অনেকদিন থেকেই আমার একটা লম্বা ট্রেন সফর করার ইচ্ছা। ছোটবেলায় কতবার রাতের ট্রেনে ঘুমোতে ঘুমোতে পুরুলিয়া-কোলকাতা অথবা কোলকাতা-দিল্লী যাতায়াত করেছি। মাঝরাতে অচেনা স্টেশনে ‘চায় গরম’ ডাক, ওপরের বাঙ্কে হোলডলের ওপর পাতা বিছানায় ঘুমপাড়ানি ট্রেনের দুলুনি, জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চোখেমুখে কয়লার গুঁড়ো—এসবই তো রেলযাত্রার সুখস্মৃতি।
ক্যানাডা তো কাছের প্রতিবেশী দেশ, ওদেশে transcontinental (আন্তর্মহাদেশীয়?) রেলগাড়ি দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাড়ি দেয়। ঝঞ্ঝাটবিহীন আরামের ট্রিপ, বিরাট জানলার বাইরে অতুলনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য, এসবের জন্য এই রেলের খুব নামডাক। (অবশ্য চায় গরম আর কয়লার গুঁড়ো পাওয়া যাবে না।) আমেরিকাতেও দূরপাল্লার ট্রেন আছে কিন্তু ক্যানাডার সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না।
এখন অতিমারীর কবল থেকে একটু ছাড়া পেয়েছি, টুরিস্ট কোম্পানিগুলোও পুরনো ব্যবসা শুরু করার আনন্দে অধীর। আগে থেকেই অনলাইনে কিংবা ফোনে রিজারভেশন, টিকিট ইত্যাদির ব্যবস্থা খুব সহজেই করা যায়। রেলের কর্মীরা হাসিমুখে আমাদের সব রকম সাহায্য করেছিল। কানাডায় ঢুকতে হলে কোভিড-এর সব কটি টিকার সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে এবং ট্রেন ও স্টেশনে সর্বক্ষণ মুখঢাকা মাস্ক পরে থাকতে হবে। শুধু খানাপিনার সময় আর নিজের কেবিনে থাকার সময়টুকু ছাড়া।
আমাদের যাত্রা শুরু পশ্চিম প্রান্তের শহর ভ্যানকুভার থেকে। ট্রেনে রওনা হবার দু’দিন আগে গিয়ে আমরা এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা জমালাম। তারপর
যাত্রা শুরু। প্রথম ট্রেনটির নাম ‘রকি মাউন্টেনিয়ার’। ভোর বেলা স্টেশনে পৌঁছেই আপ্যায়নের বহর দেখে চমৎকৃত হলাম। স্টেশনটি শুধু আমাদের ঐ একটি ট্রেনের জন্য। পারকিং লট থেকে নামতেই কর্মীরা হাত থেকে লাগেজ ছিনিয়ে নিয়ে ট্রেনের ‘লাগেজ কার’-এ তুলে দিলো। স্টেশনে ফ্রি চা, কফি, বিস্কুটের ব্যবস্থা। সামনেই দাঁড়িয়ে বিরাটকায় ট্রেন, সকালের রোদে ঝকমক করছে। দরজার সামনে লাল কার্পেট পাতা, পাশে হাসিমুখে পরিচারিকারা দাঁড়িয়ে, লক্ষ্য করলাম সবাই সুন্দরী ও অল্পবয়সী। যাত্রীরা সবাই গাড়ির সামনে সেলফি আর গ্রুপ ফোটো তুলতে শুরু করলেন।
ট্রেনে বিরাট জানলা ও স্বচ্ছ কাঁচ দেওয়া ছাদ যাতে বাধাহীন ভাবে প্যানোরামার মত বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। চেয়ারগুলি নরম আরামকেদারা, এমনকি শীতের সময় বোতাম টিপে সীট গরম করার ব্যবস্থাও আছে। এই ট্রেনে স্লিপিং কার নেই। রাত্তিরে শোয়ার ব্যবস্থা প্রতিদিন বিকেলে কোনো পাঁচতারা হোটেলে করা হয়। তা-ও হোটেলে নেমে চেক-ইন করার দরকার নেই, ট্রেনেই ঘরের চাবি হাতে তুলে দেয় আর লাগেজও ঘরে পৌঁছে দেয়। শুধু দু’পা হেঁটে ঘরে ঢোকার অপেক্ষা।
খাওয়াদাওয়া সব ট্রেনেই। ডাইনিং কারে রেস্টুরেন্টের মতো সুন্দর করে টেবিল সাজানো। প্রতিদিন নতুন নতুন খাবার, কিন্তু সবই ইওরোপিয়ান-আমেরিকান স্টাইল, ভারতীয় বা চাইনিজ খাবার এখানে পাবেন না। অবশ্য ভেজিটেরিয়ান খাবারও প্রচুর। এখানেও বিরাট জানালা, যাতে খেতে খেতেও কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য মিস না হয়। এখানেই প্রতিবেশী যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। (আর ট্রেনের বন্ধুত্ব যে কতো গাঢ় ও গভীর হয় তা কে না জানে।)
সবাই ডাইনিং কারে একসঙ্গে কুলোয় না, তাই ব্যাচে করে বসায়। অপেক্ষারতদের সাময়িক খিদে উপশমের জন্য ডাইনিং কারের বাইরেও এলাহি খাবার—স্ন্যাক্স, ফল, ডোনাট, চা, কফি, ইওগারট—চব্বিশঘণ্টা মজুত। সারাদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ড্রিঙ্কস সারভ হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, এত ককটেল, বিয়ার, ওয়াইন-এর ছড়াছড়ি সত্ত্বেও আমি কিন্তু কাউকে বেহেড মাতাল হতে দেখিনি।
ট্রেনে লাগেজ একবার তোলা হলে, হোটেলে নামা পর্যন্ত সেটা নাগালের বাইরে। তাই, মনে করে দরকারি জিনিস--বইপত্র, কাগজ, চশমা, ওষুধ, ক্যামেরা ইত্যাদি সব হাতব্যাগে রাখতে ভুলবেন না। ট্রেনে wi-fi নেই। আর তার দরকারই বা কি! বাইরে তাকিয়েই মন ভরে যায়। তবুও, আপনি যদি ঐ নেশায় ভোগেন তাহলে একটু অসুবিধা হবেই। এইজন্যই বোধহয় বেশিরভাগ যাত্রীরা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধবয়সী। অনেকেই দেখলাম নাতিনাতনী সহ চলেছেন। ছোটোরা অবশ্য সহজেই বোরড হয়ে যায়, তাই হাতে ভিডিও গেম আর কানে ইয়ার-পড। ট্রেনে একজন বিরানব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধার সঙ্গে আলাপ হল। সঙ্গে চলেছেন ষাট বছরের কন্যা, রিটায়ার্ড স্কুলটিচার। অনেকেই দূর দেশের অতিথি, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা এমনকি
অস্ট্রেলিয়া থেকেও এসেছেন এই বিখ্যাত ট্রেনযাত্রার জন্য। অনেকেই কোনো বিশেষ বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিন পালন করছেন, কারুর বা শুধু ট্রেনে চড়ার শখ, অনেকেই আগে ট্রেনের কোনো বিভাগে কাজ করতেন এখন রিটায়ারড হয়ে সেই ট্রেনেরই যাত্রী হওয়ার সুখটা উপভোগ করছেন।
আর বাইরের দৃশ্যও সত্যি চোখ জুড়ানো। ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও পাশের রাজ্য অ্যালবারটা দুই-ই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। পশ্চিমের ক্যাসকেড পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ট্রেন লাইন। দুপাশে ঘন জঙ্গল—বার্চ, পপলার, পাইন আরও কতো নাম না জানা গাছ। আমি গেছিলাম গ্রীষ্মকালে, হেমন্তে এইসব বন রঙে রঙিন আর শীতের সময় বরফসাদা রূপ। এক এক সময় এক এক রকম সৌন্দর্য। মাঝেমধ্যে ঝরনা বা জলপ্রপাত। কিংবা শান্ত লেকের নীল, কাকচক্ষু জল। প্রচুর ঈগল, সারস ও নানারকম হাঁস দেখলাম, কিন্তু ছোট পাখিগুলো ট্রেনের কাছে থেকে দেখা যায় না। চলন্ত ট্রেনে, কাছের দৃশ্যে বাইনকুলার বা ক্যামেরা ব্যাবহার করাও মুশকিল।
পাখি ছাড়াও দেখেছি বুনো ভালুক, লাইনের ধারে বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে যেন ট্রেনেরই অপেক্ষায়। দেখেছি পাহাড়ি বিগহর্ন ভেড়া, মুজ ও হরিণ। কোন ইন্টারেস্টিং দৃশ্য পেলেই ট্রেনের কর্মীরা মাইকে ঘোষণা করে দেন— ‘ডান দিকে হরিণের দল’—সবাই চটপট ছবি তুলে নেন।
গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ট্রান্স-ক্যানাডা হাইওয়ে। বনের পশুদের জন্য রাস্তার ওপরে ঝোপজঙ্গলে ঢাকা ব্রিজ বানানো হয়েছে যাতে বুনো পশুরা নির্বিঘ্নে রাস্তা পার করতে পারে। কি সুন্দর ব্যবস্থা, না?
প্রথম রাত কামলুপ নামে একটি ছোট্ট শহরে কাটিয়ে আমরা আলবার্টা প্রদেশে ঢুকলাম আসল রকি পর্বতমালায়। এখানে পাহাড়গুলি আমেরিকার রকি পাহাড়ের থেকে অনেক উঁচু, অনেক অগম্য। আশপাশে শহর, গাঁ বা রাস্তাঘাট নেই। গাড়ির স্বচ্ছ ছাদ দিয়ে দেখা যায় বরফঢাকা উত্তুঙ্গ চূড়া। তিন হাজার চার হাজার মিটার উচ্চতা। আশপাশের জায়গাগুলোর নামও বেশ মজার—Hell’s Gate, Kicking Horse Canyon, 70 miles House, Jaws of Death Gorge ইত্যাদি।
এখানেই এই ট্রেনযাত্রার সবথেকে বিস্ময়কর (আমার মতে) ব্যাপারটা দেখলাম। Spiral tunnel. ব্যানফ থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে। এই প্রথম দেখলাম একটা পেঁচালো, সর্পিল সুড়ঙ্গ, ভেতরে প্রায় তিন হাজার ফুট প্যাঁচালো লাইন, ভেতরে নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, একদম বোঝাও যায় না যে গাড়িটা ঘুরছে। ঐ পাহাড়ের ভেতরেই ২৯০ ডিগ্রী প্যাঁচ নিয়ে গাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে ওঠে! মাত্র পাঁচ মিনিট লাগে। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখি লাইনটা পড়ে আছে পাঁচ তলা নীচে! এ যেন মাজিক। এতবড় গাড়িটা এত তাড়াতাড়ি এতটা উঁচুতে চড়তে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই হয় না।
পরদিন বিকেলে আমরা ‘ব্যানফ’ (Banf) ন্যাশনাল পার্কে ‘লেক লুইজ’ নামক ছোট্ট স্টেশনে নামলাম। (এখানেই নাকি ‘ডক্টর জিভাগো’ ফিল্মের রেলস্টেশনের সীনটা তোলা হয়েছিলো।) সঙ্গে লেক লুইজ স্কি শহরটি গরমের সময় আমাদের মতো টুরিস্টে ভরা। শহরটার পাশেই বিখ্যাত সুন্দর লেকটি। এর নাম দেওয়া হয়েছিলো রানি ভিক্টোরিয়ার কন্যা লুইজ-এর নামে। কাছেই একটা হিমবাহর নাম ভিক্টোরিয়া গ্লেসিয়ার। আর সবজুড়ে সারা প্রদেশটার নাম স্বামী অ্যালবার্ট-এর নামে। অথচ এই তিন জনের এক জনও কখনো এদেশে পদার্পণ করেননি।
ব্যানফ ও উত্তরে জ্যাসপার পার্ক সারা ক্যানাডার সর্বশ্রেষ্ঠ জাতীয় উদ্যান। বিরাট উঁচু, বরফঢাকা পাহাড় হ্রদ, হিমবাহ, জলপ্রপাত, গভীর বনে ভরা উপত্যকা। কি নেই! পাহাড়ি হ্রদগুলি হিমবাহ থেকে পাথরের গুঁড়ো বয়ে নিয়ে আসে। গুঁড়োগুলি এত মিহি যে জলে গুলে জলেরই রং বদলে দেয়। পান্নার মতো স্বচ্ছ সবুজ থেকে আরও ঘন ফিরোজা বা টারকয়েজ-এর মতো রং, কিংবা আকাশী থেকে ঘন নীল, কতো রকমফের। সবথেকে প্রসিদ্ধ লেক লুইজ, কিন্তু আমার মতে একটু বেশি ভিড়, এর থেকেও সুন্দর, ভিড়হীন লেক মোর্যান। ছবির মতো স্বচ্ছ পান্নাসবুজ জল আমি আগে কখনো দেখিনি।
ঠিক চল্লিশ বছর আগে আমি ক্যালগারি থেকে ড্রাইভ করে লেক লুইজ-এ এসেছিলাম। এখানে অনেকগুলো প্রাকৃতিক উষ্ণকুণ্ড আছে। খোলা আকাশের নীচে গরমজলে গা ডুবিয়ে মুখে-মাথায় ঝুরঝুরে বরফকুচি পড়াটা উপভোগ করেছিলাম। সেই গরম পুকুরগুলির খোঁজ করতে গিয়ে শুনলাম সব বন্ধ হয়ে গেছে। ঐ কুণ্ডগুলিতে এক ধরনের ক্ষুদে শামুক (Physella jonsonii) বাস করে, মানুষের চামড়ার তৈলাক্ত পদার্থ সেই শামুকদের মেরে ফেলছিল। তাদের বাঁচাতে সরকার উষ্ণকুণ্ডে চানই বন্ধ করে দিয়েছেন! আহা, সেই স্মৃতিটাকে আর বাস্তব করা গেল না।
ব্যানফে একদিন কাটিয়ে আমরা বাসে করে (রেলের লোকেরাই সব আয়োজন করে দিয়েছিল) উত্তরে জ্যাসপার পার্কে চললাম। ব্যানফের তুলনায় এই পার্কে পাহাড় বেশি, টুরিস্ট কম। মধ্য গ্রীষ্মেও বেশ ঠান্ডা। লেক পেটো (Petoe) নামে একটি বরফঠান্ডা হ্রদ, অপূর্ব নীলসবুজ টারকয়েজ জলের রং। হ্রদের নামকারী মিস্টার পেটো নাকি গত শতাব্দীর একজন নামকরা ক্যানাডিয়ান অ্যাডভেঞ্চারার—তাঁর নামে নানারকম বিখ্যাত, কুখ্যাত সত্যি-মিথ্যে অনেক গল্প শোনা যায়। এই পার্কে গোল্ড রাশ-এর সময় খুব বার বা পাব-এর রমরমা ছিল। দিনের শেষে ভিড়ও হতো খুব। পেটো-র প্রিয় বার-এ একদিন বসার জায়গা না পেয়ে ভদ্রলোকের মেজাজ চড়ে যায়। তিনি তক্ষুনি জঙ্গলে গিয়ে একটা ভীষণ হিংস্র লিঙ্কস (lynx) ধরে আনলেন। এবং সোজা গিয়ে পশুটাকে ভিড়ভর্তি বার-এর মধ্যে ছেড়ে দিলেন। ক’জন আহত বা মারা গেছিল তা ঠিক জানা যায় না কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ভিড় সাফ। পেটো-ও আরামসে তাঁর প্রিয় পানীয়ে চুমুক দিলেন।
হ্রদ ছাড়াও জ্যাস্পার-এ আছে বিশাল বরফপ্রান্তর (Columbia icefield) যা থেকে বেশ কয়েকটা গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ নেমে এসেছে। প্রত্যেকটাই ইদানীং শুকিয়ে যাচ্ছে। কয়েকশো গজ অন্তর সাইনবোর্ড লেখা কোন সালে হিমবাহটি এতদূর এসেছিলো। এখন সেখানে পারকিং লট। স্পষ্ট দেখা যায় গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর প্রভাব।
সবথেকে বড়ো হিমবাহটির নাম আথাবাস্কা। এর ওপর টুরিস্টরা হাঁটতে পারেন। বিরাট চাকাওয়ালা গ্লেসিয়ার-বাস আপনাকে একেবারে বরফের ওপর তুলে দেয়। পায়ের তলায় ৩০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো বরফ, দুপুরের রোদে একটু একটু করে গলছে। এখানে ওখানে গভীর খাত, একবার পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত। কোথাও বা ঝরঝর করে ঝরনার মত জল ঝরে পড়ছে। এই রেটে গলতে থাকলে এই শতাব্দীর শেষে এই বিরাট হিমবাহের চিহ্নটুকুও থাকবে না।
হিমবাহ থেকে কয়েক মাইল দূরে হাইওয়ের একপাশে একটা গভীর গিরিবর্ত্মের ওপর ঝুলন্ত skywalk বানানো হয়েছে। লম্বা প্ল্যাটফর্ম-এর পায়ের তলায় স্বচ্ছ কাঁচের মেঝে, নীচে দেখায় অতল গভীর খাদ। বেশ গা শিরশির অনুভূতি!
জ্যাস্পার-এ আরও আছে ছোট-বড় বহু জলপ্রপাত। এর মধ্যে আথাবাস্কা ফলসটি বিরাট, বাষ্পে ভরা ও গভীর গর্জনে কানে তালা লাগায়। এরই আশপাশে আছে বুনো ঝোপ--বাফেলো বেরির জঙ্গল।
এগুলি নাকি ভালুকদের ভীষণ প্রিয়। সাবধানে পাশ কাটাই। লাল টুকটুকে ফলগুলি দেখতে সুন্দর কিন্তু খেতে ভীষণ টক ও কষায়। ভালুকরা তো স্যামন মাছ আর মধু খেতে অভ্যস্ত। এই অখাদ্য ফলগুলি কী করে খায় কে জানে।
দ্বিতীয় ট্রেন শুরু হল জ্যাসপার থেকে। এর নাম Via Rail. এটা যায় টানা টরন্টো পর্যন্ত। দুটো সাবধানবাণী—প্রথমত এই গাড়িটা তিন-চার ঘণ্টা লেট হওয়ার জন্য বিখ্যাত। আসলে এটা প্রত্যেকটি মালগাড়ি পার না হওয়া পর্যন্ত থামে। ক্যানাডায় মালগাড়ির প্রাধান্য প্যাসেঞ্জার গাড়ির ওপর। আর মালগাড়ি গুলো ভীষণ লম্বা, ২৫০ বগিসহ (হ্যাঁ, আমি গুনে দেখেছি), তাই বেশ সময় লাগে। অতএব ট্রেনের পরে তাড়াহুড়ো থাকলে বা অন্য কানেকশন ধরতে হলে মুশকিল হবে। ট্রেন টরন্টোতে সারা রাত থামে। বাসে করে নায়াগ্রা ফলস দেখানোর ব্যাবস্থা আছে। তারপর ট্রেন যায় হ্যালিফ্যাক্স পর্যন্ত।
দ্বিতীয়ত, আপনার বাক্সপত্র সব লাগেজ কারে বন্দী। তিন দিন, তিন রাত ওসবে হাত দিতে পারবেন না। তাই তিন দিনের জন্য জামাকাপড়, ওষুধপত্র ও অন্যান্য দরকারি জিনিস সব আগে থেকে হিসেব করে হাতব্যাগে প্যাক করা দরকার। নাহলে মুশকিলে পড়তে হবে।
Via রেলে স্লিপিং কার আছে। ছোট্ট কেবিন কিন্তু আরামের সমস্ত উপাদান মজুত। প্রতি কেবিনে (২ জনের) সঙ্গে লাগোয়া নিজস্ব বাথরুম, আয়না, সিঙ্ক। বসার জন্য গদিওয়ালা বেঞ্চ বা আরামকেদারা। রাত্তিরে ওই চেয়ার জোড়া দিয়ে ও মাথার ওপরে বাঙ্ক খুলে দুটি বিছানা তৈরি করে দেয়, সঙ্গে তোশক, বালিশ, কম্বল। মাথার কাছে রিডিং ল্যাম্প, এমনকি চশমা রাখবার খাপ পর্যন্ত লাগানো। রাত্তিরে ‘চায় গরম’ অবশ্য নেই কিন্তু গাড়ির দুলুনিতে ঘুমনোটা ঠিক আগের মতই আছে। এর থেকে ভালো ঘুমের ওষুধ কোথাও পাবেন না।
বাথরুমটা প্রাইভেট হলেও শাওয়ার-এর জন্য দু’পা হাঁটতে হবে। প্রতি চার-পাঁচ কেবিনে একটি শাওয়ার। এছাড়াও আছে গেম-রুম, তাস, বোর্ড গেম, জিগস’ পাজল, কিছু পেপারব্যাক বই ইত্যাদি। বাইরের দৃশ্যে চোখ ক্লান্ত হলে এইসব দিয়ে সময় কাটানো যায়। স্বচ্ছ কাঁচের ছাদওয়ালা কেবিন আর বিরাট জানলা দেওয়া ডাইনিং কার তো আছেই। সঙ্গে আগের ট্রেনের মতই প্রচুর খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা।
জ্যাসপার ছাড়ার ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে বাইরের দৃশ্য আমূল বদলে গেল। বিদায় সুউচ্চ রকি ও ঘন পাইনের বন। তার জায়গায় এল দিগন্তজোড়া খোলা আকাশ আর সীমাহীন প্রান্তর। আঃ, এই নেব্রাস্কাবাসীর চোখের আরাম! চাষের জমি, গরু-ভেড়ার খামার, দু-একটা ঘরবাড়ি, এখানে ওখানে কিছু লেক, দেখতে দেখতে বেশ সময় কেটে যায়। রাত্তিরে কাঁচের ছাদ দিয়ে খোলা আকাশের তারার শোভাও এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। পেরিয়ে এলাম ধূ-ধূ আকাশজোড়া সাসকাচেওয়ান ও মানিটোবা প্রদেশ। মাঝরাতে কখন যে উইনিপেগ পার হলাম টেরও পেলাম না। অন্টারিও প্রদেশে এসে লেকের সংখ্যা বাড়লো। সীমাহীন চাষের জমির বদলে কিছুকিছু পত্রমোচী বনের দেখা শুরু হল। লেকের আশপাশে মাছ ধরার কেবিন—বেশ সুন্দর বাড়িগুলো। ছুটির দিনে ভাড়া করা যায়, সঙ্গে নৌকোও। বনেজঙ্গলে অনেক হরিণের দেখা পেলাম, তবে ভালুক আর মুজ শুধু পশ্চিম দিকেই। আর পাখি বলতে শুধু বড়সড় জলচর পাখিই দেখা যায়। ট্রেন থেকে ছোটো পাখিদের দেখা অসম্ভব।
তিন দিন পর নামলাম টরন্টো স্টেশনে। ভাগ্য ভালো ট্রেন মাত্র দু’ঘণ্টা লেট ছিল, তাই চটপট মন্ট্রিয়লগামী হাইস্পীড ট্রেনটা ধরতে পারলাম। এটা আমাদের তিন নম্বর ট্রেন। Via রেল সোজা হ্যালিফ্যাক্স পর্যন্ত যায়, সেখানে আটলান্টিকের উপকূলে যাত্রার আসল সমাপ্তি। কিন্তু আমরা উত্তরে কুইবেক প্রদেশের দিকে চললাম। এই হাইস্পীড ট্রেনে ডাইনিং কার বা স্লিপিং কার নেই। এটা নেহাতই দৈনিক যাতায়াতের বাহন। ঝাঁ করে চার ঘণ্টায় মন্ট্রিয়ল পৌঁছে দিলো।
তা সব মিলিয়ে সাত-আট দিন ধরে তিন রকম ট্রেন চড়ার অভিজ্ঞতা হল। আমরা পশ্চিম থেকে পূবে রওনা হয়েছিলাম, উল্টোদিকে পূব থেকে পশ্চিমেও যাওয়া যায়, একদম একই ট্রেন, একই রুট, শুধু উলটো যাত্রা।
মন্ট্রিয়ল ভীষণভাবে ফরাসি, হঠাৎ এলে মনে হবে আদত ফ্রান্সেই এসে পড়েছেন। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দু’দিন চুটিয়ে আড্ডা মেরে আমরা অবশেষে বাড়িমুখো হলাম, এবার আর ট্রেনে নয়, প্লেনেই।
ভ্রমণকাল-- সেপ্টেম্বর, ২০২২