‘জানিস, যখন ছোট ছিলাম, এই ধর পাঁচ ছ’ বছরের, তখনও মাঝেমাঝেই এই পৈঠাতে বসতাম। আমার খুব ভাল লাগত। আমার মনে হত আমি একটা পাখি।’
আমি বিশাখাদির কথায় আশ্চর্য হলাম না, কারণ আমারও ছোটবেলায় পাখি হয়ে উড়তে ইচ্ছে করত। বিশাখাদি তাহলে আমার মতই ভাবে। বিশাখাদি আমার পিসতুতো দিদি, আমার চাইতে বছর তিনেকের বড়। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাই ছুটি এখন। আমাদের বাড়ি এখান থেকে ট্রেনে বেশ পাঁচ ছ’ঘণ্টার পথ, তাই ছুটি না হলে পিসির বাড়ি যাওয়া হয় না। ওদের বাড়ি বেশ গণ্ডগ্রামে, সেখানে বাড়িগুলো টিলার উপর, গাছপালায় ভর্তি, টিলার নীচে পুকুর, মধ্যেমধ্যে ধানজমি, বেশ রহস্যময় মনে হয় জায়গাটাকে।
আমি মনোযোগ দিলাম তার কথায়। ‘ওই সামনে পথের ঢালে যে গাছগুলো, ওখান থেকে অনেক পাখি আসত, এই এখনো যেমন আসে। তারা আমার কাছে বসত। এই যেমন আমার কাছে তুই বসে আছিস তেমনি। আমার দুধারে লাফাত, আমার গায়েও বসত।’
তার কথায় আমারও মনে হয়, আমি কি তাহলে পাখি হতে পারি?
বিশাখাদি বলল, ‘এখন যেমন ওরা ভয় পেয়ে যাচ্ছে, দূরে দূরে থাকছে, তখন এমন থাকত না। ভয় মোটে পেত না আমাকে। আমার মনে হত আমি তাদের কথাও বুঝতে পারছি। আমাকে যেন বলত, ‘এই দেখ, কেমন উড়ে যাই। এক উড়ালে সব ক’টা পৈঠা পেরোই। তুইও আয় অমনি করে।’ আর আমি সত্যি সত্যি হাত দটো দুদিকে মেলে দিলাম, পা-দুটোকে অল্প ছড়ালাম, বুক ভরে শ্বাস নিলাম, আর --- উড়ে গেলাম। বেশি দূর নয়, কিন্তু এক উড়ালে পৈঠাগুলো ছাড়িয়ে পথে চলে গেলাম, ও-ই-খানে---’
ওদের বাড়ি টিলার উপর, হাত তিনেক লম্বা সুপুরি কাঠে আটকানো মাটির কুড়িটি ধাপ টিলার গায়ে, প্রতিটি সুপুরিকাঠের দুধারে দুটো করে ছোটছোট খুঁটি দিয়ে আটকানো। আমরা প্রথম ধাপে বসে ছিলাম। ধাপগুলোর নিচে টিলার গা কেটে সরু রাস্তা, বেঁকে গ্রামের দিকে নেমে গিয়েছে। রাস্তার ওধারে টিলার ঢাল, ঢালে ছোট বড় গাছের জঙ্গল। গাছগুলোর গায়ে নানারকম লতা, অর্কিডের ফুল ঝুলে রয়েছে। ওখানে অনেক পাখি থাকে। ছোট্ট বিশাখাদি হাত বাড়িয়ে ডানা মেলে ওই রাস্তা অবধি অবধি উড়ে যেতে পারত, কী আশ্চর্য!
‘আমিও ছোটবেলায় উড়তে চেষ্টা করতাম দু’হাত মেলে, খুব ইচ্ছে করত, কিন্তু পারতাম না,’ আমি বলি।
‘আমি পারতাম। কিন্তু কেউ দেখে নি কোনোদিন, আর বললে কেউ বিশ্বাস করত না।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ রে, সত্যি। কিন্তু মাকে বললে, মা বলত, ‘বাজে বকিস না, আমার সময় নেই শুনবার। যা, উঠোনে ঘাস হয়েছে, সেগুলো উপড়ে ফেল তো। কিছু কাজ তো কর। সারা গরমের ছুটি জঙ্গলে ঘুরে কাটাচ্ছ।’ বা আর কিছু কাজে যেতে বলত।
দাদাও শুনে হাসত। ‘উড়াল দিয়ে গাছে ওঠ তবে, আম কাঁঠালগুলো পেড়ে আন। আমাকে তাহলে গাছে উঠতে হবে না।’
‘কিন্তু আমি সত্যি সত্যি গাছে চড়বার চেষ্টা করলে সবাই চেঁচাত। ‘গাছে উঠবি না মুখপুড়ি। মেয়েরা গাছে উঠলে লোকে গেছো মেয়ে বলবে, বিয়ে হবে না।’ বাবা বলত, ‘গাছে উঠতে হবে না, মা। পড়েটড়ে যাবি, হাত পা ভাঙবে। ওসব করতে হবে না’।’
বিশাখাদির দিকে তাকাই। মাঝারি গঠন, শ্যামলা, তেলমাজা ত্বক, কোঁকড়া তেলমাখা পিঠছাওয়া চুল। বড় বড় কালো চোখ, দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব একটা হাসে না। হাঁটাচলাও ধীর স্থির। তার কোনো কথাই অবিশ্বাস করতে পারি না, এতই সহজ শান্তভাবে কথাগুলো সে বলে।
আমি জিগ্যেস করি, ‘কখন থেকে আর উড়তে পার না?’
‘আরো বড় হবার পর, যখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনে।’
আমি আবারও জিগ্যেস করলাম, ‘তুমি যখন উড়তে তখন কেউ কোনোদিন দেখেনি?’
‘না, তখন আমি একা থাকতাম, কেউ কাছে থাকত না। পাখিগুলো আসত তাই। তাদের সঙ্গে ওই পথ অবধি উড়ে যেতাম।’
‘তারপর আর যেতে না?’
‘না, ওরাও জঙ্গলে উড়ে যেত। আর আমাকে বাড়ির কেউ না কেউ ডাকত, না ডাকলে কী জানি আরো উড়তাম।’
‘কী করে তোমার ওড়া বন্ধ হয়ে গেল?’
সে চুপ করে রইল।
অনেকক্ষণ পর প্রসংগ পাল্টে বলল, ‘তুই অতুলকাকাকে দেখেছিস তো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি যেদিন এলাম সেদিন এসেছিলেন সন্ধ্যার পর, উনিই না?’
‘হ্যাঁ, উনিই। উনি একজন গুনিন।’
‘হ্যাঁ, বুঝলাম তো সেদিন। ওঁর গল্প শুনছিলাম। পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দারুণ সব কথা বলছিলেন।’
‘জানিস, উনি আমাদের বাড়িতেই একবার ঘরবন্ধন করেছিলেন। অনেকবছর আগে, আমি তখন ফোরে পড়ি। একদিন হঠাৎ করে একদিনের জ্বরে আমাদের ছোট ভাই বিতান মারা গেল। মাত্র তিন বছরের ছিল তখন। আমরা খুবই কান্নাকাটি করছিলাম, মায়ের তো অবস্থাই খারাপ। ঠিক দুপুরবেলা বাড়ির উপর দিয়ে একটা হাওয়া শন শন শব্দে বয়ে চলে যায়, অতুলকাকা সেদিন ছিলেন এখানে, বলেছিলেন, শর চলছে তোমাদের বাড়ির উপর দিয়ে। এ মাঝরাতেও যেতে পারে। এর পথ পাল্টে দিতে হবে, না হলে যা তার সামনে পড়বে তারই অপঘাত হবে।’
‘মানে?’ বাবা জিগ্যেস করলেন।
‘মানে ডাকিনীর উড়ে যাবার পথ। পরিষ্কার দিনের ভরদুপুরে বা ভররাতে হঠাৎ করে একই বার হাওয়া চলে গেলে তা স্বাভাবিক নয়। ডাকিনী অদৃশ্যভাবে উড়ে যায়, তারই হাওয়া। তোমরা আগে খেয়াল করনি সুনীলদা? আমায় বললে আগেই প্রতিকার করতাম। ছাওয়ালটা ডাকিনীর সামনে পড়েছিল। আমি থাকলে বেটিকে দেখিয়ে দিতাম, আমাদের ছাওয়ালকে কী করে নিতে পারে।’ কাকা প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে বলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন,
‘তবুও একটা প্রতিকার করানো দরকার। তোমার বাকি ছেলেমেয়েদের জন্য। বলা তো যায় না – ’
বাবা তখন তাঁকে প্রতিকার করতে বলেন। পরের শনিবার কাকা কীসব পুজো করে মন্ত্র পড়ে বাড়ির চারদিকে চারটি কিছু জিনিষ পুঁতে দেন। এখন যেকোনো প্রেতযোনি এখান দিয়ে গেলেও তার আমাদের অনিষ্ট করার শক্তি থাকবে না।’
‘তারপর থেকে আর কখনো ওই হাওয়া চলে নি?’
‘কী জানি, আমি বুঝতে পারি না। তবে হাওয়া চললেও নাকি আমাদের কিছু অনিষ্ট হবে না, বাড়ি বন্ধন করে দিয়েছেন তো।’
অতুলকাকু বিশাখাদিদের গ্রামেই থাকেন, বাড়িতে কালী মন্দির রয়েছে। তিনি নাকি তন্ত্রসিদ্ধ। গ্রামে অল্পস্বল্প যজমানি করেন, সেইসঙ্গে তন্ত্রমন্ত্র, ঝাঁড়ফুক। কপালে দুই ভুরুর মাঝখানে একটা ছোট লাল সিঁদুরের তিলক লাগান। পুজোর কাজ ছাড়া অন্য সময় পরনে সাদা ধবধবে ধুতি সুন্দর ভাবে কাছা ও কোঁচা দিয়ে পরা, গায়ে শার্ট, যেমন শার্ট হেমন্ত মুখার্জি পরতেন। বেশ ফিটফাট। সবচাইতে বড় কথা উনি যখন গল্প করছিলেন, তখন তা এমন আকর্ষণীয় লাগছিল যে আমি কান পেতে শুনছিলাম। বেশ নাটকীয় ভাবে কথা বলেন, কখনো জোর দিয়ে, কখনো আস্তে, গলার স্বর আবৃত্তিকারদের মত ভাল এবং স্পষ্ট। চোখগুলো উজ্জ্বল, যেন সামনের মানুষের ভেতর অবধি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। বেশিরভাগই তিনি কীভাবে কাউকে প্রেত বা অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করলেন, দৈব ভরকরা মানুষের ভর ছাড়ালেন সেইসব গল্প। গা ছমছম করছিল, কিন্তু উঠে যাবার জো নেই, যেন আটকে রয়েছি। সেদিন যখন চলে যাচ্ছেন, আমার মনে হচ্ছিল আবার কখন আসবেন। উনিও বোধ হয় আমার কথা বুঝেছিলেন। যাবার সময় আমার দিকে চেয়ে বলেছিলেন, ‘আরো কত গল্প আছে, বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। কাল এসে বলব।’
এর পর দুদিন আসেন নি, আজ এখন পর্যন্ত না।
‘ওঁর কথা বলব একদিন।’ বিশাখাদি আমাকে বলল।
পরদিন তিনি এলেন। ‘সুনীলদা, বাড়ি আছ?’
সুনীলদা মানে বিশাখাদির বাবা মানে আমার পিসে বেরিয়ে ডাকলেন, ‘এসো, অতুল, বসো।’ অতুলকাকা এখানে সম্মানিত অতিথি। ভেতরে এসে একখানা চেয়ারে বসলেন অতুলকাকা। পিসে ভেতরে পিসিকে চা করতে বলে এসে অন্য চেয়ারে বসলেন। আমি ও বিশাখাদি একধারে বিছানার উপর বসেছিলাম। বিশাখাদি উঠে রান্নাঘরে চলে গেল।
অতুলকাকু বললেন, ‘যা কাণ্ড হল দুদিন, বুঝলে সুনীলদা। সন্তোষ ধরের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। কাজ করে এলাম।’
‘কী ব্যাপারে?’
‘সন্তোষের বউটাকে দেখেছ? বেশ লক্ষ্মীমন্ত বউটি, কথাবার্তা ব্যবহার ভাল, বউটার জ্বর এসেছিল। তিনদিন ধরে জ্বর, চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল, সঙ্গে ভুল বকা, শাশুড়িকে গাল দিচ্ছে, স্বামীকে গাল দিচ্ছে একেবারে চোদ্দ পুরুষ তুলে, মাঝেমাঝে ঘরের জিনিষপত্র ছুঁড়ে ফেলে তুলকালাম করছে, শুইয়ে দিতে গেলে ধাক্কা মারছে।’
‘বউটিকে তো ভাল মানুষ বলেই জানতাম। গলা তুলে কথা বলত না।’ পিসিও কথায় যোগ দিলেন।
‘হ্যাঁ, সেরকমই তো ছিল। সন্তোষই এসে আমায় বলল, ‘ঠাকুরদা, বড্ড মুশকিলে পড়েছি, আপনাদের বউমার জন্য।’
‘কী হয়েছে?’ জিগ্যেস করলাম।
‘সে বলল, ‘বউ কদিন থেকে জ্বর, হেমেন ডাক্তারের ওশুধ আনিয়ে খাওয়ালাম, সারছে না। তাতে গা পুড়ে যাচ্ছে, ভুল বকছে, তবু কলসি নিয়ে পুকুরঘাটে ছুটছে, মা বারণ করল, মাকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আমি আটকাতে গেলাম, আমাকে গালাগালি করে ঠেলে মাটিতে ফেলে উপরে পা দিয়ে মাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। পুকুরে এই জ্বরগায়ে ডুব দিয়ে চান করছে তো করছে, উঠছে না, ডাকলে সাড়া নেই। আমি ধরে টানলাম, আমার হাতে দাঁত ফুটিয়ে দিয়েছে, এই দেখ। বাতাস লেগেছে নাকি ঠাকুদ্দা? কি হবে গো, কি করব,’ সে একরকম কেঁদে ফেলে আরকি।
‘আচ্ছা, যাও, আমি যাচ্ছি।’ তাকে বললাম।
‘আমি যেতে যেতে সন্তোষের বউ কলসি নিয়ে ঘরে এসে গেছে, নিজে থেকে এসেছে। কিন্তু ঘরে ঢোকে নি, দাওয়ায় বসে আছে। কাপড় ভেজা, চুল ভেজা, দাওয়া উঠোন কাদা হয়ে আছে। চোখের অবস্থা ভাল নয়, লাল টকটকে, দৃষ্টি অস্থির, কিন্তু চকচকে। বোঝা যাচ্ছে ভর হয়েছে।’
‘আমি বললাম, ‘ওকে ঘরে নিয়ে যা।’ সন্তোষ হাত ধরতেই বউটি ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে দিচ্ছিল, সন্তোষ ও তার মা ভয় পাচ্ছিল। ওরা সামলাতে পারছে না দেখে আমিও বউটির একহাত ধরলাম, সন্তোষের মা পিছে পিছে।
‘আমি তাকে মেঝেয় বসিয়ে দিতে বললাম, ঘরের বাইরে গেলাম, তারা কোনোরকমে ভেজা কাপড় ছাড়িয়ে শুকনো পরিয়ে দিল। তারপর আমি ঢুকলাম, ওদের বললাম ধুপধুনো জ্বালিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে বাইরে যেতে বললাম। ঘর বন্ধন করলাম যাতে আর কোনো অপদেবতা ঢুকতে না পারে। যন্ত্র এঁকে ডাকিনী মন্ত্র পড়ে কিছু কিছু কৃত্য করলাম। দুঘণ্টা পর বউটির শরীর মোচড়াতে লাগল, গলা থেকে অস্পষ্ট অন্যরকম আওয়াজ। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কে তুমি?’ আওয়াজ এল, ‘আমি বনদুর্গা।’ আমি মাটিতে প্রণাম করলাম, জিগ্যেস করলাম, ‘মা, তুমি কেন ওর উপরে ভর করেছ? ও কি তোমার কাছে কিছু অপরাধ করেছে?’
বনদুর্গা একইভাবে বললেন, ‘ও তরশু দিন লাল শাড়ি পরে খোলা চুলে সন্ধ্যাবেলা পুকুরঘাটে গিয়েছিল। আমার শ্যাওড়া গাছের নিচে অপবিত্র করেছে। যা করার নয় তাই করেছে।’
‘ছেড়ে দাও মা ওকে, প্রসন্ন হও। কী করলে তুমি ওকে ছেড়ে দেবে?’
‘কাল মঙ্গলবার আছে। সারাদিন উপোস করে নিশুত রাত করে ভৈরব থানে একটি রক্তবস্ত্র, পাঁচটি কালো মাছ ও সোয়া সের চাল নৈবেদ্য দিয়ে বনদুর্গার পুজো করবি।পুজোর আশীর্বাদী পুষ্পবিল্বপত্র ও চরণোদক ওকে দিবি।’
‘কী আর করা, মাকে বললাম, ‘তাই হবে।’ একটা টিকটিকি টিকটিক করল। মাথার উপরে মেঘের শব্দের মত শব্দ হল, বোধ হয় মা অনুমোদন করলেন।
‘আমি দরজা খুলে সন্তোষকে সব কথা বললাম। বউটি আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল পুরোদিন। সন্তোষ বুঝে নিয়ে কাল রাতে পুজোর আয়োজন করল, রাত দশটা থেকে পুজো করলাম, দুটোয় শেষ হল। বউটিকে আশীর্বাদ দিয়ে এলাম। চরণামৃত ওর মুখে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের চালের উপর থেকে কিছু একটা উড়ে গেল। বুঝলাম মায়ের ডাকিনী বউটির শরীর ছেড়েছে।ওর চোখের লাল জবার মত রং ও ফিকে হয়েছে। ওকে প্রসাদ খেতে বললাম।
‘সন্তোষও দেখল, বউ যেন এখন কিছুটা ধাতস্থ। তাই আমি চলে এলাম। বিশাল ধকল গেল কাল।’
ওঁর গল্প আমি হাঁ করে গিলছিলাম। মনে হচ্ছিল আমারও যদি ভর হত। দেখতাম অতুলকাকা কীভাবে প্রতিকার করেন। আবার ভাবলাম, কিন্তু যার ভর হয় তাকে তো ভীষণ কষ্ট পেতেও হয়। না বাবা, ভর হয়ে কাজ নেই। বাড়ি যেতে হবে, কদিন বাদে রেজাল্ট আউট হবে, তারপর কলেজ। ভরের ব্যাপারে কৌতূহল থাকলেও এখানে থাকতে পারব না।
বিশাখাদি চা করে নিয়ে এসে হাতে হাতে দিয়েই চলে গেল। পিসিও এসে অল্পক্ষণ বসে কুশল জিগ্যেস করে গেলেন। চা খেয়ে হঠাৎ উনি আমাকে বললেন, ‘দেখি তোমার হাত?’ আমি বাঁ হাত বাড়ালাম। উনি হাতটা নিজের উরুর উপর নিলেন, বেশ খানিক ক্ষণ হাতখানা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলেন, রেখা দেখতে দেখতে একটু একটু চাপও দিলেন; তারপর দু চারটে মামুলি কথা বললেন, যেমন আমার বিদ্যাস্থান ভাল, ধনস্থান ভবিষ্যতে ভাল হবে, অর্থাত চাকরি করব, বিয়ে ভাল ঘরে হবে, হাত নরম, মনটি সরল ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্তত দশ মিনিট হাত ধরে থেকে থেকে এই ক’টা কথা বললেন, তারপর ছেড়ে দিলেন। ব্যাপারটা কী হল? ওদিকে বিশাখাদি যে গেল আর এল উনি উঠে যাবার পর। এঁটো কাপগুলো নিয়ে ধুয়েটুয়ে রেখে দেবার পর আমরা বিশাখাদির ঘরে গিয়ে বসলাম। ওর ঘর মানে সেখানে সে তার মা এবং কোলের ভাইটি শোয়। বাবার ঘর আলাদা, বড় দুভাই বাইরের ঘরে শোয়। পিসি এখন শুঁটকির রসা রান্না করছেন, বাড়ি গন্ধে ম ম করছে। ছোট ভাই ঢাকা বারান্দার একধারে দাদার কছে পড়ছে।
রাতের বেলা রাস্তার মুখে সিঁড়ির উপর মেয়েদের বসে থাকতে নেই। অনেকগুলো ‘করতে নেই’এর মধ্যে এটি আরেকটি করতে নেই। অথচ ওদের ওই জায়গাটায় বসতে আমারও খুব ভাল লাগে। ওরও প্রিয় বসবার জায়গা ওখানটায়, সেই ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু বাড়িতে বারণ।
বিশাখাদি বলল, ‘আমি উড়ি শুনে প্রথম প্রথম মা বাবা আমল দিতেন না। তখন আমি ক্লাস সিক্স, একদিন রাতের বেলা শুনি মা বাবাকে বলছেন, ‘অতুল ঠাকুরপোকে বলো বিশির ব্যাপারে। ওর এই উড়বার ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না। মেয়ে বড় হচ্ছে, বিয়ে দিতে হবে একদিন। এরকম কথা বলতে থাকলে বিয়ে হবে?’
‘বাবা বললেন, ‘একথা অন্য কাউকে বলো না যেন। আমি অতুলকে বলব।’
‘আসলে মা বাবা ভেবেছিলেন আমাকেও ডাকিনী ধরেছে, তাই ওরকম বলি। কাকা পরদিন এলেন। মা প্রায় কাঁদো কাঁদো। ‘অনেকদিন থেকেই এরকম বলে যে ও ওড়ে। বেশ কবছর । এরকম যদি বলতে থাকে তাহলে লোকে ওকে পাগল ভাববে। এ মেয়ের বিয়ে হবে বলো?’
‘বাবা বলছিলেন, ‘আমার দুটো চারটে নয়, একটাই মেয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করিয়ে একটা ভাল চাকুরে ছেলে দেখে বিয়ে দেব, ভেবে রেখেছি। কিন্তু সে এমন করছে কেন, বড় চিন্তা হয়।’
পিসিদের গ্রামে একটা মিড্লস্কুল আছে, বিশাখাদি ও তার ভাইয়েরা সেখানেই সেভেন পর্যন্ত পড়েছিল, এর বেশি পড়তে গেলে পনেরো কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে হয়, মেয়েদের জন্য মুস্কিল। ভাইরা সেখানে এক পরিচিতের বাড়িতে থেকে পড়েছে এবং পড়ছে। বিশাখাদি বাড়িতে এক মাস্টারের কাছে পড়ে শুধু পরীক্ষা দিতে যেত। তবে পড়াশোনায় খারাপ ছিল না বলে ম্যাট্রিক পাশ করে গেছে। পড়াশোনা আর এগোয়নি।
বিশাখাদি বলতে থাকল, ‘অতুলকাকা বললেন, ‘ঠিক আছে, দেখছি। অত চিন্তা করো না। আমি অনেক প্রেতযোনির প্রতিকার করেছি। দেখে নেবো, আমাদের মেয়েকে কে ভোগাচ্ছে। চিন্তা করোনা বউদি। আমি যখন কাজ ধরি, তখন শেষ করেই ছাড়ি। সামনের মঙ্গলবার আসব। সেদিন অমাবস্যা ও আছে, মায়ের পুজোর প্রশস্ত দিন।’
‘মঙ্গলবার অতুলকাকা প্রতিকারের জন্য যথারীতি রাত দশটায় এলেন। বাবার শোবার ঘরটা ভেতরের বারান্দার দিকে, যেহেতু মা বাবা পাঁচকান করতে চাইছিলেন না, তাই এই ঘরটাতেই আয়োজন করা হয়েছিল। কাকা যন্ত্র এঁকে ঘট বসিয়ে ধুপধুনো জ্বালিয়ে ঘর অন্ধকার করে মন্ত্র পড়তে থাকলেন, আমাকে একটা মাদুরে মেঝেতে শুতে বললেন। মা বাবা সবাই বাইরে, দরজা বন্ধ। আমাকে কিছু তরল একটুখানি খাইয়ে দেওয়া হল। জোরে জোরে মন্ত্র চলতে থাকল। আমি ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না, আচ্ছন্নের মত শুয়েছিলাম। আমার চোখ যেন জোড়া লেগে আছে। টের পাচ্ছিলাম আমার জামার নিচে সারা শরীরের উপর দিয়ে একটা কিছু সরে যাচ্ছে যেন একটা হাত, যেন একটা সাপ। আমার বুকে চাপ পড়ছে, ব্যথা লাগছে, আমার তলপেটে, দুই উরুতে চাপ দিচ্ছে, আমি কিছু বলতে পারছিলাম না, আমার আওয়াজ বের হচ্ছিল না। আমার শরীর প্রায় অবশ, কি করা হচ্ছে কিছু বোঝবার ক্ষমতাও ছিল না। বেশ খানিকক্ষণ পর চাপটা সরে গেল, মন্ত্র একই সঙ্গে চলছিল, আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর কিছু মনে নেই।
‘পরদিন সকালে কিছু আবছা আবছা মনে পড়ছিল। মা বাবা আমাকে জাগতে দেখে উঠিয়ে মুখ ধুয়ে চান করে এসে পুজোর আশীর্বাদ প্রসাদ ইত্যাদি নিতে বললেন, দেখলাম একটা কবচও বাঁধা হয়েছে বাঁ বাহুতে। যা কিছু বলা হল সব করলাম। মাকে আলাদা করে বললাম, যখন আচ্ছন্ন ছিলাম তখন আমার সারা শরীরে কিছু একটা সাপের মত সরে সরে যাচ্ছিল, চাপ দিচ্ছিল, কিন্তু মা কথাটা গ্রাহ্য করলেন না।
‘তোর গায়ে হাওয়া লেগেছিল। সেসব চলে গেছে, আর আসবে না, তাই এই মাদুলি পরানো হল। কাউকে বলবি না কেন এই মাদুলি পরেছিস। বলতে নেই।’
আমি সব বুঝতে না পারলেও বিশাখাদির কথা শুনে ওর উপর খারাপ কিছু হয়েছিল বলে আন্দাজ করতে পারছি। সে বলল, ‘সেই সময় আমাকে অনেকদিন চোখে চোখে রাখা হত, আমাকে একা সিঁড়িতে বসতে দেওয়া হত না। বিভাসকে সঙ্গে নিতে হত।’ বিভাস ওর সবচেয়ে ছোট ভাই।
‘তারপর থেকে আমি আর উড়তে পারি না। পাখিগুলো ও আমার কাছে আসে না। আমার খুশিটাই নষ্ট হয়ে গেল। অন্যরকম হয়ে গেল সবকিছু।
‘আমি আর অতুলকাকার সামনাসামনি বড় একটা আসি না। আসতে ইচ্ছে হয় না। কেমন লাগে লোকটাকে। মাঝে মাঝে ডাকে আমাকে, ওদের বাড়িতে যেতে বলে। কিন্তু আমি যাই না। এতবছরে একবারও না।’
এর পর বছরের বেশি কেটে গেছে। বিশাখাদির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পিসে তাঁর মনোমত পাত্র খুঁজে পেয়েছেন, বি এস এফ-এর অফিস ক্লার্ক। ছেলের বাড়ি এই মহকুমায় হলেও চাকরি সেই মণিপুরে, এই একটাই খারাপ। কাজেই বিশাখাদির পক্ষে বাপের বাড়িতে আসা একটু চাপের হবে। এছাড়া সব ঠিকঠাক, বিশাখাদি নিজেও খুশি।
সেই বিয়ে উপলক্ষে এসেছি। আগের বার আমি চলে গিয়েছিলাম অতুলকাকার হাত দেখার পরদিনই। আমার ম্যাট্রিকের রেজাল্ট বের হবার ছিল। অনেকদিন হয়ে গেল, আর যাওয়া হয় নি। এই বছর আমি কলেজে পি ইউ দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, পড়াশুনো ও বন্ধুবান্ধবের সংস্রবে নতুন আলোকে পৃথিবীকে দেখছি।
বিয়ের জন্য একজন পুরোহিত দরকার, পিসে নিজের একজন গরিব আত্মীয়কেই ঠিক করেছিলেন অনুষ্ঠানের জন্য, যাতে সেই লোকটির কিছু রোজগার হয়। অতুলকাকা নিজে এসব করেন না, তিনি নিজের কাউকে দিতে চেয়েছিলেন, পিসে রাজি হননি।
বিয়েতে অতুলকাকা আসেন নি। তাঁর সেদিন নাকি কোনো যজমানবাড়িতে যেতেই হবে। তবে বউভাতে যাবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন।
বিয়ের দিন দেখা গেল বেনারসি শাড়িটা পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজাখুঁজি, তোলপাড়, তারপর দেখা গেল সেটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বিশাখাদির মনে একটা ভয় ঢুকে গেল, ওর বিয়েতে কিছু খারাপ হবে না তো?
বিয়ে চুকল। পরদিন সে শ্বশুরবাড়ি যাবে সন্ধেবেলা। আমিও তার সঙ্গে যাব, প্রথামত একজন বোনকে কনের সঙ্গে যেতে হয়। আমি রেডি হয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম কারণ কনেবিদায় উপলক্ষে বিশাখাদি তার মা বাবা ও অন্যান্যদের কান্নাকাটি চলছে, এবং এইসবের সামনে থাকা আমার মোটে ভাল লাগে না। সেই পৈঠের নিচে প্রায় লুকোনো একটুখানি লালসুতো জড়ানো ও সিঁদুর মাখানো তিরকাঠির মতন কিছু এবং একটা জবাফুল দেখতে পেলাম। এসব কী জিনিষ? উপর থেকে দেখা যায় না। পিসতুত দাদাকে ডাকলাম দেখতে। সে দেখে গিয়ে তার বাবাকে চুপিচুপি বলল।
পিসে পিসি কেঁপে উঠলেন, তাঁদের মেয়েকে কেউ কি বাণ মেরেছে? এটাই নাকি কারো অনিষ্ট করবার জন্য তুকতাক, যাকে বাণ মারা বলে? বিশাখাদি ও বর পেছনে আছে, ঘটনাটা জানানো না হলেও কিছু একটা ঘটেছে সে বুঝতে পারছিল ।
সিড়ির ধাপের নিচে বস্তু-কটা পড়ে আছে, তার উপর দিয়ে গেলেই বরকনের খারাপ হবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেউ সেটা তুলে ফেলতেও ভয় করছে। আমি এগিয়ে গিয়ে সেগুলো তুলে দূর করে জঙ্গলের দিকে ফেলে দিলাম। পিসে পিসি ও দাদা ভীত হয়ে তাকিয়ে থাকল। আমি বললাম, ‘আমার কিছু হবে না, দেখো।’
নতুন জামাইবাবুর সঙ্গে দিদি গাড়িতে উঠল, আমি তার পাশে বসলাম। শ্বশুরবাড়িতে বউভাতের অনুষ্ঠান ঠিকঠাক হয়ে গেল, আনন্দ হল খুব। তিনদিন পর দ্বিরাগমনে ওরা এল, সঙ্গে আমিও ফিরে এলাম।
এর মধ্যে নাকি অতুলকাকার জ্বর হয়েছে, শুনলাম। উনি বউভাতে যাবেন বলেছিলেন, জ্বরের জন্য যেতে পারেন নি। পিসেপিসি যান নি দেখতে, মেয়ে বিয়ে দিয়ে মুহ্যমান ওঁরা, বেরোনোর ইচ্ছে তো দূরের কথা। এখন তো মেয়ে জামাই এসেছে, দু’তিনদিন অনেক কাজ । বিশাখাদি খবর শুনে আমাকে বলল, ‘মরুক গে।’
কনে দ্বিরাগমনে এলে দু’রাতের বেশি থাকতে নেই, তাই দুদিন বাদে সকালবেলা ওরা ফিরে গেল। সেদিনই রাতে শুনলাম, অতুল কাকা মারা গিয়েছেন। ওদের গ্রামে এবং আশেপাশেও হাসপাতাল নেই, বাড়িতেই ছিলেন। পিসি ফিসফিসিয়ে বললেন আমি সেই যে বাণ মারার জিনিষগুলো ফেলেছিলাম, সেগুলো নাকি তাঁর বাড়ির দিকে মুখ করে ফেলেছিলাম। বাণ বিফল হলে উল্টে যে মেরেছে তারই গায়ে লাগে। যেহেতু অতুলকাকা মারা গিয়েছেন, এবং তিনি গুনিন, বোঝা যাচ্ছে তিনিই বাণটি মেরেছিলেন। পিসি বললেন, ‘তোর পিসে অতুলকে নিয়ে খুব গদগদ ছিলেন, আমার মোটেই ভাল লাগত না। বিশিকে বাণ মারতে এসেছিল, এত শয়তান। তোর জন্যই আমার মেয়েটা বেঁচে গেল।’
আমি না বুঝেই কি ওদের কাছে গুনিন হয়ে গেলাম! তবে খুব খারাপ ও লাগল না। কারণ লোকটার যা পরিচয় পেয়েছিলাম তাতে তাকে মোটেই ভাল মনে হয় নি। বিশাখাদির ভর হবার এবং প্রতিকারের গল্পের মানেও এখন বুঝতে পেরেছিলাম। মারা গেছে নিশ্চয় কোনো অসুখে, কিন্তু যে কারণেই মারা যাক, লোকটির জন্য সহানুভূতি লাগল না।
পরদিন আমি ফিরে গেলাম নিজের জগতে।
বছরখানেক পর বিশাখাদির মেয়ে হল। সুন্দর একটা ফুটফুটে শিশু। আমি বিশাখাদিকে বললাম, ‘মেয়ে যদি উড়তে চায় তাকে যেন ‘করতে নেই’এর শেকলে বেঁধে রেখো না। তাকে বিশ্বাস করো, উড়তে দিও।’