বুনো ফুল, দূরে রকি মাউন্টেন
চন্দ্রাণী ক’দিন ধরে ফোনে বার বার বলছে “ক্যাম্পিঙে যাচ্ছি। চল, ঘুরে আসবি।” তিনি তো সপরিবারে রিক্রিয়েশানাল ভিহেকল (RV)-তে চেপে ওয়াটারটন ন্যাশনাল পার্কে (Waterton National Park) ক্যাম্পিং করবেন। ওদের আর.ভি. একটা চলন্ত বাড়ি। শুদ্ধ আর শিউলিও ওখানে ক্যাম্প করবে। এই স্বামী-স্ত্রীর জুটি ক্যানেডিয়ান বন্ধুদের সাথে ১০ বছর ধরে ক্যাম্প করছে। ওদের গাড়ির মাথায় তাঁবু ভাঁজ করা থাকে। গাড়ির উপরে মেলে দিলে দুজনে থাকবার দিব্যি ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাঁবুতে ঢুকে গেলেই, বিছানা, নরম লেপ--সব আছে। ছাদের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে আকাশও দেখা যায়। “Rooftop collapsible tent” এই রকম কিছু একটা গালভরা নাম থাকলেও, এটাকে “গাড়ি-বাড়ি” বলা যাক।
আমাদের না আছে RV, না আছে তাঁবু। ২০২০-এর ঘটনা হলেও মনে হচ্ছে যেন চোখের সামনে সব জীবন্ত দেখছি। তখন গ্রীষ্মে শুধুমাত্র কানাডার ন্যাশনাল পার্কগুলোই খোলা ছিল। শহরগুলোতে লকডাউন চলছে। হোটেলগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে, গিয়ে থাকতে নিরাপদ লাগছিল না। দিনে-দিনে ফিরলে – তিন-তিন ছ’ঘন্টার ড্রাইভ। তাছাড়া ওয়াটারটন-এ অনেকবার গেছি। চন্দ্রাণীর বর অভিজিৎদা বলল, “আমরা Cardston-এ Fort Heritage Frontier RV পার্কে ক্যাম্প করছি। ওয়াটারটন থেকে ৩০ মিনিট। একটা নতুন জায়গা, চলে এসো।”
গাড়ি-বাড়ি
শেষপর্যন্ত নাছোড়বান্দা বন্ধুদের জন্যই কার্ডস্টোনে আসা হোল। ওরা শুক্রবার রাত্তিরে চলে গেছে, আমরা শনিবারে যাচ্ছি। কার্ডস্টোন চাষিদের একটা ছোট্ট গ্রাম। মাত্র তিন হাজার লোকের নিবাস। এই RV পার্কটা সবে খুলেছে বলে, বেশি লোক জানে না। তাই ভিড় নেই। আমরা গিয়ে দেখি RV আর “গাড়ি-বাড়ি” পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। পিকনিক টেবিলে জোর আড্ডা চলছে। শুদ্ধ আর শিউলি একটু আগেই পাহাড় থেকে হাইকিং করে ফিরেছে। আমরা আসব বলে, খুব সকালে গিয়ে ফিরে এসেছে। কতদিন পরে সবাইকে দেখে কী যে আনন্দ হোল! করোনা-পূর্ব জীবনে আমাদের প্রায় প্রত্যেক উইকেন্ডে দেখা হোত। ক্যাম্প গ্রাউন্ডের কোনায় লাল টুকটুকে বাড়ি। সামনে ঘোড়া দাঁড়িয়ে।
এরা এই জমির মালিক। চারি দিকে যত দূর চোখ যায় ঘন সবুজ ঘাস। সামনে ছোট্ট লেক। দূরে রকি মাউন্টেন দেখা যাচ্ছে। লেকের জলে হাঁস পরিবার ছানাদের নিয়ে দিব্যি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে খেলছে। দূরে রাস্তা দিয়ে দু চারটে গাড়ি চলে গেলেই, যা কিছু আওয়াজ। তারপর চারি দিক নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ এই শান্তিতে থেকে মাথাটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল।
চাষীর বাড়ি
পথে জোরালো হাওয়া পেয়েছি। সৌরভকে রীতিমতন চেষ্টা করে গাড়ি সোজা রাখতে হচ্ছিল। এই অঞ্চলে প্রবল হাওয়াকে কাজে লাগিয়ে উইন্ডমিলে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি হয়। রাস্তার পাশে সারি সারি সাদা পোলের মধ্যে ফ্যানের মতন উইন্ডমিলগুলোকে আদিম স্থাপত্যের মতন লাগছিল। হাওয়ার দৌরাত্ম্যে বাইরে টেঁকা দায় হয়ে উঠল। করোনা পরিস্থিতিতে, সবাই মিলে RV-র ভিতরে ঢুকতে চাইলাম না। ওটা ওদের পরিবারের লোকেদের জন্যই থাক। শুদ্ধ পাকা ক্যাম্পার। ওর ঝুলিতে নানা ব্যবস্থা থাকে। সে মাথার উপরে ত্রিপল টাঙিয়ে দেওয়াতে বাইরে বসা গেল। জোর গল্প-গুজব হাসাহাসি চলছে। এই শান্ত জায়গায় আমরাই একমাত্র সশব্দ।
কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে। শিউলি বলছিল, “বাইরে রীতিমতন কনসার্ট শুনছিলাম।” আমি ভাবছিলাম “এই উলু জায়গায় কনসার্ট? তাও রাত্তিরে!” শিউলি বলছে “একটানা ব্যাঙ ডাকছিল। তারপরে ভোঁদড় গাইতে শুরু করল। আমি আর শুদ্ধ বাইরে এসে দেখি ঝিরিঝিরি ঠান্ডা হাওয়ায়, আকাশটা ছোট-বড় তারায় ছেয়ে গেছে। আকাশের উপর থেকে নীচে ছায়াপথ জেগেছে।” যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তো শহর থেকে অনেক দূরে এই জায়গাটায় লক্ষ-কোটি-তারায় ঠাসা ছায়াপথ দেখতে পাওয়া যায়। একবার আমরাও পাহাড়ে গভীর রাতে ছায়াপথ (Milkyway) দেখেছিলাম। সেই অপার্থিব দৃশ্যে প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে, গা ছমছম করে উঠেছিলো। এইসব বিরল অভিজ্ঞতা, কে ভোলে?
এর মধ্যে অভিজিৎদা চা বানিয়েছে। চা-এর সাথে টা খেতে খেতে, আড্ডা জমে উঠেছে। আমি বেমক্কা শুদ্ধকে বললাম, “তোমরা তো সামারে প্রত্যেক সপ্তাহেই ক্যাম্পিং-এ যাও। কিসের টানে?” ও একটু অবাক হোল। কারণ এতবছর মেলামেশায় এই প্রশ্ন কখনও করিনি। ও যা বলল, তা আমি নিজের ভাষায় লিখছিঃ
শহরের “concrete jungle”-এ, কাজের চাপে কিছু দিন পর পরই পালাতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া কানাডার ভয়াবহ শীতে আমরা তো আট ন’মাস বরফচাপা-বাড়িবন্দী থাকি। তাই সামার এলেই ক্যাম্পিং। চেষ্টা করি প্রত্যেক সপ্তাহে যেতে। জানুয়ারি মাসেই কানাডার সব ক্যাম্পিং-এর জায়গা বুক হয়ে যায়। তাই অনেক আগেই আমাদের প্ল্যান করতে হয়। অনেক বছর ধরে ক্যাম্প করে অভ্যাস। পুরো সিজিনে গাড়ির পিছনে ছোট-বড় বাক্সে জিনিস ঠাসা থাকে। ক্যাম্পের সাথে হোটেলে থাকবার কোন তুলনাই হয় না। আমরা খোলা আকাশের নীচে, গাছপালার মধ্যে, পাহাড়-নদীকে জড়িয়ে থাকি। প্রকৃতিতে থাকবার একটা নেশা আছে। সকালে পাখিরা তোমায় ডেকে ঘুম থেকে জাগাবে। দিনে পাহাড়ে হাইকিং-এ যাই, সাথে কিছু শুকনো খাবার। রাতে ফিরে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। কাঠের আগুনেই রান্না হয়। চারদিকে জন্তু জানোয়ারের ডাক, বহমান নদীর শব্দ। তুমি বাতাসের প্রত্যেকটা নড়াচড়া অনুভব করতে পারবে। বেশিরভাগ জায়গায় সেলফোন কাজ করে না। তাই বাইরের জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। মাথার মধ্যে কোন “to-do-list” নেই। তাড়া নেই। অনুভূতিগুলো খুব প্রখর, প্রকৃতিমুখী হয়ে যায়। নিজের ভিতরের কত কথা শুনতে পাই। ব্যস্ত জীবনে যা চাপা পড়ে থাকে। ক’দিনের জন্য একদম রুটিন থেকে হারিয়ে যেতে দারুণ লাগে! এটা সারা বছরের অক্সিজেন দেয়।
আমরা চুপচাপ শুনছিলাম। এবার আমি চন্দ্রাণীর দিকে ফিরি। ও বলে যে, RVটা চলমান বাড়ি, এর ভিতরে বাড়ির সব স্বাচ্ছন্দ্যই আছে। ছোট্ট কিচেন, সিঙ্ক, ফ্রিজ, বাথরুম। তবে আমরা ক্যাম্পিং-এ এলে রাতে ঘুমোতে যাওয়া ছাড়া বাকিটা বাইরেই থাকি। “শান্ত জায়গা খুব ভালো লাগে। জানিস, নিস্তব্ধতার একটা আলাদা শব্দ আছে। আমি তা এক মনে শুনি।” আমি ভাবছিলাম যে পাহাড়ের বিশালত্বের মধ্যে চলে গেলে, নিজেদের সমস্যাগুলো বড্ড জোলো লাগে। প্রকৃতি ধুয়ে-মুছে সাফা করে নতুন উদ্যম জীবনে ফিরিয়ে দেয়। জীবন বড্ড সংক্ষিপ্ত, যদি দূরে যেতে না পারি, হাতের কাছে যা আছে তাই দেখে নিতে হবে।
উইন্ডমিল
সৌরভ বলল, “তোর RVটা তো চলমান বাঙালি রান্নাঘর। আজ পোস্ত-বড়া পাওয়া যাবে?” আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, “এখানে পোস্ত – একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না।” দেখলাম চন্দ্রাণী-অভিজিৎদা দুজনেই মিটিমিটি হাসছে। আরো কিছুক্ষণ জমিয়ে গল্পটল্প করে, এবার আমাদের ফিরতে হবে। ওরা কাল ফিরবে। চন্দ্রাণী আজ ডিনারের ব্যবস্থা করেছে। আমরা আগে খেয়ে নেব। RVতে খাবার গরম হয়ে এল। আরি বাব্বা – ভাত, মাংস, মেথিশাক। আর …প্লেটের এক পাশে দুটো পোস্ত-বড়া জ্বলজ্বল করছে। না, ঠিকই পড়েছেন – কার্ডস্টোন ক্যাম্পিং-স্পটে বসে পোস্তর বড়া খাওয়া হোল। এবার তাঁবুর বাইরে থেকেই ফিরে এলাম। দেখা যাক, যদি পরের বছরে সবাই মিলে ক্যাম্পিং করা যায়।