পত্রিকায়। প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক তপোধীর ভট্টাচার্য মানব চক্রবর্তীর গল্প সম্বন্ধে বলেছেন, 'তার গল্পে পদান্বয়ের বিশিষ্টতা, আঞ্চলিক বাচনের প্রয়োগ, তদ্ভব বাকভঙ্গি বা কখনো কখনো প্রাকৃতায়িত চলন এদিকেই ইঙ্গিত দেয়। এবং তা আসলে সমাজ-পরিসর ও সময়চেতনার অভিব্যক্তি।'
লেখকদের একধরনের অন্তর্মুখী চরিত্র থাকে, তারা বিশেষ হইহুল্লোড়ে যেতে চান না কিন্তু মানব চক্রবর্তী ছিল বিচিত্র চরিত্রের। সে ছিল রাজস্থান ক্লাবের প্লেয়ার। প্রথম ডিভিশনের বিখ্যাত সব টিমের সঙ্গে খেলেছে। ট্রেকিং করতে গিয়েছে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন দুর্গম পর্বতে। এই ফুটবলপ্রেম থেকেই তার বিখ্যাত একটি গল্প 'দানো'। ও একজন কসাই যে নাকি ফুটবল প্রেমীও। নিজের ছেলেকে বড় ফুটবলার বানাতে চায়। যে কারণে তার নামই রেখেছে ফকরি, রোজ দুবেলা টেংরির জুস খাওয়ায় সেই কারণে দোকানে কাউকে বিক্রি করে না। কেন ফকিরের অধিক পরিশ্রমসাধ্য ট্রেনিং করতে গিয়ে মৃত্যু হয়, এখানে লেখক মানবও একটি চরিত্র-- ?? অনেকদিন পর আমি সবে লেখালেখি করছি। কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছি হাওড়া অমৃতসর মেলে। খুব ঠান্ডার দিন। চিত্তরঞ্জন স্টেশনে যখন নামলাম রাত বারোটা। ঠান্ডা হওয়া সূচের মত শরীরে বিঁধছে। আর অত রাতে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা লোক নেই। খুব দ্রুত পার হচ্ছি জায়গাটা হঠাৎ নজরে পড়লো খোলা প্লাটফর্মে আলোর নিচে খালি গায়ে একটি মানুষ শুয়ে আছে। বড় চুল বড় দাড়ি নোংরা ধুতি কুচকুচে কালো গায়ের রং চলেই যাচ্ছিলাম, দানো কসাই যে একটি ফুটবলকে চুমু খাচ্ছে, ওই গভীর ঠান্ডা রাতে, সে উন্মাদ ছাড়া আর কি হবে! মানুদাকে জীবনের গল্প বলে যাচ্ছে। ফিরে যাচ্ছে সেই প্রথম দিকে যখন তার খাসি ছাড়ানোর দক্ষতা দেখে দীননাথ থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল দানো'তে। সব হারিয়ে আজ তাকে খুঁজছে চরম শাস্তি দেওয়ার মানসে। আর এই গল্পে আমরা দেখতে পাই তখনকার ডহর ডাঙ্গায় খেলা, যানবাহনহীন যুগের পরিবহন চিত্র। এক একটি সাইকেলে তিনজন প্লেয়ারকে ঝড়ের বেগে বহন করে পৌঁছনোর যে প্রক্রিয়া, তারপরেও সারা মাঠ দৌড়ে বেড়ানোর দৃশ্য, এসব ওই অঞ্চলে একদা আদৌ বিরল ছিল না। একদিকে অজয় অন্যদিকে দামোদর বিহার সীমান্ত, পরে ঝাড়খণ্ডের পরিবেশ নিখুঁত উঠে এসেছে।
আবার কারখানার শ্রমিক যুগল কিশোর একজন ওয়াটার ওয়ার্কসের ভালভ ম্যান। দীর্ঘ আঠারো বছর একই পোস্টে কাজ করেও প্রমোশন দিতে চাইলেও সে নেবে না, কারণ তার আনন্দ মানুষকে জল খাইয়ে। ঘরে ঘরে জল পাইপে পৌঁছে গেলে যে উল্লাস উঠে তাতেই কর্কশ মানুষ যুগল কিশোরের আনন্দ। 'বাজার' গল্পের নায়ক খালেদ মিয়াকে বোঝানো যায় না রক্ত যত চাও নাও ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু গ্রুপ জানতে চাইলে, খালেদ মিয়া অবাক হয় রক্তের আবার জাত বিচার আছে নাকি?
মানব চক্রবর্তীর আটখানি গল্পের বই। সমীপেষু, ওয়ান্ডারের মৃত্যু, আলেয়া জংশন, ফাহিন ও অন্যান্য গল্প, নাথুরাম সেতুরাম, রতন ও আমরা, আপাতত কতটা অন্ধ, দুজন দেবশঙ্কর। 'রতন ও আমরা' গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান। আকরিক গল্পটি নিয়ে মঞ্চসফল নাটকও হয়েছিল।
মানবের 'সভ্যতার রথ' একটি গবেষণা গ্রন্থ যাতে উদয়ন ঘোষ কথিত সেই গ্রামপতনের বা ভার্জিন সয়েলের সুলুক সন্ধান পাওয়া যাবে।
'ফার্নেস' ছিল তার সম্পাদিত দারুণ একটি পত্রিকা। যতদূর জানি তিনটি সংখ্যা বের করেছিল।
কবিতার বই ছিল চারটি। অসুখে সুন্দর আমি, রোদের ঈগল, ফেউ না ফার্নেস, সাদা উঁচুনিচু। এই সব কবিতায় আদি ঝাড়খণ্ড তার উদার হাওয়া, ফল ফুল বৃক্ষের সঙ্গে কাব্যিক মাধুর্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তার একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি মানব চক্রবর্তী বিষয়ে যেটুকু জানি।