• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • গণতন্ত্রের স্বর: প্রতিরোধের ভাষা এবং গৌরকিশোর ঘোষ : পূর্বাশা বন্দ্যোপাধ্যায়



    ।।১।।

    শতবর্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন গৌরকিশোর ঘোষ, চলছে বর্ষব্যাপী উদ্যোগ আয়োজন। গত বাইশ বছর বাঙালির প্রতিদিনের যাপনে তিনি অনুপস্থিত তবু, শতবর্ষের আলোকে ভাস্বর নির্ভীক সংবেদনশীল এই বাঙালিই--বাঙালির মরচে পড়া বিবেক বোধকে এক প্রবল ধাক্কায় আবার যেন কিছুটা সতেজ ও প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছেন। মানুষে-মানুষে ভালোবাসা, গণতন্ত্র আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, এই ছিলো গৌরকিশোর ঘোষের জীবনাদর্শ। মানুষের স্বাধীনতায় তাঁর অগাধ বিশ্বাস। আজীবন কর্মে ও পন্থায় তিনি বাঙালির জাগ্রত বিবেকের দুয়ারে কড়া নেড়ে বলে গেছেন- “জাগতে রহো”। বৈষম্য, পক্ষপাত ও নীতিহীনতার বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত কলম গর্জে উঠেছে বার বার সাংবাদিকতায়, সাহিত্যে। উত্তরকালের জন্য তিনি রেখে যেতে চেয়েছিলেন অফুরান আনন্দের উৎস। এই শতাব্দির সূচনা লগ্নেই গৌরকিশোর পৃথিবী থেকে প্রস্থান করেছেন। তাঁর মৃত্যুর দুই দশক পর কোথায় দাঁড়িয়ে আছি ‘আমরা’—তাঁর ভালোবাসার বাঙালি সমাজ, নিঃশর্ত শ্রদ্ধার গণতন্ত্র, আর তাঁর স্বদেশ? শতবর্ষের ফিরে দেখায় এই প্রশ্নগুলি নিশ্চিতভাবেই উঠে আসবে।

    শতবর্ষ পালনের ডাক শুধু উদ্‌যাপনের বোধ থেকে জাত নয়। এ প্রয়াস আন্তরিক--কারণ তিনি আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। অবক্ষয়িত মূল্যবোধ ও নীতিহীনতার বর্তমান পরিসরে গৌরকিশোর চর্চা নিঃসন্দেহে আমাদের উৎসারিত আলোর পথ দেখাবে। তাঁর নির্ভয় স্পষ্টবাদিতার পরম্পরা বহন করতে পারলে আবারও বাঙালি ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করবে। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের সপক্ষে আজীবন লড়াই ছিলো গৌরকিশোরের। পুরস্কার অথবা তিরস্কার, কোনটির তোয়াক্কা না করেই তিনি লিখে গেছেন, নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। এই চলমান জীবনবোধটুকুই আজ আমাদের পাথেয় হোক।

    ।।২।।

    ২৫শে জুন ১৯৭৫, ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে এক গভীর ক্ষত। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওই দিন সারা দেশে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করলেন। খর্ব করা হল জনগণের সংবিধানপ্রণীত মৌলিক অধিকার, ‘প্রেস সেন্সরশিপ’ চালু হলো। সরকারবিরোধী যেকোন লেখা নিষিদ্ধ বলে বাজেয়াপ্ত হতে থাকল; ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ হলো। সরকার বিরোধী বা বিরোধী বলে সন্দেহভাজন যেকোন ব্যক্তির ওপর জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তারি, ও পরোয়ানা রহিত কারাবাস সরকারি নির্দেশ হিসাবে বলবৎ হলো।

    প্রতিবাদ করলেন গৌরকিশোর, তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতেই। রাষ্ট্র সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ করছে, যেন ১৯০৮-এর ‘প্রেস সেন্সর অ্যাক্ট’-এর ছায়া নেমে আসছে স্বাধীন ভারতে, মাতৃভাষায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, এ তো মাতৃবিয়োগেরই সমতুল--তাই প্রতীক হিসাবে মস্তক মুণ্ডন করলেন গৌরকিশোর। ঘন কালো কোঁকড়া চুলের পরবর্তে মুণ্ডিত মস্তক দেখে কৌতূহলী কেউ প্রশ্ন করলে তাঁর সাফ জবাব, “আমি লেখক, আমার কলমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, আমার মাতৃবিয়োগের থেকে তা কোন্ অংশে কম?” এই স্পর্ধাটাই আসলে গৌরকিশোর ঘোষ। এই অভিনব প্রতিবাদ, বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলে সাড়া ফেলে দিল।

    ‘দেশ’ পত্রিকার ‘রূপদর্শী’ কলমের জন্য লেখা প্রস্তুত হলো, কিন্তু সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র না মেলায় ৩০শে জুন ১৯৭৫-এর প্রকাশিতব্য ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে রূপদর্শীর নিয়মিত লেখা বাদ পড়ল। আনন্দবাজার পত্রিকা-র লেখাও বাতিল হয়ে গেল। একটুও দমে গেলেন না গৌরকিশোর। গণতন্ত্রমনা নাগরিক ও লেখক তিনি, কিছুতেই, ‘যো হুকুমের’ খেলায় আত্মবিক্রয় করবেন না। ঠিক করলেন, মস্তক মুণ্ডনে তেমন প্রতিক্রিয়া তৈরি না হলে সরকার পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য “গলায় কুকুরের বকলেস বেঁধে” ঘুরবেন। যাই হয়ে যাক্, প্রতীকী প্রতিরোধ বজায় থাকবে।

    সচেতন সমাজের সব মহলেই অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল ক্রমশ। ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত এগিয়ে এলেন। তিনি ‘কলকাতা’ পত্রিকার একটি বিশেয রাজনৈতিক সংখ্যা প্রকাশের পরিকল্পনা করলেন; গল্প, কবিতা ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রবন্ধের সঙ্গে এখানে প্রকাশ পেল গৌরকিশোর ঘোষের নিষিদ্ধ রচনা, সংযোজিত হলো ‘পিতার পত্র’ (আবাসিক স্কুলে পাঠরত পুত্রকে লেখা খোলা চিঠি)। সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই প্রকাশিত হলো। কলকাতা, পত্রিকার ‘বর্ষা সংখ্যা’, এমনকি তার ইংরাজি সংস্করণও। তৎক্ষণাৎ সরকার পত্রিকাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল কিন্তু নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণে যে কতোটা ব্যাপক, তা সহজেই অনুমেয়!

    সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছিলেন সম্পাদক ও লেখক। জরুরি অবস্থা চলাকালীন সরকার বিরোধিতার ফলও স্পষ্ট। একদিকে ‘কলকাতা’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা নিঃশেষ হচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত মানুষদের মুক্ত রাখা সরকারের ভীতির কারণ হয় উঠছে। ইংরাজি সংস্করণ প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ধরা দেবেন না, জ্যোতির্ময় দত্ত তাই দেশ ছাড়লেন সাময়িকভাবে। আর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে MISA (Maintenance of India Security Act) আইনে গ্রেপ্তার হলেন গৌরকিশোর ঘোষ ৬ই অক্টোবর ১৯৭৫।

    কলমের শক্তির কাছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরাভব স্বীকারের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অজস্র, কলম পেষা নাগরিককুলকে তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্ভ্রমের চোখে দেখে, জরুরি অবস্থা চলাকালীন গৌরকিশোরও কারারুদ্ধ থাকলেন প্রায় এক বছর। ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬, অবশেষে ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলো। ভাবতে ইচ্ছা করে, কোন্ শক্তিশেল লুকানো ছিলো, ‘কলকাতা’ পত্রিকার বিশেষ রাজনৈতিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নিষিদ্ধ রচনা’-য়, যার জন্য ‘রূপদর্শী’র মতো বিশিষ্ট রচনাকারকে কারারুদ্ধ করলেন সিদ্ধার্থশংকর রায়ের প্রশাসন? এবার সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক্—

    ।।৩।।

    ‘কলকাতা’ পত্রিকার চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় গৌরকিশোর ঘোষের মোট তিনটি রচনা প্রকাশ পায়, যার ফলশ্রুতি হিসাবে প্রায় এক বছর কাল কারাযাপন। “দুটি নিষিদ্ধ রচনা” শিরোনামে ছাপা হয়েছিল দুটি লেখা-- ‘গৌড়ানন্দ কবি ভণে’ ও ‘রূপদর্শীর সোচ্চার চিন্তা’ আর গৌরকিশোর ঘোষ নামে ‘পিতার পত্র’। প্রথমটি শ্লেষাত্মক রসরচনা, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে অনুচ্চারতার আবরণ ভেদ করে সোচ্চার ধর্মের স্পষ্ট প্রকাশ। ‘পিতার পত্র’ ব্যক্তিগত চিঠি, কিন্তু লেখকের অনুভূতি বৃহত্তর সামাজিক অভিঘাত তৈরি করবে, এই প্রত্যাশায় ছাপার অক্ষরে তা প্রকাশ করা হয়েছে, হয়তো, এইজন্যে দুটি রচনাই রাজরোষের কারণ হয়ে থাকবে। তবে ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত এইসব রচনার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর জরুরি অবস্থা জারির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা আসলে কি, তা একটু বোঝা দরকার, কারণ তবেই এটা বোঝা সম্ভব হবে যে গৌরকিশোর ঘোষ অপশাসনের ঠিক কোন্ জায়গাটায় আঘাত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

    উনিশশো ঊনষাট সালে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী হন। ১৯৬৪তে জহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্যপদ পেয়েছিলেন। এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মন্ত্রীসভার তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রীর আসন অলংকৃত করে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে মোরারজি দেশাইকে পরাজিত করে ইন্দিরা স্বাধীন ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। সামনে ছিল অনেকগুলো গভীর সমস্যা যার আশু সমাধান তিনি দিতে পারেননি। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, খাদ্য সংকট প্রভৃতি জটিলতায় ১৯৬৭-তে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস আশানুরূপ ফল করল না। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও দলের আসন সংখ্যা কমল। সমাজতান্ত্রিক নীতির প্রতি পক্ষাপাতিত্ব ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, এই দুই ইস্যু-তে কংগ্রেস বিভাজিত হয়ে গেল ১৯৬৯ সালে। ইন্দিরা সমর্থক সংসদদের নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী নতুন দল গড়লেন। যার নাম হলো কংগ্রেস (R), যদিও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে সংসদে তাঁকে DMK-র সমর্থন জোগাড় করতে হলো।

    উনিশশো বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বাধিক নাজেহাল দশা। ১৯৬৭ থেকে বাংলায় শুরু হলো নকশাল আন্দোলন। যার ঢেউ বিস্তৃত হলো মধ্যপ্রদেশ ও অন্ধ্রপ্রদেশেও। বিরোধী রাজনীতির সক্রিয়তার এতগুলো ক্ষেত্র থাকার পরও এল স্বজনপোষণের অভিযোগ। সঞ্জয় গান্ধীর ‘ড্রিম প্রোজেক্ট’ ‘Maruti Motors Ltd.’-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে নীতিহীনতার বেশ কটি স্তর পেরিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। একদিকে ইন্দো-পাক যুদ্ধ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, অন্যদিকে অন্ধ অপত্য স্নেহ, দুয়ের মাঝে দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী, সালটা ১৯৭১। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়াল উদ্বাস্তু সমস্যা। এমনই টালমাটাল পরিস্থিতিতে এলাহাবাদ হাহকোর্টে একটি মামলা দায়ের হলো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। মামলাকারী: সমাজবাদী পার্টির শ্রীরাজনারায়ণ। ’৭১-এর নির্বাচনে রায় বেরিলি কেন্দ্রের জয়ী প্রার্থী শ্রীমতী গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন, এই ছিল অভিযোগ। বম্বে, মাইসোর, নাগপুরে খাদ্যসংকট, অনাবৃষ্টি, ধর্মঘট, অর্থনৈতিক মন্দা--সব দিক দিয়েই অব্যবস্থা চরমে উঠেছিল, যা নিয়ে ইন্দিরা বিব্রত ছিলেন। তাঁর নিজের দপ্তরের অন্দরেও অন্যতম উপদেষ্টা পরমেশ্বর নারায়ণ হাক্সার ও সঞ্জয় গান্ধীর মতবিরোধ দূর করতে তিনি ব্যর্থ হন। সঞ্জয়কে রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে বসতে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী আদতে নিজের অবস্থান ও ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই দুর্বল করছিলেন এই পর্বে, যার চরমতম পরিণতি ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার নির্দেশ।

    ‘দেশ’ পত্রিকায় রূপদর্শীর ধারাবাহিক কলমে ‘সোচ্চার চিন্তা’ হিসাবে সংকলিত লেখাগুলো প্রকাশিত হয় অগাস্ট ১৯৭২ থেকে জুন ১৯৭৫-এর মধ্যবর্তী সময়ে। এই পর্বের রচনায় তীক্ষ্ণ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা পরিহার করে, ‘রূপদর্শী’-কে ইতিবাচক গঠনমূলক প্রতিবেদনের পথ ধরতে দেখেছিলাম আমরা। প্রাদেশিক শাসন পরিবর্তনে সঞ্জাত আশা প্রথম দিকের লেখাগুলিকে প্রভাবিত করছিলো। যুবশক্তি, নাগরিক ও বুদ্ধিজীবিদের সরকারের গঠন ব্রতে ভূমিকা গ্রহণের জন্য আহ্বানও করেছিলেন তিনি। কিন্তু '৭৩-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই মানসিক ক্ষুণ্ণতা তৈরি হতে লাগল, খাদ্য, পরিবহন, ডাকব্যবস্থা, শিল্প প্রভৃতি বিষয়ে সরকারি অপদার্থতা ও নিস্পৃহা, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীন দলাদলি, কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর হাত শক্ত করার বিষয়ে রাজ্যের নেতাদের চাটুকারিতার বিরুদ্ধে রূপদর্শীর সোচ্চার চিন্তা প্রকাশ হতে শুরু করল।

    ২৫শে জুন ১৯৭৫—ওই দিন জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে জারি হয়েছিল। কিন্তু এর কয়েক মাস আগে থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার নানান অর্ডিন্যান্সের জেরে নিষেধাত্মক আইন বলবৎ করে জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিত তৈরি করেছিল। অপশাসনের এই ক্রম-উত্থানপর্বে রূপদর্শীর ধারাবাহিক রচনায় রম্যতার আস্তরণ ছিন্ন করে এক নির্ভীক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকের চেহারাই ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ‘ধিক ফ্যাসিবাদ’ শীর্ষক ধিক্কার-মূলক রচনাটি এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। ফ্যাসিবাদের বীভৎস তাণ্ডব দেখে শিউরে উঠেছেন গৌরকিশোর।

    ক্ষুরধার রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে চাঁচাছোলা শব্দবন্ধে প্রকাশ করার শিল্পিত ভঙ্গি ও সত্যকথনের অহং সাংবাদিক জীবনে গৌরকিশোরকে সিদ্ধি দিয়েছিল। রূপদর্শীর কলমে পরিহাস ও বিদ্রূপের আড়াল ভেদ করে যতবার সেই সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছেন, ততবার চমৎকার হয়েছে। ১৯৭১-এ এলাহাবাদ হাহকোর্টে নির্বাচনবিধি-ভঙ্গের যে মামলা হয়েছিল, ১৯৭৫-এর জুন মাসে তার নিষ্পত্তি হল। নির্বাচনী কাজে সরকারি Machinary ব্যবহারের অপরাধে বিচারপতি জগমোহন সিং প্রধানমন্ত্রীর ১৯৭১-এর নির্বাচন বাতিল করার রায় দিলেন, পরবর্তী ছ’-বছর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার রায়ও ঘোষিত হলো একই সঙ্গে। গণতন্ত্রের স্বাধীনতা ও বিচারব্যবস্থার অক্ষুণ্ণ প্রতাপে উচ্ছ্বসিত গৌরকিশোর রূপদর্শীর কলমে লিখলেন ‘এলাহাবাদের রায়’।

    এই রায়ের ফলে এই বিষয়টিই প্রমাণিত হয়েছে যে ভারতে বিচারব্যবস্থার টুঁটি প্রশাসন এখনও টিপে ধরতে পারেনি। … আমার মতো গণতন্ত্রমনা নাগরিকের পক্ষে এটা একটা বড় আশার কথা। কারণ স্বাধীনচেতা বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রকে রক্ষা করে।
                                                                           (রূপদর্শী সংগ্রহ ২; পৃষ্ঠা ৫০২)

    উত্তেজনা তৈরি করে গণতন্ত্র রক্ষা হয় না, ‘রূপদর্শী’ এ-কথা তাঁর পাঠকদের গভীরভাবে বোঝাতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা জ্ঞাপনের নেশায় মত্ত সমর্থকদের সৃষ্ট উত্তেজনাকে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন, একই সঙ্গে নিন্দা করেছেন বিরোধীদের ঘৃণাসর্বস্ব রাজনৈতিক আচরণের। প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থনের নামে ‘গণ-হিস্টিরিয়া সৃষ্টির পিছনে’ একনায়কতন্ত্রের কায়েমী স্বার্থ যে সুকৌশলে কাজ করে চলেছে এটাই উপলব্ধি করে তিনি মানুষকে সেটা বোঝাতে চেয়েছিলেন। শাসন ব্যবস্থার কূটনৈতিক অভিসন্ধিগুলিকে গৌরকিশোর বিশ্লেষণ করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছিলেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রশাসন তাই তাঁকে থামাতে বাধ্য হলো। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ও ‘দেশ’-এ প্রকাশিতব্য পরবর্তী দুটি রচনাই বাতিল হলো।

    ।।৪।।

    গৌড়ানন্দ কবি ভনে:

    এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক ভাবমূর্তিতে একটা বড় মাপের ধাক্কা দিয়েছিল। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার নড়বড়ে দশা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-রাজনীতি, কংগ্রেসের গোষ্ঠীগত মতপার্থক্য ইন্দিরার পূর্বের অবস্থানকে অবশ্যই কিছুটা বিপন্ন করেছিল। তার উপর এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় তাঁর আত্মবিশ্বাসকেও আঘাত করে। তখন কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে তাঁর প্রতি আস্থা প্রদর্শনের একটা হিড়িক পড়ে যায়। ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের এই হতাশাব্যঞ্জক ক্রিয়াকলাপ দেশ জুড়ে একটা আলোড়ন তৈরি করে যার ফলে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। এই ঘটনাকে তীব্র ব্যঙ্গে বিদ্ধ করে গৌড়ানন্দের জবানিতে লিখিত হয় 'পূর্ণ সমর্থন লাভের সহজ উপায়'। রসরচনার আড়াল ব্যবহার করে এখানে ইন্দিরার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের পাগলামিকে কটাক্ষ করা হয়েছে, শুধু তাই নয় এই সমর্থন প্রদর্শনের বিপুল আয়োজন যে আসলে মস্ত ফাঁকি, সেটাই চিহ্নিত করেছেন লেখক।

    “এতো হিউজ ব্যাপার”।

    “আজ্ঞে হ্যাঁ, ন্যাশান্যাল ক্রাইসিসকে এইভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য হয়, একথা কখনও শুনেছেন?”

    “আজ্ঞে তা অবশ্য শুনিনি।”

                                                                           (‘কলকাতা’ বর্ষা সংখ্যা; পৃষ্ঠা ৩৭)

    দুই কংগ্রেস সমর্থকের আলাপচারিতায় শ্রীভুবনেশ্বর পারিবারিক পর্যায়ক্রমিক আমরণ অনশনের যে প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন, তার সমস্তটাই ফাঁকি। ইন্দিরা গান্ধীর আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে গণ-সমর্থন প্রদর্শনের দাওয়াই আদতে যে একটা fallacy, গৌরকিশোর তাই জনসমক্ষে স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন।

    রূপদর্শীর সোচ্চার চিন্তা:

    ‘রূপদর্শীর সোচ্চার চিন্তা’র সর্বাধিক আলোচিত রচনা ‘ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র’, যা তাঁর বিরুদ্ধে রাজরোষের অন্যতম কারণ হয়েছিল। রচনাটিতে সংকটাপন্ন গণতন্ত্রের জন্য গৌরকিশোর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ইন্দিরাপন্থী কংগ্রেসিরা দেশব্যাপী উগ্র আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। দুর্নীতির সমর্থনে, আদালত অবমাননা করে গড়ে তোলা এই আন্দোলনকে লেখক তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন। এই অন্যায় আন্দোলনকে প্রশ্রয় দানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অভিযুক্ত করেন এবং স্পষ্টভাষায় এই ঘটনাক্রম নির্মাণকে ইন্দিরা গান্ধীর আত্মবিশ্বাসের অভাব বলে বর্ণনা করেন।

    শ্রেণিগত বিচারে, ‘ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র’ রম্যরচনার কোঠায় একেবারেই আটকে নেই, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ও লেখকের জোরালো বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রম্যতার সীমা অতিক্রম করে এটি serious প্রবন্ধের চেহারা নিয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে লেখক অতি সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা তরঙ্গের বিশ্লেষণে উদ্যোগী হয়েছেন, এসেছে কংগ্রেস বিভাজনের প্রসঙ্গ।

    কংগ্রেস যখন দু’ভাগ হয় তখন দেশে যে “ইন্দিরা হাওয়া” বয়েছিল, তা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। আর আজ, হায়, সেই ইন্দিরার পালে হাওয়া দেবার জন্য কত না সাজানো আয়োজন!!
                                                                           (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; পৃষ্ঠা ৩)

    এই তুলনা টেনে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাতাবরণ সম্পর্কে লেখক তাঁর পাঠককুলকে সজাগ করেছেন। জরুরি অবস্থা জারির আবহে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু দেখেছিলেন গৌরকিশোর, ‘চাটুকার-সমারোহের সুবিশাল আয়োজন’- এর উল্লেখ ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ মহলের নেতিবাচক ভূমিকার কথাই স্মরণ করায়।

    রচনায় ইন্দিরা গান্ধীকে স্পষ্টত আস্থাহীন দলনেত্রী হিসাবে উল্লেখ করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পর গণতন্ত্রের প্রহরী এক প্রধানমন্ত্রীর আশু কর্তব্য ঠিক কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে গৌরকিশোর আটটি পথনির্দেশ দিয়েছেন। এই বিশ্লেষণ অবশ্যই জনমত গড়ে তোলার তাগিদ। বাস্তব পরিস্থিতি ছিল এর বিপরীত। ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে পারল না, তা জেনেই নিজের মত জোরালো ভাবে প্রকাশ করলেন গৌরকিশোর।

    এই অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। চাটুকারের দল আজ ইন্দিরাকে দেশের আইন, কংগ্রেস দল, এমনকি ভারতের চেয়েও বড় বলে জাহির করতে শুরু করেছেন।
                                                                           (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; পৃষ্ঠা ৪)

    এই সোচ্চার বক্তব্যের সামাজিক অভিঘাত কতটা হতে পারে, তা বুঝে নিতে আজকের পাঠকেরও কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। ‘ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র’ লেখা হয়েছে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হবার ঠিক প্রাক্কালে, যখন একের পর এক অর্ডিন্যান্স জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রদ করছে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ ছিল গৌরকিশোর ঘোষের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ, এক সৎ সাংবাদিকের সত্য উদ্ঘাটনের স্পর্ধা।

    নিন্দাবাদের কুৎসা রটনা গৌরকিশোরের এ রচনার উদ্দেশ্য নয়, রচনাটির শেষাংশে পৌঁছালে বোঝা যাবে ইতিবাচক চিন্তার স্রোত অব্যাহত রয়েছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে উহ্য রেখে কংগ্রেস পরিষদীয় দলের এই সংকটে ইন্দিরার প্রতি আস্থা জ্ঞাপনকে লেখক সুপ্রচেষ্টা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কংগ্রেস পরিষদ দলের সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতৃত্ব ও নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল বজায় রাখতে আহ্বান করেছেন। তাঁর স্বদেশের ভালো-মন্দের ভাবনায় কোন বিকল্প ব্যবস্থা তিনি চাননি, বরং কংগ্রেসের গণতান্ত্রিক বোধের পুনর্জাগরণেই আস্থাশীল থেকেছেন। ‘সোচ্চার চিন্তা’র প্রথমদিকের রচনাগুলিতে যে গঠনমূলক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল এই প্রবন্ধের উপান্তে সেই আশার ক্ষীণ রশ্মি প্রজ্বলন থাকতে দেখলাম আমরা।

    দেশের ভালো-মন্দ এখনও কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক বোধের উপরই নির্ভর করছে। এই গণতান্ত্রিক চেতনাটিকে সরল ও পুষ্ট করে তোলাই গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বজায় রাখার উপায়। আপাতত এছাড়া পথ নেই।
                                                                           (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা ৫)

    পিতার পত্র:

    ‘পিতার পত্র’ ব্যক্তিগত চিঠির মোড়কের ভিতর মননশীল একটি প্রবন্ধ, যা প্রেরকের ইচ্ছা সাপেক্ষেই, ‘কলকাতা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ছাপার অক্ষরে তা প্রকাশ করার পিছনে লেখকের যে স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল, তা তিনি চিঠিতে ব্যক্ত করেছেন—

    লেখাটা আরও অনেকে পড়ুন, আমি চাই। কেননা, তা হলে হয়ত আরও অনেকে নিজের কথা বলতে সাহস পাবেন। তাই এটা ছাপতে দিচ্ছি।
                                                                           (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা ১১)

    নাগরিক অধিকার হরণ ও দেশে জরুরি অবস্থা জারি, এই দুই ঘটনা গৌরকিশোর ঘোষকে মানসিক সংকটে ফেলে দিয়েছিল। চিঠিতে তা উল্লেখ করে আত্মজকে তিনি তার ব্যাখ্যা করেছেন।

    ন্যায়-নীতি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে গৌরকিশোরের কলম বরাবর সরব থেকেছে। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ছিল। গণতন্ত্রের সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন হয়েই তিনি সামাজিক উত্থান-পতনের নিয়মতান্ত্রিক মার্গ হিসাবে গণতন্ত্রকে নির্বাচন করেছিলেন, তাকে ভালোবেসে ছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন “গণতন্ত্রই মানুষের স্বাধীনতাকে জীইয়ে রাখে” (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা, পৃষ্ঠা ৮)। গণতন্ত্রই সেই ব্যবস্থা, যেখানে বিরোধিতাও সম্মানীয়। তিনি পাঠককে স্মরণ করিয়েছেন যে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনশীলতাই সত্য কিন্তু পরিবর্তন আসা উচিত নিয়মতান্ত্রিক যুক্তিসম্মত বাগ্মিতার পথে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তনে হিংসা ও রক্তক্ষয়কে তিনি আদিম বর্বরতা বলেছেন, সহনশীল গণতন্ত্রই তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়। সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট শাসনে তাঁর কোনো আস্থা নেই, গণতান্ত্রিক সহনশীলতাকে তিনি মানব সভ্যতার দান হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

    কিন্তু ১৯৭৫-এর রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই গণতান্ত্রিক আবহাওয়াকেই আবিল করে তুলেছে। ব্যক্তির মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, বাক্‌-স্বাধীনতা হরণ করা, জরুরি অবস্থার অজুহাতে মৌলিক অধিকার হরণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়কের এই Dictatorship গৌরকিশোরকে অস্থির করে তোলে।

    তিনি লেখক, যুক্তিবাদী লেখক। তাঁর মত প্রকাশের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াকে তিনি অস্তিত্বহীনতা বলে বোধ করেন। তাই মানুষ গৌরকিশোর ঘোষ, তাঁর আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে প্রবল প্রতিবাদী। অসত্যের সঙ্গে আপোষ, কোনো লেখকের ধর্ম হতে পারে না তাই তিনি জেহাদি। তাঁর প্রতিরোধ, গণতন্ত্র বিরোধী, স্বাধীনতার পরিপন্থী সেন্সর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। মস্তক মুণ্ডনের প্রতীকী প্রতিবাদ এই নীতিহীনতার জন্যই। আরো বৃহত্তর প্রতিবাদে যেতে চান তিনি, তার প্রতিবন্ধকতা--পারিবারিক দায়িত্ববোধ। প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের ফলশ্রুতি তাঁর জানা ছিল। একদিকে লেখকের স্বাধিকার অন্যদিকে পরিবারের নিরাপত্তা, কাকে রক্ষা করবেন গৌরকিশোর!! তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে পিতার পত্র লিখতে বসলেন তিনি।

    তাই আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে জানিয়ে রাখছি। আমার বাক্-স্বাধীনতা হরণের আমি তীব্র প্রতিবাদ করি।
                                                                          (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; পৃষ্ঠা ৭)

    প্রতিবাদ ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠল। রচনাগুলি প্রকাশ করলে গ্রেফতার হওয়া নিশ্চিত জেনেও সরকারি অনাচারের সমালোচনা করলেন গৌরকিশোর। গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিকগুলি পাঠক সমক্ষে তুলে ধরার পরে তিনি ইন্দিরা প্রশাসনকে সরাসরি আঘাত করলেন।

    প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে, আমি প্রধানমন্ত্রীকে এই কথা বলি, প্রধানমন্ত্রী আপনি এ কোন্ সর্বনাশের পথে নেমে এলেন। এ-পথে আপনার আমার আমাদের বংশধরদের কারও কল্যাণ নেই। ইতিহাস বার বার তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, ফিরুন। আপনি ফিরুন!
                                                                          (দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; পৃষ্ঠা ১০)

    সচেতনতার এই ডাক প্রধানমন্ত্রী শুনবেন না, তা তিনি জানতেন কিন্তু তবু নিজের প্রতিবাদটুকু জনসমক্ষে প্রকাশ করে গৌরকিশোর জনমত গঠন করতে চাইছিলেন। গণতন্ত্রে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য গণতন্ত্রের রক্ষায় এগিয়ে আসা, তাকে আগলে রাখা। জনমতকে জোরালো করে তুলতে এক শক্তিশালী লেখকের এই আন্তরিক প্রচেষ্টাকে শতবর্ষের আলোয় তাঁর উত্তরকাল নিশ্চয়ই কুর্নিশ জানাবে।

    সংবাদপত্র শুধু সংবাদ পরিবেশনেই নিজের দায়িত্ব শেষ করবে না, জনমত গঠনেও তার একটা ভূমিকা থাকবে। সত্য-নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদান এবং গণতন্ত্র সহায়ক জনমত গঠন -- এই দুটিকেই গৌরকিশোর আদর্শপরায়ণ সাংবাদিকের ধর্ম বলে জেনেছেন ও মেনেছেন। জরুরি অবস্থার ভয়ানক সংকটকালেও তিনি তাঁর ধর্মনিষ্ঠা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি রচনা, সামাজিক আলোড়ন তৈরির প্রয়াস, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা, এই সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই গৌরকিশোর ঘোষ বিশেষ। শতবর্ষের ফিরে দেখায়, তাঁর জীবন ও কর্মের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে আগামীর দরজায় তাঁর সত্যনিষ্ঠ, নির্ভীক জীবনচেতনা প্রতিষ্ঠা পাক, এই কামনা রইল।


    সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা:

    ১। ‘কলকাতা’, বর্ষা সংখ্যা, ১৯৭৫

    ২। দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা; সম্পাদনা: সোহিনী ঘোষ; প্রথম সংস্করণ জুন, ২০১৫, আনন্দ পাবলিশার্স

    ৩। রূপদর্শী গৌরকিশোর, সম্পাদনা: সোহিনী ঘোষ; প্রথম সংস্করণ জুন, ২০২২, দে’জ পাবলিশিং

    ৪। রূপদর্শী সংগ্রহ ২, গৌরকিশোর ঘোষ; প্রথম সংস্করণ এপ্রিল, ২০০৭, আনন্দ পাবলিশার্স

    ৫। Beyond the Laws, an Auotobiography; by Kuldip Nayar; 1st Edition June, 2012, Roli Books

    ৬। Indira: India’s Most Powerful Prime Minister; by Sagarika Ghosh; 1st Edition, 2017, Juggernaut Books



    অলংকরণ (Artwork) : রাজীব চক্রবর্তী
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments