“Nothing has been used in the manufacture of this poetry, that could be used in the manufacture of bread.”
— জেন কুপার
জেন কুপারের কবিতা মিতবাক ও মৃদুভাষী; ভাবুক, নিরুচ্চার অথচ জীবনীশক্তিতে ভরপুর। ৮৩ বছরের দীর্ঘ জীবন তাঁর, কবিতা লিখেছেন পাঁচ দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু এই প্রতিভাবান কবির যখন “কবিতা সমগ্র” প্রকাশিত হল ২০০০ সালে – ভূমিকা, টীকা সব মিলিয়ে ২৬৩ পৃষ্ঠা, তাতে কবিতার সংখ্যা মোটে একশোর কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও তিনি বহু আলোচিত, বহুপঠিত এবং সম্মানিত। অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃত এবং ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ আমেরিকার ন্যুইয়র্ক রাজ্যের রাজকবি।
তিনি কবিতা সমগ্রের নাম দিয়েছিলেন “আলোর নৌকা” (“The Flashboat: Poems collected and Reclaimed”, প্রকাশক: ডবলু ডবলু নর্টন। দুটি শব্দকে কোমরের কাছাকাছি ভেঙে দুটুকরো করে আবার তাদের ন্যাজামুড়োকে নতুন করে জুড়ে দিয়ে একটি অভিনব শব্দের জন্ম দিয়েছেন জেন – “Flashlight” অর্থাৎ যাকে আমরা ‘টর্চ’ বলি তার মার্কিন পরিভাষা (মার্কিন ইংরেজিতে “Torch” শব্দটির অর্থ “জ্বলন্ত মশাল”) এবং ‘Lifeboat’ – এই দুটি শব্দকে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে “Flashboat”।
প্রায়-নিমজ্জিত কবিকে উদ্ধার করবে, শুশ্রুষা করে বাঁচিয়ে তুলবে, এনে দেবে প্রেম, প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন এবং আরও অনেক কিছু – এটাই সফল কবিতার, মহান কবিতার প্রথম ও প্রধান কাজ। সেইজন্য আরেকজন ভগিনী কবি যখন গ্রন্থটির পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় লেখেন – “The Flashboat will save your life.” – তাকে কোনওভাবেই অত্যুক্তি বলে ঠাহর হয় না। আর এক অনুজ, সতীর্থ কবি জানিয়েছেন –
“Jane Cooper has been engaged in a long, patient act of making, a consideration of self-in-the-world – Vigorous, humble and fierce, all at once. It is not quite accurate to say – The Flashboat is full of life – instead, it its own way, it is a life.”
আমেরিকার ন্যু জার্সি রাজ্যের আটলান্টিক সিটিতে কবির জন্ম ১৯২৪ সালের ৯ অক্টোবর; তাঁর শৈশব কেটেছে দক্ষিণে, ফ্লোরিডা রাজ্যের জ্যাকসনভিল শহরে। তাঁর কবিতায় গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের এই ক্রমাগত পরিবর্তনশীল শহরটির অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। ইস্কুলের পড়া শেষ হলে তিনি ভর্তি হন নারীশিক্ষার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান – ন্যু ইয়র্কের ভাসার কলেজে। কিন্তু অল্প কিছুদিন লেখাপড়ার পরে গুরুতর অসুখে আক্রান্ত হয়ে লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হন। সম্পূর্ণ সেরে উঠে যোগ দেন উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৪৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
কলেজ শেষ করে এবার তিনি বেড়াতে গেলেন ইংল্যান্ডে ১৯৪৭ সালে; যুদ্ধবিধ্বস্ত কয়েকটি শহরে জনসাধারণের দুর্দশা দেখে বিষণ্ণ মানুষটি উচ্চশিক্ষা শুরু করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেই ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট কবিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও বন্ধুত্ব, এবং তার টানেই নিজের কবিতা লেখার সূচনা। গভীর অধ্যবসায় এবং নিবিড় কামনা-বাসনায় কাটে তাঁর দিনগুলি – অক্সফোর্ডের পরিবেশ ও মানুষজনকে মিশিয়ে নেন নিজের শরীর, মানসিকতা ও কবিকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই সময়কার দীর্ঘ দিনপঞ্জীগুলি তাঁর পরবর্তীকালের সাহিত্যসৃষ্টির ভিত্তিভূমি এবং অনুপ্রেরণা। আমেরিকার অন্তহীন প্রাচুর্য থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইয়োরোপের কৃচ্ছ্রসাধন – এই পরিবেশের পরিবর্তন গভীরভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত করে তাঁকে, খুলে দেয় তাঁর সৃষ্টির উৎসমুখ। আমেরিকায় যে কোনও দিন পাড়ার দোকানে গিয়ে কেনা সম্ভব দামী সিল্কের ব্লাউজ; অথচ দিঘির ওপারে – “The first silk I saw after five years in wartime England was a parachutist’s landing chart made into a woman’s headscarf.”
১৯৫০ সালে আমেরিকায় ফিরে এসে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন খ্যাতনামা সারা লরেন্স কলেজে – সেখানে ৩৭ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৭ সালে অবসর নেন তিনি। আরও দুজন শক্তিশালী মার্কিন কবি ছিলেন সেখানে তাঁর সহকর্মী গ্রেস পেলি [১৯২২-২০০৭] এবং মিউরিএল রুকাইজার [১৯১৩–১৯৮০]--এই তিন কবির অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে ওঠে কলেজের “সৃষ্টিশীল সাহিত্য” (“Creative Writings”)-এর বিভাগটি – অনেক নবীনা কবিই সেখানকার ছাত্রী এবং এখনও তা আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র।
পাশাপাশি চলেছে তাঁর নিজস্ব ধারায় সাহিত্যচর্চা – সংহত এবং ঘনিষ্ঠ; অনেকদিন ধরে লেখেন এক একটি কবিতা – দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তাদের ঘষে মেজে, শান দিয়ে নতুন করে তোলেন – একটি শব্দও অবহেলার সৃষ্টি নয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ – এই ১৩ বছরে রচিত ৩২টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম গ্রন্থ – লেখা শুরু করার প্রায় দুদশক পরে – গ্রন্থের নাম “ছয় প্রত্যুষের আবহ” (“The Weather of Six Mornings”), প্রকাশক: ম্যাকমিলান; প্রকাশ: ১৯৬৯ সাল। অ্যাকাডেমি অফ আমেরিকান পোয়েটস-এর পক্ষ থেকে ‘লামন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত হয় কাব্যগ্রন্থটি। কবির মতে – “The Weather of Six Mornings was a largely personal domestic book….” সেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মহাযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে সাধারণ মানুষজনের বেঁচে থাকার ও দুঃখ পাওয়ার বিবরণ। “A sense of continuous journey the work has been for me all along …”
পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হ’ল দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ – “মানচিত্র ও ঝরোখা” (“Maps and Windows”); প্রকাশক: ম্যাকমিলান; প্রকাশ: ১৯৭৪ সাল। ৩৫টি কবিতা অন্তর্ভূক্ত এই গ্রন্থে, যার মধ্যে ৯টি আগের গ্রন্থে প্রকাশিত। গ্রন্থটির শুরু অল্প বয়েসে লেখা কিছু অগ্রন্থিত কবিতা (রচনাকাল ১৯৪৭–৫১) দিয়ে আর শেষ হয়েছে ব্যক্তিগত বিষাদ বেদনার রসে জারিত একগুচ্ছ সমসাময়িক (১৯৬৮–৭৩) কবিতার সম্ভারে। কিন্তু গ্রন্থের মূল আকর্ষণ তার কেন্দ্রস্থলে – একটি দীর্ঘ আত্মজৈবনিক গদ্য – “এই কবিতার প্রস্তুতিতে এমন কিছু দ্রব্যের ব্যবহার করা হয়নি, যা দিয়ে রুটি বানানো যায়।” প্যারিসে এক বিভাগীয় বিপণিতে বিক্রয়ের জন্যে রাখা একটি আসবাবের গায়ে নোটিসটি দেখেছিলেন কবি। ইয়োরোপে তখন প্রবল খাদ্যাভাব – ফলে রুটি তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন কোনও উপাদান অন্যভাবে ব্যবহার করা বেআইনি। “আসবাবের” বদলে “কবিতার” বসিয়ে দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এই অবিস্মরণীয় বাক্যবন্ধ। তার ভেতরে চির-অনূঢ়া, সন্তানহীনা এক শিক্ষিত, সংবেদনশীল নারীর কবিতাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকার বর্ণনা; যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমা, নারীবাদ, যৌন-রাজনীতি, বর্ণবৈষম্য – এইসব সমসাময়িকতার ছায়া পড়ে তাঁর রচনায়। শৈলিগতভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বের দিকপাল ইয়োরোপীয় কবিরা – রিলকে, লোরকা, ম্যানডেলস্টাম।
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ “মাচান” (“Scaffolding – New and Selected Poems”) প্রকাশিত হল ইংল্যান্ডে। প্রকাশক: অ্যানভিল প্রেস পোয়েট্রি; প্রকাশ ১৯৮৪ সাল। সেখানে পূর্ববর্তী দুটি কবিতার বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা নতুন করে কালানুক্রমে সাজিয়ে দেওয়া হয় – তার সঙ্গে ১৯৭৫–৮৩ সালে রচিত কিছু নতুন কবিতা। গ্রন্থটির প্রথম মার্কিন সংস্করণ প্রকাশিত হতে হতে কেটে যায় আরও ন’বছর। এই গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা – “সূত্র – জেলখানা থেকে রোজা লুকসেমবুর্গ” – ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রবল বিরোধিতায় রচিত দীর্ঘ কবিতা। জার্মানির মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী রোজা লুকসেমবুর্গ (১৮৭১–১৯১৯) প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে কাইজারের যুদ্ধনীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং যুদ্ধের পুরো সময়টাই তাঁর কাটে জেলখানায়। সেই সময় বন্ধু ও সহবিপ্লবী কার্ল লাইবনিখ্ট (১৮৭১–১৯১৯) এর পত্নী সোফি (১৮৮৪–১৯৬৪)-কে লেখা তাঁর চিঠিগুলি পরবর্তীকালে “সোফি লাইবনিখ্টকে লেখা জেলখানার চিঠি” নামে প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। সেই মহান গ্রন্থটির অনুপ্রেরণায় জেন কুপার এই দীর্ঘ কবিতাটি রচনা করেন আর এক অন্যায় যুদ্ধের বিরোধিতায়। লুক্সেমবুর্গের গ্রন্থটির একটি নতুন ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশ করেছিলেন যুদ্ধবিরোধী লিগ ১৯৭৯ সালে।
কবিতা বিষয়ে কুপারের মন্তব্যটি ভেবে দেখার মত – “Poetry is a way of giving people more life, a more vivid awareness of the exact moment they are living through – first a sensuous awareness, then a historical one. What else can tell us who we care, while telling us more than we know? The true poem is always without signature. It is a living experience in which we, poet and reader, participate together. A partnership. A means of practising freedom.”
তাঁর অন্তিম কাব্যগ্রন্থটির নাম “সবুজ নোটবুক, শীত পথ” (“Green Notebook, Winter Road”) প্রকাশক: টিলবেরি হাউস; প্রকাশ: ১৯৯৪। কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯৮১–৯৩। সেখানে শৈশবের স্মৃতি, কৈশোরের স্বপ্ন, পারিবারিক দুঃখশোক, শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, চার দশক জুড়ে ছাত্রীদের মিছিল বিভিন্ন স্তরে তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। “শীতপথ” কবিতার অনুপ্রেরণা চিত্রশিল্পী জর্জিয়া ওকিফ (১৮৮৭–১৯৮৬)-এর আঁকা একটি তৈলচিত্র – তিনি যে কথা শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করতে অসমর্থ, তিনি তার বর্ণনা করেন রঙ এবং আকারের মাধ্যমে। “বৃত্তি: একটি জীবন” কবিতার বিষয়বস্তু কথাসাহিত্যিক উইলা ক্যাথার (১৮৭৩–১৯৪৭) – সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে হলেও মনে পড়িয়ে দেবে বুদ্ধদেব বসুর গল্পটির কথা। কখনও চলচ্চিত্রের দৈত্য কিংকং, কখনও প্রিয় কবির কয়েকটি লাইন তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়।
অধ্যাপনা থেকে অবসর নেবার পরে দু-দশক তিনি ছিলেন সারা লরেনস কলেজের আবাসিক কবি (Poet-in-residence)। এই শতাব্দীর সূচনায় তিনি পার্কিনসনের অসুখে আক্রান্ত হন এবং সেই অসুখ সংক্রান্ত জটিলতায় তাঁর মৃত্যু অক্টোবর ২৬, ২০০৭। সাম্প্রতিককালে আমি জেন কুপারের গত পঞ্চাশ বছরের রচনাগুলি থেকে আমার ভালো লাগা বেশ কিছু কবিতার অনুবাদ করেছি। তাঁর কবিতার সংখ্যা কম, কিন্তু প্রতিটি কবিতা নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। স্থানাভাবে এখানে তার থেকে তাঁর নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা সংকলিত হল। আশা করি সেখান থেকে তাঁর শৈলি ও রচনারীতির মোটামুটি একটা সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যাবে।
আসুন আমরা জেন কুপারের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই।
চিঠি
|| ১ ||
অই শান্ত আলোর বিন্দু
কেঁপে কেঁপে নিভে যায়।
লোহা ছোঁয় কাঠের গুঁড়ি
ভেঙে প্রথমে কয়লা, তারপরে ছাই।
কাঠের গুঁড়ি নিজাকারে ঘুমোয়।
দ্বিতীয়ার চাঁদ দেখা দেয়।
প্রিয়তম, আমার শুভ্র তনুতে
এখনো তোমার পৌরুষের চিহ্ন।
|| ২ ||
হাওয়া চিবোয় ঘরের পর্দা,
বৃষ্টি আঁচড়ায় জানলার কাচ।
বাইরে তিনটে কাক
কর্কশ, বৃষ্টিময় গলায় ডাক পাড়ে।
জুলাই মাসের শুরুতেই
শরৎ এসে হাজির।
বাগানময় ফুলের শাদা পাপড়ি :
আমার বৃষ্টিভেজা চিঠির ডালি।
“ছয় প্রত্যূষের আবহ” (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থ থেকে।
ছয় প্রত্যূষের আবহ
|| ১ ||
সূর্যালোক আমার টেবিলে
শুয়ে থাকে ছেঁড়া কাগজের মত।
যে কথা বলা শক্ত
আমি বলতে চাই মুখ ফুটে
— এই এলোমেলো জীবন—
প্রাচীনতার সিলমোহর!
একটানা দীর্ঘ গ্রীষ্মে পোকামাকড়,
পাইন কাঠি, বার্চ পাতা
নিঃশব্দের পটভূমি, উদারা
গেয়ে চলে অন্তহীন।
|| ২ ||
গাছেদের কালো কালো মুণ্ডুগুলো
দল বেঁধে কাঁপে
ঝড়ের আগে ঘূর্ণায়মান
নৃত্যশীল জলরাশির মত।
কথারা ধাক্কা দেয় আমার স্তনে,
দোলে আর ছটফটে, বেরোতে চায়।
এক কৃষ্ণঝুঁটি পাখি
ঠুকরে যায়, অচঞ্চল।
ধরা দাও, ধরা দাও
ছুটে আসা বৃষ্টির মর্মরে।
|| ৩ ||
বৃষ্টিভেজা ঝোড়ো হাওয়া
ঘিরে রয়েছে আমাদের, যেন
দূর থেকে ভেসে আসা বাঁধা কুকুরের আর্তনাদ
অরণ্যের হৃদয়ে ঢেউ তোলে।
কেবল একা এক পুরুষের কণ্ঠস্বর
জেগে থাকে তাকে ছাপিয়ে।
দূরে পথের ধারে
তোমার মৃত্যুসংবাদ শুনে
আমি স্মৃতিচিহ্ন গড়তে চাই, কিন্তু
তোমার চিতাভস্ম ভেসে যায় সাগরে।
|| ৪ ||
যদি ঝড় থামে
বলতে পারি তোমার মৃত্যুর কথা,
যদি ঝড় থামে,
যদি কাকেরা কা কা বন্ধ রাখে
আর নীচু দিয়ে ওড়ে
(আবার আজকে ঝড়, নিকটে-
দূরে ....),
বলতে পারি তোমার জীবনের কথা,
এক বিদ্যুৎ ঝলকের দেখায়, সবুজ পাতারা
তখন হাত নাড়বে জানলার বাইরে থেকে।
>
|| ৫ ||
গতকালের চিঠি জানালো
আমাদের বিচ্ছেদ সংবাদ—
এক ধরনের মিলিয়ে যাওয়া
কিন্তু হঠাৎ থেমে পড়া নয়।
মাঝের অতগুলো বছর
ডানা ঝাপটায় হারানো কবিতার মত।
সকালের মৃদু, নরম আলো,
অন্তঃসারহীন...
বিশাল উচ্চতায়, দীর্ঘ অসুখের শেষে,
বুক ভরে নেয় অদৃশ্য পৃথিবীর ধূলিকণায়......
|| ৬ ||
বিশ্রাম।
বেহালার ছড়, হাওয়া
ছুঁয়ে গেল বার্চ গাছে
শস্তা – নতুন বাঁশি
বাজালো গাছের শীর্ষ।
কাঠবেড়াল ছুটে পালায় ভয়ে....
কার পা মাড়াবে এই ডালপালা?
প্রত্যাশিত নৈঃশব্দ্যের সাগরে
কেন আমি লিখবো
আমার নাম?
[“ছয় প্রত্যূষের আবহ” (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থ থেকে।]
অনধিকার
|| ১ ||
আসবাব
এখানে সব আসবাব তার নিজের মতন থাকে। আমি যখন
সিঁড়ি বেয়ে উঠি, হলঘরের চেয়ারগুলো গোনে আমায়।
টবে রাখা তিনটে গাছ – তার পেছনে পিয়ানো আপন মনে বাজে,
আর চারটের সময় নিজে নিজে আলো জ্বলে উঠলে
উজ্জ্বল টুপি পরা মৃত মেয়েটির ছবিতে গোলাপি আভা লাগে।
আমরা বেশ দয়ালু মানুষ। মাঝে মধ্যে বিগড়ে
যেতে পারে কেউ, বাইরের জগতকে সোচ্চার জানায়
টাইপরাইটারের খটাখট বা চানের জলের ঝর্ঝর শব্দে।
তারপর ছড়ানো থাকে এঁটো গ্লাস, স্বাস্থ্য ভালো রাখার বইপত্তর
কিন্তু সরঞ্জামগুলো আমাদের আগে থেকেই আছে এখানে।
আর গাছের আসবাবপত্রের চেয়েও প্রাচীন।
তারা এখানে দেখেছিল প্রথম নিমজ্জন
(তুমি যাই বলো, আমি সর্বদাই জানি শিশুরা ডুবেছিল জলে)।
কাল রাতে এক কণ্ঠস্বর ডাকলে আমায় দরজার বাইরে থেকে।
কোন মানুষের স্বর নয়, হয়তো ছাতার আলনাটাই কথা বলেছিল
|| ২ ||
স্মৃতিচিহ্ন
যে যাই হোক আমরা সবসময় জেগে উঠি
মৃত মানুষের শয়নকক্ষে, তাদের
ধুমসো শীতজ্যাকেটের ঘেমো গন্ধ শুঁকি, আর
তাদের জুতোর ছাপ আমাদের ধূসর কার্পেটে।
ওই এক পোস্টকার্ড হাতে নিয়ে বসে থেকে কি হবে?
কোন শিশুর একগোছা অলক যদি
স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনে তার মুখাবয়ব, আমি কি
তবু তাকে হাওয়ায় উড়ে যেতে দিতে পারি?
ঘর, বাড়ি, এই আবর্জনায় বাস আমাদের!
আশায় ঘর বাঁধি, মলিন ফটোতে খুঁজি
অজাত সন্তানকে, স্বাধীন হতে চাই
আমাদের হিংস্র অথচ নিষ্ঠাবান জীবনকে ছেড়ে।
|| ৩ ||
উত্তরাধিকার
মাল্টে লরিড্স, স্বেচ্ছাচারী : এবং কারুর কোন
সম্বল নেই আর কেউ কয়েকটা জামাকাপড়
আর খানকতক বই ঝুলিতে বেঁধে পৃথিবীভ্রমণে যায় না।
কি ধরণের জীবন আমদের? গৃহ নেই,
নেই উত্তরাধিকার (কাচের বাক্সে, ধরে নাও
কর্তামশাই এর চশমা?), নেই
কুকুরের দল—
তাও কর্তামশাই এর মৃত্যুর পর সে লেখে:
আমি ভয়কে জয় করার পন্থা হিশেবে,
সারা রাত জেগে বসে থেকে লিখেছি আর লিখেছি।
আর, এখনো পর্যন্ত শুধু
স্মৃতিকে ধরে রাখাই যথেষ্ট নয়, তাকে
পরিণত করো তোমার শরীরে, রক্তে।
কবির টীকা— “উত্তরাধিকার” কবিতাটির প্রায় পুরোটা রাইনার মারিয়া রিল্কের (১৮৭৫–১৯২৬) “মাল্টে লরিড্স ব্রিগ্গের নোটবুক” গ্রন্থ থেকে হুবহু উদ্ধৃত।
“মানচিত্র ও ঝরোখা” (১৯৭৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে।
পথ চেয়ে
চিঠি আসে, ফোন বাজে, জানালার পাশে তুমি
শেষ জলের গ্লাসটির মত সামলে সুমলে বসে।
এপার ওপার শহরের হাসপাতাল আহত মানুষে গিজগিজ।
বিয়ের মত, ডিভোর্সেও দুই শত্রুপক্ষ চাই।
কিন্তু যা রয়ে যায় এখন বাড়িয়ে বলা কি দরকার :
তোমার শোক, তার শোক — এই ব্যথার অধিকার।
“মানচিত্র ও ঝরোখা” (১৯৭৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে।
বাড়ি ভাড়া
তুমি যদি আমার ফ্ল্যাট নিতে চাও,
যাও, নিয়ে ঘুমোও গে
তবে একটা বোঝাপড়া করে নেওয়া যাক :
বইপত্রগুলো কিন্তু তোমার নয়, তারা স্বাধীন।
দোলনা-চেয়ারের বাহু তোমায় ঘিরে থাক
কিংবা আবার ছেড়ে দিক,
বাতাস দিয়ে তারা বানিয়ে নিক শরীর।
তোমার থেকে আমি বাড়ির ভাড়া চাই না,
আমি চাই তোমার মনোযোগের বিকীরণ
খাবার টেবিলে মোমের আলোর মতন।
এক বিচিত্র বিস্ময়
আমাদের দুজনের মাঝে শূন্যতায় বিচরণ করুক —
ছাদ চাই না, মাঠভরা নক্ষত্র চাই।
[১৯৮৪ সালে প্রকাশিত “মাচান” কাব্যগ্রন্থ থেকে]
ক্লাস
কিভাবে সে ধীবরকন্যা দাঁড়ালো শীর্ষাসনে ইস্কুলের
দেয়ালের পাশে
দেখালো তার পরনে কোন জাঙিয়া নেই
ঠিক সেই সময় শবযাত্রার মত হাজির আমার দিদিমার
পুরানো কালো প্যাকার্ড
কিভাবে আমরা জঙ্গলে গর্ত খুঁড়ে জলদস্যুর গুপ্তধন খুঁজি
আর পাই কেবল ধেনোর খালি পাঁইট
“সবুজ নোটবুক, শীতপথ” (১৯৯৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে।