সময় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ। সেই সময়ে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে – তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন নেতৃবৃন্দ। ভারতের স্বাধীনতা আসছেই – এই বার্তা তখন নিশ্চিত। ‘বন্দেমাতরম্’ ও ‘জনগণমন’ গানদুটির মধ্যে যাঁরা ‘বন্দে মাতরম্’-এর পক্ষপাতী, তাঁরা ‘জনগণমন’ যে সম্রাট-প্রশস্তির গান – এই কথা তুলেছিলেন।
হঠাৎ সম্রাট-প্রশস্তির কথা উঠল কেন – তার আছে এক কৌতূহল-উদ্দীপক পূর্ব ইতিহাস। অনেকেই এ-নিয়ে আলোচনা করেছেন। দুটি মাত্র গ্রন্থের উল্লেখ করছি –
১) ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত – প্রবোধচন্দ্র সেন, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের পক্ষে পূর্বাশা লিমিটেড থেকে প্রকাশিত, ১৯৪৯।
২) আমাদের জাতীয় সঙ্গীত উত্তরকালের প্রার্থনা – অরবিন্দ পোদ্দার, প্রত্যয় প্রকাশকাল, ২০০৮।
পাঠকেরা লক্ষ করবেন – দুই গবেষকের সিদ্ধান্ত পৃথক।
বিষয়টি সংক্ষেপে এরকম –
১) সম্রাট পঞ্চম জর্জ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। তখন তিনি ব্রিটেন-এর রাজা এবং ভারতেরও রাজা। দিল্লিতে তাঁর অভিষেক-সংবর্ধনা হয় ১২ ডিসেম্বর, ১৯১১। তাঁর কলকাতায় আসবার কথা ৩০ ডিসেম্বর।
২) এই উপলক্ষ্যে মধ্যপন্থী (মডারেট) কংগ্রেস দলের সদস্যরা সম্রাটকে স্বাগত জানাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তখনই স্থির হল যে, সম্রাট-প্রশস্তিমূলক একটি গান লিখে দেবার জন্য অনুরোধ করা হবে রবীন্দ্রনাথকে। কেউ একজন তাঁকে সেই অনুরোধ করলেন। যিনি অনুরোধ করেছিলেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেননি। কিন্তু তিনি লিখে দিলেন ‘জনগণমন’ গানটি।
৩) এই ঘটনার ছাব্বিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ পুলিনবিহারী সেনকে একটি ব্যক্তিগত পত্রে কয়েকটি কথা লিখেছিলেন। ব্যক্তিগত হলেও পুলিনবিহারী যেন সেটি প্রকাশ করেছিলেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় (১৯৩৭)। চিঠির তারিখ ২০ নভেম্বর ১৯৩৭। চিঠিটি খুবই তাৎপর্যময়।
“রাজ সরকারের প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, এই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমন অধিনায়ক গানে সেই ভারত ভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি...। সেই যুগ যুগান্তরের মানবভাগ্যরথ পরিচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে-কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।”৪) কিন্তু এই চিঠি ঘটনার ছাব্বিশ বছর পরে লেখা। তা-ও ব্যক্তিগত চিঠি। তখন, ১৯১১-তে গানটি লেখবার সময়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুই বলেননি। তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল গানটি সম্রাট পঞ্চম জর্জ-এর প্রশস্তি রূপেই রচিত। দেশের রাজাকে ‘ভারতভাগ্য বিধাতা’ বলাও খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
৫) তবে গানটি গাওয়া হয়েছিল সম্রাটের উপস্থিতিতে নয়। কংগ্রেস-এর ছাব্বিশতম অধিবেশন হয়েছিল কলকাতায় ১৯১১-র ২৬-২৭-২৮ ডিসেম্বর। সেই অধিবেশনেই দ্বিতীয় দিন ২৭ ডিসেম্বর উদ্বোধনী সঙ্গীত রূপে গাওয়া হয়েছিল ‘জনগণমন’ গানটি।
৬) কাজেই গানটিকে রাজ-প্রশস্তিমূলক বলে ধরে নেবার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে সম্রাটের আগমন-বার্তার একটা বাতাবরণ ছিলই। তাছাড়া এই গানটির ঠিক পরেই গাওয়া হয়েছিল রামভজ দত্তচৌধুরী (সরলা দেবী চৌধুরাণীর স্বামী) রচিত একটি গান যেটি স্পষ্টতই সম্রাটের স্তুতি – ‘মেরা পাদশাহ্’। ফলে ভুল বোঝবার অবকাশ কিছুটা থেকেই গেল।
৭) এই অধিবেশনের ঠিক পরেই দু-তিনদিন ধরে সংবাদপত্রে যে-সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে কোথাও লেখা হয়েছিল গানটি দেশাত্মবোধক, আবার কোথাও লেখা হয় গানটি সম্রাটের উদ্দেশে রচিত স্বাগত-সঙ্গীত। প্রবোধচন্দ্র সেন এবং অরবিন্দ পোদ্দার – দুই লেখকই সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলি উদ্ধৃত করেছেন।
৮) উপসংহারে বলা যায় – এই বিতর্ক কালক্রমে স্তিমিত হয়ে গেছে। ‘জনগণমন’ যে একটি দেশপ্রেমেরই গান এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন গান্ধীজি, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু। কিন্তু মাঝে মাঝে বিরুদ্ধ মতটাও উঠে আসে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে।
তেমনই একটি পরিস্থিতিতে ১৯৩৭-এ এই নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ‘বন্দে মাতরম্’ না ‘জনগণমন’! কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
আরও একটি চিঠি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সুধারাণী দেবী নামের কোনও এক মহিলাকে। সেই চিঠি, ২৯ মার্চ ১৯৩৯ তারিখে লেখা, প্রকাশিত হয়েছিল, ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের (মার্চ ১৯৪৮) সংখ্যায়। সেই চিঠির বাক্যগুলি উদ্ধৃত হল – “শাশ্বত মানব ইতিহাসের যুগ যুগ ধাবিত পথিকদের চিরসারথি বলে আমি চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব করতে পারি, এরকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করতে পারেন তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্মাবমাননা।” সুধারাণী দেবী কী লিখেছিলেন তা আমরা জানতে পারি না। জানি না তাঁর চিঠি কোথাও রক্ষিত আছে কি না। কিন্তু এটুকু অন্তত বোঝা যায়, ১৯৩৯-এও এই প্রশ্নটি সাধারণ মানুষের মনে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে।
এখানে আমরা জেম্স্ কাজিন্স্ (১৮৭৩ – ১৯৫৬) নামের এক ইঙ্গ-আইরিশ সাহেবকে স্মরণ করতে পাড়ি। তিনি যুক্ত ছিলেন থিওসফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে।
‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’ সম্পর্কে দু-একটি কথা জেনে নিতে হবে কারণ সারাজীবনই কাজিন্স্ যুক্ত ছিলেন এই সংস্থার সঙ্গে। এই সংযোগ তাঁকে হিন্দু ধর্মের দিকেও আকৃষ্ট করেছিল। মাদাম হেলেনা পেত্রোভ্না ব্লাভাটস্কি (১৮৩১ – ১৮৯১) এবং হেননির স্টিল ওলকট (১৮৩২ – ১৯০৭) নিউ ইয়র্ক-এ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই সোসাইটি স্থাপন করেন। প্রথমজন ছিলেন রুশ, দ্বিতীয়জন আমেরিকান। তাঁদের লক্ষ্য ছিল জীবনের সত্যকে অতীন্দ্রিয় অনুভবের পথে উপলব্ধি করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় আচরণসর্বস্ব ছিল না। আচার-আচরণের পথে নয়; অধিবাস্তব বা পরাবাস্তব উপলব্ধি ও ধ্যানের মধ্যে দিয়ে অন্তরে সত্যের জাগরণ ছিল তাদের অভিপ্রায়। এই সংস্থায় জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহ ছিল নিবিড়; তুলনামূলক ধর্ম, দর্শন এবং বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনায় সমবেত হতেন সদস্যরা। প্রচলিত সাম্প্রদায়িক ধর্মের কোনও স্থানই ছিল না এই সংস্থায়। যে কোনও জাতি ও ধর্মের মানুষ সদস্য হতে পারতেন।
বিশ শতকের প্রথম দিকে থিওসফিক্যাল সোসাইটি-র একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয় দক্ষিণ ভারতের আদিয়ার-এ। ক্রমে সেটিই হয়ে ওঠে মূল কেন্দ্র। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিল তার শাখা। বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে এই সোসাইটি ভারতে বেশ জনপ্রিয় ছিল। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন এই সংস্থায়। তাঁদের মধ্যে বঙ্গদেশে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কেউ কেউ, বিশেষ করে স্বর্ণকুমারী দেবী থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে যুক্ত ছিলেন। ভারতে এই সোসাইটি-র বিশেষ উৎসাহী সদস্য ছিলেন অ্যানি বেসান্ত (১৮৪৭ – ১৯৩৩)। এই ব্রিটিশ মহিলা যুক্ত ছিলেন সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। তার মধ্যে ছিল শিক্ষা, মানবাধিকার, নারী-স্বাধীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি। মাদাম ব্লাভাট্ক্সি-র সঙ্গে পরিচয়ের ফলে ১৮৯০-তে বেসান্ত থিওসফিক্যাল সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন; ১৯০৭-এ হেনরি ওলকট-এর পর তিনিই হয়েছিলেন এই সোসাইটির সভাপতি। তখন থিওসফিক্যাল সোসাইটির প্রধান কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ ভারতের আদিয়ার। সেই সূত্রে অ্যানি বেসান্তও ভারতে এসেছিলেন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। ভারতকেই তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ বলা যায়। একাধিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর তিনি ছিলেন এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। অ্যানি বেসান্ত-এর সঙ্গে জেম্স্ কাজিন্স্-এর সংযোগ ঘটেছিল থিওসফিক্যাল সোসাইটির সূত্রে। কাজিন্স্ থিওসফির বিষয় নিয়ে, অনেক লেখা লিখেছেন। বেসান্ত-এর আগ্রহেই তিনি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। তাঁর যাবতীয় ব্যয় বহন করেছিলেন অ্যানি বেসান্ত। তারপর থেকে জেম্স্ কাজিন্স্ তাঁর জীবন প্রধানত ভারতেই অতিবাহিত করেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজিন্স্-এর পরিচয় হয় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি। প্রথম থেকেই মুগ্ধ হয়েছিলেন কাজিন্স্। রবীন্দ্রনাথও পছন্দ করেছিলেন তাঁকে। ক্রমে কাজিন্স্-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গতা ঘনিষ্ঠতর হতে লাগল। তার একটা প্রধান কারণ কাজিন্স্ তখন বাস করছেন ভারতেই। দক্ষিণ ভারতের মদনাপল্লে নামক স্থানে এক শিক্ষায়তনে তখন জেম্স্ কাজিন্স্ অধ্যক্ষ। থিওসফিক্যাল সোসাইটি-র সঙ্গে এই শিক্ষায়তনটির সংযোগ ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণভারত ভ্রমণে গিয়ে কাজিন্স্-এর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। এ বিষয়ে মনোজ্ঞ বিবরণ পাওয়া যায় কাজিন্স্ দম্পতির স্মৃতিচারণে। ‘উই ট্যু টুগেদার’ নামে একটি বই যুগ্মভাবে লিখেছিলেন তাঁরা।
রবীন্দ্রনাথকে রেল স্টেশন থেকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসা হল। এক সপ্তাহের দু-একদিন বেশি সময় রবীন্দ্রনাথ সেখানে কাটিয়েছেন। সেখানেই ঘটেছিল একটি বিশেষ ঘটনা; তার চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায় কাজিন্স্-দম্পতির স্মৃতিকথায়।
রবীন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হলেন ২৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার অপরাহ্নে। প্রতি বুধবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা আবাসনের সামনে একত্র মিলিত হতেন গান-গল্প-আলোচনা-আবৃত্তির আসরে। আসরটির নাম ছিল ‘সিং সং ফান্ সেশান’ (Sing Song Fun Session)। সেখানে সকলের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ গাইলেন ‘জনগণমন’ গানটি – বাংলা ভাষাতেই। সেই গান মুগ্ধ করে দিল ভাষা-না-বুঝতে পারা শ্রোতৃবর্গকে। অধ্যাপক কাজিন্স্ লিখেছেন –
“In a voice surprisingly light for so large a man, he sang something like a piece of geography giving a list of countries, mountains and rivers; and in the second verse a list of the religions in India. The refrain to the first verse made us clear our throats. We asked for it again and again, and before long we were singing it with gusto : Jaya Hai, Jaya Hai, Jaya Hai, Jaya Jaya Jaya Jaya Hai (Victory, Victory, Victory to thee).”--We Two Together, 1950
ইংরেজিতে গানটি অনুবাদ করবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ জানালেন অধ্যাপক কাজিন্স্। ‘জনগণমন’ গানের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ হল এভাবেই। মদনাপল্লে-র ‘বেসান্ত থিয়োসফিক্যাল কলেজ’-এর গ্রন্থাগারে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে এই অনুবাদের প্রতিলিপি।
আরও একটি ঘটনা ঘটল এখানে। শ্রীমতী মার্গারেট কাজিন্স্ ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ এবং গান-বাজনার দক্ষ প্রশিক্ষক। তিনি এই গানের সুরকে পাশ্চাত্য পদ্ধতির নোটেশন্-এ সাজালেন এবং অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিলেন সেই সুর। রবীন্দ্রনাথ তা অনুমোদন করলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত সুরে গানটি গাওয়া হয়ে এসেছে ১৯১১ থেকেই। সুরের কাঠামো তৈরি করাই ছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্ট স্বরলিপি করা হয়েছিল কী না এ-বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তার ফলে হয়তো গানটি বিভিন্ন জনের কন্ঠে কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন সুরে গীত হতো। কিন্তু এরপর সেই সুর হয়ে গেল একেবারে সুনির্দিষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে অনূদিত গানটির নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য মর্নিং সং অব্ ইনডিয়া’। গানটি ‘বেসান্ত থিয়োসফিক্যাল কলেজ’-এ প্রভাতী প্রার্থনা রূপে গাওয়া হত।
মদনাপল্লের এই শিক্ষায়তনে রবীন্দ্রনাথ গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন – এই তথ্য খুবই উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত অনুবাদটির প্রতিলিপি রক্ষিত আছে।
এরপর রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রচিত এই গানটির প্রসঙ্গে জেম্স্ কাজিন্স্-এর বিশিষ্ট ভূমিকা দেখা দেয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের নির্দিষ্ট একটি জাতীয় সংগীত স্থির করে নেওয়া প্রয়োজন – একথা বার বারই ১৯৩০-এর পর থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছে। কিন্তু কোন্ গানটিকে সেই মর্যাদা দেওয়া উচিত – তাই নিয়ে ছিল বিতর্ক। ‘বন্দেমাতরম্’ অথবা ‘জনগণমন’ কোন্টি গৃহীত হওয়া উচিত। এই বিতর্ক বেশ সামনে চলে আসে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। সেই সময় ‘মদনপল্লে থিওসফিক্যাল কলেজ’-এর অধ্যক্ষ কাজিন্স্ সাহেব ১৯৩৭-এর ৩ নভেম্বর ম্যাড্রাস মেল পত্রিকায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন – যা উল্লেখযোগ্য।
“My suggestion is that Dr. Rabindranath’s own intensely patriotic, ideally stimulating, and at the same time world-embracing Morning Song of India (Jana-Gana-Mana) should be confirmed officially as what it has for almost twenty years been unofficially; namely, the true National Anthem of India.
(উদ্ধৃত: ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত, প্রবোধচন্দ্র সেন। পূর্বাশা লিমিটেড, ১৯৪৯ পৃ. ৩৪-৩৫)
যখন ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আরও দশ বছর দূরে; এবং ঠিক কবে সে-স্বাধীনতা আসবে তা কেউ জানে না; যখন শুরু হয়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উত্থিত হয়নি ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন – তখন এক শ্বেতাঙ্গ কলেজ-অধ্যক্ষ প্রথম ‘জনগণমন’-কে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত করবার প্রস্তাব রেখেছিলেন – এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত স্বাধীন হবার আগেই ‘জনগণমন’ গান জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পেল সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭ - ১৯৪৫) স্বপ্নের স্বাধীন ভারতে। সুভাষচন্দ্র দেশ ছাড়েন ১৯৪১-এর ২৬ জানুয়ারি, প্রথমে রাশিয়া, তার পরে জার্মানি। জার্মানিতে তিনি স্থাপন করলেন ‘ফ্রি ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশন’। বহুবিধ রাজনৈতিক চাপান-উতোরের জটিল জাল ছিঁড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭-এ স্বাধীন হয়। তার ছয় বছর আগেই সুভাষচন্দ্রের স্বপ্নের স্বাধীন ভারত বিদেশের মাটিতে নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করল। তখন থেকেই তিনি নেতাজি। সুভাষচন্দ্র স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করলেন ‘জনগণমন’। হামবুর্গ-এ ১৯৪২-এর ২৯ মে তারিখে সেই গান বায়ুতরঙ্গে ছড়িয়ে গেল বিশ্বে।
তার আগেই স্বাধীনতা-সংগ্রামী রাসবিহারী বসু (১৮৮৫-১৯৪৫) ১৯৪০-এর কাছাকাছি সময়ে জাপানে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টোকিও ইন্ডিয়ান লিগ’। তাঁরও মনের মধ্যে স্বাধীন ভারতের জন্য যুদ্ধের সংকল্প। গড়ে তুলেছেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। তাঁর আহ্বানে জাপান থেকে সুভাষচন্দ্র ১৯৪৩-এর ২ জুলাই সিঙ্গাপুরে পৌঁছলেন; ৪ জুলাই রাসবিহারী বসু তাঁকে সমর্পণ করলেন নেতৃত্ব। তখন থেকেই তাঁর সেনাবাহিনী প্রস্তুত; এবং উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য তৈরি হয়ে আছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ সহ আরও অনেক গান। সেই সঙ্গীত-বিভাগের প্রধান ছিলেন শিল্পী-সৈনিক রাম সিং (১৯১৪-২০০২)।
তারপর স্বাধীনতা এল ১৯৪৭-এ। কিন্তু সরকারি ভাবে ‘জনগণমন’ গান তখনও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে ঘোষিত হয়নি।
বিশেষ বিশেষ সরকারি অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীতের সুর বাজাবার প্রথা আছে। কিন্তু ভারত সরকার স্বাধীনতার পরেও নির্দিষ্ট জাতীয় সঙ্গীত স্থির করতে পারেননি। এ-বিষয়ে জওহরলাল নেহরু, পার্লামেন্ট-এর অধিবেশনে নিজে যা ১৯৪৮-এ বলেছেন তা উদ্ধৃত হল –
“We were constantly being asked as to what tune should be played on such occasions. We could not give an answer because the decision could only be made ultimately by the Constituent Assembly.The ‘Jana-Gana-Mana’ tune, slightly varied, had been adopted as National Anthem by the Indian National Army in South-East Asia and had subsequently attained a degree of popularity in India also.
The matter came to a head on the occasion of the General Assembly of the United Nation in 1947 in New York. Our delegation was asked for our National Anthem for the orchestra to play on a particular occasion. The delegation possessed a record of ‘Jana-Gana-Mana’ and they gave this to the orchestra who practiced it. When they played it before a large gathering it was very greatly appreciated, and representatives of many nations asked for a musical score of this new tune which struck them as distinctive and dignified. This orchestral rendering of “Jana-Gana-Mana” was recorded and sent to India. The Practice grew for our Defence Services bands to play this tune, and foreign embassies and legations also used it whenever occasion required.”
(২৬ অগাস্ট, ১৯৪৮; হিন্দুস্থান স্ট্যানডার্ড)
দেখা যাচ্ছে, সরকারিভাবে ঘোষিত হবার আগেই ঘটনাচক্রে সম্মীলিত জাতিপুঞ্জের সভায় ‘জনগণমন’ গানের সুর জাতীয় সঙ্গীতের সুর রূপে স্বীকৃত হয়ে গেল। অতএব স্বীকৃত হল গানটিও। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯-এ কন্স্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্ব্লি-র সভায় সরকারিভাবে গৃহীত হল সেই সিদ্ধান্ত।
সেই সিদ্ধান্ত আর অন্যরকম হবার অবকাশ ছিল না। আর কোনও বিতর্ক উঠল না। সম্মীলিত জাতিপুঞ্জের সভায় জাতীয় সঙ্গীত রূপে এই গানের সুর বাজাবার পরে (যেহেতু আর কিছু তখন হাতের কাছে ছিল না। কোনও ভাবনা-চিন্তাও ছিল না) সকলকে মুগ্ধ করে দেবার ফলে আর কোনও প্রশ্নও কেউ করেননি। বলা যেতে পারে, ‘জনগণমন’ গান ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রূপে নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল সরকারি ঘোষণার আগেই।