• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৮ | অক্টোবর ২০২২ | গল্প
    Share
  • হরাওয়ালী দুলহন : গোপা দত্তভৌমিক



    হরাওয়ালী দুলহন যেদিন আমাদের বাড়িতে এল, সেদিন কী একটা ফল্ট হয়ে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। আমি আর আমার ছোটো জা বুল্টি ঘরে ঘরে মোমবাতি দিচ্ছিলাম। শাশুড়ি তাঁর ঘরে ঠাকুরের আসনের সামনে সন্ধ্যা দিতে বসেছেন, দরজার কড়ানাড়া শুনে শোবার ঘর থেকে রজত বেরিয়ে এসে বলল, ‘বোধহয় সুব্রত এল, অফিসে ফোন করেছিল, আসব বলল।’ আমি ঢাকা বারান্দা পার হয়ে সদর দরজাটা খুলে দেখি সত্যিই সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে।

    রজতের স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সুব্রতই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। রজত কলরব করে এগিয়ে এগিয়ে এল। সুব্রতর হাতে একটা লম্বা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট আমার চোখে পড়েছিল। সুব্রত খুবই ঘনিষ্ঠ বলে বসার ঘরে না গিয়ে সরাসরি ওকে আমাদের শোবার ঘরেই নিয়ে আসে রজত ববারর। আমাদের ঘরে টেবিলে প্যাকেটটা রেখে সুব্রত বলল, ‘খুলে দ্যাখ। তোদের জন্য একটা দুর্দান্ত পুতুল এনেছি।’

    এটা-সেটা উপহার দেওয়া সুব্রতর স্বভাব। অফিসের কাজে ট্যুর করতে হয় ওকে, নানা জায়গায় যায় আর টুকটাক কিনে আনে বন্ধুদের জন্য--রজতের জন্য তো বটেই।

    মোমবাতির ম্লান আলোয় রজত প্যাকেটটা খুলতেই একটা দেড়ফুট মতো লম্বা কাঠের তৈরি মেয়েপুতুল বেরিয়ে এল। আধো অন্ধকারে মনে হল হঠাৎ যেন পুতুলটার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। ভাবলাম নিশ্চয়ই সে আমার মনের ভুল। রজত আমার হাতে পুতুলটা তুলে দিল। কাঠ কুঁদে নাক মুখ চোখ, চমৎকার রংকরা নাকে কানে সিঁথিতে হাতে গলায় চকচকে নানারঙের পুঁতির গয়না। পরনে সবুজ চিত্রবিচিত্র ছাপা কাপড়ের ঘাগরা, চোলি, মাথায় সবুজ ওড়না; তাতে সলমা চুমকি ঝিকমিক করছে, পাটের আঁশের কালো রংকরা চুল লম্বা বেণী করা, তাতেও পুঁতির ফুল ঝুলছে।

    ‘এর নাম হরাওয়ালী দুলহন।’

    সুব্রতর মুখে ভারি খুশির হাসি।

    আমি টিপ্পনী কাটতে ছাড়লাম না, ‘বাব্বা! এর আমার নাম দিয়েছো তুমি। এমন দুলহন পছন্দ বুঝি? তা বললেই হয়।’

    সুব্রত আয়েস করে গদিমোড়া সোফায় পা তুলে বসল। ‘আগে ভালো করে চা খাওয়াও কুহু, সঙ্গে তোমার ফেমাস পেঁয়াজি চাই। পুতুলের নাম কি আর আমি দিয়েছি!’

    ‘তবে কে দিল এমন নাম?’

    ‘পুতুলওয়ালী বুড়ি। শিমুলতলার দিকে কাজ ছিল, কাছে একটা মেলা হচ্ছিল, গেঁয়ো মেলা--তা বিকেলে একটু ঘুরতে গেছি দেখি এক বুড়ি সাত-আটটা এমন পুতুল নিয়ে বিক্রি করছে। নেবার জন্য ঝুলোঝুলি, বলল এই পুতুল ঘরে থাকলে শত্তুর কিছু করতে পারবে না। তা, একটা কিনে ফেললাম।’

    রজত পুতুলটা নেড়েচেড়ে দেখছিল, ‘বেশ দেখতে রে পুতুলটা। তুই নিজে রাখতে পারতিস।’

    ‘আরে একা মানুষ, থাকি কোনোরকমে মাথা গুঁজে, আমার ঘরে কি এসব মানায়। তোরা সাজিয়ে রাখ।’

    আমার কেমন মনে হল রজতের হাতে পুতুলটা মুচকি হাসল যেন। কেমন খুশি খুশি। আমার হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিল। ‘এরকম নাম কেন সুব্রত তোমার পুতুলের?’

    ‘আরে সবুজ সাজপোশাকের জন্য। বুড়ি আরো পুতুল দেখিয়েছিল ‘পীলাওয়ালী, লালুওয়ালী, নীলাওয়ালী--এই সব নাম দিয়েছে। বলল এরা দুলহন তো, নিজেরা দুলহা খুঁজে নেবে।’

    আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘আমাদের বাড়িতে দুলহা কোথায়? রজত আর রাহুল দুজনেই তো বিয়ে করে ফেলেছে, দুলহা তো তুমি। এটা তুমি নিয়ে যাও।’ তক্ষুনি রজতের ভুরু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে, ‘আরে! মাথা খারাপ হল নাকি তোমার কুহু? মনে করো একটা উপহার এনেছে সুব্রত, সেটা ফেরত দিচ্ছ? যাও এক্ষুনি বাইরের ঘরে একটা হুকে এটা টাঙিয়ে দাও।’ বড্ডো রাগী আমার বর, একটুতেই ওর মেজাজ চড়ে যায় আবার সেই মেজাজ পড়ে যেতেও দেরি হয় না। তখন আমাকে খুশি করার জন্য ঘুরঘুর করে। ওর কথামতো বসার ঘরে সোফার ওপরে দেয়ালে একটা খালি হুকে পুতুলটা ঝুলিয়ে দিলাম। একটা লোহার আংটা দেখলাম পুতুলটার মাথায় বসানোই আছে ঝোলানোর সুবিধার জন্য। ঝোলাবার সঙ্গে সঙ্গেই মিঠে একটা সরু গলা আওয়াজ কানে গেল, ‘বহোৎ শুক্রিয়া’--কে বলল কথাটা? ঘরে তো কেউ নেই। পুতুলটার লাল ঠোঁটে টেপা হাসি। সেই মুহূর্ত থেকে হরওয়ালী দুলহনকে ভয় করতে লাগল আমার। আমার কানে কোনো গণ্ডগোল নেই, স্পষ্ট শুনেছি। কিন্তু কারুকে বলতে পারলাম না, সবাই পাগল ভাববে।

    আমার তখন প্রায় তিন মাস চলছে, বিয়ের পর পাঁচ বছর বাচ্চাকাচ্চা হয়নি বলে আমার শাশুড়ির ভুরু একটু কুঁচকে যেত আমাকে দেখলে। আমার দু বছর পরে বিয়ে হয়ে বুল্টির কোলে এক বছরের ফুটফুটে ছেলে তেজো। আমি খুব নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যখন সন্তান সম্ভাবনা হল। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই বসার ঘরে বসে রোজকার মতো টিভি খুলে খবর শুনছি, তেজো ঘুমোচ্ছে শাশুড়ির কোলে। সকলেই খবর শোনার ফাঁকে ফাঁকে পুতুলটা দেখে তারিফ করল। টিভির খবরের থেকে নানারকম পুতুল নিয়েই চর্চা বেশি হল। রাহুল বলল সে এরকম পুতুল নেপালে দেখেছে বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেক করতে গিয়ে। সত্যিই পুতুলটার হলদে গায়ের রঙ, চেরা চেরা চোখ আর কোনাচে মুখে কেমন নেপালি নেপালি ভাব। ভাবলাম সুব্রতকে পরে জিজ্ঞাসা করবো সেই পুতুলওয়ালী কি নেপালি ছিল?

    সবাই শুতে যাবার পর আমি বসার ঘরের দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি দিলাম। সকালে প্রথম ঐ ঘর খুলে ঝাড়ামোছা করা আমার প্রতিদিনের প্রথম কাজ। ঘরটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখার ভার আমি নিজেই নিয়েছিলাম। দু-একটা সুন্দর ইনডোর প্ল্যান্টও রেখেছি শোভা বাড়াবার জন্য। কিন্তু পরদিন সকালে বসার ঘরে ঢুকে আমার মাথা পুরো ঘুরে গেল। সোফার ওপরের হুক থেকে সরে গেছে হরাওয়ালী দুলহন--এখন সে ঝুলছে পারিবারিক ফোটোগ্রাফ টাঙানো দেয়ালে--ঠিক রজত আর আমার বিয়ের পর জোড়ে তোলা ছবির পাশের হুকে। চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, সপাটে আছাড় খেয়ে পড়ার জন্য গর্ভপাত হয়ে গেছে আমার। সে কী রক্ত! সবাই মাথায় জল ঢালছে, জলে রক্ত সপ্‌সপ্‌ করছে আমার শাড়ি। নার্সিংহোমে কয়েকদিন থাকতে হল।

    কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না আমার কথা, সকলেই বলল পুতুলটা নিজে কখনোই যেতে পারে না, আমিই ওটা সরিয়ে রেখে পাগলামি করছি। শাশুড়ি বললেন, গর্ভাবস্থায় নাকি অনেকসময় হিস্টিরিয়া হয়। আমার শাশুড়ি, একটু সবজান্তা ধরনের, তার ওপর বিধবা হওয়ার পর একা হাতে দুই নাবাল ছেলেকে মানুষ করেছেন। কেউ এই বাড়িতে তাঁর মুখের ওপর কথা বলে না। আমার হিস্টিরিয়া সাব্যস্ত হয়ে গেল। রজত খুবই আশাহত হয়েছিল অ্যাবর্শন হয়ে যাওয়ায়, কিন্তু পুতুলটার ব্যাপারে কিছুতেই বিশ্বাস করল না।

    ডাক্তারের নির্দেশে কিছুদিন পুরো বিশ্রামে কাটল আমার। খুব মনখারাপ থাকত। বাচ্চাটা পেটে রইল না… একা একা দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম। বাপের বাড়ি গিয়ে দুদিন জুড়োবো সেই উপায় নেই, মা, বাবা দুজনেই গত হয়েছেন। বিয়ে দিয়ে দেবার পর আর বাপের বাড়ি যাই, বৌদি একেবারেই চায় না। ছেলেপুলে নিয়ে তার সাজানো সংসারে আমাকে উটকো উৎপাত মনে করে। দাদার মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস নেই। রজত অফিসের পর কীসব কাজে ব্যস্ত--ফিরতে রাত হয়।

    বড্ডো একা লাগছিল বলে একদিন দুপুরে শাশুড়িকে বলেই স্কুলের বান্ধবী চিত্রিতার কাছে চলে গেলাম। ও থাকে টালিগঞ্জে, আমাদের পঞ্চসায়রের বাড়ি থেকে খুব দূর নয়। ওর বিয়ে হয়েছে ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে। ওদের বাড়িতে গিয়ে অনেকদিন পর গলা ছেড়ে হাসলাম, ওর বাচ্চা মেয়েটার টেবো টেবো গালে চুমু খেয়ে অস্থির করে দিলাম। চিত্রিতার শাশুড়ি খুব মিষ্টি স্বভাবের মহিলা--কতো কী খাওয়ালেন। সন্ধ্যে গড়ালে ওদের বাড়ির গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেল আমায়। বেশ ফুরফুরে ছিল মেজাজটা, বুল্টি দরজা খুলে বলল, ‘দাদা অনেকক্ষণ ফিরে এসেছেন, তোমার খোঁজ করছিলেন। তাড়াতাড়ি চটি ছেড়ে শোবার ঘরে ঢুকেই চীৎকার করে আবার অজ্ঞান হয়ে গেলাম আমি। জ্ঞান ফেরার পর আমি নাকি প্রলাপ বকছিলাম, ‘ওকে তাড়াও, ওকে তাড়াও, পায়ে পড়ি ওকে তাড়াও।’ কী দেখেছিলাম? সে কথা বাড়ির কেউ বিশ্বাস করেনি।

    খাটে ওপাশ ফিরে শোওয়া রজতের পিঠের ওপর পুরো দস্তুর মানুষের আকৃতি নিয়ে ঝুঁকে আছে হরাওয়ালী দুলহন। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ ফিরিয়ে হাসল, চোখে সূর্মা, হলদেটে মুখ, লাল ঠোঁট।

    এবার রজতের সঙ্গে আমার নিত্য ঝগড়া শুরু হল। বিয়ের পর এমনটা কখনো হয়নি আর। মোটামুটি ভাবই ছিল আমাদের স্বামী-স্ত্রীতে। বাচ্চা না হওয়ার জন্য শাশুড়ি মুখ ভার করলেও রজত কখনো কথা শোনায়নি। পুতুলটা অশান্তি নিয়ে এল। আমি যতবার বলি, ‘ওই পুতুলটা ডাইনী, ওকে তাড়াও।’ রজত তত বলে আমার মাথার দোষ হয়েছে, বাচ্চা না হওয়ার জন্য টেনশন, তারপর গর্ভপাত—সব মিলিয়ে এমনটা নাকি হতেই পারে। এরই মধ্যে এক রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর রজত ঘুমোচ্ছে খাটে, আমি মেঘ করে আসছে দেখে ছেদে গেলাম শুকনো জামাকাপড় আনতে। ফিরে এসে আবার শুতে যাবো--দেখি আমার শোবার জায়গায় বিছানার চদরে কয়েকটা সলমাচুমকি ঝিকমিক করছে। এমন সোনালি চুমকি বসানো আছে হরাওয়ালী দুলহনের ঘাগরা, চোলি, ওড়নায়। রজতকে ডেকে তুলে দেখালাম, ও পাত্তাই দিল না। ‘তোমার কতো জামাকাপড়ে এমন চকচকে জিনিস আছে দেখেছি।’ যতোবার বলি সে সব জামা-শাড়ি তো আলমারিতে তোলা, খাটে কীভাবে আসবে, রজতের মেজাজ তত্তো চড়ে যায়।

    সেদিন ঝগড়া এতদূর গড়াল যে রাগের চোটে বসার ঘরের দেয়াল থেকে পুতুলটা নামিয়ে আমাকে খেলতে দিয়ে দিল রজত। আমি ভয়ে চীৎকার করতে করতে পুতুলটা ছুঁড়ে ফেলে তেজোকে কোলে নিয়ে বুল্টির কাছে দিতে দৌড়োলাম। বুল্টি রান্নাঘরে রাতের জন্য রুটি করছিল তখন। কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকেই আমি যেন জমে গেলাম। বুল্টি কোথায়? লম্বা টেবিলের সামনে পিছন ফিরে রুটি বেলছে হরাওয়ালী দুলহন--পুরো মানুষের চেহারা, ঝুন্‌ঝুন্‌ আওয়াজ হচ্ছে চুড়িতে। পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ ঘোরাল--মাথার ঘোমটা কঁধে খসে পড়েছে, চোখ দিয়ে যেন আগুন ছুটছে, লাল ঠোঁটের ফাঁকে চিরুনিদাঁত। এবার ধড়াম্‌ করে পড়ার সময় তেজোকে নিয়েই পড়েছিলাম। ভাগ্যি ভালো আমার কোলে থাকাতে খুব বেশি লাগেনি ছেলেটার, শুধু আমার হাতের কঙ্কণে লেগে ওর কপালে একটু কেটে গিয়েছিল। আমার নাকি দাঁতে দাঁত লেগে ফিট হয়েছিল, খিঁচুনি ধরেছিল হাতে পায়ে। তেজোকে কোলে নেওয়াই এরপর বারণ হয়ে গেল আমার। বুল্টি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, এসব আমার ঢং, হিংসের চোটে তেজোকে ব্যথা দিয়েছি আমি। মনে বড়ো কষ্ট হয়েছিল আমার, বাচ্চাটা আমার কতো আদরের কী করে বলি।

    এবার মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যেতেই হল আমাকে। তিনি ভাব দেখালেন যেন সব বিশ্বাস করছেন, আর লম্বা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন। সেসব ওষুধ খেলে শুধু ঘুম পায়। সারাদিন ঝিমোতে শুরু করলাম। বসার ঘরে পারতপক্ষে যেতাম না, গেলেই চোখে পড়ত পুরোনো জায়গায় বহাল তবিয়তে দুলছে আমাদের জোড়ে ছবির পাশে হরাওয়ালী দুলহন। ওর কব্জা দিয়ে লাগানো কাঠের হাত পা যে নিজে থেকে নড়াচড়া করে সেটা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। কতোবার রাতে পুতুলটার হাত দুটো সোজা করে রেখে যেতাম, সকালে দেখতাম কনুই ভাঁজ হয়ে আছে। রাতে ওর (…?) পা ডানদিকে ঘুরিয়ে দিতাম, সকালে দেখতাম ঠিক সোজা হয়ে আছে।

    সুব্রত এল একদিন, ওর সামনেই বিশ্রী ঝগড়া হয়ে গেল রজত আর আমার। দোষের মধ্যে আমি পুতুলটা নামিয়ে খবরের কাগজে মুড়ে সুব্রতকে ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। রজত ধরে নিল ইচ্ছে করে ওর প্রাণের বন্ধুকে অপমান করেছি আমি। সুব্রত বরং হাওয়া গরম দেখে বলেছিল, ‘কুহুর যখন এতো অপছন্দ, আমি বরং ওটা নিয়েই যাই।’ রজত আমাকে ঠেলতে ঠেলতে সুব্রতর সামনেই ঘরের বাইরে নিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “পাগলামির একটা সীমা আছে কুহু, এমন করলে তোমাকে ডিভোর্স করব আমি।’

    বুঝে গেলাম সোজা কথায় কিছু হবে না, কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই পরদিন যখন দুপুরে বাড়ি চুপচাপ, রজত, রাহুল অফিসে, শাশুড়ি নিজের ঘরে ভাতঘুমে মগ্ন, দামাল তেজোকে দরজা বন্ধ করে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে বুল্টি… আমি হুক থেকে পুতুলটা পেড়ে সোজা টিপিটিপি পায়ে ছাদে উঠে গেলাম। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা পোড়ো জমি--কে যেন বাড়ি শুরু করে শেষ করেনি, শ্যাওলা ধরা পাঁচিল আধখানা জেগে আছে। যতো রাজ্যের জঞ্জাল জমিটার, প্লাস্টিকের ভাঙা বালতি, ভাঙা ঝাঁটা, ছেঁড়া ব্যাগ, কানাভাঙা কাপ, রাজ্যের প্লাস্টিক প্যাকেট। ছাদ থেকে পুতুলটা জঞ্জালের স্তূপে জোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। শান্তি হল প্রাণে আমার। রজত আসার পর এক চোট ঝগড়া হবে বটে কিন্তু আর বাড়িতে ঢুকবে না ঐ অলুক্ষুণে পুতুল।

    কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, কেউ ডাকেনি আমায়। ঘুম ভাঙল--তখন রাত হয়ে গেছে। রজত তখনো আসেনি। উঠে দেখি শাশুড়ি চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন, ‘কুহু! খোকা কি কিছু বলে গিয়েছিল যে দেরি হবে?’ কিছু তো বলে যায়নি দেরির কথা।

    আজকাল ওর দেরি হয় বটে কিন্তু তাই বলে রাত দশটা কখনো করে না। রাত এগারোটা অবধি দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হল। রাহুল আর রজতের সব বন্ধুরা পরের সাত দিনে তোলপাড় করে ফেলল, শহর--হাসপাতাল, মর্গ, থানা, পুলিশ, মিসিং পার্সন, খবরে কাগজে বিজ্ঞাপন কিছু বাকি রইল না। রজত যেন কর্পূর হয়ে উবে গিয়েছে। ওর অফিসের দারোয়ান বিকেল পাঁচটার সময় রজতকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল। তারপরে আর কেউ ওকে দেখেনি।

    আমি পরদিন সকালে পাশের জমিতে সেই বুনো ঝোপে গিয়ে পুতুলটা খুঁজছিলাম--কোত্থাও নেই। না থাকারই কথা, তবু আশপাশে জঞ্জাল হাঁটকালাম। বৃথা সন্ধান। পুতুলটা না পেয়ে আমি রজত ফিরে আসবে এই আশা ছেড়ে দিলাম। ভয়ে দুঃখে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ ফুলে গেল। বুল্টি আর শাশুড়ি এই চরম বিপদে পুতুল নিয়ে আমার মাথাব্যথার কথা শুনে আরেকরকম পাগলামি ধরে নিল। ওরা আমাকে বোঝাতে লাগল পাড়ার কোনো বাচ্চা ওটা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, কিংবা কুকুর টেনে নিয়ে গেছে। আমি যেন অবুঝ ছেলেমানুষ। আমি কি জানি না ওই জঞ্জালভরা জায়গায় পাড়ার কোনো বাচ্চা যায় না, আমাদের পাড়ায় কোনো কাগজকুড়ুনিও আসে না। কে নেবে ঐ পুতুল একবেলার মধ্যে? কুকুর টেনে কতো দূর নেবে? আর কুকুর টেনে নিলে কি পুতুলটার পোশাকের চুমকি কয়েকটা জমিতে পড়ে থাকতো না? একটাও নেই--আমি ভালো করে দেখেছি।

    উধাও হবার দিন রজতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে মোটা টাকা তোলা হয়েছে ক্রমে জানা গেল। পুলিশ বার বার জিজ্ঞেস করছে আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি কি না। কী বলব আমি? ওদের ধারণা রজত কোনো গোপন অপরাধীচক্র, কোনো পাচারকারী দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তারাই ওকে লোপাট করে দিয়েছে। আমি তো জানি ওসব কিছু না, হরাওয়ালী দুলহন তার দুলহা খুঁজে নিয়েছে। গোড়া থেকেই লম্বা সুঠাম চেহারার রজতকে পছন্দ হয়েছিল ওর। ওরা দুজন চলে গেছে নেপাল কিংবা শিমূলতলায় অথবা অন্য কোনো দেহাতে। কোনো গমের ক্ষেতের পাশে, নাম না জানা নদীর ধা্রে নির্জন কুঁড়েতে ওরা সুখে সংসার পেতে বসেছে। ওদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, খুঁজে লাভ নেই।


    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments