• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গল্প
    Share
  • কিস্‌সা জানকী রমণ পাণ্ডে قصہ جانکی رمن پانڈے : জ়কিয়া মশহদি
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়



    উর্দু কথাকার-অনুবাদক জ়কিয়া মশহদি (জন্ম ১৯৪৪) প্রায় চল্লিশ বছর ধরে লিখছেন। উর্দু ভাষায় তাঁর সাতটি ছোটগল্প সংকলন, তিনটি উপন্যাস ছাড়াও অন্য ভাষা থেকে অনূদিত কথাসাহিত্য, হিন্দি-ইংরেজি-উর্দুতে অ্যাকাডেমিক বইও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মধ্যপ্রদেশ সরকারের ‘ইকবাল সম্মান’ পেয়েছেন। এছাড়াও ইংরেজি থেকে উর্দুতে অনুবাদের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য মির্জা গালিব পুরস্কার পেয়েছেন।

    গঙ্গা-যমুনার দুপাড়ে অসংখ্য গ্রাম-শহরে পাশাপাশি বাস করা হিন্দু-মুসলমানদের ‘মিলিজুলি’ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে রচিত কথাসাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এবারে অনূদিত এই সুদীর্ঘ গল্পটি। বিভিন্ন ধর্ম, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মানুষদের লেখিকা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ধর্ম এবং ধর্মীয় সমানুভূতি সম্পর্কে তাঁর বীক্ষণের প্রতিফলন ঘটেছে এই গল্পে। পাপ-পুণ্য, জীবন-মৃত্যু, হালাল-হারামের মত বহু বিষয়ে তাঁর গভীর অনুধ্যানও লিপিবদ্ধ হয়েছে এখানে। বহু-সাংস্কৃতিক, বিবিধ ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর সমাজে সহাবস্থানকারী মানুষের জীবন দর্শনের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে এই কাহিনিটিতে।

    মূল উর্দু গল্পটি পাওয়া গেল দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত (২০১৬) ‘জ়কিয়া মশহদি: মুনতখব আফসানে’ গ্রন্থটিতে। উর্দু থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদের অনুমতি দেওয়ার জন্য আমি লেখিকা জ়কিয়া মশহদির কাছে কৃতজ্ঞ।
    এখন যদি কেউ অ্যাডভোকেট জানকী রমণ পাণ্ডেকে জিজ্ঞেস করে যে এলাহাবাদে তো ভালোই ছিলে, রসুলপুরে মরতে কেন গেলে? শুধু যে আলংকারিক অর্থে তা তো নয়, আক্ষরিক অর্থেই তো সে সেখানে মারা গেল। একটা সাধারণ বিশ্বাস তো আছেই যে মৃত্যুর সময় আর স্থান পূর্বনির্দিষ্ট থাকে (মরার থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময়ও তো আগে থেকেই ঠিক করা থাকে, যেমন শাদি)। কিন্তু প্রশ্নটা হল সাধারণের বিশ্বাস এমনটা হলে ক্ষতিটাই বা কি? কী আর করবেন? চোখা চোখা মন্তব্য করার লোকের অভাব হয় না। তাদের এটাও তো ভাবতে হবে যে মরার জায়গা আর সময় নাহয় ওপরওয়ালা হাকিম স্থির করে দিয়েছেন। কিন্তু এমনও তো কিছু থাকা উচিত যা আমাদের হাতে থাকবে। আমরা মৃত ব্যক্তির ওপর ন’মন মাটি চাপাব না কেরোসিন তেল (ইদানীং তো জীবন্ত মানুষের ওপর কেরোসিন তেল ঢেলে পুড়িয়ে মারার কাহিনিও বেশ শোনা যায়), নাকি তাকে কাক-চিলের খাদ্য হিসেবে রেখে দেব, সে সিদ্ধান্ত তো আমাদের। আর ভাই হাজার কথার এক কথা হল গিয়ে এই যে, সেই সব নিয়মনীতিই ভালো যা আমাদের মর্জিমাফিক আর সুবিধেজনক। নাহলে তো যেগুলো অপছন্দের সেগুলোকে মানুষ ডাণ্ডা মেরে বিদেয় করবে। এটাই তো আমাদের ধর্ম। এখন দেখুন পাণ্ডেজির হাল!

    পাণ্ডেজির পুরো কিস্‌সা তো শোনাতেন কে.কে. মামা। কে.কে. অর্থাৎ কৃষণ কান্ত। কিন্তু ওই সংক্ষিপ্ত নামই ছিল তাঁর পরিচয়। নামের পরে টাইটেল লাগানো তো তিনি অনেক দিনই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলতেন এই কলিযুগে যখন সব বামুন পণ্ডিত চোর আর চামারদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেছে, খানাপিনার ব্যাপারেও কোনও সংযম নেই, তখন কেন আর তিনি বাপ-দাদার নাম কাদায় ফেলে টানাটানি করবেন? কিন্তু কৃষণ কান্তের সব চেলাচামুণ্ডারাই জানত যে এই সব কিছুই তাঁর চারিত্রিক ভাঁড়ামির অঙ্গ। তিনি জাতপাতের কঠোর বিরোধী ছিলেন। পদবী ব্যবহার না করাটা আসলে ছিল তাঁর প্রতিবাদ। কে.কে-র কোনও ভাগ্নে তো বোধহয় ছিলই না। কে জানে ভাগ্যের কোন্‌ পরিহাসে তাঁর নামের আগে ‘মামা’ লেগে গিয়েছিল। ব্যস, তিনি জগতের মামা হয়ে উঠলেন। বেশ দীর্ঘ সময় লখনউয়ে কাটিয়েছিলেন। ভালো উর্দু বলতেন। গল্প বলার খুব শখ ছিল। মনে হত যেন বাজারের কোনও চুটকির ওস্তাদের আত্মা তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেছে (এই খেয়াল বোধহয় কখনও জানকী রমণ পাণ্ডের মনেই উদয় হয়েছিল)। তিনি পান এক গাল থেকে আরেক গালে ঠেলবেন, আর যাতে পানের পিক ছিটকে শ্রোতার গায়ে না লাগে তার জন্য মুখটা ওপরে তুলে অদ্ভুত গোল গোল স্বরে কথা বলবেন। কিন্তু সে কথার জাদু এমনি যে কেউ সেখান থেকে ওঠার নামও করত না। চলত গল্পের পর গল্প।

    কে.কে. মামার শ্রোতাদের মধ্যে প্রধান ছিল বৃহত্তর পরিবারের সব নওজোয়ান। আর মির্জা আনোয়ার বেগের বিবি নাইয়ারা বেগের মত দুয়েকজন পড়শি। আরও কেউ কেউ হয়ত আসত যেত। আনোয়ার বেগই বোধহয় কে.কে.মামার ওপর বিরক্ত ছিল...‘কোথাকার এক মিনমিনে পুরুষ'...এই ছিল তার কমেন্ট...‘মেয়েমানুষের মত সব সময় গল্পবাজি। পরিবারে এ অমন, সে তেমন।' কিন্তু আনোয়ার বেগ যাই বলুক, কে.কে-র জনপ্রিয়তা তাতে এতটুকু কমেনি। কে.কে-র আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে যেত। বিশেষত শীতের সময় যখন চিনেবাদামের স্তূপ আর গরম গরম চায়ের পেয়ালা থাকত সামনে। গামলায় কাঠকয়লার আগুন জ্বলত। সামনে কম্বলে ঢাকা কে.কে.মামা তখন যেন সাক্ষাৎ ভাঁড়! কথক মামা যেন তাঁর চারপাশে আমোদের স্বর্গ তৈরি করে নিতেন।

    এমনই কোনও শীতের মরসুমে কে. কে. মামা অ্যাডভোকেট জানকী রমণ পাণ্ডের কিস্‌সা শুনিয়েছিলেন। পাণ্ডে অনেকদিন এখানে বাস করার পরে হঠাৎই রসুলুপরে চলে গিয়েছিল। আর সেখানে সে মারা যাওয়ায় বেশ একটা ক্রাইসিস্‌ তৈরি হয়েছিল। মামার বলা গল্পটা ছিল এরকম:

    ‘পাণ্ডে যখন ছোট ছিল – পাণ্ডে তেমন ছোট ছিল তো আসলে অনেক বছর আগে – তখনই তার মা মারা যান যাঁকে লোকে পণ্ডিতাইন নামে চিনত। তিনি আমার মায়ের পিসতুতো ভাইয়ের শালির ভাসুরের খুড়তুতো বোন হতেন। আত্মীয়তা তো ছিলই, তা ছাড়াও দুটি পরিবারের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।'

    গল্পই হোক বা বাস্তব, বিপিন ভাইয়ার ফুট কাটার স্বভাব ছিল। সে মামাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘যতটা আত্মীয়তা ছিল, সম্পর্কও ঠিক ততটাই ছিল – নাকি একটু কম বেশি?'

    ‘এখন দেখো ভাই, সম্পর্ক মাপার কোনও যন্ত্র তো আমরা আবিষ্কার করিনি। তবে হ্যাঁ, সম্পর্ক ছিল, খুব বেশিই ছিল – আর আত্মীয়তাই বা কম কী ছিল? আরে মিয়াঁ, আগে তো লোকে চিঠিতে লিখত আমার এই ছোট্ট চিঠিটাই অনেক বড় জেনো। শুধু চিঠি লেখাই নয়, সামান্য সম্পর্ককেই অনেক বড় ধরা হত আর সেই সম্পর্ক বজায়ও রাখা হত। আমরা তো তাঁদেরই মত,' মামা হাত দিয়ে বুক চাপড়ে বলতেন। আর বেশ খানিকটা পানের পিক তাঁর মুখ থেকে উড়ে গিয়ে বাতাসে মিশে যেত। মামা মুখের ধারটা মুছে নিতেন।

    ‘এই খবরদার, আবার যদি মাঝখানে কথা বলো তো...' নাইয়ারা বেগ বিপিন ভাইয়াকে বকুনি দিল। সে যেন আনোয়ার বেগ সহ সবাইকে বকাঝকা করার ঠিকা নিজেই নিয়ে রেখেছিল।

    ‘তা বিটিয়া, পাণ্ডের মা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর তার বাবা তো করে নিলেন দ্বিতীয় বিয়ে। সেই সময় লোকে প্রয়োজন বুঝলে বউ মরা পর্যন্ত অপেক্ষাও করত না। মনের সুখে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিত। তাহলে উনি বউ মরার পরে বিয়ে করে এমন কীই বা পাপ করলেন? তাও যখন আবার পরিবারের বয়স্ক মহিলারা তাঁকে এই বলে প্ররোচিত করত যে হায় পণ্ডিত, মা-হারা বাচ্চাটা কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে। আরেকটা বিয়ে করে ফেলো না! পাঁচ বছরের ছেলেটাকে মানুষ করবে কী করে?'

    নাইয়ারা বেগ, যিনি একটু আগেই ফুট কাটার জন্য বিপিন বিহারিকে বকেছিলেন, এবার নিজেই আর চুপ থাকতে পারলেন না। টপ করে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘যদি পণ্ডিত মারা যেত তাহলে কী হত? তখন কি কেউ বলত যে হায় পণ্ডিতাইন, দ্বিতীয় বিয়েটা করেই ফেলো? তখনও তো পাণ্ডে দিব্যি মানুষ হয়ে যেত, কেউ ভাবতই না যে পাণ্ডের বিধবা মা যদি আবার বিয়ে না করেন, তাহলে পাণ্ডেকে কে মানুষ করবে!'

    ‘নিন, পাণ্ডেকে কি তার মা পেলেছে ভাবছেন? তার বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এবার তিনি যে পণ্ডিতাইনকে ঘরে নিয়ে এলেন তিনি তো পাণ্ডের বিবাহিত বড় দিদি উমার চেয়েও বছর খানেকের ছোট!’

    ‘এঃ হে মামা, বছর খানেকের ছোট না বড়?’ নাইয়ারা বেগ আবার তাকে কনুইয়ের টোকা দিলেন।

    ‘এখন শোনো নাইয়ারা বিবি, সে তো বছর খানেকের ছোটই ছিল। যদি তোমার মন চায়, তা হলে বলে দাও বড়।’ মামা গাল ভর্তি পান আবার এদিক থেকে ওদিকে ঠেললেন।

    ‘মামা, এবার কেউ কথা বললে দেবেন তো এক থাপ্পড়,’ কান্তিদি বলে উঠলেন। গল্প এগোচ্ছে না বলে তিনি যেন একেবারেই শান্তি পাচ্ছিলেন না।

    ‘তো ভাইয়া,’ মামা পানের ডিবে খুলে সামান্য একটু খুশবুদার জর্দা তুলে মুখে পুরে বললেন, ‘আমি এই বয়েসে আর কী থাপ্পড় মারব? তুমি শুধু বাকি গল্পটা শোনো। পণ্ডিতজির যে বেটির এলাহাবাদে বিয়ে হয়েছিল, সেই ছিল সবার বড়। এমনিতে তো দেবীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে তার নাম উমা রাখা হয়েছিল। কিন্তু সব ছেলেরা তাকে দিদ্দা, দিদ্দা বলে ডাকত। বয়েস তখন তার মাত্র আঠারো বছর। বাপের বাড়ির রঙ ঢঙ তার চোখে পড়ল – দেখল তার নতুন মা কেমন কপালে টিপ পরে পায়েলের রুনুঝুনু তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর বাবা হয় বাড়ির পুরুষ মহলে থাকেন, নচেৎ নতুন মায়ের আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে করতে তার প্রেমে গদগদ হয়ে হাত কচলান। তো মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে অসুস্থতার ভান করে খাটে শুয়ে পড়ল আর স্বামীকে বলল আমি তো ভাইয়াকে আমার কাছে রাখব। মাঝখানে তিন বোন মারা যাওয়ার পর সেই ভাইয়ের জন্ম। আর সৎমা তার সঙ্গে কী কুৎসিত ব্যবহারটাই না করতেন। ঘরে দু-দুটো গাই বাঁধা থাকলেও এক বাটি দুধ চাইতেও সে ভয় পেত। স্বামী তাঁকে বলতেন, ভাই, তুমি চাইলে আমি কবে তাকে নিয়ে আসতে মানা করেছি? তুমি এই কথাটা কি সোজাসাপ্টাভাবে বলতে পারতে না? তুমি যখন আমার একমাত্র বউ তখন এইভাবে রানি কৈকেয়ী সাজার কী প্রয়োজন ছিল? দিদ্দা খুশি খুশি মুখে পরদিনই ফিরে গিয়ে পাণ্ডেকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। সৎমা ভাবল জঞ্জাল যত বিদায় হয় ততই ভালো। তার পায়েলের ঘুঙুর আরও জোরে বাজতে লাগল।

    দিদ্দা পাণ্ডেকে ভালোবেসে 'ভাইয়ান' বলে ডাকত। তাকে ভাই নয়, ছেলেই ভাবত। নিজের সন্তান হয়ে যাওয়ার পরেও 'ভাইয়ানের' আদর কমেনি। যারা জানত না তারা ভাবত ভাইয়ান বোধহয় তার বড় ছেলে। তার স্বামী ওঙ্কারনাথ মিশ্রও শালাকে কম মানমর্যাদা দেননি। দিদ্দার মত বউ পেয়ে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করতেন। চেহারায় ব্রাহ্মণীর মত চোখ-ঝলসানো ছটা, রাজপুতানির মত ফরসা আর পতিব্রতা। পরিবারের সব খরচ-খরচার হিসেব রাখা, বিষয়-সম্পত্তি, জমিজমার দেখাশোনার ব্যাপারে যেন বৈশ্য, আর খাটাখাটনি, সেবা করার ব্যাপারে শূদ্রদের মত। ওঙ্কার তাকে চোখে হারায়, সে যা বলে তাই করে। কাজেই ভাইয়ান ভালোরকম শিক্ষাদীক্ষা পেল।

    ভাই যখন বি.এ-র ফাইনাল ইয়ার, তখন তার বিয়ে ঠিক করে দিদ্দা যেন নিজের শখই মেটাল।'

    কে.কে. মামা আসন বদল করে পান এক গাল থেকে অন্য গালে নিলেন। উদ্দেশ্য গল্পের মধ্যে একটু নাটকীয়তার সঞ্চার করা। শ্রোতারা একটাও শব্দ না করে দমবন্ধ করে বসে আছে কাহিনীর ক্লাইম্যাক্সের অপেক্ষায়।

    'এবার ভাইরা এটা শুনে রাখো যে এদিকে তো দিদ্দা বিয়ের ব্যবস্থা ঠিক করে এসেছে, আর ওদিকে কেউ গিয়ে ভাইয়ানের কানে লাগিয়েছে যে মেয়েটা একদম কেলেকুষ্ঠি। ভাইয়ান তো শুনে খুবই নিরাশ হয়ে অনেক সাহস সঞ্চয় করে দিদ্দার কাছে গেল। দিদ্দা তখন তক্তপোশের ওপর বসে ধোপার হিসেব করছিল। চোরের মত মুখ করে মাথা নিচু করে, জামার কোণটা আঙুলে জড়াতে জড়াতে ভাইয়ান চুপিসারে এসে দিদ্দার পেছনে এমনভাবে দাঁড়াল যেন দিদ্দার নজরে সরাসরি না পড়েও নিজের কথাটা বলা যায়।

    দিদ্দা,... কিছুক্ষণ পরে ভাইয়ের গলা থেকে অস্ফুট আওয়াজ বেরোল।

    এঃ হে, আবার বোতাম ভেঙে এনেছিস?

    ভাইয়ানের সব গড়বড় হয়ে গেল। ছোটবেলায় কী কামিজ্‌ কী নিকারবোকার – সবেরই বোতাম চিবোত আর দিদ্দার কাছে খুব বকুনি খেত, কিন্তু এখন...

    কী, আবার কোথাও বোতাম ভাঙল নাকি?

    না দিদ্দা, কোথায়? ভাইয়ান তাড়াতাড়ি জামার বোতামগুলোয় হাত দিয়ে দেখে।

    আরে! তুই এখানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস রে? তোকে নয়, আমি এই হতচ্ছাড়া ধোপাটাকে বলছিলাম। চারটে ধুতি, দুটো চাদর, একটা জ্যাকেট...

    দিদ্দা,… ভাইয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা চুলকোয়।

    কী হয়েছে রে?...সময় নেই অসময় নেই, হঠাৎ চলে আসিস...সকাল না সন্ধ্যে তাও ভাবিস না?

    আচ্ছা দিদ্দা,…ভাইয়ান আবার ঘাবড়ে যায়। …আমি পরে কখনও কথা বলব।

    আরে তোকে না, এই হতভাগ্য ধোপাটাকে বলছিলাম।...আয় বোস...বোস না...পেছনে কেন দাঁড়িয়ে আছিস? সে ধোপার আনা পুঁটলিটা সরিয়ে তক্তপোশের ওপর ভাইয়ের জন্য জায়গা করে দেয়। দেখ না, এটা নাস্তার সময়...আর এ চলে এল। কোনও মতে কাপড়টা নামিয়ে দিয়েই আবার গায়েব হয়ে যাবে। দিদ্দা ধোপাকে নকল করে: ...হিসেব করে রাখবেন। আশপাশে ঘুরে আসছি।...এবার তো বল কী বলছিলি...

    দিদ্দা,…পাণ্ডে এবার সাহসে ভর করে বোমাটা ফাটাল।

    শুনলাম মির্জাপুরের মেয়েটার রঙ কালো। আর তুমি নাকি কথা দিয়ে এসেছ?

    কী?...দিদ্দার হাত থেকে নোটবই আর পেন্সিলটা পড়ে গেল। ভাইয়ান যে এমন বেহায়ার মত বলবে এটা সে আশা করেনি। নিজের পেটের সন্তানের মত যাকে দেখেছে, তাকে এবার দিদ্দা মন দিয়ে ঠাহর করল। নিয়ে এসেছিল যখন তখন বয়েস পাঁচ। পেলেছে, পুষেছে। সেবা করেছে। পড়ালেখা করিয়েছে। তার এই রূপ! আসলে পাণ্ডেও তো তার মনে যা আছে সেটা ঝেড়ে কাশতে পারছিল না। যেদিন থেকে বিয়ের কথা তার কানে গেছে, সেদিন থেকেই তো একটা চাঁদপানা মুখের ছবি তার চোখের সামনে ভাসছিল। কিন্তু তারপরে এই খবরটা আসায় কেউ যেন সেই ছবির ওপর এক রাশ কালি ছিটিয়ে দিল। ভবিষ্যতের এই ছবি তার মনকে দমিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল যে সকাল-সকাল চোখ খুলেছে কী খোলেনি – আর সামনে মা কালী হাজির! সে এত সব না বলে মনের কথা ঢেকে চেপে রেখেই বলেছিল।

    দিদ্দা রেগে ধোবির পুঁটলিটার ওপর একটা চাপড় মেরে বলল...শোনো ভাইয়ান, সৌন্দর্য দেখা হয় বেশ্যাদের। বেটিদের তো খানদান দেখতে হয়। এমন পরিবার হাজারে একটা মেলে। মাছ-মাংস তো ছেড়েই দাও – ওই পরিবারে কেউ পেঁয়াজ-রসুনও খায় না। এক শো শরিফের এক শরিফ তারা। তার ওপরে মেয়েটা তো হাই স্কুল পাশ। সামনের মঙ্গলবার মেয়ের বাড়ির লোকেরা বর দেখতে আসবে। কিন্তু তুমি বরং এখন গিয়ে পড়াশুনোয় মন দাও।

    এর মধ্যে নাস্তার জন্য ডাকতে এসে ওঙ্কার নাথ মিশ্র ওরফে ভাইয়ানের জামাইবাবু এদিকে চলে এসেছিলেন। ভবিষ্যতের শালা-বৌয়ের সব গুণপনা সম্পর্কে তিনি ইতিমধ্যেই শুনে রেখেছিলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ পরামর্শ, …শোনো ছেলে, এখন পারিবারিক মর্যাদা আছে এমন কাউকে বিয়ে করে নাও। পরে কখনও না হয় কোনও সুন্দরীকে নিয়ে এসো। দিদ্দার বড় বড় সুন্দর চোখগুলো তখন তার স্বামীকে দেখছে। যাই হোক পাণ্ডে তার জামাইবাবুর পরামর্শ মেনে খুশি মনে কালী মাকে বিয়ে করে এনেছিল। নিজের পেটের সন্তানের বিয়ে হওয়ার আগেই দিদ্দার ঘরের উঠোনে পায়েলের ঝংকার তুলে বউমার আগমন হল।

    পাণ্ডে দিদ্দাকে খুবই ভালোবাসত। তা হওয়ার কথা ছিল বটে। তবে সে তার দয়ালু জামাইবাবুর কদরও কিছু কম করত না। আর তা তো হওয়াই উচিত। যে বাপ পাণ্ডের জন্ম দিয়েছিল সে কি কখনও তার ভালোমন্দ কিছু জিজ্ঞেস করত? তার যা কিছু সবই তো এই জামাইবাবুর দেওয়া। নিজে উকিল বলেই তো তিনি এখন শালাকে আইন পড়াচ্ছেন। বলতেন ভাইয়ান ঘরেই খুব ভালো ট্রেনিং পেয়ে যাবে। ব্যবসা জমেছে এমন সফল উকিলের সঙ্গে থেকে প্র্যাক্টিস্‌ করলে তো খুব তাড়াতাড়িই দাঁড়িয়ে যাবে। এখন দেবতা সদৃশ এমন জামাইবাবুর কথাটা সে কীভাবে অগ্রাহ্য করে? তাই তালিম সম্পূর্ণ করার কয়েক বছর পরে যখন ওকালতির ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল, আর পাণ্ডে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করল, তখন সে কোনও এক সুন্দরীকে বিয়েও করে ফেলল।’

    কিস্‌সার এই জায়গায় এসে কে.কে. মামা ঠান্ডা শ্বাস নিলেন। আবারও গরম চায়ের তলব পাঠালেন। গল্পের মধ্যে এই নাটকীয় বিরতিতে শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়ল।

    ব্রেকের মধ্যে হঠাৎ বিপিন ভাইয়ের অট্টহাসির আওয়াজে ছাদ ফেটে যায় আর কী! বলল, ‘আরে, এটা তো আমরা সবাই জানি যে সেই সুন্দরী মুসলমান্টি ছিল। কিন্তু কোথায়, কীভাবে তাদের যোগাযোগ হয়েছিল সেটা মামাই বলতে পারবেন।’

    জবাব দেওয়ার আগে মামা আবার চেবানো পানটাকে এক গাল থেকে অন্য গালে ঠেলে দিয়ে পানের পিকটাকে মুখের মধ্যেই ধরে রাখলেন।

    ‘যান না, পিকটা ফেলে আসুন না,’ শ্রোতাদের মধ্যে কেউ বলে।

    ‘আবে চুপ...,’ আরেক শ্রোতা তাকে থামিয়ে দিল। ‘আগে চা আসতে দে, মামা ফ্রেশ হয়ে যাবে।’

    খুব তাড়াতাড়িই চা চলে এল। নাইয়ারা বিবি সকলের জন্য পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে বিপিনের দিকে একবার কটমট করে চেয়ে বললেন, ‘ওই মুসলমাণ্টি-র ব্যাপারটা আমি তোমার সঙ্গে একটু পরে বুঝে নেব। তার আগে মামার কাছ থেকে কিস্‌সাটা শুনে নিই।’

    শুনে বিপিনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ‘তুমি আমার কাছ থেকে কী বুঝে নেবে, নাইয়ারা ভাবি? কতবার বলেছি তোমার মত কোনও খুবসুরত মুসলমাণ্টি আমার জন্য খুঁজে এনে দাও। কিন্তু তুমি তো শুনলে না। এখন আমি তোমার প্রেমে পড়ব। ওই শালা আনোয়ারের কিসমত। কোনও এক ওস্তাদ বলেছেন না...মুখপোড়া বাঁদরের কোলে এক হরি...’

    নাইয়ারা বিপিনের ঘাড়ে একটু গরম চা ঢেলে দিল। ‘মর...কমবখত...হিন্দু চে...’

    মুখ থেকে পানটা ফেলে কুলকুচো করে নিয়ে চায়ে সুরুত সুরুত আওয়াজ তুলে চুমুক দিতে দিতে মামা আবার দাস্তানের সুতোটা পাকড়ে ধরলেন। শ্রোতারাও চায়ে চুমুক দিচ্ছিল।

    ‘ইয়ারদোস্তরা কথা তো অনেক ওড়াল। তাকে রান্ডি-মান্ডিও বানিয়ে ফেলল। কিন্তু সেটা কখনও সত্যি নয়। সেই সুন্দরীর খানদানও হেলাফেলা করার মত ছিল না। আর মুসলমাণ্টা বা মুসলমাণ্টির কথা যদি তোলেন তা হলে তো বলতে হয় নাইয়ারা বিবিকে দেখে বলুন উনি হিন্দু না মুসলমান? লোকে মাথায় তাদের জাতপাত অথবা ধর্মের পরিচয় নিয়ে ঘোরে না। আর মিয়াঁ, যদি আমার নিয়ম চলত তা হলে আমি পৃথিবীর সব ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিতাম। ধর্ম ছাড়া অন্য আর কিছু মানুষের মধ্যে এত কলহ আর বিবাদের কারণ হয়ে ওঠেনি।’

    মামার এই শেষ বাক্যটির আবেগ কিছুক্ষণের জন্য শ্রোতাদের হতভম্ব করে দিল। কিন্তু মানুষ যেমন হঠাৎ রেগে গিয়েই আবার শান্ত হয়ে যায়, মামাও তেমনি আবার নরমাল হয়ে গেলেন। ‘পাণ্ডের জামাইবাবু পণ্ডিত ওঙ্কার নাথ মিশ্রের আজ্ঞাবহ ও বিশ্বস্ত পুরোনো মুনশি ছিলেন মুনশি রজব আলি। বয়সে ওঙ্কারনাথের থেকে একটু বড়। রজব আলির বাবা ইমতিয়াজ আলি ওঙ্কার নাথের বাবার আমল থেকে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জমিজমার তদারকি সব তিনিই করতেন। অত্যন্ত সৎ, দায়িত্বশীল ম্যানেজার ছিলেন। ছেলেকে পড়াশুনো করিয়েছিলেন। তাই রজব আলি ওঙ্কার নাথের মুনশি বনে যান। দিদ্দা তাঁকে রজব আলি ভাইসাহেব বলে ডাকত। ইমতিয়াজ আলি কখনও এসে পড়লে দিদ্দা মাথায় ঘোমটা দিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করত। তবে হ্যাঁ, সে ইমতিয়াজের বাড়িতে যেত না। মিয়াঁ, এ সেই জমানা যখন লোকে একে অন্যের বাড়িতে যাক বা না যাক, পারস্পরিক উষ্ণ স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কের কোনও অভাব ছিল না। এখন রুটির রিস্তা তো কায়েম হয়েছে, কিন্তু হৃদয়ের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। কী লজ্জার কথা!’ মামা আবার পানের ডিবে থেকে ভাঁজ করা পান বার করলেন।

    ‘খাওয়া-দাওয়ার বাধানিষেধ শুধু রান্না করা খাবার আর তরল পানীয়ের ব্যাপারে। শুকনো জিনিস, পান-তামাক-ফলে কোথাও কোনও নিষেধ ছিল না। ইদের সময় রজব আলির বাড়ি থেকে উপহারের থালি আসত। তামার নতুন ট্রে-তে শুকনো সেমাই আর মেওয়া, চিনি...আর কী আশ্চর্য এক কোণে দুধ কেনার জন্য রাখা থাকত কয়েকটা নতুন কড়কড়ে নোট! সব ছেলেমেয়ের জন্য নামে নামে ইদের লেফাফা! এই সব জিনিস যখন ট্রে সমেত দিদ্দার কাছে এসে পৌঁছোত, তখন দিদ্দা প্রতিবারই বলে উঠত,…আরে রজব আলি ভাইসাহেব! আবার একটা নতুন থালা! বলেছি না আমাদের সেই বাসন কোসনে কোনও আপত্তি নেই যাতে রান্না করা অথবা খাওয়া হয়নি? পুরোনো বাসনই নিয়ে আসবেন, আবার ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু রজব আলি সে কথা কানে নিত না। তিনি মারা যাওয়ার পর দিদ্দা ঠান্ডা শ্বাস নিতে নিতে বলল, সব ট্রে-গুলো ভাঁড়ার ঘরে রাখা আছে। গিয়ে গুনলে বুঝতে পারবে কতগুলো ইদ একসঙ্গে কেটেছে।

    সেই রজব আলির এক বিধবা বোন ছিল। বয়েসে অনেকটা বড়। আর সেই দিদির ছিল এক নাতনী যার মা যুবতী অবস্থায় মারা যায়। মেয়েটার বাবা আবার বিয়ে করেছিল। রজব আলি বিধবা দিদি আর তার নাতনীকে ঘরে নিয়ে আসে। তার নিজের মেয়ে না থাকায় বোধহয় মেয়ের খুব ইচ্ছে ছিল। খুব ধুমধাম করে তার বিয়ে দিয়েছিল। দিদ্দাও সেই বিয়েতে কনের জামাকাপড় পাঠিয়েছিল। কিছুদিন বাদে জানা গেল যে ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার কোনও মানসিক অসুখ আছে। রজব আলির অকাল মৃত্যুর কারণ আদরের নাতনীর বিবাহ বিচ্ছেদ। মেয়েটা ঘরে ফিরে এল। নীরবতার এক প্রতিমূর্তি যেন। এই সময় প্রথম বার পাণ্ডের চোখ তার ওপর পড়তেই পাণ্ডে হয়ে গেল উন্মাদ! সূর্য যেন ঠিক তার মাথার ওপরে – মস্তিষ্কটা যেন গলে যাচ্ছে। রজব আলি মারা যাওয়ার পরে পাণ্ডে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে গেলে মেয়েটি হঠাৎ সামনে এসে পড়ে। মুখে কান্নার ছাপ স্পষ্ট, চোখ দুটি লাল। পাণ্ডের তখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, অনেক সুন্দরী নারীও এ জীবনে তার নজরে এসেছে। কিন্তু কাউকে এভাবে সে হৃদয় সঁপে দেয়নি।

    ঘটনা হল রজব আলির প্রতি পুরোনো বিশ্বস্ততার নিদর্শন রাখতে পাণ্ডে তাঁর বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করল। উপহার-উপঢৌকনে তাদের ভরিয়ে দিল। রজব আলির বেচারা বউ সাদাসিধে ঘরকন্না করা মহিলা। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু আর বাচ্চা মেয়েটার ওপর দিয়ে যা হয়ে গেল তাতে রজবের বউয়ের বোধবুদ্ধি তো প্রায় লুপ্ত হয়েই গিয়েছিল। বেশ অনেক দিন তার মাথায় কিছুই ঢুকত না। আর তো ছিল দিদ্দা যে ঋতুটা বসন্ত কী না সে খবরও রাখত না। চমকে গিয়ে ধড়মড় করে যখন উঠে বসল তখন জল তার মাথার ওপর দিয়ে বইছে। ...হর হর...হর...হর...

    আরে ভাইয়ান, এ আমি কী শুনছি?

    ভাইয়ান চুপ তো চুপ!

    আরে কিছু বলছিস না কেন? শেষ পর্যন্ত এই পেলি? একে তো মুসলমান, তায় তালাক দেওয়া!...আরে, আমি কি পাথরের সঙ্গে কথা বলছি নাকি?... দিদ্দা এবার কাঁদতে শুরু করে দিল।

    প্রেম আচ্ছা-আচ্ছা মানুষকেও বোকা বানিয়ে দেয়। দিদ্দা যখন বেশি হাঙ্গামা শুরু করল, তখন পাণ্ডে – যে কয়েক বছর আগেই তার বোনের পছন্দের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে পবিত্র আগুনের মধ্যে দিয়ে সাতবার গেছে – তাকেও মুখ খুলতে হল – যদিও সে দিদ্দাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই কথা বলেছিল: দিদ্দা তুমি আমার মায়ের সমান। মা বেঁচে থাকলে তাঁকেও আমি এর চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতে পারতাম না। যখন আমাকে জিজ্ঞেস না করেই তুমি আমার জীবনের ফয়সালা করে ফেলেছিলে তখন আমি তোমার সম্মান রেখেছিলাম। মনপ্রাণ দিয়ে তাকে গ্রহণ করেছিলাম। সেই পাটরানি যেমন ছিল তেমনটাই থাকবে। কিন্তু এ আমার প্রেম, কাজেই এও থাকবে।

    দিদ্দা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ভাইয়ান তার মুখের ওপর উত্তর দিয়ে দিল! এর পরে তো আর কিছুই বলার বা শোনার থাকে না।

    কেউ একজন বলে ফেলল, ‘ওয়াহ, ভাইয়ান সাহাব, ওয়াহ! খুব বীর হয়েছ দেখছি। এক তো এই আমাদের বিপিন ভাইয়া আছে। মেয়ের ধর্ম আলাদা ছিল না, শুধু অন্য জাতের ছিল। মা এমন বকুনি দিলেন যে ছেলে এসে তাঁর আঁচলের তলায় লুকোল।’

    ‘শেম, শেম,’ সকলের চিৎকার একসঙ্গে শোনা গেল।

    ‘যারা জেনারেশন গ্যাপের কথা বলে, তাদের মুখে গোবর লেপে দাও গিয়ে। লোকে বিনা কারণে আজকের মানুষদের বদনাম করে। এই আগের লোকেরাও কিছু কম ছিল না,’ আরেকজন কেউ কমেন্ট করল।

    বিপিন ভাইয়াকে যেন সাপে শুঁকেছে, সে এমনই নিশ্চুপ। তার করুণ মুখখানি দেখে কেউ তার মদত করতে এগিয়ে এল... ‘আচ্ছা মামা, এরপরে আরও কিছু তো নিশ্চয়ই ঘটেছিল, নাকি?’

    ‘তারপরে যা ঘটেছিল তার সবই বিধাতার ইচ্ছে। তার ওপরে দিদ্দা, পাণ্ডে আর মির্জাপুরবাসীদের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পাণ্ডে যখন সুন্দরীকে বিয়ে করল, তখনই সে দুটি মেয়ের বাপ। তাদের বয়সও অন্তত পাঁচ-ছ বছর হবে। এবারে দ্বিতীয় বিয়ে করার পরে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছেলে হল। পরের বছর আবার একটা বেটা। এদিকে তারপরে প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে তিন নম্বর বেটি। দিদ্দার গোসা গেল উবে। সে তার ভাইয়ের বউকে বরণ করে নিল বড় বড় খানদানি ঝুমকো দুল পরিয়ে। ভাইপোদের চাঁদ আর সূর্যের মত ঝকমকে মুখ দেখে দিদ্দা তো আহ্লাদে আটখানা! তাদের সুন্দরী যুবতী মা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালে দিদ্দা তাকে ‘দুধোঁ নাহাও, পুতোঁ ফলো’ বলে আশীর্বাদ করল। তার হাত থেকে সাজা পান নিয়ে খেল (পানের ডিবে তো পাণ্ডের জন্য সব সময় তৈরিই থাকত)।

    দিদ্দা ফিরে এসে ভগবান সত্যনারায়ণের পুজোর আয়োজন করল। পুজোর প্রসাদ নিয়ে আরও একবার সেই ভিনধর্মী ভাই-বউয়ের কাছে গেল। সাফ কিছু বলতে তো পারল না, তবে প্রসাদটা বাড়িয়ে দিল। যুবতী দুহাতে অত্যন্ত ভক্তিভরে সেই প্রসাদ গ্রহণ করল। ...(কমবখতটা কতই না সুন্দরী!)...হাত নয় তো যেন চাঁদি দিয়ে তৈরি, দিদ্দা ভাবে। তারপরে মাথায় ঠেকিয়ে প্রসাদটা খেয়ে নিল। দিদ্দা দেখল, আরে এই মেয়েটার নিষ্ঠা তো খুব, বড়দেরও খুব সম্মান করে। একটু থেমে দিদ্দা বলল,… ভাইয়ানের সঙ্গে তোমার জুড়ি যেন রাম-সীতার জুড়ি বলে মনে হচ্ছে। আমি আজ থেকে তোমার নাম রাখলাম জানকী। জানো বোধহয় সীতা মাইয়ার আরেক নাম জানকী। ভাইয়ানের নামের মধ্যেই এই নামটাও আছে।...রোশন আরা হেসে ফেলে। (‘নামে কী আসে যায়?’ শেকস্পিয়ার তো বহু শতাব্দ আগেই সাড়ম্বরে ঘোষণা করেছিলেন। তারপরে কোনও তীক্ষ্ণবুদ্ধি মানুষ কাব্যিক দক্ষতার পরিচয় রেখে তাঁর নামটিকে ‘শেখ পিয়ার’-এ রূপান্তরিত করেন।)

    ছেলেদের নাম রাখা হয়েছিল আমির আর সাবির। দিদ্দার কাছে নাম দুটি বদলে হল ‘অমর’ আর ‘সুবীর’। এইভাবে সে সকলকে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেই ঘরে ফিরল। হিন্দু আর ইসলাম ধর্মের মধ্যে বিপুল দূরত্ব এক লহমায় ঘুচিয়ে দিল সে। এত তাড়াতাড়ি তো হনুমানজীর ফৌজও শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধ্যে সেতু তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের ‘ফলআউট’ কিছুটা গড়বড় হয়ে গেল। যে খানদানি পরিবার থেকে দিদ্দা অত আগ্রহের সঙ্গে ভাইয়ের বউকে ঘরে এনেছিল, সেই পরিবারের লোকেরা এতে খুবই নিরাশ হল। মিয়াঁ, এই শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে ঝগড়া তো অনেক পরিবারেই হয়ে থাকে। তবে ভদ্র পরিবারে এই সব ঘটনা একটু ঢেকেচেপে রাখা হয়।

    ‘ঠিকই তো সাহেব, শাহজাদী অ্যান্‌ আর লেডি ডায়নার মধ্যে কখনও সুসম্পর্ক ছিল না।’

    ‘ওয়াহ সাহেব – সোজা ইংলিস্তানেই পৌঁছে গেলেন! নিজের দেশের সফদরজং রোডকে কেন ভুলে যাচ্ছেন?’

    পাণ্ডেকে নিয়ে কথা হতে হতে রাজনীতির নেতা আর তাদের আত্মীয় পর্যন্ত আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল। চায়ের সঙ্গে চিনেবাদাম আর পরনিন্দা-পরচর্চাসহ সেই অধিবেশন অনেকক্ষণ চলেছিল। (মুস্তাক ইউসুফির বয়ানে শীতের মরসুমে উভয়ই বড়ই আরামদায়ক।) সে মজার আসর বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।

    এমন অধিবেশন আজও বসে, কিন্তু সে মজা আর নেই। কে.কে. মামা পঞ্চান্ন বছর বয়েসে (তাঁর ভাষায় ভরপুর যৌবন) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দুবছর পরে মারা যান। তাঁর কাহিনির হিরো তখনও তত বুড়ো হয়নি। ষাট বা তার চেয়ে সামান্য বেশি তার বয়েস। চার-পাঁচ বছর বেশি হতে পারে। ব্যায়াম করা চেহারা। সে যে মরবে এমন ইঙ্গিত দূর দিগন্তেও দেখা যাচ্ছে না। মনে হত আশি-পঁচাশির আগে একটা ইটও খসবে না। গোটা বাড়িটার কথা তো ছেড়েই দিন। হ্যাঁ, দিদ্দা মরে গিয়েছিল, মেয়েরাও বড় হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রথমা স্ত্রীর চাপও বেড়েছিল। রসুলপুরে গেলেও তাড়াতাড়ি ফিরে আসত। কিন্তু এবারে যখন গেল, তখন আগে-পিছের সব হিসেব চুকিয়ে দিল। সেখানেই তার মৃত্যু হল। ব্যস, এমনি এমনি, হঠাৎই বসে বসেই মরে গেল। কে.কে. মামা তো জীবিত নেই, নচেৎ নিশ্চয়ই বলতেন...‘দেখো মিয়াঁ, যেমন কারও প্রেমে পড়ার সময় নির্দিষ্ট করা নেই, তেমনি আঁধি ঝড় যে কখন আসবে কেউ বলতে পারে না। বিয়ে-শাদি আর মৃত্যুও তেমনি। এসবই কখনও সখনও এমন অকস্মাৎ ঘটে যায় যে বিশ্বাস করাও কঠিন। এখন দেখো পাণ্ডে তো বেশ ভালোই ছিল ঘরে বসে। রসুলপুরে মরতে কেন গেল? মানছি, সেখানে ছিল তার প্রিয় বিবি। কিন্তু সেই সময় যদি না যেত, তা হলে হয়ত মরতও না। আর যদি মরতও, তাহলেও তো রসুলপুরে তার মৃত্যু হত না।’

    পাণ্ডে যখন রোশনের কাছে প্রোপোজ্‌ করে করে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, তখন রোশন একদিন বলেছিল, ‘কিন্তু পণ্ডিত, (সে পাণ্ডেকে ওই নামেই ডাকত) তোমার আর আমার ধর্ম ভিন্ন। তার ওপরে তুমি বিবাহিত – দুই বাচ্চার বাপ। এখন তুমি যদি লক্ষ বারও বল যে আমার জন্য তুমি বিষও খেতে পার...’

    ‘ধর্ম!’ পাণ্ডে গভীর শ্বাস নিয়ে মাথা চুলকোত। ‘হ্যাঁ, ধর্ম তো আছেই। তুমি মুসলমান, আর আমি হিন্দু। কিন্তু আমি যে বিবাহিত এই ব্যাপারটাকে আবার এর মধ্যে টেনে আনছ কেন? তোমার ধর্ম তো চারবার বিয়ে করার অনুমতি দিয়েই রেখেছে।’

    রোশন আরা হাসে, 'হিন্দুদের তো এ ব্যাপারে কোনও সীমাই বেঁধে দেওয়া নেই। চারই হোক বা চল্লিশ।' পাণ্ডে বিরক্ত হল, ‘আর গভর্নমেন্ট তো আইন লাগিয়ে দিয়েছে না? তা না হলে আমার পূর্বপুরুষের মধ্যে একজন ছিলেন। একই পরিবারের চার বোনকে একের পর এক বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলেন। তারপরে যখন সেখানে মেয়েদের স্টক শেষ হয়ে গেল, তখন এক বাজারের মেয়েকেও রেখেছিলেন। কিন্তু তোমাদের তো কোনও বাধানিষেধ নেই না।...' রোশন আরা রাগত দৃষ্টিতে চাইল, ‘আমাদের ওপর তো নিশ্চয়ই আছে। শুধু আমাদের পুরুষদের ওপর কিছু নেই। বাই দ্য ওয়ে পণ্ডিত, তুমি আমাকে কী ভাবো?'

    ‘জান-এ-পণ্ডিত...আমার প্রাণ!'

    ‘ওই খাঁটি হিন্দু শব্দটার সঙ্গে ফারসি ‘এ' জুড়লে শুনতে ভালো লাগে না। যেমন তোমার-আমার এই জুড়ি। এক বিরল বেজোড়!'

    ‘রোশন আরা, তুমি একদিন দারুণ মার খাবে।'

    রোশন সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর। ‘মার তো আমি খেয়েই ফেলেছি। জীবনের দাবা খেলার বোর্ডের ওপর বেচারা এক ঘুঁটির মত। পণ্ডিত, এখন আমি কী করি?' অজ্ঞাতসারেই সে হাত কচলাতে শুরু করল। তার কথায় প্রবল হতাশার ছাপ স্পষ্ট।

    ‘কিছু কোরো না। শুধু চুপচাপ আমাকে বিয়ে করে নাও।'

    ‘তোমাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে। আমি কোর্ট ম্যারেজ করব না।'

    ‘কোর্ট ম্যারেজ তো এমনিও হবে না। ঘরে ওই যে একজন আছে না...মির্জাপুরওয়ালি...আমি কীভাবে অস্বীকার করি যে তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে?'

    ‘তাহলে? আমাকে রক্ষিতা করে রাখবে নাকি?'

    এবারে পাণ্ডের গম্ভীর হওয়ার পালা। যাকে এত ভীষণভাবে, সব কিছু ছেড়ে দিয়ে ভালোবেসেছে, তার ওপর কী করে এমন অসম্মানের বোঝা চাপায়?

    এক মুহূর্তের জন্য পাণ্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।

    ‘বলো পণ্ডিত,' রোশন আরার কথায় বোঝা যায় সে নিশ্চিত উত্তরের প্রত্যাশা করছে।

    ‘আমি নিকাহ্‌ করব,' পাণ্ডের স্বরে প্রত্যয়ের ছাপ স্পষ্ট।

    ‘ধর্ম বদলাতে হবে, সেটা জানো তো?’

    ‘এবারে তুমি উকিলকে পড়াবে, রোশন আরা বেগম! তুমি এমন এক আওরত যার – জ্ঞানীগুণীরা যেমন বলেন – বুদ্ধির অধিষ্ঠান হল গোড়ালিতে!’

    ‘গোড়ালিতে কার বুদ্ধির অধিষ্ঠান সে ফয়সালা পরে হবে। প্রথমে তুমি তো এটা ভেবে রাখো যে রাস্তা এবড়োখেবড়ো পাথরে ভরা থাকবে। নিজের পিতৃপুরুষের ধর্ম ছেড়ে...’

    ‘কেয়ার করি না,’ পাণ্ডে ঠোঁট কামড়ায়।

    ‘কাকে কেয়ার করো না? ধর্মকে না পিতৃপুরুষদের?’

    ‘সমাজকে। যে সমাজ ধর্ম তৈরি করেছে। তবে হ্যাঁ, তোমার ধর্ম তো আকাশ থেকে নেমে এসেছে।’

    ‘এই মুহূর্তে তুমি হিন্দু। যা প্রাণে চায় বলে নাও। একবার মুসলমান হয়ে গেলে কিন্তু বেয়াদবি করার অনুমতি পাবে না।’

    ‘ইয়ার, তোমার ধর্মে রেজিমেন্টেশন খুব বেশি।’

    ‘হয়ত’… রোশন আরা ভাবতে থাকলেও মুখে কিছু বলল না।

    ঘরে ফিরে রাতে বউয়ের পাশে শুলেও পাণ্ডের আর ঘুম আসে না। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। দিদ্দা তাকে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে দেয়নি। যাতে ভাইয়ের আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে, লোকে কথা বলার সুযোগ না পায়, তার জন্য বিয়ের কিছুদিন পরে যখন পাণ্ডে রোজগারও করতে শুরু করেছে, তখনও নিজের বাড়ির লাগোয়া জমিতে একটা কটেজের মত বাংলোতে ভাইয়ের সংসার পেতে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। দুটি বাড়ি একই কম্পাউন্ডের মধ্যে। দিদ্দার নিজের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত মালিকে দিয়ে তৈরি করা বাগান। এমন সব সুন্দর গাছ যাদের পাতাগুলোও ফুলের চেয়ে বেশি সুন্দর। সেই সব গাছপালার মধ্যে দিয়ে যখন হাওয়া বয়, তখন তা যেন একটু বেশিই মনোরম। পরিষ্কার নীল আকাশে চাঁদ যেন একটা ফানুসের মত ঝুলছে। সিগারেটটা খেতে খেতে পাণ্ডে সেখানেই বসে থাকে। বেলফুলের খুশবু যেন সিগারেটের গন্ধকেও ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গিয়ে জাদুময় পরিবেশ তৈরি করে।

    সকাল হতে তখনও একটু দেরি। পাণ্ডে কুর্সি থেকে উঠে দিদ্দার ঘরের দিকে চলল। এক দিকে সাদা নাগবল্লীর বড় বড় ঝাড়। শোনা যায় গৌতম বুদ্ধ তাঁর কোনও এক জন্মে শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অমাবস্যার রাত। তিনি কোনও ক্রমে হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছিলেন। হঠাৎই অরণ্যকে আলোকিত করে সারি সারি নাগবল্লীর ঝাড়ে চাঁদের আলোর মত ফুল ফুটে উঠল। চাঁদের আলো সর্বত্র ছড়িয়ে গেল। কিন্তু সে চাঁদের আলো নয়, ফুল থেকে বিচ্ছুরিত আলো। তখন গৌতম বুদ্ধ সেই নাগবল্লীর ঝাড়কে আশীর্বাদ করলেন। সেই আশীর্বাদ আজও কাজ করছে – নাগবল্লীর ঝাড়ে সারা বছর ফুল ফুটে থাকে। জানা নেই সেই কাহিনির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব নাকি ফুলের কোনও সহজাত গুণের জন্যই তাদের দিকে তাকালে হৃদয় আর মন যেন শান্তিতে ভরে ওঠে। এও কি গৌতম বুদ্ধের আশীর্বাদ? বুদ্ধ কি সমগ্র মানব জাতির মধ্যে যাতে কাণ্ডজ্ঞানের উদয় হয়, তার জন্য প্রার্থনা করেননি? তারা যাতে সুস্থ, বিবেচক মনের অধিকারী হয়, তার জন্য প্রার্থনা? মন থেকে সব অপবিত্রতা দূর করার জন্য প্রার্থনা, সব ভ্রষ্টাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দোয়া, বার্ধক্য, রোগভোগ আর মৃত্যুর এই আবর্ত থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা? এগুলো তো আজও মানুষের ভয়ের কারণ, এখনও তো তারা মানুষের মনকে আতঙ্কে ভরিয়ে দেয়। মা...পেয়ারি আম্মা...যুবতী বয়েসে চলে যাওয়া সুন্দরী মাকে মনে পড়ায় পাণ্ডের চোখ জলে ভরে আসে। রাতের এই প্রহরটি তার অসহায় দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে। মা মরে কোথায় চলে গেলেন? তাঁকে কি সত্যিই বৈতরণী পেরিয়ে যেতে হল? এই জগতের পরে আরও কি কোনও জগৎ আছে? মৃত্যুর পরে কি তার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে? বেঁচে থাকতে ছোট্ট জানকী রমণকে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নিয়ে যে মা ঘুরে বেড়াতেন, তাঁর মন কি এখনও ছেলেকে দেখার জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠে? বছর বছর গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান করলে কি সত্যিই মায়ের আত্মা শান্তি পাবে? আত্মা? আত্মা কী? (রোশন আরাও তো মুনশি রজব আলির নাম নিয়ে ফাতিহা পড়ে বলে যে তাতে তাঁর হৃদয় শান্তি – আর পুণ্যের ফল লাভ করবে।) পাপ আর পুণ্যফলই বা কী? রোশন তাকে কখনও ভালোবাসতে দেয়নি – শুধু তার আঙুলগুলো ছোঁয়ার অনুমতি দিয়েছে। তার প্রিয় কথাটা হল ‘এটা পাপ’…যেটা প্রায় মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। (কিন্তু রোশন বিবি, তোমার ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া ...নারী আর পুরুষের মধ্যে এই আকর্ষণকে পথ দেখানোই তো পাপ।) পাপ আর পুণ্যফলের এই অর্থের সৃষ্টিকর্তা কে?...পাণ্ডে অধৈর্য হয়ে দ্রুত পা চালিয়ে চলল। সে যদি কলমা পড়ে বলে আমি মুসলমান, তাহলেও তো সে জানকী রমণ পাণ্ডেই থেকে যাবে? নাকি অন্য কেউ হয়ে যাবে?

    তখন সে ফয়সালা করল যে না...সে তো সেই মানুষই থাকবে...তার সব জ্ঞানগম্যি আর সচেতনতা, ওকালতির সব চুলচেরা বিচার, তার শরীর আর রং ও রূপ, তার আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা, তার সব বজ্জাতি আর অভাব-ত্রুটি, তার সব প্রেম-ভালোবাসাসহ সেই একই মানুষ...

    ভালোবাসার পাত্রীরা – তার দুটি কন্যা আর এক স্ত্রী বর্তমান। স্ত্রীর প্রতি এমন কোনও টান, আবেগের তেমন কোনও দুরন্ত ঝড় সে অনুভব করেনি যা রোশন আরার জন্য করেছে। কিন্তু দিদ্দা আর মেয়েরা? তাদের জন্যও কি তার হৃদয়ে ভালোবাসা নিজের ওপর শুধু এই নতুন লেবেলটা লাগানোর কারণেই কমে যাবে (অথবা সম্পূর্ণ মুছে যাবে)? এটা কীভাবে হতে পারে জানকী রমণ পাণ্ডে? পাণ্ডে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল। তা হলে এটা কী ধরনের বিতর্ক? আল্লাহ্‌ আর ভগবানের মধ্যে এই পার্থক্য...এটা কেন মোছা যাবে না? (এর সমাধান কি কখনই হবে না? পাণ্ডের ভাবতেও বেশ কষ্ট হল।)

    পরের সপ্তাহে পাণ্ডে রোশন আরাকে গিয়ে বলল যে সে কলমা পড়ার জন্য তৈরি।

    ‘কিন্তু রোশন,’ পাণ্ডে সেই শান্ত, নিমীলিত নয়ন, উজ্জ্বল মুখের নারীকে বলল, ‘আমি বিষ্ণুভক্ত, আমি মন থেকে তাঁকে মুছে ফেলতে পারব না। তুমি এটা বোঝার চেষ্টা করো যে এই সব নাম আর ধ্যানধারণা বিভিন্ন সময়ে মানুষ তার বুনিয়াদি প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তৈরি করেছে। এ জগৎ কার তৈরি? মানুষের মৃত্যু হয় কেন? মরার পরে মানুষ কোথায় যায়...তার কী হয়? জগতে যে অন্যায় আর দুঃখ আছে, সে ক্ষতির কী কোনওভাবে পূরণ হবে না? যে পাপীদের আইনি সাজা হয় না, তারা কি কোথাও কখনও শান্তি পাবে? যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য কি কোথাও পুরস্কার আছে? এমনিতেই তো এই দুনিয়ায় পাপ আর অত্যাচার অনেকই আছে, রোশন বেগম! ধর্ম না থাকলে তার বন্যা বয়ে যেত। ধর্ম মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শয়তানের জন্য লক্ষ্মণরেখা এঁকে দেয়। দুঃখে, ক্রাইসিসে তা মানুষকে শক্তি আর সাহস জোগায়। আশা জাগিয়ে রাখে। ...এই যে তুমি কথায় কথায় ‘ইনশাল্লাহ্‌’ বলো...’মাশাল্লাহ্‌’ বলে খারাপ নজর থেকে বাঁচতে চাও...রোশন...তোমার আল্লাহ্‌ রহমান (দয়ালু) আর রহিম (ক্ষমাশীল)...তিনি যেমন পাপ ক্ষমা করে দেন, তেমন শাস্তিও দেন। তিনি যেমন জীবনের রক্ষাকর্তা, তেমনি মৃত্যুরও নিশ্চয়তা দেন। আমার বিষ্ণুরও এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো আছে। আমরা শুধু তাঁকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখি – তিনি সৃষ্টি করেন, লালনপালন করেন, আবার ধ্বংসও করেন। এই তিনই একই সত্তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। পাণ্ডে হাসে...তোমার আল্লাহ্‌ সকল জগতের অধীশ্বর – শুধু মুসলমানদের অধীশ্বর নন। সেই ভাবে তিনি আমারও হলেন।...হ্যাঁ, এখন আমি তাঁকে আমার বলে ঘোষণা করতে পারব। তাঁরই কৃপায় আমাদের চার হাত এক হবে। কিন্তু তাঁকে যে রূপে আমি আজ পর্যন্ত পুজো করে এসেছি, সেই রূপেই পুজো করে চলব, রোশন...আর রোশন বেগম...দ্বিতীয় কথাটা হল আমার স্ত্রী, আমার বাচ্চাদের আর দিদ্দাকে আমি ছাড়তে পারব না। আমার স্ত্রী যেমনই হোন না কেন, তিনি বিধিবিধান মেনে আমার বিয়ে করা বউ। আমার গোটা সমাজ তার পেছনে দাঁড়াবে। শুধু একটা সম্পর্কের জন্য সকলকে কুরবানি দেওয়া যাবে না। পাণ্ডে আবার একটু থেমে হাসল। মিসেস সিম্পসনের জন্য খ্যাত কিং এডওয়ার্ডের তুলনা টেনো না যেন! তিনি রাজা ছিলেন, তাও আবার ইংল্যান্ডের রাজা। আমি সাধারণ মানুষ...জনতা জনার্দন...হিন্দুস্থানের অত্যন্ত জটিল বর্ণাশ্রমের শিকার।

    চাঁদপানা মুখটা হাতের মধ্যে বাটির মত ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে পাণ্ডের লেকচার শুনতে শুনতে রোশন হেসে ফেলে।...বেদনার, উদ্বেগের সে হাসি। পাণ্ডে...তোমাকে আমার হৃদয় দেওয়ার সময় আমি এটা ভাবিনি যে তুমি জানকী রমণ পাণ্ডে আর আমি রোশন আরা। যখন দুটো নামের মধ্যে পার্থক্যের কথা আমার মাথায় এল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তোমার মন যা চাইবে, তাই করতে থাকো। শুধু কলমা পড়ে আঙুলে রক্ত লাগিয়ে নিও।...কারণ নিকাহ্‌ করা ছাড়া অন্য কোনওভাবে তোমার সঙ্গে থাকার অনুমতি আমার জুটবে না। আমি তো এমনকী তোমাকে মাংস খাওয়ার জন্যও বলব না।...তারপরে রোশন একটু রেগে বলল, তুমি যখন আমার এখানে আসবে, তখন গরুবাছুরের দানাপানিই না হয় তোমাকে খেতে দেব।...আর যদি কখনও তোমার স্ত্রীর অধিকার কেড়ে নেওয়ার কথা ভাবি, তাহলে যেন শুয়োর খাই...এখানে আসার ব্যাপারে বলি...যখনই মন চাইবে আসবে। আর ততদিনই থাকবে যতদিন থাকলে তোমার মানসিক শান্তি নষ্ট না হয়।

    পরের সপ্তাহে দুজনের বিয়ে হয়ে গেল। নিকাহ্‌ হওয়ার আগে জানকী রমণ পাণ্ডে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, গোবেচারা চেহারার এক মৌলবির উপস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। নিকাহ্‌র সময় রোশনের নানি অর্থাৎ রজব আলির বিবি দুঃখে কাতর আর ক্ষুব্ধ হয়ে বসেছিলেন। তাঁর কষ্টের কারণ এটা ছিল না যে রোশন এক হিন্দুকে বিয়ে করছে। তাঁর যন্ত্রণার কারণ তিনি এবার ওঙ্কার নাথের বউয়ের কাছে কীভাবে মুখ দেখাবেন? কোন্‌ মুখে তিনি ইদের সময় সেমুই পাঠাবেন! নানি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! দুই খানদানের এতদিনের পুরোনো সম্পর্ক। সিঁধ কাটার জন্য কি তাদের ঘরটাই বাকি ছিল? জানকী রমণ তো পুরুষ মানুষ। তাকে কেউ কিছু বলবে না। রোশন তো প্রথম সাক্ষাতেই তার প্রেমে পড়েনি। জানকীর বারবার যাতায়াত আর তাদের সম্পর্ক বহাল রাখার জন্য সে কোনও বাহানাও খুঁজে বার করেনি। বরং প্রথম দিকে সে জানকীর আসা-যাওয়াকে বেশ সন্দেহের চোখেই দেখত। কিন্তু সে এমন একটি মেয়ে যে জীবনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর আর বেদনাদায়ক একটা সময় অতিক্রম করে এসেছিল। তাই যখন কারও মনোযোগ আর ভালোবাসা পেল, তখন ঢলে পড়ল। কিন্তু এসব কথা কেই বা দাঁড়িয়ে শুনবে? কেই বা এর ব্যাখ্যা চাইবে? বাস্তবিকই জানকী রমণকে কেউ কিচ্ছুটি বলল না। সকলে রোশন আরার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    কুলটা, চরিত্রহীন! প্রথম বরকে ছেড়ে এসেছে। এমন সুন্দর মেয়েকে কোনও মরদ মারতে পারে নাকি? ভ্রষ্টা হয়ে গিয়েছিল বলেই তো মার খেয়েছে। আর তারপরে বর পাগল হয়ে গেছে বলে নালিশ ঠুকেছে। ধারেকাছে তো ঘেঁষতে দিত না। আর তাই বিয়ের তিন বছর হয়ে গেলেও একটা ইঁদুরও তো বিয়োতে পারেনি।...আর এখানে...এখানে পাণ্ডের সঙ্গে বিয়ে হতেই একটা ছেলে হয়ে গেল। কে জানে তখন থেকেই হয়ত পাণ্ডের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি চলছিল। (পাণ্ডে কেন দেবদূতেরাও তো তখন রোশনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত না। বেশ্যা! ধর্ম-অধর্মের কথাও ভাবে না!)

    এখন ব্রাহ্মণের ধর্ম নষ্ট করছে। সোজা নরকে যাবে। আর নরকেও জায়গা মিলবে না। তাকে কে জানে কী খাওয়াচ্ছে!

    তারপরে একদিন সারা দুনিয়ার লোকজনের এইসব কথা শুনে আর নিজের চিন্তার কথা ভেবে পাণ্ডের স্ত্রী তাকে বলল, ‘তুমি ওখানে খাওয়া-দাওয়া করে এসো। নিজের বাসনকোসন আলাদা করে নাও। এখানে আমাদের বাসনে কখনও খাওয়া চলবে না।'

    পাণ্ডে তার স্ত্রীর সঙ্গে সব সময়ই নরম ব্যবহার করে এসেছে। কে জানে কীভাবে সে অন্য সব বিষয়ে নিজের দিকটা বাঁচিয়ে চলেছিল অথবা স্ত্রীকে কোন্‌ চতুর পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার কথা শুরু হতেই সে গীতা বার করে নিয়ে এল। তার ওপরে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করল। আমি যখন ওখানে থাকি তখন একদম আলাদা বাসনে পৃথক উনুনে খানা পাকানো হয়। তিনি নিজেও ওই দিনগুলোতে মাছমাংস, পেঁয়াজ-রসুন খান না। শুদ্ধ সাত্ত্বিক খাওয়া দাওয়া হয়। ''তিনি' শুনে তো মির্জাপুরওয়ালির মাথায় আগুন জ্বলে উঠত। কিন্তু গীতার ওপর হাত রেখে শপথ নিতে থাকা পাণ্ডেকে দেখে এমনই নিরীহ গোবেচারা আর সত্যবাদী বলে মনে হত যে তার পর থেকে পাণ্ডের স্ত্রী কোনটা 'খাদ্য' আর কোনটাই বা 'অখাদ্য' তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা করা ছেড়ে দিল।

    খাওয়ার ব্যাপারে তো পাণ্ডে কসম খেয়েই রেখেছিল। কিন্তু সে দিন থেকে সে বড়ই যন্ত্রণায় ছিল। নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে এই প্রথম বার তাকে এমন শেষ পর্যন্ত যেতে হল। নিজেকে তখন তার উকিলের বদলে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। রামায়ণে সীতার অগ্নি পরীক্ষার কথা মনে পড়ল। সে অনেকক্ষণ বসে ভাবতে থাকল হালাল, হারাম, খাদ্য, অখাদ্য এসব তাহলে কী? কেউ মাংস খায়, কেউ খায় না। কেউ মাংস খেলেও আবার শুয়োর অথবা গরু খায় না। অথবা গাইয়ের মাংস খায় না। সবজির মধ্যেও আবার কোথাও কোথাও পেঁয়াজ-রসুন নিষিদ্ধ, যেমন পাণ্ডের নিজের বাড়িতেই। এদিকে দিদ্দার ছেলেরা ঘরেই পেঁয়াজের পকোড়া বানাতে শুরু করে দিয়েছে। দিদ্দার শ্বশুরবাড়িতে তার ভাসুরের দুই ছেলের মধ্যে এইসব খানাপিনা নিয়ে ঝগড়ায় উনুন আলাদা হয়ে গেছে। বহু বছরের যৌথ পরিবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। দিদ্দার ভাসুর হতাশ-বিষণ্ণ হয়ে থাকতেন। তাঁর এক ছেলে কে জানে কোন্‌ বদসঙ্গে পড়ে মাংস খাওয়া ধরেছিল। তার বিবি কোনও নেভাল অফিসারের মেয়ে, একদম দারুণ মডার্ন। সে তার স্বামীকে শাসন করার বদলে আরও সাহস জুগিয়ে চলেছিল। খানায় পেঁয়াজ রসুনের অতিরিক্ত ব্যবহার তো ছিলই। পরে লুকিয়ে চুরিয়ে হোটেল থেকেও খাবার আসতে থাকে। আরও পরে যখন বাধানিষেধ একটু শিথিল হল, তখন টিফিন কৌটোয় ভরে মুরগির মাংস আর বিরিয়ানি আনা শুরু হল। চতুর্বেদী ব্রাহ্মণের বাড়িতে এহেন অনাচার! রাম! রাম! দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া হল। বড় ছেলের চিন্তাভাবনা ছিল পুরোনো দিনের মত, বাপকে সে বড়ই ভালোবাসত। বাবা বেঁচে থাকতেই এই সব শুরু না হলে হয়ত ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না। বড় ভাই ছোটর উনুন আলাদা করে দিল। বড় দোতলা বাড়িটা দুই পরিবারের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। বাবা-মা বড় ছেলে আর তার বউয়ের সঙ্গে রইলেন। পৃথক রান্নাবান্না শুরু হওয়ার পর থেকেই আগে যেসব ছোটখাটো বিষয় অগ্রাহ্য করা হত, এখন সেগুলো নিয়েই লড়াই শুরু হল। একদিন তো মজা করতে করতেই ঝগড়া বেধে গেল। দেওর বড় বৌদিকে বলেছিল, ‘ভাবি, একবার মুরগির পা চিবিয়ে তো দেখো! মুর্গা তো দূর, তারপরে মানুষ খেতে শুরু করবে।’ বৌদি শুনে এমন চেঁচাল যে বাড়ির সবাই ছুটে এল। বাকবিতণ্ডা এমন গরম গরম হতে থাকল যে শেষ পর্যন্ত তা সম্পত্তি আর জমিতে গিয়ে পৌঁছোল। (সম্পত্তি ভাগের বিষয়টা আসলে অনেক দিন ধরেই বড় ভাইয়ের বউয়ের মনে ছিল। এবারে সে বেশ ভালো সুযোগ পেয়ে গেল।)

    মানুষ কতটাই না আহাম্মক হতে পারে! এভাবেই আরও কতদিন সে থাকবে?

    রোশন আরা একদিন বলছিল যে তার আম্মা শুয়োরের নাম পর্যন্ত নিতেন না! তিনি শুয়োরকে 'খারাপ' অথবা 'হারাম-মুখো' বলতেন। বলতেন শুয়োরের নাম উচ্চারণ করলেও ঘরে আশীর্বাদ বহন করে দেবদূতদের আগমন ঘটবে না।

    ‘আর বিবি রোশন আরা, তোমরা সেই মানুষ যারা মুরগি, গাই-গরু থেকে শুরু করে মোষ, এমনকী উট আর ঘোড়াও খেয়ে নাও। তাহলে একমাত্র শুয়োর নিয়ে এত হাঙ্গামা?’

    ‘আমি তো উট, ঘোড়া খাই না।' রোশন লজ্জা পায়। ‘আর বিফ খাওয়া তো তুমি ছাড়িয়ে দিয়েছ।'

    ‘কিন্তু উট-ঘোড়াকে তো অন্তত হালাল বলে ধরা হয়। আর তোমার সেই দূরসম্পর্কের আত্মীয় বদন মিয়াঁ...তিনি তো ছটা মেয়ের পর ছেলে হওয়ায় উট কুরবানি দিয়েছিলেন। তোমাদের এখানেও তো সেই মাংস পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বেটির জন্ম হলে উট তো কোন্‌ ছার, বকরিও কুরবানি দেওয়া হয় না।' পণ্ডিত আরও বলল, ‘আর তুমি বারবার বল ইসলামে নারীর স্থান অনেক ওপরে। কিন্তু ধর্ম আর সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সংঘাত কোথায় নেই...?'

    ‘আমি কখন খেলাম সে উটের মাংস?’

    ‘আরে, সেই একই কথা, মুরগির এক ঠ্যাং! ওই সব মাংস হালাল তো, না কি? তোমার ধর্মভাইরা তো ওসব খায়, তুমি খাও বা না খাও।’

    ‘মুরগির এক ঠ্যাং নিয়ে ঝগড়া তো তুমিই চালিয়ে যাচ্ছ। মনে হচ্ছে যেন রেকর্ডের ওপর সূচটা আটকে গেছে!’

    ‘সূচটা তো এই কারণে আটকে রয়েছে যে তোমরা বলনি শুয়োর নিয়ে কেন তোমাদের এত আপত্তি! মনে আছে একবার এমন প্রতিজ্ঞাও করেছিলে যে যদি কখনও আমার স্ত্রীর অধিকারে হস্তক্ষেপ কর, তা হলে শুয়োর খাবে।’

    ‘কারণ বোধহয় এই যে ওদের দেখতে এত নোংরা যে বমি আসে!'

    ‘সে তো আমারও লাগে। অন্যদেরও হয়ত লাগে। কিন্তু তোমাদের সাইকি-তে এই পরিমাণে নেতিবাচক ধারণা ওদের সম্পর্কে আছে কেন? ওদের থেকে এতটা দূরে সরে থাকা আহাম্মকের কাজ। ওরা হারাম হলে কুত্তা বা গাধাও তো হারাম! হয়ত কারণ এটা হতে পারে যে লোকে কুকুর বা গাধার মাংস খায় না। যেহেতু লোকে শুয়োর খায়, তাই সঙ্গে সঙ্গে এইসব ধারণা চলে আসে। থুঃ, থুঃ! কিন্তু নারাজ হলে শুয়োর খাওয়ার কথা তুলে গালি দাও কেন? ...গাধা খাওয়া, কুকুর খাওয়ার প্রসঙ্গ তোল কেন?'

    ‘এই যুক্তিটা নিয়ে আমি কখনও গভীরভাবে ভাবিনি। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি ভাবতে থাকো...' রোশন আরা আবার কটমট করে চাইল।...‘আরে পণ্ডিত, ঘরেই ফ্যাসাদ তৈরি করছ কেন? বাইরে তো অনেকই গণ্ডগোল তুমি বাধিয়ে রেখেছ।’

    পাণ্ডে খিলখিল করে হেসে উঠল।

    হালেই তো একটা ঝামেলা শুরু হতে হতে বেঁচে গেল। কোনও দুষ্টু লোক মসজিদে মাংসের পুঁটলি ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এবারে সেটা কীসের মাংস এই সত্য তো কোনও ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়ে উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যেহেতু মসজিদের ভেতরে ফেলা হয়েছে তাই লোকে ভেবে নিল এ নির্ঘাত শুয়োরের মাংস। ক্রুদ্ধ যুবকদের যুক্তি দিয়ে বোঝানো আর তারপরে তাদের শান্ত করার দায়িত্ব যারা নিল তাদের মধ্যে পাণ্ডে ছিল প্রথম সারিতে। সেই সময় সে রসুলপুরে রোশনের কাছে ছিল।

    ‘সংখ্যায় যারা বেশি তুমি তাদের সঙ্গে লড়াই করে পারবে না। তোমার কোনও সাধারণ ভুলত্রুটি তোমার জনগোষ্ঠীর বড়সড় লোকসানের কারণ হতে পারে। ধৈর্য ধরে কাজ করো আর সামান্য কথাকে উত্তেজনা বা প্ররোচনার কারণ হতে দিও না।' এটা কি একটা সামান্য কথা? কেউ কেউ ভ্রূকুটি করেছিল। ...ছোট ব্যাপার এই কারণে যে পুঁটলিটা তুলে যে কেউ বাইরে ফেলে দাও। বালতি ভরে ভরে মেঝেটা পরিষ্কার করে নাও! গল্প শেষ। যে তোমাদের প্ররোচিত করে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চাইছিল, তাকেই একেবারে লজ্জায় ফেলে দাও।... কিন্তু অনেক সময় লেগে গেল এটা বোঝাতে। পাণ্ডে নিজেই পুঁটলিটা তুলে আবর্জনার পাত্রে ফেলে এল। ইমাম সাহেবের হাত-পা ধরল। পরিস্থিতি যথেষ্ট গরম হয়েছিল, কিন্তু খোদার নাম নিয়ে বড় কোনও গণ্ডগোল রোখা গেল।

    (বড় গণ্ডগোল হতই বা কীভাবে? মুসলমানদের মধ্যে দম আছে নাকি? যদি কিছু বলে তা হলে তোমরাই মেরেপিটে ওদের ঠিক করে দেবে। কবরস্থানগুলোকে কব্জা করো আর কবরস্থানে পাঠানোর ধমক-ধামক দাও। ‘কিন্তু আমরা তো পাকিস্তানে যাব না বলেই ঠিক করেছি,’রোশনের মন্তব্য এল। সেই সময় বাবরি মসজিদের ঘটনাও খুব উত্তেজনা তৈরি করেছিল। রোশনের বাড়ির দেওয়ালেও কেউ সে ব্যাপারে লিখে গিয়েছিল: মুসলমানোঁ কো দো ইস্থান...পাকিস্তান ইয়া কবরস্থান’।)


    **********************************************


    রোশন এই সব শুনতে-শুনতে যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে চারপাশে যা ঘটছে সে সম্পর্কে তার কোনও হুঁশ নেই। (আর সত্যিই তা ছিল না।) তার লম্বা লম্বা চুল যা আগের রাতে পাণ্ডে নিজের হাতে খুলে নিজের কাঁধের ওপর বিছিয়ে রেখেছিল, সেগুলো তেমনই আলুথালু হয়ে আছে। এখন যেন কিছুটা জট বেঁধেও আছে। তার চোখের নিচে কালি। তার চোখদুটি এখনও উজ্জ্বল আর চমকদার। কেউ যেন তাদের মধ্যে বিস্ময় ভরে ভরে দিয়েছে। বিস্ময় সেই অজানা, অপ্রত্যাশিত ঘটনার কথা ভেবে...যে এসব কী ঘটছে! মন এসব মেনে নিতে পারছে না। মনের কোথাও যেন এই বিছেটাও কামড়াচ্ছে যে পাণ্ডে তার কাছে আসার পরেই কেন মৃত্যু এল? (সে যদি তার আসল জায়গায় থেকে মরত, তা হলে রোশনকে হয়ত এই দুঃখ ক্ষতবিক্ষত করত যে শেষ সময়ে সে পাণ্ডের মুখ দেখতে পেল না।) জানা নেই সেখানে লোকেরা কী ভাবছে।...পাণ্ডের দুই ছেলেই তো এখানে। এলাকার সব মানুষও তো জড়ো হয়েছে।

    পাণ্ডে খুবই জনপ্রিয় ছিল। রোশন বুঝতে পারছিল না যে মানুষকে কী বলবে, কীভাবে বলবে যে তার স্বামী মুসলমান নয়? তার ক্রিয়াকর্ম হিন্দুমতে হওয়া উচিত। (পুরো গ্রামটাই ছিল মুসলমান অধ্যুষিত। কেবল কয়েকটাই ব্রাহ্মণ আর রাজপুত পরিবার। গ্রামের শেষপ্রান্তে ছিল চামারদের ঝুপড়ি।) কিন্তু পাণ্ডেকে কি কোনও একটি শ্রেণিতে রাখা যায়? সেটা কোন্‌ শ্রেণি, কাদের শ্রেণি?

    অনেক দিন আগে একবার যখন পাণ্ডে রোশনের লম্বা, ঘন কালো চুলে বিলি কাটছে, রোশনের মাথাটা তার বুকের ওপর রেখে শরীর এলিয়ে দিয়েছে, তখন রোশন তাকে বলেছিল, ‘পণ্ডিত, তুমি এত বড় এক ভণ্ড! জুম্মাবারে মসজিদে গিয়ে নামাজও পড়ে এলে। সত্যি বলবে তুমি ঠিক কী পড়েছিলে – গায়ত্রী মন্ত্র নাকি হনুমান চালিসা?’

    পাণ্ডে শুনে হেসেছিল। ‘আমার সাতটা কলমাই মুখস্থ হয়ে গেছে – এমনকী আল হামদও। ব্যস, ওগুলোই উল্টেপাল্টে পড়ে নিই। আর অন্যদের দেখে দাঁড়িয়ে উঠি বা বসে পড়ি।‘ তারপরেই সে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘দুই মোল্লার মাঝে পড়ে মুরগিকে কখনও হারাম হতে দেখেছ, রোশন?’

    ‘কেন? হঠাৎ মুরগির কথা উঠল কেন পণ্ডিত? তাও আবার হালাল আর হারাম? খাবে নাকি?’

    ‘রোশন,’ পাণ্ডে তখনও গম্ভীর। ‘আমি সাদাসিধে হিন্দু ছিলাম। তোমার চক্করে পড়ে নকল মুসলমান বনেছি। তা হলে আমি আর আসল হিন্দুও রইলাম না। আমি একদম পাক্কা বিধর্মী হয়ে গেলাম। ওই কী যে বলে – নাস্তিক!’ রোশন এক ঝটকায় চুল সরিয়ে উঠে বসেছিল। ‘উল্টোপাল্টা কথা বোলো না। চলো, খাবার দিয়ে দিচ্ছি।’ রোশন কিচেনের দিকে এগোল। দেখল পণ্ডিত তার পেছন পেছন এসে গ্যাসের চুল্লিতে কনুইয়ের ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    ‘রোশন, এর আগে কখনও আমি খোদা বা ধর্ম নিয়ে এত ভাবার প্রয়োজন বুঝিনি। আমি শুধু জানতাম আমাদের পালনকর্তা কেউ আছেন। সন্ধ্যা আরতি করেই আমি তাঁর প্রতি কর্তব্য সারতাম। আশপাশে অন্য ধর্ম নিয়ে অনেক সমালোচনা শুনতাম। আমারও মনে হত আমার ধর্মই বুঝি শ্রেষ্ঠ। তারপরে দুনিয়াটাকে মন দিয়ে দেখলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে তোমার ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করলাম। আগে আমি শুধু উকিলই ছিলাম, রোশন। কানুন ছাড়া কিছুই আর জানতাম না। ধর্মে আগ্রহ হওয়ার পরে অনেক কিছু পড়লাম। হিস্ট্রি, সোশিওলজি, অ্যানথ্রোপলজি, ধর্ম। আর রোশন, এখন...এখন আমি প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন সব সীমারেখার ঊর্ধ্বে।'

    ‘শোনো পণ্ডিত,' রোশন চানার ডাল ভরা স্কোয়াশ কড়াই থেকে একটা সুন্দর কানা-উঁচু প্লেটে ঢালতে ঢালতে বলল, ‘আমার কোনও ঠাট্টা-ইয়ার্কিকে গুরুত্ব দিও না। খোদার নাম নিয়ে বলছি তোমার ধর্ম নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আমার কাছে তুমি শুধুই তুমি। এমন এক মানুষ যিনি আমাকে সম্পূর্ণ ভালোবাসা আর সুরক্ষা দিয়েছেন।'

    ‘জানি, রোশন। আর আমি তো শুধু রূপ দেখে তোমায় ভালোবাসিনি। তোমার বুদ্ধি, তোমার রসিকতাবোধ, তোমার গভীর বিচক্ষণতা আর মহানুভবতাকে ভালোবেসেছি। আমার স্ত্রীর মধ্যে আমি এই সব গুণই চেয়েছিলাম। সেখানে তা না পেয়েই তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু এখন আমি তোমাকে কিছু বলার মুডে আছি। আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করেছি যে বিশ্বজগৎ তার সব গোপন কথা আর রহস্য, জীবনের সব চড়াই উতরাই যেমন মৃত্যু, বার্ধক্য আর দুঃখ নিয়ে...সব যুগ, সব বর্ণ আর জাতির মানুষের মধ্যে এমন একটি সত্তার কল্পিত রূপ সৃষ্টি করে যিনি জগৎ নামক একটি জটিল ধাঁধাকে বশে রাখেন। এমন এক সত্তা যিনি বাপের মত স্নেহশীল, যিনি সব বিভেদ আর পার্থক্যের ঊর্ধ্বে। এমন এক সত্তা যাঁর কাছ থেকে আমরা সত্যের সমর্থন আর মিথ্যার প্রতিরোধ আশা করি। এমন এক সত্তা যিনি সদা জাগ্রত, যিনি সব জীবন্ত প্রাণীর ওপর নজর রাখছেন। এমন এক সত্তা যাঁর কাছে আমরা যা খুশি চাইতে পারি। সেই সত্তাকে খুশি রাখতে, তাঁর ক্রোধ থেকে বাঁচতে আমরা পাপ-পুণ্যের ধারণাগুলোকে তৈরি করেছি। প্রাথমিকভাবে তো সেই সবই পুণ্যকর্ম যাতে কারও কোনও উপকার হয় আর পাপ তাই যা কারও ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু রোশন, এই সব কিছু করতে গিয়ে আমরা ভুলে গেলাম যে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন চিন্তাভাবনার মানুষের মধ্যে ধ্যানধারণার এই পার্থক্য তো সত্যিই স্বাভাবিক...যদিও তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য একই। সকল ধর্মীয় ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত মানুষকে একই দিকে নিয়ে যায় – সেই সর্বশক্তিমান সত্তার কাছে যিনি জগতের স্রষ্টা, যিনি জন্ম আর মৃত্যুর নিয়ন্তা। অথচ আমরা শুধু সেই ব্যবস্থাকেই সঠিক মনে করি যা নিজেরাই তৈরি করে অনুসরণ করছি। আর সেই ব্যবস্থার বাইরে যারা, আমরা মনে করি তাদের সকলের গর্দান দেওয়া উচিত। পাপ আর পুণ্যের মধ্যে আমরা এমন শত শত শাখা তৈরি করেছি যার কোনও অর্থই নেই।’

    রোশন চালের থালাটা ট্রের ওপর রেখে দুঃখিত মুখে বলল, ‘এর মধ্যে এমন একটা পাপ আছে যা আমিও করেছি। অন্য ধর্মাবলম্বী এক মানুষকে বিয়ে করেছি। আমি জানি পণ্ডিত, তুমি কলমা শুধু এই জন্য পড়েছিলে যাতে আমাদের নিকাহ্‌ আইনসঙ্গত হয়।'

    ‘রোশন, কিন্তু আমিও তো কোনও এক খুদায় বিশ্বাস রাখি। আমার সনাতন ধর্মও তাই বলে। আমি তোমার পয়গম্বরকে অত্যন্ত সম্মান করি। তিনি একজন জবরদস্ত বৈপ্লবিক সংস্কারক ছিলেন। এমন ব্যক্তি দ্বিতীয় আর কেউ জন্মাননি যিনি দুনিয়ার এত মানুষের মন জয় করেছেন। যিনি নিজের সমাজে এমন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন।'

    ‘কিন্তু এরপরেও তো তুমি মুসলমান নও!'

    'আমি বলেছি না রোশন, আমি এখন হিন্দুও নই। আমি শুধুই একজন মানুষ। আমি পাখির কলতান, ফুলের খুশবুতে, উন্মুক্ত প্রান্তরের বিস্তারে, ছায়াপথে ছড়িয়ে থাকা তারায়, নদীর জলে, সূর্যের উদয় আর অস্ত যাওয়ার মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা দেখতে পাই। হয়ত আমাদের মুনিঋষিরা এই কারণেই সূর্যের পুজো শুরু করেছিলেন...নদী আর গাছপালাও পূজিত হত...এসবই তো খোদার ঈশ্বরিক ক্ষমতার প্রকাশ। আর রোশন, প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস আর ধর্ম মেনে চলার অধিকারকে আমি মর্যাদা দিই।...তাঁরা যেমন ভাবেই খোদার কাছে পৌঁছোতে চান না কেন। কিন্তু ধর্মের নামে যত দেওয়াল উঠেছে, যত জুলুম হয়, হয়ত আর কিছুর জন্যই তা হয় না। আমেরিকা আবিষ্কারের পর স্পেনীয়রা যখন সেখানে পৌঁছোল, তখন সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বারুদ আর জলবসন্ত ছাড়া এক নতুন ভগবানকেও উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল। ধরেই নেওয়া যায় যে সেই নতুন খোদার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে তাদের অসুবিধে হয়েছিল। যে পূর্বপুরুষদের তারা পূজনীয় বলে মনে করত, তাদের আত্মাকে ভুলে যাওয়া অথবা তাদের পবিত্র মোষেদের গণবলি হতে দেখেও দুঃখ না পাওয়ার চেষ্টা করতে তাদের সময় লেগেছিল। প্রাচীনকালে জার্মানরা ওক গাছকে পুজো করত। খ্রিস্টান মিশনারিরা সেই সব গাছ কেটে দেয়।'

    ‘আর রোশন, মাফ কোরো, কিন্তু তোমাদের মধ্যেও ধর্মের প্রচার আর প্রসারের কাজের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। আমার জ্ঞান অনুযায়ী যদিও শুধু তলোয়ারের জোরেই ইসলামের বিস্তার ঘটেনি, তবু বলতে হয় মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের দেশজয় ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পরাজিত জাতিগোষ্ঠী বিজয়ীদের ধর্ম গ্রহণ করে নিরাপদ থাকতে চেয়েছে। বিজয়ীদের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রভাব ধীরে ধীরে পরাজিতদের ওপর চেপে বসেছে।'

    ‘আর তোমরা বৌদ্ধদের মারতে মারতে তাড়িয়ে দিয়েছিলে, তাই না? তাদের মন্দিরগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলে। আর মহাত্মা বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার বানিয়ে খেয়ে ফেলা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মকে শেষ করে দেওয়ার সেটা ছিল একটা ভালো পন্থা।'

    রোশন যেন রেগে উঠেছে। কিন্তু তারপরেই আবার হাসতে হাসতে বলল, ‘কিন্তু আমি মুসলমান হলেও গৌতম বুদ্ধকে অত্যন্ত ভক্তি করি। অনেক ধর্মোপদেশ দিলাম। এবার চলো ঘাসখোর, খাবার দেওয়া হয়েছে।'

    'রোশন, তোমার মহাত্মা বুদ্ধ মূর্তিপূজা আর যাবতীয় আচার-বিচারের কঠোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাঁর শিষ্যরা সারা দুনিয়ায় তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে দিল। আর তারা সেই সব কিছুই করতে শুরু করল তিনি যার বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন। রোশন, কথা হল এটাই যে মানুষের একজন ঈশ্বর প্রয়োজন, আর তাঁকে এমন হতে হবে যাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। তোমাদের মূর্তিহীন খুদাকে পুজো করাও বেশ মুস্কিলের কাজ ভাই। এর জন্য যে গভীর বুদ্ধিবিবেচনার প্রয়োজন তা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোথায় পাওয়া যাবে? হ্যাঁ, হাতে ডাণ্ডা থাকলে মানুষের দেহ আর ধর্ম এই দুইয়ের ওপরই কর্তৃত্ব করার চিন্তা সকলেরই মাথায় আসে। মানুষের মধ্যে যে আহাম্মক শয়তান বাস করে তাকে বাগে আনো...দেখো, বামিয়ানের সেই ঐতিহ্যপূর্ণ বুদ্ধমূর্তিকে তোমার তালিবানরা ...'

    রোশন এবারে সত্যিই রেগে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। ‘তালিবানরা আমার কেন? এই কারণে কি যে তারাও আমার মত একই ধর্মাবলম্বী? আমার মাথা লজ্জায় নত হয়ে যাচ্ছে পণ্ডিত। আফগানিস্তান যারা জয় করেছিল তারা কেউ ওই মূর্তির কোনও ক্ষতি করেনি। এমনকী প্রতিমাভঙ্গকারী কালাপাহাড় বলে কুখ্যাত মামুদও না। এত উন্নতি হলেও মানুষ মানুষ হতে শেখেনি।' রোশনের কণ্ঠস্বরে রাগের সঙ্গে দুঃখও মিশে ছিল।

    ‘সব ধর্মই আসলে এক ছিল, কিন্তু সেই ধর্মের অনুসরণকারীরা তাকে অন্য কিছু তৈরি করে দিল। একটা কথা বলো, রোশন,' পাণ্ডে নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলল, 'আমি মরে গেলে আমার অন্ত্যেষ্টি কোন্‌ ধর্মের নিয়ম মেনে হবে? ভাই, আমার কিন্তু কবরের মধ্যে যেতে বড় ভয়। তোমাদের ওই দুই দেবদূত মুনকর নকরি কবরের মধ্যে এসে আমাকে পীড়ন করবে। তুমি আমার উল্টোপাল্টা কথা মেনে নাও। তারা তো তাদের গদা নিয়ে এসে মারতে শুরু করে দেবে দনাদ্‌দন...' রোশন হাসি চাপতে ঠোঁট কামড়ে অন্য দিকে চাইল। কিন্তু পাণ্ডের কাঁচির মত জিভ চলতেই থাকল।

    ‘আর রোশন...আমরা কবীর নই যে আমি মরলে আমার শরীরের জায়গায় ফুল ফুটবে যাতে সে ফুল তুমি আর আমার প্রথম স্ত্রী দুজনে আধাআধি ভাগ করে নিতে পার।' রোশন পাণ্ডেকে মন দিয়ে দেখল। হাসির রেখাটা তার মুখ থেকে মুছে গেছে। পাণ্ডে আবার হেসে ফেলল।...‘আচ্ছা রোশন, আরেকটা কথাও একবারটি বলো। এই সব অলৌকিক ঘটনা শুধু অতীতের মানুষদের নিয়েই কেন ঘটে? আগের মানুষ যাদের আমরা দেখিনি? আমাদের সঙ্গে কেন এমন ঘটে না? আজকে? এখন? তবে একটা ভালো ব্যাপার তো আছে! আমি মরলে দুবার পুণ্য হবে। পিণ্ডদান তো হবেই। তুমিও ফাতিহা পড়বে। যেমন তোমার আম্মা আর রজব আলি চাচার জন্য পড়েছ।' রোশন থালাটা সজোরে উল্টে দিল। ‘খাবার সামনে নিয়ে এই সব আজেবাজে কথা...'

    ‘রোশন, আমি তোমার চেয়ে বয়েসে অনেক বড় বলেই আমি যে তোমার আগে মরব তা তো প্রায় নিশ্চিত। ‘প্রায়' আমি এই কারণেই জুড়লাম যাতে তুমি আমাকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত না নাও। কিন্তু আমি জানি তুমি তা করবে না। তুমি আমাকে একলা ছেড়ে নিশ্চয়ই কোথাও যাবে না।' পাণ্ডে রোশনের লম্বা, মোলায়েম চুলের গোছা মুঠোর মধ্যে নিয়ে হালকা টান দিল। ‘আচ্ছা, সত্যি করে বলো যদি আমি আগে মরে যাই তাহলে তুমি কী করবে?'

    ‘কী আর করতে পারি?' রোশন অনেক কষ্টে চোখের জল সামলাল। ‘এখনও খোদার যা ইচ্ছে তাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছি, তখনও তাই দেব।’

    ‘তাঁর ইচ্ছেয় নিজেকে সঁপে দেব,' পাণ্ডে প্রতিটা শব্দের ওপর জোর দিয়ে আবার বলল। 'যেখানে রাম আমায় রাখবে, সেখানেই থাকব!'

    'রাম তিনিই...নৈতিক দিক থেকে উচ্চাসীন সেই সত্তা যাঁর ওপর আমাদের সব দায়িত্ব সঁপে দিয়ে আমরা মুক্ত থাকতে পারি। যাঁর জন্য আমরা ধৈর্য ধরে সব দুঃখ সইতে পারি। ইনি দশরথের পুত্র রাম নন। ইনি বেদে বর্ণিত ব্রহ্মা। কবীরের রাম তিনি, গান্ধীর রামও তিনি। আমরা যে ধর্মই গ্রহণ করি না কেন রোশন, লেবেল যাই লাগাও না কেন, আমরা তো সেই মানুষই থাকব। আর মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্বগুলো পালন করে যাব। আমি আমার অর্ধেক সম্পত্তি তোমার আর তোমার বেটাদের নামে লিখে দিয়েছি। বাকি অর্ধেক দিয়েছি তিন বেটিকে। বসত বাড়িটা দিয়েছি বিবির নামে।'

    ‘পণ্ডিত, আমার কিছুই চাই না। এখানে রসুলপুরে থাকার ঠিকানাটার ব্যবস্থা তো তুমি করেই দিয়েছ। ছেলে দুটো উচ্চশিক্ষা পেয়েছে। ওরা নিজেরা খুব ভালো উপার্জন করবে। এই শ্রেষ্ঠ সম্পদটা তুমি তাদের দিয়েছ। বাইরে রেখে প্রথম সারির ইস্কুল-কলেজে পড়িয়েছ। এত খবর করেছ। আবার কী দেবে? আমার মাথায় সব গুলিয়ে যায় যখন ভাবি যে মানুষ আসলে এত হীন আর স্বার্থপর! আমি নিজেও তো একটা স্বার্থপরের মত কাজ করেছি – বেচারি এক আওরতের স্বামীকে কব্জা করেছি!'

    ‘সে মহিলা তেমন বেচারি নয়, রোশন। তিনি আমার সম্পূর্ণ সহায়তা পেয়েছেন। সমাজ তাঁকে এমন অনেক কিছুই দিয়েছে যা আমি তোমাকে দিতে পারিনি। সমাজ থেকে বেরিয়ে এলে মানুষ ভীষণই নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তাঁর তুলনায় তোমার সঙ্গে অন্যায় বেশি করেছি। তোমাকে নির্বান্ধব, অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে মরে গিয়ে আমি সেই পাপ আরও বাড়াতে চাই না। আমার একান্ত ইচ্ছে তো এটাই যে মরলে যেন তোমার কাছেই মরতে পারি।' রোশন তার নরম আঙুলগুলো পাণ্ডের ঠোঁটের ওপর রাখল।

    কে.কে.মামা বেঁচে থাকলে বলতেন, ‘আরে, ওর জিভ তো সব সময় কালো। যা কিছু অহিতকর, ওর মুখ থেকে বেরোবে, সব সত্যি হয়ে যাবে।’ কিন্তু কে.কে. তো অনেক দিন হল মারা গেছেন। তাঁর সেই গল্প আর বৈঠক তো অতীতের ঘটনা হয়ে গেছে। সদা রহে নাম আল্লাহ্‌ কা – যার না আছে আদি না অন্ত। তিনি অখণ্ড আর অভেদ। যাঁর শুরু বা শেষ নেই, যিনি জন্ম আর মৃত্যুর নাগালের বাইরে। (আমরা মানুষরা তো শুধু মৃত্যুর নাগালের বাইরে থাকতে চাই, আর তাই মৃত্যুর পরে অন্য জগতের কল্পনা করে রাখি।)


    **********************************************


    দরজায় আওয়াজ ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল। জনতার হাতে লাঠি। কারও কারও লাঠির ওপর লোহার ধারালো বল্লম লাগানো। লাঠিধারী জনতা স্থানীয় মানুষ। এলাহাবাদ থেকে পাণ্ডের তিন জামাই, দুয়েকজন আত্মীয় আর দিদ্দার ভাসুরের পরিবারের লোকজন এসেছিল। দিদ্দার দুই ছেলে নিজেদের এই ঝামেলা থেকে আলাদা রেখেছিল। রোশনের দুই বেটা তাদের মায়ের নামে দেওয়া অশ্লীল গালিগালাজ শুনে দরজা খুলে নিরস্ত্র অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ভেতরের উঠোনে হাতে কোরানটা শক্ত করে ধরে রোশন থরথর করে কাঁপছিল।

    ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অতি দ্রুত ঘটে চলেছিল। রোশন যখন কিশোরী, তখন হঠাৎই একদিন কুস্তিগিরদের প্রতিযোগিতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেহারা নিয়েছিল। দোকানিরা ধড়াধ্বড় দোকানের শাটার নামাচ্ছিল। রোশনদের গলিতে পলায়মান জনতার পায়ের দুদ্দাড় আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। সেই সময় রোশনের দাদি এইভাবেই হাতে কোরান নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আর জোরে জোরে ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করছিলেন। তাদের চাকরানি মাথা ঢেকে মৌলা মুস্কিল কুশার কাছে সেই ভয়াবহ ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছিল।

    (হজরত ওসমান যখন শহীদ হন, তখন তিনি কোরান আবৃত্তি করছিলেন। রক্তের ছিটে আল্লাহ্‌র বাণীর ওপর পড়ে তাকে রঙিন করেছিল।) যা হবার ছিল, তা তো হবেই। ভবিতব্যকে কেউ ঠেকাতে পারে না। রোশনের ঠাকুর্দা সেদিন রাস্তায় খুন হন। তিনি ফসল তুলতে গাঁয়ে গিয়েছিলেন, আর সেদিনই তাঁর ফেরার কথা ছিল। শহরের ভেতরে কিছুই হয়নি।

    রোশন অস্থির হয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে তার ছেলেদের আগলে দাঁড়িয়েছিল।

    ‘এরা তোমাদের আত্মীয়। জানকী রমণ পাণ্ডের নিজের ছেলে।' রোশন চেঁচিয়ে বলেছিল।

    ‘প্রথমে তো এই কুলটাকেই মারা উচিত।' ভিড়ের মধ্যে থেকে কারও কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

    ‘তোমরা কাগজপত্র নিয়ে এসো। শান্তিতে আমাদের সঙ্গে বোসো। পণ্ডিত আমাদের নামে যে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন, আমরা তার ওপর থেকে আমাদের দাবি তুলে নিচ্ছি।' রোশনের খুব ভালোই মনে ছিল যে দিদ্দার ভাসুরের বাড়িতে মাংস খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল, তা সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারাতে গিয়েই শেষ হয়েছিল। ছেলেদের পেছনে ঠেলে দিয়ে রোশন এই কথাগুলোও চিৎকার করে বলেছিল।

    ঠিক সেই সময় মহামান্য ওঙ্কার নাথ মিশ্র কোনও আশঙ্কার ঘটনার পূর্বাভাস পেয়ে জিপে করে সেখানে পৌঁছেছিলেন। তাঁর বয়েস তখন সত্তরেরও বেশি। স্ত্রীবিয়োগের পরে প্রায় সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছিলেন। দুনিয়ার ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। মানুষের মেজাজ আর ধরনধারণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান তো ছিলই। জগত যে অনিত্য তাও তাঁর মনে গভীরভাবে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তিনি পাকা খবর পেয়েছিলেন যে পাণ্ডের তিন জামাই লোকলস্কর নিয়ে রসুলপুরের দিকে রওনা হয়ে গেছে। যেহেতু পাণ্ডে সেখানেই মরেছিল, তাই লোকেরা নিয়ম মেনে তার জানাজার নমাজ পড়ে কবরস্থানে তার দফনের ব্যবস্থা করেছিল। মরার আগেই পাণ্ডে যে তার সম্পত্তির অর্ধেক রোশন আর তার ছেলেদের নামে লিখে দিয়েছিল, এই কানাঘুষোও তিনি শুনেছিলেন। এদিকে ইলেকশন কাছে এসে গিয়েছিল। রসুলপুরে আই.এস.আই-এর এজেন্টদের ক্রিয়াকলাপের গুজবও কখনও সখনও তাঁর কানে এসেছিল। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ বিপজ্জনক। ওঙ্কার নাথ কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

    পাণ্ডের প্রথম স্ত্রী মাথা ঘোমটায় ঢেকে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ‘ভাই সাহেব, ছেলেদের আর তাদের মায়ের ওপর এই ঘটনার আঁচ যেন না লাগে দেখবেন। রোশন আরা কখনই তাঁকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেননি। আর ছেলেদের সঙ্গে তো তাঁর রক্তের সম্পর্ক, তাই না? ধর্ম অন্য হলেও রক্ত তো আর বদলে যায় না?' পাণ্ডের স্ত্রীর গলা ধরে এল। ‘জামাইরা আমার কোনও কথাই শুনল না।'

    ওঙ্কার নাথের শুকনো, ম্রিয়মাণ চোখও জলে ভিজে গেল। স্ত্রীবিয়োগের পরে এই প্রথম তিনি কাঁদতে চাইলেন। একটু থেমে বললেন, ‘ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো যাতে আমি সেখানে পৌঁছোনোর আগে কোনও অঘটন ঘটে না যায়।' তারপরে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর প্রয়াত স্ত্রী ভাইয়ের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। আর সেই যোগাযোগের কারণে তিনি রোশন আর তাঁর ছেলেদের স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ওঙ্কার নাথের ছেলেরা সেই সময় জানকী রমণের জামাইদের সমর্থন করেছিল। এটা সত্যি যে তাঁর ছেলেরা জামাইদের সঙ্গে যায়নি, কিন্তু তারা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেওনি। আর ওঙ্কার নাথের ভাইপোরা – তারা তো সেই জনতার সঙ্গে যোগও দিয়েছিল। ঠিক সেই সময় বোধহয় তাদের সব সম্পর্ক রক্ষা করার কথা মনে পড়েছিল।

    জানকী রমণের স্ত্রীর গায়ের রঙ ময়লা হলেও তাঁর হৃদয়টা সোনা-বাঁধানো। তাই বোধহয় তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর হয়ে গেল। ওঙ্কার নাথ ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। না হলে কী যে ঘটে যেত কে বলতে পারে? সব কিছুর শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়ে গেল। রোশন সম্পত্তি-জমির ওপর তার অধিকার ছেড়ে দেবে এই প্রতিজ্ঞা এবং আরও কিছু শর্তসাপেক্ষে জনতা পাণ্ডের লাশ কবর থেকে তুলে নিয়ে ফিরে এল।

    ওঙ্কার নাথের সঙ্গে রোশনের এই প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘ছোট বউ, ওঁদের অনুমতি দিয়ে দাও। তোমরা তো মাত্র তিনজন, কিন্তু গ্রামে অসংখ্য নিরীহ মানুষ আছে যাদের সঙ্গে এই জটিল সমস্যার কোনওই সম্পর্ক নেই। তারাও মারা পড়বে। পরিস্থিতি পরিবেশ খুব খারাপ। নিজেই বলে দাও যে আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে যান। এইভাবে বললে ব্যাপারটা শোভন হবে। সদ্ভাব বজায় থাকবে। যাদের মাথার ঠিক নেই, আমরা তাদের সকলের সঙ্গে লড়তে পারব না।'

    পণ্ডিতের মৃত শরীরটার এমন অমর্যাদা! লজ্জায় দুঃখে রোশন ওলটপালট খেতে থাকে। সে গ্রামের মানুষদের, ছেলেদের কত বলেছিল যে পণ্ডিতকে যেন এলাহাবাদে তার ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয় – কিন্তু লোকেরা মানল না।

    ‘ছোটো বউ, মরা মানুষের লাশ কোথাও পচবে বলে ফেলে রাখা যায় না – না ঘরে, না সড়কে। এটা সবাই জানে।' লোকেরা লাশ নিয়ে যাওয়ার পরে ওঙ্কার নাথ কিছুক্ষণ সেখানেই বসে রইলেন। ‘এখন ওকে পুড়িয়েই দাও বা কবরস্থ করো – সে তো দুনিয়া থেকে চলেই গেছে। পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে। মাটিতে মিশে গেছে, আকাশে মিলিয়ে গেছে, আগুনে খাক হয়ে গেছে, জলে আর হাওয়ায় মিশে গেছে। পুড়িয়ে দিলে যা হয়, দফন হলেও তাই হয়। তফাত শুধু এটুকুই যে কবর দিলে এই প্রক্রিয়াটির জন্য অনেক বেশি সময় লাগে। কিন্তু লোকেরা এই কথাটা বুঝবে না। মৃত্যুর পরে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়, তার সব আসলে জীবিত মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। আমি তো সাধারণ মানুষ। আমি আর কী বলব? কিন্তু মুনি-ঋষিরা তো শরীরকে আত্মার সেই আচ্ছাদন বলে অভিহিত করেছেন যার নিয়ত বদল হতে থাকে। আত্মা তো অজর, অমর। এটা যদি মানো তাহলে যে মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে তাকে তুলে আনার কোনও অর্থই হয় না, বেটা। কিন্তু আমরা কীই বা করতে পারি? ভগবান বোধহয় মূর্খদের বিশেষভাবে ভালোবাসেন। তাই হয়ত তিনি এত মূর্খকে পৃথিবীতে আনেন। ধৈর্য ধরো।'

    ছলছল চোখে ওঙ্কার নাথের দিকে মুখ তুলে দেখে রোশন বলে, 'ওঙ্কার ভাই সাহেব, ধরিত্রী আপনার মত দেবতুল্য মানুষদের জন্য এখনও টিকে আছে। ইতনি সি মেহেরবানি কিজিয়ে। আমাদের এলাহাবাদ নিয়ে চলুন। যেখানে পারবেন আমাদের রেখে দেবেন। আমাদের কয়েকজন আত্মীয়ও সেখানে আছেন, যদিও তাঁরা সকলেই আমার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। আমার নানা রজব আলি তো মরেই গেছেন। নানিও আর নেই।' রোশন আবার হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে।



    **********************************************


    শান্তিতে বয়ে চলা গঙ্গার ধারে চিতা ধু-ধু করে জ্বলছে। সন্ধ্যের অস্পষ্ট আঁধারে চিতার হলুদ আগুন লকলক করে উঠছে। আকাশে দুটো-একটা ছাড়া ছাড়া মেঘ ভেসে চলেছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে আসছে ঝিঁঝি পোকার গুঞ্জন। লোকেরা সব চলে গেছে। লকরির ফটফট, ব্যাঙ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক, ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ সত্ত্বেও ভয়-ধরানো নিস্তব্ধতা যেন অনন্ত, অশেষ, অবিচল। আশেপাশে আরও কয়েকটা চিতায় আরও মানুষের শরীর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

    নদী রে নদী, তুমি কত মনুষ্য শরীরকে এভাবে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে দেখেছ? দুই তীরে? এখান থেকে ওখান পর্যন্ত...যেখানে তোমার শুরু সেখান থেকে যেখানে তোমার শেষ সেই পর্যন্ত?

    এক সারি গাছের পেছন থেকে সে সামনে এগিয়ে এল। একদিকের জমি একটু উঁচু, যার পেছনে সারি দিয়ে গাছ। সেই উঁচু জমির ওপর এসে দাঁড়াল সেই লম্বা, শীর্ণ ফরসা রমণী। এখন যেন সে কাগজের মত সাদা। তার সুন্দর পাড়ের সাদা শাড়ির আঁচলটা হাওয়ায় ফড়ফড় করে উড়ছে। হঠাৎই মনে হল তার উপস্থিতি যেন পুরো পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

    এই পুরুষটি, যার শরীরকে আগুনে বিসর্জন দেওয়া হল, যার ঘন চুলগুলো আগুনে এক নিমেষে – শুধুই নিমেষের মধ্যে – পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল – যার (প্রবীণ বয়েস সত্ত্বেও) মজবুত মাথাটা কপাল ক্রিয়ার সময় লাঠির আঘাতে ভেঙে দেওয়া হল –এই মানুষটি ওই মহিলার কে? এই নারী শ্মশান ঘাটে এসেছিলেনই বা কেন – মেয়েদের তো এখানে আসার অনুমতি নেই? মহিলার পরিচয়ই বা কী? আর এই সব মানুষরাই বা কারা যারা কবরের কীট আর চিতার আগুনকে বিস্মৃত হয়ে প্রাণ দিতে আর প্রাণ নিতে তৈরি? কেন তারা নিজেদের আর তাদেরই মত অন্য মানুষদের মধ্যে ঘৃণার দেওয়াল তুলে রেখেছে?

    ‘কোনও কিছুই যেন তোমাকে ভুলিয়ে না দিতে পারে, রোশন আরা বেগম! আরেকটা জগতের কল্পনা আসলে চিরকাল বেঁচে থাকা আর মৃত্যুকে জয় করার জন্য মানুষের যে মনোবাঞ্ছা, তার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আত্মা যে অজর-অমর অথবা তাকে যে ধরা যায় না – এই সব আসলে জালিয়াতি। তোমার-আমার এই সম্পর্ক শুধু ততদিনের, যতদিন আমরা বেঁচে থাকব। এরপরেও যদি তোমার মনে চায়, তাহলে আমার নামেও ফাতিহা পড়ে নিও।' তারপরে সে দুষ্টুমির হাসি হেসেছিল। ‘কিন্তু তোমার ফাতিহা আমার কাছে পৌঁছবে তো, কারণ আমি তখন...'

    নিভতে থাকা চিতার ধোঁয়ার মত একটা অস্বস্তি রোশনের অবচেতনে কুণ্ডলী পাকাতে থাকে।

    ‘সব জন্নত, সব জাহান্নম আমি এই এক জীবনেই পেরিয়ে এলাম। এ সবই আমাদের তৈরি, আমাদের কাজকর্মেরই পরিণাম।'

    রোশন আরা তার কড়ে আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছল। ‘বিদায়, জানকী রমণ পাণ্ডে, তুমি এখন যাও – আর ফিরে এসো না। এ জগত এখনও তোমার জন্য তৈরি নয় – এখনও নয়।'


    টীকা:

    ১) ঈশ্বর যেন তোমায় দুধে স্নান করান আর অনেক সন্তান-সন্ততি দেন
    ২) পবিত্র কোরানের যে সুরায় আল্লাহ্‌র প্রশংসা বর্ণিত আছে: ‘সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে।'
    ৩) মুস্কিল আসান, যিনি বিপদ থেকে পরিত্রাণ করেন; চতুর্থ খলিফা হজরত আলিকে বলা হয়




    অলংকরণ (Artwork) : ময়ূখ সান্যাল
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments