• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | গল্প
    Share
  • অশোকযাত্রা : দিবাকর ভট্টাচার্য



    তখন মধ্যরাত। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে আছে এক গভীর অরণ্য। সেই অরণ্যে এক সামান্য কুটিরে নিশ্চিন্তে নিদ্রিত রয়েছে এক ব্যাধের পরিবার। বৃদ্ধা মা ও শিশুপুত্রটি একটি ঘরে। আরেকটি স্বল্প পরিসরের ঘরে ব্যাধ নিজে। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে দিনশেষে তিনটি বক শিকার করতে পেরেছে সে। অর্থাৎ আগামী কয়েকটি দিনের ক্ষুন্নিবৃত্তির ভাবনা থেকে মুক্তি। অতএব সামান্য স্বস্তি। বিপুল ক্লান্তির উপর এই স্বস্তির স্পর্শে ব্যাধটি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গাঢ় স্বপ্নে মগ্ন।

    সেই স্বপ্নে সে দেখছিলো যে সে শিকার করেছে এক বিশাল শ্বাপদ… সবাইকে বিস্মিত করে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার প্রকাণ্ড ধনুকটি নিয়ে… ওই মৃত শ্বাপদটির পাশে—হঠাৎই এই তীব্র যন্ত্রণায় ছিন্ন হয়ে যায় এই সুখস্বপ্ন—ব্যাধটি অনুভব করে এক সুতীক্ষ্ণ দংশন তার বাম পায়ের উপরিভাগে—স্বস্তির নিদ্রা নিমেষেই লুপ্ত হয় প্রবল ব্যথার স্রোতে।

    তখনই সে সেই স্বল্পালোকেও স্পষ্ট দেখতে পায় তার ডান পায়ের উপর স্থির হয়ে থাকা একটি ভয়ঙ্কর সর্পের বিশাল উদ্যত ফণাটিকে। মুহূর্তের মধ্যেই তার হাত চলে যায় পাশে রাখা ধনুক এবং শরের উপর। এবং পলকের মধ্যেই তার জ্যা-নিক্ষিপ্ত শরটি নির্ভুলভাবে বিদ্ধ করে ওই বিষধরটির বিপুল ফণাটিকে। শরবিদ্ধ সর্পটির দেহ মুহূর্তের জন্য প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়ে ধীরে ধীরে স্থির হয়ে যায় ওই ছায়াছন্ন ঘরের এককোণে কুণ্ডলীর আকারে। সমস্ত ঘটনাটি যেন কয়েকটি অনুপলে অস্বচ্ছভাবে ফুটে উঠলো ব্যাধের চোখের সামনে।

    ওই অস্পষ্টতার মধ্যেই সে দেখতে পায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে ওই ঘরের কোণের অন্ধকারে। এইবার সেই মূর্তিটি যেন অতি সন্তর্পণে এগিয়ে এসে তার দুহাতে তুলে নেয় ওই কুণ্ডলী পাকানো সর্পটিকে। ব্যাধের সমস্ত দেহটি সহসা তীব্র যন্ত্রণায় কুঞ্চিত হয়ে যায়—দৃষ্টি ধূসর হয়ে যায়—তা সত্ত্বেও এক জান্তব অনমনীয়তায় সে চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াবার—কিন্তু শরীরকে তিলমাত্র নাড়াতে সমর্থ হয় না। কেবল স্থির দৃষ্টিতে ওই আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে এক আড়ষ্ট বিকৃত কন্ঠে কোনোক্রমে বলতে পারে—“কে তুমি?” অতি শীতলকন্ঠে উত্তর আসে—-“আমি মৃত্যু।”

    মুমূর্ষু ব্যাধটির চোখদুটি যেন ক্ষণিকের জন্য বিস্ফারিত হয়—আর সে বিজড়িতস্বরে বলে ওঠে—“এভাবেই আসতে হয় তোমাকে, তাই না? এভাবেই সবার অজান্তে? অন্ধকারে?” মৃত্যুর দিক থেকে কোনো উত্তর আসে না। ব্যাধটি আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে ওঠে—“আমি ব্যাধ, দিনের আলোয় শিকার করেছি হিংস্র সব জন্তুদের সামনাসামনি—বুক চিতিয়ে—মাথা উঁচু করে—বরাবর—কিন্তু তুমি? চিরকাল এইভাবে চুপিসাড়ে এসে—কাউকে—” বলতে বলতেই স্থির হয়ে যাবে ব্যাধটির সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং তীব্র দৃষ্টিটি।

    মৃত্যু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেই স্থির চোখদুটির দিকে। কোনো তীক্ষ্ণ শর নয়—যেন এক অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে ব্যাধটি বিদ্ধ করে দিয়েছে তাকে। ওই সদ্যমৃত সর্পটির মতো সেও যেন সহসা নিশ্চল প্রস্তরখণ্ড হয়ে যায়।

    কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। কারণ পরমুহূর্তেই মৃত্যু ঘরের কোণ থেকে ওই মৃত সর্পটিকে দুহাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় ব্যাধের সেই নিষ্প্রাণ দেহটির দিকে। তারপর যেন পরম মমতায় সেই মৃত সর্পটিকে শায়িত করে দেয় সদ্যমৃত ব্যাধটির বিশাল বক্ষের উপর। তখনই তার মনে হয়—‘যদি আমিও পারতাম—এইভাবে… এই ব্যাধ আর সাপের মাঝে… শুয়ে পড়তে…. আমার যেন কোনো ক্লান্তি নেই… বিরাম নেই…. অনন্তকাল ধরে এই ভয়ঙ্করতম হরণের ভার থেকে মুক্তি পেতে….’

    ঠিক তখনই তিনি প্রবেশ করেন নিঃশব্দে। কিন্তু নিশ্চিতভাবে। মৃত্যু চমকে উঠে সেদিকে তাকায়। দেখতে পায় তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই বিশালপুরুষ, যিনি তার অনির্বচণীয় কন্ঠস্বরে বলে ওঠেন—“এসো—তারপর যেতে হবে….” অর্থাৎ তার প্রভু মহাকাল।

    মহাকালের তালিকার স্থাননামগুলির কিছুই যেন মৃত্যুর কানে প্রবেশ করে না—সে যেন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে ওই স্বল্পালোকেও কি সুস্পষ্ট তার প্রভু মহাকালের মুখটি। নিজের সমস্ত চেতনাকে একাগ্র করে সে প্রার্থনা করে—“এবার মুক্তি হোক আমার।”

    মহাকাল ওই ব্যাধের কুটির থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আবার যাত্রা শুরু করলেন তাঁর অবধারিত পথে।

    আর পরমকাঙ্ক্ষিত মুক্তি পেয়ে মৃত্যুরও যাত্রা শুরু হোলো… ছায়ার আকারে…. মহাকালের ছায়া…. মহাকালের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে… অশোকযাত্রা….

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)