• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • ‘অমন মানুষ হয় না, অমন আর্টিস্ট হয় না’ : অমিত মণ্ডল

    নন্দলাল বসু --অগ্নিবর্ণ ভাদুড়ী; উত্তরসূরি প্রকাশন, প্রচ্ছদ ছবি- ‘কাঠখোদাই’ নন্দলাল বসু; প্রচ্ছদ পরিকল্পনা—শমীন্দ্র ভৌমিক; প্রথম প্রকাশ—অক্টোবর, ২০২১; কলকাতা

    ‘অবনীন্দ্রনাথ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন আমায় শিল্পের ভুবনে’—এ কথা নন্দলালের। নন্দলালের শিল্পচর্চার শুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত মন আশ্রয় নিয়েছে কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে, কলাভবনে। ১৯০৫ সালে নন্দলাল যখন আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে আসেন, তার আগেই তিনি মনে মনে অবনীন্দ্রনাথকেই গুরু নির্বাচন করে ফেলেছেন। কারণ প্রবাসীর পাতায় অবনীন্দ্রনাথের মুদ্রিত ছবিতে মুগ্ধ নন্দলাল ভেবেছেন শিল্পকর্ম শিখতে হলে অবনীন্দ্রনাথের কাছে শেখাই শ্রেয়।

    অগ্নিবর্ণ ভাদুড়ীর ‘নন্দলাল বসু’ গ্রন্থটি চারটি পর্বে; যথাক্রমে: নন্দলাল বসু, মানুষ নন্দলাল, রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল, ও দেশপ্রেমিক নন্দলাল-এ বিন্যস্ত। নন্দলাল বসু সম্পর্কে একাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থ আছে। এতদসত্ত্বেও অগ্নিবর্ণ ভাদুড়ীর গ্রন্থটি পাঠকমহলে সমাদৃত হবে কারণ লেখক স্বল্প পরিসরে শিল্পস্রষ্টা, মানুষ, ও দেশপ্রেমিক নন্দলালের স্বরূপটি তুলে ধরেছেন।

    লেখক বাংলাসাহিত্যের অধ্যাপক। একই সঙ্গে শিল্পরসিক ও লোকশিল্প গবেষক। নানা তথ্য ও কালানুক্রমিকভাবে নন্দলালের চিত্রসৃষ্টির এক অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। কোন সালে কী ছবি তিনি এঁকেছেন সে সম্পর্কে লেখকের মতামত ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ পাঠকের পরম প্রাপ্তি। সেইসঙ্গে ছবি বিষয়ে লেখকের বিশ্লেষণটাও মনে রাখতে হবে—নন্দলালের খ্যাতি পৌরাণিক চিত্র আঁকড়ে গড়ে উঠলেও এবং সারা জীবনে মাঝে মাঝে পৌরাণিক ছবি আঁকলেও, লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, কেন নন্দলাল শুধুমাত্র পৌরাণিক দেব-দেবীর শিল্পী বলে একপেশে বিচার-বিশ্লেষণে খ্যাতিমান হবেন? কারণ, নন্দলাল যেমন শিব, রাম, পঞ্চপাণ্ডব এঁকেছেন, পাশাপাশি সাঁওতাল ও পাহাড়ি স্ত্রী-পুরুষ এঁকেছেন। লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯১২/১৩ শুধু পার্থসারথি, শিবের বিষপান, যম-নচিকেতার কাল নয়, কালি-তুলিতে পেঁপে পাতা, আম, শিশু, কাঁঠাল গাছ আঁকারও কাল। তাঁর সৃষ্টিযাত্রা প্রকৃতি থেকে প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত। নন্দলাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন। তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে, কালি-তুলিতে বীরভূম, দার্জিলিং, কালিম্পং, গোপালপুর, পুরী, ছোটনাগপুর প্রভৃতি অঞ্চলের যে-সমস্ত প্রকৃতিচিত্র তাঁর তুলিতে উঠে এসেছে তা তুলনারহিত। ১৯০৯ সাল নন্দলালের জীবনে তাৎপর্যময়, কারণ ঐ বছরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, এবং লেডি হ্যারিংহামের অজন্তা-চিত্র অনুলিপিতে সহায়তার জন্য তাঁর অজন্তা যাত্রা। আর্ট স্কুলের ছাত্র নন্দলাল ও অসিতকুমারকে অজন্তাচিত্রের বৈশিষ্ট্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন হ্যারিংহাম, এ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে নন্দলালকে নিশ্চিতভাবে তাঁর কাজে প্রভাবিত করেছে। নন্দলাল সারা জীবনে দেশি-বিদেশী বহু পণ্ডিত মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁর পরিচয়ের বৃত্তে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, কালিমোহন ঘোষ যেমন আছেন, তেমনি স্টেলা ক্রামরিশ, আন্দ্রে কার্পেল-ও আছেন। নন্দলাল এইসব বিদেশীদের পাশ্চাত্য শিল্পরীতি নিয়ে বক্তৃতা মন দিয়ে শুনেছেন, ছাত্রদেরও শুনতে বাধা দেননি কোনোদিন। কিন্তু নিজে স্বদেশের সংস্কৃতি থেকে নড়েননি আজীবন। ১৯৩০ সালে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথের চিত্র প্রদর্শনীর সফলতায়, কবিগুরুর সবচেয়ে আগে মনে পড়েছে নন্দলালের কথা। নন্দলালকে লিখেছেন, ‘তোমরা রূপকলার প্রাণনিকেতন ওখানে গড়ে তুললে—এতো আর্ট স্কুল নয়—এ খাঁচা নয়, এ যে নীড়, তোমাদের জীবন দিয়ে এ রচিত। সেই জন্য এ হাওয়াতে আমার বহুকালের অফলা একটি শাখায় হঠাৎ ফল ধরল।’ এই ফল সম্বন্ধে দ্বিধা কেটেছে নন্দলালের প্রশংসায়, ভরসায়।

    এই পর্বে উল্লেখযোগ্য আলোচনা, ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় পর্যন্ত কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষ্যে গান্ধীজির কাছাকাছি আসা এবং গান্ধীজির অনুরোধ ও নির্দেশে বিভিন্ন কংগ্রেস অধিবেশনের মঞ্চসজ্জা, অলংকরণ ও প্রদর্শনীতে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। হরিপুরা কংগ্রেসে নন্দলালের ছবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অবশ্যই পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।

    ‘মানুষ নন্দলাল’-এর ছবিটিও লেখক প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যদিও শিল্পী, শিক্ষক ও মানুষ নন্দলাল একাকার হয়ে গিয়েছেন—মানুষ নন্দলালকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা মুশকিল। নন্দলাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এবং সে বলা দীর্ঘকাল মানুষটিকে নানা অবস্থায় খুব কাছ থেকে দেখে ও জেনে—বুদ্ধি, হৃদয়, অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির এরকম সমাবেশ অল্পই দেখা যায়। মানুষ নন্দলালের ছবি তুলে ধরতে লেখক কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন যা থেকে মানুষ হিসাবে নন্দলাল সাধারণ পাঠকের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন—যেমন গৌরপ্রাঙ্গণে তোরণঘরের দোতলায় ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্ররা— রামকিঙ্কর, সুধীর খাস্তগির ও প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করতেন। নন্দলাল দেখছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেল। কাছেই একটা লন্ঠন ছিল, সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে লন্ঠন উঁচু করে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন নন্দলাল—যতক্ষণ না তিন শিক্ষার্থী ভাস্কর জল, ন্যাকড়া ও রবারক্লথ দিয়ে অসমাপ্ত মূর্তিগুলি ঢেকে, হাত-পা ধুয়ে তৈরি না হলেন। তেমনি, কোন এক বুধবারে উপাসনা চলছে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ভাষণ দিচ্ছেন, এমন সময় বিপদসূচক ঘণ্টা বাজতেই, নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি সত্ত্বেও, অন্য শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছুটেছেন ভুবনডাঙ্গায় পড়শির ঘরের আগুন নেভাতে। আশপাশের সাঁওতাল, বাগদি, বাউরি ও ডোমপল্লির অনাদৃত মানুষেরা—বিপদে-আপদে, মহামারী ও রোগশয্যায় কাছে পেয়েছে নন্দলাল ও তাঁর ছাত্রদের। হরিপুরাতে সুভাষচন্দ্রের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলেই গান্ধীজি ও জওহরলাল সমেত প্রথম শ্রেণির অন্য সব কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের অত্যন্ত কাছের ও শ্রদ্ধেয় নন্দলাল আর কোনোদিন স্বয়ং কংগ্রেস অধিবেশনের মণ্ডপসজ্জায় অংশ নেননি।

    নন্দলাল চিরকালই আত্মপ্রচার বিমুখ, শান্তিনিকেতনের যেকোন উৎসব, নাটকে নিজেকে নেপথ্যে রেখে মঞ্চসজ্জা, রূপসজ্জায় সক্রিয় থেকেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও দেশি-বিদেশি মনীষীরা যখন শিল্পকলা, সাহিত্য, সমাজ নিয়ে আলোচনা করতেন, সে আলোচনায় নন্দলাল অংশগ্রহণ করেননি অথচ বহুবিষয়েই তাঁর প্রভূত জ্ঞান ছিল। নন্দলালের প্রখর আত্মমর্যাদা প্রসঙ্গে লেখক প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি তথ্য তুলে এনেছেন—ফৈজপুর অধিবেশনে নন্দলাল ও তাঁর ছাত্রদের তিন মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর বেতন দিতে এলেন এক কর্মকর্তা—নন্দলালজী কে ষাট রূপেয়া বেতন—নন্দলালের আত্মমর্যাদায় ঘা লেগেছিল। নিজেও নেননি, ছাত্রদেরও নিতে দেননি। সুরেন্দ্রনাথ কর লিখেছেন—পারিবারিক জীবনে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও আশ্রিতদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা, সহানুভূতি যা দেখেছি তা বর্ণনাতীত। নন্দলাল শুধু ছাত্রছাত্রীদের নন, তখনকার আশ্রমবাসীদের কাছে তিনিই মাস্টারমশাই—মানুষ মাস্টারমশাই সম্পর্কে অশ্রদ্ধা কখনই দেখা যায়নি কারণ মানুষ হিসাবে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চরিত্রের লোক ছিলেন।

    ‘রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল’ পর্বে লেখক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলালের পরিচয়ের সেতুটি কীভাবে তৈরি হল সেসম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের প্রথম সাক্ষাৎ ১৯০৯ সালে। জোড়াসাঁকোতে। কবি ও চিত্রীর মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তখন নন্দলালের বয়স সাতাশ আর কবির আটচল্লিশ। সেসময় রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ সম্পাদনার কাজ চলছে। চয়নিকা গ্রন্থের কিছু ইলাসট্রেশনের জন্য রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে ডেকেছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। কবি বললেন, ‘তোমার “তারা” মূর্তি আমি দেখেছি। বেশ হয়েছে। তা তোমাকে এখন আমার কবিতার বই (চয়নিকা) ইলাস্ট্রেট করতে হবে।’ কবিতার নির্যাস অনুযায়ী চয়নিকার প্রথম সংস্করণে নন্দলাল সাতটি ছবি এঁকেছিলেন। চয়নিকার জন্য নন্দলালের তুলি থেকে সুন্দর ছবিগুলো পেয়ে কবিগুরু ভীষণ খুশি। প্রতীক্ষা করতে থাকেন মুদ্রণ অবস্থায় ছবিগুলো কেমন চেহারা নেয়, তা দেখার। শেষপর্যন্ত মুদ্রণরূপ দেখে রবীন্দ্রনাথ তেমন খুশি হতে পারলেন না। ছবিগুলোর রিপ্রোডাকশন খারাপ হয়েছিলো। অসন্তুষ্ট রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখলেন (২৮সেপ্টেম্বর, ১৯০৯)— চয়নিকা পেয়েছি। ছাপা ভালো, কাগজ ভালো, বাঁধাই ভালো। …কিন্তু ছবি ভালো হয়নি সেকথা স্বীকার করতেই হবে। এই ছবিগুলোর জন্যেই আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছিলুম…নন্দলালের পটে যেরকম দেখেছিলুম বইয়েতে তার অনুরূপ রস পেলুম না। বরঞ্চ একটু খারাপই লাগলো।’

    সম্পর্কের সেই শুরু। ক্রমে ক্রমে নন্দলালের ওপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে। মমত্ব বেড়েছে। সর্বোপরি নন্দলালের চিত্রশৈলী ও প্রতিভা বিষয়ে নিঃসংশয় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১০/১১ সাল থেকে জোড়াসাঁকোয় নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের আরও পরিচিত হয়েছেন। দেশে, বিদেশে রবীন্দ্রগ্রন্থ ও অনুবাদ প্রকাশের প্রয়োজনে গ্রন্থচিত্রন-এর জন্য নন্দলালের ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, এভাবেই নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষ হয়েছেন। ১৯১২তে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ নন্দলালের। ১৯১৪ সালে নন্দলাল প্রথম শান্তিনিকেতন যান। ১৯১৪-র ১মে সকালে শান্তিনিকেতনে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে নন্দলালকে সংবর্ধনা জানালেন রবীন্দ্রনাথ। এই সংবর্ধনার সূত্রে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে কতটা মর্যাদা দিতেন। সংবর্ধনার এই বিশেষ দিনটির কথা নন্দলাল বিস্মৃত হতে পারেননি কখনো। রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখেছিলেন অভিনন্দনকবিতা। এই সংবর্ধনার দিনটির কথা বিশদে উল্লেখ আছে অন্যান্য গ্রন্থে। অগ্নিবর্ণবাবুর লেখায় তা দেখা গেলনা। ১৯১৬ সালে কবিগুরু শিলাইদহে পদ্মানদী ভ্রমণের সঙ্গী হতে আহ্বান জানান নন্দলাল, সুরেন্দ্রনাথ কর আর মুকুল দে-কে। কবিকে নতুন করে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন নন্দলাল। ওই বছরেই জোড়াসাঁকোয় প্রতিষ্ঠিত হল ‘বিচিত্রা’। কবিগুরু ‘বিচিত্রা’য় আঁকা শেখানোর প্রধান দায়িত্ব দিলেন নন্দলালকে। ‘বিচিত্রা’য় ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা ছাড়াও বাইরে থেকে অনেকে শিখতে আসতেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান যান। জাপানের চিত্রকলা রবীন্দ্রনাথকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল। ওখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের বার বারই মনে পড়েছে নন্দলালের কথা। এ প্রসঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির চিঠিপত্রের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন। চিঠিপত্রে জাপানী শিল্পী আরাইকাম্পোকে ‘বিচিত্রা’য় আনার কথা লিখেছেন। আরাইকাম্পো ‘বিচিত্রা’য় যোগ দিয়েছিলেন ২৯ডিসেম্বর, ১৯১৬। খুব যত্নে নানারকমের জাপানী তুলির ব্যবহার নন্দলালকে শিখিয়েছিলেন আরাইকাম্পো। ‘বিচিত্রা’ পর্বের পর গ্রন্থচিত্রণ ও গ্রন্থ অলংকরণের কাজ করেছেন নন্দলাল। কারণ ১৯১৯-এ ‘Gitanjali and fruit gathering’-এ নন্দলালের ছবি ছিল। নন্দলাল যেমন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গ্রন্থের অলংকরণ করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথও নন্দলালের ছবিতে প্রাণিত হয়ে কবিতা লিখেছেন। ‘ছড়ার ছবি’ গ্রন্থের সবকটি কবিতাই নন্দলালের ছবি দেখে আঁকা। রবীন্দ্রনাথ ১৩৪০এর ‘বিচিত্রা’র চৈত্র সংখ্যায় নন্দলাল বসু প্রবন্ধে মানুষ নন্দলাল, শিল্পী নন্দলাল, শিক্ষক নন্দলালের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। আমরা জানি ‘বিচিত্রা’ স্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর কাজে নন্দলালকে টানতে চাইছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পী হিসাবে সমকালীন তরুণ শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র নন্দলালই সবথেকে প্রতিভাবান এবং নন্দলালের মধ্যেই আছে শিল্পে স্বদেশের টান। ১৯২০ সালে নন্দলাল স্থায়ীভাবে কলাভবনে চলে এলেন। এর পর বিভিন্ন সময়ে কবিগুরুর সঙ্গে নন্দলাল বার্মা, চীন, জাপান, ভূপাল ও সিংহলে যান। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে শেষ গ্রন্থ ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। এ গ্রন্থও নন্দলালের চিত্রশোভিত। শিক্ষক নন্দলালের প্রতি মৃত্যুকাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ শ্রদ্ধা-প্রীতির পরিচয় আছে এ গ্রন্থে। এ ছাড়া ‘শ্যামলী’ নির্মাণে নন্দলালের দল যে দিবারাত্র পরিশ্রম করেছে এবং তাতে গড়ে ওঠা বাড়িটা যে তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছে—এ কথা স্বীকারে কোনো কুণ্ঠা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। এই পর্বে লেখক অগ্নিবর্ণ রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের সম্পর্কটি খুব যত্নে নির্মাণ করেছেন, কিন্তু কিছু মুদ্রণ প্রমাদ, বিশেষত সাল উল্লেখে, বড়ই অস্বস্তিকর লেগেছে।

    ‘দেশপ্রেমিক নন্দলাল’ পর্বে লেখক যুক্তিনিষ্ঠভাবে নন্দলালের দেশপ্রেম বিষয়টির উপস্থাপনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন প্রাচীন ভারতের আদর্শ নন্দলালকে প্রেরণা দিয়েছে, একই সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি প্রমুখ ব্যক্তিত্ত্ব তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছে। বিভিন্ন আদর্শের টানাপোড়েনে তাঁর মানসিক গঠনে জটিলতা এসেছে। গান্ধীজি যেখানে চরকায় সুতো কাটা ও বিলাতী কাপড় বর্জনকে স্বরাজ লাভের অন্যতম উপায় মনে করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে আক্ষেপ জানিয়েছেন। নন্দলাল একইসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সর্বজনীন উদারনৈতিক আদর্শের কাছে, আবার গান্ধীজির জাতীয়তাবাদী আদর্শের কাছে আনুগত্য স্বীকার করেছেন। এই পরস্পরবিরোধী প্রভাবের টানাপোড়েন নন্দলাল কীভাবে অতিক্রম করলেন—এর সহজ উত্তর নন্দলালের দেশপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে নন্দলাল প্রকৃতপক্ষে শান্তিনিকেতনের টানে বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন, বস্তুতপক্ষে দেশপ্রেমের একটা টানও তার পিছনে সক্রিয় ছিল। সরকাররি অর্থপুষ্ট সোসাইটিতে তিনি কাজ করতে চাননি, সেদিক থেকে বিশ্বভারতী তাঁর কাছে আদর্শ প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানেরই একজন হতে চেয়েছেন, তার মূলে তাঁর দেশপ্রেম। সেযুগে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের তহবিলে টানাটানি লেগেই থাকত, দেড়-দুশো টাকার অনিশ্চিত মাইনে সম্বল করে পুত্রকন্যার জনক নন্দলাল দেড়-দুহাজার টাকার চাকুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন বার বার—স্বদেশিকতার এ এক দৃষ্টান্ত। উগ্র স্বাদেশিকতার জন্যই নন্দলাল ইউরোপ যাননি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। সাংসারিক কারণে এবং কলাভবনের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও, ছাত্র বা সহকর্মী কেউ অংশগ্রহণ করলে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন। নিবেদিতার সংস্পর্শ নন্দলালকে প্রাণিত করেছিল, গ্রন্থটিতে উল্লেখ আছে। একজন বিদেশিনী হয়েও স্বদেশি যুগে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অফুরন্ত উদ্দীপনার প্রেরণাদাত্রী। তাঁর সংস্পর্শে এসে নন্দলাল রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ভাবধারায় দীক্ষিত হন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, বিপ্লবীদের সশস্ত্র আন্দোলনে ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও নিবেদিতার প্রেরণায় তুলি-কলমকে আঁকড়ে থেকেছেন।

    শিল্পকলা বিষয়ে গান্ধীজি নন্দলালকে বিশেষ মান্যতা দিতেন তার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, কোনারকের বদ্ধ কামমিথুন মূর্তিগুলি গান্ধীজির চক্ষুশূল ছিল। যমুনালাল বাজাজ চুনবালির আস্তর দিয়ে ঢেকে দেওয়ার খরচ দিতেও তৈরি। গান্ধীজির মনে হয়েছিল নন্দলাল বসুকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার। নন্দলালের তীব্র আপত্তিতে কোনারক রক্ষা পায়। বিভিন্ন কংগ্রেস অধিবেশনে মঞ্চসজ্জা ও অলংকরণের কাজে নন্দলালের ডাক আসত গান্ধীজির কাছ থেকে। যার শুরু লখনউ অধিবেশন (১৯৩৬) এবং শেষ হরিপুরা কংগ্রেস (১৯৩৮)। হরিপুরা কংগ্রেসের পর নন্দলাল আর কোনো কংগ্রেস অধিবেশনে নিজে যাননি, ছাত্ররা গেলে নন্দলাল তাদের সাহায্য করেছেন। ১৯৪৩ সালে নন্দলালের বিখ্যাত ছবি ‘অন্নপূর্ণা ও রুদ্র’। মন্বন্তরের বীভৎসতায় পীড়িত নন্দলালের প্রিয় শিব-পার্বতীর পুরাণপ্রতিমা এক তীব্র সংবেদনময় প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছিল। হলদে-বাদামিতে মেশানো গাঢ় পটভূমির উপরে নীল একটি বৃত্ত। পদ্মে বসা অন্নপূর্ণার হাতে ভিক্ষাপাত্র। তাঁর সামনে ভিক্ষাপাত্র মেলে ধরা হাত কঙ্কালময় শিব। কাঙাল নটরাজ যার কঙ্কালময় শরীর ঘিরে রয়েছে খিদের জ্বালার প্রতীক চিহ্ন। এ ছবির প্রেক্ষিতে বলতে হয়, নন্দলাল দীর্ণ সময়ের বাস্তবতা এড়িয়ে যাননি, বরং সমাজের আলোড়ন তোলা ঘটনাসমূহে সচেতনভাবে সব আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন শিল্পের ভাষায়।

    পরিশেষে বলি, নন্দলালের জীবন ও শিল্প বহু-আলোচিত, তবুও নতুন কিছু ঐশ্বর্য পাবার আশায় নন্দলাল-প্রসঙ্গ বার বার পড়তে হয়। এ গ্রন্থটি তারই একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।


    Tags: Rabindranath Tagore
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments