অনিকেন্দুর হাতেই ছিল ফোনটা। সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিল, "হ্যালো! এক মিনিট আগেও কি একদিনও করতে নেই? আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি!"
ওপার থেকে ভেসে এলো মিষ্টি হাসির ঝাপটা। হাসতে পারে বটে মেয়েটা! কথায় কথায় হাসি। অনিকেন্দু কপট রাগ দেখালো, “এত হাসির কি আছে শুনি! সারাদিনে একটামাত্র সময়ে কথা বলবে। কেন? কতবার চেষ্টা করি তোমাকে ফোন করার। কিছুতেই হয় না। কিরকম ফোন তোমার? আমি ফোন করলেই বলে -- দিস নাম্বার ডাস নট এক্সিসট! আর তুমি তো এই একবারই শুধু করবে! সেই রাত বারোটা। কতদিন চলবে এইভাবে? আমি আর পারছি না।"
ওপার থেকে বেজে ওঠে সেই মিষ্টি রিনরিনে গলাটা, “আরে বাবা, এত রাগ করতে নেই। কি করি বলো? এর আগে বা পরে যে আমি পারি না। আমি তো তোমায় বলেছি অনেকবার। আমারও তো ইচ্ছা করে সারাদিন কথা বলতে। কিন্তু কি করি বলো? সেটা সম্ভব নয়।"
অনিকেন্দুর কন্ঠস্বর এবার অধৈর্য হয়ে ওঠে, “ঋতু, আমি তো বারবার সেটাই জানতে চাইছি কেন সম্ভব নয়? পাঁচ মাস হয়ে গেল আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে। আমার সম্বন্ধে সবকিছুই তোমায় বলেছি। তোমার সঙ্গে এতবার দেখা করতে চেয়েছি। তুমি কিছুতেই রাজি হলে না। কেন বলো? আমি এবার জানতে চাই।"
এবারে ঋতুপর্ণা আর হাসল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। ঋতুর কন্ঠে বিষন্নতা, “তোমায় তো বলেছি, অনি, আবার বলছি, যা হবার নয়, তা চেও না।"
অ: কেন নয় সেটুকু জানবার অধিকার কি আমার নেই ঋতু? আমি আগে কোনো মেয়েকে এইভাবে ভালোবাসিনি। বিশ্বাস করো। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।
ঋ: আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো।
অ: তাহলে? তুমি কি আমায় বিশ্বাস করছ না?
ঋ: বিশ্বাস না করলে কি রোজ ফোন করতাম?
অ: তাহলে আমায় এত দূরে ঠেলে রেখেছ কেন? বলো? সারাদিনে কতবার চেষ্টা করি। কিছুতেই পাই না!
ঋ: তুমি একটা আস্ত পাগল। আমার যে উপায় নেই সোনা। বোঝার চেষ্টা কর। আমি শুধু এইসময়টাই ফোন করতে পারি।
অ: কি যে অদ্ভুত প্রবলেম তোমার! বেশ এবার একদিন দেখা করো আমার সঙ্গে। তুমি যেখানে বলবে, সেখানে।
ঋ: তারপর আমায় দেখে যদি তোমার ভালো না লাগে? যদি মনে হয় কি কুচ্ছিত মেয়ে! তখন?
অ: আমার চোখে তুমি কিছুতেই কুচ্ছিত হবে না। আমি জানি তুমি সুন্দর।
ঋ: কি করে জানলে?
অ: আমার মন বলছে তুমি সুন্দর। আর সুন্দর বলেই আমায় নিয়ে এরকম খেলছ।
ঋ: যদি সুন্দর না হই?
অ: মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকে সে সবসময়ই সুন্দর দেখে।
ঋ: আচ্ছা ওসব ছাড়ো। এবার বলো তো, কাল তো তোমার বোনের জন্মদিন। কি গিফ্ট দিচ্ছ? অ: তুমি কি করে জানলে কাল টুয়ার জন্মদিন?
ঋ: ম্যাজিক!
অ: আমার আজকাল সন্দেহ হচ্ছে তুমি বোধহয় টুয়ার কোনো বন্ধু। তাই না?
ঋ: কেন এরকম মনে হল তোমার?
অ: নাহলে আমার নাম্বার তুমি পেয়েছিলে কি করে? তুমিই তো প্রথম ফোন করেছিলে, তাই না? তাছাড়া অনেক কিছুই তো তুমি বলো আমাকে যেগুলো আমি তোমায় বলিনি!
ঋ: যেমন?
অ: যেমন ধরো মায়ের যে জ্বর হয়েছিল, তুমি সেটা জানতে। বাবা নতুন বই লিখছেন, সেটাও তুমি জানো। কাল টুয়ার জন্মদিন। সেকথা বললে। এগুলো কি করে জানছ? আমি আজকাল হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর যে তুমি টুয়ার বন্ধু।
ঋতু হেসে গড়িয়ে পড়ে, “সেইজন্য বুঝি আজকাল টুয়ার বন্ধুদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকো? সবাই তো হাসাহাসি করবে তোমায় নিয়ে?"
অ: ওই তো! দেখেছ? তুমি কি করে জানলে আমি টুয়ার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে থাকি? বলো এবার বলো। বলতেই হবে। আমি টুয়ার বেশিরভাগ বন্ধুদের জানি। তুমি কোন জন? ঋতুপর্ণা তোমার আসল নাম নয়।
ঋ: তুমি খুঁজে নাও আমি কে। এবার ঘুমোও। একটা বাজে।
নিস্তব্ধ হয়ে গেল ফোনটা। অনি খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল মোবাইলটা। আর কতদিন? আর কতদিন এভাবে চলবে? মাস পাঁচেক আগে একদিন শোওয়ার পর ও মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। সবে কিনেছে। ফোনটার বিভিন্ন অ্যাপগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিল।
রাজার দোকানে কাউন্টারে ফোনটা ছিল। ও গিয়েছিল ওর নিজের ফোনটা রিচার্জ করাতে। ফট করে চোখ পড়ল এই ফোনটার দিকে। চুম্বকের মত ওকে টানতে লাগলো ফোনটা। রাজা বলল, “এটা সেকেন্ড হ্যান্ড। একজন ভদ্রলোক তার এক বন্ধুর থেকে কিনেছিলেন কিন্ত ফোনটা বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে বেচে দিলেন। আপনি সত্যিই নেবেন?"
অনিকেন্দু ফোনটা কিনল। ফোনটা যেন ওকে টানছিল।প্রথম দিন রাতে ঘুমানোর আগে ফোনটা নিয়েই নেড়েচেড়ে দেখছিল। এটার নম্বর এখনো পরিচিতদের দেওয়া হয়নি। বারোটা বাজল। আর তখনই বেজে উঠল ফোনটা। রং নম্বর ভেবে কেটে দিল। আবার বাজল। এবার ধরতেই ওপারে সেই রিনরিনে গলা, “হ্যালো, অনিকেন্দু?"
অচেনা গলার স্বরে অবাক হয়ে অনিকেন্দু স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো, “কে বলছেন?"
অচেনা কন্ঠে সেই প্রথমবার বেজে উঠলো রিনরিনে মিষ্টি হাসি, “আমি ঋতু, ঋতুপর্ণা। এখন কথা বলা যাবে?"
সেই শুরু। ঋতু বলেছিল--এই ফোনে শুধুই তুমি আর আমি কথা বলব। আর কেউ নয়। কথা রেখেছে অনিকেন্দু।
কিভাবে একটু একটু করে অনিকেন্দু এই কন্ঠস্বরের জাদুতে বাঁধা পড়ে গেছে। আপাদমস্তক সিরিয়াস বলে বন্ধুমহলে পরিচিত অনিকেন্দু এই অজানা কন্ঠের অধিকারিণীকে একটু একটু করে মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে ফেলেছে। কি আশ্চর্য মেয়েটা! অসম্ভব গভীর। কখনও কোনো চটুল কথা বলে না। শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, সঙ্গীত-- সবকিছুতেই গভীর পর্যবেক্ষণ, সুচিন্তিত মতামত। একেক সময় মনে হয় ঋতুর অপেক্ষাতেই বুঝি এত বছরেও কোনো মেয়ে অনিকেন্দুর মনে স্থান পায়নি। কিন্তু এ মেয়ে আর কতদিন নিজেকে এভাবে রাখবে পর্দার আড়ালে? আজকাল অনিকেন্দু আর ধৈর্য রাখতে পারছে না।
সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, অনেক কিছু না বলতে বুঝে যায় ঋতু। এটা কি করে সম্ভব? কিছুদিন আগেই একজন পেশেন্টের একটু জটিলতা দেখা দিয়েছিল। রীতিমতো চিন্তিত ছিল অনিকেন্দু। বাড়িতে বলেছিল বটে কিন্তু ঋতুকে বলেনি। অথচ রাত্রে ফোন করে ঋতু ঠিক ওই পেশেন্টের কথাটা জানতে চাইলো। কি করে জেনেছে, সেই প্রসঙ্গটা হেসে উড়িয়ে দিল।
মায়ের যখন জ্বর হল, রোজ খবর নিয়েছে। বাবার নতুন বই--কিছুতেই হিসাব মিলছে না। আজকাল অনিকেন্দুর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে নির্ঘাৎ টুয়ার কোনো বন্ধু হল ঋতু। নাম গোপন করে কথা বলছে। বলবে বলবে করেও টুয়াকে বলতেও লজ্জা করছে। নিরুপদ্রব তিরিশ বছর কাটিয়ে একি সমস্যা!
অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে অনিকেন্দু ঘুমের আরাধনা করতে লাগল। কিছুতেই ঘুম আসছে না দেখে উঠে ঠান্ডা জল খেল। তারপর খুব লো ভল্যুমে ইউ টিউবে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি চালিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙলো বেশ ভোরেই। এ বাড়িতে সবাই ভোরেই ওঠে। আজ যদিও রবিবার। তাও ঘুম থেকে উঠতে উঠতে অনিকেন্দু টের পেল বাকিরাও উঠে পড়েছে।
সাড়ে সতেরোশো স্কোয়্যার ফিটের তিনতলার এই ফ্ল্যাটটায় ওরা আছে প্রায় বারো বছর। এইখানেই ছিল অনিকেন্দুর বাবা অনিমেষের পৈতৃক বাড়ি--সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির ওপর। অতবড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ রীতিমতো সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তখনই পরিচিত এক প্রোমোটারকে দায়িত্ব দেন অনিমেষ। চারতলা ফ্ল্যাটের তিনতলাটা আর দুটো গ্যারাজ পেয়েছেন। অনিকেন্দু ঘুম ভেঙে বেরিয়ে দেখল, বাবা চায়ের কাপ হাতে সোফায়। মা যথারীতি পুজো সেরে রান্নাঘরে আর টুয়া নিজের ঘরে এক্সারসাইজ করছে। ছেলের গলা পেয়ে মা শ্রাবণী বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিলেন। আজ টুয়ার জন্মদিন। ছুটির দিনে পড়েছে বলে টুয়ার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসবে; দুপুরে খাবে। শ্রাবণীর ভোর থেকেই নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই। টুকটাক কিছু বাজার বাকি। তার লিস্ট করতে করতেই টুয়া এক্সারসাইজ সেরে চলে এল লিভিং রুমে। প্রথমে খাবে পাতিলেবুর রস মেশানো এক কাপ ঈষদুষ্ণ জল, তারপর এক কুচি আদা, এক কুচি রসুন, এক কুচি হলুদ আর এক চামচ মধু। অনিকেন্দু আড়চোখে দেখল। তারপর গলা খাঁকারি দিল। টুয়া না তাকিয়েই বলে উঠল, “গলা খাঁকারি দিয়ে লাভ নেই। আমার মত ফিটনেস রুটিন চালু কর। নাহলে ভুঁড়ি বাড়তেই থাকবে।"
অনিকেন্দু কপট রাগে চোখ পাকালো, “ভুঁড়ি? বলিস কি? জানিস ডা: অনিকেন্দু দত্ত হল কলকাতার সবচেয়ে স্মার্ট এবং সবচেয়ে হ্যান্ডসাম সাইকিয়াট্রিস্ট? মেয়েরা মনখারাপের বাহানা করে আমার চেম্বারে লাইন দেয়।"
টুয়া কাঁচা রসুন চিবোতে চিবোতে মুখ বিকৃত করে বললো, “হুঁ, ভারি আমার শাহরুখ খান এলেন রে।"
অনিকেন্দু হাত নেড়ে টুয়ার কথাগুলো উড়িয়ে দিল, “আরে রাখ তোর শাহরুখ। ওই 'ডিয়ার জিন্দেগী' বলে কি একটা অখাদ্য সিনেমার অখাদ্য সাইকিয়াট্রিস্ট! আমার সঙ্গে তুলনাই হয় না।" টুয়া এক চামচ মধু খেতে খেতে চোখ ছোট করে তাকাল, “অত কথায় কাজ নেই। তিরিশ বছর বয়স হল। এখনো একটা বিয়ে করতে পারলি না। আর কথা বলিস না।"
এবার শ্রাবণী রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন, “টুয়া আর কথা নয়। চান করে এসো। আমার পায়েস হয়ে গেছে।"
ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে গেছে। টুয়া স্নান সেরে নতুন সালোয়ার কামিজ পরে বসেছে। শ্রাবণী কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলেন, প্রদীপ জ্বাললেন, শঙ্খে ফুঁ দিলেন। টুয়া চামচে করে পায়েস খেতে শুরু করল। তারপর বাকিরাও শুরু করল। ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা আর পায়েস। খেতে খেতে টুয়ার মেসেজ আসছে অবিরাম-- জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
বেলায় টুয়ার বন্ধুরা এল একসঙ্গে-- ছ জন। চারটি মেয়ে, দুটি ছেলে। হইহই কাণ্ড। বন্ধুরা বিরাট কেক নিয়ে এসেছে।
মোমবাতি এনেছে। ডাইনিং টেবিলে কেক কাটা হল। শ্রাবণী সবাইকে একটা করে বড় টুকরো প্লেটে করে দিলেন। তার সঙ্গে পায়েস, গুলাবজামুন আর বাড়িতে তৈরি মালপোয়া।
দুপুরে দুটো নাগাদ সবাই খেতে বসা হল। পোলাও, কড়াইশুঁটি দিয়ে মুগডাল, পাঁচরকম ভাজা, মাছের মাথা, পাবদা মাছ সর্ষে পোস্ত দিয়ে, দইপোনা, মাটন, টমেটোর চাটনি, পাঁচরকম মিষ্টি। খেয়ে আইঢাই অবস্থা। টুয়া বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে গেল নিজের ঘরে।
অনিকেন্দু শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল এদের মধ্যে কেউ ঋতু কিনা। কিন্তু কন্ঠস্বর কারুর সঙ্গেই ম্যাচ করছে না!
সেদিন রাতে ঋতুর ফোন আসতেই অনিকেন্দু ঝাঁপিয়ে পড়লো, “ঋতু আজ তোমায় বলতেই হবে তুমি কে। নাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। বল। এক্ষুনি বল।"
ওপারে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ। তারপর ভেসে এলো ঋতুর গলা, “বেশ, বলবো। তবে একটা শর্ত আছে। তোমাকে একটা খেলা খেলতে হবে আমার সঙ্গে। রাজি?"
অনিকেন্দু প্রায় চাঁদ পেল হাতে, “রাজি, রাজি। প্লিজ বলো কি করতে হবে।"
ঋ: বেশ। আমি যা বলব করতে হবে কিন্তু।
অ: আরে হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ।
ঋ: ঠিক আছে। প্রথম কাজটা হল আমি কয়েকজনের কথা তোমায় বলবো। তোমায় তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। কিন্তু কারুর কাছেই আমার নাম বলা যাবে না। তুমি তোমার মত করে তাদের সঙ্গে আলাপ করবে। পারবে?
অ: সেরেছে! আচ্ছা চলো। রাজি। লোকগুলো কারা এবার বল।
ঋ: প্রথম লোকটি হল রমেশ সরকার। হাওড়া মন্দিরতলায় বাস টার্মিনাসে যেকোনো লোককে বললেই দেখিয়ে দেবে বাড়িটা। উনি ওদিককার একজন নামকরা নেতা। বড় ব্যবসাও আছে। তুমিও বোধহয় নাম শুনেছো। টিভি, খবরের কাগজ --সবজায়গায় দেখতে পাওয়া যায় ওনাকে।
অ: এইরে! মেরেছে! নেতার সঙ্গে ভাব করব কি করে? তাও আবার অত বড় নেতা! টিভিতে দেখেছি তো! ভয়ানক কথাবার্তা।
ঋ: তাহলে? পারবে না তো?
অ: আরে, পারবো না মানে? দেখছি কিভাবে আলাপ করা যায়। তারপর?
ঋ: ওই বাড়ির সবার সঙ্গে আলাপ করবে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবে। তাড়াহুড়ো করতে যেও না। আর কোনভাবেই আমার নাম উচ্চারণ করবে না। আগে এই কাজটা কর। তারপর পরের কাজ।
লাইনটা কেটে গেল। এই এক দোষ ঋতুর। কথা শেষ হওয়ার আগেই কেটে দেবে।
মোবাইলটা রেখে অনিকেন্দু আকাশপাতাল ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোরবেলায় অ্যালার্ম বাজতেই লাফ দিয়ে উঠলো। আজ সোমবার। সকালে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ওকে বসতে হয়। সন্ধে বেলা রাসবিহারীতে ওর নিজের চেম্বার। ওদের কালিঘাট রোডের ফ্ল্যাট থেকে কাছেই।
সারা সকাল কাজের ফাঁকে রমেশ সরকারের কথাই মাথায় ঘুরতে লাগলো। আলাপ করতে যাওয়ার কোনো ছুতোই মাথায় আসছে না। মঙ্গল, বুধ পেরিয়ে বৃহষ্পতিবার সন্ধে বেলা ওর চেম্বারে একটি পেশেন্ট এল-- একটি নামী স্কুলের ছাত্র। পড়ার চাপ নিতে পারছে না। কথায় কথায় অনিকেন্দু জানতে পারলো ছেলেটির বাবা সেই রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী, যে দলে রমেশ সরকারও আছে।
অনিকেন্দু রাজনীতি নিয়ে কোনোদিনই মাথা ঘামায় না। কিন্তু আজ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই দলটির ভূয়সী প্রশংসা করে ভদ্রলোকের সঙ্গে অনেক কথা চালালো। মাঝে একবার আলগোছে প্রশ্ন করলো, “ আপনি রমেশ সরকারকে চেনেন নাকি? উনি তো আপনাদের বড় নেতা!"
ভদ্রলোক বিগলিত হয়ে পড়লেন, “আরে,দাদাকে চিনবো না? বলেন কি? উনি তো আমাদের স্তম্ভ। কবে থেকে দলটা ধরে রেখেছেন। ওনার বাড়িতে তো রবিবার করে আমাদের সভা হয়। গান বাজনাও হয় মাঝে মাঝে। "
অনিকেন্দু আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর গদগদ হয়ে বললো, “আমার কবেকার শখ জানেন রমেশবাবুকে দেখব। এত বড় নেতা! তাঁর কাছাকাছি যেতে পারা কি মুখের কথা? উনি রাজনীতি নিয়ে কত গভীরভাবে ভাবেন। একবার যদি দেখতে পেতাম! নিয়ে যাবেন আমাকে?"
লোকটিও খুশি হয়ে উঠলো। একজন ডাক্তারবাবুকে দলে ভেড়াতে পারলে ভালোই হয়। বললো, “অবশ্যই। এই রবিবার তাহলে সকাল নটা নাগাদ তৈরি থাকুন। আমার মোটরবাইকে নিয়ে নেবো আপনাকে।"
সেদিন রাত্রে এই সংবাদটা ঋতুকে দিল অনিকেন্দু।
রবিবার সকালে নটায় রাসবিহারী মোড় থেকে অনিকেন্দুকে তুলে নিলেন ভদ্রলোক-- সঞ্জীব হালদার। রবিবার রাস্তা ফাঁকা। মিনিট চল্লিশের মধ্যে ওদের মোটরবাইক গিয়ে দাঁড়ালো একটা পেল্লাই তিনতলা বাড়ির সামনে। একজন দারোয়ান আর জনা কয়েক ছেলেছোকরা আড্ডা দিচ্ছিলো গেটে। তাদের পাশ দিয়ে দুজনে সোজা বাড়ির দরজায়।
দরজা খোলাই ছিল। ঢুকেই একটা বড় হলঘর। সেখানে সোফা, সেন্টার টেবিল, ইতস্তত ছড়ানো চেয়ার, একপাশে একটা বড় কাঠের টেবিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাদা লোক বসে আছে। হইহট্টগোল চলছে। মেঝেতে পড়ে কয়েকটা পোস্টার, দেওয়ালের একদিকে একটা বড় ফ্লেক্স। মেঝেতে অনেক খালি চায়ের কাপ জড়ো করা। সঞ্জীব এর-ওর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে করতে অনিকেন্দুকে নিয়ে পৌঁছে গেল হলের ভেতরে একদম শেষপ্রান্তে। একটা গোল বেতের চেয়ারে বসা ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েই অনিকেন্দু বুঝলো -- ইনিই তিনি।
সঞ্জীব অনিকেন্দুকে দেখিয়ে বললো, “দাদা, এইযে এনাকে নিয়ে এলাম -- আমাদের ডাক্তারবাবু, সাইকিয়াট্রিস্ট অনিকেন্দু দত্ত। আমাদের পার্টির সাপোর্টার। আপনার সঙ্গে খুব আলাপ করতে চাইছিলেন।”
ষাটের আশপাশে বয়স, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে একদৃষ্টে তাকালো রমেশ সরকার। পরণে চকরাবকরা লুঙ্গি, সুতির ফতুয়া, গলায় মোটা সোনার চেন, হাতে অনেক রত্নবিশিষ্ট আংটি--- আট আঙুলে পরা। দু-হাতের বুড়ো আঙুল দুটি খালি। অনিকেন্দুর গলা শুকিয়ে এলো। এরকম ভয়ানক লোকের সঙ্গে ঋতুর কি সম্পর্ক? কোনোরকমে হাসিমুখে হাত জোড় করে নমস্কার করতে না করতেই জলদগম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন এলো, “কিসের ডাক্তার বললে?"
সঞ্জীবই তড়িঘড়ি উত্তর দিল, “উনি সাইকিয়াট্রিস্ট। খুব নামকরা। আমার ছেলের চিকিৎসা করছেন।"
এবার একটু নড়েচড়ে বসলো রমেশ, "সাইকিয়াট্রিস্ট? আচ্ছা! কোথায় বসেন?"
অনিকেন্দু বললো।
রমেশের কতগুলি চেলা বসে ছিল। একটি বলে উঠলো, “আমি ডাক্তারবাবুর নাম জানি। আমার এক শালা একবার চিকিৎসা করিয়েছিল। সে তো আপনার বিরাট প্রশংসা করে।"
রমেশের ইশারায় অনিকেন্দুকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হল। অনিকেন্দু মুখে একটা অমায়িক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
রমেশই আবার কথা বলে উঠলো, “তা ডাক্তারবাবু, আপনি আমাদের পার্টির লোক যখন তখন তো ভালোই হল। আপনারা শিক্ষিত মানুষেরা এগিয়ে না এলে দলের শক্তি বাড়ে না। বুঝলেন তো? সিনেমা-থিয়েটারের অনেক লোক আছে আমাদের দলে। কিন্তু এইসব আপনাদের মত বিশিষ্ট মানুষ আরও বেশি করে দরকার। বসুন। গল্প করুন। চা-টা খান। মাঝেমাঝে আসুন--" কথার মাঝেই ঘরে ঢুকে এলো কতগুলি ছেলে। তাদের সঙ্গে আগামী কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রমেশ।
অনিকেন্দু চূড়ান্ত অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে। এরকম পরিবেশে ঋতু ওকে কেন আসতে বললো ভগবান জানে! উঠে পড়বে কিনা ভাবছে। সঞ্জীব কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে। অনিকেন্দু আশপাশের কথাবার্তায় কান দেওয়ার চেষ্টা করলো। আজেবাজে কথা, আজেবাজে রসিকতা, একদিকের জটলায় পার্টির কর্মসূচি নিয়ে বাকবিতণ্ডা। মাছের বাজার বললে কম বলা হল। সিগারেটের ধোঁয়ায় গোটা ঘরটাই ধোঁয়াটে। অনিকেন্দু উঠে বাইরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।
পিঠে হাত পড়তে চমকে ফিরে দেখে রমেশ সরকার। অনিকেন্দুকে বললো, "একবার ভেতরে আসুন। কিছু দরকারি কথা আছে।"
একটা প্রশস্ত করিডোর দিয়ে অন্দরে যেতে হয়। বিরাট বড় একটা হলে এসে দাঁড়ালো রমেশ। লেদারের সোফাসেট ঘরের মাঝখান জুড়ে। বার্মাটিকের সেন্টার টেবিল, বহুমূল্য বড় বড় ফুলদানি, টেরাকোটার বড় বড় ঘোড়া আর ডোকরার নানা হস্তশিল্প -- গোটা ঘরটাই প্রমাণ দিচ্ছে রমেশ সরকার ধনী ব্যক্তি। মেঝের পুরু কার্পেটে পা ডুবিয়ে সোফায় বসলো অনিকেন্দু। রমেশ বললো, “একটু বসুন।" বলে ভেতরে চলে গেল। দু-তিন মিনিট বাদেই ফেরত এলো। অনিকেন্দু তখন ঘরের চারপাশ মন দিয়ে লক্ষ্য করছে দেখে রমেশ আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলো। অনিকেন্দু বললো, “দারুণ সব রেয়ার শোপিস দিয়ে সাজিয়েছেন তো!"
রমেশ বললো, “আমাদের তিন পুরুষের ব্যবসা; বুঝলেন ডাক্তারবাবু! সোনার দোকান। এখানে হাওড়ায় একটা, কলকাতার দু জায়গায়, বর্ধমানে একটা। পয়সার অভাব আমার নেই। একটাই সমস্যা। আপনি হয়তো সাহায্য করতে পারবেন --"
কথা শেষ হওয়ার আগেই ভারী পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন একজন পৃথুলা মহিলা-- রমেশেরই কাছাকাছি বয়স, ধবধবে ফর্সা, মাথার পাতলা হয়ে আসা চুলের সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ। গলা, কান আর দুই হাতে সোনার গয়নার বহর বলে দেয় এরা সোনা ভালোবাসে।
মহিলার পেছনে একটি লোক-- হাতে ট্রে। নামিয়ে রাখলো অনিকেন্দুর সামনে। বড় প্লেটে দুটো প্যাটিস, একটা ভ্যানিলা পেস্ট্রি, দুটো বড় বড় সন্দেশ। সঙ্গে সুদৃশ্য কাপে ধূমায়িত চা।
অনিকেন্দু দেখেই আঁতকে উঠলো, “দেখুন, আমি বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়েছি। এখন এত কিছু--"
রমেশের স্ত্রী বলে উঠলো, “সে তো অনেকক্ষণ বেরিয়েছেন। একটু কিছু খান।"
অনিকেন্দুর মুখের অবস্থা দেখে রমেশ ট্রে হাতে লোকটিকে বললো, “যা একটা প্লেট নিয়ে আয়। ডাক্তারবাবু যেগুলো খাবেন তুলে নেবেন।"
অনিকেন্দু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। প্লেট আসতে একটা প্যাটিস আর একটা সন্দেশ তুলে নিল। রমেশও চা খাচ্ছে।
দু-এক মিনিট চুপচাপ। তারপর রমেশ বললো, “ডাক্তারবাবু, আমার ছোট ছেলেটিকে নিয়েই একটু সমস্যা। পাঁচ বছর বয়সে একবার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যায়। তারপর থেকেই মাথাটা কেমন-- এখন পঁচিশ বছর বয়স। পড়াশোনা করেছে। হায়ার সেকেন্ডারি অবধি। বার কয়েক ফেল করেছে। টেনে টেনে এই অবধি এনেছি। এমনিতে চুপচাপ থাকে। কারুর সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না। মাঝেমধ্যে কেমন ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। তখন কেউ সামলাতে পারে না--"
অনিকেন্দু: তখন কি করে?
রমেশ: জিনিসপত্র ছোঁড়ে, ভাঙচুর করে। কেউ থামাতে গেলে তাকে মারতে আসে।
অনিকেন্দু: তখন কি করেন? থামান কি করে?
রমেশ: আমার বড় ছেলে ভাই অন্ত প্রাণ। সে বাড়িতে থাকলে ভালো। নাহলে খবর পাঠাই। আমার হাওড়ার শোরুমে ওই বসে। সে ছুটে এসে ভাইকে শান্ত করে। একজন নার্স থাকে চব্বিশ ঘন্টা। আমার মায়ের নব্বই বছর বয়স-- হাঁটাচলা পারে না, খাইয়ে দিতে হয়-- তার দেখাশোনার জন্য। সেই নার্স এসে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেয়। এইভাবেই চলছে।
অনিকেন্দু: ডাক্তার দেখাননি ছেলেকে?
রমেশ: অনেক দেখিয়েছি। কিছু মনে করবেন না ডাক্তারবাবু। সব গাদা পয়সা নেয় আর ঘুম পাড়িয়ে রেখে দেয়। লাভের লাভ কিছু হয় না-- শেষে--
অনিকেন্দু: শেষে?
রমেশ: শেষে বাঞ্ছাবাবার কাছে নিয়ে গিয়ে একটু ভালো ছিল--
অনিকেন্দু: বাঞ্ছাবাবা?
রমেশের স্ত্রী: উনি খুব পণ্ডিত মানুষ ডাক্তারবাবু। আপনারা হয়তো এসব মানেন না। ওনার ওষুধে ছোটকু ভালো হচ্ছিলো। তারপর তো-----
অনিকেন্দু: তারপর?
রমেশের স্ত্রী: তারপর ছোটকু আর যেতে চায় না। তারফলে অবস্থা আবার খারাপের দিকে গেছে।
রমেশ: আসলে বাবার বড় জটা। ভাবের ঘোরে থাকেন। অনেক ভক্তটক্ত বসে থাকে। ধূপধুনো-- ধোঁয়া-- ছোটকু অস্থির হয়ে ওঠে।
অনিকেন্দু: তা, আপনারা যখন দৈব ওষুধে বিশ্বাস করেন, তখন আমাকে কেন বলছেন এসব?
রমেশ: না না। আমরা আপনার ওপর বিশ্বাস রেখেই বলছি যদি একবার দেখেন।
অনিকেন্দু: দেখুন আমাদের চিকিৎসা তো অনেক সময়সাপেক্ষ। পেশেন্টের সঙ্গে অনেক বেশি সময় দিতে হয়, কথা বলতে হয়, বোঝাতে হয়। বাড়ির লোকেদেরও সহনশীল হতে হয়। এক আধ দিনের ব্যাপার নয়। তাছাড়া আমি দেখলে কিন্তু কোনো দৈব ওষুধ চলবে না। আমার সব কথা শুনতে হবে।
রমেশের স্ত্রী: হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি যা বলবেন। এখন বছর খানেক তো কোনো ওষুধই খাচ্ছে না। এই কিছুদিন আগেই হঠাৎই রান্নাঘরে ঢুকে একটা ছুরি নিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলতে গেছিলো। আমরা খুব ভয় পেয়ে গেছি।
রমেশ: ছোটকুকে একবার দেখে যান।
অনিকেন্দু: দেখুন এইভাবে তো হবে না। আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন। আমি দেখে দেব।
রমেশ: তাই হবে। তবে আজ একবার যদি দেখেন---
অনিকেন্দু: ঠিক আছে। নিয়ে আসুন।
রমেশের স্ত্রী উঠে গেল।
একটু পরেই তার সঙ্গে ঘরে ঢুকলো বছর পঁচিশের একটি রোগা লম্বা ছেলে। সরল চোখমুখ। শান্ত কিন্তু চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। চুপ করে এসে বসলো।
অনিকেন্দু ছেলেটির দিকে মনোযোগ দিল।
মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। ছোটকুর সঙ্গে অনিকেন্দুর মোটামুটি একটা সমঝোতা তৈরি হয়েছে। সপ্তাহে একদিন ওকে অনিকেন্দুর চেম্বারে নিয়ে যায় রমেশের স্ত্রী মাধবী। আর রবিবার সকালে রমেশের গাড়ি এসে অনিকেন্দুকে নিয়ে যায় । ওখানে ছোটকুর সঙ্গে ঘন্টাখানেক কথা বলে অনিকেন্দু। তারপর ঋতুর কথামতো রমেশের পার্টির লোকেদের সঙ্গে একটু বসে।
এই এক মাসে অনিকেন্দু বুঝেছে, রমেশের মত ঠান্ডা মাথার বদমাইশ লোক খুব কমই আছে। নাহলে অত বড় ব্যবসা, পার্টির অত ওপরের সারির নেতা হওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। অবলীলায় হাসতে হাসতে মানুষের মৃত্যদণ্ড দিতে পারে এই লোকটা। ইদানীং প্রোমোটিং-এর ব্যবসাতেও হাত লাগিয়েছে। বাপের সবরকম দুষ্কর্মের ডানহাত বড় ছেলে সন্দীপন। এই আরেকটি চরিত্র!
প্রতি দিন রাত্রে ঋতুকে সবকিছু বলে অনিকেন্দু। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ঋতু যেন আগে থেকেই সব জানে। সন্দীপনের সঙ্গে আলাপও ঋতুর আগ্ৰহেই।
একটা রবিবার অনিকেন্দু কাজ সেরে রমেশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, দেখা হল সন্দীপনের সঙ্গে। সন্দীপন নিজেই এগিয়ে এসে আলাপ করলো। তিরিশের একটু ওপরে বয়স, লম্বাচওড়া, ফর্সা, মাথায় হাল ফ্যাশনের চুলের কাট, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। হাত বাড়িয়ে দিল অনিকেন্দুর দিকে, “হ্যালো, আমি সন্দীপন। আপনি তো ডাক্তারবাবু। দেখুন যদি ছোটকুটার কিছু ডেভেলপমেন্ট হয়।"
সন্দীপন ওদের হাওড়ার শোরুমটা দেখে। এছাড়া ইদানীং প্রোমোটারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সন্দীপন অনিকেন্দুর সঙ্গে নিজেই বেশ জমিয়ে নিল। এইধরনের চরিত্রের সঙ্গে অনিকেন্দুর একেবারেই পোষায় না। তাও জোর করেই মুখে হাসি রেখে টুকটাক গল্প করতো। একটা শনিবার সন্দীপন জোর করে অনিকেন্দুকে ধরে নিয়ে গেল ক্লাবে। কলকাতার একটি অভিজাত ক্লাব। এখানে শনিবার করে আসর জমায় সন্দীপন। তারপরে মদে চুর হয়ে কোনো ডান্সবারে যায়। কোনো মেয়েকে মনে ধরলে তাকে গাড়িতে তুলে নিজের ফ্ল্যাটে যায়। দুটো ফ্ল্যাট আছে সন্দীপনের। শ্রীমানের নাকি একটা বিয়েও হয়েছিল। কি একটা কারণে বউ পালিয়েছে। এই খবরটা অবশ্য ছোটকুর দেওয়া।
ছোটকু মাঝে মাঝেই অদ্ভুত কথা বলে। একদিন বললো, “জানেন তো ওরা বলে বৌদি হারিয়ে গেছে। কিন্ত আমি জানি ওরা বৌদিকে মেরে ফেলেছে।"
অনিকেন্দু জিজ্ঞেস করেছিলো, “কারা মেরে ফেলেছে?"
ছোটকু ভয় পেয়েছিলো। বলেছিল, "জানি না।" ওর দু চোখে ত্রাস দেখে অনিকেন্দু আর ঘাঁটায়নি।
ঋতুকে ঘটনাটা বলায়, ঋতু বলেছিল, "বড়লোক বাড়ির কেচ্ছা সহজেই ধামাচাপা দেওয়া যায়। তাড়াহুড়ো কোর না। ঠিক জানতে পারবে। আর ছোটকুকে কিছু জিজ্ঞেস করে বিপদ বাড়িও না।"
এরপর ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে অনিকেন্দু ছোটকুর বরাদ্দ সময় একটু কমিয়ে ফেললো। ছোটকুর সঙ্গে সাবধানে কথা বলতো।
একটা শনিবার সন্দীপনের পীড়াপিড়িতে ক্লাবে গেল অনিকেন্দু। সামান্য বিয়ার খেলো। মহিলাদের সঙ্গে সন্দীপনের ঢলাঢলি দেখলো।
সেদিন রাতে ঋতুকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো, “ঋতু এই নোংরা লোকগুলোর সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক? প্লিজ বল। আমি এদের নিতে পারছি না।"
ঋতু স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর বললো, “এইতো অনেকটা এগিয়ে এসেছো আমার দিকে। আর দুজনকে চিনতে হবে। তারপরেই পৌঁছে যাবে আমার কাছে।"
অ: আ--রো দুজন? ইমপসিবল ঋতু। আমি পারবো না।
ঋ: তাহলে ছেড়ে দাও। আমি তোমায় জোর করব না।
ঋতুর কন্ঠস্বরের বিষন্নতায় নিমেষে মত পরিবর্তন করলো অনিকেন্দু, “আচ্ছা চলো। কিছু ব্যাপার নয়। বলো কার সঙ্গে আলাপ করতে হবে।"
ঋ: তোমাকে রবিবার বিকেলে একটা পার্কে যেতে হবে। বেহালা বড়িশায় জেমস লঙ সরণিতে, বেহালা ক্লাবের আশপাশে। বেশ বড় সুন্দর একটা পার্ক। ওখানে ঠিক সাড়ে চারটের সময় যাবে। ইতু বলে একটি মেয়ে-- এই ধরো ছাব্বিশ বছর বয়স, সুন্দর দেখতে আর তার সঙ্গে একটা ছোট্টো মেয়ে-- বছর দুয়েকের। ওদের সঙ্গে আলাপ করবে।
অনিকেন্দু উঠে বসলো উত্তেজনায়। "বাঃ, এইটা ভালো কাজ। সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য বেহালা কেন, আমতলা যেতে বললেও রাজি। তা, তোমার এই ইতুকে চিনবো কি করে? মহিলাদের ধরে ধরে নাম জিজ্ঞেস করলে তো মার খেয়ে যাবো।
ঋতু হাসলো অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বললো, “পার্কে ঢুকে সোজা এগিয়ে যাবে। উল্টোদিকের বাউন্ডারির গায়ে পাশাপাশি একটা কৃষ্ণচূড়া আর একটা রাধাচূড়া। ওখানে পর পর তিনটে বেঞ্চ আছে। মাঝখানেরটায় বসবে। ইতুকে চেনার উপায় হয়ে যাবে। শুধু তোমার এই মোবাইলটা ভাইব্রেশন মোড-এ রাখবে।
অ: বাঃ। জলের মত। কিন্তু এই ইতু যদি মারাত্মক সুন্দরী হয়, আর তাকে দেখে আমি তোমাকে ভুলে যাই, তাহলে?
ঋ: তাহলে তো ঝামেলা চুকেই গেল। এবারে ঘুমাও।
ফোন নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রবিবার বিকেলে নিজের গাড়ি চালিয়ে অনিকেন্দু পার্কের গেটে এলো। তখন ঘড়ির কাঁটা বলছে চারটে চল্লিশ। গাড়ি পার্ক করে ঋতুর কথামতো ঠিক জায়গায় পৌঁছে মাঝখানের বেঞ্চটায় বসে একটা মেডিকেল জার্নাল বের করে পড়ার ভান করে চারপাশে আড়চোখে একটু জরিপ করে নিল। হঠাৎ হাঁটুতে কি একটা এসে ধাক্কা খেয়ে ওর কোলে পড়ল। তাকিয়ে দেখলো একটা বড় লাল টুকটুকে বল। বলটা ধরে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা ফুলের মত ছোট্ট মেয়ে গুটগুট করে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোট ছোট দুহাত বাড়িয়ে আধোআধো মিষ্টি বুলিতে বললো, “আমাল বল।"
অনিকেন্দুর বুকপকেটে দু নম্বর মোবাইলটা ভাইব্রেট করলো। ও চমকে উঠলো। ঋতু কোথা থেকে দেখছে?
ঋতুর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বাচ্ছাটার হাতদুটো ধরে অনিকেন্দু বললো, “এই সুন্দর বলটা তোমার? আগে নাম বলো। তবে বল দেবো।"
বাচ্ছাটা গালে টোল ফেলে হাসলো। তারপর বলল, “আমাল নাম থোনাই।"
"ওর নাম সোনাই"-- মিষ্টি, সুরেলা কন্ঠস্বরে চোখ তুলে অনিকেন্দু দেখলো ছিপছিপে লম্বা টকটকে ফর্সা একটি মেয়ে তাকিয়ে আছে হাসিমুখে। ধারালো নাক চোখ, চুল কপাল থেকে উল্টে তুলে পেছনে হর্সটেল করা। অনিকেন্দুর মোবাইল আবার ভাইব্রেট করলো।
অনিকেন্দু সোনাইয়ের হাতে বলটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল, “আমি অনিকেন্দু। ডা: অনিকেন্দু দত্ত।"
মেয়েটি হাসলো। সোনাইয়ের মত একগালে টোল পড়লো। তারপর সেই মিষ্টি স্বরে বললো, "আমি ইতু, সোনাইয়ের মাসি।"
সোনাই ততক্ষণে অনিকেন্দুর একটা হাত ধরে ফেলেছে। সেই হাতেই টান দিলো, “আমাল থাতে বল খেলো।"
ইতু সোনাইকে ধরে কাছে টানলো, “আঙ্কলকে ডিসটার্ব করতে নেই সোনা। চল আমি তো খেলছি।"
অনিকেন্দু বলে উঠলো, “আরে না না। ডিসটার্ব হবে কেন? চলো সোনাই আমি খেলবো।"
সেদিন রাতে খুব রাগ করলো অনিকেন্দু, “ঋতু তুমি কি করে বুঝছিলে? আমার ফোন দুবার ভাইব্রেট করলো। তুমি তার মানে কাছেই ছিলে। তবু সামনে এলে না। আমি তোমার সব কথা কিন্তু শুনছি।"
ঋতু আজ খুব খুশি। সেই গলাতেই বললো, “দেখা হওয়ার আর বেশি দেরি নেই। বিশ্বাস কর। তবে এবার আসল কাজটা করতে হবে। পরের দিন রমেশের বাড়ি যাবে যখন, তখন বাঞ্ছাবাবার সঙ্গে আলাপ করতে চাইবে।
আঁতকে উঠলো অনিকেন্দু, “কভি নেহি। ওই ভণ্ডটার সঙ্গে আমি আলাপ করতে পারবো না।"
ঋ: এটাই লাস্ট অনি। এরপরেই আমাদের দেখা হবে। কথা দিচ্ছি।
অনিকেন্দু অত্যন্ত ব্যাজার। হাঁড়িমুখে চুপ করে রইলো। তারপর বললো, “কেন কথা বলতে চাইছি, জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?"
ঋ: তোমার তো একটা জেনুয়িন কারণ রয়েছে!
অ: কি?
ঋ: এইযে তোমার এখনো বিয়ে হচ্ছে না!
খিলখিল হাসির মধ্যে ফোনটা কেটে গেল।
পরের রবিবার রমেশের কাছে প্রসঙ্গটা তুললো অনিকেন্দু একটু কায়দা করে, “আচ্ছা, রমেশবাবু এইযে আপনারা বাঞ্ছাবাবার কথা বলেন, ওনার কি সত্যিই অলৌকিক ক্ষমতা আছে?"
রমেশ কপালে হাত ঠেকালো, “আছে তো বটেই। যবে থেকে বাবার কাছে যাচ্ছি, তবে থেকে আমার ব্যবসায়ে আরও উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু আপনি কেন জানতে চাইছেন? কোনো প্রবলেম?"
অনিকেন্দু একটু সমস্যায় পড়ে গেল। কোনোরকমে বললো, “হ্যাঁ মানে, ওই আর কি--একটা সমস্যা--মানে মা বলছিলো আরকি--"
রমেশ থামিয়ে দিলো, “আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে। অত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন? পরের শনিবার বিকেলে, এই ধরুন তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি নতুন রাস্তার মোড়ে নেতাজি স্ট্যাচুর কাছে চলে আসুন। আমার লোক থাকবে। ও আপনাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমি আগের দিন বাবাকে বলে রাখবো। নাহলে যা ভিড় হয়, আপনি ডেট পাবেন না।"
এই রবিবারটাও বিকেলটা কাটলো বেহালায় ইতু আর সোনাইয়ের সঙ্গে। ইতুর মধ্যে এমন একটা প্রাণবন্ত ভাব আছে, তার সঙ্গে ওর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, যে ওর সাহচর্য ভালো না লেগে উপায় নেই। আর কোথাও যেন খুব চেনা চেনা লাগে। ইতু পড়াশোনাতেও ভালো। এম.কম করতে করতেই চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি করেছে। এখন কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ফার্ম করেছে। সেটার কাজকর্ম নিয়েই সোম থেকে শনি ব্যস্ত থাকে। রবিবারটা ছুটি। সোনাইয়ের সঙ্গে খেলার ফাঁকে ফাঁকে ইতু টুকটাক অনেক গল্প করলো। শুধু পারিবারিক জীবন নিয়ে কথা বলতে দেখা গেল ওর খুব অনীহা। অনিকেন্দুও বিশেষ ঘাঁটালো না। এমনিতেই ও নিজে কালিঘাটের বাসিন্দা হয়ে বেহালার পার্কে কেন হাওয়া খেতে আসে এই প্রশ্নটার কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। এই কাছাকাছি একটা ক্লিনিকে আসে-- সেখানে যাওয়ার পথে এখানে একটু সময় কাটায়-- এরকম একটা ভাসা ভাসা উত্তর দিয়েছে ইতুকে।
সেদিন রাতে ঋতুকে বেশ উত্তেজিত লাগলো। বার বার করে বোঝাতে লাগলো বাঞ্ছাবাবার যেন কোনোভাবেই সন্দেহ না হয় যে অনিকেন্দুর আসলে কোনো সমস্যা নেই।
শেষে জানতে চাইলো, “ইতুকে কেমন লাগছে?"
অ: বেশ ভালো। খুব সেন্সিটিভ, বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু বেচারির ফ্যামিলি লাইফ মনে হয় ভালো নয়। ওইটুকু একটা বাচ্ছা সোনাই! তার মা বাবা কোথায় কেজানে!
ঋতু একটু চুপ করে রইলো। তারপর বললো, "কেমন লেগেছে সোনাইকে?"
অনিকেন্দু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো, “সোনাই ইস আ ওয়ান্ডারফুল চাইল্ড। এত ভালো বাচ্ছা! কোনো বায়না নেই। সব কথা শোনে।"
এরপর আর বিশেষ কথা হল না। ঋতু আজ একটু তাড়াতাড়িই ফোন রেখে দিল।
পরের শনিবার অনিকেন্দু সময়মতো নেতাজি স্ট্যাচুর কাছে পৌঁছে দেখলো রমেশের লোক দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটিকে ও অনেকবার দেখেছে রমেশের বাড়িতে। লোকটির নাম ভবেন। ও অনিকেন্দুর গাড়িতে উঠে এলো। তারপর কিছুদূর এগিয়ে একটা মাঠের ধারে গাড়িটা পার্ক করতে বললো। বাবার বাড়ি একটা গলির ভেতর। সেখানে পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
ভবেনের সঙ্গে অনিকেন্দু একটা সরু গলি পেরিয়ে একটা হলুদ দোতলা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িটা দেখে মনে হল বহু বছরের পুরোনো। ভবেন বললো বাবার তিনটে বাড়ি আছে। এখানে শুধু ভক্তদের সঙ্গে দেখা করেন।
দরজায় দুটো লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ভবেন একটু এগিয়ে গিয়ে গুজগুজ করে কিছু বললো। সঙ্গে সঙ্গে একজন এগিয়ে এসে অনিকেন্দুকে ইশারা করে ডাকলো। ওর পেছন পেছন ঢুকে প্রথমে একটা টানা ঘর, তারপর একটা খোলা উঠোন পেরিয়ে আরেকটা ঘরের সামনে এসে অনিকেন্দু দাঁড়ালো। বাইরের ঘরে বহু মানুষ বাবার অপেক্ষায় বসে। লোকটা ভালোই পসার জমিয়েছে বোঝা যাচ্ছে।
লোকটি অনিকেন্দুকে বাইরে দাঁড় করিয়ে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সামান্য পরেই বেরিয়ে এসে বললো, “ভেতরে যান। আপনি রমেশবাবুর লোক বলেই এত চট করে সুযোগ পেলেন। নাহলে পাঁচ-ছমাস অপেক্ষা করতে হত।"
অনিকেন্দু নার্ভাস ভাবে ঢুকলো। আবছা আলোয় দেখলো ঘরে কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই। এক কোণে একটা বড় পিতলের প্রদীপ জ্বলছে। মেঝেতে ছোট গদি পেতে চাদর বিছানো। তার ওপর বাবা বসে। সুস্বাস্থ্য, লম্বা চুলের জটা, কাঁচা-পাকা দাড়ি বুক অবধি নেমেছে, অসংখ্য রুদ্রাক্ষের মালা। লাল ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। ভাঁটার মত লাল চোখে অনিকেন্দুকে জরিপ করে আঙুল দিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলো।
অনিকেন্দু অলরেডি নার্ভাস। ঘরে একটা বড় ধুনুচিতে ধুনো ছাড়াও আরও কিছু পুড়ছে। একটা ঝিমধরানো মিষ্টি গন্ধ ঘরময়। চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া।
বাবা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলো, “বল্।"
অনিকেন্দু আমতা আমতা করে মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “বাবা একটা সমস্যায় পড়ে এসেছি। মানে কিভাবে বলবো--"
বাবার কন্ঠে যেন বজ্রপাত হল, “হুঁম। আমার কাছে সবাই সমস্যা নিয়েই আসে। তোকে রমেশ পাঠিয়েছে। ওরা আমার অনেকদিনের ভক্ত। বল্। চট্ করে বল্।”
অনিকেন্দু গলা ঝেড়ে মরিয়া হয়ে বলে ফেললো, “বাবা,আমার, মানে বার বার সম্পর্ক হয়। কেটে যায়। কিছুতেই বিয়ে অবধি যেতে পারছি না।"
বাবা সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। খপ করে অনিকেন্দুর হাতের চেটোটা নিজর হাতে টেনে নিল। তারপর একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে অনেকক্ষণ দেখলো। এরপর আবার একটা বজ্রগম্ভীর "হুম।”
এরপর অনিকেন্দুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “তোর বাড়িতে অবিবাহিত মেয়ে আছে?"
অনিকেন্দু ঘাবড়ে গিয়ে বললো, "আছে।"
বাবা: ওই মেয়ে তোর কে হয়?
অ: বোন।
বাবা: হুঁ। ওইখানেই গণ্ডগোল। বুঝলি?
অনিকেন্দু কিছুই বুঝলো না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলো।
বাবা: শোন ছেলে। ওই আইবুড়ো মেয়ে তোকে টেনে ধরছে। দোষ কাটাতে হবে। যজ্ঞ করতে হবে। ওই মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যত দেরি করবি, তত বিপদ। আজ শনিবার। সামনের মঙ্গলবার ভালো দিন। ওই মেয়েকে এখানে আন। ওর করকোষ্ঠি দেখি। বিচার করি। তারপর যজ্ঞের দিন স্থির করবো। তোর মা বাবা আছে?
ঘাবড়ে গিয়ে অনিকেন্দু বলে ফেললো, “তারা খুব অসুস্থ। উঠতে চলতে পারে না।"
বাবার গলায় খুশির সুর, “ভালো।"
আসলে অনিকেন্দু ভেবেছিলো যে মা-বাবাকে যদি এখানে আনতে বলে, সেই ভয়ে এইসব বলে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে বাবা "ভালো" বলল কেন কে জানে!
বাবা পাশ থেকে একটা বড় ঘন্টা তুলে নিয়ে সেটা নাড়াতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে এলো একটি লোক। সে এসে অনিকেন্দুকে উঠতে বললো। তারপর চোখের ইশারা করলো। এবার অনিকেন্দু দেখতে পেল ওর পেছনের দেওয়ালে একটা কুলুঙ্গিতে একটা ছোট কালীমূর্তি-- সর্বাঙ্গে সিঁদুর লেপা আর তার সামনে মেঝেতে একটা চৌকো টিনের বাক্স।
লোকটি অনিকেন্দুর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, “হাজার টাকা মায়ের চরণে দিন ওই বাক্সে।"
দুটো কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট অনিকেন্দুর পকেট থেকে চলে গেল টিনের বাক্সে।
বেরিয়ে এসে অনিকেন্দু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মঙ্গলবার এই ভণ্ডটার কাছে টুয়াকে আনা কি উচিত হবে?
আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে সোজা রাসবিহারীর চেম্বারে ঢুকলো।
রাত্রে ঋতুকে প্রথমেই এই প্রশ্নটা করলো।
অ: কেলেঙ্কারি হয়েছে ঋতু। ভণ্ডটা টুয়াকে নিয়ে যেতে বলেছে।
ঋ: তুমি তো আচ্ছা বোকা! ওই লোকটা তো আর টুয়াকে চেনে না। অন্য কাউকে নিয়ে যাও।
অ: কাকে নিয়ে যাব?
ঋ: হা কপাল! এত বছরেও তোমার কোনো মেয়ে বন্ধু নেই? যে রাজি হবে! ভেবে দেখো। অনিকেন্দু হাঁ করে ভাবতে লাগলো। তারপরেই লাফিয়ে উঠলো, “ইউরেকা!"
ঋ: কি হল?
অ: আছে, আছে। রাকা আছে 'দৈনিক বার্তা'য়। ও জার্নালিস্ট। সারাক্ষণ স্কুপ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওকে বলি।
সোমবার একটা কফি শপে রাকার সঙ্গে দুপুরে দেখা করলো অনিকেন্দু। রাকা পুরো লুফে নিল, “আরে একদম চাপ নিস না। আমি যাব তোর বোন সেজে। এই লোকটাকে নিয়ে কিছু কথা কানে আসছে বুঝলি? কিন্তু ফাঁদে ফেলতে পারছে না কেউ। সব বড় বড় লোকের সঙ্গে কানেকশন। দেখি এবার কি হয়।"
প্রচুর পরিকল্পনা হলো।
মঙ্গলবার ঠিক সময়ে অনিকেন্দু রাকাকে নিয়ে পৌঁছে গেল বাঞ্ছাবাবার ডেরায়। সেই ঘরটাতে আলো আঁধারির মধ্যে বসলো দুজনে।
রাকা রীতিমতো সুন্দরী। বাঞ্ছাবাবা একদৃষ্টে দেখলো বহুক্ষণ ধরে। রাকার হস্তরেখা দেখলো পনেরো মিনিট ধরে।
তারপরে অনিকেন্দুর দিকে ফিরে বললো, “বোনের বিয়ে দিসনি কেন?"
অনিকেন্দু আমতা আমতা করছে দেখে রাকা বলে উঠলো, “আমার চার বার বিয়ের সম্বন্ধ হয়ে ভেঙে গেছে বাবা।"
বাবা: হুঁ। এতো যজ্ঞ ছাড়া উপায় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যদি মঙ্গল চাস, সামনের সপ্তাহে একটা ভালো দিন আছে। বুধবার অমাবস্যা। ওইদিন রাতে দুটোর সময় আমি যজ্ঞ করবো। যদি রাজি থাকিস তো বল।
অনিকেন্দু আড়চোখে রাকার দিকে তাকালো। রাকা অসম্ভব আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অনিকেন্দুর দিকে তাকিয়ে বললো, “দাদা, রাজি হয়ে যাও। বাবা আমাদের সব বাধা দূর করে দেবে।"
অগত্যা অনিকেন্দু মাথা নাড়লো, “আমি রাজি বাবা। কি করতে হবে বলুন।"
বাবা: দুজনে বুধবার সারাদিন শুধু দুধ আর ফল খাবি। তারপর রাত দশটার সময় স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে বারোটার মধ্যে এখানে পৌঁছবি। এই মেয়ে এলোচুলে লালপাড় কোরা শাড়ি পরবে। যজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে ঠিক বারোটায় মায়ের পুজো হবে। পুজো শেষ হলে তুই এই মেয়েকে রেখে বাড়ি চলে যাবি। তোর উপস্থিতিতে যজ্ঞ হবে না। পরদিন প্রাতে পাঁচটা নাগাদ আসবি। বোনকে নিয়ে যাবি। এখন দশ হাজার টাকা দিয়ে যা। যজ্ঞের শুরুতে আরো দশ দিবি।
অনিকেন্দু তৈরি হয়েই এসেছিল। দশ হাজারের একটা বান্ডিল বের করে দিল।
বেরোনোর মুখে বাবা বললো, “আজ থেকে শুরু করে নিরামিষ খাবি। রাতে শোওয়ার আগে মা কালীর ধ্যান করবি। আর এসব কথা কারুর সঙ্গে আলোচনা করবি না। তাহলে মন্ত্র কাজ করবে না। যা এবার।"
ফিরতি পথে গাড়িতে উঠে রাকা বললো, “এতো শুধু তোর,আমার কম্মো নয়। এ একেবারে ঘুঘু। পুলিশে চঞ্চল আছে। দেখি ও কি বলে। পুরো প্ল্যান করে বাবাজিকে ফাঁসাতে হবে।"
অনিকেন্দু বললো, “আমি কিছুতেই তোকে রাত্তিরে রেখে যেতে পারবো না।"
রাকা হাসলো, “আরে আমরা সাংবাদিকরা কতরকম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি জানিস? তুই একদম চিন্তা করবি না। আমি দেখছি চঞ্চল কি বলে। তোকে পরে জানাচ্ছি।"
বিরাট উত্তেজনায় সপ্তাহটা কাটলো। রাকা রোজ যোগাযোগ রাখছে। কিভাবে কাজ এগোচ্ছে জানাচ্ছে।
অনিকেন্দু সারাক্ষণ তুমুল উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। বাড়িতেও সবাই লক্ষ্য করেছে। ইদানীং মা প্রায়ই বলছে, “তোর কি হয়েছে বল তো অনি? বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি সবসময় অন্যমনস্ক!"
টুয়া ফোড়ন কাটছে, “মা, দাদাভাই নির্ঘাৎ কোনও মেয়ের চক্করে পড়েছে। সারাক্ষণ আনমনা, রাতে দরজা লাগিয়ে অনেকক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলে। খবর নাও। খবর নাও।"
অনিকেন্দু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটছে। যবনিকা পতন হতে চলেছে। এখন একদম স্পষ্ট যে ঋতু এই বাবাটিকে জব্দ করতে চায়। আর তারপরেই ওর সঙ্গে দেখা হবে। এতদিনের এত টানাপোড়েনের অবসান।
নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন, অনিকেন্দু বাড়িতে বলে রাখলো, "কাল আমাদের একজন কলেজের বন্ধুর বাড়িতে খাওয়াদাওয়া আছে। রাত্রের দিকেই হবে। আমি পরেরদিন ফিরবো।"
বুধবার রাত নটায় গাড়ি নিয়ে বেরোলো অনিকেন্দু। সোজা রাকার বাড়িতে। রাকা বাড়িতে খানিকটা বলে রেখেছে। ওর মা বাবা এতদিনে রাকার নানা ব্যাপারে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাতবিরেতে বেরোনো, বিপদজনক জায়গায় যাওয়া-- এসবই তো ওর কাজের অঙ্গ।
অনিকেন্দু পৌঁছে দেখলো একজন অচেনা ভদ্রলোক বসে আছেন। রাকা আলাপ করিয়ে দিল। উনিই চঞ্চল।
চঞ্চল অনিকেন্দু কে বললো, “আপনারা একদম ভয় পাবেন না। সকাল থেকেই প্লেন ড্রেসে আমার লোক ওখানে আছে। ওই ঠগটাকে আমরাও ধরতে চাই।"
রাকা আর অনিকেন্দুর কাছে দুটো হুইসিল দেওয়া থাকলো। বিপদ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে বাজাতে হবে।
ঠিক পৌনে বারোটা নাগাদ অনিকেন্দু আর রাকা পৌঁছলো। চারিদিক শুনশান। অন্ধকার। দরজায় নক্ করতে একজন চেলা এসে খুলে দিল। বাবা সব গোপন কাজকর্মের বেশি সাক্ষী রাখতে চায় না, বোঝা গেল।
আগের দিনের ঘরটায় ঢোকার পর দেখা গেল, ঘরটায় আরেকটা দরজা আছে, যেটা আগের দুদিন অনিকেন্দু লক্ষ্য করেনি। বোধহয় বন্ধ থাকতো।
সেই দরজাটা দিয়ে একটা ছোট ঘরে ওদের ঢুকিয়ে চেলাটা দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ালদর্শন কালীমূর্তির সামনে বাবা পুজোয় বসেছে। ঘরময় নানা উপচার। ওদের দুজনের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ইঙ্গিতে বসতে বললো। চেলাটা ঘরে ঢোকানোর আগেই দশ হাজার টাকা নিয়ে নিয়েছে।
ঘরের ধোঁয়ায় সেই মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ কিন্তু আরও তীব্র। কেমন একটা আচ্ছন্নতা আসছে।
ঠিক বারোটায় পুজো শুরু হলো। দুঘন্টা পরে যখন পুজো শেষ হল, তখন ওরা দুজনেই সজাগ থাকার চেষ্টা করেও ঢুলছে।
বাবা এবার অনিকেন্দুর দিকে তাকালো, “পুজো শেষ। তুই এবার চলে যা। এই নারীকে ধ্যান করে মন্ত্র জপ করতে হবে সারারাত। আমি যজ্ঞ করবো। তখন অন্য কেউ উপস্থিত থাকলে হবে না। "
অনিকেন্দু অসহায়ভাবে রাকার দিকে তাকালো। যদিও চঞ্চল অভয় দিয়েছে, তাও এখানে রাকাকে রেখে যাওয়া---
রাকা হাত নেড়ে ওকে বিদায় দিল।
অনিকেন্দু ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে কয়েক পা এগোতেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে চঞ্চল ওর হাত ধরে টেনে অন্য গলিতে ঢুকে পড়লো। তারপর নিঃশব্দে বাবার বাড়িটার পেছনদিকে গিয়ে পৌঁছলো। ওখানে ঝোপের আড়াল থেকে আরো দুজন বেরিয়ে এলো। তারপর সবাই চুপচাপ পাঁচিলের গায়ে একটা দরজা খুলে একটা খোলা উঠোনে ঢুকে ঘাপটি মেরে রইলো। চঞ্চলের কোনও সাগরেদ আগেই পাঁচিল টপকে ঢুকে এই দরজাটা খুলে রেখেছিল।
আধ ঘণ্টা কোনো শব্দ নেই। তারপরেই রাকার গলায় চিৎকার আর হুইসিলের শব্দ। সবাই দৌড়ে ভেতরে ঢুকে এল। একটাই দরজা-- সেটা ভেজানো। অনিকেন্দু আর চঞ্চল পুজোর ঘরটায় সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়লো।
রাকার তখন বিধ্বস্ত অবস্থা। বাবা তখনো ওর শাড়ির একটা কোণ ধরে। চেলাটা পালানোর চেষ্টা করতেই চঞ্চল ধরে ফেললো।
রাকা বাবার হাত থেকে শাড়িটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়ালো। তারপর বললো, “চঞ্চল, এরা আমাকে কি একটা সরবত খাইয়ে বোধহয় অজ্ঞান করতে চাইছিলো। ওইযে ওই বড় ঘটিটায় এখনও খানিকটা আছে। আমি আমারটা না খেয়ে এই পেছনের বাটিতে লুকিয়ে ঢেলে দিয়েছি। নাহলে এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেতাম। তুই যে স্পাই ক্যামটা দিয়েছিলি, তাতে সব রেকর্ড হয়ে গেছে।"
বাবাকে হাতকড়া পরানো হল রাকার শ্লীলতাহানি করতে যাওয়ার অপরাধে। চঞ্চলের ডাকে আরও পুলিশ হাজির হল। এরা আশপাশেই ছিল। গোটা এলাকাটাই ঘিরে ফেলা হল। বাবা ক্রমাগত শাসাতে লাগলো বড় বড় নানা লোকের নাম বলে।
অনিকেন্দু রাকাকে নিয়ে ওদের সঙ্গে থানায় গেল। সকালের মধ্যেই চেলাটার স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল। বাবা বহু মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছে। কিন্তু সমাজের ভয়ে সেই কলঙ্ক কেউ প্রকাশ করেনি। এছাড়াও আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সকালের আলো ফুটতেই বাবার বাড়ির পেছনের কাঁচা মাটির উঠোন খুঁড়ে পাঁচটি নারী কঙ্কাল পাওয়া গেল।
ওই চেলাটি ছিল বাবার সকল কূকর্মের সঙ্গী। আরো দুএকটা বিশ্বস্ত সঙ্গীর নাম পাওয়া গেল।
ওই চেলাটির স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল তিনটি বালিকা এবং দুটি যুবতী নারীর কঙ্কাল ওইগুলি। অজ্ঞান করার জন্য অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগে দুটি বাচ্ছা মেয়ে মারা যায়।
একটি মেয়ে বাবার কীর্তি ফাঁস করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল। তাই তাকে মরতে হয়।
একটি যুবতীরও তাই।
অন্য মহিলাটি ওষুধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে এলেও নিজের সম্মান বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় সামনে থেকে ফলকাটার বঁটি তুলে নিয়ে বাবাকে আঘাত করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা এবং তার তিন চেলা মিলে তাকে অত্যাচার করে এবং শেষে মেরে ফেলে মাটির নিচে পুঁতে দেয়। বাড়ির লোককে পরেরদিন জানায় যে তাদের বাড়িতে এতদিন একটা পিশাচ ছিল। তার জন্যই ছোটছেলে পাগলামি করতো। বড় ছেলের বিয়ের পরেই সেই পিশাচ বউটির ভেতরে ঢুকে যায়। যজ্ঞের ফলে পিশাচ তাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। পিশাচটির প্রভাবেই তাদের ছোটছেলে পাগলামি করতো। সে এবার ভালো হয়ে যাবে। মেয়েটির বাপের বাড়ির লোক থানা পুলিশ করেও কিছু লাভ করতে পারেনি কারণ মেয়েটির শ্বশুর প্রভাবশালী নেতা -- রমেশ সরকার। মেয়েটি তার বড়ছেলের বউ-- ঋতুপর্ণা সরকার।
পরের চারটে দিন খবরের কাগজে, টিভিতে শুধু এই একটাই খবর। তাবড় তাবড় নেতা, পুলিশ, ব্যক্তিত্বের নাম উঠে এল যারা সব জেনেও বাবার মহিমায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল।
সমস্ত কাগজে অনিকেন্দু আর রাকার ছবি।
শুধু অনিকেন্দুর জগতটাই বদলে গেল। না-- ওই দিনের পর থেকে অনিকেন্দুর মোবাইলটা আর একবারও বাজেনি।
অনিকেন্দুর মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে সবটাই বোধহয় স্বপ্ন। ওর ঋতুপর্ণা অন্য মানুষ। সে আবার ফোন করবে, সেইরকমই হাসিতে ভেঙে পড়বে। ওদের যে এইবার দেখা করার কথা ছিল!
একসপ্তাহ হল অনিকেন্দু বাড়িতেই আছে -- ছুটিতে।
মা বাবা এতসব শুনে ছেলের জন্য গর্বিত। টুয়ার উত্তেজনা তো চরমে।
পাড়ার লোকের চোখে অনিকেন্দু এখন হিরো।
সপ্তাখানেকের মাথায় একদিন সকালে বেল বাজলো।
ইতু, একজন ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আর ছোট্ট সোনাই।
ইতু এগিয়ে এসে অনিকেন্দুর পায়ে হাত দিল। ওর দু-চোখে জলের ধারা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো, “ডা: দত্ত, আপনি যে আমাদের কি উপকার করলেন-- আমি জানতাম ওরা দিদিকে মেরে ফেলেছে -- আমি জানতাম---"
বিহ্বল অনিকেন্দু অস্ফুটে বললো, “আপনার দিদি?"
ইতু চোখের জলের মধ্যে বললো, “ঋতুপর্ণা। ঋতুপর্ণা আমার দিদি। সোনাই ওরই মেয়ে। দিদি উধাও হয়ে যাওয়ার পর মা বাবা ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে। ওর তখন একবছর বয়স। আমি মধুপর্ণা।"
অনিকেন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এইজন্যই ইতুকে এত চেনা চেনা লাগতো-- ওর কন্ঠস্বর, ওর হাসি, ওর কথা বলার ভঙ্গি--
তখন ইতুর মা, অনিকেন্দুর মায়ের হাত জড়িয়ে বলে চলেছে, "--ওই বাড়িতে আমরা মেয়ের বিয়ে দিতে চাইনি জানেন--কি করবো--মেয়ে আমার এত সুন্দরী-- ওদের চোখে পড়লো-- আমাদের জোর করতে লাগলো, অত বড় নেতার ছেলে, ভয় পেয়ে গিয়ে আমরা--আমাদের মেয়েটাকে ওরা শেষ করে দিল।"
আরও কিছুদিন পেরিয়ে গেছে। অনিকেন্দু কাজে জয়েন করেছে। আজ রবিবার। গাড়ি নিয়ে বিকেলে বেহালার পার্কে এসেছে। ইতু আসবে। অনিকেন্দুই ডেকেছে।
পার্কের বাইরে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বাইরেই দাঁড়ালো। ওইতো আসছে ইতু বিকেলের সোনালী আলো গায়ে মেখে। অনিকেন্দু এগিয়ে গেল। ইতুর দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, “ইতু, তুমি আমার হবে?"
ইতু চোখ নামিয়ে অনিকেন্দুর হাত শক্ত করে ধরলো। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। দুদিন আগে ফোনে অনিকেন্দু ওকে ঋতুর কথা বলেছে। যার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাবে তার কাছে কিছু গোপন করতে নেই।
ইতু চোখ তুলে চাইলো। শহরের জনকোলাহল কোথায় ভেসে গেল। সীমাহীন নিস্তব্ধতার মাঝে দুজনে দুজনের চোখে বন্দী। আচমকা এক ঝলক হাওয়া খুশির তোড়ে ওদের ছুঁয়ে গেল। এই তেরো দিনের নিস্তব্ধতার পর অনিকেন্দুর বুকপকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করলো। তারপর সেই হাওয়ার ঝলক আরেক পাক খেয়ে অস্তমিত সূর্যের আলোয় মিলিয়ে গেল।