“প্রজাপতিটাকে সবুজ রঙ করলি কেন, ইডিয়ট? প্রজাপতি কখনো সবুজ হয়?”
এক রাশ সাদা বিরক্তি নিয়ে বাবা একটা সিগারেট ধরাল। ফানুসের মন হাল্কা বেগুনি কষ্টে টনটন করে উঠল।
বাবা কিচ্ছু জানে না! প্রজাপতিরা কত শান্ত, নিরীহ। আপন মনে ফুলে ফুলে ঘুরে বেরায়, সবাইকে কত আনন্দ দেয়! তাই জন্য ওরা শ্যাওলার মতো সবুজ।
বাবা এটাও জানে না যে চাঁদের রঙ হাল্কা গোলাপি। মায়ের ওই রঙের একটা শাল আছে, কাশ্মীর থেকে কেনা। ফানুস যখন ওই শালটা জড়িয়ে বসে থাকে, শালের ভেতর লেগে থাকা মা মা গন্ধটা শোঁকে, তখন ওর মনে হয় মা ওকে জড়িয়ে বসে আছে। চাঁদের আলো দেখলেও ফানুসের ওইরকম লাগে। মনে হয় চাঁদও আলোয় বোনা একটা চাদর দিয়ে ফানুসকে জড়িয়ে নিয়েছে। মাঝে মাঝে ধূসর মেঘ এসে চাঁদ ঢেকে দেয়। তখন আকাশে রাগী রাগী কমলা বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে।
পাখিরা সব হলুদ-সবুজ, কিন্তু রাস্তার বেড়ালটার রঙ চায়ের লিকারের মতো। ঝর্ণামাসীর করা চায়ের লিকার কোনদিন হয় কমলা, কোনদিন বাদামী, কোনদিন খয়েরী। কোনদিন যে কি রঙ হবে ঝর্ণামাসী নিজেও বোধহয় জানে না। বেড়ালটার স্বভাবও ঠিক ওরকম। কখনো ফানুসের পা ঘেঁষে দাঁড়ায়, আদর চায়, আবার কখনো এমন ভান করে যেন ফানুসকে চেনেই না। গম্ভীরমুখে অন্য বাড়ির পাঁচিল বরাবর হেঁটে চলে যায়। পাড়ার দুটো কুকুর লালু আর ভুলু আবার পুরো উল্টো। ফানুসকে দেখতে পেলেই বাটারস্কচ আইস ক্রীমের মতো হলুদ রঙের আশা নিয়ে ছুটে আসে, আর ফানুসও বাড়ি থেকে চুরি করে আনা বিস্কুটটা, পাঁউরুটিটা ওদের খেতে দেয়।
রঙ যে শুধু জীবন্ত প্রাণীদের আছে এমন কিন্তু নয়। বাড়িরও রঙ থাকে। যেমন ফানুসদের বাড়ির রঙ মন খারাপ করা নীল। আর দিদানের বাড়ির রঙ উজ্জ্বল বাদামি। ঠান্ডা জল খোঁচাখোঁচা রুপোলী রঙের হয়, আর গরম জল হয় গোলগোল আকাশী রঙের।
এই সব নিয়ে ফানুসের একটা নিজস্ব জগৎ আছে। সেখানে প্রত্যেকটা জিনিসের আলাদা রঙ আছে, শব্দ আছে, গন্ধ আছে। বললে ফানুস মা বাবাকেও সেসব চেনাতে পারত, কিন্তু কোনদিন তাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি।
কলিং বেল বেজে উঠল। বাবাই দরজা খুলে দিল। আজ রবিবার বলে বাবার অফিসে ছুটি। মারও ছুটি আছে, তবে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছে।
“ফানুস বাড়ি আছে, কাকু?”
বাঁশির মতো সুরেলা গলার আওয়াজ ভেসে এল।
গাবলু এসেছে!
ফানুসের মনের ভেতর সোনালী আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। গাবলু এসে গেছে মানে এবার খেলতে যাওয়া হবে! ফানুস তো সেই কখন থেকেই খেলার জন্য রেডি। বাবার দিকে তাকিয়ে মনে হলে ও খেলতে গেলে বাবাও খুশী হবে।
দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ল। গাবলু ফানুসদের ওপরের ফ্ল্যাটে থাকে। ফ্ল্যাটবাড়িটার নীচে এক টুকরো ঘাসে ঢাকা জমি আছে। ওটাই ওদের খেলার 'মাঠ'। রোজ বিকেলে দুই বন্ধু ওখানেই গিয়ে বসে।
“তোরা যেন কবে আমেরিকা যাচ্ছিস?” ফানুস গাবলুকে জিজ্ঞেস করল।
“এই তো, বুধবার।”
“ওখানে উল্টো হয়ে হাঁটতে পারবি? পড়ে যাবি না?” ফানুস গতকালই শুনেছে আমেরিকা ভারতের একদম উল্টো পিঠে। সেই থেকে তার মাথায় চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছে।
“ধুর!” গাবলু ঘাসের ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। “আমরা কি আকাশে পা দিয়ে হাঁটব নাকি? মেঝেতেই পা থাকবে শুধু উল্টো হয়ে ঝুলব।”
“মা বলেছে উল্টো হয়ে ঝুললে মাথায় রক্ত উঠে যায়।”
গাবলু একটু চিন্তা করে বলল, “সেটা প্র্যাক্টিস করতে হবে।”
ফানুস গাবলুর পাশে শুয়ে আকাশের গায়ে লেগে থাকা মেঘের টুকরো দেখতে লাগল। সেই বেগুনি কষ্টটা আবার তার মনে ফেরত আসছে। তার সঙ্গে মন খারাপ করে দেওয়া নীল রঙ। বুধবার থেকে সে কার সঙ্গে খেলা করবে?
“বাবা বলেছে আমায় পুজোয় আসতে দেবে,” গাবলু হঠাৎ বলে উঠল।
এক ঝলক হলুদ আশা দেখা দিল।
“তোরা সবাই আসবি পুজোয়?”
গাবলু মাথা নাড়ল।
“মা বাবা ছুটি পাবে না। আমি কাল খুব কাঁদলাম বলে বাবা বলল, ঠিক আছে তোকে একা পাঠিয়ে দেব। গিয়ে ফানুসদের বাড়িতে থাকিস।”
কথাটা ফানুসের বিশ্বাস হয় না।
“অত দূর থেকে তুই একা আসতে পারবি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ,” গাবলুর গলায় তাচ্ছিল্যের সুর। “আমি কত প্লেনে উঠেছি!”
গাবলুর কথায় ভরসা পেয়ে ফানুসের বাকি সন্ধেটা কেটে গেল। মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে, এ বছর পুজো অক্টোবরের শুরুতে পড়েছে। তার মানে মাঝে মোটে তিনটে মাস। তারপরেই গাবলু আমেরিকা থেকে চলে আসবে আর ওখান থেকে অনেক চকলেট আর খেলনাও আনবে। ফানুসের মনে আনন্দের জোয়ার খেলতে থাকল।
কিন্তু সব আনন্দেরই শেষ আছে। দেখতে দেখতে রবিবার শেষ হয়ে সোমবার এসে গেল। তার মানে ছুটির দিন শেষ হয়ে আবার স্কুল শুরু। আর স্কুল মানেই একটা সাদা কালো জগৎ – যেখানে গিয়ে ফানুসের মনের সব রঙগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। পড়ার বইয়ের পাতার মতোই সব সাদা কালো হয়ে যায় - সারাদিন শুধু মিসদের সাদা বিরক্তি আর ফানুসের মনে কালো আতঙ্ক। পাশের বন্ধুর দিকে তাকালে বকা, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে বকা, কিছু বুঝুক আর না-ই বুঝুক, মিসের মুখের দিকে পুরো সময়টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হবে।
আগে তবু গাবলু ওর সঙ্গে এক বাসে যেত, আজ থেকে আর ফানুসের কোন সঙ্গীও রইল না। হাঁ করা রাক্ষসের মতো স্কুল বাসটাতে উঠে ফানুস বুঝল একা হয়ে যাওয়ার রঙটা হল মনমরা ধূসর। বাড়িতেও এই রঙটা কয়েকবার এসেছে, তখন ফানুস আলাদা করে চিনতে পারে নি।
স্কুলের পড়া শেষ হলে মিস হোমওয়ার্ক প্রজেক্ট দিলেন। এই সপ্তাহের প্রজেক্টের নাম 'মাই হোম'। শুক্রবার সবাইকে একটা করে কার্ডবোর্ডের বাড়ি বানিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বাড়ির কি মাপ হবে, কত ইঞ্চি বাই কত ইঞ্চি তাও বলে দেওয়া হল।
একটা ছোট্ট হাত হাওয়ায় নেচে উঠল। অদ্রীশ জানাল যে ও মিসের কথা কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। অমনি মিসের দিক থেকে এক রাশ রাগ আগুনের মতো দাউদাউ করে ছুটে এল।
“ক্লাসে মন দেবে না, কোন কথা শুনবে না তো বুঝবে কেমন করে? সারাদিন শুধু হুলিগানের মতো লাফিয়ে বেরাবে! তোমার মাকে এসে দেখা করতে বলবে! খাতা দাও, আমি লিখে দিচ্ছি!”
মিসের বকা শুনে অদ্রীশ ভয়ে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেল। তাই দেখে ফানুস আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসই পেল না। পাশে বসা দেবপর্ণাকে এক ফাঁকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করে-
“মিস কি বলল কিছু বুঝতে পারলি?”
দেবপর্ণা জানাল যে সেও কিছু বুঝতে পারে নি, তবে সবটা খাতায় লিখে নিয়েছে। বাড়িতে গিয়ে মাকে দেখালে মা বুঝে নেবে। ফানুস দেবপর্ণার খাতা থেকে টুকতে শুরু করে দিল।
“আহেলি!”
মরেছে! মিস ফানুসকে দেখতে পেয়ে গেছেন।
“আমি যখন কথাগুলো বলছিলাম তখন না লিখে এখন পাশের জনের খাতা থেকে লিখছ কেন? ও ভুল লিখে থাকলে তো তুমিও ভুল করবে!”
ফানুস ভয়ে জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়াল।
“সরি মিস।”
মিস আর কিছু বললেন না। বুক টিপে ধরা আতঙ্কটা একটু দূরে সরে গেল। একেবারে চলে গেল না। ইঁদুরের অপেক্ষা করা বেড়ালের মতো একটা অন্ধকার কোণায় ঘাপটি মেরে সু্যোগের আশায় বসে রইল। কিন্তু ভাগ্য ভালো, বাকি দিনটা আর তেমন কিছু ঘটল না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফানুসের জীবনে নতুন সমস্যা দেখা দিল। মা'র কাছে প্রজেক্টের কথাটা পাড়তে হবে। সারাদিন অফিস করার পর ফানুসের স্কুলের পড়া দেখতে মা খুব বিরক্ত হয়। এমনি ফানুস মাকে মোটেই ঘাঁটাতে চায় না। খুব মন খারাপ হলেও কখনো মায়ের শাল কখনো ওড়না জড়িয়ে ধরে কাজ চালায়। কিন্তু প্রজেক্ট করে দেওয়া শাল বা ওড়নার কম্ম নয়। সাক্ষাৎ রূপে মাকেই ধরতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ফানুস ঠিক করল রাতে খেয়ে ওঠার পর কথাটা পাড়বে।
ঝর্ণামাসী ওকে বাস থেকে নামিয়ে ম্যাগি বানিয়ে দিল। ফানুস আসার সময়েই দেখেছে গাবলুদের বাড়ি অন্ধকার। গাবলু ওকে বলেছিল, আমেরিকা যাওয়ার আগে ওদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। আজ বিকেলের খেলাটা হবে না ভেবে ফানুসের মনটাই দমে গেল।
অগত্যা ম্যাগি খেয়ে ফানুস বই খাতা খুলে বসল। বাড়ির মিস বলেছে কাল পড়া ধরবে। যদিও বাড়ির মিস অত রাগী নয়, তবুও মিস তো বটে। ঘাঁটাতে গেলে কপালে কি জুটবে কিছুই বলা যায় না।
রাত হয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষ। ফানুস খাতা হাতে মা বাবার ঘরে ঢুকে এল। মা ফোনে কি দেখছে, মুখে হালকা হাসি। ফানুসকে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে।
“মিস একটা প্রজেক্ট দিয়েছে, এই ফ্রাইডে সাবমিট করতে হবে,” অপরাধীর মতো ফানুস স্কুলের খাতাটা বারিয়ে ধরল।
মা খাতায় চোখ বোলালো। দেখতে দেখতে মুখের হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল। ফানুস যা ভয় পেয়েছিল ঠিক সেটাই হল।
“বাড়ি বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে মানে? এটা কি ধরণের আবদার? অদ্ভুত স্কুল তো, বাচ্চা যে প্রজেক্ট নিজে করতে পারে না সেটা হোমওয়ার্ক দেওয়ার মানেটা কি? এটা কি বাচ্চার হোমওয়ার্ক না গার্জেনের হোমওয়ার্ক?” খাতাটা মা ফানুসের হাতে ফেরত দিয়ে দিল। “আমি এখন খুব টায়ার্ড আছি, তোমার বাবাকে বল হেল্প করতে!”
বাবা ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকাল।
“আমি এখন কোন হেল্প করতে পারব না, আমার নিজের অফিসের প্রজেক্ট নিয়েই সারা সপ্তাহ কেটে যাবে।”
“মানে?” মা রুক্ষস্বরে বলল, “চাকরি কি একা তুমি কর? আমার অফিসের প্রজেক্ট নেই? আমি কোন চোরের দায়ে ধরা পড়েছি যে ফানুসের সবকিছু আমাকেই করে দিতে হবে?”
বাবা হাত নেড়ে বলে, “বললাম তো আমি পারব না।”
“কিসের পারবে না?” মায়ের গলা থেকে কমলা আগুন বেরিয়ে আসে। “বিয়ে করেছ, বাচ্চা করেছ, এখন দায়িত্ব নিতে পারবে না বললে তো চলবে না!”
বাবার বিরক্তিতেও ধীরে ধীরে কমলার ছোপ লাগে।
“এই সংসারের দায়িত্ব আমি নিই না তো কাজগুলো কি ভূতে করে দেয়? সারাদিন অফিসের খাটনি তারপর বাড়ি ফিরে যত উটকো ঝামেলা!”
“বাড়ির ঝামেলা এত খারাপ লাগলে ডিভোর্স করে আলাদা হয়ে যাও!”
নিমেষে ঘরের আবহাওয়া গরম হয়ে উঠল। ফানুসের বাড়িতে ইদানিং এটা রোজকার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। আর সব কিছুর জন্য ফানুসকেই দায়ী করা হয়। ওর জন্যেই মা বাবার জীবনে এত অশান্তি...ওর জন্মানোটাই একটা অপরাধ হয়েছে। ফানুস কান চেপে ধরে ঘর থেকে পালিয়ে গেল। দরকার নেই মা বাবাকে হেল্প করতে বলার।
এদিক ওদিক ঘেঁটে একটা পুরনো জুতোর বাক্স নিয়ে এসে সেটা দিয়েই ফানুস বাড়ি বানানোর চেষ্টা করতে থাকল। তারপর এক সময়ে মনমরা হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পাশের ঘরে তখনও মা বাবা ঝগড়া করছে, কেউ তাকে গুড নাইট বলতেও এল না।
শেষ রাতে হঠাৎ ফানুসের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখে চারদিক নিঝুম হয়ে আছে। মা বাবার ঝগড়া কতক্ষণ চলেছে তা সে জানে না। এখন দু'জনেই পাশের ঘরে ঘুমচ্ছে।
বিছানা থেকে উঠে কি এক জেদের বশে ফানুস আবার ওর প্রজেক্টটা নিয়ে বসল। যদিও শুক্রবারের দেরি আছে, কিন্তু ও আর তর সইতে পারছে না। বাড়িটা ওকে শেষ করতেই হবে। চটপট আঙুল চলতে থাকে। বেশ অনেকক্ষণ যুদ্ধ চলল, তারপর ফানুস ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল।
এর বেশী তার আর ক্ষমতা নেই।
জুতোর বাক্সটার দশা দেখে ফানুসের হাসিই পেয়ে গেল। এটা আর যাই হোক মানুষের বাড়ি কিছুতেই হয়নি। যতই সেলোটেপ লাগাক আর রঙ করুক, একটা তোবড়ানো জুতোর বাক্সকে 'হোম' বানানোর ক্ষমতা ফানুসের নেই। মা বাবা হেল্প না করলে ও একা কিছুতেই পেরে উঠবে না।
কথাটা মনে হতেই কেন জানি ফানুসের মনের মধ্যে বিষন্ন নীল রঙ ছড়িয়ে পড়ল।
আস্তে আস্তে ফানুস বাক্সটাকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তারপর গ্রিলের ওপর দিয়ে সেটাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিল।
কারুর মাথায় পড়ল না তো?
ফানুস সেটা দেখতে পেল না, কারণ গ্রিলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে দেখার মতো লম্বা সে এখনো হয় নি।
রাস্তার আলোগুলো এখনো নেভায় নি, তবে বাড়িগুলো অন্ধকার। দূরে একটা কুকুর একটানা ডাকছে। ভোর হওয়ার ঠিক আগের এই সময়টা ফানুসের খুব বিচ্ছিরি লাগে। যেন রাত ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে, কিন্তু নিজের গায়ের বাসি চাদরটাকে ফেলে রেখে গেছে। ফানুসও এখন সেই চাদরটার মতোই একটা ফেলে যাওয়া জিনিস। মা, বাবা, দিদান, দাদুভাই, গাবলু সবাই ওকে ফেলে রেখে একটা অন্য জগতে চলে গেছে। ও একাই শুধু বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে আসা এসির শব্দ শুনছে। কোথা থেকে চোখের জলের মতো হাওয়া এসে ওর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল।
সারি সারি ফ্ল্যাটের মাথা আর ঘিঞ্জি শহরটা থেকে চোখ সরিয়ে ফানুস আকাশের দিকে তাকাল। সেখানে হাল্কা হতে শুরু করা নীলের মধ্যে বেগুনির ছোপ লেগেছে। কিছু জায়গা এখনো ধূসর।
ফানুস বুঝতে পারল ওই একই রঙগুলো ওর বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মনকে উদাস করে দেওয়া সেই অনুভূতিটার নাম কি সেটা অবশ্য ও জানে না।