• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || সেই সেই মানুষের ঘ্রাণ,...এবং সত্য ও সত্ত্বা! ||


    Raghu Rai: People, his finest portraits; Aleph Book Company, Daryaganj, New Delhi-2; First published 2016; ISBN: 978-93-83064-13-7

    কিছু বই বই নয়। জমাট বাঁধা সঙ্গীত। সে বই হাতে করা পুণ্যের কাজ, নিখাদ আনন্দের।

    কবি যেমন ‘এক বিন্দু নয়নের জল’-কে ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ দেখেছিলেন—সে তখন আর কঠিন শ্বেতপ্রস্তরের তাজমহল নেই, ঠাঁই পেয়ে গেছে সে কালের গালে! টলটল করছে ঐ জলে ভরা আঁখি! প্রস্তর কীভাবে কালোত্তীর্ণ হয়!

    এই বইয়ে যেমন সাদাকালো চিত্ররাজি হয়েছে।

    এ’বইতে কিন্তু রাজাবাদশাহরাই যে কেবল আছেন তা তো নয়, যদিও ইন্দিরা-মোরারজী-বাল ঠাকরে-দলাই লামা থেকে টাটা-বিড়লা কে নেই এখানে? তবু তাঁরাই সব নন, কারণ ঐ যে সর্বহারা নারীর শূন্য দৃষ্টি যা বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক-ছবি হয়ে আছে আজও, বা ভোপাল গ্যাস দুর্যোগের শিকার বালকত্রয় বা রাজস্থানী ঘাগরা ওড়ানো গ্রাম্যসুন্দরীরা...এঁরা সবাই একই লেন্সে আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এবং ভারতীয় সাদাকালো ফোটগ্রাফির নবদিগন্ত স্থাপন করেছেন। সেই আলোকচিত্রীর নাম কে না জানে? কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন সেই জীবন্ত কিংবদন্তী!

    রঘু রাই!

    ***

    ১৯৪২-এ’ অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের এক গণ্ডগ্রামে যখন তিনি পৃথিবীর আলো দেখলেন গান্ধীজী ততদিনে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলেটি দিল্লী-স্টেটসম্যান পত্রিকার ফোটগ্রাফার হিসেবে যোগ দিলেন তেইশ বছর বয়স পূর্ণ হবার আগেই। সুনীল জানা/হোমি ব্যারাওয়ালারা তখন ভারতীয় ফটো-জার্নালিজমের ক্ষেত্র আলো করে আছেন। এর বছর ছয়েকের মধ্যেই প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফিক সংস্থা থেকে ডাক পাবেন রঘু, — রঘু রাই চৌধুরী কেবলমাত্র ‘রঘু রাই’ নামেই বিখ্যাত হয়ে আছেন যিনি, ক্যামেরা হাতে যিনি ছবি তুলতেন না, বেহালার ছড় টানতেন। স্টেটসম্যান থেকে কলকাতার ‘সানডে’ পত্রিকা হয়ে উনি যখন দিল্লির ‘ইণ্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় যোগ দিলেন মধ্যকলিকাতার এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র অপার বিস্ময়ে সাদাকালো ছবিগুলি গোগ্রাসে গিলতো তাঁর, আজ তার অনেকগুলো এই বইয়ে দেখতে পেয়ে একই সাথে নস্টালজিয়া ও শিহরণ জেগে উঠছে।

    ***

    সাজানো-গোজানো ‘স্টেজড্‌’ ফটোগ্রাফিকে চিরকাল অপছন্দ করে এসেছেন এই প্রবাদপ্রতিম আলোকচিত্রী। যদিও এই কেতাবের নব্বুই ভাগ-ই সেলিব্রিটিদের ফটোয় ভর্তি, যাঁরা বড়ই ছবি-সচেতন। তবু তারই মধ্যে কী করে সত্যজিৎ রায় বা অপর্ণা সেন বা দলাই লামার ঐ ঐ সব অনবদ্য ছবিগুলি তুলেছিলেন রাই-সাহেব— এক এক লাইনে সেই সব গল্প এখানে পড়তে পাওয়া বিশেষ প্রাপ্তি; আর ছবিগুলি দেখতে পাওয়া তো অলীক অনুভূতি। ভাষায় ব্যক্ত করি সে কলম পাবো কোথায়? চিত্র-ব্যাকরণেও দড় নই। তবু মুগ্ধতার পায়ে বেড়ি কে পরাতে পারে? তাতে তো কোনো লাগাম নেই।

    প্রায় দুই শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে এই যে বিভিন্ন মানুষের ছবি তার একেকটির দিকে তাকিয়ে থাকলে তাদের পিছনের গল্পগুলি যেন মূর্ত হয়ে ওঠে—কত কত সব না-বলা গল্প বেরিয়ে আসে।

    অন্ততঃ চারটি ঘন্টা সময় নিয়েছি এ’ বইয়ের শ্রেষ্ঠ দুইটি ফটো বাছতে; ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে এসেছি ছবিগুলির কাছে। শেষে যে দুটিকে শ্রেষ্ঠ না মেনে উপায় নেই সেই বিসমিল্লাহ্‌ খান ও ইন্দিরা গান্ধীর ছবি দুইটিকে দুই প্রচ্ছদে পেয়ে মন প্রশান্ত হয়েছে, যেমন ঐ দেখুন খান সাহেবের ছবিটি। বিলায়েৎ খান সাহেবের সঙ্গে বিসমিল্লাহের যুগলবন্দীর ছবি এটি, সমাহিত-নিমগ্ন মুখচ্ছবি কাকে বলে এটিকে দেখে শিখতে হয়।

    বা, ইন্দিরা গান্ধীর ঐ ছবিটি (পৃ. ১২৪-১২৫এ’ দুইটি পাশাপাশি)। জরুরি অবস্থাকালীন কালো দিনের প্রতীক হয়ে পোডিয়ামের ঐ কৃষ্ণবর্ণ ব্লক যেন গিলে খেতে আসছে শুভ্রবর্ণা ভারতনেত্রীকে! ডিজিটাল ফোটগ্রাফি ও ওয়াইড-এনগেল লেন্সের টেকনলজিসর্বস্বতাকে চিরকাল অপছন্দ করে এসেছেন রঘু-জী। তেমন লেন্স ব্যবহার করলে কি এই ছবিটা আমরা কখনও দেখতে পেতাম?

    ধীমান দাশগুপ্ত চলচ্চিত্রে ‘ফ্রেম’-এর ব্যবহার সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘কম্পোজিশন শুধু বিভিন্ন অনুপুঙ্খ ও উপাদানের বন্টন নয়, সেগুলির এমন এক সন্নিধি যার মধ্যে দর্শকের চোখ ছবির ফ্রেমের উপর দিয়ে কীভাবে চালিত হবে সেই গতিপথেরও ইঙ্গিত দেয়।’

    না, এ’বিষয়ে স্টিল ও মুভি ফোটোগ্রাফির বিভেদ নেই। রঘু রাই সাহেবের এই কেতাবের অনবদ্য ছবিগুলি দেখতে দেখতে সেই বোধটিই জেগে ওঠে।

    রঘু রাই বলেন, একটা পোর্টেট তুলতে আমি তার ঘ্রাণ তার পরিমণ্ডলকে তুলে আনতে চাই যাতে তার থেকে সত্যটা বেরিয়ে আসে, বেরিয়ে আসে সাবজেক্ট-মানুষটির সত্ত্বা!

    বড় গভীর বোধ থেকে বলা এ’কথা।

    মহাত্মন্‌ দলাই লামার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে ওঁর এই কথার মর্ম অনুধাবন করা যায়-যাঁর মধ্যে রঘু খুঁজে পেয়েছিলেন গুরু নানকদেবকে।

    বুকের বড় কাছে এ’বইয়ের স্থান গো!

    দু’দিন এ’বই হাতে করো, বন্ধু—-যেদিন বৃষ্টি হবে সেদিন; আর যেদিন হবে না!!

    || ভ্রমি বিস্ময়ে, হ্যাঁ, ভ্রমি বিস্ময়ে! ||


    ভ্রমি বিস্ময়ে—অমিতাভ ঘোষ; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০১; ISBN: 81-7756-138-3

    প্রখ্যাত বঙ্গসন্তান শ্রী অমিতাভ ঘোষ মহাশয় বাংলাভাষায় লেখেন না।

    নিঃসন্দেহ, ওঁর চাইতে বিখ্যাত ও দামি জীবিত বাঙালি লেখক আজ আর কেহ নাই এ’পার তথা ও’পার বাংলায়, আর উনি তো এ’দুপার ছেড়ে সে’পারের স্থায়ী বাসিন্দা— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন আজ বহু বছর।

    বর্তমান সংকলনটি ওঁর ‘গ্লাস প্যালেস’ বা, ‘সী অব্‌ পপীজ’-এর মতো অতুলনীয় ওয়ার্ক অব্‌ ফিকশন কিছু নয়, চার-পাঁচটি রিপোর্টাজধর্মী লিখনের বঙ্গানুবাদ, তবু এই এই ‘অমূল্য রচনা’ প্রকাশ করতে পেরে ‘আনন্দ’-হেন প্রকাশক যার-পর-নাই ‘গর্বিত’ হয়েছেন বলে মুখবন্ধে জানিয়েছেন।

    সেটা দেখেই মহোৎসাহে এ’পুস্তকের ক্রয় ও সুখপাঠ।

    ***

    বাবর বাদশাহ্‌ থেকে আজকের বর্মার অবিসংবাদিত নেত্রী সু-চি, নেতাজীর আজাদ হিন্দ্‌ থেকে পোখরানের পরমাণু-বিস্ফোরণ—এমন এমন ‘চক এন্ড চীজ’-ধর্মী পাঁচ-ছয়টি দীর্ঘ দীর্ঘ নিবন্ধের সমাহার ঘটেছে এখানে, যার শ্রেষ্ঠ অবশ্যই শেষেরটি যেখানে আনন্দবাজারের সাংবাদিক শ্রীশুভরঞ্জন দাশগুপ্ত মহাশয়কে অমিতাভ নিজের লেখালেখির বিষয়ে বলেছেন, যদিও সেখানে লেখালেখির চাইতে ওঁর বিশাল রেঞ্জের পড়াশুনো নিয়েই কথা বেশি উঠেছে। ভাগ্যিস উনি গোবিন্দদাস দেশানীর মতো অতুলনীয় ঔপন্যাসিকের উল্লেখ করলেন, তাই বাবার আলমারি থেকে ধুলো ঝেড়ে মিঃ হ্যাটার-সাহেবকে বের করলাম আজ। পড়ব। নাইজেরীয় ঔপন্যাসিক আমোস টুটুওলা বা পেরুর মারিও বার্গাস ইয়োসা-র মতো ঔপন্যাসিকের কথাও এসেছে, যাঁদের নামটাই মাত্র শুনেছি। পড়িনি। কত কী-ই তো পড়িনি জীবনে। অমিতাভ ঘোষ পড়লে হীনমন্যতা জাগে।

    সংকলনের এই এই নিবন্ধগুলি ১৯৯৪ সাল থেকে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অমিতাভের ইং-নিবন্ধগুলির বঙ্গানুবাদের সমারোহ। অনুবাদকদের নাম কোথাও দেওয়া নেই। তাঁরা গৌণ, নাম ‘অমিতাভ’-টাই আসল, কারণ তিনিই বিকোন। যদিও নেতাজীর আজাদ হিন্দ্‌ বলুন বা পোখরানের বম্ব বিস্ফোরণ—কোথাও নূতন কিছু পেলাম না যাতে প্রকাশকের গর্বের সহমর্মী হতে পারি। যেমন, পরীক্ষামূলকভাবে পরমাণু বম্ব ফাটালে সে অঞ্চলের লোকজনের উপরে শারীরিক কু-প্রভাব পড়বে, বা প্রথম IAS-টপার কৃষ্ণস্বামী সুব্রমণ্যমের মতো ডিফেন্স স্ট্রাটেজিস্ট ‘ডিটারেন্ট’ হিসেবে বম্ব-টির জয়গান গাইবেন—এ’সব তো নতুন কথা নয় কিছু। আর অমিতাভের মতো তাবড় লেখকের সুবিধা হলো তিনি রক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ থেকে বর্মার সু-চি—এমন এমন সেলিব্রিটির সঙ্গে সরাসরি কথা বলে নিয়ে তবে লিখতে পারেন। এ’ সুযোগ এতাবৎ আর ক’জন বাঙালী লেখক পেয়েছেন, বলুন তো (জ্ঞানপীঠ তো অনেকেই পেয়েছেন)?

    ‘ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের অকথিত কাহিনী’ নামক দীর্ঘতম অধ্যায়টিতে নেতাজী, আজাদ হিন্দ্‌ থেকে তাঁর ফৌজী পিতৃদেবের অদম্য প্রতিবাদের কথা শুনিয়েছেন অমিতাভ, কিন্তু পড়ে মন ভরলো না কারণ থোড় বা বড়ি বা খাড়া খেয়ে কি জিভ ভরে? তার চাইতে বাল্যকালে কলকাতায় ওঁর মাতুলালয়ের গ্রীষ্মাবকাশের কথা, মামার লাইব্রেরিতে ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়ার কথা, বা বঙ্কিমের প্রথম ইং-রচনা ‘রাজমোহন্স ওয়াইফ’-এর তুল্যমূল্য বিচার অনেক চিত্তাকর্ষক পাঠ। পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।

    অমিতাভ কিন্তু ঢাকায় জন্মাননি। ক্যালকাটা-বর্ন, সন ১৯৫৬-এ’। এ’বইয়ের ব্লার্বে ভুল লিখেছে।

    উপরন্তু, গ্রন্থের পৃষ্ঠপ্রচ্ছদে লেখকের পূর্ণমুখায়ব তৈলচিত্রও তো আনন্দের আর কোনো বইয়ে দেখিনি।

    এই ছয়টি নিবন্ধপাঠে নামী প্রকাশক মহাবিশ্বে মহাকাশে বিস্ময়ে ভ্রমণ করেছেন। আমরা আর তেমন করতে পারলুম কৈ?

    ইঙ্গভাষার বাঙালী সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ মশাই, তাই, এক ক্ষণজন্মা পুরুষ । হ্যাঁ, মশাই, ক্ষণজন্মা।

    || মেরা লাল দুপাট্টা মলমল কা... ||


    কলকাতার সিনেমা হল—-পটভূমি ও ইতিবৃত্তান্ত—সুজয় ঘোষ; অরণ্যমন প্রকাশনী, কলিকাতা ১২; ISBN: 978-81-945862-5-8

    অশোককুমার অভিনীত হিন্দি ‘কিসমত’ (১৯৪৩) ছবিটি সেকালে কলকাতার রক্সি সিনেমা-হলে লাগাতার সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে এক রেকর্ড করেছিল যা পঞ্চাশ বছর ধরে অক্ষত ছিল (শাহরুকের ‘দিলওয়ালে...’ (১৯৯৫) আসবার আগে পর্যন্ত)। যদিও অনেকে বলেন, ‘কিসমত’-এর এই রেকর্ডের পেছনে আরেকটা মজার ঘটনাও ছিল। সেটা বলিঃ

    সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ মিলিটারি থেকে হল-টি নিয়ে নিতে চেয়েছিল তাদের ফৌজকে রাখবার জন্য। কিন্তু ‘রক্সি’-র মালিক চুক্তিপত্র দেখালেন যে যতদিন ‘কিসমত’ ছবিটা চলবে ততদিন হলের অন্য কোন ব্যবহার করা যাবে না, ছবিটা উঠে গেলে তারপর অবশ্য করা যাবে।

    সাড়ে তিন বছর ধরে ছবিটা চলেছিল, আর রক্সির মালিক রমেশ কাপুরও হল-টা ফৌজের হাতে দিয়ে দেওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। হেঁ হেঁ হেঁ!

    না, এই গল্পটা যদিও আলোচ্য বইটাতে নেই কিন্ত যা বা যা যা আছে তা-ই বা কম কী

    ১৯৩০-এর দশক থেকে শহর কলকেতার অধিবাসী নতুন আসা বিনোদন মাধ্যম ‘সিনেমা’-কে তার দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করে ফেলল। না, সিনেমা মাধ্যমটির ‘পাওয়ার অব্‌ পেনিট্রেশন’ এতই গভীর ছিল যে তা যে কেবল উচ্চবিত্তশ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল তা নয়। (সম্ভবত) বড়ে গোলাম আলি সাহেব বলেছিলেন পঙ্কজকুমারকে, ‘কী গান-ই যে বেঁধেছেন মল্লিক সাহেব, রেঙ্গুন থেকে পেশওয়ারের বিড়িওয়ালা গুনগুন করছে আপনার গানা .... ‘পিয়া মিলন কো জানা’... ! এ’ ১৯৩৯ সালের কথা!

    রবীন্দ্রনাথের নাম দেওয়া সিনেমালয় ‘মিত্রা’, বা অবনীন্দ্রনাথের দেওয়া ‘ছায়া’ এইভাবে বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে পড়ে, যা নিয়ে বর্তমান মূল্যবান কাজটি করেছেন শ্রীমান সুজয় ঘোষ। না, ইনি জনপ্রিয় বিদ্যা বালান-স্টারার ‘কাহানী’-র পরিচালক সুজয় নন, গবেষক সুজয় ঘোষ। অসাধারণ কাজ করেছেন এ’টি।

    ***

    সওয়া শ’ পৃষ্ঠার বইটির চতুর্দশ অধ্যায়ব্যাপী সূচিপত্রটিতে চোখ বোলালেই বইটির ব্যাপ্তি ও গভীরতা বোঝা যাবে। কলকাতার গুচ্ছ গুচ্ছ সিনেমা হল, তার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট, তাদের সম্বন্ধে ছোট ছোট ছুট্‌কহানী (anecdote) থেকে তাদের প্রযুক্তি ও অর্থনীতি—কোন্‌ দিকটা বাদ পড়েছে আলোচনায়? সুদীর্ঘকালব্যাপী গবেষণায় নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে এ’ মহৎ তথ্যভাণ্ডার। এ-কাজের জন্যে লেখকের পঠিত গ্রন্থ-/পত্রিকাপঞ্জির তালিকা কত দীর্ঘ? মুখবন্ধে লেখেননি প্রকাশক বা লেখক। আমাদের জানবার ইচ্ছে রয়ে গেল। কারণ ‘সহায়ক গ্রন্থাবলীর’ লিস্টিতে যে যে কেতাবের নামোল্লেখ আছে তাদের বেশ কিছু পড়া থাকলেও অত অত পত্রিকাবলী পড়া নেই, না অত লাইব্রেরি-ওয়ার্ক করা আছে। হ্যাটস অফ্‌, সুজয়বাবু!

    ***

    যেমন, শুনুন, সপ্তম অধ্যায়টির কথাঃ ‘সিনেমার একশত নাম’ঃ সিনেমাকে যে বায়োস্কোপ ছাড়াও ‘অডিটোন’, ‘কোভেক্স’, ‘মুভিটক’ বা, ‘সোনোটোন’ নামেও ডাকা হতে পারে, সেটা জানতেন কি? আমি তো জানতাম না। সিনেমার এমন শতনাম লিপিবদ্ধ হয়েছে এখানে যেগুলি পড়তে পাওয়া যথেষ্ট মজার। যদিও বাঙালী যে আজও একে ‘বই’ বলতে ভালোবাসে, সেটা লেকেনি!

    একটি সত্যিই পরিশ্রমের অধ্যায় হলো অষ্টমটিঃ 'সিনেমা হলগুলির ধারাবাহিক ইতিহাস'; এটি দীর্ঘতম অধ্যায়ও বটে। উত্তর কলকাতা থেকে ধরে ধরে মধ্য হয়ে দক্ষিণ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশটি হলের প্রতিষ্ঠা, নামমাহাত্ম্য থেকে কর্মচারীদের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলা হয়েছে বর্তমান হল মালিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এই একটি অধ্যায়ের জন্যেই কেতাবটির ‘স্বর্ণকমল’ পুরস্কার পাওয়া উচিত; সর্বজনশ্রদ্ধেয় জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বা অরুণ রায় মহাশয়ের কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বর্তমান কেতাবখানি।

    ***

    বাংলা চলচ্চিত্রের উপরে রবীন্দ্র-প্রভাব নিয়ে অসাধারণ এক কাজ করেছিলেন শ্রী অরুণ রায় মহাশয়। সে বোধহয় ১৯৮০-র দশকের কথা। সুজয়বাবুর বর্তমান গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়টি পড়ে সেই রসের পুনঃপ্রাপ্তি হলো। এখানে শিশির ভাদুড়ী মশায়কে লেখা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত চিঠিটির বক্তব্য যে কত সুদূরপ্রসারী সেটা না পড়লে বোঝা যাবে না। এখানেই বলে দিয়ে রসভঙ্গ করছি না। (পৃ ৯২)

    তিনটি দশকের মধ্যে মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র যে নিজের এক ভাষা খুঁজে পেতে চলেছে, ১৯২৯এ লিখিত যুগপুরুষ রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিতে তার প্রকাশ ঘটেছেঃ

    ...ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত যা কোন বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে...

    পড়ুন, পাঠক, বইটি পড়ুন এর রসগ্রহণ করতে।

    নানান ছুটকাহানী পড়তে পাওয়া এই বইয়ের যথেষ্ট মনোলোভা দিক বৈকি, আর এখানে রয়েছে পাতায় পাতায় তার অফুরন্ত ভাণ্ডার!

    আর বেশি বলে দিয়ে রসভঙ্গ করব না। শুধু, শেষে ২১১-২১৩ পৃষ্ঠার পরিশিষ্টখানি মাথায় করে রেখে দেব পরবর্তীতে আরো-পাঠের জন্যে।

    হ্যাটস অফ!

    || আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সুর ||


    প্রাগিতিহাসঃ ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন— মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়; গাঙচিল, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২১;

    ISBN 978-93-90621-49-1



    দাস-ব্যবসা নিরসনের প্রবাদপুরুষ উইলিয়ম উইবারফোর্স! তাঁর সেজ ছেলে স্যামুয়েল (‘সোপি স্যাম’) ছিলেন ‘চার্চ অব্‌ ইংল্যান্ড’-এর বিশপ, এবং ডারউইনবাদের মস্ত বিরোধী।

    ১৮৬০-এ অক্সফোর্ডে এক মস্ত সারস্বত সভায় তিনি টমাস হাক্সলিকে সর্বসমক্ষে খোঁচালেন, ‘মহাশয় কি ঠাকুর্দার দিক থেকে বাঁদরের বংশধর, বা দিদিমার দিক থেকে?’ (কারণ, হাক্সলি সাহেব কিনা ডারউইনবাদের এ্তটাই ভক্ত ছিলেন যে লোকে তাঁকে ‘ডারউইন’স বুলডগ’ বলতো! )

    হাক্সলিকে উত্তর দিতে হলো না, পাশ থেকে ডারউইনের জিগরী দোস্ত প্রখ্যাত বটানিস্ট জোসেফ হুকার বলে উঠলেন, ‘বিশপের বংশধর হবার চেয়ে বান্দরের সন্তান হওয়া শ্রেয়!’

    হ্যাঁ, সেকালে এমনই তীব্র ছিল বিবর্তনবাদের বিতর্ক যে মহামহারথীগণ এ’হেন ব্যক্তিগত আক্রমণেও বিরত থাকতেন না।

    এ’ বিতর্কের আজও যে সম্পূর্ণ নিরসন হয়েছে তা নয়। অতি সম্প্রতি এর উপরে একটা চমৎকার বাংলা সিনেমা দেখলামঃ ‘দ্য হোলি কন্সপিরেসি’।

    প্রাগিতিহাসের উপরে অনবদ্য এই বইটি পড়তে পড়তে এ’গল্প মনে পড়ে গেল কারণ তার সঙ্গে বিবর্তনবাদের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে যে, নৈলে ‘তিনি’ ছয় দিনে সমগ্র বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করে সাবাথের রবিবারে ঝিমোচ্ছিলেন মেনে নিলে তো প্রাগিতিহাস বলে কিচ্ছু হয়ই না।

    নৈলে এ’বইটা পড়তে পেতাম কী করে?

    তাহলে যে মস্ত খামতি থেকে যেত গো, কারণ বাংলাভাষায় এই বিষয়ের উপরে এই মানের বই হয়ত আর পড়িনি, যদিও বিশ বছর আগে প্রকাশিত ‘আনন্দ’-র ‘ইতিহাস গ্রন্থমালা’-সিরিজে অধ্যা. দিলীপ চক্রবর্তী মহাশয়ের বইটিও চমৎকার ছিল। মধুশ্রীর বর্তমান কাজটি অবিশ্যি অনেক আপডেটেড ও জেনেটিক্স-বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণালবদ্ধ সুফল নিয়ে লেখা হয়েছে (যা সম্বন্ধে কিছুই জানি না)।

    ***

    জানি না বলেই তো পড়া।

    এবং সহজ মাতৃভাষায় গোলা লোককে বুঝিয়ে দিতে পারাতেই লেখিকার মুন্সিয়ানা। সেখানে উনি ব্যাপক সফল কারণ যেমন সরল ভাষা সারা কেতাবের অঙ্গ জুড়ে তেমনি পণ্ডিতি দেখানোর অনীহা—-ভালো লাগিয়ে দেয় জটিল বিষয়ের উপরে লেখা বইটিকে।

    জটিল কেন ?

    একটা উদাহরণ নিই, যেটা কিনা যতটা না বিজ্ঞানের তার চাইতে বেশি রাজনৈতিক—বিশেষত আজকের ভারতের প্রেক্ষাপটে। এই যে সত্তর হাজার বছর আগে থেকে আফ্রিকা থেকে হেঁটে হেঁটে হোম স্যাপিয়েন্সের বিশ্বভ্রমণ ও বিশ্বজয়—আজকের হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাকে মানতেই চাইবেন না। তাঁদের কাছে আর্যরাও ভারতোদ্ভূতই, এবং পাঁড় ‘হিন্দু’! যদিও এক নিবিষ্ট বিজ্ঞানীর মতোই লেখিকা সে-সব বিতর্কে না গিয়ে তন্নিষ্ঠভাবে ‘মহাপরিযান’, ‘জিনবিদ্যার কথা’, থেকে ‘হরপ্পীয় সভ্যতা’ ইত্যাদি ইত্যাদি জরুরি বিষয়ের প্রাঞ্জল আলোচনায় সমৃদ্ধ করেছেন গ্রন্থটিকে।

    অতীব সুখপাঠ।

    রাখি মস্তকোপরি!

    ***

    মুখবন্ধে প্রখ্যাত জেনেটিক্সবিজ্ঞানী ডঃ পার্থপ্রতিম মজুমদার যেটা লিখেছেন এখানে সেটা হুবহু উল্লেখের লোভ সামলাতে পারলাম না, কারণ এরই মধ্যে কেতাবখানির নির্যাস ধরা রয়েছেঃ

    লেখিকা মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং সংস্কৃতির বিবর্তন নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন । মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও ধীশক্তির বিবর্তনের ইতিহাস এখনো পর্যন্ত খুব বেশ বোঝা যায়নি। তবুও , বিভিন্ন হস্তনির্মিত বস্তু, গুহাচিত্র এবং অনুরূপ বস্তুগুলি থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন সেই প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বোধের ক্ষমতাকে, জড়বস্তুকে নিজের সুবিধামত কাজে ব্যবহার করার বুদ্ধিকে এবং জটিল ছবি আঁকার দক্ষতাকে। এ’গুলোই আসলে মানুষের ধীশক্তির বৈশিষ্ট্য।

    মানবজাতির প্রাক্‌-ইতিহাস এখানেই বিধৃত হয়ে রয়েছে।

    ***

    ভারতের পাশাপাশি বঙ্গদেশের প্রাগিতিহাস নিয়ে শেষ অধ্যায়খানি পূর্ণ নিবেদিত রেখেছেন লেখিকা—নীহাররঞ্জনের ‘বাঙালীর ইতিহাস’ মহাগ্রন্থে এই বিষয়টিকে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছিল মাত্র।

    লেখিকা আক্ষেপ করেছেন এখানে যে, ‘সাম্প্রতিককালে দেশী-বিদেশী জিনবিদগণ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের উৎস ও জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করলেও পূর্ব ভারতের মুন্ডা, হো, বিরহোর, খাসি, ত্রিপুরী, চাকমাদের নিয়ে কিছুই করেননি। ’

    তা সত্ত্বেও বিশ হাজার বছর আগেকার মুর্শিদাবাদ-অঞ্চল বা গঙ্গারিডি ও মহাস্থানগড় সম্পর্কে পাঠ যথেষ্ট সুখকর।

    ***

    সমগ্র গ্রন্থ জুড়ে অসংখ্য ছবি-চার্ট-টেবিল উপস্থাপিত হয়েছে অতি যত্নে। অতি খেটে করা কাজ। একটিও মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি। কত যত্ন মুন্সিয়ানা ও নিবেদিতপ্রাণতা থাকলে এক কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়র প্রি-হিস্ট্রির উপরে ঢাই-শ’ পৃষ্ঠার এমন এক বিশ্বমানের কেতাব লিখতে পারেন ভেবে কুর্নিশ জানাই।

    ইঙ্গভাষায় লিখলে এ’বই ব্রনিসল’ পুরস্কার পেত সন্দেহ নেই।

    দশে সাড়ে দশ পায় এই বই।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments