মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তে সোনাইপুর নামে একটি ছোট গ্রাম। সেই গ্রামের একপ্রান্তে ছোট একটি কুটিরে থাকত সদাকান্ত। সদাকান্ত মহাজন। তার আসল নাম সবাই ভুলেই গেছিল, সমবয়সীরা সদু আর ছোটরা সদুজ্যাঠা বলে ডাকত।
সদুর বাবারও মহাজনী ব্যবসা ছিল, সদু সেটাই আরও বড় করে চালিয়েছিল। সোনাইপুর ও আশপাশের গ্রামের গরীব চাষীদের সে চড়া সুদে টাকা ধার দিত। তখনও ব্যাঙ্কের মত প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামের মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারেনি, সদুর মত মহাজনরাই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির ভরসা। খেতে ফসল উঠলে বিক্রিবাটা সেরে চাষীরা হাসিমুখে এসে ঋণ শোধ করে বন্ধকী জিনিষ ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। আর নয়ত সদু নিজেই তা বিক্রি করে সুদ সমেত তার প্রাপ্য টাকা তুলে নিত।
যখনকার কথা বলছি ততদিনে অবশ্য সদুর বয়েস হয়েছে৷ সে বিয়ে-থা করেনি। একদিন সে ব্যবসা গুটিয়ে নিল। এখন সে বাড়িতে বসে আরাম করে আর সময় কাটাতে বাড়ির সামনের জমিতে নানারকম শাকসব্জির চাষ করে৷ পদ্ম বলে গাঁয়ের একটি কাজের মেয়েকে সে রেখেছে, সে রোজ এসে ঘরদোর ঝাঁট দেয় আর দুবেলা রান্নাবান্না করে দেয়। তার নিজের জন বলতে এক ভাইপো কার্তিক, সে দু-তিনটি গ্রাম পরে থাকে আর মাঝেমধ্যে এসে কাকার খোঁজ নিয়ে যায়। অবশ্য সদু তাকে বিশেষ পছন্দ করে না। সে জানে কাকার বিষয়সম্পত্তির লোভেই কার্তিক আসে। তাই সে তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না৷
সদুর সম্পত্তি নিয়ে অবশ্য গাঁয়ের লোকের কৌতূহলের শেষ নেই। তারা জানে সারা জীবন তেজারতি কারবার করে সদু প্রচুর টাকা জমিয়েছে। সে টাকা বা সোনাদানা সে কোথায় রেখেছে কেউ জানে না। তার বাড়িতে কোন সিন্দুকটিন্দুক নেই। সে যে ব্যাঙ্কে বা ডাকঘরে টাকা রাখে না সে নিজের মুখেই অনেকবার বলেছে। তাহলে টাকাগুলো গেল কোথায়? জিগ্যেস করলে সে শুধু মুচকি মুচকি হাসে। গাঁয়ের লোকের কৌতূহলের আর একটা কারণ হচ্ছে বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও সে ঘোরতর কিপটে। নিজের জন্য সে নামমাত্র খরচ করে, ডালভাত খেয়ে থাকে। দানধ্যানও নেই। গাঁয়ের স্কুলের সেক্রেটারি একবার স্কুলের জন্য কিছু সাহায্য চাইতে গেছিলেন, সদু তাকে অপমান করে বিদায় করেছিল। এদিকে ভাইপোর সঙ্গেও তার সদ্ভাব নেই, তার জন্য রেখে যাবে এমনও নয়। তার টাকা তাহলে খাবে কে? লোকে বলাবলি করে সদু যখ হয়ে নিজের সম্পত্তি নিজেই পাহারা দেবে। ওতেই তার আনন্দ৷
কিন্তু এরই মধ্যে একদিন সকালে পদ্ম কাজ করতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসল। সারা ঘর লন্ডভন্ড আর ঘরের মেঝেতে তিনহাত গভীর করে বিশাল গর্ত খোঁড়া। একটা ছোট কালো ঢাকনা-খোলা সিন্দুক গর্তের মধ্যে পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ওর ভিতর থেকে জিনিষপত্র সব বার করে নেওয়া হয়েছে। একপাশে সদু হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে গোঙ্গাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে সদুর বাঁধন খুলে দিল। চোখেমুখে জল দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে তুলল। তারপরই সদুর বুকফাটা আর্তনাদে চারিদিক খানখান হয়ে গেল।
আশপাশ থেকে গাঁয়ের লোক ছুটে এল। অনেক কষ্টে সদুর বিলাপ থামিয়ে যা বোঝা গেল, কাল রাতে সদুর বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সকলেরই মুখ কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। তাদের একজনের হাতে বন্দুক ছিল। তারা প্রথমেই সদুকে বেঁধে ফেলে। তারপর ঘরের মেঝে খুঁড়ে ফেলে। সেখানে মাটির তলায় সিন্দুকে সদুর সারাজীবনের সঞ্চয় সোনাদানা টাকাপয়সা সব রাখা ছিল, সবকিছু নিয়ে তারা চলে গেছে।
খবর পেয়ে দারোগাবাবু এলেন, রুটিনমাফিক সদুকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কিন্তু সদু শোকে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে, তার কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য পাওয়া গেল না। দারোগা পরে আসবেন বলে চলে গেলেন। সকলেই বুঝল বিশেষ আশা নেই। তাছাড়া এই দারোগা খুব ডাকাবুকো নন, দৌড়ঝাঁপ করে ডাকাত ধরা এনার কম্ম নয়।
দুপুর নাগাদ লোকজনের ভিড় হাল্কা হয়ে গেল। পদ্ম এরই মধ্যে কোনরকমে দুটো রান্না করেছিল। সদু অবশ্য খাবার অবস্থায় ছিল না। অগত্যা পদ্ম খাবারটা একটা বাসনে করে ঢাকা দিয়ে রেখে গেল।
গাঁয়ের লোক কেউ কেউ ভেবেছিল সদুর মত ঘাঘু লোক নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আরও কিছু সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু কদিন পরে দেখা গেল তা বোধহয় নয়, কারণ সদু একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। সে শুধু সারাদিন ধরে হাঁটুতে মাথা গুঁজে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। তার খাবার রুচি নেই এবং অন্নজল প্রায় ত্যাগ করেছে৷ দিন দিন সে শুকিয়ে যেতে লাগল। একসময় সে শয্যা নিল। এখন সে বিছানা থেকে ওঠে না, পদ্ম রান্নাবান্না করে একরকম জোর করেই তাকে উঠিয়ে বসিয়ে দুটো খাইয়ে দিয়ে যায়। সদু অনিচ্ছাসত্ত্বেও নামমাত্র খায়। ধীরে ধীরে তার শরীর কঙ্কালসার হয়ে বিছানায় মিশে যেতে লাগল। দুই চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। মাঝেমধ্যে নিজের মনেই বিড়বিড় করে কি যেন বলে৷
গাঁয়ের কবিরাজ মশাইকে ডাকা হল। তিনি এসে নাড়ি টিপে দেখে ওষুধ দিলেন বটে, সেইসঙ্গে বলেই দিলেন এ মনের অসুখ, নিজে থেকে উঠে হাঁটাচলা করলে, বাইরে গেলে, লোকজনের সঙ্গে দুটো কথা কইলে তবেই সদু ভাল হবে, নচেৎ নয়।
একদিন সকালে এসে পদ্ম দেখল সদু কথা বলছে না, দুই চোখ খুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে জল খাওয়াতে গেল, জল ঠোঁটের কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।।সে ভয় পেয়ে আবার কবিরাজ মশাইকে ডেকে আনল। তিনি এসে নাড়ি টিপে বললেন নাড়ির গতি অত্যন্ত ক্ষীণ, আর বেশি সময় নেই, গাঁয়ের লোকদের খবর দে।
পদ্ম দৌড়ে গিয়ে গাঁয়ের মোড়লমশাইকে খবর দিল। তিনি আর পাঁচজনকে নিয়ে এলেন। কিপটে সদুকে গাঁয়ের লোক বিশেষ পছন্দ না করলেও বিপদের সময় তারা একে অন্যের পাশে এসে ঠিকই দাঁড়ায়। দেখতে দেখতে ঘর ভরে গেল। কবিরাজ মশাই নাড়ি টিপে বসে আছেন। পদ্ম সদুর ঠোঁট ফাঁক করে গঙ্গাজল ঢেলে দিচ্ছে, বেশির ভাগটাই বাইরে গড়িয়ে পড়ছে।
এই সময় একটা কাণ্ড হল। সদু হঠাৎ চোখ খুলল। তার সেই ঘোলাটে দৃষ্টি আর নেই, বরং চোখ দুটি ভাঁটার আগুনের মত জ্বলজ্বল করছে। সে মুখ ফাঁক করল তার পর হাড় হিম করে দেওয়া এক অপার্থিব স্বরে বলল, আমার সোনা নিয়ে যাবি? এত সহজ?
কবিরাজ মশাই চমকে উঠে দুপা পিছিয়ে গেলেন। সমবেত লোকজন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর সদুর গলা দিয়ে একটা তীক্ষ্ম জান্তব চিৎকার বেরিয়ে এল। সে শব্দ শুনলে বুঝি মরা মানুষও জেগে ওঠে। তারপর যেন কোন মন্ত্রশক্তিতে তার শরীর বিছানার উপর টানটান হয়ে উঠে বসল। তার দুই চোখে ভয়াল ও হিংস্র দৃষ্টি, দুই হাত সামনে প্রসারিত, যেন সে কাউকে খুঁজছে।
কবিরাজ মশাইয়ের মুখ সাদা হয়ে গেছে। তবু তিনি মনে জোর এনে এগিয়ে গিয়ে উঠে বসা সদুর নাড়ি টিপে ধরলেন। একটু পরে আঁতকে উঠে পিছিয়ে এসে বললেন, নাড়ি পাচ্ছি না। সদু আর বেঁচে নেই৷
ঘর জুড়ে সমবেত একটা আতঙ্কের শব্দ উঠল। তারপর কয়েক জন ঘর ছেড়ে পালাল। যারা রইল তাদেরও পিছোতে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মোড়লমশাই দুর্গানাম জপ করছেন। ওরই মধ্যে একজন মাথা ঠাণ্ডা রেখে মধুওঝাকে ডাকতে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু মধুওঝা আসার আগেই সদুর ভাইপো কার্তিক হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘরে ঢুকল। সে কোথা থেকে খবর পেয়েছে কাকা মৃত্যুশয্যায়। ছুটতে ছুটতে এসেছে৷
সে ঘরে ঢোকা মাত্র সদুর দৃষ্টি ঘুরে গিয়ে তার মুখের উপর স্থির হল।
তারপর যে কি হল সঠিক করে কেউ বলতে পারেনি। আতঙ্কে অনেকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। সাহসী দু-এক জন যাদের সম্বিৎ ছিল তারা বলে দিনের বেলাই ওই ঘরে হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া দিয়েছিল আর চারিদিক অন্ধকার করে যেন আঁধি নেমে এসেছিল। সেই অন্ধকারে সদুর মৃত শরীর দুই হাত প্রসারিত করে বিদ্যুতরেখার মত ছুটে গিয়েছিল কার্তিকের দিকে। তারপর এক রক্ত জমিয়ে দেওয়া বীভৎস চিৎকার ও কার্তিকের মর্মন্তদ আর্তনাদে অন্ধকার যেন টুকরো টুকরো হয়ে যায় ৷
সম্বিৎ ফিরে এলে সকলে বিস্ফারিত চোখে দেখল কার্তিকের দেহ মাটিতে পড়ে আছে, তার গলার দুই দিকে গভীর ক্ষত, সেখান থেকে রক্ত ঝরে পড়ে ঘরের মেঝে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আর সদু বিছানায় শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে যেন ঘুমিয়ে আছে, তার মুখে এখন প্রশান্তির চিহ্ন।
অনেকক্ষণ পরে একটু ধাতস্থ হয়ে কবিরাজ মশাই এগিয়ে গিয়ে সদুর নাড়ি দেখলেন তারপর দুদিকে ঘাড় নাড়লেন। মোড়লমশায়ের ইঙ্গিতে তিনি কার্তিকেরও নাড়ি দেখলেন, আবার ঘাড় নাড়লেন। একজন দারোগাবাবুকে ডাকতে চলে গেল।
পরে কার্তিকের বাড়ির বাগানে খোঁড়াখুঁড়ি করে পুলিশ সদুর সম্পত্তি প্রায় সবটাই উদ্ধার করেছিল। কোন ওয়ারিশ নেই, তাই সেসব সদরে সরকারী তোষাখানায় জমা পড়ে। সেখান থেকে রহস্যময় ভাবে একদিন উধাও-ও হয়ে যায়। তদন্ত হয়েছিল কিন্তু কিছু বোঝা যায়নি।
দেখতে দেখতে কয়েক বছর ঘুরে গেল। সদুর ভিটে এখন পরিত্যক্ত ও আগাছায় ভর্তি। সাপখোপ ঘুরে বেড়ায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে বাড়িটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু কয়েকটা দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। গাঁয়ের লোকে বলাবলি করে ঐ পোড়ো ভিটের তলায় নাকি লক্ষ লক্ষ টাকার সোনাদানা লুকান আছে৷
তবু সাহস করে কেউ ও তল্লাটে পা মাড়ায় না। কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে একবার দুপুর বেলা সাহস করে দল বেঁধে শাবল হাতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু একটু পরেই তারা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করতে করতে বেরিয়ে আসে। কি দেখেছিল বা শুনেছিল তারাই জানে কারণ সেই ঘটনার কথা উঠলেই তাদের মুখচোখ থেকে নিমেষে সবটুকু রক্ত চলে যায়, কথা বলতে গেলে জিভ জড়িয়ে আসে।
তারপর আরও অনেক বছর কেটেছে। সোনাইপুর আর সে সোনাইপুর নেই। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। ধীরে ধীরে লোকের ঘরবাড়ি পাকা হয়েছে। গ্রামে পোস্টঅফিস, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এসব হয়েছে। রাস্তাঘাটও আগের থেকে অনেক ভাল। অনেক বাড়িতেই টিভির ডিশ বসেছে। কিছুদিন আগে পাশের গ্রামে মোবাইল টাওয়ার বসায় গ্রামের অনেকের কাছেই মোবাইল ফোনও আছে।
আর এই সবকিছুর মধ্যে গ্রামের এক প্রান্তে এক পোড়ো ভিটের তলায় সেই সোনাদানা আজও পড়ে আছে। লোকে এখনও পারতপক্ষে ওদিকটা এড়িয়ে চলে।
তোমরা বড় হলে একবার সোনাইপুরে গিয়ে দেখবে নাকি?