• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • বাঘের বন্ধু, ভাদাই থারু : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

    এক মাতঙ্গ সমান উঁচু,
    এক বন এলিফ্যান্ট গ্রাস।
    এই বনে বাঘ আছে কিছু,
    এই বনে সাপ আছে কিছু,
    তবু শ্বাপদ সঙ্কুল নয়।
    এই বনে শান্তি ছেয়ে আছে,
    এই বন মানুষের নয়।
    তাই সাপ খোপ বাঘ নিয়ে
    এই বন অপার শান্তির,
    মানুষ তফাতে থাকো দূরে,
    এই বনে শান্তি ছুঁয়ে আছে।

    আমাদের কবিশেখর বাঘুদা, হোয়াটসঅ্যাপে কবিতাটা আমাকে পাঠিয়েছে দিন দুয়েক হল, ওর এই মানুষকে একদম দূর-ছাই করাটা আমার পছন্দ হয়নি বলে কোনও সাড়াশব্দ করিনি, যতই হোক আমিও তো দু’পেয়ে। তোমরা ভাবছ, বাঘুদাটা আবার কে? কবিতা লেখে নয় বোঝা গেল, তবে তার কবিতা ছাপলেই হয়, তাকে নিয়ে গল্প ফাঁদার দরকারটাই বা কী? আর নামটাই বা কেমনতরো, ‘বাঘু’! কবিদের তো এমনতরো নাম কস্মিনকালেও হয় না!

    রোষো তবে, বাঘুদার সঙ্গে তোমাদের পরিচয়পর্বটা সেরে ফেলি আগে, তার পরে গল্পে ফেরা যাবে। আমার মাসতুতো দাদা, বাঘুদার পিতৃদত্ত নাম হচ্ছে, ‘বিশ্বেশ্বর গাঙ্গুলি’।

    তোমরা কী ভাবছ, বিখ্যাত কবি বিশ্বেশ্বর গাঙ্গুলিই তবে বাঘুদা কি না? একদম ঠিক ধরেছ, কবিশেখর বিশ্বেশ্বর গাঙ্গুলি এবং বিখ্যাত বাঘ বিশেষজ্ঞ এবং ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার বাঘুদা একই ব্যক্তি।

    বিশ্বেশ্বর গাঙ্গুলি নামটার পরিচিতি শুধু ওই কাব্য মহলেই সীমাবদ্ধ। আমার মেসোমশাই ছিলেন অরণ্যপ্রেমী মানুষ। ওঁর ছুটিতে ঘুরতে যাওয়া মানেই ছিল জঙ্গল ভ্রমণ। আমরা যখন পুজোর ছুটিতে বা গরমের ছুটিতে পুরী, দিঘা, দার্জিলিং যেতাম; তখন বিশুদা, আমার মাসি-মেসোমশাইয়ের সঙ্গে বান্ধবগড়, রণথম্ভোর, কাজিরাঙা, মানসের জঙ্গল চষে ফেলত, আর ক্যামেরায় পশু পাখির ছবি তুলত। সেই থেকেই বিশুদার বন আর বন্য প্রাণী প্রেম, বিশেষ করে ব্যাঘ্র প্রেম। বাঘের প্রতি অদম্য ভালোবাসা থেকে বিশুদা হয়ে গেল ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার, বাঘেদের ফটোগ্রাফার বললেই বরং ভালো হয়। বিশুদার ব্যাঘ্রপ্রীতি দেখে, ওর বন্ধু বান্ধবেরা ওকে বাঘু বলে ডাকতে শুরু করে, এখন সারা বিশ্বের বাঘ মহলে বিশ্বেশ্বর গাঙ্গুলিকে সকলে বাঘুদা বলেই এক ডাকে চেনে।

    তা যাই হোক, আজ সকালে দেখি বাঘুদার ফোন, “কী রে বোঁচা, বেশি মাতব্বর হয়ে গেছিস? তোকে যে দু’দিন আগে একটা কবিতা পাঠালাম, তার কোনও উত্তর দিলি না তো?” এই বোঁচা নামটা আমার মোটেই পছন্দ নয়, আমার একটা সুন্দর নাম আছে, ‘স্বর্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়’। বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে সোনা বলেই ডাকে, তবে বাঘুদার ব্যাপারটা আলাদা। আমার নাকি ছোটবেলায় নাকটা বোঁচা ছিল, সেই থেকে বাঘুদা আমাকে বোঁচা বলে ডাকে। আমি আয়নায় তো রোজ নিজের নাক দেখি, আমার ও বস্তুটিকে টিকোলো আখ্যা না দেওয়া গেলেও বোঁচা বলা চলে না, তা বাঘুদাকে সে কথা কে বোঝাবে? নেহাত আমাকে খুব ভালোবাসে আর আমিও বাঘুদার এক নম্বর ভক্ত বলে মেনে নিই আর কী। বাঘুদা যখন দেশ-বিদেশের সেমিনারে বাঘ নিয়ে বক্তৃতা দেয় আর খবরের কাগজে সেসব খবর বেরোয় তখন গর্ব হয় বই কী। কবি হিসেবে খ্যাতি তো আছেই। এ হেন কবির ভাই যদি তার কবিতা পড়ে দু’-একটা প্রশংসাসূচক মন্তব্য না করে, তাও আবার যে কবিতায় বাঘের কথা উল্লেখ করেছে, তবে তো রাগ হতেই পারে, হওয়ারই কথা। আমি ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার জন্য বললাম, “দেখো, কবিতা হিসেবে তো ভালোই হয়েছে, তবে তোমার ওই মানুষকে একদম দূরে সরিয়ে দেওয়ার কথাটা বাপু মেনে নেওয়া যায় না। শুধু বাঘই থাকবে আর আমরা বাদ, এটা কি বাড়াবাড়ি নয়?”

    বাঘুদা, ফোনের ওপার থেকে খুব একচোট হাসল, তারপর বলল, “শোন বোঁচা, তুই বাঘ আর কবিতা কোনওটাই বুঝিস না।” আমার তো আঁতে ভারী ঘা লাগল, বললাম, “কেন কেন? তোমার সঙ্গে একমত না হলেই আমি বুঝি অবুঝ হয়ে গেলাম?” বাঘুদা বলল, “শোন তবে, এখানে মানুষকে দূরে থাকতে বলা মানে অমানুষদের দূরে থাকতে বলা। ‘ভাদাই থারু’র মতন সৎ এবং জ্ঞানী মানুষদের নয়। তবে বেশিরভাগ মানুষই হল ওই অমানুষের দলে। এখনই তো জিজ্ঞাসা করবি, ভাদাই থারুটা কে?”

    আমার মনের কথাটাই বাঘুদা বলে ফেলল। আমি সম্মতিসূচক, “হুঁ” বললাম। বাঘুদা আবার শুরু করল, “শোন, ভাদাই থারু কে, তা জানার আগে কয়েকটা কথা তোর জানা দরকার। একশো বছর আগেও সারা পৃথিবীতে জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। বাঘের চামড়ার লোভে আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রাচীন ওষুধ তৈরিতে বাঘের নখ, দাঁত, হাড়ের ব্যবহারের জন্য নির্বিচারে বাঘ শিকার এবং বাঘের ঘর বাড়ি, জঙ্গল কেটে ফেলার ফলে ২০১০-এ, বন্য বাঘের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় তিন হাজারের আশপাশে। বাঘের তিনটি উপপ্রজাতি, Bali Tiger (Panthera Tigris Balica), Javan Tiger (Panthera Tigris Sondacia), Caspian Tiger (Panthera Tigris Virgata) তো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

    ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখ বোঁচা, এত সুন্দর একটা প্রাণী মানুষের লোভে প্রায় শেষ হতে বসেছে। এটা কি ভালো কথা?

    একসময় সারা এশিয়া জুড়েই বাঘের দেখা পাওয়া যেত, ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে হতে বাঘ বাবাজি শেষে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, চিন, মালয়েশিয়া, মায়ানমার এই মোট তেরোটি দেশে কোনওরকমে নিজেদের ঠিকানা বাঁচিয়ে রেখেছিল। তবে দুঃখের কথা হল যে ভিয়েতনাম, লাওস আর কম্বোডিয়ার জঙ্গলেও আর বাঘ নেই।

    অর্থাৎ দশটা দেশের জঙ্গলে এখনও টিমটিম করে বাঘের জীবনপ্রদীপ জ্বলছে, তার মধ্যে ভারতের অভয়ারণ্যগুলোতেই পৃথিবীর সত্তর ভাগের বেশি বন্য বাঘের আবাসস্থল।

    যাক, সব কথা তো আর ফোনে বলা সম্ভব নয়, সামনাসামনি বসে, তোকে একদিন শোনাব সেসব গল্প।

    এ বার তোকে বলি, ভাদাই থারুর কথা। নেপালের এক ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা ভাদাই থারু, নিজেও বাঘ সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত। সময়টা ২০০৪ সাল, ভাদাই থারু তার গ্রামের কাছের জঙ্গলে গরুর জন্য ঘাস কাটার সময় বাঘের হামলার শিকার হয়েছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি যা বলেছিলেন, সেটা তার বয়ানেই শোন, ‘বিশাল হাঁক দিয়ে বাঘটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমি প্রথমে ছিটকে পড়লাম, বাঘটাও একটু থমকে গেল, তারপর আমি শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করে সাহায্যের জন্য তীব্র চিৎকার শুরু করলাম।’ ভাদাই থারু চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খোলার পর দেখা গেল চোখের কোণে একটি বড় ক্ষত এবং একটি চোখ তার নেই। ভাদাই থারু বলতে থাকেন, ‘আমি খুবই রেগে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাঘ সংরক্ষণের কাজ করে কি আমি অপরাধ করেছি? কিন্তু আমি বুঝি, বাঘ বিপন্ন এবং তাদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’

    এ বার বুঝেছিস বোঁচা, কেন আমি ভাদাই থারুকে সৎ এবং জ্ঞানী বলেছিলাম। ভাদাই থারুর প্রথাগত শিক্ষা না থাকতে পারে, কিন্তু তিনি কত বড় মনের মানুষ বল তো! যে বাঘের আক্রমণে তার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে রক্ষা করতেই তিনি বদ্ধপরিকর। তিনি জঙ্গলের ভূমিপুত্র হিসেবে জানেন, বাঘ আছে বলেই জঙ্গল আছে, জঙ্গল আছে বলেই মানুষ আছে। নয়তো সব ধ্বংস হয়ে যেত। দেখ না, আমাদের ঘরের পাশে সুন্দরবন আছে বলেই আমরা একের পর এক সাইক্লোনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। সুন্দরবন বারবার সাইক্লোন এবং কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা তুলনায় অনেক কম হয়েছে। বাঘ না থাকলে, সুন্দরবনও কেটে সাফ করে ফেলা হত।

    সব দেশেই যেমন চোরা শিকারী এবং বাঘের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অসাধু ব্যবসায়ীরা আছে, তেমন তাদের প্রতিরোধ করার জন্য ভাদাই থারুর মতন বাঘবন্ধুরা রয়েছেন। শুধু চোরা শিকার আর নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস ছাড়াও বাঘের বাসভূমিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, রাস্তা, রেলপথ তৈরিতে বাঘ সংরক্ষণের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। তবুও আমরা লড়াই ছাড়িনি, কবিতায় যে মানুষকে জঙ্গল থেকে দূরে থাকতে বলেছি, তা প্রতীকী, তা মানুষেরই মঙ্গলের জন্য। মানুষ যত তাড়াতাড়ি তা বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল।”

    আমি বললাম, “বুঝেছি বাঘুদা। কিন্তু আমার দেশ ভারত বাঘ সংরক্ষণে কতটা সাফল্য পেল তা তো বললে না!”

    বাঘুদা বলল, “আগেই বলেছি, পৃথিবীতে বন্য বাঘের সত্তর শতাংশের বেশিই ভারতে বাস। ১৯৭৩-এ ভারত সরকার বাঘকে জাতীয় পশু হিসেবে ঘোষণা করে, ৯টি অভয়ারণ্য দিয়ে বাঘ সংরক্ষণ শুরু করার পর এখন এ দেশে ৫২টি অভয়ারণ্যে বাঘের সংরক্ষণের কাজ চলছে। কিন্তু সমস্যা অনেক। টাইগার করিডরগুলো রাস্তা, পান্থশালা নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত। যাই হোক, নিজে একটু পড়াশোনা কর, তুই তো আবার ছোটদের জন্য লেখালেখি করিস। ছোটরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ।

    তা লেখ না বাঘ নিয়ে কিছু ওদের জন্য, ওরা সচেতন হলে বনের বাঘও সব প্রতিকূলতা নিয়ে বেঁচে থাকবে। বাঘের সঙ্গে সঙ্গে রক্ষা পাবে তার অভয়ারণ্যের অন্যান্য প্রাণীরাও, সবারই তো বাঁচার অধিকার আছে, মানুষ একলা শুধু বাঁচবে, এ কেমন কথা? আর, তা সম্ভবও নয় কখনও। আজ ফোন ছাড়ি বুঝলি, অনেক কাজ আছে।” বলে বাঘুদা তো ফোন ছেড়ে দিল, আমি বসলাম তোমাদের সে গল্প শোনাতে। তোমাদের কেমন লাগল, আমাকে চিঠি লিখে জানাতে ভুলো না কিন্তু। তোমাদের একটা তথ্য দিয়ে আজ শেষ করি।

    ২০২২-এর পয়লা ফেব্রুয়ারি, ওয়ার্ল্ড টাইগার রিকভারি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে শুরু হয়ে গেছে ইয়ার অফ দা টাইগার। চলবে, ২০২৩-এর ২১শে জানুয়ারি অবধি। এই এক বছর ধরে বন্য বাঘ সংরক্ষণে পৃথিবী জুড়ে নানান কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

    পাহাড় প্রমাণ বাধার মধ্যেও, ইয়ার অফ দা টাইগারে উৎসাহী হওয়ার মতন যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে যেখানে সারা বিশ্বে বন্য বাঘের আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৩৭২৬টি, সেখানে; ২০২২-এ, সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫৭৮টি। অর্থাৎ, জঙ্গলে বাঘের বেঁচে থাকার আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি, সেটুকু বলা যেতেই পারে। ভাদাই থারুর মতো মানুষেরা যতদিন থাকবেন, ততদিন বাঘও জঙ্গলে বেঁচে থাকবে। তবে ইয়ার অফ দা টাইগারের ভালো কাজটুকু ভবিষ্যতেও

    কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে।

    তোমরাও নিজেদের মতো করে ভাবো বাঘের মতন অনিন্দ্যসুন্দর প্রাণীকে রক্ষা করতে কী কী করা সম্ভব। জঙ্গল কেটে ফেলা আর চোরাশিকারীদের বিরুদ্ধে আমরা তো সোচ্চার হতেই পারি, জনমত গড়ে উঠলে অসচেতন মানুষও একটু হলেও সচেতন হবেন। তাতে বাঘ এবং মানুষ উভয়েরই লাভ। আমরা কেউই

    তো চাই না, ভয়ংকর সুন্দর এই প্রাণীটি জঙ্গল থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাক। তোমরা কী বলো?



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments