• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • শেক্সপিয়ার-এর “ওথেলো”, মরিসনের “ডেসডিমোনা” : এক মহাকাব্য থেকে আর এক মহাকাব্য : দূর্বা বোস

     


    এসো যুগান্তের কবি,
    আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
    দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে,
    বলো “ক্ষমা করো”...
    হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
    সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।

    --“আফ্রিকা”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    If you took the gaze of the white male— or even the white female, but certainly the male— out of the world, it was freedom! You could think anything, go anywhere, imagine anything . . . there was no longer the problem of looking through the master’s gaze.

    — Toni Morrison

    “শেক্সপিয়ার” আর “আফ্রিকা”-- এক অবশ্যম্ভাবী জটিল সম্পর্ক। অবশ্যম্ভাবী, কারণ পশ্চিমী সাহিত্যে-মঞ্চে মুখ্য “ব্ল্যাক” চরিত্র “ওথেলো”--যে নাটকের ভিত্তিই প্রতিহিংসায় উন্মাদ এক “মূর”। গত চারশ বছর ধরে “সাদা” পাঠক (এবং আমাদের মতো ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে) দর্শকের মনে জারিত হয়ে আছে এই ছবিই। অনেকের দাবী সেই জন্যেই হয়তো মহাকবির সঙ্গে “ব্ল্যাক” সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের স্বতঃস্ফুর্ত লেনদেন সম্ভব হয় নি। কিন্তু, সেখানেই শেষ নয় – সেই সমাজেরই অন্যতম সাহিত্যিক এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন নতুন প্রেরণা। টোনি মরিসনের (Toni Morrison) জহুরির চোখ, তাই ‘শেক্সপিয়র’-এর বিশাল খনিতে ছড়িয়ে থাকা অজস্র মণি-মুক্তোর মধ্যে লুকোনো নারীবাদী স্বর তাঁর নজর এড়ায় নি। এ বিষয়ে মহাকবির অন্তর্দ্বন্দ্ব একেবারে অধরা থাকে না। শেক্সপিয়রের ডেসডিমোনা অভিভাবকদের মত অগ্রাহ্য করে এক “মূর”-কে গ্রহণ করেন জীবনসঙ্গী হিসেবে: “But here’s my husband, And so much duty as my mother showed/ To you, preferring you before her father, / So much I challenge that I may profess/ Due to the Moor my lord. (Shakespeare 1.3.184-188) মূল নাটকের একেবারে শুরুতে ডেসডিমোনার চরিত্রে যে আত্মনির্ভরতার (agency) আভাস নজরে পড়ে তা মিলিয়ে যায় স্ফুলিঙ্গের মতো, বাকি নাটক জুড়ে সে কেবল মোমের পুতুল। তাই, অন্ধ ভক্তি, কিংবা বিতৃষ্ণা— কোনটিতেই সায় দেয়নি টোনি মরিসনের মন। মহাকবিকে দূরে সরিয়ে না রেখে নিজের হাতে তুলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে চেয়েছেন। সেই নাড়াচাড়া থেকে শুরু বিনির্মাণের সমুদ্রমন্থন। শেক্সপিয়রের “ওথেলো” থেকে মরিসনের “Desdemona” (Morrison, Toni. “Desdemona”, Oberon Modern Plays, 2012)—এক মহাকাব্য থেকে আর এক মহাকাব্য।


    এই সেই শিল্পী যিনি আজীবন খুঁজে বেড়িয়েছেন তন্নতন্ন করে হারিয়ে যাওয়া “স্বর”, তুলে এনেছেন ইতিহাসের গহ্বর থেকে—তাদের ব্যথা, তাদের টিকে থাকার লড়াই, দ্বন্দ্ব, প্রেম, দ্বেষ আবার কীর্তিও। তাঁর উপন্যাসে, গল্পে স্বীকৃতি পেয়েছে তাদের মানবিকতা, মানুষী দুর্বলতাও —কেবল গৌরব-গাথায় নয়, চরম লাঞ্ছনার অনিবার্য বিকৃতি—সবটুকুই। জীবনের প্রায় প্রান্তে এসে কোনো এক “ঝঞ্ঝা-ক্ষুব্ধ রাতে” এবার দুজনে মুখোমুখি। এ যুগের কবির আহ্বান প্রাচীন কবিকে: এস কবি দাঁড়াও আমার পাশে সমান জমিতে, এক আকাশের নীচে। ফিরে দেখ তোমার সৃষ্টিকে। বিস্ময়, মুগ্ধতা, আবার সংঘাতও। ‘হ্যামলেট’-এর বিখ্যাত দীর্ঘ স্বগতোক্তির পাশাপাশি ওথেলোর আত্মকথন মাত্র কয়েকটি লাইনে সীমিত। এ কেমন বিচার, কবি! “পশ্চিমী” দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে “কালো”-মানুষটিকে অভিনয় করে যেতে হয় একটানা। অথচ, তার নিজের জীবনের কোনও হদিস দর্শক/পাঠকের কাছে নেই। তার শৈশব, বেড়ে ওঠা—সবটুকুই অন্ধকারে। সমাজহীন, ইতিহাস-হীন একাকী এক “মূর”। সে কেবল এক অসামান্য বীর যোদ্ধা। বীর, আবার অন্যদিকে হিংসায় উন্মাদ এক প্রেমিক। যার একদিকে বিকৃত ইয়াগো, আর অন্যদিকে পবিত্র, অসহায় কিশোরী ডেসডিমোনা। এমন সরলীকরণেই আপত্তি মরিসনের। তাঁর দাবী নাটকটির বেশিরভাগ মঞ্চায়নে মূল রচনাটির যে জটিল, ঘন বুনোট, এবং যে গভীর অস্বস্তিতে সমাপ্তি— কিছুই ধরা পড়ে না। মরিসন সেই বুনোটের স্তরগুলি আলগোছে তুলে খুঁজে দেখতে শুরু করেন কে কোথায় লুকিয়ে আছে। খানিকটা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মতো। উঠে আসে “বারবেরী”/বারবারা-র মতো এক চরিত্র। কে এই বারবেরী? মূল নাটকটির চতুর্থ পর্বে ক্ষণিকের জন্য তার উল্লেখ পাই:

    My mother had a maid call'd Barbara:
    She was in love, and he she loved proved mad
    And did forsake her: she had a song of 'willow;'
    An old thing 'twas, but it express'd her fortune,
    And she died singing it: that song to-night
    Will not go from my mind; I have much to do,
    But to go hang my head all at one side,
    And sing it like poor Barbara…

    আসন্ন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে ডেসডিমোনার মনে পড়ে বারবারাকে, ছোটবেলার দাইমা। আফ্রিকান নারী। মনে পড়ে তাঁর গলয় শোনা “Willow Song”—ব্যথার গান। আর, বহির্বিশ্বের সঙ্গে ডেসডিমোনার যোগাযোগের সূত্রও সম্ভবত এই দাইমা— তাঁর কাছে শোনা গল্পের মধ্যে দিয়ে অন্য সমাজ, ভিন্ন রীতিনীতির সঙ্গে ডেসডিমোনার পরিচয়। খননে উঠে আসে এক অব্যক্ত ইতিহাস: ‘বারবেরী’ কেবল ব্যক্তি বিশেষ নয়, এক গোটা সমাজ/সংস্কৃতির প্রতিনিধি, যার সঙ্গে শেক্সপিয়রীয় যুগে ইউরোপের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ—মূলত ব্যবসা-কেন্দ্রিক। ‘বারবেরী’ হল উত্তর আফ্রিকা – মরক্কো, টিউনিশিয়া, আলজিয়ার্স ইত্যাদি। কিন্তু মানুষের লেনদেন তো শেষ পর্যন্ত বিকিকিনিতে দাঁড়িয়ে থাকে না, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দেওয়া-নেওয়া ঘটে যায়ই। এবার প্রশ্ন: শেক্সপিয়র কতটুকু জানতেন বাস্তব “আফ্রিকা”-কে? বিশিষ্ট নাট্য-ব্যক্তিত্ব পিটার সেলার্স (Peter Sellars) নাটকটির মুখবন্ধে মনে করিয়ে দেন নাট্যকার তাঁর থিয়েটারের নাম রেখেছিলেন “গ্লোব”। তাই, ধরে নিতেই হবে বিশ্ব-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না। তাছাড়া, “ওথেলো” (The Tragedy Of Othello, The Moor Of Venice), “মার্চেন্ট অফ ভেনিস”(“The Merchant Of Venice”)-এ “আফ্রিকা” প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে।

    গোটা নাটক জুড়ে দুটি স্তরে চলে বোঝাপড়া, কখনও দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের ভঙ্গিতে, কখনও স্বগতোক্তিতে। এক স্তরে চলে মূল নাটকে আভাসে বলা বিষয়গুলি সামনে মেলে ধরা, খানিকটা ধাঁধা সমাধানের মতো। আর এক স্তরে চলে ইতিহাসের ফাঁকগুলি ভরাট করার কাজ। এই জটিল বোঝাপড়ার জন্য মরিসন তৈরি করে নেন এমন এক পরিসর যা জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি, এক অতিপ্রাকৃত মানসলোক। কালহীন অনন্তে দাঁড়িয়ে এবার ডেসডিমোনা দ্বিধাহীন স্বরে ঘোষণা করেন : “I exist in between now: being killed and being un-dead; between life on earth and life beyond it; between all time, which has no beginning and no end…”(Morrison 1/14) ভিন্ন “বাস্তবে” দাঁড়িয়ে সামাজিক বাধা-নিষেধের বাইরে চরিত্রগুলি যেন মুক্তি পায়। আর কোনও বিচ্ছিন্নতায় নয়, নিজেদের সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বলে তাদের না-বলা কথা। মরিসনের ‘ডেসডিমোনা’ ব্যক্ত করেন নিজেকে, শেক্সপিয়ার যে সুযোগ দেন নি তাঁকে: “My name is Desdemona.” নিজেই ব্যাখ্যা করে বলেন: “The word ‘Desdemona’ means misery. It means ill-fated. It means doomed.” পরের ছত্রেই: “I am not the meaning of the name I did not choose.” (Morrison, 1/13) কন্যা সন্তানের জন্য এই নামই উপযুক্ত মনে করেছিলেন মা-বাবা। সমাজটাকে তাঁরা চিনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজেদের কন্যাটিকে তো চেনেন নি: “They were wrong. They knew the system. But they did not know me.” (Morrison, 1/13) এই আত্মোপলব্ধির সঙ্গে করুণ, কোমল খোলসটি আলগা হয়ে খসে পড়ে যায়, বেরিয়ে আসে এক পূর্ণ নারী। সমাজের চোখ-রাঙানি ছুঁড়ে ফেলে পুকুরের জলে খালি পায়ে সে নেমে পড়ে, জল ছিটিয়ে খেলা করে মুক্তির অনাবিল আনন্দে: “I remember once splashing barefoot in our pond, pretending I was one of the swans that swam there. My slippers were tossed aside.” (Morrison, 2/17)

    তারপর আর কি! কন্যার এমন ‘বেহায়াপনায়’ ক্ষুব্ধ মায়ের আদেশে দশ দিন খালি পায়ে ঘোরা। শাস্তি হিসেবে ছোট হলেও সমাজের নির্দেশটি স্পষ্ট—অভিজাত ঘরের কন্যাকে তার সমস্ত স্বতস্ফুর্ত ভালোলাগা, আকাঙক্ষা আঁটোসাট ‘করসেট’-এ বেঁধে রাখতে হবে। পর্দায় ঘেরা জীবনের ছোট্ট ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় যে খোলা আকাশ সে তো সেই বারবেরী। পরম আবেগে জড়িয়ে ধরতে চান ডেসডিমোনা: “Barbary! Barbary, come closer. How I have missed you. Remember the days we spent by the canal? We ate sweets and you saved the honey for me eating none yourself. We shared so much.” (Morrison, 9/45)

    “We shared nothing,” —বারবেরীর নিরুত্তাপ স্বরে বাঁধা থাকে বজ্রের নির্ঘোষ। ‘কে তোমার বারবেরী?! আমার সঠিক নামটিও তো জানো না! বারবেরী! সে তো এক বহু দূরের দেশ, তোমাদের অভিধানে ‘আফ্রিকা’। ওগো কন্যে, সে যে এক “বর্বর-ভূমি”, তোমাদের কল্পনায়। যে মাটির “বন্য” মানুষকে ছিনিয়ে এনেছ বিজয়ীর দম্ভে। যে ‘বর্বর’দের রক্তে-ঘামে নির্মিত তোমাদের বৈভব, তোমাদের বেঁচে থাকা।

    সম্পর্কের আকস্মিক, উন্মুক্ত সংঘাতে বিস্মিত, বিহ্বল ডেসডিমোনা প্রশ্ন করেন: 'তবে কে তুমি?’

    'আমি সারান।’(“Sa’ran”)

    ডেসডিমোনা: 'যে নামই হোক না কেন, তুমিই আমার চিরকালের সখী। একমাত্র তোমার সঙ্গেই বারে বারে মেতেছি প্রাণের ঘূর্ণি-স্রোতে।'

    'না, আমি ছিলাম তোমার দাসী,' আবারও মনে করিয়ে দেন দাইমা।

    ডেসডিমোনা: তবু তোমাকেই ভালোবেসেছি চিরকাল।

    সারান: ওগো, শ্বেত-শুভ্র কন্যে, তুমি চেন না এই কৃষ্ণকায়াকে।

    ডেসডিমোনা: ভুলে যেও না – আমিও এক কৃষ্ণকায় মানুষকেই বেছে নিয়েছিলাম জীবনসঙ্গী হিসেবে, মা-বাবার মতকে অগ্রাহ্য করে, চলে গিয়েছিলাম যুদ্ধক্ষেত্রে তারই হাত ধরে।

    সারান: “আর, সেই প্রাণের দোসরের হাতেই তোমার নির্মম পরিণতি।

    ডেসডিমোনা: আর, সেই যে তোমার প্রেম, সেখানেই বা আলো কোথায়? তোমার বিরহের গান, Willow Song? যে গান গাইতে গাইতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলে, বিনা প্রতিবাদে!—

    সারান: থামো এবার!...

    ডেসডিমোনা (কাতর স্বরে): শুনবে না আমার কথা?!

    “না, তুমি শোন আমার কথা। তোমার-আমার মাঝে বিরাজ করছে এক বিশাল খাদ। আমাদের সম্পর্ক দাসত্বের শৃংখলে বাঁধা—ভুলে যেও না। আমার কাজ তোমাদের হুকুম তামিল করা। তোমার ব্যথায় প্রলেপ, তোমার চোখের জল মুছে দেওয়া—এ সবই আমার “দায়”।

    ডেসডিমোনা: আমাকে দায়ী করছো বুঝি?

    সারান: না, কেবল মনে করিয়ে দিলাম, স্পষ্ট করে।

    Desdemona: “You blame?”, Sa’ran: I clarify.” (Morrison, 9/48)


    সামাজিক বিভেদরেখাগুলি আর আড়ালে থাকে না। ডেসডিমোনা: “সারান, (শেষ পর্যন্ত) আমরা দুজনেই তো নারী। আমার জীবনের এই জেলখানা ঠিক তোমার মতো না হলেও, জেলখানা তো বটে। ... আমি তো কখনও নিষ্ঠুর হই নি তোমার প্রতি, বলো? ‘না, তুমি কোনও আঘাত করো নি।' ডেসডিমোনা: 'তাহলে কে?' 'সে তো তোমার অজানা নয়।... থাক সেসব কথা, আজ আর ব্যথার গান নয়, নতুন গান বেঁধেছি। পুরোনো ‘Willow Song’ ফেলে দিয়ে এবার গাইব বেঁচে থাকার গান: …I shore up heart to run. To stay…And I hear a call, clear, so clear: ‘You will never die again’. What bliss to know/I will never die again”. Desdemona: “We will never die again” (Morrison, pg. 9/49)— সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ‘সেতু’ বাঁধে দুটি মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ।

    মরিসনের ‘যাদুর’ ছোঁয়ায় ওথেলোও মুক্তি পায়, উত্তীর্ণ হয় একমাত্রিক থেকে বহুমাত্রিক চরিত্রে। আর উধাও হয় ‘ইয়াগো’ (Iago)। মরিসনের মতে একেবারে অপ্রয়োজনীয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি যে বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ তা যেন বিচ্ছুরিত হয় ইয়াগো-র মধ্যে দিয়ে। যার অঙ্গুলিহেলনে চরিত্রগুলি ওঠে বসে কাঠের পুতুলের মতো। তাই তাঁর বিনির্মাণে মরিসন ‘ইয়াগো’-র “শ্বেত-দৃষ্টির” (white gaze) কোনও জায়গা রাখেন নি। ওথেলোর জটিল জীবনের টুকরো ছবি ধীরে ধীরে গোচরে আসে। শৈশব, পালিকা মায়ের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা। দাসত্বে বিকিয়ে যাওয়া, দারিদ্রের যন্ত্রণা, ক্ষুরধার জীবন, ‘জীবিকা-বিজয়ী’ বাঁচার মন্ত্রে দীক্ষা সেই সিরিয় সৈনিকদের কাছে যাদের বন্দী ছিল সে। যুদ্ধের উন্মাদ নেশা, উল্লাসের মধ্যে দিয়ে ভেতরের গভীর একাকীত্বের বিষাদকে জয় করার মরিয়া চেষ্টা:
    “As an orphan child, a root woman adopted me as her son and sheltered me from the slavers…She taught me some of her science. How to breathe when there is no air… Yet, I was captured by the Syrians… (Morrison, 6/31) Only as a soldier could I excel and turn the loneliness inside into exhilaration... (Morrison, 6/31)

    বলে চলেন ওথেলো: “There is an island surrounded by a lavender ocean where fish leap into your boat, or you can reach into the waves and catch them in your hand; where trees bear fruits year-round; where birds speak as humans; where the islanders have no heads and their faces are settled in their chests… ”(Morrison 6/33) ভবঘুরে জীবনে দেখা বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে চান প্রেমিকার কাছে। শোনান “অদ্ভুত” নারী চরিত্রের কাহিনী ডেসডিমোনাকে, যাদের সঙ্গে সে সময়ের ‘পশ্চিমী’ নারীর ছিল না কোনও মিল : “There are armies of women who kill men in battles so fierce the moon itself hides from the ribbons of shed blood. They cut off their right breasts to ease the arrow shots of their long bows to lethal precision. For this, they are called No-breast, or A-Mazon. They rule wooded nations and desert kingdoms…I have seen them and marveled at their war skills.” (Morrison, 6/34) “চিত্রাঙ্গদা”-দের দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

    ডেসডিমোনাও পরম কৌতূহল আর বিস্ময়ের সঙ্গে শোনেন জীবনসঙ্গীর বিচিত্র জীবনগাথা: “I was captured by love and prospect of inhabiting a broad original world where I could compete with the Amazons.”

    ধীরে ধীরে নিঃসৃত হয় মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অপরাধবোধ, গ্লানি—সব। যুদ্ধক্লান্ত শরীর-মনের ভেতরের জমাট বাঁধা বিকৃতি কেমন করে দুই বন্ধু (ইয়াগো আর ওথেলো) উজাড় করে দেয় দুই শ্রমক্লান্ত বৃদ্ধার দেহের ওপর। সাক্ষী থাকে কেবল এক শিশু। লুকিয়ে ছিল সে। এই একবারই কেবল ‘ইয়াগো’-র উল্লেখ নজরে পড়ে: “Aroused by bloodletting Iago and I entered a stable searching for food or drink. What we found two women cowering… They were old, so old. Fingers gnarled by brutal works…No matter. We took turns slaking the thirst of our loins rather than our throats…” (Morrison, 7/37) ভয়ংকর স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়া প্রেমিকের উদ্দেশ্যে ডেসডিমোনার আশ্বাস: নাহ, ক্ষমা করিনি। তবে, এই নির্মম স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়েই তো তোমার মুক্তি। তবুও বলে চলেন ওথেলো: “I murdered myself and you to stop the drama. If I could slay myself again, I would. But afterlife forbids a double death.” (Morrison, 10/54) “I am sick of killing as a solution. It solves nothing. Questions nothing, produces nothing, nothing, but more of itself…” (Morrison 10/54)

    ডেসডিমোনার ধিক্কার যেন শোনায় কোনো পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণের মতো। মাত্র দুটি লাইনে কি অনায়াসে নাট্যকার মুহূর্তে মেলে ধরেন এক গভীর জীবনদর্শন! মরিসনকে আমরা পাই একজন ‘theorist of justice’, ন্যায়ের প্রবক্তা হিসেবে। আজকের ‘পশ্চিমী’, মূলত আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাঙ্গণে “Abolitionist vision of justice” হিসেবে চর্চিত যে বিতর্ক, ‘ডেসডিমোনার’ উক্তিতে সেই চেতনারই ইঙ্গিত। রাষ্ট্র-ক্ষমতার দ্বারা পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত “শাস্তি-নির্ভর” ‘বিচার-ব্যবস্থা’ শেষ পর্যন্ত আমাদের টেনে নিয়ে যায় আত্মপরাজয়ের (self-defeating) চোরাবালিতে। সুরক্ষার পরিবর্তে সমাজকে বেঁধে রাখে অন্তহীন হিংসার আবর্তে— “কালো” মেয়েরা এ কথা বুঝেছেন মর্মে মর্মে ঔপনিবেশিক আমেরিকা তথা মূলস্রোত “পশ্চিমী” সমাজের তৈরি “ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম”-এর সঙ্গে প্রত্যেক দিনের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে। বলাই বাহুল্য, বিকল্পের সম্ভাবনার ভাবনাও তাই উঠে আসছে ব্ল্যাক ফেমিনিস্ট আন্দোলন থেকেই। তাঁদের মতে এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক পরিবর্তন (paradigm shift) অপরিহার্য। আমাদের মনে অপরাধী আর সাধারণ নাগরিক – এই দুয়ের মাঝে যেন একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল তোলা। অপরাধী আর ‘সাধারণ’ নাগরিক – যেন দুই ভিন্ন প্রজাতি, অপরাধীর মানব-অস্তিত্ব যেন সম্পূর্ণ বিলীন। সমাজ ভুলে যায় যে কোন মানুষই জন্মায় না অপরাধী হয়ে, ভুলে যায় এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আসলে, যুক্তি নয়, শাস্তির এক দারুণ সম্মোহিনী শক্তি বা আকর্ষণ আছে। আছে সহজ আত্মতৃপ্তির আকুল আকাঙক্ষা। তবে, অপরাধীর কপালে দুর্বৃত্তি-পরায়ণতার স্থায়ী ‘তিলক’ এঁকে দেওয়ার পরিবর্তে সমাজের কাছে তাকে এক দায়গ্রস্ত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করার সুস্থ বিকল্পের যুক্তিসঙ্গত দাবী আজ আর পুরোপুরি utopia হিসেবে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই দক্ষিণ আফ্রিকার “Truth and Reconciliation Commission”-এর মতো পরীক্ষার সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই যখন ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্যে অপরাধী এমন সক্রিয় দায়িত্ব গ্রহণ করবে, যার পরিণাম হবে নির্মাণক্ষম (constructive): “[The lawbreaker] is thus no longer an evil-minded man or woman, but simply a debtor, a liable person whose human duty is to take responsibility for his or her acts, and assume the duty of repair.” (Herman Bianchi, as quoted by Angela Davis) শাস্তি-ভিত্তিক ব্যবস্থায় এই দায় বা ‘accountability’-র প্রসঙ্গটি (ব্যক্তি এবং সমাজের) সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে যায়—“জাস্টিস”-এর নামে পড়ে থাকে কেবল প্রতিহিংসা। জেলখানাগুলি হয়ে ওঠে হিংসার প্রজনন ক্ষেত্র। প্রতিশোধের মতো মধ্যযুগীয় প্রৈতিতে ভর করে নয়, ন্যায়-সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পথে এবার সভ্য সমাজের পাথেয় হোক সৃজনশীল চিন্তা আর যুক্তি। নাটকটির সমাপ্তিতে রচয়িতা মনে করিয়ে দেন সেই কথাই: “[If] we haven’t secured the passionate peace we yearn for because we haven’t imagined it.” (Morrison 10/56)

    টোনি মরিসনের “Desdemona” “বিলোপ-পন্থী” নারীবাদেরই (Abolitionist Feminism) মহাকাব্যিক রূপান্তর।

    পরিশেষ:

    শেক্সপিযারের “ওথেলো” জুড়ে প্রায় একটানা শুনি ‘পৌরুষের গান’। এক গুচ্ছ ‘রক্তকরবী’ হাতে নিয়ে মরিসন যেন প্রাচীর ভেঙে ঢুকে পড়েন সেই ‘অচলায়তনে’। মৌনতা ভেঙে নারী চরিত্রেরা সামনে এসে দাঁড়ায়। পুরুষ চরিত্র আর কুন্ঠিত নয় তাদের ক্ষত, কান্না মেলে ধরতে। ‘কালো’ মেয়েদের গল্প বলার ঐতিহ্যের সঙ্গে শেক্সপিরিয় কথকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধ্রুপদী কাহিনীকেই নতুন করে ঢেলে সাজানোর মধ্যে দিয়ে ঘটে যায় কালোত্তরণ। শিল্পী তাঁর যাদুদণ্ডে ‘শেক্সপিয়র’-কে ‘ফেমিনিস্ট’, বহু-সাংস্কৃতিক, এক কথায় পূর্ণ গণতান্ত্রিক মন্ত্রে যেন দীক্ষিত করেন। চৈতন্যের আলোয় পৌঁছে দেন মুক্তিতে দৃপ্ত এক জীবনের স্বাধীন আকাশে। যে চৈতন্য ব্ল্যাক মেয়েরা তিল তিল করে আয়ত্ত করেছেন সামন্ততান্ত্রিক-ধনতান্ত্রিক সমাজের (যার ভিত্তি বর্ণবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, যে সমাজ সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষের শোষণে) বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘ লড়াই-এর মধ্য দিয়ে। যে চৈতন্য উঠে এসেছে “ছায়াবৃতার” বিশেষ ঐতিহাসিক-সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে।

    “তোমার, আমার এই বিরহের অন্তরালে/ কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে, তালে তালে...”— নারী-পুরুষ তো বটেই, যে কোন মানব-সম্পর্কের, এমন কি অপরাধী এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংবিগ্ন সম্পর্কের, ভেতরের এই চিরন্তন আকুতিতে সাড়া দিয়েই যেন নারীমুক্তির জন্ম, আর সেই ‘নারী-স্বাধীনতা’ আন্দোলনকে তার সীমিত পরিসর থেকে মুক্ত করে পূর্ণ মানব-মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম দিশারী মরিসন, তাঁর পূর্বসূরী আর উত্তরসূরীরা -- এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। আজ যখন পৃথিবী জুড়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, উগ্র ভোগবাদের মধ্যে দিয়ে ঔপনিবেশিকতাই নতুন খোলসে জাঁকিয়ে বসেছে, মানবসত্ত্বা যখন নানা ভাবে খণ্ডিত, তখন প্রয়োজন এমন বিশ্ববোধ যা বিভিন্ন সমাজের নিজস্ব বৈশিষ্টগুলিকে অগ্রাহ্য না করেও অখণ্ড মানব-অস্তিত্বের হদিস দিতে পারে। আজকের “বিলোপ-পন্থী নারীবাদ” (Abolitionist Feminism) সেই উদার আহ্বান।


    [এই রচনাটির জন্য আমি বিশেষ ভাবে ঋণী তিন জন সমাজতত্ত্ববিদের কাছে: Dr. Rocio Garcia (Arizona State University), Dr Susila Gurusami (University of Illinois, at Chicago) এবং Dr. Diya Bose (The College of William & Mary, Williamsburg, Virginia). এ ছাড়াও--Toni Morrison’s Desdemona and #BlackGirlMagic, by Marissa Joseph. ]


    অলংকরণ (Artwork) : উইকিপেডিয়া থেকে
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments