পঞ্চাশ বছর পর বাতিল ফেয়ার-ওয়েদার ব্রিজটার অবহেলিত অবশেষ দেখতে দেখতে আশামুকুল কয়েক মুহূর্তের জন্য স্মৃতির গোলোকধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলল। চারপাশে আধুনিক শহরের কর্মব্যস্ততা। তামা কারখানার যান্ত্রিক শব্দ। ওর মানসিক অস্তিত্বে সবকিছু মায়াবী স্থবিরতায় অনড়। এমনকী চোখের লেন্সে বিম্বিত অনেক উঁচুতে মুসাবনীর দিকে মুখ করে শুয়ে থাকা ঝাঁ-চকচকে নতুন ব্রিজ, সবুজের সমারোহ বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় পাহাড়ের সারি, সব, সব কিছু যেন ধূসর আস্তরণে মোড়া নিশ্চল ছায়াছবি। ওর মনের ছায়াচ্ছন্ন অ্যালবামের হলুদ হয়ে যাওয়া ছবির পাতাগুলো আপনিই উলটোতে থাকল একটার পর একটা। আশামুকুলের বর্তমান তার সমস্ত মুখরতা নিয়ে অতীতের নিশ্চিন্ত শীতল নিবিড়তায় ক্রমশ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল। মনের মধ্যে ধস নামা পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরত গড়িয়ে পড়া স্মৃতির নুড়ি পাথর আর ধুলোর বিশৃঙ্খল মিছিল।
তখন ওর কত আর বয়স। পাঁচ বা ছয় হবে। সাধারণত এই বয়সের স্মৃতিপট স্লেটের মত। সময় সেখানে স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারে না। আশামুকুলেরও ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু ছবি ছাড়া আর কিছু মনে নেই। এই যেমন তাদের একতলা ভাড়া বাড়ির রাস্তার দিকের লোহার গরাদ আঁটা জানলা, রামদার প্রেস থেকে ভেসে আসা পুরোনো ছাপাই মেশিনের একঘেয়ে শব্দ। অন্তত এই মুহূর্ত পর্যন্ত এর বেশি আর কিছু তার মনে ছিল না। কিন্তু ফেয়ার-ওয়েদার ব্রিজের ভাঙা অংশগুলো আশ্চর্য যাদুকাঠির ছোঁয়ায় ওকে কত কিছু মনে করিয়ে দিল। ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি নয়, একটা টানা গল্পের মত। অনেকটা লম্বা। অবশ্য কালির কলমে লেখা সেই পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ কালের ষড়যন্ত্রে আবছা। নির্বোধ শৈশবের অচৈতন্য অন্ধকার থেকে জেগে ওঠা চেতন-জগতে প্রথম পা ফেলা জীবনের গল্প। আশামুকুলের জ্ঞানত প্রথম পুজো, প্রথম বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি।
২
সেই প্রথমবার ও বাবার হাত ধরে পুজোর জামা কিনতে গিয়েছিল। বোধহয় পঞ্চমী বা ষষ্ঠী হবে। না, মনে হয় সপ্তমী। গঙ্গার দিক থেকে ঢাক বাজিয়ে কলাবউ চান করিয়ে অনেকে ফিরছিল। এই ছবিটা মনে পড়তেই ও নিশ্চিত হল দিনটা সপ্তমী। নবপত্রিকা ও দেবী ঘট প্রতিষ্ঠার দিন। হরগঞ্জ বাজারের উলটো দিকের ফুটপাত থেকে বাবা ওকে একটা হাফ প্যান্ট আর জামা কিনে দিয়েছিল। নাহ্, রংটঙের কথা অনেক ভেবেও ও মনে করতে পারল না। অবশ্য এই মুহূর্তে ওর কাছে বৈচিত্র নয়, বিষয়টাই আসল।
যাওয়াটা হয়েছিল পরের দিনই। মানে অষ্টমীতে। কিন্তু কখন, কীভাবে - অনেক ভাবার পরেও আশামুকুলের মনে পড়ল না। শুধু মনে আছে ওদের সঙ্গে বিলাসকাকু গিয়েছিল। বাকি কথাগুলো অদ্ভুতভাবে স্মৃতির অন্ধকারে পথ হারিয়েছে। এই মালভূমি মফস্বলে বাবা মাঝেমধ্যেই বেড়াতে আসে। সঙ্গে বিলাসকাকু ও আরও কিছু বন্ধু। আশামুকুল আর ওর মায়ের এই প্রথম আসা। বাবার বন্ধু ন্যাড়াকাকুদের একটা বাড়ি আছে এখানে। ন্যাড়াকাকু ডাক্তার, হাওড়ার বিখ্যাত কুমারেশ কোম্পানির বাড়ির ছেলে। যদিও কুমারেশ কোম্পানি অনেক দিন আগেই উঠে গেছে। ন্যাড়াকাকুর বাবার সঙ্গে চল্লিশের সাহিত্যিকদের খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। বিভূতিভূষণ, সুমথ ঘোষ, গজেন মিত্তিরদের লেখায় তাঁর কথা আছে। বাড়িটাও করেছিলেন বিভূতিবাবুর বাড়ির পাশেই সুবর্ণরেখা নদীর ধারে। বাবা আর ওঁর বন্ধুরা মিলে ওই বাড়িতে মাঝেমধ্যেই এসে থাকত। তবে এবার ওরা সেখানে থাকেনি। আশামুকুল ভাবল কাল এখানে তার প্রথম আবাসস্থলটি খুঁজে বের করবে। হুমড়ি খেয়ে পড়া শহুরে সভ্যতার মুঠো থেকে সেই গাছে গাছে ঘেরা গ্রাম্য কোঠা বাড়িটার হদিশ সে খুঁজে পাবে কি না কে জানে। ঠিকানাও তো তার ঠিকমত জানা নেই। পরে বাবার মুখ থেকে শোনা সামান্য একটা তথ্য তার শুধু মনে আছে। তা হল, বাড়িটা ছিল এখানকার হাই স্কুলের সেই সময়কার হেডমাস্টার মশাইয়ের। তাঁর কাছ থেকেই পনের দিনের জন্য ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল বাবা আর বিলাসকাকু। ফুলডুংরি থেকে যে রাস্তাটা রেললাইন পেরিয়ে শহরের মূল রাস্তায় মিশেছে তার আশপাশে কোনো একটা জায়গায় বাড়িটা ছিল। একদম নিরিবিলি। ওই রাস্তাটার কথা আশামুকুলের মনে আছে কারণ ওই রাস্তা দিয়েই তারা প্রতিদিন বেড়াতে যেত স্টেশন, রাজবাড়ি বা বিভূতিভূষণের বাড়ির পাশ দিয়ে সুবর্ণরেখার দিকে। সবসময়ই লাইনটা পেরোতে হতো, তাই ওই রাস্তা আর রেল লাইনটার ছবি ওর স্পষ্ট মনে আছে।
এই রাস্তা ধরেই একদিন ও বাবার হাত ধরে বাজারে গিয়েছিল। বাজার নয় হাট। বাজার আদ্যন্ত শহুরে ব্যাপার। সেই পঞ্চাশ বছর আগে এই জায়গাটা ছোটো ছোটো পাহাড় আর নিবিড় সবুজে ঘেরা গ্রামই তো ছিল। আজকে তার চিহ্নমাত্র নেই। পুরোপুরি একটা হাড্ডাগোড্ডা শহর। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই গ্রামের অণু পরমাণুর অস্তিত্বও এই খনিভূমিতে আজ আর পাওয়া যাবে না। এখন এখানে আর হাট বসে না। এই নদীর পাড় থেকে কিছুটা দূরেই মৌভাণ্ডারে স্থায়ী বাজার হয়েছে। বেশ বড়। জনবহুলও।
আশামুকুলের মনে হাটের স্মৃতি বলতে একটা ধূসর দুপুর। হাটের উলটো দিকে একটা বাড়ি দেখিয়ে বাবা বলেছিল এখানকার ধর্মশালা। স্টেশন চত্বর পেরিয়ে এসে বাঁ-দিকে যে রাস্তাটা রাজবাড়ির দিকে চলে গেছে সে দিকে হাঁটতে হাঁটতে গতকাল সকালে ওর চোখে পড়েছিল একটা ধর্মশালা। এটাই কি সেই ধর্মশালা? নাকি নতুন? যদি পুরোনোটাই হয় তাহলে হাট এরই সামনেই বসেছিল। কিন্তু বাড়িটার উলটো দিকে মাঠ কোথায়? গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা ছিরিছাঁদহীন বাড়ির ভিড়। এই পর্যন্ত ভাবার পরই ওর মনে হল, পুরো জায়গাটাই তো এখন ঘিঞ্জি শহর। হয়তো তখন এখানে মাঠই ছিল। হাটের ঠিকানার সমাধান করতে পেরে আশামুকুল মনে মনে একটা জটিল গিঁট খুলে ফেলার আনন্দ অনুভব করলো।
হাটে ওরা অনেকক্ষণ কাটিয়েছিল। বড়রা বাজার-হাটে ব্যস্ত। আর তাদের ব্যস্ততাহীন নিষ্ক্রীয় সঙ্গী আশামুকুলের মনে হচ্ছিল তারা যেন বাজারে নয়, একটা মেলায় ঘুরছে। বাবা-মা, বিলাসকাকু তাকে নিয়ে মেলায় এসেছে। কিন্তু কেন যে এখানে নাগরদোলা বা ঘোড়ার দোলা নেই তা ও বুঝতে পারছিল না। অনেক কেনাকাটা হয়েছিল সেদিন। আসলে এখানে প্রতিদিন বাজার পাওয়া যায় না। হাট বসে মাত্র দু'দিন। তাই বাকি দিনগুলোর রসদ সংগ্রহ করে নিতে হয় হাট থেকে। ফলে বাজারের ব্যাগ ভারী হয়। এখানে তো সেভাবে স্পট ভ্রমণের রমরমা নেই। তাই এই হাট ঘুরে ঘুরে দেখা আর বাজার করা, বেড়ানোরই একটা অংশ। আশামুকুলের এখনও মনে আছে সেই পনের দিনের অলস দিনযাপনের কথা। বিকেলটা বাদ দিলে সারা দিনই ঘরে বসে থাকা। মা সঙ্গে করে আনা জনতা স্টোভে রান্না করত। বাবা মায়ের সহকারী। তার সঙ্গী বিলাসকাকু। বাড়ির পেছন দিকের ছোট্টো বাগানে রঙিন আনন্দে মাতোয়ারা প্রজাপতির পেছন পেছন একটা গামছা নিয়ে দৌড়ে বেড়াত দুই অসমবয়সী শিশু। একজন শরীর ও মনে এবং আরেকজন সঙ্গগুণে শৈশব ফিরে পেতে চাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক ত্রিশোর্দ্ধ যুবক। প্রজাপতি ধরেই উড়িয়ে দেওয়া হত মুক্ত বাতাসে। ধরা সারা হলেই তো খেলা শেষ। অথচ খরচের জন্য তাদের হাতে অপর্যাপ্ত সময়। তাই প্রজাপতি ধরেই আব্বুলিশ না বলে তাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই আবার খেলা শুরুর বাঁশি বাজিয়ে দিত। এভাবেই ধরা আর ছাড়ার মধ্যে দিয়ে গড়িয়ে যেত বেলা। কখনও পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসলে বিলাসকাকু তাকে শোনাতো ডাকঘরের অমল দইওলার গল্প। কাকু একাই দইওলা। একাই অমল। তাঁর আবেগময় কন্ঠস্বর সময়ের উলটো পথ পাড়ি দিয়ে নির্দয়ভাবে বদলে যাওয়া এখানকার বর্তমান জীবনের কর্কশ কাঠিন্যকে মাড়িয়ে আশামুকুলের মনের মধ্যে পাগলা হাওয়ার মত অনুরণিত হতে লাগল। অতীত তাকে বা সে-ই যেন অতীতকে বিলাসকাকুর মাদক স্বরের আবিষ্টতায় আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরল।
তাদের প্রতিদিনের ছকে বাঁধা দিনলিপিতে ছেদ পড়েছিল একদিনই। সেদিন ওরা গিয়েছিল ধারাগিরি। ভোর ছটায় গোরুর গাড়ি চেপে পাহাড়ি রাস্তায় যেতে হয়েছিল প্রায় ঘন্টা তিনেক। সেই প্রথম আশামুকুলের গোরুর গাড়ি চড়া, পাহাড়ে ওঠাও। গত পঞ্চাশ বছরে আরও অসংখ্য পাহাড়ি পথ পাড়ি দিলেও গোরুর গাড়ি ওর আর কোনো দিন চড়া হয়নি। গোরুর গাড়ির চাকার ক্রমাগত কোঁকানি, ঘন্টার আওয়াজ আর দুলুনির আবেশে ও গোটা রাস্তাটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই পার করেছিল। প্রকৃতিকে ঘুমিয়ে অবজ্ঞা করার দুঃসাহস সে বয়সে ছিল। জীবনের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এ সাহস আশামুকুলের নেই। তাই প্রথম পাহাড়ি পথ পাড়ি দেবার স্মৃতি জমা হবার আগেই তাকে ঘুমের রেশমি চাদরে মুড়ে দেওয়ার জন্য তার মনের মধ্যে থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এসে মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
ওর মনে পড়ল সেই ঘুম ভেঙেছিল ধারাগিরির সদর দরজায়। সদ্য ঘুম ভাঙা শিশুচোখের উদাসীন নির্লিপ্ত জড়তায় আড়ষ্ট দৃষ্টিতে দেখা, পঞ্চাশ বছরের দূরত্বে ধূসর, সেদিনের ধারাগিরির স্মৃতি আশামুকুলের মনের অ্যালবামে হলুদ হয়ে যাওয়া পুরোনো সাদাকালো ছবির মত। একটার পর একটা ছবি আঁটা পাতা উলটে উলটে গিয়েও ও আজ আর কোনো সম্পৃর্ণ স্মৃতির প্রতিমা তৈরি করতে পারল না। ওর শুধু মনে পড়ল আলো-অন্ধকারে মোড়া বনভূমির শেষ প্রান্তে পাহাড়ের গা বেয়ে শীর্ণকায় জলধারা নেমে এসে পড়ছিল একটা ছোটো ডোবায়। সেই হাঁটুজল ডোবায় অনেকে চান করছিল। ও আর বিলাসকাকু চান করার সময় গামছা দিয়ে জলের মধ্যে সাঁতরে বেড়ানো ছোটো ছোটো মাছ ধরেছিল অনেকক্ষণ। মাছ ধরার ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই আশামুকুলের মনে হলো তার সেই প্রথম বেড়ানোয় অনেকটা সময় কেটে গেছে ধরা আর ছাড়ার খেলায়। কখনও বাগানের প্রজাপতি আবার কখনও ধারাগিরির রঙিন মাছ। ধরতে ধরতে আর ছাড়তে ছাড়তেই তো জীবন দীর্ঘায়িত হয়ে উপসংহারের সীমা ছুঁয়ে অনন্তে মিলিয়ে যায়। তার অকিঞ্চিৎকর জীবনের সেই চিরায়ত যাত্রার ভূমিকার শুরুটা কি হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগের এই বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে?
অর্থহীন দার্শনিকতার অলসতা ছেড়ে আশামুকুল ফিরে এল স্মৃতি রোমন্থনের কষ্টসাধ্য বন্ধুর পথে। ওর মনে পড়ল সেদিন ধারাগিরিতে তারা বনভোজন করেছিল। তার জীবনে সেই প্রথম। স্টোভে মা খিচুড়ি রেঁধেছিল। সব্জি খিচুড়ি। সেই খিচুড়ি খেয়ে ফেরার সময় ও আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। পাহাড়ি পথের দৃশ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার হতাশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আশামুকুল ভাবল, জীবনে আসা যাওয়ার পথ তো সবসময়ই সুপ্তিময়। নির্জন পাহাড়িনী ধারাগিরি যেন একলা জীবন। তাই যাওয়া- আসার পথে তার ঘুমও ছিল হয়তো নিয়তি নির্ধারিত। জীবনের সব কিছুই তো পূর্ব নির্ধারিত। "পূর্ব নির্ধারিত" শব্দটা আশামুকুলের ভালো লাগলো না। ওর মনে হলো ইংরেজি "প্রি ডেস্টিনড" শব্দটা বোধহয় এক্ষেত্রে যথাযথ।
ডেস্টিনির নিয়মেই ফেরার দিন চলে এল। চলে এল বটে কিন্তু এল আরও আনন্দের পসরা নিয়ে। সন্ধ্যাকাকিমাকে নিয়ে হঠাৎই চলে এল ন্যাড়াকাকু। থাকল নিজেদের বাড়িতেই কিন্তু রাত্তিরটা বাদ দিলে সারাদিন তাদের সঙ্গেই। লম্বা, সাহেবদের মত টকটকে ফর্সা ন্যাড়াকাকু স্বভাব-হুল্লোড় মানুষ। আনন্দ আর রাগ সবটাই পঞ্চমে। কথাসিদ্ধ পুরুষ। মুখে সবসময় খই ফুটছে। সেই কথাস্রোতের সামনে অন্যরা বাধ্য হত মৌনব্রত নিতে। এই চরিত্রের জন্য ন্যাড়াকাকু কোনোদিন ডাক্তারি ঠিকমত করতেই পারল না। এত কথা বলা ডাক্তারকে বোধহয় রোগীরা পছন্দ করে না। সেই মানুষটার সঙ্গ তাদের বেড়ানোর আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তুলল। অবশ্য বড়দের আনন্দের ধরনধারণের সঙ্গে আশামুকুলের অবোধ আনন্দের মিলমিশ হত না ঠিকই। কিন্তু আনন্দ তো বড় ছোঁয়াচে। তাই এতগুলো প্রিয় মানুষের আনন্দসঙ্গ তাকেও আনন্দিত করত। বিকেল হলেই ঘুরতে বেরোনো। কখনও রাজবাড়ির পেছনে সুবর্ণরেখার পাড়ে। কখনো হাঁটতে হাঁটতে ফুলডুংরির পাশ দিয়ে গ্রামের দিকে। তবে ওর রাজবাড়ির সুবর্ণরেখাকেই সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। তার কাছে সে এক অক্ষয় স্মৃতি। সেই শৈশবের ভালোলাগার জায়গাটা এবারে এত বছর পরে দেখেও তার মুগ্ধতার কোনো হেরফের হয়নি। এবারের দেখা অভিজ্ঞ দৃষ্টির সরসতায় আরও যেন মনের গভীরে ভালোলাগার রেশকে চারিয়ে দিয়েছে । গতকাল পঞ্চাশের বৃদ্ধ চোখে জায়গাটাকে এত বছর বাদে আবার দেখতে দেখতে আশামুকুলের মনে হয়েছিল এখানে যেন অনেক অনেক কাল আগে পাথর দিয়ে কোনো পৌরাণিক ভাস্কর গড়ে তুলতে চেয়েছিল এক মহান স্থাপত্য। উত্তাল সুবর্ণরেখা তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেও নিজের সরলরৈখিক নদীপথ তৈরি করতে পারেনি। শিল্প হয়ে প্রকাশিত না হতে পারার ক্রোধে বেখাপ্পা ছোট বড় পাথরের সারি নদীর সামনে বিছিয়ে দিয়েছে পাথুরে প্রাচীর। তাই সুবর্ণরেখা এখানে প্রস্তর পথের নানা সুঁড়িপথ ধরে বহু ধারায় বিভাজিত। প্রতিনিয়ত পাথরের সঙ্গে নদীর সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে গম্ভীর শব্দের ভয়ঙ্কর গর্জন। এ এক অনন্য নদীরূপ, যার পথে পথে পাথর ছড়ানো। পাথর দিয়ে সাজানো বিদীর্ণ ধারাস্রোত। পঞ্চাশ বছর পার করেও তার রূপের কোনো পরিবর্তন হয়নি এত পরিবর্তনের মধ্যেও।
চলে আসার আগের দিন ন্যাড়াকাকুর প্রস্তাবমত যাওয়া ঠিক হলো মৌ ভাণ্ডারের দিকে। তাদের বাড়ি থেকে মৌ ভাণ্ডার অনেকটা হাঁটা। তাই বাবা, বিলাসকাকু এদিকে এলেও মা ও তার আসা হয়নি। এবারে আসা হল কারণ সে হাঁটতে না পারলে বইবার লোক অনেক। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা নানা জনের কোলে সওয়ারি হয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বড়দের দল আশামুকুলকে যেখানে নিয়ে এসে ফেলল সেখানটা একটা ঢালু বাঁধানো চত্বর। সেই চত্বর অনেকটা নেমে মিশে গেছে নদীর বুকের সঙ্গে লেগে থাকা ব্রিজটার গায়ে। জন্ম ইস্তক হাওড়া ব্রিজ দেখে অভ্যস্ত আশামুকুলের মন প্রথম দেখায় এটাকে ব্রিজ বলে মানতেই চায়নি যতক্ষণ না বাবা তাকে এর বৈশিষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিল। বাবা বলেছিল, এই ব্রিজটা ব্রিজ থাকে শুধু নদীতে জল কম থাকলে। এখন যেমন নদীতে থইথই জল, তাই ব্রিজ অচল। এই জন্যই তো নাম ফেয়ার-ওয়েদার ব্রিজ।
ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। বড়রা বাঁধানো চত্বরের একদিকে বসে গল্প করছে। নিঃসঙ্গ আশামুকুলের সঙ্গী একটা ছোট বল। ও সেই বলটা নিয়ে একাই খেলছে। আবার কখনও গুটি গুটি পায়ে নদীর কাছে চলে যাচ্ছে ব্রিজটাকে ভালো করে দেখার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর শব্দে ভয় পেয়ে ওপরে উঠে আসছে। ব্রিজের গায়ে জলের ধাক্কা লেগে তৈরি হওয়া শব্দটা রাজবাড়ির পাথরের বুক চিরে বয়ে চলা নদীর মত অত তীব্র না হলেও একটা বাচ্চার মনে ভয় ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট। ভয় পেলেই আশামুকুল দৌড়ে চলে আসছে বড়দের কাছে। খানিকক্ষণ মায়ের কোলের কাছে বসে আবার বল নিয়ে খেলা শুরু। এইভাবেই সন্ধ্যে ক্রমশ প্রৌঢ় হয়ে উঠছিল। বাঁধানো চাতালে হ্যালোজেনের থইথই আলো । সেই আলো ঢাল বেয়ে গড়িয়ে চলে গেছে নদী ও ব্রিজের মাঝ বরাবর। তারপর শুধুই অন্ধকার। টিন টিন আলকাতরা কে যেন ঢেলে দিয়েছে চরাচরের বাকি অংশে। আজ পঞ্চাশ বছর পর এই উপচে ওঠা নাগরিকতার মধ্যে বসেও স্মৃতিমগ্ন আশামুকুল সেই নির্জন আলো-আঁধারি প্রৌঢ় সন্ধ্যেকে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেল। কয়েক মুহূর্ত বাদেই ঘটল সেই ঘটনা, যা এই জায়গাটার সঙ্গে ওকে জুড়ে দিয়ে গেল চিরকালের জন্য। দাঁড়িয়ে লোফালুফি খেলায় বড়দের কড়া নিষেধ। বল নদীতে চলে যেতে পারে। কিন্তু মাটিতে বসে একঘেয়ে লোফালুফি খেলতে আশামুকুলের আর ভালো লাগছিল না। হঠাৎই শৈশবের নিয়ম ভাঙার অদ্ভুত একটা খেয়াল মুহূর্তের জন্য ওকে ভুলিয়ে দিল বড়দের নিষেধ, নদীর আগ্রাসী গর্জনের ভয়। ও বল নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাটিতে ড্রপ দিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া বলটাকে মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নেওয়ার খেলায় মেতে উঠল। কিছুক্ষণ বেশ চলছিল। গল্পে মত্ত বড়রাও কেউ ওর দিকে খেয়াল করছিল না। আশামুকুলের হাতে, পায়ে, মনে ভালোলাগার নির্ভার উত্তেজনা, আনন্দ। অজান্তেই ও বল লুফতে লুফতে কখনও কখনও জলের কাছাকাছিও পৌঁছে যাচ্ছিল। আবার ফিরেও আসছিল। কিন্তু এবার সবকিছু ঠিকঠাক হল না। ড্রপটা একটু জোরে হয়ে যাওয়ায় বলটা বেশ অনেকটা ওপরে উঠে গেল। হ্যালোজেনের জোরালো আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বলটাকে ও লুফতে পারল না। বলটা ঢালু বাঁধানো মেঝেতে পড়েই দ্রুত গড়িয়ে যেতে লাগল নিচের দিকে। আশামুকুল সমস্ত নিষেধ, সমস্ত ভয় ভুলে অন্ধের মত বলের পেছনে দৌড়ল। দৌড়োতে দৌড়োতে কখন যেন ওর পা জল ছুঁয়ে ফেলল। বলটাকেও ও আর দেখতে পাচ্ছিল না। অন্ধকার জলের স্রোতে আশামুকুলের দৃষ্টির দখল মুক্ত বল তখন নিরুদ্দেশের পথে। পায়ে ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায় ওর সম্বিত ফিরল। পিছন ফিরে দ্রুত ওপর দিকে ওঠার জন্য তৈরি হল। কিন্তু পারল না। ওর পা যেন কিসে আটকে গেছে। জল পায়ের পাতা থেকে ক্রমশ ওপর দিকে উঠে আসতে লাগল। হাঁটু, হাঁটু থেকে কোমর। ও শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ওর মনে হল নদীর গর্জন ছাপিয়ে ওর চিৎকার অনেকটা ওপরে বড়দের কানে পৌঁছবে না। তবুও ও ক্রমাগত চিৎকার করে যেতে লাগল। নদী আর ব্রিজের সংঘর্ষে তৈরি হওয়া ভয়ঙ্কর গুমগুম আওয়াজ ওকে যেন চারপাশ থেকে নাগপাশের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল। ও আর চেষ্টা করেও শরীরের ভেতর থেকে কোন শব্দ বার করতে পারছে না। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে অসহায় কান্নার স্বর। তাতে কোন জোর নেই। ওর বুকের ওপর কেউ যেন চাপিয়ে দিয়েছে একটা ভারী পাথর। ও আর দম নিতে পারছে না। চারপাশ থেকে দলা দলা অন্ধকার আশামুকুলের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। হাওয়ায় ওড়া শুকনো পাতার মত ওর শরীর ওজনশূন্য। নদী ওকে নিজের শরীরের দিকে প্রচণ্ড জোরে আকর্ষণ করতে লাগল। ঠিক সেই সময়েই ওর মনে হল একটা শক্তিশালী হাত ওর শরীরটাকে প্রচণ্ড জোরে নিজের দিকে হ্যাঁচকা টানে টেনে নিল। ঝড় খাওয়া গাছের মত ও ছিটকে গিয়ে পড়ল ঢালু বাঁধান চাতালের কঠিন মাটিতে। আশামুকুল জ্ঞান হারাল।
৩
"বাবা, বাবা, তোমার কী হয়েছে? তুমি চিৎকার করছ কেন?"
ছেলের ধাক্কায় আর ডাকে আশামুকুলের দেহের সম্বিত ফিরে এলেও মন তখনও স্মৃতির জড়তায় আচ্ছন্ন। আড়ষ্ট। অতীত আর বর্তমানের কুয়াশাময় সীমান্তে স্থবির। হঠাৎই তীব্র স্বরে তামা কারখানার সাইরেন বেজে উঠল। দীর্ঘ লোডশেডিং-এর পর বিদ্যুৎ ফিরে এলে ঘরের আলো, পাখাগুলো যেমন হঠাৎই চলতে শুরু করে ঠিক তেমনি সাইরেনের তীক্ষ্ণ কর্কশ শব্দে আশামুকুলের মনোজগতে স্বাভাবিক চলাচল শুরু হল। পঞ্চাশ বছর আগের অতীত ভ্রমণ শেষে চোখ মেলে দেখল তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রূঢ় বর্তমান। আলোকিত তামা কারখানা, ব্যস্ত মুসাবনি ব্রিজ, তাকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষের ভিড়ের মধ্যে কিছুটা হতবাক বউ ও ছেলে। তাদের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তি। এই অপরিচিত জিজ্ঞাসু ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা আশামুকুল বিড়ম্বনা কাটিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বউ-ছেলেকে বলল, "চল, ফিরি।" কয়েক পা এগিয়ে সে আরেকবার পেছন ফিরে তাকাল সেই ফেয়ার-ওয়েদার ব্রিজের দিকে। সেদিন এই ব্রিজটাই তাকে আটকে ছিল মৃত্যুর হাত থেকে। তার পা নাকি ব্রিজের একটা পাটাতনের মধ্যে আটকে গিয়েছিল। আর সেই হাতটা ছিল ন্যাড়াকাকুর। আজ ন্যাড়াকাকু নেই। নেই বাবা, মা, সন্ধ্যাকাকিমাও। বিলাসকাকু থেকেও নেই। শয্যাশায়ী। আসলে জীবনের পথ ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু স্মৃতির অবশেষ। ওই ফেয়ার-ওয়েদার ব্রিজের মত। সেই অবশেষকে আঁকড়ে ধরেই জীবনের স্রোত বয়ে চলে অতীত থেকে বর্তমানের স্মৃতি পথে।