চুল নেমেছে ঘাড় পর্যন্ত। ভালুকের মতো নখ। তার কক্ষে কোথাও নেইলকাটার খুঁজে পেল না। মুখে মাস্ক লাগিয়ে অভীক বাইরে বেরিয়ে অনেকক্ষণ হেঁটেও একটা খোলা সেলন দেখতে পেল না। দূর থেকে দেখল একটা সেলনে কাচের ভেতর থেকে লাল লেখা স্ক্রল করছে: ইউনিসেক্স সেলন। ‘উই আর ক্লোজড আনটিল ফারদার নোটিস।’
অভীক তাকায় আকাশের দিকে। শহরটার নীল আকাশে ধূসর-সাদা মেঘের অলস-অনিশ্চিত ঘুরাঘুরি। এই সেলন, রাস্তা, ছুটন্ত গাড়ি, চারপাশের ইমারত-- এমনই কোনো উপজাত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল আগে কখনও; সব যেন তার চেনা। আগের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। অভীক সূর্যের দিকে তাকাল। মেঘের মধ্য থেকে সূর্যটাকে দেখাচ্ছে চাঁদের মতো, তেমনি রঙ ও আকার। সূর্যটাও মিলে গেল একসময়, এরপর সে যা কিছু দেখতে লাগল, সব যেন তার আগের দেখা মনে হলো। কানের কাছে কেউ বলল, ‘দেজা ভু।’
অভীক বিড়বিড় করে বলল, ‘জামাইস ভু।’
অভীকের ফোন বেজে ওঠে। সে বলল, ‘হ্যালো।’
‘তুমি কোথায় আছো, টাইমম্যাশিনে?’
‘নিজেই জানি না কোথায় আছি। তুমি কিছু বলবে?’
‘বলতে তো চাই, কিন্তু কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না; আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না।’
‘আমার কাছে গুছিয়ে বলতে হবে না, কারণ আমি তোমাকে সময় দেব। তবে ইন্টারভিউতে বা ক্যানেডীয়দের সাথে কথা বলতে গুছিয়ে বলার প্র্যাক্টিস করতে হবে। তারা সময় দেবে না।’
‘হুম। আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই বাকিটা জীবন।’
‘আমি ক্ষয়িত, ভ্যাগাবন্ড আর উচ্ছৃঙ্খল।’
‘টাইমম্যাশিনে তোমাকে গ্রাস করেছে; আমি জানি তুমি গোছানো স্বভাবের।’
‘একটা অলীক বিষয় নিয়ে তুমি সময় নষ্ট করছো, এটা হবার নয়। হয় না।’
‘তোমাকে বলেছিলাম আমি অশুভ পথে নেমে গেছি আবার, আমি নামিনি।’
‘ভালো, বেশ ভালো।’
‘তুমি কি আমাকে উপহাস করছো?’
‘আমি নিজেকেই উপহাস করি, নিজের চুল ছিঁড়ি। ধিক্কার দিই নিজেকে।’
‘তুমি মনে হয় বাইরে কোথাও, হয়তো টাইমম্যাশিনে চড়ে অন্য কোথাও গেছ, মনটাও তোমার ভালো নেই। পরে কথা বলব।’
২
অভীক বসত করছে এক ঘোরের জগতে। প্রায়ই ভুলে যায় ও তারিখ। সে যেন কক্ষচ্যুত মানব--এক আজব টাইমম্যাশিনে আসীন, আর সেই টাইমম্যাশিন পৃথিবী থেকে লক্ষকোটি আলোকবর্ষ দূরে। টাইমম্যাশিনে বসে তার বর্তমানটা রূপ নিয়েছে অতীতে। তাই বর্তমানে যা ঘটছে, তা মুহূর্তেই অতীত হয়ে যায়। ভুলে যায় দিন তারিখ, গুলিয়ে যাচ্ছে বর্তমান।
অভীকের মনে হয় যে, সে এখনও টাইমম্যাশিনে আসীন। ম্যাশিনটার মতোই অনাদর্শিক আপেক্ষিক একটা উপলব্ধি কাজ করে তার মধ্যে। যা ঘটার তা ঘটছে, কোনো কিছুই বোধহয় ধ্রুবসত্য নয়; সব কিছুতেই খাদ আছে। এই অভিজ্ঞান সে লাভ করেছে টাইমম্যাশিনের কাছ থেকে।
অভীকের মনে হলো টাইমম্যাশিনে চড়েই সে কলিবা পার্কে গিয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় রহস্যময় স্লোভাকীয় রীতিনীতির পার্কের সারি সারি অদ্ভুত ক্যাবিন থেকে ক্যাবিনে ঢুঁ মারছে অভীক। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত অভীক ঘোরাঘুরি করল পার্কে।
তার অবচেতন মনে কি সাবওয়ে ট্রেনের সেই হোমলেস পাগল লোকটা ঘাপটি মেরে বসেছিল? কোনো অদৃশ্য ইশারায় সে সেখানে ফিয়েছিল? কবে গেল? কেন গেল?
মিসিসগার সেই স্লোভাকীয় কালচারে ঢুকতে সে তার নাম ও উদ্দেশ্য রেকর্ড বইতে লিখেছিল। সেই সূত্র ধরেই, সেখান থেকে জুন নামের এক মহিলা ফোন করেছিল ওর নাম্বারে।
জুন বলেছিল, ‘তুমি কোন্ দেশীয়, কেমন লাগছে তোমার আমাদের ট্র্যাডিশন?’
‘ভালো, রহস্যে ঘেরা।’
‘এখন কাজের কথায় আসি, তোমাকে এক ঘন্টার জন্য ঢুকতে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তুমি সারাদিন ছিলে। কেন?’
‘কী করে জানলে সারাদিন ছিলাম?’
‘দেখো, এই জীবাণু সময়ে আমরা তোমার ওপর কোনো নজরদারি করিনি, তুমি সুযোগ নিয়েছ। তোমার এন্ট্রি টাইম ছিল সকাল সাড়ে দশটা, ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অন্ধকার নেমেছে, তখনও তুমি আমাদের অ্যানক্লেভে ছিলে, কেন? আমাদের কিছু খোয়া গেছে কি না, আমরা নিশ্চিত নই। আমরা পুলিসকে জানাতে যাচ্ছি।’
‘আমি কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ গ্র্যাজুয়েট, তুমি আমার সার্টিফিকেট দেখতে পারো। এটা একটা অন্যতম কারণ, আর আমি নি:সঙ্গ, এই জীবাণু সময়ে আমি একটু মানসিক রিলিফ চাচ্ছিলাম।’
মহিলা নরম স্বরে বলল, ‘তুমি আমাদের ইতিহাস জেনেছ?’
‘হ্যাঁ, জেনেছি কিছুটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনজন স্লোভাকীয় কৃষক এই জায়গাটা কিনে নেয়। মিসিসগা তখন বর্তমানের আধুনিক মিসিসগা ছিল না। সেই অঞ্চলের প্রায় গোটাটাই বলতে গেলে কৃষিজমি ছিল। কালের আবর্তে তোমরা তোমাদের কালচার ট্র্যাডিশনের প্রতিফলন ঘটিয়ে আজকের স্লোভাকীয় কলিবা পার্ক গড়ে তুলেছ।’
‘বাহ্।’ জুন প্রসন্ন হয়ে বলল। ‘তুমি কবে যেন গেলে?’
‘মনে নেই। তোমাদের এন্ট্রিতে তো ডেট নিশ্চয় উল্লেখ করেছি।’
‘তুমিই বলো।’
‘আমি টাইমম্যাশিনে যাই, সে কবে কোন্ ডেটে কোথায় আমাকে নিয়ে যায় আগাম বলতে পারি না।’
‘টাইমম্যাশিন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি এসেছিলে ২৯মে, ২০২০।’
‘ধন্যবাদ।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ, সেইসাথে তোমাকে আবার আসার নিমন্ত্রণ জানালাম। আর কপ কল করার কথাটা বলার জন্য দু:খিত।’
‘দ্যাট্স ওকে, নো প্রবলেম। আবার কোনো একদিন আসব।’
৩
অস্বস্তি আর বিকৃষ্টির ঢেউয়ে ভেসে সে ডেরায় ফেরে।
বাইরে ঠান্ডা ছেনালি হাওয়া, বেইজমেন্টের ঘরের ভেতর আদিম ইঁদুরেরা ওর পায়ের কাছ দিয়ে চকিতে চলে যায়। সে যেন আটকে আছে দিদেলাসের সুড়ঙ্গে আর তার সামনে দানব মাইনোটর মুখব্যাদান করে আছে।
ডালিয়ার কথাগুলো ভেতরে অনুরণন তোলে, মনে হয়, এই ডালিয়া বুঝি যুগ যুগ আগে অনেক কথা বলেছিল আর সেসব এখনও ভাসছে ইথারে। ডালিয়া কথা বললে তার ভেতরে একটা বিচিত্র বোধ জাগে। অনেকটা বৈশাখী উদাস হাওয়ার মতো একটা হাওয়া খেলে যায়। সেটা কী বা কেন, তা অভীকের বোধ-অবোধের মাঝে ক্ষীণালোকিত একটা ধারা। উজ্জ্বল হয় না; আবার নিভেও যায় না।
কোথায়, কোন্ এক অতীতের পাণ্ডুর মহামারি-সময়ের সাথে এই ব্যপ্তমান বর্তমানের একই রূপ, একই ডাইমেনশন। সে বিছানায় ছড়ানো বইপত্র ঘাঁটতে থাকে।
…Kaiser’s abdication may be forced any time…
76 Flu Cases, 11 Pnemonia, 5 Die… Nine New Cases of Flu reported this morning… ১ নভেম্বর, ১৯১৮--যুক্তরাষ্ট্রের ডেইলি টেলিগ্রাম পত্রিকার কয়েকটি শিরোনাম।
ভুলের মাশুল গুনছে স্পেন। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।
পুরোনো ক্রনিকলস ঘাঁটছিল অভীক। ঘরের হিটে সামনে ধূমায়িত কফি নিয়ে অভীকের মনে হলো যাবতীয় জীবকূলের মধ্যে মানুষই সবচাইতে সারকাস্টিক।
তার টাইমম্যাশিনে ঘুরছে ১৯১৮ সালে মহামারির পটভূমিতে। টাইমম্যাশিন একে একে স্যাটেলাইট ইমেজ পাঠাতে লাগল।
… পহেলা নভেম্বর ১৯১৮ সালের টেলিগ্রাম পত্রিকাটা পড়তে লাগল অভীক। কাইজার সিংহাসন ছেড়ে দেবেন। পত্রিকায় ফ্লু-এর সংবাদ। পত্রিকায় ব্যাখ্যায়িত হয়েছে মহামারির উৎস, কারণ, মৃত্যু ও সারকাজম।
মহাকলেবরে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বাঁধিয়ে এখন আবার অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখাচ্ছে মানুষের মনোবল ঠিক রাখতে।
‘যুদ্ধ বাঁধানোর সময় মনোবলের বিষয়টি কোন্ চুলোয় ছিল?’ অভীক ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। সেইসাথে রাগে ঘেউ ঘেউ করে উঠল বাড়িওয়ালার হ্যাস্কি কুকুরটা।
সব দোষ গিয়ে পড়ল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নিরপেক্ষ দেশ স্পেনের স্কন্ধে। স্পেনের স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি মহামারির কুপ্রভাব তথা রাজা আলফোনসো দ্বাদশ-এর মারাত্মক অসুস্থতার সংবাদ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে।
এই সংবাদের কারণেই স্পেনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ল। সরকারসমূহ মহামারির ডাকনাম দিল ‘স্প্যানিশ ফ্লু,’ স্পেন হয়ে গেল নতুন মহামারির জন্মদাতা।
‘অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়ে জন্মদাতা পগার পার।’ টাইমম্যাশিন বলল।
অভীক ক্লান্ত হয়ে একসময় বিছানার একপ্রান্তে শুয়ে পড়ে। তার মনে হলো বিছানাসহ সে যেন নিচে দেবে যাচ্ছে।
অভীকের মস্তিষ্কে স্যাটেলাইট ইমেজ ঘুরপাক খায়। যুদ্ধ শেষ, মহামারির শুরু--দুনিয়ার ইতিহাসে সবচাইতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, প্রাণঘাতি ও অনারোগ্য ব্যাধি, যাতে পাঁচ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। স্পেনে কি তখন পাঁচ কোটি মানুষ ছিল, আর সেই দেশেই কি সব মানুষ মারা গিয়েছিল? তবে সেই দেশের ঘাড়ে পিণ্ডি চড়ল কেমন করে।
স্যাটেলাইট ইমেজ বলে-- এত মানুষ মরল আর তোমরা স্প্যানিশ ফ্লু দিবস পালন করো না!
অভীক কিছু বলতে গিয়ে বুঝল তার স্বর বের হচ্ছে না।
কয়েকটি ইমেজ একশ’ বছর পর মহামারির সৃষ্টির হোতা চিনের দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করছে স্প্যানিশ ফ্লু সৃষ্টির উৎস হিসেবে।
টাইমম্যাশিন বলল, ‘একশ’ বছর পরে বিশ্বজুড়ে বাদুড়ের উৎপাতের জন্য দায়ী হবে চিন।’
অভীক কোনোক্রমে বললো, ‘হুম।’
টাইমম্যাশিন উত্তর দিল, ‘তাড়াতাড়ি এই স্থান ত্যাগ করো। আনা দেল ভেল নামের একটি মেয়ে শিশু এখানে ফ্লুতে আক্রান্ত, সে একশ’ বছর পর ফের চিনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। তুমিও আক্রান্ত হতে পারো, আর তা হলে তোমার ভবিষ্যৎ ইতিহাস মুছে যাবে। কারণ তুমি আনার মতো একশ’ সাত বছর বাঁচবে না।
অভীকের স্বর ফুটল। সে উৎসাহ বোধ করল, ‘দাঁড়াও, বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্ব মহামারির পটভূমিটা আরেকটু দেখে নিই।’
একটা গুরুগম্ভীর ডম্বরু বেজে উঠল, যুদ্ধ শেষের দিকের একটা বোমা ফাটল ভয়ঙ্কর বজ্রপাতের মতো।
…প্রান্তরের মতো স্থানে একটা বিধ্বস্ত ক্যাবিনের পাশে বসে আছে অভীক। দূরে কিছু শরণার্থী কাঁধে বোঝা নিয়ে হাঁটছে জম্বিদের মতো। সে ক্যাবিনের কাঠের টেবিল থেকে একটা পত্রিকা তুলে নেয় ২ নভেম্বর, ১৯১৮ সালের। আলফোনসার মৃত্যুসংবাদ পড়ল। এত কম বয়সে কেউ পৃথিবী ছাড়ে!
‘কী হলো?’ টাইমম্যাশিন বলে উঠল।
‘এই উঠলাম,’ বলে অভীক উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যায় বধির করা শব্দে। বিশ্বযুদ্ধের কতকাল আগের বোমার শব্দে টলে ওঠে সে, কফির পাত্র ছিটকে পড়ে, পত্রিকাটা হাত থেকে পড়ে যায়, ওর পতনের শব্দে হ্যাস্কি ফের ঘেউ ঘেউ শব্দ করে।
অভীক ঘোর কাটিয়ে উঠে স্থানীয় একটা পত্রিকা তুলে নেয়, তাতে লেখা:
‘অনেক বিবৃতিতে মহামারির উৎস হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক আলফ্রেড ক্রসবি ২০০৩ সালে বলেছিলেন যে ফ্লু’র উদ্ভব ক্যানসাসে হয়েছিল।
… ২০১৮-এর সমীক্ষায় বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল ওয়ারোবীর নেতৃত্বে টিস্যু স্লাইডস এবং মেডিক্যাল প্রতিবেদনগুলিতে দেখা গেছে যে ক্যানসাস থেকে শুরু হওয়া এই রোগের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
… ১৯১৮ ফ্লু মহামারিতে বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলের আপাতদৃষ্টিতে কম ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে একটি হলো চিন, ১৯১৮ সালে যেখানে তুলনামূলকভাবে হালকা ফ্লু মরসুম থাকতে পারে। একাধিক গবেষণায় নথিভুক্ত করা হয়েছে যে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চিনে ফ্লুতে অপেক্ষাকৃত কম লোক মারা গিয়েছিল। ১৯১৮ সালে চিনে তুলনামূলকভাবে হালকা ফ্লু মরসুম এবং ফ্লু-তে নিম্ন মৃত্যুহারের কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে চিনা জনগণ ফ্লু ভাইরাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছিল।’
পত্রিকাটা সামান্য ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর রেখে কফির দিকে হাত বাড়িয়ে মনে পড়ল, কফির পাত্র ভাঙা এবং তাতে একফোঁটা কফি অবশিষ্ট নেই। অভীক বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা তো তাদের থাকবেই, নিশ্চয়ই গণহারে ব্যাপক কলাবাদুড়, ভ্যাম্পায়ার আর প্যাঙ্গোলিন কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা চরমে ছিল।’
২ মে রাতে রুমমেট অলি উত্তেজিত ভঙ্গিতে অভীকের কক্ষে প্রবেশ করে বলল, ‘ ফাইভ আইজ’-এর রিপোর্টে কী বলেছে জানেন অভীক ভাই?’
‘না তো, কী বলেছে?’
‘চিন ভাইরাসটির উৎস সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে মিথ্যা বলেছে। ভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কে যারা প্রথমে বলেছিল তারা অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং পশ্চিমারা যাতে ভ্যাকসিন তৈরি করতে না পারে সেজন্য ভাইরাসের নমুনা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল।’
‘তাই নাকি?’
‘শুধু তাই না, প্রতিবেদনে ভাইরাসটি ছড়ানোর বিষয়ে চিনকে দায়ী করা হয়েছে এবং একে ‘আন্তর্জাতিক স্বচ্ছতার ওপর হামলা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। চিন শুরু থেকেই ভাইরাসটি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।
চিনের কাছে ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকে ভাইরাসটির মানব সংক্রমণের প্রমাণ রয়েছে। তবুও বেইজিং ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এটা অস্বীকার করে গেছে।’
‘হুম, এটা বিশাল অপকর্ম। মানবতাবিরোধী।’
‘আরও প্রমাণ দেখুন, চিন দেশজুড়ে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখতে চলেছে। এটা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার সুস্পষ্ট ইচ্ছের প্রমাণ নয় কি?’
নিউইয়র্ক পোস্টে ফাইভ আইজ-এর রিপোর্টে সম্পর্কে পড়ছিল অভীক মে-র ৪ তারিখ রাতে। প্রশ্ন জাগছিল-- উহানের ল্যাবেই কি তৈরি হয়েছিল বিশ্বজুড়ে প্রলয় সৃষ্টিকারী নভেল করোনাভাইরাস?
রাতে তার কানে ভেসে আসে অলির কক্ষ থেকে গোঙানির শব্দ। গোঙানির স্বরেই অলি বলল, ‘আসবেন না অভীক ভাই। আমার ভীষণ জ্বর।’
অভীক ফোন করল একটা বিশেষ নাম্বারে। মুহূর্তেই হাজির হলো মহাকাশযাত্রীর মতো সুসজ্জিত প্যারামেডিক্স বহর। তারা অভীককে দুয়েকটা মামুলি প্রশ্ন করে অলিকে নিয়ে ছুটে গেল হাসপাতালে।
৪
১৯৮৬ সালের ৩ নভেম্বর। শেষ বিকেলের আভায় সপ্তদশী দেখল একটি ছেলে বেঙ্গল স্টুডিয়োর গেইট দিয়ে বেরিয়ে আসছে। হালকা-পাতলা ও উজ্জ্বল শ্যামলা নায়কোচিত চেহারা ও কাঠামো। নিশ্চয়ই সিনেমায় অভিনয় করে। কিন্তু তার মনে হলো, একে কোথায় যেন দেখেছে।
বেঙ্গল স্টুডিয়ো তার বাসার পাশে হলেও সে কখনও ঢোকেনি। মা বলেছিলেন, ওখানে ঢুকবি না। শুটিং হয়, নানা এক্সট্রা মেয়ে থাকে, সিনেমার লোকজন থাকে, কে কখন পটিয়ে তোকে সিনেমায় ঢুকিয়ে দেবে।
ছেলেটা ওকে দেখে দ্রুত সরে যেতে চাইল। ‘শুনুন।’ প্রকৃতি বলল, ‘আপনি কি অভিনয় করেন?’
‘কার সাথে আবার অভিনয় করলাম?’ ছেলেটি বলল।
‘আপনি সিনেমায় অভিনয় করেন?’
‘না তো, আমি মাঝেমধ্যে বেঙ্গল স্টুডিয়োতে ঢুকি।’
‘শুটিং দেখতে?’
‘না, জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগে, শুটিং দেখি না। তুমি ওই বাসাটায় থাকো না?’ ছেলেটা অঙুলি নির্দেশ করে নারকেল গাছওয়ালা বাসাটা দেখাল।
‘হ্যাঁ, আমি জানেন কেমন করে?’
‘ব্যালকনিতে তোমাকে মাঝেমধ্যে দেখি।’
‘তাই তো ভাবছিলাম, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।’
‘আমার নাম অভীক, তোমার নাম কী?’
‘প্রকৃতি।’
‘বাহ্, সুন্দর নাম। আমি এইমাত্র প্রকৃতি দেখে এলাম বেঙ্গল স্টুডিয়োতে।’
‘আমি ব্যালকনিতে আসি আপনি বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন?’
‘প্রকৃতিকে লুকিয়ে দেখব কেন, সরাসরি দেখি--গভীরভাবে।’
‘তাই, তাহলে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি।’
‘না, রাখিনি। তুমিও তো রাখোনি।’
‘কীভাবে?’ প্রকৃতির চোখে কৌতুক খেলল।
‘বললে যে চেনা চেনা লাগছে।’
মেয়েটির মুখ রাঙা হলো, শেষ বিকেলের রোদ তার গণ্ডে রক্তিম আভা মদত দিল। মেয়েটা প্রায় দৌড়ে পালাল।
অভীককে চিঠি দিত প্রকৃতিকে, কিন্তু উত্তর পেত না। মনে হতো অভীক বুঝি অনেক চিঠি লিখে রেখেছে, কিন্তু পাঠাতে পারছে না। অনেক প্রতীক্ষার শেষে একদিন একটা চিঠি পেল প্রকৃতি। চিঠিটা কয়েকবার চেষ্টা করেও খুলতে পারল না। হাত কাঁপছিল। বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক করছিল।
চিঠিটা পড়ে অভিমানে-রাগে, দু:খে প্রকৃতি পাগলের মতো হয়ে গেল। চিঠিতে লেখা ছিল: Love is a small word but it contains everything. Guy de Maupassant.
ভালোবাসা বুঝি খুব ছোট্ট? সে আমার ভালোবাসা, আমার অস্তিত্বকে উড়িয়ে দিল অবহেলায়। সে তো মানুষ নয়; সে পিশাচ।
সুযোগের সন্ধানে রইল প্রকৃতি। একদিন পেয়ে গেল শিকারটাকে, অভীক ওর বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। গেটে দাঁড়িয়ে ছিল প্রকৃতি। এরকম অনেকদিন, অনেকবার সে শিকার ধরার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।
‘এই যে, শুনুন।’ প্রকৃতির ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ল অভীক, ‘কেমন আছো?’
‘ভালোবাসা বুঝি খুব ক্ষুদ্র?’
‘না তো! ভালোবাসা ক্ষুদ্র হতে যাবে কেন?’
‘ওই যে লিখে পাঠালেন।’
‘ও আচ্ছা, এই কথা?’ অভীক হাসল।
‘এমন গাধার মতো হাসছেন কেন?’
‘গাধারা বুঝি হাসে? জানতাম না তো!’ অভীক আবার হাসল।
‘তুমি আমার পত্রের প্রথম অংশটুকু বুঝেছ, বাকিটা বুঝোনি। কথাটা বলেছেন ফ্রেঞ্চ স্টোরি রাইটার গি দ্য মোপাসাঁ। এর অর্থ হলো, ভালোবাসা একটি ছোট্ট শব্দ কিন্তু এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সবকিছু।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ, তুমি ভাবসম্প্রসারণ করোনি, যেমন, ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে?’
‘বুঝেছি, আমাদের ফাইনাল পরীক্ষায় এই ভাবসম্প্রসারণটি এসেছিল,’ প্রকৃতির চোখে-মুখে খুশি উপচে পড়ে।
‘তেমনি মোপাসাঁর এই কথাটা ভাবসম্প্রসারণ করে বুঝে নিতে হবে ভালোবাসা শব্দটা ছোট্ট হলেও পৃথিবীতে ভালোবাসাই সবচেয়ে বড়।’
‘আচ্ছা।’ প্রকৃতি দৌড়ে পালিয়ে গেল।
পেছন থেকে অভীক কয়েকবার ডেকেও থামাতে পারেনি। প্রকৃতি পালিয়ে গেল।
…এরকম কি সত্যিই ঘটেছিল! ডালিয়া আনমনা হয়। নাকি এটা সিনেমার কোনো দৃশ্য ছিল। এ যে কল্পনাকেও হার মানায়। টরোন্টোতে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি কি তাকে রূপকথার রাজ্যে নিয়ে গেল? নাকি সময়ের ভেল্কিবাজি তাকে ধন্ধে ফেলে দিয়েছে।
সে তার নিজের দেশ ছেড়েছিল এক যুগ আগে। তারপর তো লোকটা ওকে ফেলে চলে গেল। তারপর অনেক কষ্টে, অনেক বিবমিষায় তার সময় বয়ে গেল। অশ্রু নামে দুচোখ বেয়ে। সে ফোন করে অভীককে।
‘হ্যাঁ বলো।’
‘তুমি কি বাসায়?’
‘বাসায়, তুমিও বাসায়, কারণ বাইরে বৃষ্টি।’
‘হুম, তুমি কি এই জগতের মানুষ নও?’
‘কেন বলো তো?’
‘জানি না। মনে হয় তুমি এই জগতের মানুষ নও।’
৫
‘মানবজাতির অবস্থান এখন প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; ইয়েমেনকে খুন করা হচ্ছে। ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষে কংকালসার শিশুদের দেখে মানবতা এখন আর কাঁদে না।’ বলল বন্ধু হাসিব।
‘ঠিক,’ অভীক বলল, ‘এখন ফোন রাখি, এখন শপারস-এ গেলে জানাব আপনাকে।’
প্রেসারের ওষুধ আনতে শপারস-এ যাওয়া হয়নি; বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ঝড়--বৃষ্টি-তুষারপাতে ক্যানেডীয়রা অভ্যস্ত এবং তাদের প্রস্তুতিও থাকে; কিন্তু এখন ভিন্ন সময়, রাহুর গ্রাসের সময়।
বহু আগে বলা হাসিবের একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে অভীক শরীর ঝাঁকিয়ে হেসে নিল। একদিন ম্যাকডোনাল্ডসে বসে ছিল দুজন। সেইসময় হঠাৎই ভয়ঙ্কর তুষারপাত শুরু হলো, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার মতো যমদূত বাতাস।
‘শুরু হলো মাসিক।’ হাসিব বলল, ‘প্রাকৃতিক এই বষয়টি বড় বিরক্তিকর, মেয়েদের জন্যও, টরোন্টোর জন্যও।’
অগত্যা বৃষ্টিই দেখছিল অভীক; নৈর্ব্যক্তিক বৃষ্টি, কোনো ভাবোদয় হল না অভীকের। তবে বৃষ্টি হলে কেবল বাংলাদেশের রাজধানি শহরে গাছপালা ছাওয়া একটা টিনের বাড়ি ও অভাবি সংসারের কথা মনে পড়ে। সেই টিনের বাড়ি দ্বিসত্তার জন্ম দেয়। ফিরে যেতে মন চায় না সেই সময়টায়, আবার একই সাথে মনে পড়ে পেনশনপ্রাপ্ত হাঁপানি রোগী বাবা ও অসহায় মা ও জীর্ণ ছোটো দুই ভাইবোনের কথা। শুধুমাত্র পেনশনের টাকায় ধুঁকছিল সংসার।
***
টরোন্টোতে প্রথমবারের মতো কোনো বাঙালি মেয়ে একদিন ম্যাসেঞ্জারে তাকে কল করল। নাম ডালিয়া।
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো, আপনি?’ অভীক বলল।
‘এই সময় যতটুকু ভালো থাকা যায়, ততটুকুই আছি।’
‘হুম। পরম পবিত্র আত্মা সবাইকে ভালো রাখুন।’
‘আচ্ছা, আপনি কি খুব নি:সঙ্গ?’ মেয়েটি বলল, ‘মনে হয় আপনি খুব একাকী।’
‘এখন সবাই-ই একা। মরে গেলে মৃতের খাটিয়া ধরে নেয়ার লোক পাওয়া যায় না।’
‘তা জানি, আমি বলছি আপনি মহামারির অনেক আগে থেকেই নি:সঙ্গ। ডালিয়া জবাব দিল।
‘প্রতিটি মানুষই নি:সঙ্গ কোনো না কোনো ভাবে। আপনি কি নি:সঙ্গ?’
‘আমি নি:সঙ্গ।’
‘আপনি কি জন্য কল করেছেন জানতে পারি?’
‘পারেন। আসলে আমার একজন বন্ধু দরকার।’
‘আমার জানা মতে আমার কোনো বন্ধুহীন কেউ নেই যাকে আমি আপনার বন্ধু হতে বলব।’
‘আপনিই তো আমার বন্ধু হতে পারেন।’
‘আপনি চেনেন আমাকে?’
‘ভালো করেই, ফেসবুকে আপনার স্ট্যাটাসগুলো দেখে আমার মনে হয়েছে আপনার একজন প্রকৃত বন্ধু দরকার। সঙ্গিনী দরকার, আসলে আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে রীতিমতো রিসার্চ করে আসছি।’
‘কেন?’
‘সত্যি বলতে কি, আমি একজন প্রকৃত বন্ধু খুঁজছি। আপনাকে আমার খুব ব্যতিক্রমী মনে হচ্ছে।’
‘আমি কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিনি; আপনার বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতে পারব কি না জানি না; মেয়েদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। আমি বিয়ে করিনি।’
‘প্রেম করেননি?’
‘না।’
‘বিয়েও করেননি, প্রেমও করেননি? কোনো মেয়ে প্রেম নিবেদন করেনি আপনাকে, বা আপনার কোনো মেয়েকে ভালো লাগেনি?’
‘আমার টাইমম্যাশিন বলে--কোনো একটি মেয়ে কোনো এক অতীতে আমার প্রেমে পড়েছিল; কিন্তু সেটা যে প্রেম আমি বুঝিনি।’
পরদিনই এলো মেয়েটা। জলজ্যান্ত একটা প্রায় যুবতী মেয়ে ওর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অভীক তাকে ঘরে বসাল। এই প্রথম কোনো অপরিচিত যুবতী একটা মেয়ে ওর মুখোমুখি বসল। অভীক নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দেখল ডালিয়াকে। তারপর কফি বানিয়ে নিয়ে এলো দুজনের।
ডালিয়া কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘চমৎকার, আমি দুধ মেশানো কফি খাই কিন্তু কালো কফির যে এত স্বাদ, বুঝিনি।’
‘এখন বলুন আপনার গল্প, বলছিলেন নিজের কথা বলবেন।’
‘হ্যাঁ, বলব, তার আগে বলুন আমি দেখতে কেমন।’
‘আমি মেয়েদের বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাছাড়া কাব্যিটাব্যি আমার তেমন জাগে না। আমি কবিতা গল্প উপন্যাস তেমন পড়িনি। ননফিকশন কিছু পড়েছি।’
‘তবু বলুন আমাকে দেখতে কেমন।’
‘বেশ। টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে, কালো এলোচুল। মায়াময় চাহনি। শ্যামলা, হালকা-পাতলা গড়ন।’
মেয়েটি হাসল। বলল, ‘যতটা বেরসিক ভেবেছিলাম আপনাকে আপনি তা নন, কাব্যিও আছে, পাস করেছেন আপনি। আচ্ছা, আমার কথা বলি।
‘২০১৬ সালে আমি ক্যানেডায় আসি হাজব্যান্ড ও একটা ছোট্ট ছেলে-সহ। এখানে আসার পর আমাদের একটা মেয়ে হয়। আমার হাজব্যান্ড বাংলাদেশে একটা বায়িংহাউসে চাকরি করত। যা পেত তাতে সংসার চলে যেত। আমাদের মধ্যে মিল-মহব্বত তেমন ছিল না তার রাগী স্বভাবের জন্য। শেষে একদিন আমি তাকে মনের কথাটা খুলে বলি। তাতে সে রাজি হয়নি। তবুও আমি চেষ্টা চালাতে লাগলাম। ছেলেটাকে বোঝালাম, ছেলে গিয়ে তাকে রাজি করাল। কিন্তু আমি জানতাম সে মন থেকে মেনে নেয়নি, ছেলের মায়ায় সে রাজি হয়েছিল।
আমি গ্র্যাজুয়েট আর সে মাস্টার্স। দুজনেরই বয়স কম, আমাদের প্রথম সন্তান ছেলেটা তখন ১১ বছরে পা দিয়েছে। আমার ক্যানেডায় ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করি। দেড় বছরের মাথায় আমাদের ইমিগ্রেশন হয়ে যায়।
কিন্তু ক্যানেডায় এসে সে চরম অলস ও উদাসীন হয়ে যায়। ঘরে বসে থাকে, একসময় ওয়াইন ধরল। সে বলতে লাগল, আমি নাকি তাকে নরকে এনে ফেলেছি। ততদিনে আমাদের মেয়ে জন্মায়। মেয়েটা হওয়াতে আমাদের খানিকটা হলেও গতি হলো; দুই বাচ্চার চাইল্ড বেনেফিটে কোনোরকম একটা বেইজমেন্ট ভাড়া করে মাথা গুঁজে থাকি। আর সে সোশ্যাল অ্যাসিস্টেন্সে চলে গেল। আমি একটা পার্টটাইম জব নিলাম একটা ওল্ডহোমে ক্লিনিংয়ের কাজে। একদিন বললাম, তুমি যেমন আছো থাকো, আমিই সংসারটা গুছাব, তুমি ওয়াইন ছেড়ে দাও।’
‘হুম, তারপর?’
‘কিন্তু সে কিছুই শুনল না। একরাতে আমি কপ কল করে বসলাম। তারা এসে তাকে নিয়ে যায়। কয়েকদিন পর পুলিস তাকে হয়ত ব্রেসলেট লাগিয়ে ছেড়ে দেয়। যে যদি বিপজ্জনক দূরত্ব অতিক্রম করে আমার সাথে দেখা করতে চায় তবে পুলিসের কাছে সিগন্যাল চলে যাবে।’
ডালিয়া কেঁদেকেটে বলল, ‘আমি কেন পুলিস ডাকতে গেলাম! মানুষটা সারাদিন পথে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় থাকে, কী খায় কিছুই জানি না। একদিন তাকে ড্যানফোর্থ এলাকায় দেখলাম। সে দেখতে হয়ে গেল হোমলেসদের মতো পাগল ও নোংরা।
আমি তাকে বললাম বাসায় আসতে। সে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর অন্যদিকে চলে গেল। বাসায় এসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, একবার মনে হলো বিষ খাব। ছেলেমেয়ে দুটির কথা মনে করে সংবরণ করলাম নিজেকে। তারপর ভাবলাম, সে ফিরে আসবে। ছেলেমেয়ের মায়ায় ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর আর ফিরে আসেনি।’
দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল ডালিয়া।
‘হুম। খুব দু:খজনক।’
‘তারপর আর যোগাযোগ নেই। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। সে শেকড় ছেড়ে এই দেশে আসতে চায়নি; আমিই জোর করে তাকে এনেছি। তাকে আর দেখতে পেলাম না। পরে শুনলাম সে দেশে ফিরে এসেছে। আর আসেনি। সেই থেকে বাচ্চাদুটো নিয়ে আমি অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছি।’
অভীক বলল, ‘বেদনাদায়ক।’
‘আমি তোমার কাছে কিছুই লুকোইনি, তোমাকে আমি ঠকাচ্ছিও না; আমি মনের দিক থেকে পবিত্র, বাচ্চাদুটোকে বাঁচাতে গিয়ে একটু বেপথু হয়েছিলাম। মাসাজ পারলারে কাজ করেছি। তুমি আমাকে গ্রহণ করবে?’
‘তুমি গৃহীত, কিন্তু কী হিসেবে আমি জানি না। আমি তোমার কষ্টে সমব্যথী হয়েছি।’
‘তুমি আমাকে বিয়ে করো। আমি দেখতে তো অসুন্দর নই, একটু শ্যামলা, এই আরকি।’
‘তুমি দেখতে, মানে কী বলব। অনেক আগে শ্রীকান্ত উপন্যাস পড়েছিলাম। সেখানে অন্নদা দিদির বিবরণে তার চেহারার যে বুনোট আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল, তুমি দেখতে তেমনটি।’
মেয়েটি উবু হয়ে দুই হাত রাখল অভীকের পায়ে, ‘আমাকে গ্রহণ করো তুমি, নইলে আমাকে মাসাজ পারলারেই বাকি জীবন কাটাতে হবে।’
‘কী জানো, আমি সংসারী নই, উড়নচণ্ডী, আমার তো চালচুলোর ঠিক নেই। কোনোও নারী আসেনি আমার জীবনে। আর আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তুমি এখনও কমবয়সী।’
‘আমি যৌবন পার করতে যাচ্ছি, আর তুমি তোমার যৌবন শুরু করবে, নতুনভাবে। তোমাকে আমি গড়ে তুলব মনের মতো করে।’
‘তা হয় না। আমি আমার জীবনটাকে ছাঁচে ফেলতে পারিনি কোনোদিন। আমি পারব না ডালিয়া।’
‘তাহলে প্রেমিক হও।’
‘না, তা-ও সম্ভব নয়। তুমি ডালিয়া ছিলে তাই থাকো। কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ বলো।’
…উদাস চোখে বেইজমেন্টের ফোকর দিয়ে বাইরে তাকায় অভীক।
‘আমি তোমাকে বলেছি, প্রেম কি আমি বুঝিনি; বুঝলে আমার জীবনে যে ছায়ার মতো প্রেম এসেছিল, তাকে আমি অনুসরণ করতাম।’
ডালিয়া চুপ হয়ে গেল। নীরবতা গ্রাস করল দুই মানব মানবীকে। মেয়েটি বলল, ‘তুমি সত্যিই রহস্যে ঘেরা।’
অভীক হাসল।
‘তুমি নিষ্ঠুর।’
মেয়েটি যেতে উদ্যত হয়। তাকে কেমন ভগ্ন, আশাহত ও ক্রন্দসী আর একই সাথে ঋদ্ধ মনে হলো। নীরবে চলে গেল মেয়েটি।
অভীক একা ঘরে বিড়বিড়িয়ে বলল: ঘরসংসার, একটা যুবতী মেয়ে ও দুই শিশুর দায়িত্ব…।
অভীকের মনে হলো টাইমম্যাশিনে করে এমন কোথাও চলে যাবে যেখানে মানুষ থাকবে না। দুঃখ, ব্যথা-বেদনা থাকবে না, বাদুড়ের উৎপাত থাকবে না। থাকবে শুধু প্রকৃতি। পাখি, গাছগাছালি, ফুল ও প্রজাপতিতে ভরপুর এক প্রকৃতি। যেখানে ঝরনাগুলো জল ঢালবে, দীঘির থির জলে পদ্ম ফুটে থাকবে।
এই জীবাণু সময়টা মানুষকে ঘরবন্দী করে যেমন প্রকৃতিকে ফিরিয়ে এনেছে, তেমন সেঁধিয়ে দিয়েছে শঙ্কা ও মৃত্যুভয়। অভীক নিজেকেই শোনাল।
বাইরে মাইনাস তাপমাত্রা। ঘরের হিটও সামাল দিতে পারছে না জমাটবাঁধা প্রকৃতির শান্ত তাণ্ডবকে। তার মানসপটে অলির মুখটা ভেসে ওঠে। অলির স্থানে এসেছে নতুন একটা ছেলে। ভালো, চঞ্চল, পড়াশোনা করে আর একই সাথে উইড-খোর।
অভীকের তো মনে হয় সে যেন ক্রেটাসিয়াস যুগের এক অর্নিথিসাইরাস--ঠান্ডা মেঘের রাজ্যে চির উড্ডয়নশীল।
প্রকৃতি!
অভীক ঘরময় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে। সে বিড়বিড় করে বলল, এই ডালিয়া কি প্রকৃতি নয়!
‘হ্যাঁ।’ টাইমম্যাশিন উত্তর দিল।
একটা শ্যামলা-শুঁটকো মেয়ে, সামান্য কোঁকড়ানো চুল, বয়সেও অনেক ছোটো, চুলের গোছা কপালের ওপর টান টান হয়ে থাকত লাল ব্যান্ড লাগানোর কারণে। দুই চোখে কাজলকালো মায়া, আর সব মিলিয়ে ওকে দেখতে ভারী আদুরে ও মিষ্টি লাগত।
প্রকৃতি বলেনি কেন? আসলে প্রকৃতি বলে না কিছু। বুঝে নিতে হয়। মানুষ যখন সীমা অতিক্রম করে, তখন কানে কানে কিছু বলে যায়। ওর ফেসবুকে এতটা দিন ডালিয়া নাম ধরে ঘাপটি মেরে বসেছিল প্রকৃতি। কেন সে খেয়াল করেনি? কেন একটি বার একটা টেক্সটও পাঠায়নি সে। প্রকৃতি একদিন লিখেছিল, ‘কেমন আছেন?’
তার জবাব দেয়নি অভীক।
আসলে ওর একটা সময় ছিল, সেই সময়টা অযত্নে-অলক্ষ্যে চলে গেছে। তা আর ফিরে পাবার নয়। অভীক ফোন করল।
‘তুমি এতদিন পরিচয়টুকু দাওনি কেন?’
‘কতদিন হয়েছে তোমার ডেরায় গিয়েছিলাম, তা-ও তুমি ভুলে গেছ। এক মাস। তোমার বুকের ভেতরে পাষাণ নামের পাথরটাকে অপসারণ করো, আমার জন্য না হোক, যাতে আর কারুর প্রতি তুমি অবিচার করতে না পারো।
আমি জানি, তুমি টাইমম্যাশিন নিয়ে গবেষণা করছো, ফেসবুকে তোমার স্ট্যাটাসগুলো অদ্ভুত।’
‘না হয় এক মাস পরে করেছি। করেছি তো।’
‘কেন?’
‘তুমি এসো প্রকৃতি, আমরা টাইমম্যাশিনে চড়ে তোমার-আমার অতীতে ফিরে যাব। তোমার মনে আছে, শ্যাওলা ধরা নিচু দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে তুমি হাসতে, কানে ফুল গুঁজতে গুঁজতে? কোথাও থেকে যেন হাসনোহানার সুবাস আসত?’
ফোনের অপর প্রান্তে কাচভাঙা হাসিতে ভেঙে পড়ল প্রকৃতি। হাসি থামেই না। কিছুক্ষণ পর প্রকৃতি বলল, ‘তুমি নির্লজ্জ, কাপুরুষ। তুমি কাল্পনিক কোনো প্রাণী, মহাশূন্যে উড়ে বেড়াও উপগ্রহের মতো, তুমি আর ফিরতে পারবে না স্বাভাবিক জীবনে। তোমার অধ:পতন হয়েছে। আমি তোমার দ্বারে আসতে পারব না। আমি ফিরে গেছি পুরোনো পেশায়।’ আবার শব্দ করে হাসে প্রকৃতি।
ডালিয়া প্রকৃতি ছিল, এটা জানত না অভীক। এখন জানে। আর এই জানাটা বুকের ভেতর কান্না হয়ে পাক খায়।
ফেসবুকের ডালিয়া ছিল প্রকৃতি-- এটা এভাবে এইসময়ে কেন কান্না হয়ে ওর দ্বারে কড়া নাড়ল!
‘আমি কতবার পরাজিত হবো? অতীতে ফিরিয়ে দিলে আমাকে, ফেসবুকে চিনতে পারলে না। এমনকি কাছে গেলাম, তা-ও তুমি চিনতে পারলে না।’
‘ঘাট হয়েছে আমার। ভুল বুঝতে পেরেছি।’
‘একটা মধুর অতীতকে গলা টিপে মেরে ফেলে এখন ভুল বুঝতে পারছো? তুমি কি ভুল বুঝতে পেরেছো একথাটা বলার জন্য আমাকে ফোন করেছো?’
অভীক উত্তর খুঁজে পেল না।
‘জানি, তোমার কাছে কোনো উত্তর নেই।’
‘আমি ভাইরাস। দূর অতীত থেকেই। আমার সংস্পর্শে এলে তুমি ধ্বংস হয়ে যেতে।’
‘তুমি আমার হৃদয় বিদীর্ণ করে দিলে কেন?’
‘তুমি কোনো সুদূর অতীত থেকে কথা বলছো।’
‘বলছি, তুমি বিদেশ চলে গেলে। একটিবার তো আমাকে জানাতে পারতে, আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম।’
‘ভালো হতো না; কারণ চিরকাল আমি দারিদ্রে ও পরিবারের চাহিদা পূরণ করে কাটিয়েছি। আমি যেদিন বিদেশ রওয়ানা দিলাম, সেদিনই বুঝেছিলাম আমার স্বাধীনতা এবং আমার মন ও মননের পতন হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্যের সাথে কাউকে জড়াতে চাইনি।’
‘না হয় তোমার দুর্ভাগ্যের সাথী হতাম। হয়তো তুমি আমাকে ফেলে চলে যেতে না। ওই লোকটা তো আমাকে ফেলে চলে গেল।’
‘কী জানি, কী হতো। মানুষের জীবন বা সংসারজীবনের কিছুই আমি বুঝি না। তুমি নিজেকে আর কষ্ট দিয়ো না।’
হু-হু করে কেঁদে উঠল প্রকৃতি।
‘আজকের এই বৃষ্টির মতো কেঁদেকেটে হালকা হও। তুমি ভালো থেকো।’ ফোন রেখে দেয় অভীক।
৬
কফি হাতে কিচেন থেকে ফিরে এসে অভীক দেখল রূপা বসে আছে। রূপা আর সে থর্নক্লিফ নেইবারহুডে ফ্যামিলি ভায়োলেন্সের ওপর ভলান্টারি জব করছিল। এই দেশে আসার প্রথম দিকে। সেই থেকে ওদের বন্ধুত্ব। রূপা এখন ওয়ালমার্টে কাজ করে।
‘তুমি কখন এলে?’
‘এই তো। চারদিকে যা অবস্থা।’
‘চুলোয় যাক। তুমি এসেছো, রান্নাটা তুমি করো। দুজনে একসাথে খাব।’
‘তা করব।’ রূপা বলল, ‘পৃথিবীটা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে; কোনো শব্দ নেই, কোনো মানুষ নেই। আর তোমার ঘরটায় অদ্ভুত একটা আবহ আছে। আমার রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আলস্যে হাত পা ছড়িয়ে তোমার সাথে গল্প করি।’
‘গল্পই করব, আমি তাহলে পিজার অর্ডার করে দিই, কী বলো?’
‘সেটাই ভালো হবে। আর তুমি একটু আমার পাশে বসো।’
‘এই বসলাম।’
‘এখন বলো প্রকৃতি কে?’
‘প্রকৃতি?’ অভীক গম্ভীর মুখে সব বলে গেল।
মুগ্ধ চোখে তাকায় রূপা অভীকের দিকে, ‘তুমি সত্যিই অদ্ভুত। নিজের জীবনটাকে এভাবে কেউ নষ্ট করে।’
‘তুমিও তো নিজের জীবনটাকে নষ্ট করেছো। শুধু আমাকে বলছো কেন? তুমি আতিক নামে উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তবান একজনকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করেছিলে, শুধুমাত্র ও সামান্য খোঁড়া ছিল বলে। তুমি নিজেই স্বীকার করেছিলে একদিন।’
‘হুম, দুজনেই একই পথের যাত্রী।’
***
বিমর্ষ মনে বসে ছিল অভীক তার কক্ষে। রূপা এসেছিল দিন কয়েক আগে; তার আসাটা যেমন আশাজাগানিয়া ছিল, তেমনি সেই আশাটুকু নৈরাশ্যে পরিণত হতেও সময় নেয়নি। রূপা এসেছিল মাত্র কদিন আগে, কিন্তু সেই কয়েকদিনই যেন পরিণত হলো গুচ্ছ গুচ্ছ যুগে। যেন এমনটি কখনো ঘটেনি, এটি ঘটেছিল স্বপ্নে বা দু:স্বপ্নে। এই অবাস্তবতা বা দু:স্বপ্নই তাকে নিয়ে যায় এক যন্ত্রণার জগতে।
রূপা ওকে তীব্র আঘাত করেছিল। ওর হৃদ্পিণ্ডে জোড়া ছুরি গেঁথে দিয়েছিল। ‘অলস, নপুংসক, ভীরু-কাপুরুষ,’ ইত্যাদি গালাগালিতে ওকে খানখান করে দেয়।
শেষ পর্যন্ত রূপা বলেছিল যে, প্রকৃতির কাছে নাকি অভীক সবকিছু খুইয়ে বসেছে। তাই রূপার দাম সেখানে নেই।
কী থেকে কী হলো-- ভেবে পেল না অভীক। থ্রি ডব্লিউজ-এর মতো মেইজ। ওয়েদার, উইমেন আর ওয়ার্ক-- তিনটেরই মতিগতির ঠিক থাকে না।
নিশ্চয়ই কফি বানাতে গিয়েছিল যখন সে, তখন রূপা অভীকের ফোনের ম্যাসেঞ্জার ঘেঁটে সব জেনে নিয়েছে।
কেন সে অভিশপ্ত। কেন সে জীবনে একমুঠো সুখের সন্ধান পেল না। এসব প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তরে বিচলত হয় অভীক নতুন করে। টরোন্টোতে ব্রদেল নেই। আছে মাসাজ পার্লার। মাসাজ হয় শরীরে--নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। কোরীয় মেয়েটা অনেক চেষ্টা করেও পারেনি অভীকেকে সুখানুভূতি দিতে। মেয়েটা বলেছিল, ইউ আর ইম্পোটেন্ট।
অভিমান বাষ্পায়িত হয় গলার কাছে। বুকের ভেতর ঘন কালো মেঘের ডম্বরু বাজে।
ফোন অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলছিল, সেখানে প্রকৃতির নামটা দেখে অভীক হাত বাড়িয়েও সিদ্ধান্ত বদলে রাগী-দু:খী-অভিমানী চোখে চেয়ে থেকে সামান্য খুশিও হলো। কফির পেয়ালার দিকে তাকাল; কখন জুড়িয়ে গেছে। অভীকের মনে হলো-- এইমাত্রই তো সে আগুনগরম কফি বানিয়ে আনল, সেটা জুড়ল কখন? তাহলে কি সে অনেক আগে কফি বানিয়েছিল? আর অনেকক্ষণই কি প্রকৃতি ওকে ফোনে চেষ্টা করছিল?
আবার ফোন বাজল। ভেতরের প্রাক-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে ফোনের দিকে তাকাল না। টাইমম্যাশিন বলল ফোন ধরতে।
এবার তাকাল সে ফোনের দিকে, দেখল হাসিব ফোন করেছে। হাসিবের নামের পাশে এক পলক সে দেখল একটা লেখা-- প্যারালাল ওয়ার্ল্ড। সে ফোন হাতে নিয়ে কলব্যাক করল হাসিবকে। এক সেকেন্ডের কয়েক ভাগের কম সময়ে ফোন ধরল হাসিব।
ফোনটা সময়মতো না ধরতে পারায় অপরাধবোধ কাজ করছিল অভীকের ভেতরে। সে বলল, ‘প্যারালাল ওয়ার্ল্ড।’ সাথে সাথে ফোন কেটে গেল। অভীকের মনে হলো, কে যেন ওর মুখ দিয়ে কথাটা বলিয়েছে।
ফের বেজে ওঠে ফোন। অভীকের ফোন ধরতেই হাসিব বলল, ‘অভীক ভাই আপনার মুখে কথাটা শুনে এমন চমকে উঠেছিলাম যে ফোন হাত থেকে পড়ে গেল। আপনি জানলেন কেমন করে যে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড সম্পর্কেই আপনার সাথে কথা বলব?’
অভীক ততক্ষণে ফোনে দেখে নিল যে, হাসিবের নামের পরে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড শব্দদুটো এখন আর দেখাচ্ছে না। সে উত্তরে বলল, ‘দেজা ভু।’
‘মানে!’
‘মানে প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বলতে একটা কনসেপ্ট কিছু কিছু বিজ্ঞানী প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিন্তু এরকম কিছু আমি নিজে বিশ্বাস করি না।’
‘করেন না?’ হাসিব বলল, ‘আমি তো বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। আজকে একটু বাইরে বের হয়েছিলাম, কেন যেন মনে হলো আমি সুদূর অতীতের কোনো পটভূমিতে বিচরণ করছি। সব কেমন অপার্থিব মনে হচ্ছিল, আর মনে হলো…।’
‘বিশ্বাস করিনি এই কারণে যে, আমি দেজা ভু-এ বিশ্বাসী, যা মানসিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।’
‘কিন্তু আমি বিশ্বাস করছি। আপনি দেজা ভু-র কথা বলেন সেটাও মানি। কিন্তু আজকে আমার অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন, আমি মরে গিয়ে না, জেগে থেকেই চলে গিয়েছিলাম অন্য এক পৃথিবীতে। চেনা পৃথিবীর ভেতরে এক অজানা পৃথিবীতে। মনে হচ্ছিল যেন সেই পৃথিবী থেকে আমি আর ফিরতে পারব না, তাই চটজলদি বাসায় ফিরে আসি। বাসায় আসার পর কী এক চুম্বকীয় আকর্ষণে আমি আবার বাইরে যেতে চাইলাম। কে যেন সতর্কবাণী উচ্চারণ করল। তাই আমি বাইরে যাইনি, তবে বারান্দায় গিয়েছিলাম। তখন মনে হলো, কে আমাকে বারান্দায় আনল।’
‘আপনার অনুভূতি-অভিজ্ঞতাকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না, আর প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বা পারামনেসিয়ার ধারণায় ভর করে নাসা বলছে, তারা এমন কিছু খুঁজে পায়নি। আর আমাদেরও কোনো কাছের বা দূর অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আপনার একটা মানসিক অবস্থা।’
‘হয়তো নাসা-র পক্ষে সেটা খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।’
‘ধরুন প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বলে কিছু আছে, আর আপনি সেখানে গেলে ফিরে এলেন কীভাবে?’
‘কী জানি, আমার মাথায় কিছু খেলছে না ভাই।’
‘আমার মনে হয়, আমরা সময়সুযোগমতো একবার কোথাও বসি। আপনি তো কাজে যোগ দেননি।’
‘ঠিক আছে অভীক ভাই, এই কথাই রইল।’
৭
গজগজ করে অভীক এগিয়ে গেল আয়নার সামনে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের গালেই থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে হলো। দিন দিন চেহারাটা বুড়িয়ে যাচ্ছে। সড়াৎ করে পেছনে তাকাল সে, কে যেন পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ফের আয়নার দিকে চোখ মেলে নিজের গালে হাত বুলিয়ে খোঁচাদাড়ির স্পর্শ নিল। এবার আয়না ওকে চুম্বকের মতো টানতে লাগল।
‘এ কী রে বাবা, টাইম ডিস্টর্শন, নাকি স্পেস টাইম কন্টিনুয়ামের খেলা?’ সে ভোঁতা শব্দে আয়নার সাথে বাড়ি খেল এবং উল্টোদিকে পড়ে গেল।
জ্ঞান ফিরে অভীক অনুভব করে তার ভেতরে যেন সুনামির প্রবাহ বইছে, এবং সে উপলব্ধি করতে সে কোভিড১৯-এ আক্রান্ত।
‘এটাই বাকি ছিল।’ বিড়বিড় করে বলল অভীক।
‘কী বাকি ছিল?’
‘ওই ওইটা, তারা লাখ লাখ মানুষ খেয়েছে। আমাকে কি আর বাকি রাখবে!’
‘মেঝেতে শুয়ে আছো কেন, বাইরের দরোজা খোলা। কী ব্যাপার?’
‘কোনো ব্যাপারট্যাপার না। গেট আউট, নিকাল যাও ইঁহাসে।’
‘আরে, একটু তাকাও না। আমি প্রকৃতি।’
‘প্রকৃতি কখনো এমন আচরণ করে?’
‘আরে, কী হলো? ওঠো।’
এবার তাকায় অভীক। দেখল প্রকৃতি দাঁড়িয়ে আছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তফাৎ, তফাৎ। আমি রাজকীয় নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তোমার হবে। চলে যাও।’
মাস্ক খুলে প্রকৃতি বলল, ‘যাব কেন, আমিও করোনাক্রান্ত।’
অভীক নির্বোধের মতো তাকায়।
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
‘তবে তুমি বেরিয়েছো কেন? মানুষকে আক্রান্ত করতে? আমাকে আক্রান্ত করতে? তুমি তো জানতে না যে আমার করোনা হয়েছে।’
‘জানতাম। তুমি আমাকে ভিডিও কল দিয়েছিলে। তাই এলাম, ভাবলাম মরলে তুমি-আমি একসাথেই মরব। তাই এতদূর থেকে হেঁটে এলাম; লোকজনের যাতে ক্ষতি না করি সেজন্য মাস্ক লাগিয়ে এসেছি।’
‘ও আচ্ছা, তা তুমি জানলে কীভাবে দুজনেই মরব? তাও আবার একসাথে?’
‘বাঁচতেও পারি, বলা যায় না। এই উল্টো জমানায় কিছুই নিশ্চিত নয়।’ প্রকৃতি শরীর দুলিয়ে, ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল অভীক।
হাসি থামিয়ে প্রকৃতি বলল, ‘রূপা বুঝি তোমাকে ল্যাং মেরে গেল?’
‘রূপা?’
‘হ্যাঁ গো সোনা, রূপার কথাই বলছি। তা রূপার যখন এত রূপ-গুণ নামটা কেন কম দামি রাখল। একটু বেশি দাম দিয়ে সোনা রাখলেই পারত।’
‘সোনা!’
‘হ্যাঁ গো, সোনা।’
প্রকৃতি এগিয়ে এসে মেঝেতে পড়ে থাকা অভীকের দিকে ঝুঁকে পড়ে; ‘রূপার কথাই বলছি। ভাবছো জানলাম কীভাবে? লুপহোল। জগতের সবকিছুরই যেমন ফাঁকফোকর থাকে, তেমনি ফোকর গলে উঁকি দিয়েছিলাম আরকি। সে যাক গে।’
অভীক মেঝেতে উঠে বসে। ওর ভঙ্গি দেখে ফের হাসল প্রকৃতি। বলল, ‘মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ভূমিষ্ঠ শিশু।’
‘হোয়াট দ্যা ফাক।’
প্রকৃতি হাসল নি:শব্দে, তারপর এগিয়ে গিয়ে বিছানায় ছেড়ে দিল নিজেকে। সেদিকে ঘোলাটে চোখে তাকায় অভীক।
সকালে অভীকই আগে চোখ মেলল। হাত বাড়িয়ে সে ৯১১-এ কল করল।
***
‘হাতি কাদায় পড়লে চামচিকেও… মারে।’ চিন এমন কথাই বলছে। হাতি কাদায় পড়লে…। চিনের এমন করুণ আর্তি শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙে অভীকের। কথাগুলো মৌমাছির গুঞ্জন ও পাখার ভনভন শব্দের মতো। কানের কাছে সুড়সুড়ি লাগায় অভীক হাসছিল।
প্রতিবেশী দুয়েকটি রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন হামলায় চিনের নাভিশ্বাস। এমন একটি স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে সে। একজন বিকটদর্শন নার্স এগিয়ে আসে। তার আগাপাশতলা আগাগোড়া নানা কাপড় ও প্লাস্টিকে মোড়া।
অভীক এদিক-ওদিক তাকায়। নার্স রোবটের মতো ঠনঠন স্বরে বলল, ‘কী খুঁজছো?’
‘প্রকৃতি? প্রকৃতি কোথায়?’
‘কে?’
‘আমার সাথে আমার বান্ধবী ছিল।’
‘খুব দু:খিত। সে বেঁচে নেই।’
‘কী বলছো?’
‘হ্যাঁ, দু:খিত; সে বেঁচে নেই। গতকাল সে ইহলোক ত্যাগ করেছে।’ নার্স বুকে ক্রসচিহ্ন এঁকে বলল, ‘Our God is in the heavens, doing as He chooses.।’
অভীক শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে হলো প্রকৃতি যেন ওর চোখের সামনে দিয়ে আলোর গতিতে ছুটে গেল ব্ল্যাকহোলের দিকে।
‘আমি বেঁচে আছি কেন?’
‘মৃত্যুশোক আর কাতরানি দেখার জন্য। তুমি দেখেছো, আমি দেখছি।’ কৃষ্ণাঙ্গ নার্স বলল। অভীক উপলব্ধি করে তার মস্তিষ্কের কোষগুলি যেন প্রথমবারের মতো সজ্ঞানে ধীরস্থিরতার সাথে কাজ করছে। তার কানে বাজে প্রকৃতির হাসি। সে যেন নতুন করে প্রকৃতির ব্যথা আর কষ্ট অনুধাবন করে।
তার দুই চোখে অশ্রু গড়ায়। দুই হাত তুলে সে প্রার্থনা করল প্রকৃতির জন্য, যে পরোক্ষভাবে একদিন তার জীবনে এসেছিল।
***
হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে কাটায় অভীক। দিন কয়েক হলো সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। একটাই কাজ তার, দিনরাত শুয়ে ঘুমিয়ে কাটানো। ফুডব্যাংক থেকে খাবার আসে। তার একমাত্র কাজ হলো শুয়ে বা ঘুমিয়ে কাটানো। মাঝেমধ্যে হাসিব ফোন করে। কিংবা বাংলাদেশে ফোন করে ছোটো দুই ভাই-বোনের খোঁজ নেয়।
এই কোভিডে তার পুরোনো অভ্যাস ফিরে আসে। বই পড়া। ক্লোজেটে যে কটি বই ছিল, তার সব পড়া হয়ে গেল। এখন সে শুয়ে রিমোট হাতে বিশ্বের খবরাখবর দেখে টিভিতে। খবর দেখতে দেখতে তার কাশি ওঠে। বিছানা থেকে ইনহেলারটা নেয়।
অভীক টিভি বন্ধ করে দেশের কথা ভাবে। ওর দুই ভাইবোন আছে। বাবা পরপারে পাড়ি দেয়ার পর সংসারের ভার পড়ে তার ওপর। সে ততদিনে ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছে। চাকরির সন্ধানে ছিল। অবশেষে অভাবের তাড়নায় সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সংসার ও দুই ভাইবোনের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগল। মিতা ডাক্তার হলো। আর সৌমিক সরকারি চাকরি পেল। ততদিনে চুলে পাক ধরেছিল অভীকের।
মা অভীকের জন্য পাত্রী দেখছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে, এবং তিনি অভীকের পাত্রী দেখা স্থগিত করে অগস্ত্যযাত্রা করলেন।
অভীক ইমিগ্রেশন ক্যাটেগরিতে ক্যানেডায় আবেদন করেছিল মাস্টার্স শেষ করেই। কিন্তু তার ভিসা বাতিল হয়ে যায়। সে ফের আবেদন করে, যখন তার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, আর দুই ভাইবোন প্রতিষ্ঠিত, তখন তার কাগজপত্র আসে। পি-আর প্রাপ্তির পর সে একবার বাংলাদেশে গিয়েছিল।
২০১৯ সালের মধ্য জানুয়ারিতে অভীক ক্যানেডা থেকে প্রথম বারের মতো দেশে এসে মিতার বাসায় উঠেছিল। অভীককে পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেল শুধু মিতাই নয়, তার বরও। মিতা বড় ভাইকে ছোটো ভাইয়ের মতো শাসন-আদর করতে লাগল। এটাও সে জানাল যে, তার স্বাস্থ্যের সার্বিক অবনতি হয়েছে, ঠান্ডার দেশে ফিরে গিয়ে কাজ নেই। বরং এখানেই থাকুক সে। রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বোন-জামাই শাহ নেয়ামত তাকে চাকরি জুগিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। অভীক বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
সৌমিক মিতার বাসায় এসে দেখে গেল ভাইকে। সে নাক উঁচু বউকে বিয়ে করে বিপাকে আছে।
মিতা বলল, ‘এবার বিয়ে করো। এই দেশেই ঘরসংসার পাতো।’
‘আর বিয়ে, বয়স হয়ে গেছে। তাছাড়া সেই দেশে এখনও থিতু হতে পারিনি। কাগজপত্রের ঝামেলা আছে। পার্টটাইম চাকরি করি। তবে পাসপোর্ট হয়ে গেলে ভালো থাকব। আর আমি সেখানে বিনে পয়সার স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছি। আমার যাযাবর জীবন, আজ এখানে তো কাল ওখানে।’
‘তোমার পঞ্চাশও হয়নি; আর তুমি বলছো বয়স হয়েছে। আসলে আমাদেরকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবনটা বিকিয়ে দিলে তুমি।’
মাথা নাড়ে অভীক, করুণ চোখে তাকায় মিতা। একজনের কান্না, অন্যজনের দৃঢ় চোয়াল ও ভগ্ন জীবন-যৌবনের স্থির দৃষ্টির আড়ালে পৃথিবীর একপ্রান্তে জন্ম নিল ড্রাকুলার অশুভ মন্তরের অধীন লক্ষ কোটি ভ্যাম্পায়ার।
অভীকের ভাবনার মধ্যেই হুড়মুড় করে ঢুকে এসে পড়ে রাসেল। তার হাতে কাগজে পেঁচানো উইড। সে বলল, ‘শুনেছেন, মার্কহামের রাস্তায় একটা ভালুক এসেছে।’
‘শুধু একটা ভালুক!’ অভীক খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল, এরপর টরোন্টোর রাস্তাঘাট দখলে নিয়ে নেবে চিনা কুংফু ফাইটার, মাসাজ পারলারের চিনা অর্ধবেশ্যারা।’
রাসেল খেউ খেউ করে হাসল। সে ছোট্ট ছুরি দিয়ে উইড কাটছিল কুচি কুচি করে। সে দুটি সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে তাতে ঠেসে কুচিগুলি ভরে অভীকের দিকে একটা স্টিক বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নিন।’
অলির চলে যাওয়ার পর রাসেল ওর বেইজমেন্টে নতুন রুমমেট। হাম্বার কলেজে পড়ে, পার্টটাইম পিজা ডেলিভারির কাজ করে আর উইড নেয়। রাসেলের পাল্লায় পড়ে অভীকেরও এই অভ্যাস হয়েছে। দুয়েকটি টান দিলেই অন্য জগতে চলে যাওয়া যায়।
রাসেল দুই তিনটি টান দিয়ে তারপর স্টিকটা নিভিয়ে বলল, ‘ডিউটিতে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’
***
অভীক বদ্ধ বেইজমেন্টের ওয়াশরুমে এসে ঘষা আয়নার দিকে তাকায়। তার মনে হলো কে যেন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বলল, ‘আমি জানি তুমি কে। একজন কাঁচাপাকা খোঁচা দাড়িওয়ালা বিগতযৌবন নপুংসক।’ নেশার প্রভাবে অভীক ঘোলাটে চোখে তাকায় আয়নার দিকে।
‘সে চেঁচিয়ে বলল, দূর হ’ নরকের পিশাচ।’
***
রাসেল চলে যাওয়ার পরপরই বন্ধু হাসিব ফোন করল, ‘আমি কান্ট্রিস্টাইলের দিকে যাচ্ছি। আপনি কি যেতে চান?’
‘হ্যাঁ, ঘরে থেকে বোর্ড হয়ে গেছি।’ অভীক জানায়।
তারা দোকান থেকে কফি নিয়ে কান্ট্রিস্টাইলের কাছে রাস্তার পাশের বেঞ্চে বসল। দোকানের ভেতরে বসে খাওয়ার মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। শুধু টেইক-আউট করা যাবে।
হাসিব বলল, ‘সব আজব ঘটনা ঘটছে। আজকের রোদমাখা দিনটা আমাকে কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামে অন্ধকারাচ্ছন্ন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম পাখি ছানার খোঁজে। গরম চারদিকে, জঙ্গলের ভেতরটা ভ্যাপসা। পাখি আর শেয়ালের ডাক ভেসে আসত।’
‘হুম। টরোন্টোর সামারে মনে হয় নিজ বাসভূমে আছি।’ অভীক বলল, ‘চলুন ওই দিকে বসি।’
তারা কফি নিয়ে বেঞ্চ ছেড়ে একটা পিকআপ ভ্যানের পেছনে লাগানো নিচু চাকার কার্টে বসল।
‘কিন্তু কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছি।’ হাসিব নাল কুঁচকে বলল।
‘গন্ধ?’
‘হ্যাঁ, গন্ধ। মনে হচ্ছে ওই জায়গাটায়’, হাসিব অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে একবার তার পেছনে তাকাল, একবার কান্ট্রিস্টাইলের ইমারতের পেছন দিকটা দেখাল। ‘কেমন থমকে আছে।’
‘তা থাকুক না’, অভীক কার্টে জুত করে বসতে বসতে বলল, ‘গন্ধেরও তো অধিকার আছে থাকার। সে তো কিছু চোরছ্যাঁচড় না যে পালিয়ে যাবে। কোথাও না কোথাও থাকতে হবে। ওই কোনাটা হয়তো তার পছন্দ হয়েছে, তাই আছে।’
অভীকের কথায় সামান্য চিন্তিত দেখাল হাসিবকে। অভীক বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল। পকেট থেকে ইনহেলার বের করে পাফ নিল। হাসিব আড়চোখে একবার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে তারপর স্থায়ীভাবে নীলাকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
‘ভাইরাস অদৃশ্য, সারা মহাকাশ জুড়েও দেখতে পাবেন না।’ অভীক ফোড়ন কাটল।
‘মনটা ক’দিন ধরে ভারী হয়ে আছে।’ হাসিব একটু সরে বসে কফিতে চুমুক দেয়।
‘কেন?’
‘না, ভাবছি, পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন? নির্লজ্জ কেন মানবজাতি, কেন এত ধ্বংসাত্মক? কেন এত লোভ সংঘাত দ্বেষ জিঘাংসা?’
‘করোনার জিহ্বা কত লম্বা আমার জানা নেই হাসিব, এটা কি একশ’ বছর আগের স্প্যানিস ফ্লু-কে ছাড়িয়ে যাবে?’
‘কেউ জানে না, তবে আমি ভাইরাসের কথা বলছি না। বলছি, মানবতার দলন-মন্থনের কথা। ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেখে আমার কিছুই ভালো লাগছে না ভাই।’
‘হুম। কী দেখলেন ফেসবুকে?’
‘আত্মার ক্ষয়। যুদ্ধের যে একটা মানবেতর দিক আছে, মানবতা লুটিয়ে পড়ে নরকের দ্বারপ্রান্তে, আগে কখনও ভাবিনি এমনভাবে।’
‘হুম।’ গম্ভীর ভঙ্গিতে সায় দেয় অভীক। ‘ভাই ছবিটা আমিও দেখেছি; আমার মন খারাপ সেই একই কারণে। ১৯৪৫এ নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হবার পর তোলা একটা দশ বছরের ছেলের ছবি। ছবিটা তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার জো ও’ডনেল।’
হাসিব বলল, ‘ছেলেটার পিঠে ঝোলানো ছিল মিষ্টি ছোট্ট ভাইটি। জাপানে ছোটোদের এভাবেই কাঁধে নেয়া হতো। ঝোলানো বাচ্চাটার ঘাড় অস্বাভাবিকভাবে হেলে পড়েছিল…।’
‘সে ছিল মৃত, যুদ্ধে মারা গিয়েছিল।’ অভীক বলল। তারপর সে কেশে উঠল। ইনহেলার নিল আবার।
হাসিব কার্ট থেকে উঠে দাঁড়ায় নি:শব্দে, আড়চোখে তাকায় অভীকের হাতের ইনহেলারের দিকে।
‘যাচ্ছেন?’ অভীক বলল।
হাসিব ঘাড় নেড়ে সায় দেয় নি:শব্দে। সে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। অভীক তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে হাসিব তাকে এড়িয়ে চলে গেল।
হাসিব অনিশ্চিত ভঙ্গিতে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে ডস রোডের বাঁকে হারিয়ে গেল। অভীক আহত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আনমনে হাসল আর বলল: করোনার শ্বাসকষ্ট ইনহেলারে সারে না।
অভীক বসে রইল। বিচ্ছিন্ন ভাবনা খেলে যায় মস্তিষ্কের কোষে কোষে:
বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব কায়দায় মোকাবেলা করে চলে কোভিড-১৯ বিপর্যয়। ভয়াবহ মহামারীর মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ফেটে পড়ে বিক্ষোভে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে। একটা ঢ্যাঙা সাদা পুলিস একজনের গলায় হাঁটু গেঁড়ে বসে তার প্রাণ কেড়ে নিল।
হঠাৎ সে ক্লান্ত বোধ করে। ডেরায় ফেরার তাগাদা অনুভব করে।
সে বিছানায় শুয়ে দূর অতীতের একটা দৃশ্য দেখতে থাকে:
‘বেঙ্গল স্টুডিয়ো, রোজ গার্ডেন। হ্যাঁ, সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম গেটের কাছে। তুমি এলে, মনে হলো আমার সামনে স্বর্গের কোনো অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে। তুমি বললে… মানে তুমি বললে… কী যেন বললে, দেখো মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়… তুমি…।’
অভীক এগিয়ে যেতে চায় প্রকৃতির দিকে।
***
জ্ঞান ফিরে প্রকৃতি নার্ভাস ভঙ্গিতে জানতে চাইল তার বন্ধু অভীক কোথায়, কেমন আছে?
নার্স একগাল হেসে বলল, অভীক তো সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে।
সে আমায় দেখতে এলো না কেন?
তোমার ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন ছিল। আর কোভিড পেশেন্টদের দেখতে আসাটা আমরা অ্যালাও করি না। হয়তো তোমার বন্ধু দূর থেকে তোমাকে দেখে গেছে।
প্রকৃতি একগাল হাসল, তাই হবে।
বাসায় ফিরে প্রকৃতির পূর্ণ রেস্টে থাকার কথা। কিন্তু ভেতরটা তার ছটফট করছিল। পরের কয়েক দিন সে অভীকের মোবাইলে ফোন করেই চলল। ফোন বন্ধ। আইসোলেশন ও সাবধানতা উপেক্ষা করে প্রকৃতি ছুটে এলো অভীকের বেইজমেন্টে। সেটা তালা দেয়া। রাসেলের নাম্বার তার জানা নেই।
অনিশ্চয়তা, ভয় আর উদ্বেগের মধ্যে কাটল আরও দুটি দিন। তার পর দিন সে একটা ফোন পেল মাইকেল গ্যারন হসপিটাল থেকে। এক পেশেন্ট, তার নাম অভীক। তারা জিজ্ঞেস করল অভীককে প্রকৃতি চেনে কি না।
আমি এখুনি আসছি। বলে প্রকৃতি ছুটে এলো হাসপাতালে। অভীককে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। নার্স অভীকের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, তোমাকে দেখতে একজন এসেছে।
অভীক তাকাল প্রকৃতির দিকে। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘ও প্রকৃতি নয়। প্রকৃতি, আমার বউ, আমার ভালোবাসা, আমার হারানো ধন তো আলোর বেগে ছুটে গেছে ব্ল্যাকহোলের দিকে।’
‘এই দেখো না সোনা, আমি প্রকৃতি। সত্যিই তোমার প্রকৃতি।’
‘তুমি-আমি কিছুদিন আগে কোভিড বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার শ্বাসকষ্ট ছিল। সেদিনই রিপোর্টে আসে আমার কোভিড নেগেটিভ। আমি একজন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম আমার বান্ধবী প্রকৃতি কেমন আছে। নার্স বুকে ক্রস চিহ্ন এঁকে বলেছিল, শী হ্যাজ কিক্ড দ্যা বাকেট।’
ডাক্তার নার্স আর প্রকৃতি মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ডাক্তার বললেন, ‘কত তারিখ ছিল সেটা। সময়টা কখন ছিল। কোন নার্স ডিউটিতে ছিল?’
নার্স বলল, ‘আমি বোধহয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। সেদিন সোফি মানে দ্যাট গায়ানিজ নার্স ছিল। প্রকৃতি নামটা উচ্চারণ করা বা বোঝা খুব কঠিন। সেদিন আরেকটি মেয়ে মারা গিয়েছিল। সোফি বোধহয় তার কথাই বলেছিল মিস্টার অভীককে।’
মৃদু হাসি খেলে গেল অভীকের ঠোঁটে। সে তার দুর্বল হাতটা বাড়িয়ে দিল প্রকৃতির দিকে। প্রকৃতি ঝুঁকে পড়ে পরম মমতায় অভীকের হাতটা ধরে থাকল।
ডাক্তার বললেন, ‘তুমি এবার ওর হাতটা ছেড়ে দাও। অনেকদিন সে তোমার নাম বলেছে। আমরা তোমাকে ট্রেস করতে পারিনি। যখন পারলাম তখন…।’
ডাক্তার নার্সকে ইশারা করলেন।
নার্স প্রকৃতিকে ওয়েটিং রুমে নিয়ে এসে বলল, ‘মি. অভীকের কোভিড হয়নি। অ্যাজমা ছিল আর হার্ট খুব দুর্বল ছিল।’
‘ও ভালো হবে তো?’ কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল প্রকৃতি।
‘মি. অভীক আমাকে একদিন বলেছিলেন তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কান্ট্রিস্টাইল থেকে কফি নিয়ে বাইরে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করছিলেন। মি. অভীকের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি ইনহেলার নিচ্ছিলেন। এই অবস্থা দেখে বন্ধুটি তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।’
‘কোন বন্ধু? কী নাম?’
‘মি. অভীক তার নাম বলেননি।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রকৃতি। থমথমে মুখে বলল, ‘ওকে কবে বাসায় নিয়ে যেতে পারব?’
নার্স টলটলে চোখে বলল, ‘আর কোনো দিনও না। তুমি টের পাওনি? ওর হাতটা আছড়ে পড়েছিল বেডে। তিনি আর নেই। তুমি নিজেকে শক্ত করো। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’
নার্স রুম ত্যাগ করে অন্যদিকে চলে গেল।
টরোন্টো নামের ব্যস্ত, বিলাসী ও সৌন্দর্যমণ্ডিত শহরে আজও বিচরণ করছে প্রকৃতি। দুই ছেলের দেখাশোনা করছে, সোশ্যাল অ্যাসিস্টেন্স থেকে টাকা পায়, সাংসারিক কাজ করছে। কিন্তু আগের মতো উচ্ছ্বল আর গতিসম্পন্ন নয়।
ঘড়ির ঘন্টার কাঁটার মতো ধীর হয়ে গেছে সে।