• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • হাঁটার কথা : প্রিতম মুখোপাধ্যায়

    হাঁটার গল্প — সমৃদ্ধ দত্ত ; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রচ্ছদ – মৃণাল শীল; প্রথম প্রকাশ-- এপ্রিল ২০২১; ISBN: 978-93-90467-32-3

    কবি লিখেছিলেন ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি’। হলিউডের সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘ফরেষ্ট গাম্প’ ছিল একরোখা নায়কের অবিরাম ছুটে চলার কাহিনি। ছিল ‘রান লোলা রান’ ছবির হাড়হিম করা ছুটন্ত দুনিয়ার গল্প। এসব হাঁটা-ছোটার গল্প কবিতা আসলে জীবন প্রবাহের একটি দার্শনিক অভিধা। গল্প, কবিতা, উপন্যাসে যেরকম হয়ে থাকে। সমৃদ্ধ দত্তের ‘হাঁটার গল্প’ কিন্তু তেমন কোনও চমকিত দার্শনিক বৃত্তায়নের ধারকাছ দিয়ে যায় নি। বরং এ গল্প একেবারে দগদগে বাস্তব — রক্তাক্ত উদভ্রান্ত মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই। নিরন্তর এই লড়াইয়ে অসহায় মানুষকে ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনার যে দুবৃত্তায়ন প্রতিনিয়ত চলছে অমানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নির্মম কশাঘাতে, তারই টুকরো টুকরো গল্প আমাদের বলেছেন লেখক। না, ‘গল্প’ অভিধায় দেগে দিলে সত্যের গায়ে লেগে থাকা ঘাম-রক্তের দাগ অনেক ফ্যাকাসে হয়ে যায় — বস্তুত সবটাই অবিশ্বাস্য বাস্তব। সবটাই গল্প হলেও সত্যি।

    আসলে মানুষের হেঁটে চলার সঙ্গে শুধু আমাদের প্রশাসনই নয় এই নগর সভ্যতা লালিত আপামরেরও খুব একটা ধারণা ছিল না। একটা ভাসাভাসা জানা ছিল যে — গাঁ গঞ্জের লোকেদের একটু হাঁটাহাঁটি করতেই হয়, জান বাঁচানোর জন্যে একটু ঝরাতেই হয় ঘাম। ওই যে ‘আমরা-ওৱা’ সীমান্ত রেখা তার কুম্ভীপাকে হারিয়ে গিয়েছিল স্বাভাবিক বিচারবোধ। সেই কারণেই ঘ্যামাঘ্যমা আমলা পরিবেষ্টিত মন্ত্রীমহোদয়-মহোদয়ারা মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে করোনা-কালে চলাচলের পায়ে পরিয়ে দিয়েছিলেন নিষেধের বেড়ি। কিন্তু কোন্ সেই মানুষ যাদের জন্য প্রশাসকদের এত জাগ্রত শুভবুদ্ধি?

    করোনা অতিমারির আবহে ওঁরা অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে যে ‘আমরা-মানুষের’ কথা ভেবে সারা দেশে তুললেন নিষেধের ঝংকার, তাতে যে আরো অসংখ্য ‘ওরা-মানুষ’ পড়ে গেল এক দারুণ পাকচক্রে সে বিষয়ে এতটুকু ঘাম মাথা থেকে বার করলেন না ঘ্যামারা। ফলত হাজার হাজার ভারতের মানুষ, যারা এখনও ইন্ডিয়ার মানুষ হয়ে উঠতে পারেন নি, পড়ে গেলেন নানান বিপাকে। সংক্রমণ বাঁচানোর জন্য যে কল্যাণকামী লকডাউনের শুভারম্ভ হয়েছিল ব্যালকনি শোভিত মানুষদের কাঁসর ঘন্টা আর শঙ্খধ্বনির মধ্যে, তাতে বিপুল সংখ্যক ব্যালকনিহীন মানুষের জীবন যুদ্ধ যে আরো ঘোরতর এক অসহ্য যাপন হয়ে উঠবে, তাদের সামনে যে আরো প্রসারিত হবে মরণ ফাঁদ তার কোনও হালহদিশ জানা ছিল না বিগব্রাদারসদের। বা হয়তো জানা ছিল কিন্তু সম্রাটসুলভ তাচ্ছিল্যে সে আশংকা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ওঁরা।

    এইসমস্ত অসহায় মানুষদের চিরকালীন হাঁটার গল্প বলেছেন সমৃদ্ধ দত্ত। শুধু হালফিলের লকডাউন নয়, গরীব অসহায় মানুষদের যে আরো কত কারণে হাঁটাতে হয় সেই সব জীবনযুদ্ধের কাহিনি আমাদের জানিয়েছেন লেখক। জলের জন্য হাঁটা, স্কুলে যাওয়ার জন্যে হাঁটা। কাজ খোঁজার কারণে হাঁটা, কাজ হারিয়ে হাঁটা — এমন অজস্র চলাচলের রক্তঝরা গল্প বলে গেছেন এই প্রবীন সাংবাদিক। শুধু ম্যাক্রো নয় অনেক মাইক্রো কাহিনির হৃদয়স্পর্শী গল্পে ব্যথাতুর হয়ে উঠবে পাঠকের মন।

    পুস্তকটির মধ্যে তথ্য আছে প্রচুর, তত্ত্বের ঘনঘটাও কম নয় কিন্তু দক্ষ সাংবাদিকের স্বচ্ছন্দ লেখনিতে সবটাই হয়ে উঠেছে প্রাঞ্জল। বোঝা যায় দিল্লি কলকাতা মিলিয়ে তার কর্মময় অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ দত্তের লেখনি। আছে অজস্র ছেঁড়াফাটা মানুষের কর্দমাক্ত বেঁচে থাকার গল্প কিন্তু লেখকের মুন্সিয়ানায়, কিছুটা পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও, পাঠকের জিজ্ঞাসা বজায় থাকে একইরকম

    যাকে আমরা বলি জীবন্ত কাহিনি তেমনই হাড় হিম করা বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য সব ঘটনা বিবৃত হয়েছে এই পুস্তকে। এবং প্রায় সব কাহিনির পরিশিষ্ট হিসেবে সংযোজিত হয়েছে লেখকের নিজস্ব উপলব্ধি। ফলত প্রবন্ধের মতো কাঠখোট্টা না হয়ে পুস্তকটির দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতা ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়। বোঝা যায় কী সীমাহীন বৈপরীত্য আর অসম বিন্যাসের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে চলেছে আমাদের আদর্শ সমাজ। আর সমাজ ব্যবস্থার কথা উঠেছে বলেই যে পর্বতপ্রমাণ অবিচারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রান্তিক মানুষদের মাথায় সে প্রসঙ্গও বার বার এসেছে পুস্তকটিতে। সমৃদ্ধ দত্ত হাঁটার লক্ষণরেখা ভেঙে বলতে শুরু করেছেন প্যাকেজড ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের ফলাও ব্যবসা কীভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে কৃষকের সেচ সক্ষমতা। ডিপ টিউবওয়েল ভাড়া করে নিয়ে এসেও তাঁরা পাচ্ছেন না মাটির জল। সবটাই বোতলবন্দী হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেটের ছকবাজিতে।

    একসময় যে উত্তর মুম্বাইয়ের ওয়েষ্ট ওয়ার্ডকে বলা হত মরিশাস। সমুদ্রখাড়ির জল ওখানে এত স্বচ্ছ ছিল যে একটা কয়েন ফেললেও দেখা যেত। পমফ্রেট মাছের চাষ হত সেখানে। কিন্তু এখন আর বড় পমফ্রেট পাওয়া যায় না। সব মরে যাচ্ছে দূষণের কারণে। আগে ছিল তিনটি নর্দমা। এখন সেখানে এসে মিশছে উত্তর মুম্বাইয়ের ২৬টি নর্দমার বর্জ্য। ভারতীয় মাছের এই অন্যতম এক্সপোর্ট কেন্দ্রটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন মাছ ধরার জাল হাতে হাতে ধরে সমুদ্রের খাড়ি ধরে হাঁটতে শুরু করে জেলেরা। ‘কতটা হাঁটা? তার ঠিক নেই। কারণ কবে কোন খাঁড়িতে মাছের সন্ধান পাওয়া যাবে তা কেউ জানে না। তাই মধ্যরাত থেকে কোলিওয়াড়া অঞ্চলের এই মাছিয়ারা সম্প্রদায় জড়ো হয় আর হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যায় খাঁড়ির পর খাঁড়ি।’ (পৃ ১০৮)

    এইসব সমবেত হয়রানির কাহিনি তো আছেই কিন্তু তার পাশাপাশি লেখক শুনিয়েছেন আরো অনেক সংঘর্ষ ও অসহায়তার গল্প। আর আমাদের এই ঘোরতর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পরিসরে যা অবধারিত তাই সংঘটিত হতে থাকে নিঃশব্দে। বেঁচেবর্তে থাকার জন্য হাত আর পায়ের যে লড়াই তার পুরো দায়টাই চাপিয়ে দেওয়া হয় মেয়েদের ঘাড়ে। ওরা হাঁটুক — হেঁটে হেঁটে কয়েক ক্রোশ দূর থেকে নিয়ে আসুক পানীয় জল, বনেবাদাড়ে ঘুরে যোগাড় করুক জ্বালানি, বাচ্ছাকে দিয়ে আসুক দূরের প্রাথমিক স্কুলে, ঘর করুক সতীনের সঙ্গে যাতে বিছানার মতোই ঘরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমও ভাগাভাগি করে নিতে পারে নিজেদের মধ্যে।

    আমাদের জানার পরিধিতে যেসব হাঁটার ইতিবৃত্ত একবারেই অশ্রুত তেমন অনেক কাহিনি শুনিয়েছেন লেখক। তেমনই একটি খাপছাড়া হাঁটাহাঁটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যাক । এই হাঁটাহাঁটির দুর্ভাগ্য পুরোটাই সামলাতে হয় কৃষকদের। নামে সেটি একটি কৃষক উন্নয়ন প্রকল্প কিন্তু কাজে পুরো এক গোলকধাঁধা। সেটি হল ফসল বিমা যোজনা (পৃ ৬৫)। আসলে বিমা কম্পানীর তো কোনও অফিস থাকে না গ্রামেগঞ্জে। প্রিমিয়ামের টাকা সবসময় ব্যাঙ্কই কেটে নেয়। এবার যখন ফসলের ক্ষতি হয় তখন শুরু হয় কৃষকের হাঁটা। প্রথমে গাঁয়ের শাখায় হাঁটা। তারা সেই দায় নেয় না। বলে শহরে রিজিওনাল অফিসে যেতে। অতগুলো টাকা বাসভাড়া দেওয়ার মুরোদ নেই কৃষকের। সে গ্রাম থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় শহর। একবার নয় অনেকবার অনেকদিন ধরে হাঁটতে হয়। টাকা পেতে কখনও লেগে যায় একবছর কখনও তারও বেশি। যেরকম ডিজিটাল গতিতে প্রিমিয়ামের টাকা কেটে নেওয়া হয়, তার একের দশ ভাগ তৎপরতায় বিমার টাকা দেওয়া হয় না কেন — এ প্রশ্ন করার কোনও অধিকার কিন্তু কৃষকদের নেই। বস্তুত এই ‘কোনও প্রশ্ন নয়’এর অবিরাম চক্করে ঘুরে চলে প্রান্তিক জীবন।

    অবশ্য সবটাই যে ব্যবস্থার অবিচার তা নয়। বেশ কিছু জীবন সংগ্রাম আরো অসহ্য হয়ে ওঠে সরকারি আমলাতান্ত্রিক অবিমিশ্রকারিতায়। হয় ওই সব বাবু-আমলারা জানেন না প্রান্তিক মানুষদের কথা, নয়তো বা জেনেও ওপরওয়ালার নির্দেশে তাদের হয়ে যেতে হয় অন্ধ ও বধির। পুস্তকটিতে উল্লেখিত এমন অনেক সংগ্রামী জীবনের থেকে দুএকটি বিস্ময়কর কাহিনির কথা বললেই বোঝা যাবে কতটা নিরাসক্ত আমাদের মেট্রোপলিটন মন।

    সাউথ দিল্লির কর্পোরেশনের সাফাই কর্মী ফুলচাঁদ প্রকাশ্য রাস্তায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করে। মারা যাবার সময় দুজনের নাম বলে যায় সে — পুরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর আর তার সহকারী। এরা নিয়ম করে ফুলচাঁদের থেকে ৫০০ টাকা করে নিয়েছে প্রতিমাসে। আরো চেয়েছে ৬০ হাজার টাকা। কেন? না, চাকরিটা পার্মানেন্ট করে দেবে। ১৭ বছর ধরে ফুলচাঁদ ওই পুরসভার সাফাই কর্মচারী। অথচ তাকে স্থায়ী করা হয় নি। স্থায়ী হবার আশায় সে প্রতিমাসে দুজনকে পাঁচশো টাকা করে দিয়ে গেছে । অথচ সে জানতেই পারেনি সাফাই কর্মীদের স্থায়ী চাকরি দেওয়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। (পৃ ১৩৮)

    যাঁরা চান সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সব হতভাগ্য মানুষদের ছোট ছোট গল্পকথা জানতে, তাঁরা অবশ্যই পুস্তকটি রাখবেন নিজস্র সংগ্রহে। এখানে শুধু আর একটি অসম ব্যবস্থার প্রসঙ্গ জানানো যেতে পারে। রয়টার্সের ডকুমেন্টারির কারণে মুম্বাই থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটির কথা অনেকেই জানে। একটি তথ্যচিত্রও হয়েছে গ্রামটি নিয়ে। এই ডেঙ্গানমাল গ্রামের ঘরে ঘরে রয়েছে পানি বাঈ। মানে — ওয়াটার ওয়াইফ। এরকম নাম কেন? জল আনার জন্য বিয়ে করে পুরুষরা। একাধিক বিয়ে যাতে ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে জল আনার কাজটা ভাগাভাগি করে করতে পারে মেয়েরা। এক একটা কন্টেনারে জল ধরে ১৫ লিটার। প্রত্যেক মহিলা এরকম দুই থেকে তিনটে কন্টেনার বহন করে। ছুটি বলে কিছু নেই। শুধু সন্তান ধারণের শেষ পর্যায়ে যখন প্রসব বেদনা জেগে উঠেছে, তখন থেকেই শুধু কয়েকটা দিন ছুটির দয়াদাক্ষিণ্য মেলে শারীরীক অক্ষমতার কারণে। (পৃ ১৮৯)

    আসলে সমৃদ্ধ দত্ত যে পর্বতপ্রমাণ অমানবিকতার কাহিনি পর পর বলে গেছেন ‘হাঁটার গল্প’ পুস্তকটিতে — তার তো কোনও অন্ত নেই। ভারতের মতো দরিদ্র দেশে এই না পাওয়ার গল্প নিয়ে তৈরি হতে পারে শতসহস্র পর্বের মহাভারত। যদিও লেখকের ভাষা ও বর্ণনা বেশ স্বচ্ছ, লজিক্যাল ইন্ডাকশন এবং অর্থনীতি ভিত্তিক কিছু বিশ্লেষণ খুবই প্রাঞ্জল তবু একসময় মনে হয় এই ধারাবাহিক দীর্ঘশ্বাসের তো কোনও শেষ নেই। বরং কী করে এই অসম সমাজ বিন্যাসের অন্ধকূপ থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারে সেই তৎপরতা অনতিবিলম্বে শুরু হওয়া দরকার। পাঠকদের চিন্তায় এমন একটি প্রয়োজনীয় ভাবনা জাগিয়ে তোলাই লেখকের সার্থকতা।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments