আমি উঠে দাঁড়িয়ে নতুন আগন্তুকের সঙ্গে হাত মেলালাম। স্যান্ডোর যেমন অভ্যেস – আমাকে অঢেল প্রশংসায় ভরিয়ে দিল: ‘বাবু গোপীনাথ, তুমি হিন্দুস্থানের নাম্বার ওয়ান রাইটারের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছ। লিখবে যখন, তখন লোকেদের সব ধড়ন তখ্তা হয়ে যাবে। এমন এমন সব কুনটিনিউটলি বার করবে যে তবিয়ত সাফ হয়ে যাবে। কিছুদিন আগে আপনি কী যেন একটা চুটকি লিখেছিলেন, মান্টো সাব? মিস্ খুরশিদ গাড়ি কিনেছেন; সত্যিই, আল্লাহ্র কী কারসাজি? কী, বাবু গোপীনাথ? বলবেন না কি যে এটাই ঠিক অ্যান্টি কি প্যান্টি পো?
আব্দুল রহিম স্যান্ডোর কথা বলার ধরন ছিল একদমই আলাদা। কুনটিনিউটলি, ধড়ন তখতা আর অ্যান্টি কি প্যান্টি পো – নিজের তৈরি এই সব বাগ্ধারা সে কথা বলার সময় স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করত। আমার তারিফ শেষ হলে সে বাবু গোপীনাথের দিকে মন দিল। সেই ব্যক্তিকে তখন বেশ বিহ্বল বলে মনে হচ্ছিল। ‘আর ইনি হলেন গিয়ে বেচারা বাবু গোপীনাথ। লাহোর থেকে শেষ পর্যন্ত বোম্বে এসে পৌঁছেছে। সঙ্গে আবার এনেছে এক কাশ্মীরি কবুতরিকে!’
বাবু গোপীনাথ হাসল।
আব্দুল রহিম স্যান্ডোর বোধহয় মনে হল নতুন আগন্তুকের যে পরিচয় সে দিয়েছে তা যথেষ্ট নয়। বলল, ‘নাম্বার ওয়ান বেওয়াকুফ কেউ যদি থাকে তা হলে সে এই। লোকে একে তেল মেরে টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। আমি শুধু গল্প করে প্রতিদিন ওর কাছ থেকে দুপ্যাকেট পলসন বাটার হাসিল করি। ব্যস, মান্টো সাব, এটা বুঝে নিন যে খুব অ্যান্টিফালোজিস্টিন ধরনের আদমি। আজ সন্ধ্যেয় আপনি ওর ফ্ল্যাটে অবশ্যই যাবেন।’
খোদায় মালুম বাবু গোপীনাথ তখন কী ভাবছিল! ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই আসবেন মান্টো সাব।’ তারপরে ফের স্যান্ডোকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন স্যান্ডো, মান্টো সাব কি ... আপনি বুঝতেই পারছেন...পছন্দ করেন না?’
আব্দুল রহিম স্যান্ডো জোরে হেসে উঠল। ‘আজি, সব ধরনের মদই উনি খান। তা হলে মান্টো সাব, আজ শাম কো জ়রুর আইয়েগা! আমিও মদ খাওয়া শুরু করেছি – এই কারণে যে মুফতে মেলে!’
স্যান্ডো আমাকে ফ্ল্যাটের ঠিকানা লিখে দিল। আমি কথামত সন্ধ্যে ছটায় সেখানে পৌঁছে গেলাম। তিন কামরার সাফসুতরো ফ্ল্যাট। একদম নতুন ফার্নিচারে সাজানো। স্যান্ডো আর বাবু গোপীনাথ ছাড়া বসার ঘরে আরও দুজন পুরুষ ও দুই মহিলা ছিল যাদের সঙ্গে স্যান্ডো আমার পরিচয় করিয়ে দিল।
ওদের মধ্যে একজন ছিল ধুতিপরা গফ্ফার সাইঁ, পাঞ্জাবের ঠেট চাষা। গলায় মোটা মোটা পুঁতির মালা। স্যান্ডো তার সম্পর্কে বলল, ‘ইনি বাবু গোপীনাথের লিগ্যাল অ্যাডভাইসার। আমি যা বললাম আশা করি বুঝতে পেরেছেন। যার নাক দিয়ে জল পড়ে অথবা মুখ থেকে লালা ঝরে, তাকে পাঞ্জাবে খোদার কাছে পৌঁছে গেছে এমন দরবেশ বলে মনে করা হয়। একে দেখেও মনে হচ্ছে যে এ পৌঁছেছে অথবা পৌঁছোবে! এ লাহোর থেকে বাবু গোপীনাথের সঙ্গেই এসেছে কারণ সেখানে আর কোনও বেওয়াকুফকে পাওয়ার আশা বাবুর ছিল না। এখানে এসে এ বাবু সাহেবের সঙ্গে ‘ক্রেভেন এ’ সিগারেট আর স্কচ হুইস্কির পেগ পান করে বাবু গোপীনাথের কল্যাণ কামনা করছে...’
গফ্ফার সাইঁ এই পরিচয় শুনে হেসে ফেলল।
দ্বিতীয় জন গুলাম আলি। লম্বা, শক্তপোক্ত জোয়ান। ব্যায়াম কসরত করা চেহারা। মুখে বসন্তের দাগ। তার সম্পর্কে স্যান্ডো বলল, ‘এ হল আমার শাকরেদ। ওস্তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলেছে। লাহোরের এক নামকরা বাইজির কুমারী মেয়ে এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। একে ফাঁসানোর জন্য সেই মেয়ে বেশ বড়সড় কুনটিনিউটলি ফেঁদেছিল। কিন্তু এ বলল ডু অর ডাই, আমি আমার জায়গা থেকে নড়ব না। কোনও ধর্মীয় পীঠস্থানে এর সঙ্গে বাবু গোপীনাথের দেখা হয়। ব্যস, সেই দিন থেকে ওর সঙ্গে আঠার মত লেগে রয়েছে। প্রতিদিনই ‘ক্রেভেন এ’-র ডিবে আর খানাপিনা মিলছে।’
এই বর্ণনা শুনে গুলাম আলিও হেসে ফেলল।
গোলমুখো ফর্সা গোলাপি চেহারার এক মহিলাও সেখানে ছিল। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে সেই কাশ্মীরি কবুতরি – অফিসে স্যান্ডো যার কথা বলেছিল। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মহিলা। চুল ছোট। মনে হচ্ছিল চুল যেন কাটা হয়েছে – কিন্তু আসলে তা নয়। চোখ দুটি পরিষ্কার আর উজ্জ্বল। মুখটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় যে খুবই কাঁচা আর অনভিজ্ঞ। স্যান্ডো তার পরিচয় দিয়ে বলল, ‘ইনি জ়িনাত বেগম। বাবু সাহেব ভালোবেসে জিনু বলেন। এই আপেলটিকে বেশ এক জবরদস্ত ম্যাডাম কাশ্মীর থেকে পেড়ে লাহোরে নিয়ে এসেছিল। বাবু গোপীনাথ তার নিজের সিআইডি-দের কাছ থেকে এর খবর পায় এবং এক রাতে একে সঙ্গে করে উড়িয়ে নিয়ে আসে। নানা রকম আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছিল। দুমাস ধরে পুলিশ বেশ মজা লুটল। শেষ পর্যন্ত বাবু সাহেব মোকদ্দমার খরচ মিটিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।... ধড়ন তখতা!’
আর বাকি রইল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সেই আওরত যে চুপ করে বসে সিগারেটে টান দিচ্ছিল। তার লাল চোখদুটিতে যেন বেপরোয়া বেহায়াপনার আভাস। বাবু গোপীনাথ তার দিকে ইশারা করে স্যান্ডোকে বলল, ‘ওর সম্পর্কেও একটু হয়ে যাক!’
স্যান্ডো সেই মহিলার ঊরুতে চাপড় মেরে বলল, ‘জনাব, এ হল টিন পোটি ফুল ফুটি। মিসেস্ আব্দুল রহিম স্যান্ডো ওরফে সরদার বেগম। ...এরও জন্ম লাহোরে। সন ছত্রিশে আমার সঙ্গে প্রেম হয়। দুবছরের মধ্যে আমার হাল ধড়ন তখতা করে ছেড়ে দিল। আমি লাহোর ছেড়ে পালালাম। বাবু গোপীনাথ ওকে এখানে ডেকে নিল যাতে আমার মন এখানে থিতু হয়। এও রেশন হিসেবে ‘ক্রেভেন এ’-র একটা টিন পায়। প্রতিদিন আড়াইটের সময় মরফিনের একটা ইঞ্জেকশন নেয়। এর রঙ কালো। হলে হবে কী এ খুব টিট ফর ট্যাট ধরনের মেয়েছেলে!’
সরদার এই সব শুনে শুধু এইটুকু বলল, ‘বকোয়াস্ না কর!' বলার ঢঙের মধ্যে বেশ পেশাদার মেয়ের ভঙ্গি!
সবার সঙ্গে পরিচয় করানোর পরে স্যান্ডো তার অভ্যেসমত আমার বর্ণনা দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করল। আমি বললাম, ‘ছোড়ো ইয়ার! আও কুছ বাতেঁ করেঁ।'
স্যান্ডো চেঁচিয়ে উঠল: বয়! হুইস্কি অ্যান্ড সোডা! ...বাবু গোপীনাথ, একটা সবুজ লাগিয়ে দাও!'
বাবু গোপীনাথ পকেটে হাত দিয়ে এক শো টাকার এক বান্ডিল নোট বার করে তার থেকে একটা নোট স্যান্ডোকে দিল। স্যান্ডো নোটটা নিয়ে সেটার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে চটপট বলল, 'ওহ্ গড! ও মেরে রব্বুল আলআমিন১! সে দিন কবে আসবে যখন আমিও জিভে আঙুল ঠেকিয়ে এইভাবে নোট গুনতে পারব? যাও ভাই গুলাম আলি, জনি ওয়াকার স্টিল-গোয়িং-স্ট্রং এর দুটো বোতল নিয়ে এসো!’
বোতল এলে সকলেই পান শুরু করল। দু-তিন ঘণ্টা ধরে মদ্যপান চলল। এর মধ্যে অভ্যেসমত সবচেয়ে বেশি কথা বলল আব্দুল রহিম। প্রথম গ্লাসটা এক টানেই সাবড়ে দিয়ে সে চেঁচাল: ‘ধড়ন তখতা, মান্টো সাব! হুইস্কি হো তো এয়সি! গলা থেকে নেমে পেটে গিয়ে “ইনকিলাব জ়িন্দাবাদ” লিখে দেয়। জিও বাবু গোপীনাথ, জিও!’
বেচারা বাবু গোপীনাথ চুপ করে রইল। সে মাঝে মধ্যে অবশ্য স্যান্ডোর ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ দিচ্ছিল। আমি ভাবলাম এই লোকটার নিজের কোনও মতামত নেই! অন্যরা যাই বলে তাই মেনে নেয়। সে যে কত সহজে বিশ্বাস করে নেয় তার প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত গফ্ফার সাইঁ, যাকে স্যান্ডোর বক্তব্য অনুসারে বাবু তার লিগ্যাল অ্যাডভাইসার করে নিয়ে এসেছিল। স্যান্ডো আসলে বলতে চেয়েছিল যে বাবু গোপীনাথ তাকে বিশ্বাস করত। তাদের কথাবার্তা শুনতে-শুনতে আমার এটাও মনে হল যে লাহোরে বাবু গোপীনাথ ফকির আর দরবেশদের সান্নিধ্যেই কাটাত। বিশেষ করে এই বিষয়টা আমার নজরে পড়েছিল যে বাবু গোপীনাথ অন্যমনস্ক থাকে – যেন কিছু একটা ভাবছে। তাই আমি তাকে একবার বললাম, ‘বাবু গোপীনাথ, আপনি কী ভাবছেন?’
সে চমকে উঠল: ‘জি... ম্যাঁয়... ম্যাঁয়... কুছ নহিঁ!’ তারপরে হেসে জ়িনাতের দিকে প্রেমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল: ‘এই সব সুন্দরীদের কথা ভাবছিলাম – এ ছাড়া আমার আর কী ভাববার থাকবে?’
স্যান্ডো বলল, ‘এ খুব ফালতু লোক, মান্টো সাব – বড় গণ্ডগোলের লোক। লাহোরে এমন কোনও বেশ্যা নেই যার সঙ্গে বাবু সাহেবের কুনটিনিউটলি ছিল না।’
বাবু গোপীনাথ এটা শুনে অপ্রস্তুত হল। বিনীতভাবে বলল, ‘এখন আর কোমরে সে জোর নেই, মান্টো সাব।’
এরপরে আজেবাজে গল্পগুজব শুরু হয়ে গেল। লাহোরের সব ঘরানার গণিকাদের গুনতি করা হল। কে ছিল গণিকাশ্রেষ্ঠা, কে নটিনী, কে কার অল্পবয়সী বারাঙ্গনা, কুমারীত্ব হরণ করার সময় বাবু গোপীনাথ কাকে কত দিয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব খোশগল্প সরদার, স্যান্ডো, গফ্ফার সাইঁ আর গুলাম আলির মধ্যে হয়ে চলেছিল – লাহোরের গণিকাপল্লির ঠেট ভাষায়। কথার মানে বুঝলেও কোনও কোনও শব্দের অর্থ আমার বোধগম্য হয়নি।
জ়িনাত একেবারে চুপ করে বসেছিল। কখনও সখনও হয়ত কোনও কথা শুনে হাসছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে তার এই কথাবার্তায় কোনও আগ্রহ নেই। সে এক গ্লাস জলমেশানো হুইস্কিও খায়নি। সিগারেট খেলেও মনে হচ্ছিল যে সে তামাক বা তার ধোঁয়া কোনওটাই পছন্দ করছে না। তবে মজার ব্যাপার হল সবচেয়ে বেশি সিগারেট সেই খেয়েছিল। কোনও কথা থেকে আমি তেমন ইঙ্গিত পাইনি যে বাবু গোপীনাথের সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে বাবু গোপীনাথ তার বেশ খেয়াল রাখে। জ়িনাতের যাতে অসুবিধে না হয়, তার জন্য সব কিছুর ব্যবস্থা ছিল। তবে আমার মনে হয়েছিল যে এই দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত টেনশন কাজ করছে। আমি বলতে চাইছি যে তারা দুজন পরস্পরের কাছাকাছি আসার বদলে যেন একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।
আটটার কাছাকাছি সরদার ডাক্তার মজিদের কাছে মরফিনের ইঞ্জেকশন নিতে চলে গেল। গফ্ফার সাইঁ তিন পেগ গেলার পরে তার মাদুলিটা তুলে নিয়ে কার্পেটের ওপরই শুয়ে পড়ল। গুলাম আলিকে হোটেল থেকে খানা আনার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল। স্যান্ডো তখন তার দিলচস্প বকোয়াস্ কিছুক্ষণের জন্য থামিয়েছে। বাবু গোপীনাথ মদের ঘোরে জ়িনাতের দিকে প্রেমিকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মান্টো সাব, আমার জ়িনাতকে আপনার কেমন লাগল?’
আমি ভাবলাম এই প্রশ্নের কী উত্তর দিই! জ়িনাতের দিকে তাকাতেই সে লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিল। আমি আর কিছু না ভেবেই বলে দিলাম: ‘খুব ভালোই তো লাগল।’
বাবু গোপীনাথ খুশি হল: ‘মান্টো সাব, সত্যিই বড় ভালো মেয়ে। খোদার কসম, না আছে গয়নাগাটির শখ, না অন্য কিছুর। আমি কতবার বলেছি জানেমন একটা মকান বানিয়ে দি? উত্তরে কি বলেছে জানেন? বাড়ি নিয়ে আমি কী করব? আমার কে আছে? মান্টো সাব, মোটর গাড়ি কততে পাওয়া যাবে?’
বললাম, ‘আমার কোনও ধারণা নেই।’
বাবু গোপীনাথ তাজ্জব হল: ‘আপনি যে কী বলেন, মান্টো সাব! আপনার... আপনি মোটর কারের দাম জানেন না? কাল চলুন আমার সঙ্গে, জিনুর জন্য একটা মোটর নিয়ে আসব। আমি এখন বুঝেছি, বোম্বেতে মোটর গাড়ি থাকতেই হবে।' জ়িনাতের মুখ দেখে মনে হল না এই কথার কোনও প্রভাব তার ওপর পড়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবু গোপীনাথের নেশা খুব চড়ে গেল। সে আরও আবেগপ্রবণ হয়ে বলল: ‘মান্টো সাব, আপনি একজন পণ্ডিত মানুষ। আপনার পাশে আমি তো একটা গাধা। ...তবে আপনি আমাকে বলুন যে আমি আপনার কী সেবা করতে পারি? কাল কথায় কথায় স্যান্ডো আপনার প্রসঙ্গ তুলেছিল। আমি তখনই ট্যাক্সি ডেকে তাকে বললাম, আমাকে মান্টো সাহেবের কাছে নিয়ে চলো। আমার কোনও গুস্তাখি হয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন। আমি অনেক পাপ করেছি... আপনার জন্য আরও হুইস্কি আনাব?’
আমি বললাম, ‘না, না, অনেক খেয়ে ফেলেছি।’
সে আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল: ‘আরও খান, মান্টো সাব! বলে পকেট থেকে এক শোর নোটের বান্ডিলটা বার করে তার থেকে একটা নোট যখনই আলাদা করতে শুরু করেছে, আমি পুরো নোটের বান্ডিলটা তার হাত থেকে নিয়ে তারই পকেটে আবার গুঁজে দিলাম। ‘এক শো টাকার একটা নোট আপনি গুলাম আলিকে দিয়েছিলেন। সেটার কী হল?’
আসলে আমার তখন মানুষটার জন্য করুণা হচ্ছিল। কত লোক এই বেচারার সঙ্গে ছিনে জোঁকের মত লেগে আছে। মনে হচ্ছিল বাবু গোপীনাথ সত্যিই একটা গাধা। কিন্তু সে আমার ইশারা বুঝে ফেলে হেসে বলল, ‘মান্টো সাব, ওই নোটটা ভাঙিয়ে যদি কিছু বাকি থাকে, তা হলে তা হয় গুলামের পকেট থেকে পড়ে যাবে নতুবা... ’
বাবু গোপীনাথের কথাটা তখনও পুরো শেষ হয়নি। গুলাম আলি ঘরে ঢুকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল হোটেলে কোনও এক হারামজাদা তার পকেট থেকে সব টাকা বার করে নিয়েছে। বাবু গোপীনাথ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। আরেকটা এক শো টাকার নোট পকেট থেকে বার করে গুলাম আলিকে দিয়ে বলল, ‘জলদি খানা লে আও!’
পাঁচ-ছবার দেখাসাক্ষাতের পর বাবু গোপীনাথ ব্যক্তিটি সম্পর্কে আমার একটা সঠিক ধারণা হল। কাউকে সম্পূর্ণ জানা তো কোনওভাবেই সম্ভব হয় না। কিন্তু আমি তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানলাম যা আগ্রহ জাগাবে। প্রথমেই বলতে হয় সে একজন প্রথম শ্রেণির আকাট বলে আমি যে ধারণা করেছিলাম, তা ভুল। সে খুব ভালোই জানত যে স্যান্ডো, গুলাম আলি আর সরদার ইত্যাদি যারা তার মোসাহেব হয়ে আছে, তারা সবাই আসলে ধান্দাবাজ, সুযোগসন্ধানী লোক। সে তাদের বকুনি, গালিগালাজ সব শুনলেও রাগ প্রকাশ করত না। বরং আমাকে বলেছিল, ‘মান্টো সাব! আমি আজ পর্যন্ত কারও পরামর্শ অগ্রাহ্য করিনি। যখনই কেউ আমাকে কোনও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানায়, তখনই আমি বলি “সুভানাল্লাহ্” – তথাস্তু! ওরা আমাকে বেকুব ভাবে। কিন্তু আমি ওদের বুদ্ধিমান বলে মনে করি এই কারণে যে ওদের মধ্যে কমসে কম এটুকু বুদ্ধি তো ছিল যাতে তারা বুঝেছে যে আমি নির্বোধ? আর তাই তো সুযোগটা নিতে পারছে? আসল কথা হল এই যে আমি শুরু থেকেই ফকির আর কনজরদের২ সঙ্গেই ছিলাম। আমি তাদের কিছুটা ভালোবেসেও ফেলেছিলাম। ওদের ছাড়া থাকতে পারি না। ভেবে রেখেছি আমার ধনসম্পদ একেবারে শেষ হয়ে গেলে কোনও ধর্মীয় পীঠস্থানে গিয়ে থাকব। বেশ্যাদের কুঠি আর পিরের মাজার – ব্যস, এই দুটো জায়গাতেই আমার মন শান্তি পায়। রান্ডিদের কোঠাবাড়ি তো থাকবে না, কারণ আমার পকেট খালি হয়ে আসছে। কিন্তু হিন্দুস্থানে হাজার হাজার পির আছেন। কোনও একজনের মাজারে চলে যাব।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বেশ্যাবাড়ি আর ধর্মস্থান কেন আপনার পছন্দ?’
সে একটু ভেবে বলল, ‘আসলে ওই দুটো জায়গায় ফরাশ থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত শুধুই ধোঁকাবাজি! যে আদমি নিজেকে ধোঁকা দিতে চায়... তার পক্ষে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কোথায়?’
আমি আবার শুধোলাম: ‘আচ্ছা, আপনি তো বাইজির গান শুনতে পছন্দ করেন। আপনি কি সঙ্গীতের সমঝদার?’
সে বলল, ‘বিলকুল না! আর তেমনটাই ভালো, কারণ একদম সুরকানা বাইজির কাছে গিয়েও আমি মাথা নাড়িয়ে বাহবা দিতে পারি। মান্টো সাব, আমার গানবাজনায় কোনওই আগ্রহ নেই। কিন্তু পকেট থেকে দশ বা এক শো টাকার নোট বার করে গানেওয়ালিকে দেখাতে ভারি মজা পাই। নোট বার করে দেখালাম। সে সেটা নেওয়ার আনন্দে উঠে পড়ল। যখন কাছে এল তখন নোটটা আমার মোজার মধ্যে গুঁজে দিলাম। সে মাথা ঝুঁকিয়ে টাকাটা বার করতেই আমি খুশি হয়ে গেলাম। এমন অনেক ফাজলামির ব্যাপার আছে যা আমার মত যারা তামাশা ভালোবাসে তাদের পছন্দ হয়। তা না হলে কে না জানে যে মা-বাপ যেমন সন্তানকে বেশ্যাদের কুঠিতে বেশ্যাবৃত্তি করতে পাঠায় – মকবরা আর মাজারে মানুষ তেমনই তাদের খোদাকে পাঠায় সেই একই কাজ করার জন্য!’
বাবু গোপীনাথের পিতৃপুরুষ বা পারিবারিক পরিচয় সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা ছিল না। তবে এটুকু মালুম হয়েছিল যে সে বড়ই কঞ্জুস এক ব্যবসায়ীর বেটা ছিল। বাপ মারা যাবার পর দশ লাখ টাকার সম্পত্তি পেয়ে নিজের ইচ্ছেমত ওড়াচ্ছিল। বোম্বাই আসার সময় সঙ্গে করে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনেছিল। সে জমানায় সব জিনিসপত্রই সস্তা ছিল। তা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিদিনই এক শো – সওয়া শো টাকা খরচ হয়ে যেত।
জিনুর জন্য সে ফিয়াট মোটর কিনল। ঠিক মনে নেই, তবে বোধহয় তিন হাজার টাকায় মিলেছিল। একটা ড্রাইভার রাখা হলেও সেও গুণ্ডা প্রকৃতির ছিল। বাবু গোপীনাথের ওই ধরনের লোকই পছন্দ ছিল।
আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ঘন ঘন হতে থাকল। বাবু গোপীনাথ সম্পর্কে আমার তো শুধু আগ্রহই ছিল। কিন্তু সে আমাকে অত্যন্ত ভক্তি করতে শুরু করল। এই কারণে অন্যদের তুলনায় আমার প্রতি সে অধিক সৌজন্য আর সম্মান প্রদর্শন করত।
এমনই একদিন সন্ধ্যের কাছাকাছি তার ফ্ল্যাটে গিয়ে সেখানে শফিককে দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। মহম্মদ শফিক টুসি – এই পুরো নামটা বললে আপনারা বুঝতে পারবেন আমি কার কথা বলতে চাইছি। শফিক এমনিতেই তো খুব বিখ্যাত একজন লোক। কিছুটা তার নতুন শৈলীর গায়কীর জন্য – আর কিছুটা সরস বাকচাতুর্যের জন্য। কিন্তু তার জীবনের একটা দিক সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল ছিল না। খুব অল্প লোকই জানে যে একের পর এক তিন বোনের সঙ্গে তিন-চার সালের সম্পর্ক করার আগে সেই বোনেদের মাও তার রক্ষিতা ছিল। আর একটা অজানা বিষয় এই যে সে তার প্রথম বিবিকে – যিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা গিয়েছিলেন – বিশেষ পছন্দ করত না এই কারণে যে পেশাদার গণিকাদের মত ছেনালিপনা আর ছলাকলায় তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। তবে শফিক টুসির খবর যারা অল্পস্বল্পও রাখত, তাদের এটা জানা ছিল যে চল্লিশ বছর (সেকালের গড় আয়ু) বয়সেই শত শত বারাঙ্গনার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। দারুণ সব জামাকাপড় সে পরত। অতি সুস্বাদু খাবার খেত। শ্রেষ্ঠ সব মোটরগাড়ির সে মালিক ছিল। কিন্তু কখনও কোনও গণিকার জন্য নিজের একটা পয়সাও খরচ করেনি।
বিশেষত পেশাদার আওরতরা শফিকের ইতর রসিকতা – যাতে গানেওয়ালি মেয়েছেলেদের ঝলক দেখা যেত – অত্যন্ত পছন্দ করত। তাদের নিজের দিকে টানতে শফিককে কোনও চেষ্টাই করতে হত না।
তাকে জ়িনাতের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবিনি যে সে এরকম করছে কেন। আমি খালি এটাই ভেবেছিলাম যে শফিক হঠাৎ কীভাবে সেখানে পৌঁছে গেল। এই স্যান্ডোই তাকে চিনত, কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা তো বেশ কিছুদিন ধরেই বন্ধ। পরে আমি বুঝলাম যে স্যান্ডোই তাকে এনেছে। আবার দুজনের বোঝাপড়া হয়ে গেছে।
বাবু গোপীনাথ একদিকে বসে হুঁকোয় টান মারছিল। আমি বোধহয় এটা আগে বলিনি যে সে কিন্তু সিগারেট খেতই না। মহম্মদ শফিক টুসি গানেওয়ালা মেয়েদের সম্পর্কে তার ইতর রসিকতাগুলো শোনাচ্ছিল। জ়িনাত কিছুটা কম হলেও সরদার সেই সব কথায় অত্যন্ত আগ্রহ দেখাচ্ছিল। শফিক আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘ও-বিসমিল্লাহ... বিসমিল্লাহ...আরে...আপনারও এ গলিতে যাতায়াত আছে দেখছি!'
স্যান্ডো বলল, ‘আসুন, আসুন....ইজ়রায়েল সাব৩ , ধড়ন তখতা!' স্যান্ডো কী বলতে চাইছে আমি আন্দাজ করতে পারলাম।
কিছুক্ষণ এইভাবেই গল্পসল্প চলল। আমি লক্ষ করলাম যে জ়িনাত আর মহম্মদ শফিক টুসি পরস্পরের চাহনির মাধ্যমে যেন কিছু বলতে চাইছে। জ়িনাত এই শিল্পে বিলকুল নভিস হলেও শফিকের নিখুঁত দক্ষতা সব অভাব পূরণ করে দিচ্ছিল। আর সরদার তাদের দুজনের চাহনির আদানপ্রদানকে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল যেন কুস্তির আখড়ার বাইরে বসে গুরু তার শিষ্যদের কুস্তির প্যাঁচ দেখছে।
এর মধ্যে আমার সঙ্গে জ়িনাতের সম্পর্কও বেশ ঘরোয়া হয়ে উঠেছিল। সে আমাকে ভাই বলত যাতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। সে বেশ মিশুকে মেয়ে ছিল -- চুপচাপ, সাদাসিধে, সাফসুতরো।
শফিকের সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময়ের ধরনটা আমি পছন্দ করিনি। প্রথমত তো ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর, তাছাড়াও...বলা যাক সে যে আমাকে 'ভাই' বলে ডাকত তার প্রভাবও হয়ত ছিল। শফিক আর স্যান্ডো উঠে বাইরে গেলে আমি বোধহয় বেশ একটু রূঢ়ভাবেই জ়িনাতকে শফিকের দিকে ওইভাবে চাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা ঝরতে লাগল। আর সে কাঁদতে কাঁদতে অন্য ঘরে চলে গেল। বাবু গোপীনাথ – যে ঘরের এক কোণে বসে হুঁকোয় টান দিচ্ছিল – দ্রুত উঠে তার পেছন পেছন গেল। সরদার তাকে চোখে চোখে কিছু বলেছিল যা আমি বুঝতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরে বাবু গোপীনাথ ঘরের বাইরে গিয়ে ‘আইয়ে মান্টো সাব' বলে আমাকে ডেকে তার সঙ্গে ভেতরে নিয়ে গেল।
জ়িনাত খাটের ওপর বসে ছিল। আমি ভেতরে ঢুকতেই সে দুহাতে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ল। আমি আর বাবু গোপীনাথ পালঙ্কের দুধারে দুটো চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বাবু গোপীনাথ গম্ভীরভাবে বলতে শুরু করল: ‘মান্টো সাব! আমি এই মহিলাকে খুব ভালোবাসি। দুবছর ধরে এ আমার কাছে আছে। আমি হজরত ঘাউস-এ-আজ়ম জিলানির কসম খেয়ে বলছি যে এ কখনও আমাকে কোনও নালিশ করার সুযোগ দেয়নি। এর অন্য বোনেরা – আমি বলতে চাইছি যে এই পেশার অন্য মেয়েরা, দুহাতে আমাকে লুঠ করে খেয়েছে। কিন্তু এ কখনও একটা অতিরিক্ত পয়সাও আমার কাছ থেকে নেয়নি। একবার যখন অন্য এক আওরতের কাছে বেশ কয়েক হপ্তা পড়ে ছিলাম, তখন এ বেচারা তার কোনও গয়না বাঁধা রেখে নিজের খরচ চালিয়েছে। আপনাকে যেমন একবার বলেছি, আমি খুব জলদি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। আমার ধনদৌলত আর মাত্র কয়েকটা দিনেরই অতিথি! আমি এর জীবনটা খারাপ করতে আর চাই না। লাহোরে একে অনেক বুঝিয়েছিলাম যে তুমি অন্য বাইজিদের দেখো -- তারা যা করে তা শেখো। আজকে আমার সম্পত্তি আছে। কালকে আমাকে ভিখিরি হতেই হবে। তোমাদের যে জীবন তাতে একজন ধনী লোকের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। আমার পরে তুমি যদি আর কাউকে না ধরতে পার, তাহলে তোমার জীবন চলবেই না। কিন্তু মান্টো সাব, সে আমার একটা কথাও শুনল না। সারাদিন ভদ্র মহিলাদের মত ঘরে বসে থাকে। আমি গফ্ফার সাইঁয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। সে বলেছিল একে বোম্বাই নিয়ে যাও। আমি জানি সে কেন এটা বলেছিল। বোম্বাই গিয়ে ওর দুজন জানাশোনা বাইজি অ্যাকট্রেস হয়ে গেছে। আমিও ভেবেছিলাম বোম্বাই ঠিক জায়গা। ওকে এখানে এনেছি তাও দুমাস হয়ে গেল। সরদারকে লাহোর থেকে ডেকে এনেছি যাতে পেশার সব কলাকৌশল শেখাতে পারে। গফ্ফার সাইঁয়ের কাছ থেকেও এ অনেক কিছু শিখতে পারে। এখানে আমাকে কেউ চেনে না। তা সত্ত্বেও এর মনে হয়েছে আমার ইজ্জত তাতে নষ্ট হবে। আমি বলেছিলাম তুমি চিন্তা কোরো না, বোম্বাই অনেক বড় শহর। লাখ লাখ রইস আদমি এখানে থাকে। আমি তোমাকে মোটর কার এনে দিয়েছি। কোনও ভালো লোককে খুঁজে নাও। মান্টো সাব! আমি খোদার কসম খেয়ে বলছি আমার মনের ইচ্ছে এ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাক। সব কিছু সম্পর্কে জেনেবুঝে নিক। আরও হুঁশিয়ার হোক। আমি আজই ওর নামে ব্যাঙ্কে দশ হাজার টাকা জমা করতে তৈরি। কিন্তু জানি যে তা করলে দশ দিনের মধ্যেই বাইরে বসে থাকা এই সরদার তার প্রতিটি পাইপয়সা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নেবে। আপনিও একে বোঝান যাতে চালাকচতুর হওয়ার চেষ্টা করে। যেদিন থেকে মোটর গাড়ি কিনে দিয়েছি, তারপর থেকে প্রতিদিন সরদার একে নিয়ে অ্যাপোলো বন্দরে যায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সফল হল না। স্যান্ডো আজ অনেক কষ্ট করে মহম্মদ শফিককে এখানে নিয়ে এসেছে। ওর সম্পর্কে আপনার কী মত?'
আমার মনে হয়েছিল নিজের মত জানানো ঠিক হবে না। কিন্তু বাবু গোপীনাথ নিজেই বলে দিল! ‘বেশ ভালো খাওয়াদাওয়া করা লোক বলেই মনে হচ্ছে। দেখতে শুনতেও ভালো। কি জিনু জানি – তোমার পছন্দ হয়েছে?'
জিনু চুপ করে রইল।
জ়িনাতকে বোম্বাই নিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে বাবু গোপীনাথের কাছে শোনার পর থেকে আমার মাথা ঘুরছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না – এমনও হয়? কিন্তু আরও দেখতে দেখতে আমার সেই অবিশ্বাস দূর হল। বাবু গোপীনাথের আন্তরিক ইচ্ছে ছিল যাতে জ়িনাত বোম্বাইতে ভালও কোনও ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা হয়ে থাকে অথবা এমন ছলাকলা শেখে যাতে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে টাকা কামাতে সক্ষম হয়।
যদি শুধু জ়িনাতের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই উদ্দেশ্য হত, তা হলে সেটা তেমন কোনও মুস্কিলের ব্যাপারই হত না। বাবু গোপীনাথ এক দিনেই সেই কাজ করে ফেলতে পারত। কিন্তু উদ্দেশ্য সৎ ছিল বলেই সে জ়িনাতের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। তাকে অ্যাকট্রেস বানানোর জন্য সে বেশ কয়েকজন জালি ডাইরেক্টরকে দাওয়াতও দিয়েছিল। ঘরে টেলিফোন লাগিয়েছিল। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়।
প্রায় দেড় মাস ধরে মহম্মদ শফিক টুসির আসাযাওয়া চলেছিল। বেশ অনেকগুলো রাত সে জ়িনাতের সঙ্গে কাটিয়েও ছিল। কিন্তু টুসি এমন মানুষ নয় যে কোনও মহিলাকে সাহায্য করবে। বাবু গোপীনাথ একদিন আফশোস আর দুঃখের সঙ্গে বলেছিল: ‘শফিক সাবকে তো ফাঁপা জেন্টেলম্যান বলে মনে হল। সাহস দেখুন, বেচারা জ়িনাতের কাছ থেকে চার-চারটে চাদর, ছটা বালিশের ওয়াড়, দুশো টাকা নগদ হাতিয়ে নিয়ে গেছে। শুনেছি আজকাল আলমাস নামে একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা চালাচ্ছে।’
কথাটা সত্যি। আলমাস পাতিয়ালার নাজ়ির জানের কনিষ্ঠা কন্যা। বড় তিন বোন কোনও না কোনও সময় শফিকের রক্ষিতা হয়ে থেকেছে। জ়িনাতের কাছ থেকে শফিক যে দুশো টাকা নিয়েছে, আমি জানি সেটা ও আলমাসের জন্যই খরচ করেছে। বোনেদের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া করে আলমাস বিষ খেয়ে নিয়েছিল।
মহম্মদ শফিক টুসি আসাযাওয়া বন্ধ করে দিলে জ়িনাত বেশ কয়েকবার আমাকে টেলিফোন করে বলেছিল শফিককে খুঁজেপেতে তার কাছে নিয়ে যেতে। আমি শফিকের খোঁজ করলেও জানতে পারিনি সে কোথায় থাকে। একদিন হঠাৎ রেডিও স্টেশনে দেখা হয়ে গিয়েছিল। খুব ঝামেলার মধ্যে ছিল। জ়িনাত তোমাকে ডেকেছে এই কথা বলতে সে বলেছিল: ‘আমি এই খবর আরও অন্যদের কাছেও পেয়েছি। আফশোসের ব্যাপার হল আজকাল আমি একেবারেই ফুরসত পাচ্ছি না। জ়িনাত খুব ভালো মেয়ে, কিন্তু আচরণে আর কথাবার্তায় অতি শালীন! যাদের স্বভাব ভদ্রঘরের বিবিদের মত সেই সব মেয়েতে আমার কোনও আগ্রহ নেই।’
শফিকের ব্যাপারে হতাশ হয়ে জ়িনাত আবার সরদারের সঙ্গে অ্যাপোলো বন্দরে যাতায়াত শুরু করল। পনেরো দিন ধরে অনেক কষ্ট করে অনেক গ্যালন তেল পোড়ানোর পরে সরদার দুটো লোককে ফাঁসাতে সমর্থ হল। তাদের কাছ থেকে জ়িনাত চার শো টাকা পেল। বাবু গোপীনাথ এটাকে আশাজনক বলে মনে করেছিল কারণ সেই খদ্দেরদের একজন ছিল রেশম কাপড়ের মিল মালিক যে জ়িনাতকে শাদি করবে বলেছিল। কিন্তু তারপরে এক মাস পেরিয়ে গেলেও সে আর জ়িনাতের কাছে ফিরে আসেনি।
একদিন আমি কোনও একটা কাজে হর্নবি রোড ধরে যেতে যেতে দেখলাম ফুটপাতের ধারে জ়িনাতের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের সিটে নাগিনা হোটেলের মালিক মহম্মদ ইয়াসিন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই মোটর তুমি কোত্থেকে নিলে?’
ইয়াসিন হেসে ফেলল। ‘মোটরের মালকিনকে তো তুমি চেনো!’
বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি সেটা জানি।’
‘তা হলে বুঝে নাও এটা আমার কাছে কীভাবে এল। আচ্ছি লড়কি হ্যায় ইয়ার!’ ইয়াসিন আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারতে আমি হেসে ফেললাম।
তার চারদিন পরে বাবু গোপীনাথ ট্যাক্সি করে আমার অফিসে এল। তার কাছ থেকে জানলাম ইয়াসিনের সঙ্গে জ়িনাতের মোলাকাত কীভাবে হয়েছিল। এক সন্ধ্যায় অ্যাপোলো বন্দর থেকে একটা লোককে তুলে সরদার আর জ়িনাত নাগিনা হোটেলে গিয়েছিল। সে লোকটা তো কোনও কারণে ঝগড়া বাধিয়ে কেটে পড়ল। কিন্তু হোটেলের মালিকের সঙ্গে জ়িনাতের দোস্তি হয়ে গেল।
বাবু গোপীনাথও সন্তুষ্ট ছিল কারণ দশ-পনেরো দিনের মেলামেশার মধ্যেই ইয়াসিন জ়িনাতকে ছটা খুব দামি শাড়ি এনে দিয়েছিল। বাবু গোপীনাথ ভাবছিল আরও কিছু দিন যাক – জ়িনাত আর ইয়াসিনের সম্পর্কটা আরেকটু মজবুত হোক – তখন সে লাহোরে ফিরে যেতে পারবে। কিন্তু তা হল না।
কোনও খ্রিস্টান মহিলা নাগিনা হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়েছিল। তার যুবতী মেয়ে মুরিয়েলকে দেখে ইয়াসিনের মাথা ঘুরে গেল। ফলে জ়িনাত বেচারি হোটেলেই বসে থাকত, আর ইয়াসিন জ়িনাতের মোটর গাড়িটাতে ওই যুবতীকে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যে ঘুরে বেড়াত। বাবু গোপীনাথ এটা জানতে পেরে দুঃখ পেল। সে আমাকে বলল, ‘মান্টো সাব! এরা কেমন মানুয? ভাই, একঘেয়ে লাগছে তো সোজাসুজি বলেই দাও না কেন? কিন্তু জ়িনাতও একটা অদ্ভুত মেয়ে। সে ভালোভাবেই জানে কী ঘটে চলেছে, কিন্তু মুখ ফুটে একটুও কিছু বলবে না। মিয়াঁ! যদি তোমার ওই খ্রিস্টান ছুকরির সঙ্গে প্রেম করার ইচ্ছে হয়, তা হলে নিজের মোটর কারের বন্দোবস্ত করো, আমার মোটর নিয়ে টানাটানি করছ কেন? আমি কী করব বলুন মান্টো সাব – খুবই ভালো আর খাঁটি মেয়ে। আমার মাথায় কিছু আসছে না। একটু চালাক তো হতে হবে!’
ইয়াসিনের সঙ্গে সম্পর্ক চুকলেও জ়িনাত কোনও দুঃখ পেল না।
তারপরে বেশ অনেক দিন তেমন কোনও খবর নেই। একদিন টেলিফোন করে বুঝলাম বাবু গোপীনাথ গুলাম আলি আর গফ্ফার সাইঁয়ের সঙ্গে লাহোরে ফিরে গেছে টাকাপয়সার ব্যবস্থা করার জন্য। তার সঙ্গে নিয়ে আসা সেই পঞ্চাশ হাজার টাকা শেষ হয়ে গেছে। যাবার সময় জ়িনাতকে বলে গেছে লাহোরে তাকে কিছু বেশিদিন থাকতে হতে পারে কারণ কয়েকটা বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
সরদারকে মরফিন ইঞ্জেকশন নিতে হত। স্যান্ডোর লাগত পলসনের মাখন। কাজেই তারা দুজনে যৌথ প্রচেষ্টায় রোজ দু-তিনজন খদ্দের জ়িনাতের জন্য ধরে আনত। জ়িনাতকে বলা হয়েছিল বাবু গোপীনাথ আর ফিরে আসবে না – তাকে নিজের চিন্তা নিজেই করতে হবে। রোজ এক শো–সওয়া শো টাকা রোজগার হয়ে যেত, যার অর্ধেক পেত জ়িনাত – বাকিটা সরদার আর স্যান্ডো হাতিয়ে নিত।
‘এটা তুমি কী করছ?’ আমি একদিন জ়িনাতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে অকৃত্রিম সারল্যে বলল, ‘আমি এসবের কিছু জানি না, ভাইজান। এরা যা বলে আমি তাই মেনে নিই।’
মন চাইছিল অনেকক্ষণ তার পাশে বসে বোঝাই যে যা কিছু সে করছে সেটা ঠিক হচ্ছে না – নিজেদের স্বার্থে স্যান্ডো আর সরদার তাকে বেচে দিতেও পিছপা হবে না। কিন্তু কিছু বললাম না। জ়িনাত এতটাই নির্বোধ, অনুচ্চাশী আর নিরুদ্যম একটা মেয়ে যা বেশ ক্লান্তিকর। কমবখ্তটার নিজের জীবনের কদর বা মূল্য সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। শরীর বেচত ঠিকই, কিন্তু সে ব্যাপারে একটু হুঁশ তো থাকতে হবে? আল্লাহ্র নামে শপথ, ওকে দেখে আমার খুবই আশ্চর্য লাগত। সিগারেট, শরাব, খানা, ঘরবাড়ি, টেলিফোন এমনকী যে সোফাটার ওপরে সে প্রায়ই শুয়ে থাকত – তাতেও তার কোনও আগ্রহ ছিল না।
বাবু গোপীনাথ পুরো এক মাস পর ফিরল। আস্তানায় ফিরে দেখল সেখানে তখন অন্য কেউ থাকছে। স্যান্ডো আর সরদারের পরামর্শে জ়িনাত বান্দ্রায় কোনও বাংলো বাড়ির ওপর তলাটা ভাড়া নিয়েছিল। বাবু গোপীনাথ আমার কাছে এলে আমি তাকে পুরো ঠিকানা বলে দিলাম। সে আমাকে জ়িনাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি যা কিছু জানতাম, বললাম। কিন্তু এটা বললাম না যে স্যান্ডো আর সরদার মিলে জ়িনাতকে পেশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বাবু গোপীনাথ এবার দশ হাজার টাকা অতি কষ্টে জোগাড় করে সঙ্গে এনেছিল। গুলাম আলি আর গফ্ফার সাইঁকে লাহোরেই রেখে এসেছিল। ট্যাক্সি নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবু গোপীনাথ আমাকেও তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য জোর করল।
বান্দ্রা পৌঁছোতে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। ট্যাক্সি যখন পালি হিলে উঠছে, তখন সামনে সংকীর্ণ রাস্তার ওপর স্যান্ডোকে দেখা গেল। বাবু গোপীনাথ জোরে চিৎকার করে উঠলেন, 'স্যান্ডো!'
স্যান্ডো যখন বাবু গোপীনাথকে দেখতে পেল, তখন তার মুখ থেকে শুধু এই কথাটা বেরোল: 'ধড়ন তখতা!'
বাবু গোপীনাথ তাকে বলল, 'এসো, ট্যাক্সিতে উঠে আমাদের সঙ্গে চলো।' কিন্তু স্যান্ডো বলল, 'ট্যাক্সি একপাশে দাঁড় করান, আপনার সঙ্গে আমার কিছু প্রাইভেট কথা আছে।'
ট্যাক্সি একপাশে দাঁড় করানো হল। বাবু গোপীনাথ বাইরে বেরোতে স্যান্ডো তাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। বেশ অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে কথাবার্তা চলল। কথা শেষ হলে বাবু গোপীনাথ ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, 'ফিরে চলো।'
বাবু গোপীনাথকে দেখে খুশি বলে মনে হচ্ছিল। আমরা যখন দাদরে পৌঁছেছি, তখন বাবু গোপীনাথ বলল, ‘মান্টো সাব! জিনুর শাদি হতে চলেছে।'
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘কার সঙ্গে?'
বাবু গোপীনাথের উত্তর: ‘হায়দরাবাদ সিন্ধের একজন খুব ধনী জমিদারের সঙ্গে। খোদা যেন ওদের খুশি রাখেন। এটাও ভালো হল যে আমি ঠিক সময়ে এখানে এসে পৌঁছেছি। যে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছি তাতে জিনুর যৌতুকের খরচ মেটানো যাবে। কী, আপনার কী মনে হয়?'
আমার মনে সেই মুহূর্তে কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। আমি ভাবছিলাম হায়দরাবাদ সিন্ধের এই ধনী জমিদার কে – স্যান্ডো আর সরদারের কোনও কারসাজি নয় তো? শেষমেশ অবশ্য নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে সে সত্যিই হায়দরাবাদের সম্পদশালী জমিদার যার সঙ্গে হায়দরাবাদ সিন্ধেরই কোনও মিউজিক টিচারের মাধ্যমে জ়িনাতের পরিচয় হয়েছে। ওই সঙ্গীত শিক্ষক জ়িনাতকে গান শেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করত। একদিন সে তার মুরুব্বি গুলাম হুসেনকে (এটি হায়দরাবাদ সিন্ধের সেই রইস লোকটির নাম) সঙ্গে নিয়ে আসে। জ়িনাত তাকে অত্যন্ত খাতির করে আতিথেয়তা দেখায়। গুলান হুসেনের একান্ত অনুরোধেই সে গালিবের গজল –
'নুকতাচিন হ্যায় গম-এ-দিল উস্কো সুনায়ে না বনে'৪
গেয়ে শুনিয়েছিল। গুলাম হুসেন তার প্রেমে পড়ে যায়। মিউজিক টিচার সে কথা জ়িনাতকে জানায়। সরদার আর স্যান্ডো মিলে কথা পাকা করে ফেলে। শাদি হবে ঠিক হয়ে যায়।
বাবু গোপীনাথ খুশি। স্যান্ডোর বন্ধু হিসেবে একবার সে জ়িনাতের ওখানে গিয়েছিল। তখন গুলাম হুসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাবু গোপীনাথের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। সে আমাকে বলল, ‘মান্টো সাব, খুবসুরত নওজোয়ান, খুব যোগ্য আর সমর্থ। আমি এখানে আসার আগে দাতা গঞ্জ বখশের সৌধে গিয়ে প্রার্থনা করে এসেছি। সে প্রার্থনার ফল মিলেছে। ভগবান যেন দুজনকে খুশি রাখেন।'
বাবু গোপীনাথ অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জ়িনাতের শাদির সব ব্যবস্থা করল। দুহাজার টাকার গয়নাগাটি, আরও দুহাজারের জামাকাপড় তৈরি করিয়ে দিল। পাঁচ হাজার টাকা নগদও দিল। মহম্মদ শফিক টুসি, নাগিনা হোটেলের প্রোপ্রাইটার মহম্মদ ইয়াসিন, স্যান্ডো, মিউজিক টিচার, আমি আর গোপীনাথ শাদিতে উপস্থিত ছিলাম। কনেপক্ষের প্রতিনিধি ছিল স্যান্ডো।
শাদির প্রস্তাব আর সম্মতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর স্যান্ডো ফিসফিস করে বলল, ‘ধড়ন তখতা!'
গুলাম হুসেন সার্জের নীল স্যুট পরে ছিল। সবাই তাকে অভিনন্দন জানালে সে মুখে হাসি নিয়ে তা গ্রহণ করছিল। খুব সুঠাম, সপ্রতিভ যুবক। তার পাশে বাবু গোপীনাথকে দেখে একটা ছোট্ট তিতির পাখি বলে মনে হচ্ছিল।
শাদির নিমন্ত্রণে খাদ্য আর পানীয়ের ব্যবস্থাও বাবু গোপীনাথই করেছিল। খাওয়াদাওয়ার পর সে নিজেই অতিথিদের হাত ধোয়ার জন্য জল ঢেলে দিচ্ছিল। আমি হাত ধোয়ার জন্য গেলে সে আমাকে শিশুর সারল্যে বলল, ‘মান্টো সাব, একটু ভেতরে গিয়ে দেখুন কনের পোশাকে জিনুকে কেমন লাগছে!'
আমি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। জ়িনাত জরির কাজ করা লাল রঙের সালোয়ার আর কুর্তা পরেছিল। দোপাট্টাও সেই রঙের – সোনালি সুতোর বর্ডার দেওয়া। তার মুখে হালকা মেক-আপ। আমার যদিও ঠোঁটে লিপস্টিকের লাল রঙ দেখতে খুবই খারাপ লাগে, জ়িনাতের ঠোঁটে সেটা বেশ মানানসই লাগছিল। কিন্তু যখন ঘরের অন্য কোণে ফুলে-ফুলে সাজানো মশারি ঢাকা পালঙ্কের ওপর চোখ পড়ল, তখন অজান্তেই আমার হাসি পেল। আমি জ়িনাতকে বলেই ফেললাম, ‘এটা কেমন ঠাট্টা হল?'
জ়িনাতের চাউনি তখন একেবারেই এক সরল কবুতরির মত: ‘আপনি মজা করছেন, ভাইজান?' তার চোখ দুটি জলে ভরে গেল।
আমি যে একটা ভুল করে ফেলেছি, তা বুঝতে না বুঝতেই বাবু গোপীনাথ ঘরে ঢুকল। গভীর স্নেহে সে নিজের রুমাল দিয়ে জ়িনাতের চোখ মুছিয়ে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলল, ‘মান্টো সাব, আমি আপনাকে একজন অত্যন্ত সমঝদার, সুশিক্ষিত ভদ্রলোক বলে মনে করতাম। জিনুকে নিয়ে মজা করার আগে আপনি একবার ভাবতেও তো পারতেন?'
বাবু গোপীনাথের গলার স্বরে টের পেলাম আমার প্রতি তার যে গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাতে কতটা চিড় ধরেছে। আমি তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগেই সে জ়িনাতের মাথায় হাত বুলিয়ে অতি আন্তরিকভাবে বলল – ‘খোদা যেন তোমায় খুশি রাখেন।'
কথা শেষ করে বাবু গোপীনাথ ভেজা চোখে আমার দিকে চাইল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে তার সেই দৃষ্টিতে ছিল ভর্ৎসনা – গভীর বেদনাময় তিরস্কারপূর্ণ সে দৃষ্টি।
টীকা:
১) বিশ্বজগতের প্রভু
২) নিম্নবর্গীয় হিন্দু
৩) মৃত্যুর দেবদূত
৪) “নুক্তহ্চীঁ হৈ গ়ম-এ-দিল , উস-কো সুনায়ে নহ্ বনে; কেয়া বনে বাত জহাঁ বাত বনায়ে নহ্ বনে” [হৃদয়বেদনা আমার আত্মসমালোচক, কেমন করে জানাই তাঁকে; কোন্ আশা তাঁর পূর্ণ হবে মুখে যার কথাই বেধে যায় ॥] – ‘গালিবের গজল থেকে’ – আবু সয়ীদ আইয়ুব