• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯১ | জুলাই ২০২৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সমুদ্রজিৎ : অচিন্ত্য দাস



    উনিশশো নব্বই সালের মে মাসে একদিন টিভি আর রেডিওতে শোনা গেল বঙ্গোপসাগরে ভীষণ এক ঝড় ফুঁসে উঠছে। দু-তিন দিনের মধ্যে সে উপকূলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পরের দিনই সতর্ক-বার্তা জারি করা হলো। অন্ধ্রপ্রদেশের দীর্ঘ সমুদ্রতটে অনেক মাছধরা জেলেদের গ্রাম – প্রায় দেড় লাখ মানুষকে নিরাপদ উঁচু জায়গায় সরানো হলো। তবু আরও বিশ-ত্রিশ হাজার মানুষ নানা কারণে গ্রামেই রয়ে গেল। সমুদ্র ক্রমে অশান্ত হয়ে উঠল, জোরে দমকা হাওয়া বইছে, এই বোধহয় ঝড় এসে গেল! ভয়ে কারোর ঘুম এল না রাতে …।

    রাত্তির দুটোর সময় কিরণ সান্যালের বাড়িতে ফোন বেজে উঠল। অফিস থেকে এডিটর সাহেব বললেন “কিরণবাবু, আপনি ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ুন, ভোরের ফ্লাইটে বিশাখাপত্তনম। ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে খবর পাচ্ছি। ঘন্টায় একশ মাইলেরও বেশি গতিতে ঝড় বয়ে গেছে, সাগরে কুড়ি ফুট অবধি উঁচু ঢেউ উঠেছিল। চাক্ষুষ দেখে রিপোর্ট পাঠাবেন। আসলে ব্যাপারটা এত ভয়ানক মাপের যে জুনিয়র কাউকে পাঠাতে ভরসা হচ্ছে না।

    খবরের কাগজের লোকেদের টিকিট পাওয়ার ঝামেলা নেই, আলাদা ব্যবস্থা থাকে। কিরণবাবু দুপুরের ভেতর পৌঁছে গেলেন। যা দেখলেন তা কথায় বর্ণনা করা যায় না। গ্রামের পর গ্রাম স্রেফ ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে। মিলিটারি, স্বেচ্ছাসেবীর দল মৃতদেহ সরাতে ব্যস্ত। সাগরের জল এখনো সব জায়গা থেকে নামেনি, বহু ভাসমান পশুর দেহের অংশ দেখা যাচ্ছে জলের ওপর। কিরণবাবু তাঁর আটত্রিশ বছরের জীবনে খবরের কাগজের কাজে বেশ কয়েকটা প্রাকৃতিক বির্পযয় দেখেছেন ঠিকই কিন্তু এত ভয়াবহ ধ্বংসলীলা কখনও দেখেননি। ঘুরে ঘুরে যতটা পারা যায় খবর আর তথ্য যোগাড় করে সন্ধের দিকে হোটেলে বসে ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলেন।

    পরদিন ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়তে হলো – ত্রাণশিবিরগুলোতে মানুষেরা কী অবস্থায় আছে তা এখনও দেখা হয়নি। এ নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তি লিখে পাঠাতে হবে।

    যা দেখলেন তাতে খুব শক্ত মানুষেরও চোখে জল এসে যাবে। শয়ে শয়ে গৃহহারা মানুষজন স্থানীয় ইস্কুল-কলেজ বা হাসপাতালের উঠোনে বসে আছে। তাদের সর্বস্ব গেছে, এমনকি তাদের পরিবারও এক সঙ্গে নেই। ছেলে-মেয়ে-মা-বাবা কে কোথায় তারা জানে না।

    খবর সংগ্রহ করার কাজ চলছিল – কিরণবাবু একটা ইস্কুল-বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। মানে থামতে হলো। একটা বছর দুই-আড়াইএর ছেলে তাঁর পা জড়িয়ে ধরেছে। শিশুটি কথা ঠিক বলতে পারে না, বললেও ভাষা আলাদা। তবু প্রাণপণে কিছু একটা বলতে চাইছে। কিরণবাবু নিচু হতেই ছেলেটি পট করে ওনার কোলে উঠে পড়ল। যাঃ বাবা, এ তো বড় মুশকিলে পড়া গেল … ছেলেটিকে যত নামানোর চেষ্টা করেন সে তত কিরণবাবুকে তার ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে। একজন স্বেচ্ছাসেবী বলল “আপনাকে হয়তো এর বাবা বা কোনো পরিচিতের মতো দেখতে, তাই বেচারা ভুল করছে।”

    এতক্ষণ অচেনা অজানা পরিবেশে থেকে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করছিল ছেলেটা – কিরণবাবুকে কোনো কারণে চেনা মনে হওয়াতে সে আর ছাড়তে চাইছে না। কী করবেন কিরণবাবু? জোর করে শিশুটিকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে নিজের কাজে চলে যাবেন?

    পারলেন না। তিনি যা ভাবছিলেন পাশ থেকে একজন অনেকটা তাইই বলল “দাদা, পারলে একে নিয়ে যান। বাড়িতে মানুষ করবেন। এর মনে হয় আর কেউ নেই… একাই ভগবানের কৃপায় কোনরকমে বেঁচে গেছে।”

    কিন্তু একটা শিশুকে এ ভাবে নিয়ে আসা যায় না। কিরণবাবু আঞ্চলিক থানায় গেলেন। অফিসারের সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছিল খবরের ব্যাপারে। বললেন ঘটনাটা। অফিসার বললেন “বাচ্চাটার একটা ছবি তুলে আমাকে দিয়ে যান, আর কিছু কাগজ-পত্রে সই করতে হবে। ঠিকানা, ফোন নম্বর দিতে হবে। ধরুন এর মা অথবা বাবা বেঁচে আছে, কিছুদিন পরে এসে খোঁজ করল, তখন আপনাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।”

    কিরণবাবুকে রাজি হতেই হলো। একটা দু-বছরের শিশুর গলা জড়িয়ে থাকা ছোট্ট হাতের মায়া উনি কাটাতে পারলেন না।

    ***

    বিয়ে-থা করেননি, তাই বাড়িতে সেরকম ব্যবস্থা নেই। একজন বয়স্কা মহিলাকে রাখলেন শিশুটির দেখাশোনা করার জন্য। আরও একটা কাজ তাঁকে করতে হলো – এর নাম তো জানা নেই, এ বলতেও জানে না। নাম তো একটা দিতে হয়।

    নাম দিলেন সমুদ্রজিৎ। সমুদ্রের ভীষণ রোষ এর কিছু করতে পারেনি। সমুদ্রজিতের থেকে ভালো নাম আর কিছু হতেই পারে না।

    সমুদ্রজিৎ থেকে ডাকনাম হয়ে গেলো সমু। দিন যায়, বছর কাটে। সমু বড় হতে লাগল। ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সমু অবশ্য বাংলায় কথা বলা শিখেছে – মা-বাবার কথা, গ্রামের বাড়ির কথা, নিজের ভাষা যেটুকু জানত সব ভুলে গেছে। তা তো ভুলবেই – অত ছোট বয়সের কথা কারোর মনে থাকে না। এতদিন হয়ে গেল সমুর খোঁজখবর কেউ করেনি। মানে তার বাবা-মা সত্যিই বেঁচে নেই। সমু কিরণবাবুকে বাবা বলে জানে, বাবা বলে ডাকে।

    দেখতে দেখতে সমু ক্লাস সেভেন-এ উঠে গেল। গায়ের রং শ্যামলা, টানা দীঘল চোখ। অন্য ছেলেদের থেকে খানিকটা লম্বা। পড়াশুনোতে অত ভালো নয়, তবে পাশ করে যায়। হ্যাঁ, খেলায় খুব ভালো। স্পোর্টসে মেডেল পায়। সবই ভালো চলছিল এমন সময় সমুর একটা ব্যাপারে কিরণবাবুর খটকা লাগল। এটা তো ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না।

    ইস্কুল থেকে সমুদের চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিল। খুব ঘুরল সবাই, খাওয়াদাওয়া হলো। ফেরার সময় খেয়াল হলো সমু নেই। কোথায় গেল?

    অনেক খোঁজার পর তাকে পাওয়া গেল জলের ধারে। চিড়িয়াখানার ভেতরে একটা বড় বিল আছে, সেখানে। পাড়ে চুপ করে বসে একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সমু। তার আর কোন হুঁসই নেই। যাইহোক তাকে নিয়ে সকলে ফিরে এল।

    ঠিক একই ঘটনা আরেক বার। ঢাকুরিয়া লেকের মাঠে ফুটবল খেলা ছিল। খেলার শেষে সমু আবার বেপাত্তা। যারা চিড়িয়াখানার ঘটনাটা জানত, তারা জলের ধারে খুঁজতে লাগল। ঠিক, ওরা যা ভেবেছিল তাই। এক জায়গায় জলের কিনারায় সমু বসে আছে, জলের দিকে তাকিয়ে একমনে কী যে দেখছে, কী যে ভাবছে কে জানে।

    তিন নম্বর ঘটনাটা বেশ একটু বাড়াবাড়ির দিকে গেল। শহর থেকে দূরে এক বাগানবাড়িতে শীতের ছুটিতে পিকনিক। আবার সমু দল থেকে উধাও। এবার তাকে দেখা গেল অনেক দুরে একটা দিঘির ধারে – সে তখন দিঘিতে নেমে গেছে – হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে।

    কিরণবাবুর মনে চিন্তা ঢুকল। কী করা যায়? আর কেনই বা সমুর জলের দিকে এত টান!

    কিরণবাবুর আপিসের এক বন্ধু একটা ভালো পরামর্শ দিলেন। “আপনি বরং সমুকে সাঁতার শেখার ক্লাবে ভর্তি করে দিন। সাঁতার জানা থাকলে জলে নামলেও ডুববে না।” বুদ্ধিটা কিরণবাবুর মনে ধরল।

    একদিন বিকেলে সমুকে নিয়ে কিরণবাবু গেলেন কাছাকাছি একটা সাঁতারের ক্লাবে। বলাইদার ক্লাব। বলাইদা পাড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেদের শেখাচ্ছিলেন। বললেন “কোন ক্লাসে ভর্তি হবে?”

    “মানে?”

    “হেই পা চালা, পা চালা – সাঁতার মানে পা চালানো, হাতে জোর দিবি না ..” কয়েকটা ছেলে রেলিং ধরে ধরে জলে হাত-পা ছুঁড়ছিল। এরা সবাই শিখছে। বলাইদা ব্যস্ত মানুষ, অত বলার সময় নেই। আঙুল দিয়ে ওদিকের একটা বোর্ড দেখিয়ে দিলেন। একটা চটা ওঠা বোর্ড রয়েছে বটে। তাতে লেখা – ক্লাস ওয়ান: যাহারা সাঁতার জানে না। ক্লাস টু: যাহারা জানে কিন্তু ভালো করিয়া শিখিতে চাহে। ক্লাস থ্রী: যাহারা প্রতিযোগিতায় অংশ লহিতে চাহে।

    বলাইদাকে কাছে পেয়ে কিরণবাবু বললেন – “ক্লাস ওয়ান”

    “ঠিক আছে। কাল থেকে …”

    কিরণবাবু সমুকে বলতে গেলেন যে কাল থেকে আসতে হবে, কিন্তু কোথায় সমু? এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখেন সমুর শার্ট আর গেঞ্জি পড়ে রয়েছে, সমু নেই। এদিকে হঠাৎ সোরগোল উঠল – জলে যারা সাঁতার শিখছিল তারা সবাই চেঁচাচ্ছে “আরে আরে নতুন ছেলে লাল দড়ি পেরিয়ে গেল যে, বলাইদা ও বলাইদা…”

    লাল দড়ির ওদিকে জল অনেক গভীর, সেখানে ক্লাস থ্রী ছাড়া আর কারোর যাওয়ার অনুমতি নেই। আর এখন তো কেবল ক্লাস ওয়ান আর টু চলছে। বলাইদা দৌড়ে আগিয়ে গেলেন। বেগতিক দেখলেই ঝাঁপ দেবেন।

    কিন্তু দরকার হলো না।

    লাল দড়ি পেরিয়ে অনেকটা দূরে পঞ্চাশ মিটার মাপ করা কাঠের খুঁটি ছিল একটা। সেটা ছুঁয়ে সমু তরতর করে ফিরে এল। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে, পাড়ে উঠে ভিজে প্যান্টে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কেন যে এমন করল তা সে নিজেই জানে না।

    বলাইদা সমুকে ছেড়ে কিরণবাবুর দিকে চোখ পাকিয়ে তেড়ে এলেন। “মস্করা হচ্ছে – অ্যাঁ, মস্করা হচ্ছে আমার সঙ্গে! এ ছেলে ক্লাস ওয়ানে!”

    কিরণবাবু বলাইদার হাত ধরে বললেন “সত্যি বলছি, আমি জানতাম না যে সমু সাঁতার জানে।”

    “আবার মস্করা, আবার মস্করা হচ্ছে! বাবা হয়ে জানেন না ছেলে সাঁতার কাটতে পারে কি না – কেমন বাবা রে বাবা!

    কিরণবাবু অনেক কষ্টে বলাইদাকে শান্ত করে বললেন – “আজ যাই, এ তো ভিজে সপসপ করছে। কাল এসে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলব …”

    বলাইদা বললেন “তাই আসুন। তবে ছেলেকে আনতে ভুলবেন না। ক্লাস থ্রীতে নেব।”

    বলাইদার জহুরির চোখ। ঠিক বুঝে নিয়েছেন তালিম দিলে এ ছেলে ভালো সাঁতারু হবে।

    পরের দিন যখন সমু ক্লাস থ্রীর পড়া থুড়ি সাঁতার অভ্যাস করছে তখন বলাইদাকে কিরণবাবু বললেন যে সমু তাঁর নিজের কেউ নয়। সাইক্লোন বিধ্বস্ত উপকূল থেকে কীভাবে সমুকে পেয়েছিলেন, সব ঘটনা জানালেন।

    সমু তো বলাইদাকে গুরু মেনে সাঁতারের কায়দা শিখতে লাগল। আর এদিকে বলাইদার সঙ্গে কিরণবাবুর ভারি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আপনি থেকে তুমিতে আসা বন্ধুত্ব। দুজনে প্রায়ই চায়ের দোকানে কিংবা বাড়িতে বসে গল্পগুজব করেন। বলাইদা একদিন বললেন “আমার মনে হয় সমুর সাঁতার জানার গুপ্তরহস্য আমি আন্দাজ করতে পেরেছি ... ওরে আরেকটা করে চা দেখি, এলাচ দিবি ...” চা নিয়ে বলাইদা শুরু করলেন।

    “বুঝলে কিরণ, আমি কয়েক বার উড়িষ্যা আর অন্ধ্রতে সমুদ্রের ধারে জেলেদের গ্রামে গিয়েছি। একবার তো কী একটা নদীর মোহনার কাছে জেলেদের গ্রামে দুদিন ছিলামও। কী দেখেছিলাম জানো? দেখেছিলাম ওখানে শিশুরা ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই সাঁতার শিখে যায়। সারাদিন জলে জলে থাকে তো। আমার মনে হয় সেই ঝড়ের দিন সমুদের মাটির ঘর ভেঙে পড়ে জলে ডুবে গিয়েছিল। ওর বাবা, মা অথবা বড়রা পড়ে যাওয়া দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে জল কেটে বেরুতে পারেনি। দুবছরের শিশুটি কোনো একটা ছোট ফোকর দিয়ে সাঁতরে বেরিয়ে আসে এবং বেঁচে যায়। আসলে কী জানো, সাঁতার একবার শিখলে তা শরীরের রক্তে মিশে যায়। তা আর ভোলা যায় না। সাঁতার জানে কি জানে না তা মনে না থাকলেও সাঁতার কাটা সে ভোলেনি।

    “আরও কী মনে হয় জানো … ওর মনের অনেক গভীরে সেই বাব-মা-ভাই-বোন-পাড়াপড়শিদের সঙ্গে জলে হুটোপুটি করার স্মৃতি রয়ে গেছে। অত ছোটবেলার স্মৃতি বোবা হয়, সে স্মৃতি কিছু বলতে পারে না। তবু তার রেশটুকু তাকে বারবার জলের ধারে নিয়ে যেত। ও বুঝতে পারত যে জলের সঙ্গে ওর খুব কাছের সম্পর্ক আছে। সেটা কেন বা কীভাবে তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারত না।

    “ক্লাবে যেদিন দেখল একদল ছেলেপিলে জলে নেমে সাঁতরাবার চেষ্টায় হুটোপুটি করছে, সে আর থাকতে পারল না। মনের ভেতরে আর একটা মন থাকে – সেখান থেকে হয়তো কেউ বলে উঠেছিল, আরে এই ছেলে, ওখানে কী করছিস – জলে আয় জলে আয়... ব্যাস, সমু আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ঝপাৎ করে জলে লাফিয়ে পড়ল।

    “কিন্তু ভাই কিরণ একটা কথা মনে রেখো। বছর কয়েকের ভেতর সমুকে বলে দিও যে সে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। সত্যিটা তার জানা দরকার।”

    সাঁতারের যে কম্পিটিশনে সমু যায় সেখানেই মেডেল জেতে। হরেকরকম মেডেলে ঘর ভরে গেল। কিরণবাবু জানেন বলাইদা ঠিকই বলেছেন – সমুকে সত্যি কথাটা জানাতে হবে। কিন্তু সমু যদি খুব রেগে যায় কিংবা যদি তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে চায় …। শেষে ঠিক করলেন বোর্ডের পরীক্ষার আগে নয়। পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করলেন কিরণবাবু যাতে সমু অস্থির না হয়ে পড়ে। তারপর একদিন সমুকে সব কথা খুলে বললেন। সে যে আসলে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে আর কী অবস্থায় তাকে পাওয়া গিয়েছিল, সব।

    শুনে সমু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। কিরণবাবু ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকলেন – সমু কি রেগে উঠবে? সমু অবশ্য শান্তভাবেই সত্যিটা গ্রহণ করল। তারপর হঠাৎ একটা আজব প্রশ্ন করে বসল। “যদি আবার ঝড় আসে, সমুদ্র ডাঙায় উঠে আসে, মাটির ঘর ভেঙে পড়ে – তখন মা-বাবা-ভাই-বোনকে কে বাঁচাবে?”

    সমুর এই আচমকা প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না কিরণবাবু। ঠিক কী বলতে চাইছে সে?

    এদিকে পরীক্ষার ফল বেরোবার সময় আসছে। কিরণবাবু জানেন সমু তেমন কিছু নম্বর পাবে না। আজকাল কলেজে ভর্তি হতে অনেক অনেক নম্বর পেতে হয়। তাঁর নিজেরও বয়স হয়ে গেছে, সামনের বছর চাকরি শেষ। সেরকম টাকা-পয়সাও তাঁর নেই – সমুটা যে কী করবে! সমুর সেইদিনের প্রশ্নের উত্তর যেমন তিনি দিতে পারেননি, সমু ভবিষ্যতে কী করবে এই দ্বিতীয় প্রশ্নটাও তাঁকে ভাবিয়ে তুলল।

    ফল তখনও বেরোয়নি, সমুকে দেখা গেল সে বারবার কম্পিউটার খুলে ইনটারনেটে কী সব দেখছে। মেডেলগুলো কবে কোথা থেকে পেয়েছিল সেসব লিখে নিচ্ছে কাগজে। বলাইদার সঙ্গে এদিকে ওদিকে ঘুরল কদিন। তারপর একদিন একটা ইমেল খুলে কিরণবাবুকে দেখাল যে সে ইন্টারভিউ পেয়েছে। ভুবনেশ্বরে যেতে হবে। একাই গেল আর পাশও করে গেল! নাগপুরে এখন দুবছরের ট্রেনিং তারপর পাকা চাকরি। মাইনে খুবই সাধারণ, অন্যান্য চাকরির মত জমকালো ভবিষ্যতও হয়তো নেই। এসব জেনেও তিনজনে মানে বলাইদা, কিরণবাবু আর সমু খুব খুব খুশি। বলাইদা তো সমুর সঙ্গে নাচতে লাগলেন আর কিরণবাবু সমুকে জড়িয়ে ধরলেন। সমু একই সঙ্গে উত্তর-না-জানা দুটো প্রশ্নেরই জবাব দিয়েছে। জোড়া প্রশ্নের এর থেকে ভালো জবাব আর কী হতে পারত!

    দেশের কোথাও প্রাকৃতিক বির্পযয় হলে তা মোকাবিলা করার জন্য সরকারের একটা বিশেষ বাহিনী আছে। তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যায়, মানুষের জীবন আর সম্পত্তি রক্ষা করে। এই বাহিনীর নাম এন.ডি.আর.এফ। ন্যাশানাল ডিসাস্টর রেসপন্স ফোর্স। সমু সেখানে যোগ দিচ্ছে।

    ***

    আরও তিন-চার বছর কেটে গেছে। শীতকাল হলেও আজ কোলকাতার আকাশে ঘন মেঘ – বড়সড় একটা সাইক্লোন আসছে। বলাইদা আর কিরণবাবু চায়ের দোকানে বসেছিলেন। দোকানে একটা টিভিতে সারাক্ষণ খবরের চ্যানেল চালানো থাকে। খবরে ভীষণ ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে বারবার। সঙ্গে উপগ্রহ মানে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেয়া সাইক্লোনের ঘূর্ণিতে মেঘেরা পাক খেয়ে পেঁচিয়ে গেছে। সে ঝড় দু-তিন দিনে উড়িষ্যা বা অন্ধ্রের উপকূলে আছড়ে পড়বে।

    কিরণবাবু বলছিলেন যে ঝড়ের সতর্ক-বার্তা দেখলেই তাঁর সেই নব্বই সালের সাইক্লোনের কথা মনে পড়ে যায়। এমন সময় ওনার ফোন টুংটুং করে বেজে উঠল।

    ফোন খুলে দেখলেন সমু হোয়াটসঅ্যাপে কিছু পাঠিয়েছে। লিখেছে যে ওদের কয়েকজনকে এয়ার ফোর্সের বিমানে করে পুরীর কাছে নিয়ে আসা হয়েছে, ঝড়ের মোকাবিলা করার কাজে। অনেক কাজ দিয়েছে আর ওদের বলা হয়েছে একটাও জীবন যেন না যায় সেইভাবে কাজ করতে হবে। একটা ছবিও পাঠিয়েছে। পনেরো-কুড়িটা ছেলের একটি দল, মাঝখানে সমু।

    দুজনে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিরণবাবু আর বলাইদা – সমুর জন্য দুজনেরই আজ গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। দুজনেরই বিশ্বাস, সমুদ্রের রোষ যতই হোক না কেন, জীবন রক্ষা পাবে। সমুদ্রজিতের মতো ছেলেরা আছে যে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments