আমাদের যাত্রা শুরু মায়ামি থেকে। প্রথম দুদিন অথৈ সমুদ্রে, তারপর প্রথম দ্বীপ সেন্ট মারটিন, পরদিন সেন্ট জন, তারপর বাহামা দ্বীপগুলি, শেষে আরও দুদিন সমুদ্রে কাটিয়ে মায়ামিতে ফেরত। আমাদের জাহাজটা কার্নিভাল ক্রুজ লাইনের বৃহত্তম ‘হলিডে’। তার বহর দেখেই আনাড়ি আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! দশ তলা ডেক, প্রায় দুহাজার যাত্রীর কেবিন, সঙ্গে ছ’শো ওয়েটার ও নাবিকের দল। এলাহি কারবার। ওপর তলার কেবিনগুলি সবথেকে দামী, প্রত্যেকটির সঙ্গে ছোট্ট ব্যালকনি লাগানো (যেখানে নিরালায় নগ্ন রৌদ্রস্নান করা যায়!) আমাদের ঘরটি অনেক নিচের তলায়, জানলাহীন, জাহাজের ঠিক মাঝখানে। আমার স্বামীর আবার সী সিকনেস-এর রোগ। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন যে জাহাজের একেবারে নিচের তলায়, একেবারে মাঝখানে, দুলুনিটা নাকি সবথেকে কম অনুভব হয়। (দামটাও সবথেকে কম বটে)। আমার ভাগ্যে জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখাটা হলনা। তা আর কি করা।
কেবিনগুলি ছোট্ট হলেও ঘুপচি নয় মোটেই। খুব কম জায়গার মধ্যেই বিছানা, টেবিল, চেয়ার, বাথরুম, আলমারি, টিভি, ড্রেসিং টেবিল সবকিছু একেবারে নিখুঁত ভাবে খাপেখোপে ফিট করে রেখেছে। এতো জিনিশ এতো ছোট জায়গায়, দেখেই অবাক হতে হয়।
কেবিন ছাড়াও এইসব জাহাজে আছে বিলাসের প্রতিটি উপকরণ। পাঁচটি সুইমিং পুল, সনা, জিমন্যাসিয়াম, নানান উপহারের দোকান, চারপাঁচটে রেস্তরাঁ—বিভিন্ন খাবারের জন্য, চারচারটি রঙ্গমঞ্চগুলিতে নানারকম শো, কমেডি, নাচগান, সার্কাস, সিনেমা হল, ক্যাসিনো ইত্যাদি ইত্যদি। বিলাসিতায় মন ভরাবার কোনও আয়োজনের অভাব নেই।
এইসব জাহাজে খাবারের আয়োজনটাই সবথেকে রাজকীয়। ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনার তো আছেই, তারও ওপর চব্বিশঘণ্টা স্নাক্স, বুফে, বার, এমনকি মাঝরাত্তিরের খাবার পর্যন্ত। বিনামূল্যে এতো লোভনীয় খাবারের পাল্লায় পড়ে এক সপ্তাহেই কয়েক পাউন্ড ওজন বেড়ে যেতে বাধ্য। (সেই জন্য ক্রুজের শেষদিনে ফর্মাল ডিনারের জমকালো পোশাকটি একটু ঢিলেঢালা হলেই ভালো।) অ্যালকহল পানীয় অবশ্য ফ্রি নয়, নগদ দাম ধরে দিতে হয়। জাহাজে বেশির ভাগ খাবারই ইউরোপিয়-আমেরিকান, আমার ইচ্ছে ছিল একটু ক্যারিবিয়ান খাবার চেখে দেখার, কিন্তু সেটা সম্ভব হলনা। ওসব ঘরোয়া খাবার হয়তো ক্রুজের মত ‘উঁচুস্তরের’ নয়।
আমাদের রুটিন ছিল একেকটা দ্বীপে নেমে সারাদিন কাটানো। সমুদ্রে সাঁতার, ডাইভিং, স্নরকেল, বা জীপ ভাড়া করে সারা দ্বীপ চড়ে বেড়ানো, স্থানীয় দোকান (সব ডিউটি-ফ্রি) থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা ইত্যাদি। বিকেলবেলা ঠিক সময়ে জাহাজে ফিরতে হত। জাহাজ মিস করলে অশেষ ভোগান্তি। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে অন্য দ্বীপে পাড়ি।
পরের দিন সেন্ট জন। এই খুদে দ্বীপটি আমেরিকান-এর ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। এখানে আমার প্রথম সমুদ্রে ডাইভিং অভিজ্ঞতা হলো। জলে নামবার আগে আমাদের কিছু জরুরী সাইন শিখিয়ে দিয়েছিল—যেমন, শুধু হাত নেড়ে কিভাবে জানাতে হয় ‘আমায় ডাঙায় নিয়ে যাও’ বা ‘পায়ে কাঁটা ফুটেছে’ ইত্যাদি। ডাঙায় অক্সিজেন ট্যাঙ্ক, টিউব, মাস্ক, গগলস ইত্যদির ওজন বেশ কিন্তু জলে নামলেই একেবারে হাল্কা। তখন বরং নীচে ডুবে থাকাটাই মুশকিল, কেবলই ওপরে ভেসে উঠি। একটা দড়ি বাঁধা থাকলে ভালো হতো।
জলের নীচে আমি দিক হারিয়ে ফেলি, কোনদিকে যে বিচ তাও ঠিক করতে পারিনা। কেবল মনে রাখি ওপর দিকটা—সেদিকে আলো। আমাদের গাইড বলে দিয়েছিলো সবাইকে একসঙ্গে থাকতে। নইলে দিক হারিয়ে নাকি পোর্টো রিকোয় পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা! ঠাট্টা করেই বলেছিল কিন্তু আমরা ভয়ের চোটে এতই গায়েগায়ে সাঁতরাতে লাগলাম যে এ ওর গায়ে মুখে ধাক্কা লাগাই।
চারপাশে কত রংবেরঙের মাছ। কিন্তু প্রথমবার আমার বেশ ভয় করছিল—যদি কোন অঘটন হয়। তাই বিশেষ কিছুই মন দিয়ে দেখতে পারিনি।
শেষ স্টপ বাহামা দ্বীপমালা। রাজধানী নাসাউ-এর আশেপাশে সুন্দর বীচ আর শহরে নানা দোকানে ক্রুজ টুরিস্টদের ভিড়। আসলে এইসব দ্বীপে ট্যুরিজম আর এই ক্রুজ জাহাজগুলিই প্রধান ব্যবসা। এর ওপরেই সবার খাওয়াপরা নির্ভর করে।
এরপর আরও দুদিন খোলা সমুদ্রে মায়ামির পথে। এই সময়টা বন্ধুদের সঙ্গে হৈহুল্লোড়ে কাটিয়ে দিলাম। আসলে বন্ধুবান্ধব সঙ্গে থাকলে ক্রুজ করে মজা। কিংবা বুড়ো বয়সে, যখন ক্রুজের সেবকরা হাত ধরে সব কিছু করিয়ে দেয়, হোটেল, খাবার, ঘোরাঘুরি, সবকিছুর জোগাড় করে দেয়, আপনি শুধু আরামচেয়ারে বসে হাতে পানীয় নিয়ে নীল সমুদ্রের শোভা দেখতে পারেন।
আমার কিন্তু সুখে থাকতেও ভূতে কিলোয়। সবসময়, সব জায়গায় নানারকম সুখাদ্যের প্রাচুর্য আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল। কেবলই দ্বীপের গরীব বাচ্চাদের শুকনো মুখগুলো মনে পড়ছিল। প্রতিদিন কতো খাবার যে নষ্ট হয় ভগবান জানেন।
এছাড়াও তিন চার দিন খোলা সমুদ্রে কাটানো আমার ভীষণ একঘেয়ে লাগে। চারিদিকে অন্তহীন নীল জল, কাঁহাতক তাকিয়ে থাকা যায়? সমুদ্রের আকর্ষণই হল তার তীরের সঙ্গে খেলা। বেলাভূমিতে ঢেউয়ের আছাড়, নারকেল গাছ বা ঝাউবনে হাওয়ার শরশর, সামুদ্রিক পাখিদের ওড়াউড়ি, জোয়ার ভাঁটার দোলাচল এই সবের জন্যেই তো সমুদ্র আমাদের এত প্রিয়। এদের ছাড়া খালি সমুদ্র শুধুই ক্লান্তিকর।
সেই জন্যই জাহাজে এতো নাচগান, খাওয়া আর পার্টির আয়োজন। কিন্তু আমার যে সেসবেও বিশেষ আগ্রহ নেই। আমার মত যাত্রীদের ক্রুজ ভ্রমণে এক সপ্তাহই যথেষ্ট। অবশ্য এসব নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত মতামত, আমার সহযাত্রীদের কিন্তু এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিলনা।
তবে সব ক্রুজই একরকম নয়। ভূমধ্যসাগরের ক্রুজের চারপাশে অনেক ঐতিহাসিক, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখা যায়। আমি আলাস্কা, গালাপাগোস ও দক্ষিণ মেরুতে ক্রুজ ভ্রমণ করেছি, সেসব ছোটো জাহাজে বিশেষ কোনো জাঁকজমক ছিলোনা, খাবারদাবারের আতিশয্যও নয়, সবাই শুধু বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যেই মোহিত হয়ে ছিলেন। একঘেয়েমির কোনো সুযোগ ছিলনা।
সমুদ্র ছাড়াও অনেক বড় নদীতে ক্রুজের ব্যাবস্থা আছে। আমি নীলনদ, ইয়াংজি ও আমাজন-এ নদীযাত্রার সুযোগ পেয়েছি। সেখানে জাহাজগুলি ছোটো ও ব্যবস্থা ছিমছাম। বেশ দুপাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া, একেবারে ট্রেনে যাত্রার মতোই।
ভারতে কিন্তু এখনো ক্রুজের বিশেষ সুযোগ নেই। দু’একটা লাইন মুম্বাই থেকে গোয়া, কোচি হয়ে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত যায়। ব্যাস। পূবদিকে কোলকাতা হয়ে বাংলাদেশ এমনকি মিয়ানমার পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। আশাকরি এরকম বেড়াবার সুযোগ বাড়বে। হাত-পা ঝাড়া, নিশ্চিন্তে আরাম করে বেড়াবার জন্য ক্রুজের তো কোনোই বিকল্প নেই।