• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | গল্প
    Share
  • নিরাময় : অনিরুদ্ধ সেন



    ।।১।।

    এক প্রৌঢ় হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুমলিন মুখে শুয়ে। বাইরে ডাক্তার এক মহিলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, "সরি ম্যাডাম, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনার স্বামী এক বিরল রক্তকণিকার রোগে ভুগছেন যার এখনও কোনও চিকিৎসা নেই।"

    "আছে!" এক পেশল পুরুষ করিডোরের ছায়ার থেকে বেরিয়ে এসে অটুট আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন, "আপনার কাছে রোগের নামটা শুনে আমরা গোটা পৃথিবীতে তল্লাশি চালিয়েছিলাম। অবশেষে জেনেছি, সম্প্রতি আমেরিকার এক রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে এই রক্তরোগের মহৌষধ আবিস্কৃত হয়েছে।"

    "ও, আপনিই কিছুদিন আগে আমাকে ফোন করেছিলেন! দেখুন, আপনারা সহকর্মীকে বাঁচাতে যেভাবে পৃথিবী তোলপাড় করেছেন তার তুলনা নেই। তবে ওষুধ ল্যাব থেকে বাজারে আসতে তো অন্তত এক বছর। আর আমরা এখন দিন অথবা বলতে পারেন ঘণ্টা গুনছি।"

    "ওষুধটা ল্যাবরেটরি থেকেই তুলে আনা হচ্ছে। আর হয়তো ইতিমধ্যেই আমাদের লোক সেটা নিয়ে মুম্বইয়ের ফ্লাইট ধরেছে।"

    "এ তো অসাধ্যসাধন! করলেন কীভাবে?"

    "সহকর্মীদের জীবন আমাদের কাছে অমূল্য। তার জন্য আমরা নরকের তল অবধি নামতে পারি।" লোকটির মুখে এবার একটু চিন্তার ছাপ পড়ল, "শুধু সে যেন সময়মতো এসে পৌঁছোয়!"

    একটি কিশোর আগ্রহভরে তার কথাগুলি গিলছিল। তার বুকে এবার উত্তেজনার রেলগাড়ি – ওষুধটা সময়মতো পৌঁছবে তো? নাকি –

    প্রায় বিশ বছর কেটে গেছে। কিন্তু এই স্মৃতি এখনও সঞ্জয়কে তাড়া করে বেড়ায় – কখনও জাগরণে, কখনও রাতের দুঃস্বপ্নে।

    শেষ সময়ে বাবা রক্তবমি করেছিল। মহৌষধটি পৌঁছেছিল তার কয়েক ঘণ্টা পর। নানা কৌশলে ওষুধটাকে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত পার করাতে গিয়ে বাহকের খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।

    শোকের মধ্যে বাড়তি ফ্যাকড়া, একের পর এক অচেনা লোক তাদের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে আসতে লাগল। কারও সঙ্গে আবার পুলিশ রক্ষী, নিশ্চয়ই তাঁরা হোমরাচোমরা কেউ হবেন। তাঁদের একজন মাকে বলেছিলেন, "সুনীল মোরে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে।" কিশোর সঞ্জয় ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তার বাবা মুম্বইয়ের এক ছোট্ট কম্পানিতে সামান্য চাকরি করত, শুধু মাঝে মাঝে অফিসের কাজে বাইরে যেত। আর কোনও লড়াই-টড়াই করে নয়, সে অসুখেই মারা গিয়েছিল।

    অনেক পরে অনেক খোঁজখবর করে সঞ্জয় জানতে পেরেছিল, বাবা কিছু 'আন্ডারকভার' কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শেষ 'অপারেশন'এ সে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে পাচার করে দেশের এক গোপন গবেষণাকেন্দ্রে এনে দিয়েছিল। আনার সময়েই বিপত্তিটা ঘটেছিল। হয় কিছু লিক করেছিল। নয়তো যন্ত্রাংশটি আনা খুব দরকার ছিল বলে বাবাকে জিনিসটার বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করা হয়নি। মোদ্দা কথা, জিনিসটার থেকে নির্গত অতিরিক্ত মাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণই বাবার রক্তকণা দূষিত করে দিয়েছিল।

    এসব জানার পর সঞ্জয়ের বিশ্বদর্শনটাই যেন কেমন বদলে গিয়েছিল। যদি দেশে দেশে বিরোধ না থাকত, বাবার রক্ত বিষাক্ত হত না। আর সীমান্ত যদি অবাধ থাকত, বাবার ওষুধ সময়মতো এসে পৌঁছোত। পৃথিবীটা কত সুন্দর আর নিরাপদ হত, যদি দেশে দেশে রেষারেষি না থাকত, সীমান্তে না থাকত নিষেধের পাঁচিল!

    সঞ্জয় প্রথমে ভেবেছিল ডাক্তার হবে – কোনও দেশের নয়, গোটা পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষ অজস্র দুরারোগ্য ব্যাধিতে জর্জরিত। কিন্তু মানুষ মানুষের নিরাময়ের অস্ত্র আবিষ্কারের বদলে মানুষকে মেরে ফেলার অস্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতাতেই বেশি মগ্ন। সে চিকিৎসক হয়ে পৃথিবীর ব্যাধি সারাতে আত্মনিয়োগ করবে।

    মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। সঞ্জয় মোরে শেষ অবধি আজ ডাক্তার নয়, একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তবে ভেবে দেখেছে, এটা মন্দের ভালো। বছরে মোটামুটি ন'মাস সে মহাসমুদ্রে ভেসে বেড়ায়, যার অধিকাংশ এলাকাতেই কোনও নির্দিষ্ট দেশের দখলদারি নেই।

    তবে তার দুঃস্বপ্নের তালিকায় ইদানীং আরও একটি যোগ হয়েছে। যখন ডেকে দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তে সূর্যাস্ত দেখে, এক একদিন হঠাৎ মনে হয় সমুদ্র যেন সেখানে আগুন আর রক্ত বমন করে এক মহা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছে।


    ।।২।।

    অনন্ত সমুদ্রে তরতরিয়ে চলেছে মালবাহী জাহাজ। এবারের যাত্রা একমাসের, সিডনি থেকে ওসাকায়। সঞ্জয় সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। কোরাল সাগর ছেড়ে জাহাজ সলোমন সাগর দিয়ে চলেছে, এমন সময় ঝড় এল।

    এখন অবশ্য ঝড়ের পূর্বাভাস আগেই পাওয়া যায়। তবে মহাঝড় না হলে আধুনিক কোনও জাহাজ রুট পাল্টে বিস্তর লোকসান দিতে চায় না। ঝড়ের মোকাবিলার কায়দাকানুন ক্যাপ্টেন ও ক্রু-রা জানে।

    অশান্ত দরিয়ায় ঢেউ ঠেলে এগোচ্ছে টলমল জাহাজ। হঠাৎ সঞ্জয়ের দূরবিনে ধরা পড়ল কয়েক মাইল দূরে এক বিপর্যস্ত ছোট্ট জলযান। সম্ভবত সলোমন দ্বীপপুঞ্জের দুটি দ্বীপের মধ্যে চলাচলকারী কোনও মোটর বোট। সঞ্জয় তক্ষুনি ক্যাপ্টেনকে ব্যাপারটা জানাল।

    ক্যাপ্টেন অমানবিক নন। এসব ব্যাপারে নানা আন্তর্জাতিক নির্দেশিকাও আছে। তবু তিনি ইতস্তত করে বললেন, "জাহাজকে কিছুটা ঘোরাতে পারি। কিন্তু বেশি কাছে নিতে গেলে এই অস্থির সমুদ্রে পঞ্চাশ হাজার টন জাহাজের ঢেউয়ের আবর্ত ঐ ছোট্ট বোটকে গিলে ফেলতে পারে।"

    "আপনি যতটা পারেন কাছে চলুন। তারপর আমি দেখছি।"

    ক্যাপ্টেনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে ঐ ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রে সঞ্জয় আরও দুজন মাল্লার সঙ্গে লাইফবোটে গিয়ে মোটর বোটের চালক ও দুজন যাত্রীকে উদ্ধার করে আনল। ব্যাপারটা জানিয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ কর্তৃপক্ষের কাছে মেসেজ পাঠানো হল। বোটচালক পিটার মেলানেশিয়ান ক্রিশ্চিয়ান। যাত্রী দুজনের একজন জাপানি, অন্যজনকে দেখে মনে হয় ইউরোপীয়। তাঁরা একটু সুস্থ হলে তাঁদের পরিচয় জানতে চাওয়া হল।

    "আমি নীল বনার্জি আর উনি আকিরা ইতো। আমরা দুজন বটানিস্ট, এখানে একটা দ্বীপে এসেছিলাম এক অনুসন্ধানে। ফেরার পথে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বিপর্যয়। আপনার অসমসাহসী ক্রু-দের অজস্র ধন্যবাদ আমাদের প্রাণরক্ষার জন্য। শুধু যার জন্য এত ব্যস্ততা – এই গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পলটা যদি ফ্রিজে মাইনাস দশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার একটু ব্যবস্থা করা যায় –"

    সঞ্জয় দেখেছিল, এত বিপদের মধ্যেও ওঁরা দুজন একটা ওয়াটারপ্রুফ প্যাকেট হাতছাড়া করেননি। সেটা নিয়ে সে বলল, "সে ব্যবস্থা এক্ষুনি করছি। তবে এত ঝুঁকি না নিয়ে যদি যেখানে ছিলেন সেখানেই স্যাম্পলটা ডিপ ফ্রিজে রেখে একদিন দেরিতে বেরোতেন –"

    "আমরা যে দ্বীপ থেকে আসছিলাম, তার নাম টেটেপেয়ার। এই আশ্চর্য দ্বীপটি জনমানবহীন। কিন্তু সেখানে প্রায় দুশোটি বিরল প্রজাতির পাখি আর পঞ্চাশটি বিরল স্তন্যপায়ী ও উভচর প্রাণী আছে। এছাড়া আছে এক আদিম রেইনফরেস্ট, যার গাছগাছড়া নিয়ে গবেষণার টানেই আমরা ওখানে যাই।

    বিরল প্রজাতিগুলির সংরক্ষণের জন্য ওখানে কঠোর পরিবেশবিধি জারি আছে। জনশূন্য এই দ্বীপে ফসিল জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি বারণ। ওখানে বাড়িঘরও বলতে গেলে নেই। শুধু যাঁরা দ্বীপের বৈশিষ্ট্যে আকৃষ্ট হয়ে বা গবেষণার উদ্দেশ্য ওখানে যান, তাঁদের জন্য একটা ইকো-লজ আছে। সেটা আসলে কতগুলো কুটিরের সমষ্টি, যাতে সর্বোচ্চ ষোলোজন থাকতে পারে। সেখানে সামান্য বিদ্যুৎ তৈরি হয় সৌরশক্তিতে। তাতে কিছু আলো জ্বলে কিন্তু কোনও আধুনিক গ্যাজেট চলে না। তাই আমাদের স্যাম্পল নিয়ে অনবরত আশেপাশের দ্বীপে যাতায়াত করতে হয়।"

    এই সময় ক্যাপ্টেনের স্যাটফোনে কল এল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর তিনি বললেন, "আপনাদের মূল্যবান জীবন রক্ষা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। তবে আপনাদের আবার নামিয়ে দেবার ব্যাপারটা আছে। সুখের বিষয়, সলোমন আইল্যান্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে কথা বলে আমরা তার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। এখান থেকে প্রায় একশো নটিকাল মাইল দূরে শোয়াজল বন্দর। ঝড় তো ইতিমধ্যে থেমে এসেছে। শান্ত সমুদ্রে আর পাঁচ-ছ ঘণ্টায় কাল ভোরের আগে আমরা ওখানে পৌঁছে যাব। পোর্ট থেকে একটা বোট এসে আপনাদের নিয়ে যাবে। শোয়াজল এয়ারপোর্ট থেকে আপনারা সলোমন দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী হোনিয়ারায় চলে যেতে পারবেন।"

    "অনেক ধন্যবাদ।" বললেন বনার্জি, "আমাদের জন্য আপনাদের অনেক কষ্ট হল।"

    "সে কিছু নয়। তবে আপনাদের একটা রাত একটু অসুবিধায় কাটাতে হবে। এটা কার্গো শিপ, প্যাসেঞ্জার কেবিন নেই। কিন্তু আমাদের কিছু বার্থ খালি আছে। যেমন ধরুন আমাদের সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার ফ্যামিলি আনেনি, তার কেবিনেই আপনারা দুজন আজকে রাতে থাকতে পারেন। আর পিটারের ব্যবস্থা আমি করছি। ঠিক আছে, সঞ্জয়?"

    "অবশ্যই, অবশ্যই। আসুন।" সঞ্জয় তার অতিথিদের কেবিনের দিকে নিয়ে চলল।

    আকিরা ইতো জাপানি নাগরিক, ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ নন। নিল সঞ্জয়কে বললেন, "ধন্যবাদ, এবার আপনি ডিউটিতে যান। আমাদের বোধহয় এই ক'ঘণ্টায় ঘুম আসবে না। দয়া করে পোর্ট এলে ডেকে দেবেন।"

    সঞ্জয় ঘড়ি দেখে বলল, "আর ঘণ্টাখানেক পরে গেলেই হবে। ততক্ষণে আলাপ পরিচয়টা সারা যাক। আমি সঞ্জয় মোরে, ফ্রম মুম্বই অফ ইন্ডিয়া। আর আপনি – বনার্জি বা ব্যানার্জি বাঙালিদের পদবি হয় শুনেছি। আপনি কি তাই?"

    "দেখুন, আমি কে, সেভাবে বলা মুস্কিল। আমার বাবা একজন বাঙালি, সুইডেনে ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করতে এসে আমার সুইডিশ মার প্রেমে পড়েন। মা ছিলেন ক্লাইমেটোলজির গবেষক। বিয়ে করে বাবা সুইডেনেই থেকে যান। তার একমাত্র সন্তান আমি বটানিস্ট। কাজের স্পেশালাইজেশনের সূত্রে অস্ট্রেলিয়ায় এসে সেখানেই থিতু। ব্যানার্জি হয়তো কালক্রমে বনার্জিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আর নীল বা Neil সুইডদের একটা খুব প্রচলিত নাম।

    এবার বলুন, আমায় কী বলবেন – ইন্ডিয়ান, সুইড না অজি?"

    "কিছুই নয়, আপনি বিশ্বের নাগরিক।" ফিসফিসিয়ে বলল সঞ্জয়।

    "দ্যাটস ইট!" নিল সঞ্জয়ের পিঠ চাপড়ে বললেন, "আমরা বিজ্ঞানীরাও তাই বলি। বিজ্ঞানের কোনও দেশ নেই, জাতি নেই। ঐ বেড়াগুলি ভেঙে ফেলতে পারলেই বিজ্ঞান বাঁধনমুক্ত হয়ে এক নতুন পৃথিবী গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবে।"

    "যে পৃথিবীতে যুদ্ধ নেই, সীমান্ত নেই।"

    নীল কোনও কথা না বলে সঞ্জয়কে জড়িয়ে ধরলেন।

    একটু পরে সঞ্জয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "যদি কিছু মনে না করেন – আপনারা বটানিস্ট। কিন্তু মনে হচ্ছে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছেন, যা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করার মতো। অবশ্য অচেনা মানুষের কাছে বলতে যদি –"

    সঞ্জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নীল বললেন, "আপত্তি থাকতেই পারত। কিন্তু যে মানুষ অচেনা কাউকে বাঁচাতে প্রাণ বিপন্ন করতে পারে আর একটা ঐক্যবদ্ধ পৃথিবীর কথা ভাবতে পারে, তার কাছে বোধহয় মন খোলা যায়। আমরা পৃথিবীকে শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।"

    সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে নীল বললেন, "গাছ বা জঙ্গল পৃথিবীর ফুসফুস। তারা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অক্সিজেনে পরিণত করে বাতাসকে আমাদের নিশ্বাসের উপযোগী করে রাখে। কিন্তু লাভের লোভে আমরা নির্বিচারে তাদের ধ্বংস করে মনুষ্যজাতির সর্বনাশ ডেকে আনছি। কার্বন দূষণের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ণ হয়ে মহাপ্লাবন তো পরের কথা, এভাবে চললে শিগগিরই আমরা নিশ্বাসই নিতে পারব না।"

    সঞ্জয়ের মনে পড়ল, ইদানিং শীত পড়তে না পড়তেই মুম্বইয়ে শুরু হয়ে যায় কুয়াশা আর শ্বাসকষ্ট। তার শ্বশুরবাড়ি দিল্লিতে তো ঐ সময় প্রায় প্রাণ হাতে করে রাস্তায় বেরোতে হয়। সে উদাসভাবে বলল, "আমার শহর, আমার দেশও গভীর শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তবে জঙ্গল রক্ষা করার কাজটা তো রাজনৈতিক-প্রশাসনিক। আপনারা বিজ্ঞানীরা –"

    "আমরা জঙ্গল ধ্বংস রুখতে পারি না, কিন্তু তার দ্রুত পুনর্সৃজনে সাহায্য করতে পারি। বিভিন্ন ধরণের গাছগাছড়া নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে আমরা টেটেপেয়ারের রেইনফরেস্টে এমন কয়েকটি প্রজাতির সন্ধান পেয়েছি, যাকে সবাই আগাছা বলে উপেক্ষা করে কিন্তু তাদের বেড়ে ওঠার ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে টিঁকে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে ও অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে তাদের শঙ্কর প্রজাতি তৈরি করে আমরা একটি প্রজাতির বেড়ে ওঠার আর অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষমতা বহুগুণ বাড়াতে পেরেছি।"

    "কিন্তু বিদ্যুৎহীন ঐ দ্বীপে এইসব পরীক্ষা আপনারা করেন কীভাবে?"

    "মূল পরীক্ষাগুলি করি আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ল্যাবে। কিন্তু উৎপন্ন প্রজাতিটির ক্ষমতা যাচাই করতে তাকে আবার রোপণ করি তার আদিভূমি ঐ জনশূন্য দ্বীপে। তাই আমাদের অনবরত যাতায়াত করতে হয়।"

    "কিন্তু যে স্যাম্পলটিকে আপনারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে যাচ্ছিলেন সেটি –"

    বনার্জি গলা একটু নামিয়ে বললেন, "আমাদের গবেষণার সেরা ফসল। আমরা যা ভাবছি তা সত্যি হলে এটা পৃথিবীর শ্বাসকষ্ট দূর করার এক মহৌষধ হবে। শুধু ভাবছি, সবার নজর এড়িয়ে এটা আমরা পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিতে পারব তো?"

    "আমরা বলতে কারা? আর আপনারা কাদের ভয় পাচ্ছেন?"

    "আমরা অর্থাৎ কিছু নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীর এক গোষ্ঠী, যারা সীমান্তহীন, যুদ্ধহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। আমরা চাই আমাদের আবিষ্কারের ফল গোটা পৃথিবী ভোগ করুক। কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্যিক সংস্থার খণ্ডিত স্বার্থ চাইবে এই মাইলস্টোন গবেষণার ফল আত্মসাৎ করে নিজেদের কুক্ষিগত করতে। আমার সন্দেহ, তারা ইতিমধ্যেই কিছু আঁচ পেয়েছে। তাই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ অতি সাবধানে ফেলতে হচ্ছে।"

    "কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও দেশ বা বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্য ছাড়া কি আপনারা পারবেন?"

    "সাহায্যের তেমন দরকার নেই। যা দরকার তা হচ্ছে কেউ যেন এই বিশেষ স্পীসিসকে পেটেন্ট করে তার প্রসারকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে। তার আগেই আমরা চাইছি বিশেষ করে বিভিন্ন ট্রপিকাল কান্ট্রির ঝোপেজঙ্গলে এই 'আগাছা' ছড়িয়ে দিতে।

    “হয়তো জানেন, পৃথিবীর কিছু যুগান্তকারী আবিস্কারের আবিষ্কারক পেটেন্ট নেননি। যেমন, মেরি কুরি তেজস্ক্রিয়তার ও আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিনের পেটেন্ট নেননি, ফলে কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। আমরাও তেমনটাই চাই।"

    "আপনারা সফল হোন।" সঞ্জয় গভীর আবেগে বলল, "আর মিনিট পনেরো পর আমাকে ডিউটিতে যেতে হবে। তবে কাল সকালে আপনাদের ঠিকমতো রেসকিউ বোটে তুলে দেব।"

    নীল দেখলেন, ইতো তাঁদের ইংরেজি বাক্যালাপ বুঝতে না পেরে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি সঞ্জয়কে বললেন, "চলুন, আমরা বরং ঐ বাকি মিনিট পনেরো বাইরে ডেকে হাওয়া খেতে খেতে গল্প করে কাটাই। আর আপনার আপত্তি না থাকলে আমি আপনার কাছে একটা ছোট্ট সাহায্য চাইব।"

    সবে ভোর হয়েছে। প্ল্যানমাফিক শোয়াজল থেকে বোট এসে লেগেছে জাহাজের গায়ে। পিটার, ইতো আর নীল তাঁদের যৎসামান্য লাগেজ নিয়ে নেমে যাবার পর বোট ছেড়েছে। হঠাৎ দেখা গেল ইতো উত্তেজিত হয়ে নীলকে কী বলছেন। তারপরই নীল চেঁচিয়ে বললেন, "ক্যাপ্টেন, আমাদের একটা প্যাকেট ডিপ ফ্রিজে রাখতে দিয়েছিলাম। ওটা নেওয়া হয়নি, দয়া করে এখানে ছুঁড়ে দেবেন?"

    "দেখছি।" ক্যাপ্টেন ভেতরে গেলেন। একটু পরে এসে বললেন, "মুস্কিল হল। ফ্রিজারের চাবি সঞ্জয়ের কাছে। ও এখন ইঞ্জিনরুম লক করে একটা জরুরি কাজ সারছে, অন্তত আধঘণ্টার আগে বেরোবে না।"

    দেখা গেল, নীল বোটচালকের সঙ্গে কথা বলছেন আর সে হাত নেড়ে আপত্তি জানাচ্ছে। তারপর তিনি ইতোকে কী বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইতো পাগলের মতো শরীর ঝাঁকিয়ে শেষ অবধি জলে ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করলেন, পিটার আর নীল তাঁকে অনেক কষ্টে আটকে রাখলেন।

    একটু পরে দেখা গেল, নীল একটা মেগাফোন নিয়ে বলছেন, "সরি ক্যাপ্টেন, আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। কিন্তু পাইলট বলছে আধঘণ্টা কেন, দশ মিনিট দেরি করলেও সমুদ্রের স্রোতের পরিবর্তনের ফলে বোট চালানো মুস্কিল হবে। আমার সহ-বিজ্ঞানী গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পলটা হারানোর ভয়ে পাগল হয়ে জলে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন। আমি তাঁকে বুঝিয়ে শান্ত করছি। পরে আপনার সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে ফোনে কন্টাক্ট করে বলে দেব কীভাবে স্যাম্পলটা রক্ষা করতে হবে আর জাহাজ পোর্টে এলে ওটা কীভাবে পাঠাতে হবে।"

    ক্যাপ্টেন দেখলেন, বোটটা এরপর স্পীড বাড়িয়ে তীরের লক্ষ্যে চলে গেল।


    ।।৩।।

    প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জাপান অভিমুখে চলেছে জাহাজ। সঞ্জয় ডেকে দাঁড়িয়ে। সমুদ্র শান্ত। কিন্তু তার মন তোলপাড় হচ্ছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের ঐ বিজ্ঞানী দুজনের সঙ্গে দেখা হওয়া ও তার পরবর্তী ঘটনাবলীর অভিঘাতে।

    স্যাম্পলের প্যাকেটটি ভুলে জাহাজে থেকে যায়নি। সঞ্জয় ডিউটিতে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে ডেকের নিরালায় দাঁড়িয়ে কথা বলে নীল ঐ ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, তাঁরা এর আগে স্যাম্পলগুলি নিয়ে নিঃশব্দে যাতায়াত করেছেন দেখে কারও নজরে পড়েননি। কিন্তু এখন তাঁরা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ফিরছেন দেখে তাঁদের জিনিসপত্র চেক হবে আর ঐ স্যাম্পলটা সম্ভবত প্রশ্নের সামনে পড়বে। কেন তাঁরা বিনা অনুমতিতে একটি সংরক্ষিত দ্বীপে নতুন প্রজাতি রোপণ করেছেন, হয়তো তার জবাবদিহি করতে হবে। এসবের ফলে স্যাম্পলটা অনভিপ্রেত কারও হাতে গিয়ে পড়তে পারে। তাই নীল ওটা সঞ্জয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে নেমে গেছেন। বলে গেছেন কীভাবে জাহাজে যাত্রার সময় ওটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ওসাকা পৌঁছোলে ওটা কার হাতে তুলে দিতে হবে, সেটা তিনি পরে জানাবেন। ইতো এই ঝুঁকি নিতে রাজি হবেন না ভেবে নীল তাঁকেও কিছু জানাননি। তিনি আরও বলেছিলেন, যদি কোনও কারণে স্যাম্পলটি জাহাজে নষ্টও হয়ে যায়, অনভিপ্রেত হাতে পড়ার চেয়ে সেটাই ভালো। টেটেপেয়ারে ঐ আগাছাটি যেখানে রোপণ করা হয়েছিল, সেখানে অমন আরও চার-পাঁচটি চারা গজিয়েছে। পরের বার গিয়ে তার আরেকটা স্যাম্পল নিয়ে আসাই যাবে। আরও বলে গেছেন, ইতিমধ্যে তিনি সঞ্জয়ের সঙ্গে বার্তা বিনিময় করবেন এনকোডেড ই-ফাইল মারফত। তার পাসওয়ার্ডও তিনি সঞ্জয়কে বলে গেছেন।

    এই অবধি একরকম ছিল। কিন্তু তার ক'দিন পর নীলের জরুরি বার্তা পেয়ে সঞ্জয়ের ঘুম ছুটে গেছে। তিনি সখেদে জানিয়েছেন, ঐদিনের ঝড় ও সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে ঐ আগাছার চারাগুলি সব ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্থাৎ তার সবেধন নীলমণিটি এখন সঞ্জয়েরই কাছে! এটিও যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে তাঁদের প্রচেষ্টা অন্তত এক বছর পেছিয়ে যাবে। তাতে যে শুধু বায়ুদূষণ বিরোধী অভিযান পেছিয়ে যাবে তাই নয়। ইতিমধ্যে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেলে সমস্ত প্রচেষ্টাটাই পণ্ড হয়ে যেতে পারে।

    তাই সঞ্জয় প্রতিদিন চারাগাছটিকে বের করে তার পরিচর্যা করছে। মাঝে মাঝে নীল নির্দেশিত সলিউশন বা তার কাছাকাছি যা পাওয়া যায় তা দিয়ে ধুচ্ছে। কাঁচের বাক্সে রেখে 'গ্রীনহাউস এফেক্ট'এর সাহায্যে সূর্যের তাপ লাগাচ্ছে। আর রোজ শঙ্কাভরে দেখছে যে পাতাগুলি যেন শুকিয়ে না যায়। অবশ্যই কাজগুলি তাকে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের দুরূহ দায়িত্ব পালনের ফাঁকে ফাঁকে করতে হচ্ছে।

    জাহাজের যখন ওসাকা পৌঁছোতে আর দিন দশেক দেরি, তখনও ওসাকায় কাকে গাছটা দিতে হবে সে সম্বন্ধে নীলের কোনও মেইল এল না দেখে সঞ্জয় উদ্বিগ্ন। কিন্তু তারপর যখন সেই প্রতীক্ষিত মেইল এল, তার দুশ্চিন্তা দূর না হয়ে আরও বেড়ে গেল। নীল গাছটি হস্তান্তরের ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে লিখেছেন, "The first Pope's sweet canary song is creating the expectation of floral welcome at the incline of the big hill." অর্থাৎ, "প্রথম পোপের ময়নার মতো মধুর সঙ্গীত পর্বতের ঢালে সপুস্প অভ্যর্থনার প্রত্যাশা তৈরি করছে।"

    অফ ডিউটিতে বার্থে শুয়ে সঞ্জয় আকাশপাতাল ভেবে চলেছে। এই বার্তার মানে কী? অল্প সময়ে যেটুকু দেখেছে, নীল ধীরস্থির, ধীমান বিজ্ঞানী। তিনি অযথা ঠাট্টা করার মানুষ নন, হঠাৎ তাঁর মস্তিস্ক বিকৃতির আশঙ্কাও করা যায় না। তবে?

    ভাবতে ভাবতে মনে হল, এ নিশ্চয়ই কোনও সাঙ্কেতিক বার্তা। তার মানে, হয়তো কোনও বিপদ হয়েছে। আর নীলের আশঙ্কা, তাঁর পাঠানো মেইল পরীক্ষা করা হতে পারে। তাই পাসওয়ার্ড প্রোটেক্ট মেসেজ পাঠিয়েও তিনি স্বস্তিতে নেই। অধিকন্তু হিসেবে তাঁর বার্তা সঙ্কেতে পাঠিয়েছেন, যার মানে সঞ্জয় উদ্ধার করতে পারবে বলেই তাঁর বিশ্বাস।

    সুতরাং সঞ্জয় ভাবতে বসল। প্রথম পোপ মানে? কে তিনি? জানা ছিল না দেখে ইন্টারনেট ঘেঁটে সঞ্জয় বের করল, সেন্ট পিটার।

    তাঁর সঙ্গে নীল বা সঞ্জয়ের কী? কী যেন অস্পষ্ট মনে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে শেষে মনে পড়ল, নীলদের বোটচালকের নাম ছিল পিটার!

    সে ক্যানারির মতো গাইছে মানে? ওঃ, Singing like a canary কথাটার ইংরেজি বাগধারায় অর্থ, হড়হড় করে সব বলে দিচ্ছে। অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের জেরায় বা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে পিটার গাছের ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়েছে। হয়তো জানিয়েছে সেটা এই জাহাজে ওসাকা চলেছে।

    তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? সঞ্জয় এবার নীলের মেসেজের পরের অংশটা নিয়ে পড়ল। পর্বতের ঢালে সাদর অভ্যর্থনা? কথাটার মধ্যে কি ব্যঙ্গ রয়েছে? কী সন্দেহ হওয়ায় আবার ইন্টারনেট খুঁড়ে পেল, ওসাকা মানে বড় পাহাড় বা তার ঢাল। অর্থাৎ নীল আশঙ্কা করছেন, পিটারের বিবৃতির ফলে জাহাজ ওসাকায় ভিড়লে 'অভ্যর্থনা কমিটি' তৈরি থাকতে পারে। তারা কর্তৃপক্ষ না প্রতিপক্ষ, কে জানে! তবে ব্যাপারটা সুবিধের না হওয়ারই কথা।

    এখন কী কর্তব্য, নীল কিছু পরামর্শ দেননি। সম্ভবত তিনি ব্যাপারটা সঞ্জয়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সে সহজেই স্যাম্পলটা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে নিজের ওপর থেকে সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে।

    সঞ্জয় চোখ বুঁজল। এক মৃত্যুপথযাত্রী তার সামনে শুয়ে একটু ওষুধের প্রতীক্ষায়। কিন্তু দেরি, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।

    না, এবার আর সে দেরি হতে দেবে না। পৃথিবী এক গভীর অসুখে ভুগছে। তার নিরাময়ের কাজ অবিলম্বে শুরু করতে হবে। তার জন্য সে প্রাণের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত।

    তবে একেবারে একা পারবে না, একটু মদত চাই। কিছুক্ষণ ভাবার পর তার মুখে খুশির রেখা দেখা দিল। এবার বোধহয় নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে।

    "তুমি তো বলেছিলে এই ট্রিপের পর ইন্ডিয়া ফিরে যাবে। হঠাৎ মত বদল?" ক্যাপ্টেন বললেন।

    সঞ্জয় মাথা চুলকে বলল, "স্যার, ভাবছিলাম তেমন তো তাড়া নেই। তাই ফালতু ফ্লাইটে না ফিরে যদি ইন্ডিয়া অবধি একটা ট্রিপ মেরে কিছু বাড়তি রোজগার করা যায়।"

    ক্যাপ্টেন একটু ভেবে বললেন, "জানোই তো, আমরা এর পর ইন্ডিয়া যাচ্ছি না। তবে দেখি, আমাদের সহযোগী এক শিপিং লাইন আছে, তাদের কিছু থাকতে পারে। তুমি কাল এসো।"

    পরদিন দেখা হতেই ক্যাপ্টেন হাসিমুখে বললেন, "হ্যাঁ, একটা জাহাজ দশ দিন পর কোবে থেকে চেন্নাই যাচ্ছে। অবশ্য ন'হাজার টনের ছোট জাহাজ, ক্রু-ও জনা দশেক। আমি তোমার কেস হাইলি রেকমেন্ড করেছি। ওরা তো দারুণ খুশি এমন একজন এক্সপিরিয়েন্সড ইঞ্জিনিয়ার পেয়ে। ওরা আজই তোমাকে কমিউনিকেট করবে, তারপর মেইল চালাচালি করে কাগজপত্র তৈরি করে রাখবে। শুধু আশা করছি আমরা যেন ন'দিনের মাথায় পৌঁছে যেতে পারি, তাহলে জাহাজটা ধরতে পারবে।"

    "মেনি থ্যাঙ্কস, স্যার।" সঞ্জয় একটু ইতস্তত করে বলল, "আর একটা কথা। কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে, তাকে বলার দরকার নেই আমি কীভাবে দেশে ফিরছি। শুধু বলবেন, রিলিজ হয়ে আমি চলে গেছি, হয়তো ফ্লাইট ধরে দেশে ফিরে গেছি।"

    কিছুক্ষণ সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, "আচ্ছা, ঐ বিজ্ঞানী যে প্যাকেটটা ফেলে গেছিলেন, সেটা কীভাবে ফেরত দিতে হবে খবর পাঠিয়েছেন?"

    ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে না তাকিয়ে সঞ্জয় বলল, "হ্যাঁ, ঐ আর কী।"

    ক্যাপ্টেন চিন্তিত মুখে বললেন, "মনে হচ্ছে, কোনও অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইলে যাচ্ছ? তা যাও, আমি জানি কোনও বেআইনি কাজে তুমি জড়াবে না। তবে সাবধানে থেকো।"

    "মেনি থ্যাঙ্কস, স্যার। আমি কী কাজে যাচ্ছি এক্ষুনি বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, আমি সফল হলে পৃথিবীর খুব উপকার হবে।"

    "মে গড ব্লেস ইউ, মাই বয়।"

    সঞ্জয় যখন সিদ্ধান্ত নিল চারাগাছটি নিয়েই যাবে, তখনই বুঝেছিল ফ্লাইটে দেশে ফেরা অসম্ভব। চারাটাকে চেক-ইনে দিলে নিশ্চিত নষ্ট হয়ে যাবে। আর ক্যারি-অনে নিতে হলে সিকিউরিটি ও এয়ারলাইনকে বোঝাতে জান বেরিয়ে যাবে। তার ওপর এখন পেছনে ফেউ!

    অবশ্য তার জাপানের ভিসা আছে। ঘুরেফিরে গাছটাকে কোনও নিভৃত এলাকায় পার্কে বা জঙ্গলে পুঁতে চলে যাওয়া যায়। তবে নীল কোনও 'ট্রপিকাল কান্ট্রি'তে চারাটা রোপণের কথা বলেছিলেন। জাপান ঠিক তা নয়।

    অগত্যা সঞ্জয় জাহাজে দেশে ফেরার কথা ভেবেছিল। জাহাজিদের লাগেজ নিয়ে অত সমস্যা নেই। ক্যাপ্টেনের সহায়তায় কাজটা পেয়ে গেল। এখন অধীর অপেক্ষা, জাহাজ কখন ওসাকা পৌঁছোয়।

    জাহাজ পৌঁছোল সময়ের একটু আগেই। তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। জাহাজ জেটি ছুঁতে না ছুঁতেই সঞ্জয় মালপত্র নিয়ে লাফিয়ে নেমে দ্রুত পা চালাল।

    "শুনছেন?" অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো এক মূর্তি বেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। এক ব্যক্তিত্ববান মাঝবয়সী জাপানি পুরুষ। সঞ্জয়ের বুকটা ধক করে উঠল।

    "আপনি কি এই জাহাজটার থেকে আসছেন?"

    "ঠিক তা নয়। ক্যাপ্টেন আমার চেনা। তাই চট করে একবার দেখা করে এলাম।"

    "ওখানে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জয় মোরে বলে কেউ আছেন?"

    "নাম তো জানি না। তবে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে দেখলাম ইঞ্জিনরুমে। তাড়াতাড়ি যান, পেয়ে যাবেন।"

    লোকটি জাহাজের দিকে পা বাড়ালে সঞ্জয় দ্রুত জাহাজঘাটার অলিগলি দিয়ে উধাও হয়ে গেল। এখানে সে আগেও এসেছে। একটা ট্যাক্সি ধরে কোবে পোর্টে যেতে বড়জোর মিনিট পনেরো। সেখানে প্রথম কাজ চেন্নাইয়ের জাহাজে রিপোর্ট করা। জাহাজ সন্ধেবেলা ছাড়বে। ইতিমধ্যে সে আশেপাশে ঘুরে কিছু দরকারি জিনিস কিনে নেবে, যার মধ্যে রয়েছে ঐ চারাগাছটি রক্ষার কেমিকাল।

    ওরা তাকে খুঁজলেও সম্ভবত এয়ারপোর্টে যাবে। কোবেতে আসার কথা কারও মনে হবে না।

    ।।৪।।

    জাহাজটি ছোট। সঙ্কীর্ণ মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে চলার পক্ষে এই জাহাজই বেশি উপযুক্ত। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে বড় জাহাজেও এখন বেশি ক্রু লাগে না। এই ছোট জাহাজে যে দশজন আছে, তাই যথেষ্ট।

    তবে তারা আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সড়গড় একজন ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছিল। সঞ্জয়কে পেয়ে বর্তে গেছে।

    চারাগাছটি দেখে কিছু ক্রু একটু হাসিঠাট্টা করেছিল। সঞ্জয় তাদের গম্ভীরভাবে বলেছে, "সিডনির একজন ফরচুন টেলার বলেছে, এই গাছ দেশের মাটিতে পুঁতে দিতে পারলে আমার ভাগ্য খুলে যাবে।"

    "ভাগ্য খুলে যাবে?" ক্রু-দের হাসিতামাশা মুহূর্তে বন্ধ।

    "হ্যাঁ। তবে দেশের মাটিতে লাগাতে হবে। তদ্দিন একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"

    চেন্নাই পৌঁছোতে সাতাশ-আটাশ দিন। সেখান থেকে ট্রেনে মুম্বই আর দিন দুয়েক। সঞ্জয় দিন গুনছে আর দেখছে চারাটি একটু একটু করে বড় হচ্ছে। এটাকে সে তাদের বাড়ির থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের ন্যাশনাল পার্কের বিস্তৃত জঙ্গলের কোথাও পুঁতে দিয়ে আসবে, যাতে উদ্ভিদশিশুটি মাটি আর আলোর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি নিয়ে যথেচ্ছ বংশবৃদ্ধি করতে পারে। তারপর যেভাবে হোক নীলকে খবর দেবে।

    জাহাজ মাঝে মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন মালয়েশিয়ার ক্লাং বন্দরে থামল। এখানে কিছু মাল নামল, কিছু উঠল। একটা পেটির দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সঞ্জয় ক্যাপ্টেনকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিল। ক্যাপ্টেন তাকে থামিয়ে বললেন, "এরা আমাদের বহুদিনের ক্লায়েন্ট, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।"

    এই জাহাজপথটি ইদানিং কিছুটা শঙ্কাজনক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন মহাশক্তির পাঞ্জা লড়াইয়ের অন্যতম ক্ষেত্র এখন এই অঞ্চল। তাই ফিলিপাইন উপসাগর ও দক্ষিণ চিন সাগর ছাড়িয়ে মালাক্কা প্রণালীতে পড়লে অনেকটা নিশ্চিন্তি। এবার আন্দামান সাগর আর বঙ্গোপসাগর পেরোলেই দেশের মাটি।

    কিন্তু বিপর্যয়টা এল প্রায় ঘরের দোরে এসে। জাহাজ তখন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ আকাশে দেখা গেল কিছু দ্রুতগতি ড্রোনের আনাগোনা আর কানে এল কিছু বিস্ফোরণের শব্দ। চিন্তিত সঞ্জয় ক্যাপ্টেনের কাছে ছুটল।

    ক্যাপ্টেনও চিন্তিত। বললেন, "কোনও সংঘর্ষের খবর নেই। তবে এখানে মাঝে মাঝে যুদ্ধের মহড়া চলে। কিন্তু তেমন কিছু হলে তো কম্পানি বা গভর্মেন্ট আগেই জানায়।"

    বলতে না বলতেই মেসেজ এল, "ক্যাপ্টেন ক্রিস্টফার, তোমরা যেখানে, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের সেই অঞ্চলে এক্ষুনি এক লাইভ ওয়ার এক্সারসাইজ হবে। নিরাপত্তার জন্য তোমাকে কোর্স চেঞ্জ করতে বলা হচ্ছে।"

    "বুলশিট, ইট'স টু লেট। এখন আমরা মহড়ার মধ্যে। নাউ জাস্ট প্রে ফর আস।" ক্যাপ্টেন লাইন ছেড়ে সবাইকে দ্রুত নির্দেশ দিতে আরম্ভ করলেন।

    আধঘণ্টার মতো এমন ব্যস্ততায় কাটার পর হঠাৎ দেখা গেল একটা আগুনের গোলা কোত্থেকে এসে একটা ড্রোনকে আঘাত করল। সভয়ে সবাই দেখল, পাক খেতে খেতে ড্রোনটা তাদের দিকেই নেমে আসছে। তারপর সবাইকে আশ্বস্ত করে সেটা সামান্য দূরে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ল।

    কিন্তু সে স্বস্তি সাময়িক। ড্রোনটি সমুদ্রে পড়েই সশব্দে বিস্ফোরিত হল আর তার একটা টুকরো ছিটকে এসে জাহাজের খোলের দিকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আগুন ধরে গেল।

    "ডাবল আপ, উইথ দ্য ফায়ার এক্সটিংগুইশার!" সঞ্জয় চেঁচিয়ে উঠে দৌড়োল। কিন্তু ক্যাপ্টেন শক্ত হাতে তাকে ধরে ফেললেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

    তবে পরমুহূর্তেই তিনি ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক স্বরে চেঁচিয়ে বললেন, "আমি ক্যাপ্টেন ক্রিস্টফার হুকুম দিচ্ছি, একটা ইমার্জেন্সি দেখা দিয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের জাহাজ ত্যাগ করতে হবে, নইলে কেউ বাঁচব না। লাইফ বোট দুটো নামাও।"

    তিনি কাউকে কোনও তর্কের সুযোগ দিলেন না। কয়েক মিনিটের মধ্যে দশজন জাহাজি দুটো বোটে ভাগ হয়ে জাহাজের থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। ক্যাপ্টেন সঞ্জয়ের বোটে ছিলেন। অবাক সঞ্জয় বলল, "ক্যাপ্টেন, আপনি জাহাজ বাঁচাবার চেষ্টা করলেন না?"

    "অসম্ভব!" ক্যাপ্টেন ক্লান্তস্বরে বললেন, "তোমার চোখ আছে। ক্লাং বন্দরে যে পেটিটা তুমি দেখিয়েছিলে, তাতে এক্সপ্লোসিভ ছিল। না, কোনও বেআইনি সংগঠন এতে যুক্ত নয়। এক বিধিবদ্ধ কোম্পানি আরেক বিধিবদ্ধ কোম্পানিকে মালটা পাঠাচ্ছে পাহাড় ভেঙে পথ করার কাজে লাগবে বলে। এমনিতে পদার্থটা খুব স্থায়ী, বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু আগুন আমরা নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই তার উত্তাপে পেটিটা নিশ্চিতই বিস্ফোরিত হয়ে নরকের দরজা খুলে দিত। এখন আশা করা যাক বিস্ফোরণের আগেই আমরা যেন নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারি।"

    তাড়াতাড়িতে জাহাজিরা তাদের অত্যন্ত দরকারি জিনিসগুলিই শুধু আনতে পেরেছে। তার মধ্যেই সঞ্জয় তার চারাগাছটি এনে যত্ন করে ধরে রেখেছে। সেদিকে তাকিয়ে একজন ক্রু ব্যঙ্গের সুরে বলল, "তোমার লাকি চার্ম – সত্যিই আমাদের জন্য দারুণ সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে!"

    দৃঢ়কণ্ঠে সঞ্জয় বলল, "গুড লাক ওটাকে আমার দেশের মাটিতে পুঁতে দিতে পারলে তবেই। আর সেটা বেশি দূরে নয়। ঐ দ্যাখো।"

    সত্যিই, সামনে সন্ধ্যার আবছায়ায় একটা দ্বীপের রূপরেখা চোখে পড়ছে। আন্দামান! ক্যাপ্টেনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। "বোট চালাও!" তিনি বললেন, "আমরা ডাঙা পেয়ে গেছি।"

    কিন্তু উপকূলের কাছে এসে ম্যাপ দেখে তিনি বলে উঠলেন, "সর্বনাশ, বোট ঘোরাও, এখানে নয়। এটা নিষিদ্ধ জারোয়া দ্বীপ। ঐ জংলি মানুষেরা সভ্য মানুষ দেখলেই তির ছুঁড়ে মেরে ফেলে।"

    "কে জানে সভ্য-অসভ্য কাকে বলে।" সঞ্জয় দূরের জ্বলন্ত জাহাজের দিকে তাকিয়ে বলল, "বোধহয় বিষাক্ত তিরের চেয়ে উন্নত কোনও মারণাস্ত্র নেই দেখেই ওরা অসভ্য। তবে প্লীজ, বোট তিরে নিয়ে চলুন। আপনারা বোটে থাকুন, আমি এই চারাগাছটা লাগিয়েই ফিরে আসছি।"

    "নেমো না, তোমার বিপদ হতে পারে।"

    "আমার কিছু হবে না – এই 'লাকি চার্ম' আছে না?" সঞ্জয় হেসে বলল, "আপনি শুধু আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন। আমি যাব আর আসব।"

    "বেশ। তবে শুধু আধঘণ্টা।" দ্বিধাভরে বললেন ক্যাপ্টেন।

    ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সঞ্জয়। অবশেষে একটা জায়গা পছন্দ হল, যেখানে মাটি নরম ও আর্দ্র আর পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়বে। পকেট থেকে স্ক্রু-ড্রাইভারটা বের করে দ্রুতহাতে মাটি খুঁড়ে সে চারাটাকে সযত্নে রোপণ করল।

    "এক আদিমের সন্তান, তোমাকে আরেক আদিমের কাছে সমর্পণ করলাম। যাও, তুমি সভ্যতার বিষ হরণে সাহায্য করো।" আবেগভরে বলে সঞ্জয় ফেরার পথ ধরল।

    যখন সে উপকূলে, দেখল দূর দিগন্তের কাছে সমুদ্র আগুন আর রক্ত বমন করে এক মহা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments