• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • ছাতিম : অনুষ্টুপ শেঠ

    “যাসনি এখনো?”

    লাজুক হাসিটা রাজীবের মুখে পুরোটা ফুটে ওঠার আগেই গার্গী মাথা ঝাঁকিয়ে, তার স্টেপ কাটা চুলে হিল্লোল তুলে এগিয়ে গেল অনেকটা। একবার ফিরে তাকালও না রাজীব ওর পিছু পিছু আসছে কি না দেখার জন্য।

    টি কে বি স্যারের পড়ানোর সুনাম সাংঘাতিক। সেশন শুরুর সময়ে ছাত্রছাত্রী আর তাদের বাবা-মায়ের রীতিমতো লাইন পড়ে যায়। ক্লাস ফুল হয়ে, ভর্তি বন্ধ হয়ে ক্লাস শুরু হয়ে যাবার পরেও চলতে থাকে অদম্য কিছু গার্জেনের আনাগোনা কাকুতিমিনতি ঝুলোঝুলি। কারো কপালে শিকে ছেঁড়ে, কারো না।

    আসলে, এখানে যারা আসে তাদের কাউকেই প্রথম কেন, দ্বিতীয় সারির স্টুডেন্টও বলা যায় না। বুদ্ধির দিকটা একটু ঘষা, তাই টি কে বি র ফেমাস নোটস আর সাজেশন তাদের কাছে পাশ করিয়ে দেওয়ার বিশল্যকরণী। কত যে ‘পাশ করা অসম্ভব’ ছেলেপুলে ওই সাজেশনের উত্তর মুখস্থ করে মাধ্যমিক তরে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

    রাজীব সেই ঘষা খাওয়াদের মধ্যেও আবার আরেকদফা সরেস। সাজেশনও তাকে একটু কেউ ধরে ধরে বুঝিয়ে দিলে ভালো হয় এমন দশা। বন্ধুদের থেকে ঠাট্টা-ইয়ার্কি তো হজম করতে হয়ই, আবার মাঝে মাঝে টুকাইদি, মানে টি কে বি স্যারের মেয়েও টিটকিরি কাটতে ছাড়ে না, ‘বাবা, একে পাশ করাতে পারবে তো? নইলে কিন্তু বদনাম হয়ে যাবে ক্লাসের!’

    ওদের থেকে দু বা তিন বছরের বড়ো, বাবার সাজেশনে মাধ্যমিক পাশ করে ফেলা টুকাইদি ঠিকই করে ফেলেছিল আর পড়বে না। বাড়ির ঠেলায় যদিও একটা কলেজে নাম লেখানো হয়েছিল, সেখানে যেতে দেখা যেত না খুব একটা। দীর্ঘাঙ্গী ঢলো ঢলো চেহারা, গায়ের রঙ পরিষ্কার, বড়ো বড়ো চোখ আর টিকোলো নাকের টুকাইদিকে ঘরভরা ছাত্রছাত্রীরা বেজায় সমীহের চোখে দেখত; বিশেষ করে ছাত্ররা। ওর কথায় লাজুক রাজীব আরও গুটিয়ে যেত মনে মনে, কালো মুখে আরেক পোঁচ কালো কষ্টের ছায়া পড়ত, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে উঠতে পারত না। কেউই পারত না, স্যারও না। খুব মুখরা টুকাইদি।

    টুকাইদির মতো অতটা না হলেও, গার্গীকেও সুন্দর দেখতেই বলা চলে। পানপাতার মতো মুখটিতে কোমল লক্ষ্মীশ্রী খুব। রাজীব প্রথম দিন দেখেই ফিদা হয়ে গেছিল। কিন্তু এ মেয়ে কি আর ওর লেভেলের, যে কথা বলবে গিয়ে? অত বড়ো বাড়ির মেয়ের পড়াশুনোর এই দশা – ভাবা যায় না! তবে মা মরা মেয়েকে তো কেউ সেভাবে দেখেও না মনে হয়, বাবা পয়সা কামাতেই ব্যস্ত।

    মোদ্দা, রাজীব ঠিকই করে রেখেছে, ঘষেমেজে মাধ্যমিক দিয়ে ও কাজে লেগে পড়বে। গার্গী পড়ুক না তারপর, ওর যত ইচ্ছে পড়ুক। কিন্তু ওর বিয়ের বয়স হতে হতে, রাজীব নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটা ভদ্রস্থ বাসার ব্যবস্থা করে ফেলবে ঠিক—যাতে ওর বাবা আপত্তি করতে না পারেন। ছেলের ডিগ্রি কম? সে নিয়ে কেউ ভাবে নাকি ব্যবসার লাইনে! শুধু কামাতে হবে, বলার মতো কামাতে হবে যে করে হোক।

    নিজের মনে বেশ পরিষ্কার ভাবনাচিন্তা করতে পারে রাজীব। কিন্তু মুখ খুলতে গেলেই সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়, বিশেষ করে গার্গীর সামনে। তাই বাড়ির দরজা অবধি পৌঁছে মুখ ফিরিয়ে আজ যখন সে বলল, ‘যা, বাড়ি যা নিজের।’ রাজীব কিছু জবাব দিতে না পেরে বোকা বোকা হাসল খালি।

    খানিক পরে রেশন দোকানের পিছনের সরু জমিটা পেরিয়ে একটা রোগা, রুক্ষ, একটু বা চোয়াড়ে চেহারার ক্লাস নাইনের ছেলেটা প্রায় দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরছিল। বোকা বোকা হাসিটা তখনও তার মুখে লেগে ছিল।

    গার্গী অন্যদিন বাড়ি পৌঁছে সোজা ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ ওর সঙ্গে কথা বলেছে! আনন্দ হবে না!

    ---

    পার্থকে টি কে বি স্যারের ক্লাসে আসতে বাধ্য করেছে দীপেনকাকু। বাবার কোলিগ, মাতব্বর লোক, যা বলে বাবা তাতেই সায় দেয়। অতএব টিকেবি স্যারের সাজেশন না পেলে, বদলি হয়ে নতুন স্কুলে এসে পার্থ একেবারেই হাবুডুবু খাবে—দীপেনকাকুর গম্ভীর গলায় বলা এই কথাটা বাবার একেবারে মোক্ষম সত্য বলে মনে হয়েছিল। ফলে কথা নেই বার্তা নেই, এনে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল এই গোয়ালে। মনে মনে ফুঁসলেও পার্থর কিছু বলার উপায় ছিল না।

    বরাবর মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করার অভ্যাস তার। বদলির চাকরির বাবা ঘুরে ঘুরে বেড়াত, মা-ও যেত বাবার পিছু-পিছু সংসার করতে। ওভাবে পড়াশোনা হয় নাকি! আর পড়াশোনার বাবা বোঝেই বা কী, নিজের বিদ্যে তো ওই মেকানিকগিরি। পার্থর অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক ছোটো থেকেই ছিল। তার মাথাটা যে শার্প, এটা ছোটো থেকেই বিভিন্ন লোকের মুখে শুনে শুনে বাবাও তাকে একটু সমীহ করেই চলত। পরীক্ষার রেজাল্টগুলোও কথাটার সাক্ষ্য দিত।

    শেষের এক্সামটা বাদে।

    এখন বুঝতে পারে, একেই বলে কুসঙ্গে পড়া। কিছুটা বয়সের দোষে, কিছুটা রাঘব, মনোজ, স্বপনের সমানে টোনটিটকারিতে বিরক্ত হয়ে ওদের গ্রুপটায় ও-ও ভিড়ে গেছিল এইটের মাঝামাঝি। টিফিন টাইমে পাকা পাকা কথা, গালাগালি-খিস্তি থেকে শুরু হয়ে মেয়েশরীরের রসালো আলোচনার পাকে কখন যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছিল টেরও পায়নি নিজে। তারপর শুরু হল সিগারেট, লুকিয়ে লুকিয়ে আনা বোতল খোলা, গাঁজা।

    মামার টের পেতে খুব বেশিদিন লাগল না। এমনিতেই মামিমা এই বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে প্রসন্ন ছিলেন না, এতদিন দাদু-দিদিমার খাতিরে বুজে থাকা মুখ এবার খুলল। শুধু খুলল না, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে পাড়ায় জানান দিতে লাগল ননদ কেমন ছেলে মানুষ করার দায় তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজেরা ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে।

    ঘরে অশান্তি হচ্ছিলই রোজ রোজ। সেই সময়েই স্কুল থেকেও পাইকারি হারে কমপ্লেন আসা শুরু হল। পার্থ আসলে ঘরের অশান্তি ভুলে থাকতে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিল, টিচারদের মুখে মুখে কথা বলা, অবাধ্যতা—নিজে চাইলেও এগুলো কমাতে পারছিল না। অবশেষে অস্থির হয়ে দাদু বাবাকে ফোনটা করেই বসলেন।

    “তোমার গুণধর ছেলেকে আমি আর রাখতে পারছি না, এবার নিজেরা যা পারো ব্যবস্থা করো।”

    বাবা-মা, এমনকী ছোটো ভাই বোন দুটোও যে ওর এ বাড়িতে আসায় খুশি হয়নি ঠিক, প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিল পার্থ।

    কিন্তু কিছু বলার মুখ ওর আর নেই এখন। তাই চুপ করে সব সহ্য করে যাচ্ছে।

    তাই বলে, ওর মতো স্টুডেন্ট এসে পড়তে বসবে এই রাজীব, অমর, দীপা – এরকম গাধার দলের সঙ্গে! আজ প্রথম এসেই, এরা যে কী পরিমাণ মাথামোটা বুঝে ফেলেছে পার্থ।

    স্যার যে কটা প্রশ্ন করছেন, সমস্তর উত্তরই ওর মুখের ডগায়। কিন্তু পার্থ চুপ করেই থেকেছে, আর দেখেছে এই অতি সহজ প্রশ্নেও ঘর-ভরা ছেলেরা কেমন থতমত খাচ্ছে।

    আজই গিয়ে বাবার সঙ্গে এটা নিয়ে ফাইট করবে, না চুপচাপ ক্লাসের টাকাগুলো মেরে দিয়ে সিনেমা দেখবে সন্ধ্যাগুলোতে, ভাবছিল পার্থ। এমন সময়ে সে ভিতরের দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল।

    কোঁকড়া চুল, ফোলা ফোলা ঠোঁট, টানা চোখ। স্যারের সামনে চায়ের কাপ রাখতে নিচু হল, পার্থর ঠিক সামনে। ম্যাক্সির বড়ো গলার মধ্যে পাকা ডালিমের আভাস।

    মেয়েরা বোধহয় মাথার সর্বত্র চোখ নিয়ে ঘোরে। একবারও মুখ না তুলেও, পার্থর তার বুকের দিকে চেয়ে থাকাটা টুকাই ঠিক টের পেল। সে ইচ্ছে করে আরেকটু ঝুঁকে পড়ে বাবার তৈরি চায়ে আবার চিনি গুলতে লাগল চামচ দিয়ে। পার্থ যে অন্যদের মতো এতে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বসে বসে ঘামতে লাগল না, এটা তার পছন্দ হল। কাপ বাবার হাতে দিয়ে ফিরে যাবার সময়ে তার শরীরে একটু বাড়তি হিল্লোল খেলে গেল, তারপর পর্দার আড়ালে গিয়ে ফাঁক দিয়ে লম্বা চওড়া সুঠাম চেহারার সাহসী ছেলেটির দিকে ফিক করে এক ঝলক হাসি উপহার দিয়ে বাড়ির ভিতরে মিলিয়ে গেল সে। সে হাসিতে আবেদন ও আহ্বান দুই-ই ভরপুর ছিল।

    পার্থ তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেলল, সে ক্লাসটা নিয়মিত করতে আসবে।

    ---

    খবরটা আনল দীপা। কোথা থেকে শুনেছে ওই জানে, ওর আবার ঠাকমার সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে ঘোরা অভ্যাস।

    ওই পিছনের পোড়ো মাঠের গাছটা নাকি জাগ্রত। সুতো বেঁধে মানসিক করলে নাকি তা নিয্যস ফলে।

    দেখেছে গাছটা সবাই। বেশ বড়ো, কালচে পাতাগুলো। ছাতিম গাছ, ফুলের সময় গন্ধে এই ঘরও মাত হয়ে থাকে।

    “জাগ্রত? ভ্যাট। সে তো বট অশ্বত্থ গাছ হয়।”

    “না রে! ঠাকমাকে লালবাবা নিজে বলেছেন। জানিস তো? ওই শিবমন্দিরের পাশের দাওয়ায় বসে না? সে বলেছে। তারপর শিবমন্দিরের পুরুতও বলেছে, সত্যি কথা। এরকম নাকি অনেক ঘটনা সে জানে, ফলেছে কিন্তু!”

    “এতই যদি গুণ, তাহলে সবাই যায় না কেন? ইন ফ্যাক্ট কেউই যায় না কেন?” পার্থ চ্যালেঞ্জ করে বসে।

    দীপার মুখচোখ ঝলমল করে ওঠে। এই দু মাসে, সবাই-ই বুঝে গেছে যে পার্থ ওদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান। ক্লাসের সবকটি মেয়েই পার্থর দিকে আলাদা চোখে তাকাতে শুরু করেছে এখন। ও একটু কথা বললেও তারা ধন্য হয়ে যায়।

    “না, ব্যাপার আছে আসলে। ও গাছ শুধু জাগ্রত নয়, অভিশপ্তও! ওখানে সুতো বাঁধলে মনস্কামনা পূর্ণ হয় ঠিকই, কিন্তু তার দামও চোকাতে হয় নাকি। সে নাকি এমন দাম, লোকে আর ভয়ে যায় না ওদিকে তাই।”

    “যত গাঁজাখুরি কথ!” দীপার মাথায় আলতো চাঁটা মেরে বেরিয়ে যায় পার্থ। দীপা লজ্জা পায়, কিন্তু হাসেও।

    পর্দার আড়াল থেকে দুটো খর চোখ সেটা দেখে।

    ---

    রাজীবের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছিল না। হাফইয়ার্লিটা খুব খারাপ হয়েছে। রেজাল্ট না বেরোলেও সে জানে যে পাশ করবে না। গার্গীর পুরো মনোযোগ ওই নতুন ছেলেটা এসে অবধি তার দিকে চলে গেছে। এমনকী এক একদিন তার সঙ্গেই বাড়ি ফিরছে, আজও তাই।

    ঘরে বাবা আর সৎ মায়ের মধ্যেও রাতদিন ঝগড়া।

    সব মিলিয়ে রাজীবের বেঁচে থাকার ইচ্ছেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। গাছের ডাল থেকে কোনদিন ঝুলেই পড়বে এবার।

    গাছ বলতে হঠাৎ দীপার কথাটা মনে পড়ে গেল।

    জাগ্রত গাছ?

    হয় এমন সত্যি? তা, না হবারই বা কী আছে। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কি সব বোঝা যায়? হতেই পারে।

    করে দেখলেই তো হয়?

    কিন্তু আর কীসব বলেছিল দীপা। অভিশাপ। দাম দিতে হয় কিছু।

    দেবে। ওর আছেটা কী যা দেবে! ধুর!

    যা হয় হবে। কিন্তু যদি লেগে যায়…

    সুতো… এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে রাস্তায় পড়ে থাকা কালো একফালি কারের মতো কিছুর দিকে চোখ যায় রাজীবের। ওর জন্যই যেন পড়ে ছিল।

    এও কি একটা ইঙ্গিত নয়?

    ভাঙা পাঁচিল পেরিয়ে ঢুকে গিয়ে পিছন দিকের একটা ডালে মোক্ষম গিঁট দিয়ে সুতোটা বেঁধে আসতে একটুও সময় লাগল না ওর।

    ---

    টুকাই ভেবেছিল একটা ক্লাস টুয়েলভের ছেলেকে অনায়াসে খেলিয়ে মজা উপভোগ করার মতো ওস্তাদ সে। প্রতিবার পার্থর ব্যাচে ক্লাস চলাকালীন ছুতোনাতায় ঘরে আসত সে, অবধারিত বড়ো গোল গলার ম্যাক্সি পরে এবং সামনে ঝুঁকতেও হত তাকে কিছু একটা অজুহাতে। আগ্রাসী চোখ দুটো যে রীতিমতো চাটছে উপত্যকার ডৌল সেটা না তাকিয়েও টের পেত সে। কিছুকাল এটাতে দুজনেই অভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সে মাঝে মাঝে পার্থর পাশের সামান্য জায়গাটাতে বসেও পড়তে শুরু করল, যেন বা পড়া শুনছে। টিকেবি এসব ব্যাপারে চরম উদাসীন, সে নিজের মেয়ে হোক বা পরের মেয়েই… আর প্রথম দিনের পরেই ইঙ্গিত বুঝে পার্থ একদম কোনা করে বসতে লাগল, যাতে ওদের উরুতে উরু চেপে রাখা কারো চোখে না পড়ে।

    দিব্যি চলছিল। কিন্তু তারপর টুকাই দুটো জিনিস আবিষ্কার করল।

    এক, পার্থকে ঘিরে অন্য সব মেয়েদের মুগ্ধতা ও পার্থরও তাতে ধুনো দেওয়া।

    আর দুই, এই এক নম্বরটা তার একটুও সহ্য হচ্ছে না, গা জ্বলছে, এমনকি কলেজের দীপেশের প্রোপোজ করা, জয়ন্তর দামি পারফিউম গিফট করা বা অভিষেকের সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়ে অন্ধকারের সুযোগে বার দুই চুমু খাওয়াতেও ওই গা জ্বালা একটুও কমছে না।

    অতএব সে ঠিক করল, পার্থকে দিয়েই এই জ্বালা মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

    পরদিন পার্থর হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দেওয়া হল। তাতে ক্লাসের আগে বাড়ির পিছনদিকের নিরিবিলি মাঠে ছাতিম গাছের পিছনে আসার কথা বলা ছিল।

    পার্থ মওকা ছাড়েনি, বলা বাহুল্য। টুকাইয়ের ফোলা ঠোঁট আরও ফুলে লাল হয়ে একশা হয়েছিল। টুকাইয়ের মা সন্দেহ করেছিলেন বইকি, কিন্তু মেয়ের মুখকে তিনিও ভয় পান বলে কথা বেশি গড়ায়নি।

    ----

    গার্গী খেয়ালও করেনি রাজীব ওর জন্য আর দাঁড়ায় না। আজকাল পার্থ বাড়িতে পৌঁছে দেবার পর আলতো করে কাঁধে বা হাতে একটা চাপড় মারে, গার্গীর সারাদিন ওই ছোঁয়াটুকুর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। সারারাতও, কিন্তু সে কথা ভাবলেও তার ফর্সা মুখ ঘেমে লাল হয়ে যায় লজ্জায়।

    টাকার অভাব তাদের নেই। পার্থও নিশ্চয় খুব ভালো চাকরি পাবে, এত ভালো পড়াশুনোয়। তাদের ভবিষ্যৎ মিলনের যে কোনও বাধা নেই সেটা গার্গী প্রায় নিশ্চিত। জাত-টাতও এক। খালি বয়সটা, তা সে তো আজকাল হয়ই। বলে, বয়সে ছোটো ছেলের সাথেই কত বিয়ে হচ্ছে!

    বুক ধুকধুক করে গার্গীর এসব ভাবলে। একটা নিজের সংসার…! আচ্ছা এ বাড়িটা তো জ্যাঠার ছেলে পাবে ঠিক আছে, তাহলে ও কি মতিঝিলের বাড়িটা পাবে? পুরোনো বাড়ি, ওখানে মনে হয় পার্থ থাকতে চাইবে না। তাহলে নিজেদের ফ্ল্যাট কিনতে হবে। সেই ভালো। সানন্দায় কত সুন্দর সুন্দর ঘর সাজানো দেখেছে সে। লেসের পর্দা, কী সুন্দর না?

    হবে, সব হবে। তাড়া কীসের।

    শুধু পার্থকে সব মেয়েই এত পছন্দ করে! মায় টুকাইদিদি অবধি। অতবার ঘরে কেন ঢোকে সে কি আর ওরা বোঝে না!

    আয়নায় আবার নিজেকে দেখে গার্গী। লম্বাটাই যা নয়, নইলে এত সুন্দর মেয়ে এ পাড়ায় আর কে আছে! এই সেদিন জ্যেঠিমা কাকে যেন বলছিলেন, দেখ না দেখ বড়ো হয়ে গেল খুকু, এখন শাড়ি পরলে লাগে লক্ষ্মীপ্রতিমাটি যেন!

    জ্যেঠিমার আলনা থেকে একটা লাল শাড়ি টেনে নিয়ে গায়ে ফেলে ঘুরে ঘুরে দেখে খুকু ওরফে গার্গী। সত্যিই লক্ষ্মীঠাকুর মনে হয় নিজেরই।

    শুধু সিঁদুর আর কপালে লাল টিপটুকু হলেই…

    লাল সোয়েডের টিপও একটা পেয়ে যায় তাক হাঁটকে। পরে ফেলে।

    বাকিটা?

    সিঁদুরদানি সামনেই ছিল। কিন্তু আজন্মের সংস্কার তাতে হাত দিতে দেয় না। উলটে হঠাৎ একটা পুরোনো অবান্তর কথা মনে পড়ে যায়।

    ছাতিম গাছটা কি সত্যিই সব ইচ্ছা পূরণ করে?

    ---

    “কী হচ্ছে কী! কেউ এসে যাবে।”

    “হুক খোলো, নইলে ছিঁড়ে গেলে আমার দোষ নেই।”

    “আহ, লাগছে… খুলছি খুলছি, তর সয় না…”

    “না সয় না।”

    পার্থ আদরের সময়ে খুব নির্মম। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেও টুকাই বারণ করতে পারে না। বড্ড সুখ। সব জ্বালা জুড়িয়ে যাচ্ছে।

    পার্থর হাত ক্রমে নামছে।

    “না, এই না, কী বলেছি? এর বেশি না।”

    “ধুর বে! এবার জোর করব বলে দিচ্ছি। খোলো নিজে। আজ আর ছাড়ছি না।”

    “পার্থ! উঁ! লক্ষ্মীটি। তুমি কথা দিয়ে…ম্মম”

    টুকাইয়ের ঠোঁট শুধু না, দমও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে পার্থর মুখ নেমে আসায়। সেই অবস্থাতেই সে প্রাণপণ বাধা দিতে থাকে কোমরের সালোয়ার খোলার চেষ্টায়। পার্থ অস্থিরভাবে টানে, ছিঁড়ে ফেলতে চায় যেন।

    “একী!! কী করছ তোমরা!”

    গার্গীর তীক্ষ্ণ গলাটা ভেসে আসতেই ঝটাপটি থামিয়ে দুটো শরীর স্থির হয়ে যায় এক পলকের জন্য, তারপরেই ওর পাশ দিয়েই দুজন দুদিকে ছিটকে সরে যায়। টুকাই নিজেদের বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়, পার্থ ছুটে কোনদিকে মিলিয়ে যায় গার্গী দেখতেও পায় না আর।

    ওর দুচোখ ততক্ষণে ভেসে যাচ্ছে জলে।

    দাঁড়ানোর শক্তি নেই, হাপুশ নয়নে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসেই পড়ে সে।

    উঠে দাঁড়ায় অনেকক্ষণ বাদে। বুক খালি, চোখ শুকনো, চোয়াল শক্ত। গটগট করে গিয়ে ছাতিমের একটা ডালে লাল সুতোটা বেঁধে দেয় যত্ন করে। বিড়বিড় করে কী বলে শোনা যায় না, তবে তার মধ্যে পার্থর নাম ছিল না এটা হলফ করে বলা যায়।

    ---

    হাফইয়ার্লির রেজাল্ট না বেরোনো অবধি পার্থ আর এমুখো হয় না। রেজাল্ট বেরোনোর পর এই কোচিং-এ তো বটেই, স্কুলেও বেশ একটা শোরগোল পড়ে। ট্রান্সফার নিয়ে এসেই এমন ভালো নম্বর নিয়ে ফার্স্ট হওয়াটা মুখের কথা নয়!

    ছেলের খবরটা দিয়ে এসে কাঁচুমাচু মুখে পার্থর বাবা জানিয়ে যান, ছেলে আর কোচিং নিতে চাইছে না। বলছে নিজেই পারবে।

    সেটা অবশ্য বলেনি পার্থ। বলেছিল ওখানে যাওয়া তার জন্য সময় নষ্ট, বরং বাবা যেন অমুক ক্লাসের কোর্স মেটিরিয়াল আনিয়ে দেন, সে অন্য অন্য পরীক্ষার প্রিপারেশন নেবে। ছেলের রেজাল্ট দেখে বাবার আরো বেশি করে ধারণা হয় যে তাঁর সন্তান আসলে সোনার টুকরো, স্রেফ দায়িত্ব এড়ানোর জন্য তার শালা-শালাজ ষড়যন্ত্র করে ওর নামে বদনাম করছিল। ফলত তিনি আগের চেয়েও বেশি করে ছেলেকে খাতির করতে থাকেন, এবং হিংসুটে শালাকে দেখিয়ে দেবার জন্য ছেলে যা যা বইপত্র বা পরে দামি কোচিং ক্লাস চায় সব জোগান দিতে থাকেন। এ ছেলের মাথা আছে, একে তিনি যত্ন করবেন না তো কী!

    পার্থর কোচিং ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে টুকাই তার বাবার পড়ানোর ক্ষমতার প্রতি যত না তাচ্ছিল্য পায়, নিজেকে বাতিল করে দেওয়ার কথা পায় অনেক বেশি। তারপর থেকে একটিবার পার্থর সঙ্গে কোথাও দেখা হবে এই আশা নিয়ে হিংস্রভাবে অপেক্ষা করতে করতে সে পর পর পার্থর টেস্টে ভালো রেজাল্টের খবর, উচ্চমাধ্যমিকের খবর এবং অবশেষে খড়্গপুর আই আই টিতে চান্স পেয়ে চলে যাওয়ার খবর পায়।

    সে রাত্রে সে চুপি চুপি মায়ের সেলাইয়ের বাক্স থেকে কিছুটা সাদা সুতো নিয়ে ছাতিম গাছের কাছে গেছিল।

    এর কিছুকাল পরেই সে দুম করে তার তিন বছরের সিনিয়র, সদ্য চাকরি পাওয়া জয়ন্তকে বিয়ে করে ফেলে ও তার সঙ্গে ভুবনেশ্বরে চলে যায়।

    ---

    হুইস্কির বোতলটা অবিশ্বাসের চোখেই দেখছিল পার্থ। এই তো সবে খুলল, এর মধ্যে শেষ হয়ে গেল কী করে!

    অন্ধকার হয়ে আছে ভিতরের প্যাসেজ, বেডরুম। অন্যজনের কাছে আশা করা যায় না, কিন্তু পার্থর নিজেরও আর উঠে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। সারা শরীরে কী অসীম ক্লান্তি আজ...

    হাউস্টনের ঝকঝকে এই বাড়িটা দুবছর হল কিনেই ফেলেছে পার্থ।

    জীবনে যা যা চেয়েছে, তার কোনোটাই না পাওয়া অবধি ছাড়েনি সে। ডিগ্রি, চাকরি, বিদেশে পোস্টিং, প্রোমোশন, সন্তানহীনতা, স্বেচ্ছাচারের ফুর্তির জীবন।

    এবং গার্গীকেও।

    হ্যাঁ, চাইলেই অনেক সুন্দরী অনেক বিদূষী কোনও মেয়েকে অনায়াসে বিয়ে করতে পারত পার্থ। অনেক সুযোগসুবিধেও পেতে পারত তাতে হয়তো। কিন্তু সেই যে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল এই মেয়েটাকেই ঘাড় ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে, সে প্রতিজ্ঞা সে রেখেছে। তার চাকরি, তার টাকার জোর, গার্গীর বাবার পড়তি দশা – সব মিলিয়ে কাজ হাসিল করতে প্রায় কিছুই খাটনি হয়নি।

    সেই গাছের নিচে টুকাইয়ের সঙ্গে ওকে দেখে ফেলার পর থেকে গার্গী ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি। গায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে গেছিল পার্থ, বোঝানোর চেষ্টা করেছিল টুকাই ওকে কীরকম প্রলোভন দেখাত… এত ঘ্যাম সে মেয়ের যে ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, আর কোনওদিন মুখ দেখবে না বলে।

    শুভদৃষ্টির সময়ে গার্গীর মুখে যে যন্ত্রণার ছাপ দেখেছিল পার্থ, তাতে তার এতদিনের জমে থাকা রাগ প্রায় ধুয়ে গেছিল।

    পুরো যায়নি যদিও। বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারে বারে গার্গীর মুখে ওই অসহনীয় কষ্ট, তার অস্থির হয়ে ওঠা, রাগ করা, কান্নাকাটি করা, পায়ে ধরে অনুরোধ করা তাকে রেহাই দিতে – এসব পার্থর নিত্য বিনোদন হয়ে উঠেছিল। কখনো চরম ব্যথা দেওয়া মিলনপ্রক্রিয়া, কখনো অল্প অজুহাতে চড় মেরে ঠোঁট রক্তাক্ত করে দেওয়া, কখনো ডেইজি-রুমি-ইসাবেলা কাউকে না কাউকে নিয়ে ওর চোখের সামনে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া।

    কখনো বা বেডরুমের দরজা বন্ধও না করা, লীলা শেষ হবার পর গার্গীকে দিয়েই সে ঘর সাফ করানো।

    বাড়ির চাবি পার্থ ওকে দেয় না। মোবাইলও। ইংলিশ না জানা, গ্রাম্য ও ভীতু মেয়ের সংস্কার যে তাকে এসব নিয়ে মুখ খুলতে দেবে না কারও কাছে, এটুকু হিসেবে ছিলই তার। গতবার দেশে গিয়ে এক ডাক্তার বন্ধুকে পটিয়েপাটিয়ে কিছু ঘুমের ওষুধের প্রেসক্রিপশনও করিয়ে নিয়েছিল, ঘুরে ঘুরে যথেষ্ট স্টক করেওছিল সেটার। মাঝে মাঝেই একটা করে খেতে বাধ্য করে গার্গীকে, ফলে সে আরওই ঝিমিয়ে পড়ছিল।

    ঠিক যেমনটি পার্থ চেয়েছিল।

    কিন্তু আজকাল যেন গণ্ডগোল হচ্ছে। গার্গী নানা বিষয়ে আপত্তি করছে, চেঁচাচ্ছে, হাত পা ছুঁড়ছে।

    মার খেয়েও যথেষ্ট ভয় পাচ্ছে না।

    কেন এমন হবে? কেন? কেন?

    এক ঝলক মনে পড়ে সেই দিনটা। ছাতিমের কাছে গিয়ে তর্জনগর্জন করেছিল সে, তার অপমানের জন্য গাছটাকেই দায়ী করেছিল। তারপর নেহাত রাগের ঝোঁকেই একটা পড়ে থাকা পাটের সুতো কুড়িয়ে নিয়ে বেঁধে দিয়েছিল বেঁকা একটা ডালে, দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল ‘সব চাই আমার, সব… অনেক টাকা, বিদেশে সেটল করা, অনেক ফুর্তি…’

    পেয়েছে তো সে? পায়নি? তাহলে এমন ক্লান্ত লাগে কেন আজকাল? কেন আতঙ্কে রাতের ঘুম ভেঙে যায়? মনে হয় সব হাতের মুঠো থেকে খসে যাচ্ছে, মনে হয় খ্যাপা কুকুরের মত ওকে তেড়ে আসছে সবাই?

    সে কি গত সপ্তাহে অফিসে আইয়ারের চুপি চুপি বলা কথাটার জন্য?

    কী রিপোর্ট গেছে তার বিরুদ্ধে ক্লায়েন্ট কোম্পানির এইচ আর-এর কাছে? তারা কী জানিয়েছে ওদের কোম্পানিকে? কে করল রিপোর্ট? ওর আন্ডারে নতুন জয়েন করা বাচ্চা মেয়েটার এত সাহস হবে?!

    পার্থ টের পায় সে আবার ঘেমে উঠছে। বোতলটা…

    উফ!

    বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলেই দেয় ওটা। মোটা বোতল, ভাঙে না, কিন্তু হাতের ফিরতি ঝটকায় গ্লাসটা পড়ে ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়।

    গত কয়েকদিনের টেনশনে কার্পেটটা ক্লিনার্স থেকে আর আনা হয়নি।

    ---

    কলিং বেলটা বাজিয়ে নার্ভাসভাবে দাঁড়িয়ে ছিল রাজীব। আজ রাস্তায় কী জ্যাম। ম্যাডাম নাকি খুব বদমেজাজি ইয়াসিন বলছিল, এই কুড়ি বাইশ মিনিট লেটের জন্য আবার ফোন করে কমপ্লেইন না করে বসে থাকেন এর মধ্যে।

    দরজাটা খুলতেই ঠান্ডা এসির হাওয়ার একটা ঝলক ওর ঘামে ভেজা শরীরে এসে লাগল।

    “ইতনা লেট করতে হো, মেরা কেয়া আউর কুছ কাম নেহি হ্যায়?”

    নরম গলায় ক্ষমা চেয়ে কাজে লেগে পড়ে রাজীব। অ্যাকোয়াগার্ডটা ওদের রেকর্ডমতো অনেক দিনই সার্ভিস করানো হয়নি, কাজেই একটু সময় লাগবে বোঝা যাচ্ছে।

    টুয়েল্ভ পাস না করা বিদ্যা নিয়ে এটুকুও যে করেকম্মে খাচ্ছে রাজীব, ওই ইয়াসিনের চাচা সালেমের কৃতিত্ব সেটা। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছে, কলকাতায় তালিম দিইয়েছে, তারপর সুযোগ মতো ভারসোভায় ইয়াসিনের দোকানে পাঠিয়ে দিয়েছে এই মুম্বইতে। সেও আজ দশ বছরের উপর হয়ে গেল।

    ওপেন কিচেন। কাজ করতে করতেই সামনে সোফায় বসে থাকা ম্যাডামকে আড়চোখে দেখে নিল রাজীব। মুম্বইয়ের সব মেয়েই বেজায় সুন্দরী, ইনি তার মধ্যেও বেশ বেশি। মেক আপটাও করা আছে মনে হচ্ছে পরিপাটি, যদিও পরনে ড্রেসিং গাউন। মুখটা বেশ চেনা চেনা, নিশ্চয় অ্যাকট্রেস। এখানে তো সবই তাই। হয়তো সিরিয়ালে দেখেছে কখনও।

    রাজীবের ফোন বেজে উঠল। ইয়াসিন।

    “হ্যাঁ ভাই, পৌঁছেছি। কাজ করছি। সময় লাগবে গো, হলে বলছি।”

    অভ্যাসমতো বাংলাতেই বলেছিল রাজীব।

    ম্যাডাম, যার ঠিকানায় নাম লেখা ছিল সোনম খান্না, উঠে এলেন হঠাৎ।

    “তুমি বাঙালী?”

    ছিল কেতার হিন্দি উচ্চারণ, হয়ে গেল খাস বাংলা! কী বলবে ভেবে না পেয়ে রাজীব শুধু ‘হ্যাঁ’ বলে।

    “নাম কী? বাড়ি কোথায়?”

    রাজীব বলে।

    “টি কে বি স্যারের কোচিং এ আসতে না তুমি? তাই ভাবি এত চেনা চেনা লাগে কেন! আমায় চিনতে পারোনি তো?”

    এর ঘন্টাখানেক পরে রাজীব আর টুকাই সোফায় মুখোমুখি বসে ছিল। রাজীবের কাজ শেষ হয়ে যাবার পরেও যেতে দেয়নি টুকাইদি, ইয়াসিনকে ফোন করে বলেছে ওকে রাত্রের ডিনার খাইয়েই পাঠাবে। তারপর সুইগি থেকে ভাত আর ফিশ কারি অর্ডার করেছে, ফ্রিজ খুলে মিষ্টি বার করেছে, ক্যাবিনেট থেকে দামি ওয়াইন পেড়ে এনে, তারপর ও খায় না শুনে একাই ঢেলে নিয়েছে। ওর সমস্ত খোঁজখবর নিয়েছে, নিজের গল্পও ছাড়া ছাড়া কিছুটা বলেছে।

    সেটা সবটা যে বুঝেছে রাজীব তা না। এইটুকু শুধু বুঝেছে, টুকাইদি গোটা চারেক বিয়ে করেছিল, একটাও সুখের হয়নি। এখন ফিল্মের সঙ্গেই জড়িত কী যেন করে। সেই কোনও একটা বিয়েতেই এই নাম পদবী পালটে ফেলার ব্যাপারটা হয়েছিল। টুকাইদির যে এখন অঢেল পয়সা সেটাও বুঝতে অসুবিধে হয় না তার।

    এত আপ্যায়নে সে লজ্জা পাচ্ছিল। আবার গর্বও হচ্ছিল।

    “এবার উঠি গো দিদি। অনেক রাত হচ্ছে, তুমিও ঘুমোবে।”

    টুকাইদির মুখটা কেমন ভেঙেচুরে যায় ওর চোখের সামনে।

    “ঘুম তো আসে না রে রাজীব! ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যা না আজ?”

    এসব আবার কী কথা! রাজীব আঁতকে ওঠে। পায়ে পায়ে দরজার দিকে পিছিয়ে যেতে থাকে।

    “কী হল…? বাচ্চা নাকি তুই? এক রাতের তো মামলা! আয় না?”

    “তুমি বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছ টুকাইদি। প্লিজ। আমি যাই।”

    “কী করি জানতে চাইছিলি না? টাকা কামাই রে, শরীর বেচে টাকা কামাই। ওই খান্না আসলে এ লাইনের দালাল ছিল। সে মাল কবেই কেটেছে, তবে আমায় সেট করে দিয়ে গেছে। তুই ঘেন্না করছিস আমায়?”

    কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল টুকাইদির।

    “সে ঠিক আছে টুকাইদি, ও নিয়ে মাথা ঘামিও না। ভালোই আছো তো… আমি আজ যাই গো, দরজাটা…”

    “ভালো আছি মানে? যা চেয়েছিলাম তাই-ই পেয়েছি, জানিস? তোর মনে আছে সেই ছাতিম গাছ? তাতে সুতো বেঁধেছিলাম জানিস? বেঁধে চেয়েছিলাম কী বল তো? ‘আমার যেন টাকা আর সেক্সের কখনও অভাব না হয়’! হি হি… তখন মনে হয়েছিল ওই দুটোই মোক্ষ… দ্যাখ, একদম তাই-ই পেয়েছি কিন্তু, সত্যি জাগ্রত গাছ!”

    রাজীব দরজার সামনে পৌঁছে গেছিল।

    টুকাইদি আরও দু পা এগিয়ে এল ওর দিকে, পা টলছে দেখল রাজীব।

    “আমার রেট কত জানিস? আগে থেকে বুক করতে হয়? সেখানে তুই ফ্রিতে পাচ্ছিস, এই দ্যাখ…”

    দুটো অস্থির হাত ঝট করে ড্রেসিং গাউন খুলে ধরেছে। ভিতরে কিচ্ছু পরে নেই টুকাইদি। সুডৌল, ভরাট, বিশাল।

    রাজীব শুধু বলে, “ছিঃ, টুকাইদি!”

    দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে, একবারও আর পিছনে না তাকিয়ে ।

    ---

    “শোনো!”

    গার্গী। কখন যে সে উঠে এসেছে টেরই পায়নি পার্থ।

    পৃথুল, অপরিচ্ছন্ন বেশবাসের চেহারাটার দিকে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকাল পার্থ। চোখ ফোলা, গলার চামড়া ঝুলে পড়া, ফ্যাকাশে মুখের এই মহিলাকে দেখে কে বলবে এ মেয়ের এককালে লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো রূপ ছিল। অথচ এরই জ্যেঠিমার এই বয়সেও কেমন টকটকে চেহারা!

    “কী চাই?” রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করে সে।

    “আমি বাড়ি চলে যাব। এখানে আর থাকব না।”

    “মানে?” খ্যাপা ষাঁড়ের মতো চিল্লে ওঠে পার্থ, “কতবার বলেছি এসব হাবিজাবি বকবে না? নেক্সট আমরা যখন দেশে যাব, তখন বাড়ি যাবে।”

    “না। আমি এক্ষুনি যাব। আমি তোমার সঙ্গে আর থাকব না।”

    পার্থর নেশা একটু একটু করে কেটে আসতে থাকে। চোয়াল শক্ত হয়। চোখের ঘোলাটে সাদা লাল হয়ে ওঠে।

    গার্গী অবুঝ বাচ্চার মতো মাথা নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছিল। না আঁচড়ানো চুলগুলো দুলছিল শ্যাওলাঝাঁঝির মতো। ও নড়ছিল বলেই হোক, বা পার্থর নিজের হাত পায়ের উপর কন্ট্রোল ছিল না বলেই হোক, মারটা অতিরিক্ত জোরে পড়ল। গার্গী ছিটকে পড়ল একদম।

    পড়ল সটান সেই ভাঙা গ্লাসে ওপর।

    ---

    ভারসোবার অভিজাত রাস্তায় মৃতদেহটা পরদিন সকালে চাঞ্চল্য তুলেছিল খুব, কারণ সাততলার জানলা থেকে গলে কার্নিশে বেরোনোর আগে সোনম খান্না তার একমাত্র পরিধেয় ড্রেসিং গাউনটিও খুলে রেখে এসেছিলেন।

    ---

    পার্থ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল ঘরের মেঝেতে ক্রমে বেড়ে ওঠা রক্তের পুকুরের দিকে। ধারালো কাচ গলাতেই গেঁথে যাবে, মোক্ষম জায়গায়, কে ভেবেছিল। ঘড়ঘড় আওয়াজটা থেমে যাওয়ার পরেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না কী ঘটে গেল মুহূর্তে।

    ফোন বাজার শব্দে তার হুঁশ ফিরল।

    ছোট্ট কথোপকথনের পর রিসিভারটা যখন নামিয়ে রাখছে পার্থ তার মুখে ছাইয়ের প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে যেন কেউ। অন্যপ্রান্তে ওর নিজের কোম্পানির এইচ আর ছিল।

    গার্গীর পাথর হয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল পার্থ খানিকক্ষণ। তারপর ঝড়ের মতো বেডরুমে ঢুকে গেল। নিজের আলমারির লুকোনো ড্রয়ার টেনে খুলে তার থেকে বার করে আনল স্টকের ওষুধগুলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মুখে চালান করল।

    একসঙ্গে চল্লিশটাই।

    ---

    টুকাইদির খবরটা পেয়ে অবধি মনটা অস্থির হয়ে ছিল। পেন্ডিং কল কটা সেরে নিয়েই ইয়াসিনের কাছে ছুটি চেয়ে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল রাজীব।

    ঈশানীর সঙ্গে দেখা হল একদম আচমকা। রাজীব এমনিই ঘুরছিল, টিকেবি স্যারের বাড়ির সামনে। স্যারেরা অনেক আগেই উঠে গেছেন এখান থেকে, কিন্তু ওর মনে এই বাড়িটা টিকেবির কোচিং হয়েই থাকবে। টুকাইদির বাড়ি।

    ঈশানীই হঠাৎ ডেকে উঠল।

    “অ্যাই! তুই রাজীব না?”

    অনেক মোটা হয়েছে, গিন্নিবান্নি চেহারা, কপালে সিঁদুর। কিন্তু মুখটা তেমনিই, চোখে তেমনি হাসি। চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি রাজীবের। ওর মুখেই পার্থ আর গার্গীর খবর পেল রাজীব। গার্গীর কেমন যেন আত্মীয় হয় ওর শ্বশুরবাড়ি, তাই ওদের বাড়িতে এখনও যাতায়াত আছে ওর।

    শুনে থমকে গেল রাজীব। টুকাইদির কথা বলবে বলবে ভেবেও শেষ অবধি আর বলে উঠতে পারল না ওকে।

    বড়ো অস্বস্তি হচ্ছিল।

    “হ্যাঁ রে, তোর মনে আছে, দীপা এই গাছটা নিয়ে কী বলেছিল?”

    “ধুর! ও তো সব বানাত। কেন রে, তুই বুঝি সুতো বেঁধেছিলি? কী চেয়েছিলি? টুকটুকে রাজকন্যা?”

    রাজীব ওর বোকা-বোকা হাসিটা হাসে।

    “ফলল?”

    এবার জোরে হেসে উঠতে অসুবিধে হয় না।

    “বিয়েই হল না তো টুকটুকে… বানানো গল্প বললি না!”

    আরও খানিক এমনি কথার পর ঈশানী চলে যায়।

    রাজীব পায়ে পায়ে ছাতিম গাছটার দিকে এগোয়। তার বুকের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। দীপার কথাগুলো বড্ড কানে ভাসছে।

    যা পাবে তার দাম দিতে হয়…

    টুকাইদি ওকে বলেছিল ও কী চেয়েছিল। যা চেয়েছিল, সব পেয়েছিল।

    গার্গীর কথাও ও জানে। গার্গীই বলেছিল। তারপর থেকেই ও আর গার্গীর ধারেকাছে যায়নি, সালেমচাচার কারখানায় ভিড়ে গেছিল যত জলদি পারে।

    ও খেটে অনেক রোজগার করতে পারে, টাকা জমাতে পারে না খেয়ে… কিন্তু ‘বিয়ে করে আমেরিকা নিয়ে যাবে’ এমন বর তো ও কখনো হতে পারবে না। গার্গীর সে ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল কিন্তু।

    আর পার্থকে সুতো বাঁধতে ও নিজের চোখেই দেখেছিল। কী চেয়েছিল কানে শুনতে না পেলেও, পার্থর মতো ছেলে যে অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সেও সব পেয়েছিল।

    দাম দিতে হবে, তাই না?

    মুখ তুলে দেখে রাজীব। গাছটা অবিকল আগের মতো আছে।

    ওকেও কি দাম দিতে হবে? এরকম ভয়ানক?

    ক্লাস টেনের সেই রোগা, হনু-উঁচু ছেলেটাকে আবছা দেখতে পায় রাজীব। ওই তো ওর সুতোটা, এখনো আছে। ছেলেটা ডিঙি মেরে ওই সুতোটা বাঁধছে, আর মনে মনে বলছে, “আমি যেন ভালো থাকি। ভালো থাকি যেন।”

    নাঃ, ওর কথা ফলেনি। ফলেছে কি?

    একদিক দিয়ে ভালোই আছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, যাহোক রোজগার করছে। ঝাড়াঝাপটা মানুষ, দায়দায়িত্ব নেই। কিন্তু খাওয়া পরা আর ডিউটির বাইরে আর কী আছে ওর জীবনে? সংসার হয়নি, করবে কিনা জানা নেই… আসলে কারো সাথে আর জড়াতে ইচ্ছে করে না। বিয়ে না করে কী পেল না, তা নিয়ে ভাবতেও ইচ্ছে করে না।

    হয়তো এই সব আশা আকাঙ্ক্ষা ঘুচে যাওয়া, এই নির্লিপ্তিই তার ইচ্ছাপূরণের দাম। হয়তো ওর লোভ ওদের তিনজনের মতো বিরাট ছিল না বলেই দামটাও ওদের মতো বিশাল নয়।

    কে জানে!

    দমকা হাওয়া বয়। ছাতিমের গন্ধে চারদিক ভরে ওঠে।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments