এতদিন পিঙ্কি একা একাই জোজোকে স্কুলে নিয়ে যেত, কিন্তু কয়েক মাস হল ওদের বাড়ির পাশের বাড়িটায় মেঘা আর তার ভাই সৌম্যরা এসেছে। মেঘা পিঙ্কির ক্লাসেই পড়ে। মেঘার সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে ওরা একসঙ্গে হেঁটে স্কুলে যায়। আর তারপর থেকেই পিঙ্কির আর জোজোকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। মেঘার ভাই সাম্যও ওদের সঙ্গে যায় তাতে ওর আপত্তি নেই কিন্তু জোজোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না পিঙ্কির। তার কারণ একটাই। জোজো একটু অন্য রকম। অন্য ওর বয়সের ছেলেমেয়েদের থেকে সে কিছুটা আলাদা। আগে ছোটবেলায় তেমন বুঝত না পিঙ্কি। ওর শুধু মনে হত সবার ভাই বোনরা কত কথা বলে তাহলে জোজো কথা বলতে পারে না কেন? কিন্তু যত বড় হচ্ছে পিঙ্কি ততই অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে জোজোর তফাতটা বুঝতে পারছে সে।
পিঙ্কির ভাইয়ের ডাউনস্ সিন্ড্রোম বলে একটা অসুখ আছে জন্ম থেকেই। তার চোখগুলো ছোটো ছোটো, মুখের ধরনটা একটু অন্য রকমের আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল কোন কিছু শিখতে তার সাধারণ বাচ্চাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সময় লাগে। ন’বছর বয়স তার, কিন্তু সে এখন মোটে গুটিকয়েক কথা বলতে পারে। আলাদা একটা স্পেশাল নীডসের স্কুলে যাওয়ার পর থেকে অবশ্য নিজে নিজেই অনেক কিছু করতে শিখেছে জোজো--কথাও অনেক বেশি বলে কিন্তু তাও ওকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে পিঙ্কির বেশ লজ্জা লাগে। জোজো অবশা নিজের দিদিকে ভীষণ ভালোবাসে!
মাঝে মাঝেই “দিদি” বলে ওকে জড়িয়ে ধরে। সেদিন স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ পিঙ্কিকে জাপটে ধরে “দিদি” বলে আদর করে দিল! পিঙ্কি তো লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল! সঙ্গে মেঘা আর ওর ভাই সাম্যও ছিল। জোজোর কারবার দেখে তাদের সেকি হাসি!
সাম্যর বয়স মোটে সাত কিন্তু সে খুব স্মার্ট আর তার মাথায় খুব বুদ্ধি। ওকে দেখে পিঙ্কির সবসময় মনে হয়, ইস্ জোজোটা যদি ওই রকম হত তাহলে কত ভালো হত! জোজো লম্বায় সাম্যরই মতন তাই সাম্য ওকে নিজের বয়সের মনে করে প্রথম প্রথম এটা-সেটা জিজ্ঞেস করত। জোজো কী বোঝে কী বোঝে না তার ঠিক নেই, কিন্তু উত্তর কিছুই দিতে পারে না, শুধু দাঁত বার করে হি হি করে হাসে।
সাম্য ভয়ানক রেগে গিয়ে ওকে দু-একবার স্টুপিড ইডিয়টও বলেছে। জোজো অবশ্য তা্তেও কিছুই মনে করে না। কেবল ওই একইরকমভাবে দাঁত বার করে হি-হি করে হাসতেই থাকে, যেন সব কিছুই একটা খেলা। জোজোর অবশ্য ওই একটা বড়ো গুণ। কোন কিছুতেই সে রাগ করে না, যেন রাগ ব্যাপারটা ওর শরীরে নেইই। ওর আরেকটা গুণ হল ওর প্রচুর ধৈর্য। যে কোন কাজ করতে ওর অনেক বেশি সময় লাগে বটে কিন্তু খুব মন দিয়ে আর অনেক ধৈর্য নিয়ে ও কাজটা করে।
ওরা সবাই পাশাপাশি বাড়িতে থাকে তাই একসঙ্গেই স্কুলে যায়। ওদের ছোট শহরে স্কুলগুলোও সবই কাছাকাছি কিন্তু তাও পিঙ্কির আর জোজোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না। মাকে কথাটা বলতে অবশ্য প্রচণ্ড ধমক খেল সে।
“কেন, নিয়ে যাবে না কেন? তুমি তো ভালোই জানো ও একা একা স্কুলে যেতে পারবে না। আমাদের তো সকালে অফিস যেতে হবে, নাকি? তোমার বায়নার জন্যে আমরা অফিস-টফিস্ যাওয়া বন্ধ করে দেব? আর ওইটুকুনি হাঁটা পথের জন্যে গাড়ি করার কোন মানেই হয় না। তাছাড়া তোমার সঙ্গে গেলেই ভালো, অন্য অচেনা লোকেদের সঙ্গে গেলে ওর মোটেই ভালো লাগবে না।“
পিঙ্কি গুঁইগুঁই করে বলল, “ছায়ামাসি তো ওকে স্কুলে দিয়ে আসতে আর নিয়ে আসতে পারে।”
“হ্যাঁ, ছায়ার যেন আর কাজ নেই বাড়িতে! তোমার স্কুল থেকে দু'পা দূরে জোজোর স্কুল, তোমার অসুবিধাটা কী শুনি?”
পিঙ্কি মাথা হেঁট করে বলল, “জোজোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে আমার লজ্জা করে…”
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মা বললেন, “ছিঃ পিঙ্কি, অমন কথা বলতেই বরঞ্চ তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত! তোমাকে কতবার বলেছি না জোজো অন্য রকম! তুমি ওর দিদি। তোমাকে ওকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। ওর না-পারাগুলোকে মেনে নিতে হবে। ও যাতে আরও অনেক কিছু শিখতে পারে সেই জন্যেই তো ও স্কুলে যাচ্ছে।”
“কিন্ত সাম্য তো ওর চেয়ে ছোটো, মোটে ক্লাস টুতে পরে, কিন্তু কত কিছু জানে। ও জোজোকে কুইজ করলে জোজো কিছুই বলতে পারে না…”
“খবরদার জোজোকে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করবে না। ও নিজের মতন, বুঝলে? বরং সাম্য ওকে বিরক্ত করলে তোমার তাকে থামানো উচিত।”
মার কাছে বকুনি খেয়ে পিঙ্কি আর কিছু বলেনি।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সাম্যদের স্কুলে গিয়ে দেখা গেল ওদের স্কুল এক ঘন্টা আগে ছুটি হয়ে গিয়েছিল টিচারদের মিটিং না কী একটা কারণে। মেঘা সকালে গেটে টাঙানো নোটিশটা পড়ে দেখেনি। তবে অনেকেই মনে হয় নোটিশটা পড়েনি। বেশ কিছু ছেলেদেরই গাড়ি বা বা গার্জেন আসেনি, তাই অনেকেই অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিল।
সাম্য দিদিকে দেখেই রাগে ফেটে পড়ল, “আমি কতক্ষণ ধরে একা একা দাঁড়িয়ে আছি, জানিস? সকালে তো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল গেটে, তুই পড়তে পারিস না?” বলে গুমগুম করে দিদিকে কয়েকটা কিল মারল।
পিঙ্কি মজা করে বলল, “ওমা তুই একা কোথায় রে? একগণ্ডা ছেলে তো দাঁড়িয়ে রয়েছে তোর সঙ্গে। আর নোটিশ পড়লেও মেঘা আসতে পারত না। আমাদের স্কুলে তো আর এক ঘন্টা আগে ছুটি হয়নি!”
সাম্য তেলেবেগুনে জলে উঠে বলল, “আমি আমার দিদির সঙ্গে কথা বলছি, তুমি একদম নাক গলাতে আসবে না! তুমি তোমার বোকা ভাইকে নিয়ে থাকো!”
পিঙ্কি ওকে আর কিছু বলেনি। ফেরার পথে সারা রাস্তা দিদিকে রাগ দেখাল সাম্য। মেঘাকে অনেকবার সরি-টরি বলতে হল।
পিঙ্কিদের ক্লাসের পিকনিকের দিন গণ্ডগোলটা হল! তিনটে নাগাদ স্কুলে ফিরে আসার কথা ছিল ওদের কিন্তু যে বাসে করে ওরা গিয়েছিল সেটা ফেরার পথে খারাপ হয়ে গেল। বাস সারিয়ে ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা বেজে গেল। মা-বাবা দু'জনের কেউই ছটার আগে অফিস থেকে ফেরেন না। আর ছায়ামাসি দুপুর বেলা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়। ওরা স্কুল থেকে ফিরে ডাকলে তবে ছায়ামাসি ঘুম থেকে উঠে খাবার দেয়। ওরা না ফিরলে সে ঘুমিয়েই থাকবে, ঘড়ির দিকে তাকায়ও না।
বাস স্কুলে এসে পৌঁছতে পিঙ্কি নেমেই পড়ি কি মরি ছুট দিল জোজোর স্কুলের দিকে। বেচারা না জানি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বসে আছে ওর জন্যে।
জোজোর স্কুলের চত্বরে গিয়ে সে দেখল সব ভোঁ-ভাঁ, কেউ কোথাও নেই। থাকবার কথাও নয়। সবাই দু'ঘন্টা আগে যে যার বাড়ি চলে গেছে। পিঙ্কির বুকটা ধ্বক করে উঠল। ও গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে একবার জোর হাঁক দিল, “জোজো, এই জোজো, কোথায় তুই?”
অমনি গেটের পাশে দারোয়ানজির ঘর থেকে জোজো ছুটে বেরিয়ে এল। দারোয়ানজি গেট খুলে দিতে বেরিয়েই পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরে “দিদি, দিদি” বলে তার সে কি আদর।
দারোয়ান প্রমোদ সিংজি বেরিয়ে এসে বলল, “ও বেচারা রোদে ঠায় তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল বলে আমার খুব কষ্ট হল, তাই আমি ওকে আমার ঘরটায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখেছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছে বেচারা। তোমার কি হয়েছিল? ভুলে গিয়েছিলে?”
“না, না, আমাদের ক্লাসের পিকনিক ছিল আজ। ফেরার পথে বাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই স্কুলে ফিরতেই দেরি হয়ে গেল।”
রোদে দাঁড়িয়ে থেকে যার গাল লাল হয়ে গেছে, খিদেয় তেষ্টায় অবস্থা খারাপ, সে কিন্তু একবারও দিদির কাছে কোন কৈফিয়ত চাইল না দেরির জন্যে, কোন রকম রাগও দেখালো না। সে জানে দিদি তাকে নিতে আসবেই! আজ শুধু একটু দেরি হয়েছে মাত্র। বাড়ি ফিরতে ফিরতে পিঙ্কি জোজোকে বলল, “জোজো তুই না একশোটা সাম্যর চেয়েও অনেক ভালো!”
জোজো কী বুঝল কে জানে শুধু হি-হি করে হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দিদি!”
##
(জন ল্যাংডন ডাউন নামে এক রিটিশ ডাক্তার ১৮৬৬ সালে প্রথম ডাউনস্ সিন্ড্রোম রোগ সম্বন্ধে লিখেছিলেন। ওঁর নামেই শেষ পর্যন্ত অসুখটার নামকরণ করা হয়! এই অসুখ শরীরের জিনঘটিত গোলমালের জন্য হয়ে থাকে। ডাউনস্ সিন্ড্রোমে শিশুর মানসিক আর শারীরিক ক্ষমতা কিছুটা (অনেক সময় হয়তো বেশ কিছুটা) খর্ব হয়। পৃথিবীতে প্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ শিশুর মধ্যে একজনের ডাউনস্ সিন্ড্রোম আছে বলে দেখা গেছে। এদের অধিকাংশদের শিশুসুলভ প্রবৃত্তির দরুন এদের ভালোবাসা সহজ। ছোটোবেলা থেকেই রোগটা ধরা, সাধারণ সমস্যাগুলো বুঝতে পারা, চিকিৎসা, পরিবারের সহযোগিতা এবং শিক্ষাদীক্ষা এই ধরনের শিশুদের জীবনে একটা আমুল পরিবর্তন এনে দিতে পারে।)