• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • বেদনার উপাখ্যান: আলফোঁস্‌ দোদে : শুভময় রায়





    ‘For there was never yet philosopher
    That could endure the toothache patiently….’
                       (Much Ado About Nothing; William Shakespeare)
    প্রেম, ঈর্ষা বা যুদ্ধের মত রোগভোগ যে কেন সাহিত্যের অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে উঠল না, সেটা একটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। অসুস্থতা নিয়ে প্রবন্ধ (On Being Ill) লিখতে গিয়ে ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ্‌ এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে উপন্যাস, টাইফয়েড নিয়ে মহাকাব্য, নিউমোনিয়া নিয়ে ভাবগম্ভীর-ছন্দময় গীতিকবিতা অথবা দাঁতের ব্যথা নিয়ে লিরিক কাব্য কেন লেখা হল না? ভার্জিনিয়া দুয়েকটি ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। টমাস ডি কুইন্সির আত্মজৈবনিক আফিমখেকোর স্বীকারোক্তি অথবা মার্সেল প্রুস্তের রচনায় ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা রোগভোগের কথা। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম। সাহিত্য বুঝিয়ে দেয় যে মন আর মননই তার খেলার মাঠ। শরীরটা যেন সাধারণ কাচের একটা দেওয়াল। আত্মা যাতে তার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় শুধু সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি। অকিঞ্চিৎকর দুয়েকটি ক্ষেত্রেই এই শরীর কামনা বা লোভের আধার হিসেবে হয়তবা উপস্থাপিত হয়েছে সাহিত্যে।

    রোগভোগ বা ব্যথাবেদনার অভিজ্ঞতা সাহিত্যে যে উপেক্ষিত তার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভার্জিনিয়া উলফের মনে হয়েছে সে সাহিত্য রচনা করতে হলে প্রয়োজন সিংহকে বশ মানানোর সাহস। আর শারীরিক বেদনার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার দুর্বলতা। যে ভাষা হ্যামলেটের মননশীলতা অথবা লিয়ারের করুণ রস প্রকাশ করতে পারে, সেই ভাষায় কাঁপুনি অথবা মাথাব্যথা বোঝাতে পারে এমন শব্দ নেই! স্কুলের মেয়ে প্রেমে পড়লে অনায়াসে শেক্সপিয়ার, ডান্‌ অথবা কিট্‌সের সাহায্য নিয়ে প্রেম নিবেদন করবে। কিন্তু রোগী ডাক্তারখানায় গিয়ে মাথাব্যথাটা কেমন তা বোঝাতে গেলে উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাবে না। সেখানে তার জন্য চটজলদি সমাধান কিছু নেই। তাকে শব্দ আর ভাষা তৈরি করে নিতে হবে।

    ‘ব্যথাবেদনা (বা ধরা যাক প্রেমাবেগের) অনুভূতি আসলে কেমন তা বর্ণনা করতে শব্দ সত্যিই কি কোনও কাজে লাগে?’

    ওই প্রবন্ধে ভার্জিনিয়া এই ব্যবস্থার পরিবর্তন — অর্থাৎ আদিম, সূক্ষ্ম, দেহসর্বস্ব, অশিষ্ট এক ভাষার প্রবর্তন যা ব্যথাবেদনা প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে উঠবে আর আবেগ-অনুভূতির শ্রেণীক্রম ঢেলে সাজানোর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। প্রেমকে সরিয়ে সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠুক ১০৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ঈর্ষার স্থান গ্রহণ করুক সায়াটিকার ব্যথা।

    ভার্জিনিয়া উলফের প্রবন্ধটির প্রকাশকাল ১৯২৬। তার বেশ কয়েক দশক আগেই ফ্রান্সে মৃত্যুপথযাত্রী এক আনন্দের ফেরিওয়ালা ভগ্ন শরীর নিয়ে ডায়েরির আকারে লিখে ফেলেছিলেন ব্যক্তিগত ব্যথাবেদনার উপাখ্যান। আলফোঁস্‌ দোদে (Alphonse Daudet) নিজস্ব নোটবইতে ধরে রেখেছিলেন শারীরিক অসুস্থতা আর ভোগান্তির নানা রঙ। সেই ডায়েরি লেখকের মৃত্যুর তেত্রিশ বছর পরে ১৯৩০-এ প্রকাশিত হয়।

    ‘গ্রামাঞ্চলের দিগন্তরেখাও যেন বেদনার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। সেই রাস্তা, তাদের সুন্দর বাঁকগুলো দেখে এখন শুধু যেন পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে। ভেগে পড়া, অসুস্থতা থেকে ছুটে পালানো।’
    আঠারো শো তিরাশির প্যারিসে রুশ কথাকার তুর্গেনেভের তলপেটে স্নায়ুর টিউমার অপারেশন হয়। অপারেশনের আগে ডাক্তাররা তাঁকে ইথার বা ক্লোরোফর্ম দিলেও লেখক চিকিৎসা পদ্ধতি চলাকালীন সজাগ ছিলেন। পরে ফরাসি লেখক বন্ধু আলফোঁস্‌ দোদে তুর্গেনেভের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। দোদে, ফ্লবের, এদমঁ দ্য গোঁকুর, এমিল জ়োলাদের সঙ্গী করে তুর্গেনেভ প্রায়শই নৈশাহার সারতেন। তুর্গেনেভ দোদেকে বললেন, ‘অপারেশনের সময় যখন আমার ত্বক ভেদ করে ইস্পাত শরীরে প্রবেশ করছে….তখন মনে হচ্ছিল যেন কেউ কলার মধ্যে দিয়ে ছুরি চালাচ্ছে।’ গোঁকুর এই ঘটনা উল্লেখ করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের পুরোনো বন্ধু তুর্গেনেভ সত্যিই এক লেখক বটে।’

    রোগভোগ, ব্যথাবেদনা অথবা মৃত্যু নিয়ে লেখক লেখেন কীভাবে? তুর্গেনেভের ওই নিখুঁত বর্ণনা সত্ত্বেও বলতে হয় যে ব্যথাবেদনা বোধহয় অবর্ণনীয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে তুর্গেনেভের বন্ধু আলফোঁস্‌ দোদে উপলব্ধি করলেন যে প্রেম বা আবেগের মত বেদনা থেকেও শব্দ উৎসারিত হয়। জীবনের শেষ পনেরো বছর সিফিলিসের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে করতেই তিনি খাতায় লিখে চললেন তাঁর অনুভূতি, তাঁর চিন্তাভাবনা। বইয়ের নাম দিলেন লা দুলু (La Doulou) যা ফ্রান্সের প্রোভঁস্‌ অঞ্চলে ফরাসি ‘দুল্যর’ (douleur) শব্দের সমার্থক। শব্দটির অর্থ ‘ব্যথা’। নিজের দেশগ্রামের শব্দ ধার করে বইয়ের নামকরণের মধ্যেই যেন দোদে রেখে যেতে চাইলেন ঘরে ফেরার অভিজ্ঞান। বইয়ের শিরোনাম পড়ে মনে হয় আহত প্রাণীর মত দোদে বোধহয় তাঁর নিজের গুহায় প্রোভঁসের একান্ত নিজস্ব আশ্রয়ে ফিরে যেতে চাইছেন।

    ‘ক্লিষ্ট মানুষের কাছে ব্যথা সর্বদাই নতুন, টাটকা। কিন্তু তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে সেই অভিজ্ঞতা দ্রুতই অনন্যতা হারায়। আমি ছাড়া আর সকলেই এই পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।’

    ‘গত রাতে কী যন্ত্রণাই যে পেয়েছি, পায়ের গোড়ালিতে আর বুকের পাঁজরে। তীব্র নির্যাতন.....যা বর্ণনা করার ভাষা নেই। হয়তবা শুধু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করলেই সে বিবরণ দেওয়া যায়।......সব যখন শেষ হয়ে যায়, তখনই শব্দগুলো ধরা দেয় — যখন সব শান্ত হয়ে যায়। শব্দের উৎস হল স্মৃতি যা হয় ক্ষমতাবিহীন নয় অসত্যভাষী।’

    সিফিলিসের যন্ত্রণা আর মরফিন-ব্রোমাইডের আচ্ছন্নতার সে বছরগুলোর কাব্যিক ও কৌতুকময় বিবরণ আলফোঁস্‌ দোদে দিয়েছিলেন। ফরাসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য মেনে নিজের দুর্ভোগকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিলেন মহৎ এক সৃষ্টি, বাস্তবিকই একটি chef d’oeuvre যেখানে এক দশকের অধিককালের যন্ত্রণা আর ক্লেশের ইতিহাস ধরা রইল ষাট পৃষ্ঠার ক্ষুদ্র পুঁথিতে। বস্তুত, ষাট পৃষ্ঠা ভরা বেদনা কি যথেষ্ট নয়? তাঁর স্ত্রী মাদাম দোদে এই বিবরণ না লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। মনে করেছিলেন স্বামীর সাহিত্যিক জীবনের অন্তিম রচনা হতে চলেছে সেটি। মাদাম দোদের ধারণা ঠিক কারণ আলফোঁস্‌ দোদে এরপরে আর কিছু লেখেননি। কিন্তু দোদের কাছে বিষয়টি ছিল নিয়তি নিয়ে বিলাপ না করে সম্মানের সঙ্গে মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার মত।

    সিফিলিসের বেদনার এলোমেলো আক্রমণ আর তীব্র ব্যথা থেকে পরিত্রাণের উপায় ছিল মরফিন ইঞ্জেকশন। কিন্তু রোগটি দ্রুত মেরুদণ্ড ধরে নাড়া দিল। লেখক শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। শেষমেশ হাঁটাচলাও অসম্ভব হয়ে পড়ল। তৎকালীন বিখ্যাত সব চিকিৎসকরা দোদের রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা চালালেও ঊনবিংশ শতাব্দের দ্বিতীয় ভাগের সেই সময় অনেক চিকিৎসা পদ্ধতিই ছিল আজকের নিরিখে আসুরিক।

    ‘কখনওবা পায়ের গোড়ালিতে একটা কাটা — চুলের মত সরু। অথবা হয়ত পায়ের আঙুলের নিচেই কেউ যেন বার বার কাগজ কাটার ছুরিটা দিয়ে খোঁচাচ্ছে। খুব ধারালো দাঁত দিয়ে ইঁদুর যেন সেখানে কামড়াচ্ছে। আর এই সব দুর্দশার মধ্যেই যেন একটা রকেট উড়ছে, রকেটটা আপনার মাথার খুলি পর্যন্ত উঠছে। আর তারপরে যেন কোনও প্রদর্শনীর চরমানন্দের মুহূর্তের মত রকেটটা সেখানেই ফেটে গেল।’
    প্রদর্শনীর চূড়ান্ত সেই মুহূর্ত? দোদেকে যা কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁর লেখনী যেন তাকে ঠাট্টা হিসেবেই দেখছে। যখন পা, পায়ের পাতা, শরীরের প্রান্তগুলোতে খিঁচুনি ধরছে, তখন দোদে বললেন —
    ‘মনে হচ্ছে আমি যেন একাই একটা ব্যান্ড — সব তার ধরে নাড়া দিচ্ছি, আমার সব যন্ত্রণাগুলো একই সঙ্গে বাজাচ্ছি।’
    ফরাসি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সাংবাদিক আলফোঁস্‌ দোদে আজ বিস্মৃতপ্রায় এক লেখক। তাঁর রচনা প্রায়শই কৌতুকের আলোয় উদ্ভাসিত। জন্মস্থান প্রোভঁসের সূর্যালোকের ঔজ্জ্বল্য, বর্ণের উষ্ণতা, জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততা আর মুখরতা যেন মিশেছিল আলফোঁস্‌ দোদের রচনাশৈলীতে। তিনি লিখেছিলেন আমার হাওয়াকল থেকে লেখা চিঠি (Lettres de Mon Moulin)-র মত বই যা সাধারণত ফরাসি শিক্ষার্থীদের প্রথম পাঠ হিসেবে পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সমকালে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল একজন লেখক, সাহিত্যের উচ্চস্তরের কলাকুশলীদের সঙ্গে ছিল তাঁর মেলামেশা। ডিকেন্স তাঁকে উল্লেখ করেছিলেন ‘ফ্রান্সে আমার ছোট্ট ভাইটি’ বলে; হেনরি জেমসের মতে তিনি ছিলেন ‘এক অসাধারণ ক্ষুদে ঔপন্যাসিক’, গোঁকুর ভালোবেসে ডাকতেন ‘আমার ছোট্ট দোদে’। আকারে ছোটখাটো মানুষটি ছিলেন দয়ালু, সদালাপী, জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষক আর অনর্গল বক্তা। চারিত্রিক এই বৈশিষ্ট্যগুলোই যেন লাফিয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁর কথাসাহিত্যে। হেনরি জেমস্‌ তাঁকে পুনরায় বর্ণনা করেছেন ‘সমকালীন প্রসন্নতম উপন্যাসকার’, ‘তুলনাহীনভাবে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর গল্পকার’, ‘জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো না হলেও যা কিছু তাৎক্ষণিক, ভাবব্যঞ্জক, বাস্তব — তার তীক্ষ্ণধী এক নিরীক্ষক যেন’। এই মূল্যায়ন থেকেই ধারণা করা যায় দোদে কথাকার হিসেবে কেমন ছিলেন। পরিশ্রমী, সম্মানীয়, জনপ্রিয় এক লেখক যাঁর খ্যাতি আর প্রাসঙ্গিকতা হয়ত কোনও অলীক কারণবশত সমকালের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে গেছে।

    সাহিত্যের উচ্চসারিতে তাঁর বেশ কয়েকজন সঙ্গীর মতই দোদে ঊনবিংশ শতাব্দের সিফিলিস-আক্রান্ত ফরাসি সাহিত্যিকদের সেই বিশেষ ক্লাবের সদস্য — যার আরও নামকরা প্রতিভূরা হলেন বোদল্যের, ফ্লবের আর মোপাসঁ। তিনি হয়তো এ দাবিও করতে পারতেন যে গণিকা সংসর্গ থেকে তিনি সিফিলিস আক্রান্ত হননি। তাঁর ক্ষেত্রে উৎসটি ছিল আরেকটু অভিজাত, সাহিত্যঘেঁষা — সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের রাজদরবারের পাঠিকা এক মহিলা যাঁর দায়িত্ব ছিল উচ্চস্বরে পড়ে শোনানো।

    তৎকালীন চিকিৎসায় ব্যবহৃত পদ্ধতি অনুযায়ী দোদের চিকিৎসা করা হয়েছিল পারদের (mercury)সাহায্যে। সে যুগে মজা করে বলা হত সৌন্দর্য আর প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভেনাসের (Venus) সঙ্গে এক রাত কাটালে বাকি জীবনের সঙ্গী হবে বাগ্মিতা আর চাতুর্যের রোমান দেবতা মারকিউরি (Mercury)। সিফিলিসের সংক্রমণ মাত্র ১৭ বছর বয়সে হলেও তারপরে কুড়ি বছরের অধিক কাল রোগটি সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। সেই বিশ বছরে আলফোঁস্‌ দোদে লেখক হিসেবে পরিণত হন, তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়, খ্যাতি জোটে, ১৮৬৭-তে বিবাহ করে তিন সন্তানের পিতাও হন। তবে সেই সঙ্গেই অবশ্য চলেছিল তাঁর চিন্তাবিহীন, লাগামছাড়া যৌন জীবন। গোঁকুরকে ১৮৮৯-তে বলেছিলেন সেই স্বপ্ন দেখার কথা যেখানে শেষ বিচারে ‘ভোগলালসার অপরাধে’ ৩,৫০০ বছর নরকে কাটানোর সাজার বিরুদ্ধে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনে লড়তে হচ্ছে।

    শেষমেশ কিন্তু গেঁটৈবাত, নিদারুণ ক্লান্তি আর রক্তক্ষরণের মত লক্ষণ নিয়ে রোগ আবার দেখা দিল। ১৮৮০-র দশকের গোড়াতেই বোঝা গেল সিফিলিস তাঁর মেরুদণ্ডকে আক্রমণ করেছে। এই রোগের পরিণতি ক্রমশ হাত-পা আর শারীরিক নড়াচড়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়া। সে সময়ের শ্রেষ্ঠ স্নায়ুবিদ জ়ঁ মারত্যাঁ শারকো (Jean Martin Charcot) কোনও আশা দিতে পারেননি। ক্রমবর্ধমান ব্যথাবেদনা এবং অশক্ততা সত্ত্বেও দোদে বেঁচেছিলেন আরও বারো বছর। এক দল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য আরোগ্য নিকেতনে গেছেন, উষ্ণ জল আর কাদা মেখে স্নান করেছেন। যতই ভয়াবহ বা উদ্ভট হোক না কেন, তৎকালীন সর্বাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। এমন চিকিৎসাও সয়েছেন যাতে চোয়ালের সঙ্গে দড়ি বেঁধে রোগীকে কয়েক মিনিট উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আশা ছিল এর ফলে মেরুদণ্ডের সম্প্রসারণ ঘটবে, অস্থিসন্ধি সচল থাকবে। দোদে তেরো বার অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। শেষে কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠায় তিনি ছাড়া পান। চিকিৎসার শেষে লিখেছিলেন একটি ছোট্ট বাক্য: ‘লক্ষণীয় কোনও উপকার মিলল না’।

    ‘গত রাতে, আমার পড়ার ঘরে, তখন বোধহয় দশটা বাজে, কয়েক মিনিট যে কী নিদারুণ যন্ত্রণায় কাটিয়েছি!

    বেশ শান্ত হয়ে একটা যেমন-তেমন চিঠি লিখছিলাম.....ইংলিশ ল্যাম্পের আলো নিবিষ্টভাবে যেন ঝকঝকে সাদা পাতার ওপর পড়েছে। টেবিলের বাকি অংশ আর পড়ার ঘরটা অন্ধকারে ডুবে আছে।

    আমার চাকর এসে একটা বই বা আর কিছু টেবিলের ওপর রেখে গেল। আমি মাথাটা তুলতেই পরের দু-তিন মিনিট যেন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললাম। আমাকে দেখে তখন নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ জড়বুদ্ধি একটা মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। চাকর আমার সেই বোকা বোকা চাউনিকে প্রশ্ন ধরে নিয়ে সে কেন এসেছে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল। আমি তার কথা কিছুই বুঝিনি, সে কথাগুলো এখন আমার আর মনেও নেই।

    যেটা ভয়ঙ্কর সেটা হল আমি নিজের পড়ার ঘরটাকে চিনতে পারছিলাম না: আমি সেখানেই আছি এই বোধ না হারালেও সেটা যে কোথায় সে ধারণাটা আমি তখন হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাকে তখন দাঁড়িয়ে উঠে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে হল। বইয়ের আলমারি আর দরজার ওপর হাত বুলিয়ে আমি নিজেকে বললাম: “এই হল প্রবেশপথ”।

    ধীরে ধীরে আমার মাথাটা আবার কাজ করতে শুরু করল। বুদ্ধিবিবেচনা ফিরে এল। কিন্তু কালো অন্ধকার টেবিলের মাঝখানে লেখার পাতার সেই উজ্জ্বল শুভ্রতা সম্পর্কে আমার প্রথম অনুভূতি আমি মনে করতে পারি।

    মানসিকভাবে আচ্ছন্ন একটা অবস্থা আর অবসন্নতা।

    আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে যখন এই সব লিখছি তখন কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। গাড়িতে যেতে যেতে কয়েক মিনিট চোখটা বন্ধ করেছি। চোখ খুলতেই দেখলাম আমি প্যারিসের আলোকোজ্জ্বল নদীর পাড়ে পৌঁছেছি। কিন্তু সেই প্যারিসকে আমি যেন চিনতে পারছি না। গাড়ির দরজা দিয়ে শরীরটা বাড়িয়ে নদী আর অপর পাড়ের কতগুলো ধূসর বাড়ির দিকে চেয়ে রইলাম। ভয়ে আমার শরীরটা ঘামে ভেসে গেল। তারপরে ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই পালে দ্য জুস্‌তিস্‌ (Palais de Justice) আর কে দেজ়রফেভ্র (Quais des Orfèvres)-কে চিনতে পারলাম। দুঃস্বপ্নটাও যেন ধীরে ধীরে অপসারিত হল।’

    ব্যক্তি এবং সাহিত্যিক হিসেবে এই সাংঘাতিক যন্ত্রণাময় জীবন সম্পর্কে দোদের প্রতিক্রিয়া ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর কাছে সাহসী হওয়ার অর্থ অন্যদের ভয় থেকে বিরত রাখা। রোগাক্রান্ত অবস্থায় পরিবারের সঙ্গে তাঁর এই দৃষ্টান্তমূলক আচরণের সাক্ষী ছিলেন অনেকেই। তাঁর শেষ সচিব অঁদ্রে এবনের (André Ebner) তেমনই এক সকালের কথা স্মরণ করেছেন যখন অবর্ণনীয় বেদনা সহ্য করে দোদে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। সেই সময় দরজার হাতলে কারও মৃদু স্পর্শ। এবনের আশ্চর্য হয়ে দেখলেন মাদাম দোদে ঘরে ঢোকার আগেই মঁসিয় দোদে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর গালে আবার রঙের আভা, চোখে হাসির ঝলক, গলায় আশ্বাসের সুর। পুনরায় দরজাটা বন্ধ হতেই দোদে আবার চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘যন্ত্রণা ভোগ করা তো কিছুই নয়। আসল ব্যাপারটা হল ভালোবাসার মানুষেরা যাতে কষ্ট না পান তা নিশ্চিত করা।’
    ‘মরার আগে কত অজস্র বার যে তোমায় মরতে হবে।’
    যন্ত্রণার বোঝা শুধু নিজের ঘাড়ে চাপানোর ধারণাটি অধুনা অচল হয়ে গেলেও এটিই হয়ত সঠিক পথ। কঠিন হলেও। এই পথে চলতে চলতে দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণাভোগের বিড়ম্বনা আর হেঁয়ালির সঙ্গে আলফোঁস্‌ দোদের নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল। ভালোবাসার মানুষ পরিবৃত অবস্থায় আত্মীয়-বন্ধুদের যন্ত্রণামুক্ত রাখার উপায় নিজের দুর্ভোগ সম্পর্কে কমিয়ে বলা। এই স্বল্প কথনের পরিণাম কিন্তু নিজের যন্ত্রণা আরও বাড়ানো। দোদে বুঝলেন নিজের কাছে ব্যথাবেদনার যন্ত্রণা রোজই নব নব রূপে এলেও তাঁর চারপাশে যাঁরা আছেন তাঁদের কাছে তা পুরোনো হয়ে গেছে। আপনি যাই বলুন না কেন সেটা তখন পুনরুক্তি বলে মনে হবে। রোগভোগ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে আপনি তাঁদের বিরক্ত করছেন, বিড়ম্বনায় ফেলছেন। এদিকে নিজে ভবিষ্যতে আরও অবমাননা সহ্য করার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আত্মহত্যাকে তখন আত্মীয়-স্বজনের বিরক্তি উৎপাদন থেকে মুক্তি পাওয়ার শুধু যুক্তিগ্রাহ্যই নয়, বেশ লোভনীয় উপায় বলে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু আপনার নিজের মানুষেরা তো শুধু তাঁদের স্বার্থে হলেও, আপনার জীবন আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য জোরাজুরি করছে!
    ‘জেলবন্দি যখন স্বাধীনতার কল্পনা করে, তখন সেই স্বাধীনতা বাস্তবের চেয়েও সুন্দর।

    রোগীর কাছে সুস্বাস্থ্য হল অনির্বচনীয় আনন্দের উৎস -- আসলে তা তো নয়।

    আমাদের যা কিছুর অভাব আছে তাকেই স্বর্গীয় বলে মনে হয়।’

    ‘একদিন এই রকম অন্যদের কাছে বোঝা হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা, যাতে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়......’

    অসুখের বিড়ম্বনার বিরুদ্ধে দোদের নিঃশব্দ প্রতিবাদ ছিল তাঁর রচনা। রোগের লক্ষণ আর দুর্ভোগ, ভয় আর ভাবনাচিন্তা, উষ্ণ জলে স্নানের ব্যবস্থা সুলভ এমন শাওয়ার-বাথে অন্যান্য রোগীদের অদ্ভুত সামাজিক জীবনের পর্যবেক্ষণ — এ সব তিনি নোটবইতে টুকে রাখতেন। শেষ পর্যন্ত স্থির করতে পারেননি বইয়ের রূপটি কেমন হবে। অন্তরে যন্ত্রণার যে উপলব্ধি সাহিত্যে তার কথক কে হবে সে প্রশ্ন নিয়েও দোদেকে লড়াই করতে হয়েছে। একদিকে ব্যথাবেদনা সম্পর্কে বাস্তব অনুভূতির প্রকাশ, অন্যদিকে তার জন্য এমন একটি শৈল্পিক মাধ্যম নির্বাচন যাতে পরিবারকে তাঁর দুর্ভোগ থেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রাখা যায় — এই অন্তর্দ্বন্দ্বেও তিনি ভুগেছিলেন। মনে হয়েছিল সে অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাস লেখা অনুচিত হবে। তাতে অভিজ্ঞতার সত্যনিষ্ঠ প্রতিফলন ঘটবে না। আবার আত্মজৈবনিক রচনাও তাঁর পছন্দ নয় কারণ সেটা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলেও পাঠকের কাছে তা হয়ে উঠবে 'আমার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের খতিয়ান'। ঊনবিংশ শতাব্দের ফ্রান্সে এই ধরনের একান্ত ব্যক্তিগত সত্য উন্মোচনের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে ধরা হত ডায়েরি আর ব্যক্তিগত চিঠিপত্রকে।
    ‘জ়ুল দ্য গোঁকুর আর বোদল্যের। সাহিত্যিকদের রোগ। বাক্‌হীনতা।’

    ‘মহান ফ্লবের, শব্দের অনুসন্ধানে কী লড়াইটাই না করেছেন! তিনি তো প্রচুর পরিণামে ব্রোমাইড গ্রহণ করতেন। সেই কারণেই না অভিধানগুলো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল?’

    ‘হাইনরিখ হাইনের কথাও খুব মনে পড়ে। মনে হয় তাঁর অসুখটাও আমারই মত ছিল।’

    মনে মনে এই সমস্যার সমাধান আবিষ্কার করতে পেরে আলফোঁস্‌ দোদে উদ্দীপিত হয়েছিলেন। তিনি কল্পনা করলেন বেদনা সহ্য করছেন এমন দুজন মানুষের মধ্যে কথোপকথন যাঁদের উভয়েই তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের দুটি ভিন্ন দিকের প্রতিভূ। এঁদের মধ্যে অবিবাহিত যিনি তিনি পরিবারকে আঘাত না দিয়েই মনের কথা লিখতে পারেন। লেখকের ভাষ্যে: 'আপনার যদি ছোট বাচ্চা থাকে, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই তাদের জীবনের সুখী, নিষ্পাপ দিনগুলোকে নষ্ট করতে চাইবেন না। তাদের মনে এমন একজন বৃদ্ধ বাপের স্মৃতি রেখে যেতে চাইবেন না যিনি সব সময় গোঙাচ্ছেন আর অভিযোগ জানাচ্ছেন।' অন্য মানুষটি বিবাহিত বলে তাঁর অভিযোগ জানানোর প্রয়োজন নেই -- অসুস্থ হলেও তাঁর ভাগ্যে তো অন্তত পারিবারিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আর স্বস্তি জুটছে।

    আলফোঁস্‌ দোদে যদি সে রচনার পরিপূর্ণ রূপ দিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে তাঁর এই পরিকল্পনা কি সফল হত? তাৎক্ষণিক লেখা নোটের তুলনায় সে বইটি অধিক সুখপাঠ্য হত বলে মনে হয় না। মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তোলা দুই চরিত্রের পারস্পরিক কথোপকথনে দোদের নোটের সহজ অকপট ভঙ্গিকে তুলে ধরাও বোধহয় অসম্ভব হত। কিন্তু বইয়ের নামকরণ নিয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ ছিল না। ‘লা দুলু’ নামটি শিশুসুলভ হলেও — এদমঁ দ্য গোঁকুরের বিবেচনায় যা ছিল ‘জঘন্য’ – শেষ পর্যন্ত লেখকের মৃত্যুর অনেক বছর পরে আলফোঁস্‌ দোদের ষাট পাতা জোড়া নোট বই ওই শিরোনামেই প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালে।

    নামটা পছন্দ না করলেও গোঁকুরের বিশ্বাস ছিল বইটি চিত্তাকর্ষক হবে কারণ সেখানে সেই তীব্র যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে স্বয়ং লেখক যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর লেখা অন্যান্য কল্পকাহিনীতেও তো দোদে নিজের জীবনের নিবিড় পরিধির মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর বেদনার উপাখ্যানে তিনি মৃত্যুর সংস্পর্শে রইলেন। এই বইতেই তো তিনি নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেই মানুষ বলে যিনি এক লাফে যেন পঁয়তাল্লিশ বছর থেকে পঁয়ষট্টিতে পৌঁছেছেন — হঠাৎ আবিষ্কার করছেন যে মাঝের বিশ বছর যেন একেবারেই ধুয়ে মুছে গেছে। আখ্যানে নায়কোচিত কিছু না থাকলেও তিনি এই কাহিনীর নায়ক। অসুস্থ মানুষদের মধ্যে নাটকীয় পট-পরিবর্তন অথবা অদম্য সাহসের যদি কিছু বা থাকে, তাহলেও রোগভোগ তো অতি সাধারণ, বিরক্তিকর রকমের একঘেয়ে একটা ঘটনা। তুর্গেনেভ নিজেকে কলার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। স্নায়বিক দুর্বলতা তীব্র হলে তাঁর পা দুটি যখন অত্যন্ত নিরাশাজনকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত, দোদের তখন মনে হত চাকা-লাগানো গাড়িতে গোল পাথর বসিয়ে যারা ছুরিতে শান দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়ায় তাদের কথা। শান দেওয়ার সময় তাদের পা-দুটো যেমন উন্মত্তের মত ওপর-নিচ করতে থাকে, তাঁর নিজের পা-জোড়াও যেন তেমনি।

    ‘ধীর গতিতে কাজে ফেরা। মস্তিষ্কের যে অবস্থা তাতে আমি খুবই সন্তুষ্ট। নানা চিন্তার ভিড় — আর বাক্যও আসছে গড়গড়িয়ে। তবে মনে হচ্ছে এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কাজটা বেশ কঠিন। অভ্যেসটা চলে গেছে এমন হতে পারে। গত ছমাস কারখানাটা তো বন্ধই ছিল, বড় বড় চিমনিগুলো থেকে ধোঁয়াও বেরোয়নি।’

    ‘স্থান যখন সংকুচিত হয়ে আসে তখন ইচ্ছেগুলোও স্তিমিত হয়ে যায়। আজ, আর যেন ভালো হওয়ার ইচ্ছেটাও নেই -- শুধু যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই।

    গত বছরেও ওরা যদি এটা আমাকে জানাত।’

    দোদে লিখেছেন ব্যথা সম্পর্কে তিনি কোনও সাধারণ তত্ত্ব জানেন না। প্রত্যেক রোগীকে তার নিজস্ব ধারণা গড়ে নিতে হয়, কারণ ব্যথার প্রকৃতিতে তারতম্য আছে। ব্যাপারটা অনেকটা গায়কের কণ্ঠস্বরের মত যা অনেকাংশেই নির্ভর করে হলঘরটি ধ্বনি-পরিবেশনের যোগ্য কি না তার ওপর। যুবক মার্সেল প্রুস্ত যখন দোদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করলেন, তখন তিনি তো লজ্জায় দোদের চোখের দিকে তাকাতেই পারলেন না। প্রুস্ত সামান্যতম ব্যথাবেদনাও সহ্য করতে পারতেন না। ‘সেই সুন্দর অসুস্থ মানুষটিকে’ দেখে প্রুস্ত বিস্মিত হয়েছিলেন যিনি তখনও জীবন আর সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ভাবনাচিন্তা ব্যক্ত করে চলেছিলেন। কোনও এক সময় দোদে মরফিন ইঞ্জেকশন নেওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও খোলা দরজার মধ্যে দিয়ে তাঁদের কথোপকথন চলতে থাকল। দোদে যখন ঘরে ফিরে এলেন তখন তাঁর কপালে স্বেদবিন্দু। প্রুস্ত বলেছেন দেখে মনে হল যেন কেউ ‘জয়ের অচঞ্চল প্রশান্তি’ উপভোগ করছেন।
    ‘আমার খুপরি ঘরে স্নানের জায়গায় আয়নার সামনে -- কী শীর্ণতা!

    আমি লাফিয়ে চলে এসেছি পঁয়তাল্লিশ থেকে পঁয়ষট্টিতে। মাঝের কুড়ি বছর আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।’

    ‘সতর্কবার্তা অনেক দিন ধরেই আসছে। অদ্ভুত ব্যথা: তীব্র বেদনার শিখা আমার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে কাটছে।

    ......................................................

    চোখে জ্বালা। জানলায় আলোর প্রতিফলনের জন্য অসহ্য বেদনা।

    আর সেই সময় থেকেই পায়ের পাতায় সূচ ফোটানোর ব্যথা, জ্বালা আর অতি-সংবেদনশীলতা...’

    ‘প্রথম দিকে শব্দ হলেই অতি-সচেতন হয়ে পড়তাম। চুল্লির চিমটে, দরজার ঘণ্টার তীক্ষ্ণ আওয়াজ, ঘড়ির টিক্‌টিক্‌; মাকড়সার জাল যেখানে ভোর চারটেয় কর্মকাণ্ড শুরু হয়।

    অতি সংবেদী ত্বক; নিদ্রাহীনতা, কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠা।’

    ‘হাঁটাচলার সময় পাশের ছায়াটা স্বস্তি দেয়। যেমন কাছে কেউ থাকলে আরেকটু ভালো হাঁটতে পারি।’

    ব্যথাবেদনার বদলে কখনওবা লেখক হয়ত সেই ভয়ঙ্কর ত্রাসের বর্ণনা দেন যখন রোগ তাঁকে শারীরিকভাবে কাবু করে ফেলে।
    ‘রাস্তা পারাপার করা: কী ভয়ঙ্কর! চোখগুলো আর কাজ করে না, দৌড়তে পারি না, প্রায়ই এমনকী তাড়াহুড়োও করতে পারি না।’
    অথবা অসহ্য ব্যথার কথা বলতে গিয়ে নিজের সঙ্গে ডন কিহোটের তুলনা করেন:
    ‘আমি বৃদ্ধ, আহত সেই বেচারা ডন কিহোটে। গাছের তলায় বর্ম পরে পাছায় ভর দিয়ে বসে আছি। অনুভূতিটা বর্ম পরার মতই, ইস্পাতের একটা বেষ্টনী যা নৃশংসভাবে আমার পিঠের তলাটাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। গরম কয়লা যেন, বেদনার তীব্র ছুরিকাঘাত যেন আমাকে সুচের মত বিঁধছে।’
    আলফোঁস্‌ দোদে অবশ্যই জানতেন যে এই লড়াইয়ে চূড়ান্ত জয়লাভ অসম্ভব। তা হলে পড়ে রইল কী? না অনিবার্য হারকে আপনি কী দক্ষতায় সামলাতে পারেন। দোদের মনোভাবটি ছিল অসুস্থতার সঙ্গে অবাঞ্ছিত অতিথির মত ব্যবহার করা যার প্রতি কোনও বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যাবে না। দৈনন্দিন জীবন যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে।
    ‘আমি বিশ্বাস করি না যে ভালো হব, শার্কোও (ডাক্তার) তেমন ভাবেন না। তাসত্ত্বেও আমি সব সময় এমন আচরণ করার চেষ্টা করি যে আগামীকাল সকালেই যেন হতচ্ছাড়া এই ব্যথাবেদনা থেকে আমি মুক্ত হব।’
    সামাজিক পরিধিতে এই মনোভাব নিয়ে চললেও তাঁর বৌদ্ধিক সত্তা অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারত না।
    ‘জল্লাদের ভাণ্ডারে নানা কিসিমের অস্ত্রশস্ত্র মজুদ। যদি সেগুলো দেখে আপনি ভয় না পান, তা হলে সযত্নে তাদের নিরীক্ষণ করুন। আমাদের যন্ত্রণা আর ক্লেশ যেমন তার সঙ্গে জড়িত, আমাদের ছায়াও তার সঙ্গে যুক্ত। মনোযোগ দিয়ে দেখলে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়, ছায়াগুলো পালিয়ে যায়।’
    তবে ছায়ারা অল্পক্ষণের জন্যই সরে থাকে। দোদের সবচেয়ে ভয় ছিল তিনি ‘জীবন্ত সমাধিস্তম্ভে’ পরিণত হবেন: সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বাকরুদ্ধ, জড়বুদ্ধি এক মানুষ’। মোপাসঁ’র তেমন হয়েছিল, জীবনের শেষ আঠারো মাস তিনি উন্মাদাগারে কাটিয়েছিলেন। দোদেকে সেই চূড়ান্ত বিস্মৃতি সহ্য করতে হয়নি। আঠারো শো সাতানব্বই এর নভেম্বরে প্যারিসে স্ত্রী-সন্তান পরিবৃত অবস্থায় নৈশভোজে এদমঁ রোস্তঁ’র নাটক সিরানো দ্য বেরজ়েরাক এর সাম্প্রতিক মহড়া নিয়ে গল্প করতে করতে চেয়ারে আসীন অবস্থাতেই আলফোঁস্‌ দোদে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
    ‘সবচেয়ে সহজ স্বাভাবিক যে কাজ সেগুলো করতেও সব সময় মনের জোর লাগছে: হাঁটাচলা, উঠে দাঁড়ানো, বসে পড়া, খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা, টুপিটা খোলা বা পরা — সত্যিই ভয়ঙ্কর! যে জিনিসটার ওপর ইচ্ছেশক্তির কোনও প্রভাব নেই সেটা হল চিন্তাভাবনার নিরবচ্ছিন্ন চলন। সেখানে থেমে দাঁড়াতে পারলে কী ভালোই না হত! কিন্তু না। দিবসরজনী সেই মাকড়সাটা ঘুরেই চলেছে। শুধু ক্লোরালের দু-এক মাত্রা প্রয়োগ করলেই কেবল ঘণ্টা দুয়েকের পরিত্রাণ মেলে। বহু বছর আগেই তো ম্যাকবেথ মৃত্যুকে হত্যা করেছে।’

    ‘আজ রাতে ব্যথা ছোট্ট একটা দুষ্টু পাখির মত আমার সূচের খোঁচা খেয়ে এখানে সেখানে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার হাতে-পায়ে, তারপরে একেবারে আমার অস্থিসন্ধির ওপর। ইঞ্জেকশনটা বার বার লক্ষ্যচ্যুত হয় আর ব্যথাও বাড়তে থাকে।’

    অমরত্বের ব্যাপারে লেখকের কোনও মোহ ছিল না। গোঁকুরের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন। গোঁকুর মনে করতেন মৃত্যু হল সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। মানুষ ক্ষণস্থায়ী বস্তুসমষ্টি। আর ঈশ্বর বলে যদি বা কেউ থেকে থাকেন, আমাদের প্রত্যেকের জন্য তাঁকে যদি আবার পুনর্জন্মের ব্যবস্থা করতে হয়, তা হলে তাঁর পক্ষে হিসেব রাখার কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে। দোদে সহমত পোষণ করে বন্ধুকে তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি যেন হলুদ ফুলের গুল্মের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছেন। তাঁর চারদিকে বীজ ফোটার মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দোদের মনে হয়েছিল আমাদের জীবনগুলোও তেমনি। মৃদু শব্দ করে বীজের ফুটে বেরোনো।
    ‘মৃত্যু চালাকি করে আমাদের ছেঁটে সরিয়ে দেয়। দেখে মনে হয় যেন ভিড় পাতলা করা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোনও একজন একদিন চলে যাই; আরেকজন যাই তার কিছু পরে। এই করতে করতে এমন একটা সময় আসে যখন আমরা দু-পা পিছিয়ে এসে চারদিকটা দেখে বোঝার চেষ্টা করি কে নেই। নিজের প্রজন্মের ব্যাপক হত্যালীলা অনুধাবন করতে হয় এই ভাবে।’
    গুরুতর অসুস্থতা থেকে জীবনে আসে ধারাবাহিকতার পরিবর্তে শূন্যতা বা ছেদ। ব্যথাবেদনা এত তীব্র হতে পারে যাতে সক্রিয় জীবন থেকে মানুষকে দূরে সরে থাকতে হয়। এই যে অপসারণ, জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া, সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটানো যায় কীভাবে? আলফোঁস্‌ দোদের ধারাবাহিকতা-বর্জিত এই খাপছাড়া নোটগুলোর গঠনই এমন যে তাতে সেই ফাঁক তো রয়েই গেছে। যন্ত্রণা যখন তীব্র হয়, তখন সাময়িকভাবে লেখায় ছেদ পড়ে। প্রতিটি নোটের মধ্যে যে ফাঁকফোকর, তা যেন ইঙ্গিত করছে দুটি অনুচ্ছেদ রচনার অন্তর্বর্তী সময়ের দিকে — যখন লেখা হয়ে ওঠেনি। এই বিরামের জন্যই এক দশকের যন্ত্রণা প্রতিবিম্বিত হতে পেরেছে ষাট পৃষ্ঠায়। যে বাক্যটি হঠাৎ ভেঙে গেল, দুটি এনট্রির মধ্যে সময়ের বিচ্যুতি আর রচনার স্বল্পতা — এসবই লেখকের জীবনের তৎকালীন বিপর্যয়ের পরিচায়ক। তিনি রোগের সঙ্গে লড়তে লড়তেই লিখেছেন। রচনার অসংলগ্নতার অর্থ গুরুতর অসুস্থতা চিন্তাভাবনায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে, ছেদ টেনেছে। সময় থেমে থেকেছে, দোদে তাঁর শরীর নিয়ে এতই বিপর্যস্ত থেকেছেন যে বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্ব মুছে গেছে। আসলে বেদনার অবস্থান যে এই রচনার বাইরে। তার শ্রেষ্ঠ প্রতিরূপ যেন পাওয়া যাচ্ছে অনুপস্থিতি আর নীরবতার মধ্যে। মানসিক সেই নৈঃশব্দ্যের চমকপ্রদ এবং বিরল উদাহরণ হয়ে রইল আলফোঁস্‌ দোদের বেদনার এই আখ্যানটি।


    তথ্যসূত্র:

    ফরাসি:

    ১. Oeuvres Complètes Illustrées; Éditions ne varietur: La Doulou (La Douleur) 1887-1895 ; Alphonse Daudet; Librairie de France ; 110 Boulevard Saint-Germain, Paris ; 1930

    ইংরেজি:

    ২. In the land of Pain, Alphonse Daudet; Translated and edited by Julian Barnes; Alfred E Knopf; New York; 2002

    (সূত্রোল্লেখ না থাকলে নিবন্ধের মধ্যে ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলির উৎস ১৯৩০-এ প্রকাশিত উল্লিখিত ফরাসি গ্রন্থটি। মূল ফরাসি থেকে উদ্ধৃতিগুলির অনুবাদ প্রবন্ধকারের। লেখকের ছবিও ওই বই থেকে সংগৃহীত।)

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments