দেশ-বিভাজনের বেদনার আরেকটি আখ্যান আলতাফ ফাতিমা (১৯২৭-২০১৮) রচিত এই গল্পটি। পুবালি বাতাস বয়ে নিয়ে এল পুরোনো স্মৃতি। হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক আদান-প্রদান, সৌভ্রাতৃত্বের স্মৃতি। মুসলমান বোন আর হিন্দু ভাইয়ের দেশভাগজনিত চিরকালীন বিচ্ছেদের বেদনাবহ স্মৃতি।
ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, কবি মহম্মদ ইকবাল-বিশেষজ্ঞ আলতাফ ফাতিমার জন্ম লখনউয়ে। দেশভাগের সময় চলে যেতে হল লাহোরে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনো। উর্দু গদ্য সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন দস্তক না দো-র রচয়িতা আলতাফ ফাতিমা উর্দু ভাষায় বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদকও বটে। নঘ্মা কা কত্ল নাম দিয়ে উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন হার্পার লি-র বিখ্যাত উপন্যাস টু কিল এ মকিংবার্ড। বিশেষ কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ বা পন্থায় বিশ্বাসী না হয়েও তিনি ছিলেন প্রগতিবাদী। বিদ্বৎসমাজ, সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবহেলিত এই লেখিকার কোনও অনুযোগ ছিল না। তাঁর এত গল্প বলার ছিল যে খ্যাতির হয়ত তেমন কোনও প্রয়োজনও ছিল না।
মূল উর্দু গল্পটি গুলশন-এ-ইকবাল, করাচি থেকে প্রকাশিত শেহেরজ়াদে প্রকাশনার গল্প-সংগ্রহ উহ্ জিসে চাহা গয়্যা থেকে সংগ্রহ করেছি। মূল উর্দু গল্পের শিরোনাম 'কাহিঁ ইয়ে পুরবাই তো নহিঁ'।
—অনুবাদক
তিন শো পঁয়ষট্টি দিনের বিপুল ভার আবারও আমার হাত থেকে পিছলে গিয়ে অতীতের অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে গেল।
শূন্য ঘরটার জানলাগুলো উজাড় করে খোলা। ঘন সবুজ গাছের পেছনে ধূসর ঘন মেঘে লেপটে থাকা আকাশটা কী সুন্দর! সেই উন্মুক্ত বিস্তারকে যেন কেউ মধুর অথচ বিষণ্ণ সুষমায় ভরিয়ে দিয়েছে। তীব্র রোদ আর তাপদাহের পরে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
‘পুরবৈয়াঁ নয় তো?’
সামনের টেবিলে বই আর কাগজের স্তূপ অবিন্যস্ত পড়ে আছে। আমি হঠাৎ লেখা থামিয়ে কলমটা বন্ধ করে গলাবন্ধে লাগিয়ে রেখেছি। আবহাওয়া ভারি মনোরম, আঙুরের বাগানের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। এই পরিবেশে কি ডেয়ারি ফার্মিং নিয়ে বই লেখা যায়? এ পরিমণ্ডলে দুধের রাসায়নিক উপাদান, গবাদি পশুর খাবারে সর্ষের খোল আর ভুসির সঠিক অনুপাত নিয়ে আলোচনা সম্ভব? হ্যাঁ, ঠিক। আমি এখন গরু-মোষ নিয়ে একটাও শব্দ খরচ করব না।
আসলে আমি বড়ই অন্যমনস্ক। কলমটা হয়ত গলাতেই ঝুলছে, আর সর্বত্র তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। বহুবার দেখা কোনও মুখ দেখে হয়ত ভেবেই চলেছি সেটা কার মুখ! আমি তো এঁকে আগে কোথাও দেখিনি। আমার স্মৃতি এতই পলকা যে কে আমাকে দুঃখ দিয়েছে, কার ওপরে রেগে থাকব ভেবেছিলাম, তাও মনে থাকে না। আর যেদিন অত্যন্ত জরুরি কোনও কাজ করার থাকে, ঠিক সেদিনই অতি অকিঞ্চিৎকর, বোকা-বোকা কোনও কর্মসূচি তৈরি করে ফেলি। তো ভাই, আমার ঠিকটা তা হলে কী? এমনও তো হতে পারে যে আমার স্মৃতির শহরটি বিস্তীর্ণ পতিত জমি হয়ে রয়ে গেল। যা কিছু জানতাম-চিনতাম, তাদের চেনার ক্ষমতা আর রইল না। এই জন্যই তো কাগজ সরিয়ে রাখলাম। কলমটাকে আবার গলায় ঝুলিয়ে নিলাম। এই জন্যই তো চাইছি যে একটু পিছিয়ে গিয়ে চোখদুটোকে সরু করে সুদূর চরাচরের দিকে তাকাই। কে জানে অতীতের অন্তহীন পথে চলতে চলতে সময়ও একবার ঘুরে পেছনের দিকে তাকাবে না?
তাই তো! সত্যিই দেখো, চলে যাওয়া দিনগুলো পেছনে ঘুরে আবার আমায় ডাকছে। আমার চারদিকের সব কিছু সরে সরে যাচ্ছে। শূন্যতায় হারিয়ে যাওয়া চরাচরের আভাস যেন ফুটে উঠছে। হ্যাঁ, এই সেই শক্তপোক্ত ফটক যার লোহার রড ধরে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলতাম। নকল টিকিট তৈরি করে বিক্রি করা হত। গার্ড সবুজ পতাকা নাড়াত। যাত্রীরা নিচের রেলিঙে পা রেখে আর গ্রিল হাতে ধরে রেলের সওয়ারি হয়ে যেত। বাকিরা উৎসাহভরে ফটক ধরে বাইরের দিকে ঠেলত। ফটকের বাইরে রাস্তার সামনেই কামারের উনুনে আগুন জ্বলত। লাল রঙের তপ্ত লোহার টুকরোগুলো সারাদিন ধরে ঠনঠন শব্দে পেটানো হত। গেটের ভেতরে ছোট-বড় বাগান; বন-আদার ঝোপ আর গোলাপ লতায় ঢাকা গেট। কল্পনায় আমাদের রেলগাড়ি জঙ্গল আর খেতখামারের মধ্যে দিয়ে কু-ঝিক-ঝিক করে চলত। গাড়ি স্টেশনে লাগানোর সময় হলে আমরা বুড়ো আঙুলটা থুতনির নিচে রেখে আর তর্জনী নাকের ওপর দিয়ে কপাল পর্যন্ত বাড়িয়ে দুই আঙুলের ফাঁক দিয়ে প্রাণপণে শিস দিতাম। কু-উ-উ! সত্যিই মনে হত গাড়ি স্টেশনে ঢুকছে।
পুরো গরমের ছুটিটাই এই রকম ফটক ধরে ঝোলাঝুলি আর সামার হাউসের ভেতরে মারপিটের খেলা খেলে কেটে যেত। ডাকাত ধরার খেলা। পুলিশ আর ডাকাতের মধ্যে জবরদস্ত সংঘর্ষ চলত। শেষ পর্যন্ত ডাকুরা ধরা পড়তই। তারপরে তারা কাঁচা পেয়ারা আর তুঁত ফলের দোকান দিত। মাটির গামলা ভেঙে টুকরোগুলো ঘষে ঘষে সের-আধ-সেরের বাটখারা আর নানা কিসিমের সিকি-আধুলি তৈরি হয়ে যেত। আর এইভাবেই খেলতে খেলতে কখন যে ছুটি শেষ হয়ে যেত! মনে পড়ত কাল স্কুলে যেতে হবে। যেদিন স্কুল খুলবে, সেদিন স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে গেছি ভান করে সকাল নটা অবধি বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকতাম। স্কুল বাস এসে আমাকে না পেয়ে ফিরে যেত। কিন্তু তেমন কি আর চলতে পারত? পরদিনই রাত চারটেয় ঝাঁকুনি দিতে দিতে আমার ঘুম ভাঙানো হত। প্রতিবারই স্কুল খোলার সময় আমরা কোনও না কোনও অসুবিধেয় পড়ে যেতাম। সেবার হল কী একজন নতুন মোটাসোটা দিদিমণি আমাদের ক্লাসে এলেন। পাড়হীন শাড়ি, চোখে চশমা। ক্লাসের মুসলমান ছাত্রীদের হাতে হিন্দি পাঠ্য বই ধরিয়ে দিলেন। বললেন নিজে নিজেই সে বই পড়ে আসতে। বই দেখে আমার ভালো লাগেনি। পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে এই প্রাইমার কেন পড়ব? এমন বই তো আগেই একবার পড়ে এসেছি। এই সব ছবিই তো সে বইতেও ছিল। যাই হোক দিদিমণির নির্দেশ ক্লাস ফাইভে হিন্দি অবশ্যই পড়তে হবে। আমি সযত্নে বইটি আমার ব্যাগে ভরে নিলেও সেটা ব্যাগেই পড়ে রইল। দুদিন পরে দিদিমণি আবার ক্লাসে এলে খুব সহজেই পড়া মুখস্থ বলে দিলাম: 'আলিফ'-এ আনার, 'বে'-তে বকরি, 'হে'-তে হুঁকো, আর 'দাল'-এ ধুল! পাগল! দিওয়ানি! দিদিমণি তো রেগে টঙ! ‘আবার শিখে এসো!'
ভাই, এ কী ঝামেলা! কে আমাকে সাহায্য করবে? ক্লাসের বাকি মেয়েরা তো সবাই আমার থেকে দুহাত মাথায় উঁচু। তারা তো ক্লাস ফাঁকা গেলে কাপড়ে লেস বসায় আর উল বুনে লাল-সবুজ সোয়েটার বানায়। আমি ভাঙা চুড়ি আর গুলি নিয়ে খেলতাম বলে তাদের সামনে লজ্জা পেতাম। তাই কী আর করি! বই জায়গা মত রেখে দিলাম। দিদিমণিকেই পাগলি বলে মেনে নিলাম। হুঁকো আর বকরির ছবি তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দিদিমণি কেন এত রেগে যাচ্ছেন? বার বার তাঁর চিৎকার শুনতে-শুনতে আমি শেষ পর্যন্ত মাকে জিগ্যেস করলাম। দিদিমণি তো নিজে পড়াতেন না। খালি বলতেন বাড়ি থেকে শিখে এসো।
‘তুমি রবি দত্তকে বলো, ও পড়িয়ে দেবে,’ মায়ের পরামর্শ।
তখন আমি সেই ছেলেটাকে খোশামোদ করা শুরু করলাম যার বাবাকে আমরা ‘মহারাজ’ বলে ডাকতাম। যিনি বাইরের কুঠিতে থাকতেন।
রবি দত্ত’র বড় বড় চোখে মোটা করে কাজল লেপা। খারাপ নজর এড়াতে সে কপালে বড় কালো টিকা আঁকে। তার গলায় কালো সুতোয় লাগানো সোনার তাবিজ। চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে সে পড়ানোর শর্ত দিল।
‘তুই আমার চুড়ো করে বাঁধা চুলগুলো ধরে টানবি না তো?’
‘না।’
‘দোলনায় দুলতে দিবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘দোলনা বিশ বার দোলাবি?’
‘হ্যাঁ।’
‘গোস্-রোটি খাওয়াবি?’
এবার আমি ইতস্তত করলাম। আমি যদি ওর ফরমাশ মত গোস্ত খেতে দিই, তা হলে আমার মা বিরক্ত হবেন। ‘খবরদার, ওকে কখনও গোস্ত খেতে দিয়েছিস তো তোর একদিন কী আমার একদিন।’
‘খেতে দিবি না তো? ঠিক আছে। আমিও পড়াব না।’
‘আচ্ছা, খাওয়াব।’
আর মহারাজ এসেই হয় পালঙ্ক নয় তক্তপোশের তলায় বসে পড়ত। সেখান থেকে টানতে টানতে তাকে বার করলে তখন বলত, ‘পড়ো। হ্রস্ব উ। দীর্ঘ ঊ। ই। সেই সব ছবির পাতাগুলো খুব তাড়াতাড়ি আমার পড়া হয়ে গেল।
তারপর একদিন পড়াল: ‘মোহন আচ্ছা লড়কা হ্যায়। ভোর ভায়ে জাগতা হ্যায় অউর আস্নান করতা হ্যায়।’
ভাই, আমার তো ধারণাই ছিল না যে ওই অদ্ভুত হরফগুলো থেকে এত চেনা সব শব্দ বেরোতে পারে।
‘কমবখ্ত, গাধা! পড়াচ্ছ না তো ঠিক করে!’
‘পড়াচ্ছি তো! আর কী তোমার মাথা পড়াব?’
‘মিথ্যুক! জোচ্চোর! ইংরিজি অক্ষর থেকে তো ইংরিজির আওয়াজ বেরোয়। আর তুমি হিন্দিতে উর্দু পড়াচ্ছ?’
‘যাও, আমি পড়াব না।’ সে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেত। মনে হয় এটা তার মগজেও ঠিক ঢুকত না যে কীভাবে হিন্দি অক্ষর থেকে উর্দু আওয়াজ বেরোয়।
অনেক কষ্টের পরে এই ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছিলাম যে এই অদ্ভুত আর একেবারেই নতুন হরফগুলো থেকে সেই আওয়াজই বেরোচ্ছে যা আমরা উর্দুতে পড়তাম।
এবার লেখা শুরু হল। ‘ও’-এর ওপরে আঁকাবাঁকা ওটা কী লাগানো আছে?’ আমি মাত্রাটা দেখে জিগ্যেস করি।
শুনে সে আবার হকচকিয়ে যায়। ‘ওটা এভাবেই লেখা হয়। ওটা নিয়ে না ভেবে নিজের কাজটা করো।’
আসলে সে মাত্রা চিহ্নটা আমাকে ব্যাখ্যা করে বোঝাবে না ঠিক করেছিল। তাই বোঝালই না।
তবে আমার মনে একটা উদ্বেগ থেকেই গেল। এ কী অন্যায় কথা! যে কথা আমি উর্দুতে পড়েছি, সেই একই কথা এই আজব হরফেও লেখা আছে! এ নিশ্চয়ই পড়ুয়াদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য কেউ মতলব কষেছে। আমার জেদ ধরে গেল। এর পেছনে পড়ে থেকে কী লাভ? আমার রোজকার ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে-শুনতে রবি দত্তও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমরা হিন্দির প্রাইমার এক পাশে সরিয়ে রেখে দিলাম। আরেকটা কারণও ছিল বটে। কিছুদিনের মধ্যেই আমার এমন একটা নতুন স্কুলে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল যেখানে ওসব ঝামেলা কিছু নেই। কাজেই ওস্তাদি-শাগরেদির সে সম্পর্ক ভেঙে গেল। এবার তো তাকে দিনভর আর দেখতে পাই না। সে স্কুলে যায়। আর স্কুল থেকে ফিরেই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ে। নচেৎ ঘরে বসে বুড়োদের মত কথা বলে। তার না ছিল কোনও ভাইবোন। আর নিকটাত্মীয়রা সব থাকত দেশের বাড়িতে।
হ্যাঁ, তো ভাই তুমি রবি দত্ত তো খুব ছিলে! আজ এই জগতেও আমি তোমায় দেখতে পাই। প্রায়ই দেখি। তুমি হারাও না। যখন বর্ষা আসে, তখন মনে এই খেয়ালও আসে যে যেখানে আমাদের ঘর ছিল, সেখানেও নিশ্চয়ই এখন ঘন কালো মেঘ করে এসে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের ছাঁচা বেয়ে নদীর স্রোতের মত জল নামছে। হয়ত সেখানে রাখিবন্ধনও পালিত হচ্ছে। এমন সময়ে তোমার কথা মনে তো পড়বেই। তোমার-আমার মধ্যে ওস্তাদ আর শাগরেদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে তুমি আমায় এক নতুন বন্ধনে জড়ালে। পরদার পেছনে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলে, ‘তুমি কেমন বোন যে আমার হাতে রাখিও বাঁধো না? সব বোনেরা তো এই দিন ভাইয়ের হাতে রাখি পরিয়ে দেয়।’
সারা দিন তুমি বারে বারে এসে দরজার পেছন থেকে রাখি না পরানোর জন্য অনুযোগ করতে থাকায় মা তোমার হাতে পরানোর জন্য বাজার থেকে রাখি আনিয়ে দিলেন। পরের বার তুমি দরজার বাইরে থেকে উঁকি মারতেই তোমাকে খপাৎ করে ধরে ফেলে লাল-সবুজ ডোরা কাটা ঝোলানো সুতোর রাখি বেঁধে দিয়েছিলাম। হাতে তিন-তিনটে রাখি পরার খুশিতে তুমি এক ছুটে বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলে। সেদিনই সন্ধ্যায় সাদা ধুতি, লেস লাগানো কুর্তা আর গান্ধী টুপি পরে পেতলের থালায় চাল, চালের পিঠে আর কলার সঙ্গে আট-দশ আনা পয়সা নিয়ে এসে তুমি সেই দরজাটার পেছনে দাঁড়িয়ে বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে থালা রেখে বলেছিলে, ‘এই তোমার দক্ষিণা।’
সত্যিই তোমাকে আর কী বলব! এখানে কারই বা রাখি বাঁধার খেয়াল বা শখ হত? কিন্তু তুমি যে প্রতি বছর রাখি উৎসবের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে। ‘আমার জন্য রাখি আনিয়েছ?’ ওই রকম জবরদস্তি করে আমার ভাই বনে যাওয়া কী সম্মানের ব্যাপারই না ছিল তোমার কাছে! শাদীর পরে নতুন বিবি যখন প্রথম বার শিমলা থেকে এল, তো তুমি বাইরে থেকে কত কষ্টে তার বিছানা-বালিশ কাঁধে করে বয়ে এনেছিলে। যখন তোমাকে বলা হল, ‘তুমি কেন এই ভার টানলে? জব্বলই তো নিয়ে আসতে পারত,’ তখন তোমার শান্ত উত্তর ছিল, ‘জব্বল কেন? আপা’র বর তো আপাকে বলেছে এ কেমন ভাই তোমার যে একটা বিছানা বয়ে নিয়ে যেতে পারে না!’
আর তাতেই শেষ নয়। আমার সঙ্গে লড়াই করে দোলনায় বসতে। আমি যখন দোলনা ঠেলতাম, তুমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে, ‘আস্তে, আস্তে ঠেলো। আমি ভয় পাচ্ছি যে।’
‘ভয় পাচ্ছ কেন? আমার তো ভয় করে না।’
তখন মৃদুস্বরে তোমার জবান আসত, ‘তুমি তো মাংস-রুটি খাও। আমি যে ডাল-রুটি খাই!’
আর ঘরে-বাইরে যখন কেউ তোমায় জিগ্যেস করত তুমি হিন্দু না মুসলমান, তখন কত সহজে জবাব দিয়ে দিতে: ‘আমি তো বেগম সাহেবের জাতভাই। আমি তো বেগম সাহেবেরই ছেলে!’
তোমরা শুধু ব্রাহ্মণ নয়, কুলীন শ্রেণির ব্রাহ্মণ ছিলে। এতই কুলীন যে তোমার ডাক্তার দাদু তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এমন একজনের সঙ্গে যাকে সকলে কুঁড়ে বলে জানত।
হ্যাঁ, তো তুমি সময় পেলেই উজু করে তক্তপোশের ওপর আম্মার নমাজ পড়ার মাদুর বিছিয়ে ফটাফট মাথা নুইয়ে রুকু আর নতজানু হয়ে কপাল মাটিতে ছুঁইয়ে সাজদা করতে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে করতে মুখের ওপর হাত ঘোরাতে। তা দেখে কেউ হাসলে তোমার খারাপ লাগত। আর যদি মহারাজনকে এই বলে ভর্ৎসনা করত যে তোমার ছেলে কেন সারা দিন মুসলমানদের মধ্যে থাকে আর তাদের নকল করে, তখন তিনি হেসে বলতেন, ‘চলো, ওকে ওদের মতই না হয় জীবন কাটাতে দাও। তাও যদি এইভাবেই ও বেঁচে থাকে! আমার আর দুটো ছেলে তো মরেই গেছে।’
কিস্সার ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোনো গেল যখন পাড়ার ঘরে-ঘরে মিলাদ পালনের ধুম উঠল। আমাদের ঘরেও হল। আর যায় কোথায়! তুমি কখনই বা অন্য কারও কথা মেনেছ? মহারাজনের সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া শুরু করে দিলে যে তোমাদের ঘরেও নবীর জন্মদিবস পালন করতে হবে। তিনিও এতই ভোলিভালি ছিলেন যে তৈরি হয়ে গেলেন। আমাদের কাছ থেকে সুতির কার্পেট, ওপরে পাতার সাদা চাদর ধার নিলেন। ফুলের ঝাড় আনিয়ে সুগন্ধি ধুপ জ্বালালেন। ‘আমার লালা জেদ ধরেছে’ বলে পাঠানি বুয়াকে অনেক খোশামোদ করে নবী হজরত মহম্মদের জন্মদিন পালন করে অতিথিদের পবিত্র কোরান পড়িয়ে নিলেন।
সে মেহফিলের প্রধান আকর্ষণ তো ছিলে তুমিই! কখনও পান খাওয়াতে, কখনও আতর লাগাতে, বারংবার গোলাপ জলের পাত্র থেকে জল ছেটাতে। এই দুশ্চিন্তায় মরে যেতে যে এমন কিছু কী করা বাকি রইল যা বেগম সাহেবের কোঠিতে হয়ে থাকে?
শীতের রাতে যখন সকলে সন্ধে হলেই লেপের তলায় ঢুকে পড়েছে, আর কখনও বা গল্প শোনা হচ্ছে, তখন তুমিও কারও লেপের তলায় ঢুকে পড়তে যাতে আরও খানিক আমাদের এখানে থাকতে পার।
আর তারপরে পৃথিবীটা বোধহয় নিজের ভার বইতে বইতে ঘাবড়ে গেল। পরিচিত মুখ আর চেনা আওয়াজ বোধহয় তার খারাপ লাগতে শুরু করল। কেউ যেন কুলোয় নেড়ে নেড়ে শস্যের দানা ফাটিয়ে দিল। কে যে কোথায় ছিটকে ছড়িয়ে গেল কে জানে! বীজ আর দানা যেখানেই গিয়ে পড়ুক না কেন, সংসার পেতে ফেলে! পৃথিবীর বুকে বহুপদী বিছের মত নিজের সরু শেকড় ছড়িয়ে দেয়। মাটির সঙ্গে লেপটে থাকতে থাকতে কোনও একদিন আবার পৃথিবীর বুক চিরে বাইরে বেরিয়ে আসে।
তো ভাই রবি দত্ত, ঘটনা হল এই যে আমি এখানে এসে পড়লাম। তুমি সেখানে রয়ে গেলে। কে জানে তুমি কেমন মাতব্বর, কেমন রাশভারি মানুষই না হয়ে উঠেছ। আবারও বর্ষা এসেছে। যেখানে তুমি আছ সেখানে নিশ্চয়ই অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কিষানেরা বস্তা মাথায় দিয়ে নালা কাটছে, ক্ষেতের তদারকিও করছে। তাদের মাথার ওপরে বক আর টিয়াপাখিরা নিশ্চয়ই ঝাঁকে ঝাঁকে এধার থেকে ওধারে উড়ে বেড়াচ্ছে। ব্রাহ্মণীরা ভাইদের রাখি পরানোর জন্য এবার ঘরের বাইরে বেরোবেন। লাল-সবুজ শাড়ি তাদের পরনে, কপালে টিপ। পায়ে আলতা। উজ্জ্বল, ফরসা, গোলগাল বাহুতে কালো আর সবুজ চুড়ির শোভা।
তোমার হাত নিশ্চয়ই রাখিতে ভরে উঠেছে। তুমি থালায় সাজিয়ে দক্ষিণা দিচ্ছ। আর দরজার পেছন থেকে নয়, একেবারে সামনে বসে।
তাহলেই বা কী ভাই? আমার কীই বা এল-গেল! আমার আবার কবে তোমাকে রাখি পরানোর শখ জেগেছিল? তুমিই তো জোরাজুরি করে আমাকে দিয়ে রাখি বাঁধিয়েছিলে। আর ভাই, এখন তো ওই সব ছোটখাটো আবেগ-আহ্লাদের যুগও শেষ হয়ে গেছে। মানুষ এখন বড়-বড় বিষয় নিয়ে ভাবতে শিখেছে। যা কিছু নগণ্য বা সামান্য তাই এখন তার অপছন্দ। আর সত্যি বলতে কী তুমি বা আমি অথবা অন্য কেউ যদি অতীতের কথা ভাবি, তা হলে আমরা ভুল করছি। জীবন কেনই বা এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকবে? জীবন-জাহাজের কাজই তো হল সময়ের অশান্ত ঢেউয়ের মধ্যে দুলতে থাকা। তীরের সঙ্গে লেগে থেকে কী লাভ?
জীবন-সমুদ্রে কারও জাহাজ পশ্চিমে, কারও বা পূর্ব দিকে চলে। বাতাসও সেই মাফিক তাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। নিয়তি তাদের গন্তব্য নির্দিষ্ট করে দেয়।
তোমার আর আমার জীবনের জাহাজও সেই তীরে এসে ভিড়েছে যা আমাদের জন্য স্থির করা ছিল। তাসত্ত্বেও না জানি কেন এই আজকের দিনটায় প্রাণ চাইছে লুকিয়ে-চুরিয়ে তোমাদের ওখানে পৌঁছে যাই। সেই যেখানে তুমি বেশ একজন মাতব্বর হয়ে উঠেছ। তোমার পিঠে একটা চাপড় মেরে জিগ্যেস করি, ‘রাখি পরবে? আমার দক্ষিণার থালাটা যেন কোন্টা?’
পুরোনো ব্যথার মত আজ কেন এই ভুলে যাওয়া কথাগুলো আমার স্মৃতিকে উথাল-পাথাল করছে? এর কারণ কি এই যে গনগনে সূর্য আর প্রখর রোদের দিনগুলোর পরে আজ হঠাৎই ঠান্ডা বাতাস বইছে?
আরে, এ পুরবৈয়াঁ নয় তো?