• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | গল্প
    Share
  • নয়ন জেলের নৌকো : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়



    ।।১।।

    কখন যে আকাশে মেঘেদের মিছিল হল, জমায়েতে নেতৃস্থানীয়রা বক্তব্য রাখলেন, নিম্নচাপের তাড়া খেয়ে লরী-বোঝাই ভাড়ার জনতা এল আর ফিরে গেল, বিলকুল টের পাইনি। সকালবেলা রাস্তার ওপর পড়ে থাকা দু’-দশ পাটি ছেঁড়াখোঁড়া চপ্পল আর ফ্রী-টিফিনের এঁটো কাগজের প্লেট ছাড়া হুজ্জুতের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য নজর করে দেখলে বোঝা যায় সেগুলো নিছক ঝরে পড়া হলদে-সবুজ বাদাম পাতা। আজ অফিসের ছুটি, বারান্দার দরজা খুলতেই দেখি খবরের কাগজের সঙ্গে কে যেন একখানা সাদা আলোর লেফাফা ফেলে দিয়ে গেছে। খাম ছিঁড়তেই ঝকঝকে নীল আকাশ, ফুড়ুৎ পাখিগুলো যেন পাখি নয়, আসমানি কাগজে গোটা-গোটা অক্ষর, হাতে লেখা চিঠি... নিচে ইতি ভবদীয় পচ্ছিমঘাট পর্যন্ত দৃশ্যমান। পাহাড়টা যে এতদিন বাড়ির পাশে ঠায় পায়ে দাঁড়িয়েছিল সেটাই ভুলে মেরে দিয়েছিলাম।

    এতদিন ভাবতাম আমার চোখের অসুখ, বয়স বাড়লে যেমন হয়। আজ মনে হল অসুখটা অন্য কারও, অন্য কোথাও। যদিও আজ কিছুটা উপশম হয়েছে। গত রাতের ঝড়-বাদলে হাওয়ার কার্বন-কণা ধুয়ে গেছে, শহরের পেটের নিচের নালা-নর্দমার ল্যাবাইরিন্থ দিয়ে অন্ধকার জলের স্রোত বয়ে গেছে সমুদ্রের দিকে। তবু অস্বস্তিটা যেন রয়েই গেছে। সে সব তাচ্ছিল্য করে বেরিয়েই পড়া যায়, যাযাবর পাখিরা যেমন আকছার বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য এখন আর আগের মতো অচেনা রেলওয়ে স্টেশানে নেমে পড়ার দিন ফুরিয়েছে। এমনকি হতভাগা পাখিরাও আহাম্মকের মতো ঘুরে ফিরে চেনা জায়গায় ফিরে আসে, যতই অবৈধ শিকারের নিশানা হোক না কেন। রোজ ক্রীক ব্রীজ পেরোবার সময় দেখি তাদের অস্থায়ী বেসক্যাম্প, কালো পাথরের ওপর তারা মৌসুমী ফুলের মতো ফুটে রয়েছে, ইচ্ছে মতো ঢেউয়ে দুলছে, জল মাখছে, নোনা মাছ খুঁটে খাচ্ছে।

    এইসব ভাবনার মাঝখানে খুট করে ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি খুলে মহুয়া বেরিয়ে এল। অনভ্যাসের কাঁটা চড়চড়, মহুয়া যে বাড়িতে আছে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। একটা সময় ছিল যখন সকালে ঘুম ভেঙে হাত বাড়ালে অনায়াসে মহুয়ার বাসি শরীর ছুঁয়ে দিতে পারতাম। মহুয়ার চিরকাল বেলা করে ঘুমনো স্বভাব, গুনগুন করে আপত্তি করত, অন্য পাশ ফিরে শুত। আমি ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিতাম, আধা ঘুমন্ত শরীরের ওম নিতাম। সে’সব দিন তামাদি হয়ে গেছে। আপাতত বিষণ্ণ হয়ে ভাবলাম, আজ আর পাখি দেখতে বেরনো সম্ভব হবে না। কারণ পাখি দেখতে যাবার জন্য মহুয়া কোনওদিনই তেমন উৎসাহ দেখায়নি।

    মহুয়া থাকাকালীন ছুটির দিনগুলোয় আমরা সাধারণত বাতানুকুল মলে বেড়াতে যেতাম। হাতে হাত জড়িয়ে আলো-ঝলমল দোকানপাট দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়াতাম। কাচের জানলায় ম্যানিকুইনের উদ্ধত শরীরে চড়ানো কোনও পোশাক চোখে লাগলে মহুয়া আমায় শো-রুমের ভিতরে টেনে নিয়ে যেত। এক গুচ্ছ পোশাক হাতে নিয়ে মহুয়া ট্রায়াল রুমে ঢুকত আর আমি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পায়ের নিচে শিকড় গজিয়ে যেত। মাঝে মাঝে ট্রায়াল রুমের দরজা খুলে মহুয়া চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করত, কেমন? আজ অবশ্য আমারই একটা বারমুডা আর টি-শার্ট পরে আছে মহুয়া, টি-শার্টটা ঢলঢল করছে, কাঁধ থেকে সরে গিয়ে অন্তর্বাসের স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে। কাল রাতে সে নিঃস্ব হয়ে এসেছিল। অধৈর্য বেলের শুনে দরজা খুলে দিতে মুখ কালো করে ঘরে ঢুকে বলেছিল, “সব শেষ করে দিয়ে এলাম, সায়ন।”

    দেওয়াল ঘড়িতে দেখেছিলাম রাত প্রায় দুটো, এই সময় অপদেবতারা পৃথিবীর দখল নেয়, মানুষের সঙ্গে নাজায়েস সম্পর্ক পাতায়। মুহূর্তের জন্যে আমার সন্দেহ হয়েছিল তেমন কেউ মহুয়ার ছদ্মবেশে ঘরে ঢুকে পড়েছে! কিন্তু মহুয়ার ‘শেষ’ শব্দটার উচ্চারণ শুনে দ্বিধা কেটে গিয়েছিল। ওইভাবে সাপের মতো হিস হিস করে মূর্ধন্য ষ’র ওপর জোর দিয়ে “শেষ” শব্দ উচ্চারণ করতে ওকে আমি আগেও অনেকবার শুনেছি। ঘুমের আঠায় আমার চোখ জড়িয়ে ছিল, মহুয়া কী শেষ করে দিয়ে এসেছে জানতে তখন আগ্রহ দেখাইনি। বলেছিলাম, “তোমায় অসুস্থ দেখাচ্ছে, শুয়ে পড়, কাল শুনব।”

    কেন জানি না, মনে হয়েছিল আমার সঙ্গে এক বিছানা ভাগ করে নিতে মহুয়া রাজি হবে না, ওর অস্বস্তি হবে, আমারও, হাজার হোক অভ্যাস বড় বালাই। ওকে বেডরুম ছেড়ে দিয়ে একটা চাদর টেনে, ফ্যান চালিয়ে লিভিংরুমের সোফায় এসে শুয়ে পড়েছিলাম। মহুয়া কিছু বলেনি, লক্ষ্মী মেয়ের মতো বেডরুমের দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল। আলো নিভিয়ে দিতেই লিভিংরুমের জানলার শার্শিতে বিদ্যুৎ ঝলসেছিল। বর্ষা ফিরে যাবার সময় এ অঞ্চলে কখনও কখনও এ রকম অসময়ের মেঘ জমে, দু-চার ফোঁটা জল ঝরতে পারে না, নিজে নিজেই উড়ে যায়, ধুলোও ভেজে না। মহুয়ার আসাটাও যেন সেই রকম, অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

    আজ ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছে মহুয়ার আসার কারণটা জানা জরুরী। যখন গিয়েছিল বলে গিয়েছিল বরাবরের মতো চলে যাচ্ছে। মহুয়াকে যত দূর চিনি, বড় রকমের কোনও ফ্যাসাদে না পড়লে ফিরে আসত না। সামনের সোফায় এক ফালি রোদ এসে পড়েছিল, মহুয়া তার পাশে এসে বসল। ওর চোখের কোল ফুলে আছে, রগের কাছে চুলের ডগায় দু’-একটা জলের ফোঁটা দুলছে। মহুয়া সেগুলো গুছি করে কানের পিছনে সরিয়ে রাখল। পায়ের ওপর পা তুলে বসে সেন্টার টেবিলে ভাঁজ করে রাখা খবরের কাগজটার ওপর চোখ ফেলল। দেখলাম এক দৃষ্টে হেডলাইনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বারমুডার নিচে দিয়ে বেরিয়ে থাকা ওর মসৃণ উরুর দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “এবার বলো...”

    মহুয়া চমকে উঠে বলল, “কী?”

    বললাম, “কাল রাতে কী শেষ করে দিয়ে এসেছ?”

    মহুয়া চুপ করে রইল। হেডলাইনের থেকে চোখ সরাল না। বিড়বিড় করে বলল, “সব... সব... ,” আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না মহুয়া ‘সব’ বলল না ‘শব’। আমি অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে? পরিষ্কার করে বলো, আবার কী ঝামেলা পাকিয়েছ?”

    মহুয়া এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে বলল, “সায়ন, আমি আর পারছিলাম না। আমিও তো একটা মানুষ! মনের কথা বাদ দাও, রক্ত-মাংসর শরীরেরও সহ্য করার একটা সীমা থাকে। কত আর ক্ষতবিক্ষত হওয়া যায়! রোজ-রোজ, একতরফা অত্যাচার...”

    আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “সে কী! জানতে না? নিজেই তো বেছে নিয়েছিলে।”

    দুটো আঠাশ ইঞ্চির স্যুটকেসে নিজের জামাকাপড়, গয়নাগাটি গুছিয়ে অর্ণবের সঙ্গে মহুয়া চলে গিয়েছিল। প্রায় ছ’মাস হয়ে গেল। একটা যোগাযোগ না, খবর না... যদিও জানি ওরা কোথায় বাসা নিয়েছিল। একই অফিস, ঠিকানা জোগাড় করতে অসুবিধে হয়নি। অর্ণব আমাদের অফিসে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিল বরোদা থেকে। দোহারা পেটানো চেহারা, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, অসম্ভব ভাল গানের গলা। দুর্গা পুজোর সময় আমিই ওকে টেনে এনেছিলাম। অমলদার বাড়িতে রিহার্সাল ছিল, মহুয়া মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল, দৃষ্টিতে একটু লোভও মিশে ছিল কি? কে জানে?

    তারপর যা হয়, আহা বেচারার তিন কুলে কেউ নেই, গেস্টহাউসে একাবোকা পড়ে থাকে। বাড়িতে আসা-যাওয়া, প্রথম প্রথম আমি থাকতে, পরের দিকে আমি পাখি দেখতে বেরিয়ে গেলে। সিউরি জেটি থেকে ফ্লেমিঙ্গোদের ঘর-সংসার দেখে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে দেওয়াল থেকে পোড়া নিকোটিনের গন্ধ পেতাম, জলের শব্দের ওপর কান পেতে শুনতাম মহুয়া গান ধরেছে, ‘না জানে কোই, ক্যায়সি হ্যায় ইয়ে জিন্দেগানি, হামারি আধুরি কাহানি...।’ একবার সিঙ্গাপোরে ক্লায়েন্ট সাইটে যেতে হল, দু’-মাসের জন্য, ফিরে এসে শুনলাম ওরা মনস্থির করে ফেলেছে... মহুয়া বলল, “তুমিও তো আটকাওনি, ঠেলে দিয়েছিলে, নর-রাক্ষসটার মুখে।”

    হয়তো আমারও দোষ ছিল কিছুটা। আসলে তখন আমার মাথার মধ্যে পাখি দেখার নেশা চেপে বসেছে। ছুটির দিন হলেই আমি ক্যামেরা ঘাড়ে করে, নয়ন জেলের ডিঙি নৌকোয় চড়ে স্যান্ডপাইপারদের ওড়াউড়ি দেখতে যেতাম। নয়ন দাঁড় বাইত, আমি ছবি তুলতাম। প্রতি শীতে এই শহরের আনাচে কানাচে জলা জমিতে হাজার হাজার মাইগ্রেটরি পাখি এসে সাময়িক আস্তানা পাতে। পাখির জীবন দেখতে গিয়ে আমি মহুয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। তাকিয়ে দেখলাম মহুয়ার ঠোঁটের কোণে রক্ত জমে আছে, হাতে কালশিটের দাগ, বললাম, “এখন আর সে সব কথা আলোচনা করে কী লাভ?”

    মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “লাভ লোকসান জানি না। তখন আটকালে আজ অর্ণবকে এইভাবে মরতে হত না।”

    আমি আঁতকে উঠে বললাম, “মানে? অর্ণব মারা গেছে? কবে? কীভাবে?”

    মহুয়া বলল, “আমার আর কোনও উপায় ছিল না সায়ন।”

    আমি ঝুঁকে পড়ে বললাম, “মহুয়া, ছেনালি কোরো না, খুলে বলো, কী হয়েছে? কিচ্ছু লুকোবে না।”

    মহুয়া বলল, “লুকোবার কী আছে? ঘুমের মধ্যেই জানোয়ারটার মাথা থেঁতলে দিয়েছি। ও আর কোনওদিন জাগবে না, মদ খেয়ে ঘাড়ের ওপর এসে হামলে পড়বে না। আঃ কী শান্তি!”

    আমি হাত পা হিম হয়ে আসছিল, মেয়েটা বলে কী! মহুয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, “সায়ন, আমার গা চটচট করছে, আমি চান করব। বাথরুমের গীজারটা কাজ করছে না। ইলেক্ট্রিশিয়ানকে ফোন করো না একটা।”

    ।।২।।

    মহুয়াকে বলেছিলাম দেরি হবে না, কিন্তু ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে গেল। সকালে চা শেষ করে আমি ক্যামেরা আর লেন্সগুলো ব্যাগে ঢোকাচ্ছিলাম, মহুয়া জিজ্ঞেস করেছিল, “বেরোচ্ছ নাকি কোথাও?”

    আমি বলেছিলাম, “কাছেই, সি-উডস-এ... এ বছর আর্ক্টিক রাশিয়া থেকে অনেকগুলো কারলিউ স্যান্ডপাইপার এসেছে, ট্যাগড বার্ডস...”

    মহুয়া নিজেই চা বানিয়েছিল, যেমন আগে বানাত। গরম চা খেতে পারে না বলে কাপের কিনারায় ফুঁ দিয়ে বলেছিল, “বডিটার তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়!” যেন তার যা করনীয় ছিল সে করে এসেছে, বাকি সব দায়িত্ব আমার। তার নির্ভরতা দেখে আশ্চর্য লেগেছিল, সতর্ক হয়ে বলেছিলাম, “অন্ধকার নামার আগে ওখানে ফিরে যাওয়া নিরাপদ নয়। কে কখন দেখে ফেলে...”

    ঠোঁটের থেকে কাপ সরিয়ে মহুয়া বায়না করেছিল, “তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে পাখি দেখতে যাই, একা একা বাড়িতে বসে থেকে কী করব?”

    ওর ন্যাকামি দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল, বলেছিলাম, “না, তুমি থাকো। ইলেক্ট্রিশিয়ানকে ফোন করেছি, এসে পড়বে। তুমি চেনো... মধু পাটিল, গীজারটা ঠিক করিয়ে নিও... টায়ার্ড আছ, চান-খাওয়া করে রেস্ট নাও। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।”

    রাতে ফিরে এসে দেখলাম ডাইনিং টেবিলে ডিনার রেডি। মহুয়া রান্না করেছে। টান-টান করে চুল বেঁধেছে। মুখে অল্প রূপটান। দু-একটা কস্মেটিক সামগ্রী আমার অজান্তে এ বাড়িতে পড়ে ছিল হয় তো। অথবা ওর হ্যান্ডব্যাগে। আমায় দেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এত দেরি করলে, মোবাইলও ধরছিলে না... ভাবছিলাম আমায় ফেলে চলে গেলে কি না!”

    শুকনো হেসে বললাম, “কে কাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, মহুয়া?”

    মহুয়া আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “সরি গো...”

    ইচ্ছা হচ্ছিল একটা অলৌকিক ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মাঝখানের ছ’টা মাস মুছে দিই। সারাদিন জলে জঙ্গলে ঘুরে খিদে পেয়েছিল, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। মহুয়া প্লেটে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, মুখে তুলছিল না। বললাম, “কী হয়েছে? খাচ্ছ না কেন?”

    মহুয়া মুখ চুন করে বলল, “তুমি আসছ না দেখে আমি একটা হঠকারিতা করে বসেছি।”

    মহুয়া একটার পর একটা ফ্যাসাদ বাঁধাবে আর আমাকে সমাধান খুঁজে বার করতে হবে, আমাদের যৌথ-যাপনের এটাই নিয়ম। আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “কী?”

    মহুয়া বলল, “বারীনদাকে ফোন করেছিলাম...”

    বারীন শাসমল মহুয়ার দূর সম্পর্কের দাদা, আন্ধেরিতে থাকেন, বৌ মরাঠি, শ্বশুরের ভাল পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, একবার অ্যাসেম্বলি ইলেকশানে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করলাম, “বারীনদাকে বললে সব কথা?”

    মহুয়া বলল, “মন দিয়ে শুনলে তো? অর্ধেক শুনেই বলল, তোর সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয় না, আসছি... এসে সব শুনব।” নাও, ল্যাটা সামলাও! কোথায় কোন অন্ধকার ফ্ল্যাটে একটা দেড় দিনের বাসি মড়া পড়ে আছে, আর কয়েক ঘন্টা ওই ভাবে থাকলে পচে গন্ধ বেরোবে, লোক জড়ো হবে, পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ঢুকবে... সেটার ঠিকানা লাগানোর বন্দোবস্ত হল না, এর মধ্যে বারীনদা! অবশ্য ব্যাপারটা থানা-পুলিশ অবধি গড়ালে বারীনদার হেল্প লাগবে। লোকটার ওপরমহলে চেনাজানা আছে। বললাম, “বেশ করেছ। বারীনদাকেও নিয়ে যাই, চল। এমনিতেও অর্ণবের বডি ওঠাতে আর একজন লোক লাগবে, আমার একার দ্বারা হবে না।”

    মহুয়া বলল, “তোমার কী মনে হয় বারীনদা যেতে রাজি হবে?”

    “তুমিই তো বলতে, বারীনদা তোমায় খুব ভালবাসেন। আদরের বোনের জন্য এইটুকু করবেন না,” আমার গলায় হালকা বিদ্রূপ ছিল, মহুয়া ধরতে পারল না, বলল, “দেখি বলে...”

    মহুয়া কাস্টার্ড বানিয়েছিল। কাস্টার্ড পাউডারের এক্সপায়ারিটা দেখে নিয়েছিল কিনা কে জানে। মহুয়া চলে যাবার পর থেকে ঘরে রান্নাবান্নার পাট চুকে গিয়েছিল। এক চামচ কাস্টার্ড মুখে দিতেই দরজায় বেল বাজল। মহুয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। বারীনদা মানুষটা বাইরে থেকে চমৎকার মিশুকে। তবে আমার কেমন জানি মনে হয় ওটা বারীনদার ভেক। হাসি-হাসি মুখ করে ভিতরের ধূর্তামিটাকে সযত্নে আড়াল করে রাখেন। বারীনদা ডিনার করে এসেছেন। মহুয়া এক বাটি কাস্টার্ড এনে দিল। বারীনদা চামচের মাথায় কাস্টার্ড লাগিয়ে জিভে ঠেকিয়ে বললেন, “ফোনে কী যেন বলছিলি, মার্ডার-ফার্ডার... আজকাল যা হয়েছে, ফোন ট্যাপ করা কোনও ব্যাপার নয়, মিডিয়া খবর পেলে বেকার হাল্লা মাচাবে... তাই ভাবলাম চলেই আসি।”

    মহুয়া বলল, “দাদামণি, খুব ভাল করেছ এসেছ, তোমাকে একটা উপায় করতেই হবে।”

    বারীনদা মহুয়াকে আশ্বস্ত করে বললেন, “আহা, কী হয়েছে বলবি তো!”

    মহুয়া পুরো ঘটনাটা আবার বারীনদাকে শোনাল। অর্ণবের জোর জবরদস্তির বিবরণ দিতে দিতে ওর চোখ ছলছল করে উঠছিল। বারীনদা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে ডিটেলস জেনে নিচ্ছিলেন। এত কথা মহুয়া আমায় বলেনি। যেমন আমি জানতাম না, মৃত্যুর সময় অর্ণব সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় উল্টো হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। মহুয়া একটা অব্যবহৃত শিলনোড়ার নোড়া দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়। তারপর তার নাকের নিচে আঙুল রেখে নিঃশ্বাস পড়ছে না দেখে নিশ্চিত হয়, সে আর উঠবে না, ইত্যাদি। বাটির গায়ে লেগে থাকা কাস্টার্ডের শেষ চিহ্নটি পর্যন্ত বিলুপ্ত করে বারীনদা টেবিলের ওপর রাখা জলের বোতলের জন্য হাত বাড়ালেন। বোতলটা খালি। মহুয়া জল আনতে কিচেনে গেল। আমি বারীনদার দিকে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝলেন?”

    বারীনদা গলা নামিয়ে বললেন, “ছুটকিটা, ছোট থেকেই মিথ্যে কথা বলতে ওস্তাদ।”

    আমি বলতে যাচ্ছিলাম মহুয়া আমায় যে গল্পটা বলেছে তার সঙ্গে বারীনদাকে শোনানো গল্পটার বিস্তর ফারাক। আমায় বলেছিল অর্ণব গত রাতে পার্টি থেকে ড্রিঙ্ক করে ফিরেছিল। বারীনদাকে বলার সময় বলল, সে ঘরে বসেই মদ খাচ্ছিল। আমি মুখ খোলার আগেই মহুয়া ওয়াটার ফিল্টার থেকে জল নিয়ে ফিরে এল। বারীনদা ঢকঢক করে আধ বোতল জল খেয়ে বোতলে ছিপি লাগাতে লাগাতে বললেন, “চল ছুটকি, ব্যাপারটা দেখে আসি। তোদের সেই বিল্ডিংটা এখান থেকে কত দূর?”

    মহুয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল, “তুমি যাবে? ব্যাস, তাহলে আমার আর কোনও ভাবনা নেই।”

    আমরা তিন জনে বেরনোর জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছিলাম। ল্যান্ডলাইনে একটা ফোন এল। আমি তুলে ‘হ্যালো’ বললাম। অন্যদিক থেকে কাকের মতো কর্কশ গলায় মরাঠিতে কেউ বলল, লোকাল থানা থেকে বলছি, সায়ন কর্মকারের সঙ্গে কথা বলা যাবে? আমার গলা শুকিয়ে উঠল, কোনওমতে বললাম, “বলতোয়ে...”

    লোকটা বলল, আমার পাশপোর্ট-রিনিউয়ালের অ্যাপ্লিকেশান পুলিশ ভেরিফিকেশান জন্যে এসেছে, আমি যেন অরিজিনাল ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে পুলিশ স্টেশানে গিয়ে দেখা করি। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। মহুয়া আর বারীনদা উৎকণ্ঠিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিছু না। বারীনদা মহুয়াকে বললেন, “চাবি নিতে ভুলিস না।”

    মহুয়া হ্যান্ডব্যাগ খুলে চাবি খুঁজল। আমি বললাম, “চাবি আমার কাছে। একটু আগেই তো দিলে রাখতে।”

    মহুয়া অন্যমনস্ক ভাবে তাকাল যেন মনে করতে পারছে না। ওকে দেখে নার্ভাস লাগছিল। নেমে এসে সবাই বিল্ডিং-এর পার্কিং লটের দিকে এগোচ্ছিলাম। বারীনদা থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “অটো পাওয়া যাবে না?”

    বারীনদার কথায় যুক্তি আছে। সবাই এক সঙ্গে না যাওয়াই ভালো। বারীনদা বাসার চাবি আর মহুয়াকে নিয়ে অটোতে রওনা দিলেন। আমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে গাড়িতে। ডেডবডিটার গতি করতে হলে গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। মহুয়াদের বিল্ডিং থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি পার্ক করে আমি হেঁটে এগোলাম। মহুয়াদের সাত তলার ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে কলিং বেলের স্যুইচে হাত রাখতেই বারীনদা দরজা খুলে দিলেন। ছোট্ট এক চিলতে লিভিংরুম, সোফা, সেন্টার টেবিল, ফ্লাওয়ার ভাস। বেডরুমের দরজাটা খোলা, এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, মহুয়া কেমন হতভম্ব হয়ে খাটের ওপর বসে আছে। একটা ফটফটে সাদা চাদর টান-টান করে পাতা, দুটো ফুলো-ফুলো বালিশ, অর্ণবের লাশের চিহ্নমাত্র নেই। আমি খাটের তলায় উঁকি দিতে যাচ্ছিলাম, বারীনদা আমার হাত ধরে টানলেন। বারীনদার মুখ দেখে বুঝলাম, লাভ নেই। বললেন, “তুমি আসার আগে তন্নতন্ন করে পুরো ফ্ল্যাট খুঁজেছি। একটা ইঁদুর বা টিকটিকিও মরে পড়ে নেই।”

    আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “মানে?”

    বারীনদা বললেন, “মানেটা তোমায় বুঝিয়ে দিতে হবে সায়ন? ফুর্তি খতম, পয়সা হজম। অর্ণব ছুটকিকে ফেলে পালিয়েছে। ছুটকি সেটা মেনে নিতে পারছে না। হাবিজাবি গল্প বানাচ্ছে। জেনেবুঝে না অজান্তে বলতে পারব না। আমার মনে হয় ছুটকিকে কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। হয় তো কিছু সুরাহা হবে।”

    আমি অস্ফুট স্বরে বললাম, “সাইকিয়াট্রিস্ট... !”

    বারীনদা বললেন, “অবশ্য সেটা তোমাদের পার্সোনাল ব্যাপার।”

    মহুয়ার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আমার কষ্ট হল। চেষ্টা করেও ওকে না ভালবেসে পারি না। ওর কাঁধে হাত রাখলাম। মহুয়া আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল, আমার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “বিশ্বাস করো... প্লিজ, বিশ্বাস করো...”

    ।।৩।।

    “আমি কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি সায়ন? যা নয় তাই দেখছি?”

    “মহুয়া, রিল্যাক্স! ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা বন্ধ করো।”

    “কিন্তু আমার পরিষ্কার মনে আছে...”

    “এটা জাস্ট একটা মানসিক অবস্থা, তুমি মনের মধ্যে যা চাইছ তাই দেখতে পাচ্ছ। তুমি অর্ণবের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য ওকে খুন করতে চেয়েছিলে, তাই দেখেছ। একে হ্যালুসিনেট করা বলে। আমরা তো ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিই...।”

    “সেরে যাব তো সায়ন? আমার ভীষণ ভয় করছে।”

    “নিশ্চয়ই সেরে যাবে। দেখো, সেদিনের ঘটনার পর একবারও কি উল্টোপাল্টা কিছু দেখেছ?”

    “না, তবে তোমার কথা শুনে শুনে আজকাল চোখ বুজলে আমিও পাখিদের ওড়াউড়ি দেখতে পাই... কালো জল-পাথরের ওপর হাজার হাজার গোলাপি রঙের পাখি থিকথিক করছে। উড়ছে, খেলছে, নৌকোর গলুইয়ের ওপর গিয়ে বসছে।”

    আসলে মহুয়া পশ্চিমের জানলায় দাঁড়িয়ে পাখি দেখে। আমাদের ফ্ল্যাটটা একুশ তলায়। জানলা দিয়ে কোলিদের বস্তি, খাড়ির সমুদ্র দেখা যায়। কোলি জেলেরা গরান গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ডিঙ্গি নৌকো চলার মতো সুঁড়িপথ কেটে রেখেছে। জোয়ারের সময় তারা সেই আঁকাবাঁকা জল-রাস্তা দিয়ে নৌকো বেয়ে মাছ ধরতে যায়। সব নৌকোই কি আর যায়! দু-চারটে বয়স্ক নৌকো ঘাটে আঘাটায় বাঁধা থাকে, জলের ওপর দোল খায়, একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে, ঢেউয়ের গল্প, ঝড়ের গল্প... খোঁজ নিলে পাখির ছবি তোলার জন্য সে রকম নৌকা সহজেই ভাড়া পাওয়া যায়। কাছেপিঠেই বিচরণ, গভীরে যাওয়া তো নয়, কাজ চলে যায়। আমি একাই যাই সাধারণত, নয়ন জেলের খোলির সামনে এসে দরজা ধাক্কা দিই। আগে নয়ন সঙ্গে যেত, এখন দূর থেকে দেখিয়ে দেয় কোথায় নোঙর করা আছে। নৌকা বেয়ে পাখিদের কলোনির কাছাকাছি চলে যাই, সাবধানে, এদিক-ওদিক পেতে রাখা মাছ ধরার জাল এড়িয়ে। নৌকো বাইতে আমার ক্লান্তি লাগে না। মহুয়া বলে, “আমাকে একদিন নিয়ে চল না গো তোমার সঙ্গে।”

    আমি বলি, “রোদ-বাদলে কোথায় যাবে? তার চে’ চল মলে যাই, এত ভালবাসতে শপিং করতে!”

    মহুয়া ম্লান মুখে বলে, “ভাল লাগে না আর।”

    অর্ণব সেই যে বেপাত্তা হয়েছে, কোনও খবর নেই। অফিস থেকে তাকে অ্যাবস্কন্ডিং ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে। মহুয়া বারীনদার সঙ্গে থানায় গিয়ে একটা মিসিং কমপ্লেন লিখিয়ে এসেছে। পুলিশ সেটা নিয়ে খুব উদ্যোগ দেখিয়ছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে বারীনদা বা তার শ্বশুরের কোনও হাত আছে কি না বলতে পারি না। মহুয়াকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। এক গাদা ঘুমের ওষুধ, নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো খেয়ে মহুয়া দিনরাত ঝিমোয়। মাঝে মাঝে তার খুব কাজ করার উৎসাহ হয়। একদিন আমায় জিজ্ঞেস করল, “শিলনোড়াটা কোথায় রেখেছ? খুঁজে পাচ্ছি না।”

    আমি বললাম, “মিক্সি আছে তো, শিলনোড়ার কী দরকার?”

    সে বলল, “নারকোল বেটে নাড়ু বানাব। মিক্সিতে মিহি করে বাটা হয় না।”

    বললাম, “ফেলে দিয়েছি, শিল কাটাবার লোক পাওয়া যায় না এখানে।”

    মহুয়া বিমর্ষ হল। আমি ওর মন ভাল করার জন্যে বললাম, “চল, কোথাও বেড়িয়ে আসি দিন কয়েকের জন্য।”

    মহুয়া খুশি হয়ে বলল, “যাবে? মুসৌরি পাহাড়ে যাই চল। খাদের ধারে পাথরের বেঞ্চিতে দুজনে বসে থাকব। আমার শীত করলে তুমি তোমার গায়ের পশমিনা চাদরের মধ্যে আমায় জড়িয়ে নেবে, হাতের পাতায় ঠোঁট লাগিয়ে ভাপ দেবে। ”

    সেদিন রাত্তিরে ডিনারের পরে দু’জনে বেডরুমে বসে বেড়ানোর প্ল্যান করলাম। রাত বাড়লে উঠে আসছিলাম, পরের দিন অফিস, মহুয়া আমায় বুকের ওপর টানল। মহুয়া ফিরে আসার পর থেকে আমরা কাছাকাছি হইনি, কোথায় যেন একটা বাধা, অনভ্যাসের নিষেধ। মহুয়া শুনল না। সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে পাখি দেখাতে নিয়ে গেল। বিদেশি পরিযায়ী পাখি নয়, তুরুক লাফ বুলবুলি। আদর শেষ হলে আমার বুকের মধ্যে গুটিসুটি হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। আমি জেগে রইলাম।

    আসলে জেগে থাকা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। কত রাত ঘুমোই না। মহুয়া জানে না। ছাই রঙের একটা প্যাঁচা আমার রাতের ঘুম ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেছে। ঘুম যেন মেঠো ইঁদুর, মহুয়ার চাঁদের মতো রূপে মোহিত হয়ে গর্তে ঢুকতে ভুলে গিয়েছিল, পালাতে পারেনি। আসলে ব্যাপারটা অত রোম্যান্টিক কিছু নয়, ঘুমনোর চেষ্টা করলেই আজকাল চোখের মধ্যে একটা নগ্ন শরীর ঢুকে পড়ে। কাঠ কাঠ হাত পা, রাইগর মর্টিস সেট ইন করে গেছে, দুমড়ে মুচড়ে আঠাশ ইঞ্চির স্যুটকেসে ঢোকাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছিল সেদিন।

    দিনের আলোয়, সবার নজর এড়িয়ে সাত তলার ওপর থেকে স্যুটকেসটাকে কী করে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়েছিলাম আমিই জানি। কেউ দেখে ফেললে জবাবদিহি করতে প্রাণ বেরিয়ে যেত। বিল্ডিং-এর ওয়াচম্যান খৈনি ডলতে ডলতে চোখে সন্দেহ নিয়ে তাকিয়েছিল। ওকে বলেছিলাম, সাত তলার ম্যাডাম বাসা বদলাচ্ছে। পার্সের ভিতরে যত্ন করে রাখা মহুয়ার ছবি দেখিয়েছিলাম। এই অঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ এগারো মাসের কড়ারে বাসা ভাড়া নেয়। এগারো মাস অন্তর-অন্তর নতুন বাসায় সংসার পাতে। ওয়াচম্যান আশ্বস্ত হয়েছিল। স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতে যেতে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফালতু ঝুট-ঝামেলায় কেন জড়াচ্ছি। উত্তর পাইনি।

    কোলি বস্তির কিনারায় গাড়ি থামিয়ে নয়নের ঘর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। নয়নের সেদিন ধুম জ্বর, খোলির বাইরেও আসেনি। আমি ওকে আওয়াজ দিয়ে জানিয়েছিলাম, যাচ্ছি। নৌকা খুলে দিয়েছিলাম, ভাঁটার টানে সমুদ্রের দিকে ভেসে গিয়েছিল নয়ন জেলের ডিঙি। শ্বাসমূলের শাসন পেরিয়ে নির্জন জলের ওপর, নৌকোর পাশটিতে অর্ণবকে শুইয়ে দিয়েছিলাম। শবদেহটা আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছিল। জল ওকে টেনে নিয়ে যাবে গভীর সমুদ্রে। সামুদ্রিক প্রাণীরা ওর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবলে খাবে। দৈবক্রমে যদি কোথাও শক্ত জমি খুঁজেও পায় ওকে শনাক্ত করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।

    সবাই অর্ণবকে ভুলে যাবে, ওই নামে যে কেউ কোনদিন ছিল সে কথারও কেউ হদিশ রাখবে না। ঘটনাচক্রে সেদিন রাতে বারীনদার মতো ধুরন্ধর লোক সাক্ষী থাকায় পুলিশও তদন্ত করার দরকার মনে করেনি। কত মানুষই তো এমন বিনা মতলব লা-পতা হয়ে যায়। মহুয়ার মনেও একদিন অর্ণবের সঙ্গে সহবাসের স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে। হয়তো সে ভুলেই যাবে অর্ণব বলে কাউকে সে চিনত। মেয়েরা খুব সহজে অনেক কিছু ভুলে যেতে পারে। আমার হয়েছে এক উপদ্রব। এই পৃথিবীতে একমাত্র আমিই জানি যে অর্ণব পালিয়ে যায়নি। প্রতি রাতে চোখ বুজলেই অর্ণব আমার শিয়রে এসে বসে। আমার কাঁধে নাড়া দিয়ে বলে, “সায়ন, সাবধান! যে মেয়ে একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে সে আবার গ্রামে ফিরে আসে। রাত্তিরের আনাচে কানাচে, উঠোনে, দাওয়ায়, একলা মানুষ খুঁজে বেড়ায়...”

    আমি ওকে উড়িয়ে দিয়ে বলি, “ধ্যুত, মহুয়া আমায় ভালবাসে।”

    অর্ণব হো হো করে হেসে ওঠে, বলে, “সে তো আমাকেও বাসত...”

    আজকাল আমার মাথার মধ্যে একটা অহেতুক ভয় চেপে বসেছে। আমি রাত জেগে পাগলের মতো বাড়িতে যা যা ভারী জিনিষ আছে খুঁজে বার করি, কাটারি, হাতুড়ি, সাঁড়াশি...। ভোরবেলা মহুয়ার ঘুম ভাঙার আগে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে বাইরে ফেলে দিয়ে আসি। মহুয়া কাজের সময় খুঁজে না পেয়ে চ্যাঁচামেচি করে। মাঝে মাঝে বারীনদারা আসেন, একটা দিন হৈ-চৈ গল্পগুজব করে কেটে যায়। ফেরার সময় বারীনদা আড়ালে ডেকে মুচকি হেসে বলেন, “সায়ন, একটু রয়ে সয়ে ভাই, জানি অনেক দিন পরে মহুয়া ফিরে এসেছে, তাও... বেশি রাত জেগো না, চোখের নিচে কালি পড়ছে।”

    আমি চুপ করে থাকি। বলতে পারি না, বারীনদা, ‘আপনি যা ভাবছেন তা নয়।’ বলি, ‘আবার আসবেন।’

    বারীনদারা চলে গেলে মহুয়া গুনগুন করে গান গায়, ঘর গুছোয়। কখনও চুপিচুপি পিছন থেকে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি চমকে উঠি। রাত বাড়ে। মহুয়া শুয়ে পড়ে। আমায় ডাকে, বলে, ‘কী করছ? আমার পাশে এসে শোও।’

    আমি বিছানায় গেলে সে আমার বুকের মধ্যে ঘন হয়ে আসে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে আমি অন্ধকার জানলার দিকে চেয়ে থাকি। একটি দুটি করে চারপাশের হাইরাইজের জানলায় আলো নিভে যায়। কার্ণিশে সারি দিয়ে বসে থাকা কবুতরদের পিঠের ওপর কুয়াশা নামে, বিজ্ঞাপনের নিওন সাইন স্তিমিত হয়ে আসে। মায়ার শহর নিশ্চিন্তে ঘুমোয়, কেবল আমি দু-চোখের পাতা এক করতে পারি না। আমার শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি এক অনিবার্য আঘাতের প্রতীক্ষায় সতর্ক হয়ে জেগে বসে থাকে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)