সাহিত্য থেকে শতযোজন দূরের এক কর্পোরেট নব্য যুবা, সদ্য পিতা হবার পর ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’ বইটি কিনে ফেলেছিলেন মলের বুকশপ থেকে। ভেবেছিলেন সন্তান পরিচর্চার ঝকঝকে বইটি তার সন্তানের জননীকে উপহার দেবেন। অবশ্য অচিরেই বইটির কয়েক পাতা ওল্টানোর পর ভেঙে গিয়েছিল তার পর্বতপ্রমাণ ভুল। বুঝেছিলেন এই ‘মাদার’ সেই ‘মাদার’ নয়।
কলেজস্ট্রীটের শো-কেসে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ দেখে রন্ধন পটিয়সীদের মনে তেমনই এক বিভ্রম জেগে উঠতে পারে। বইটির প্রচ্ছদ এবং নাম — দুয়েই অবশ্য সেই ইশারা বিদ্যমান। এই পুস্তকে প্রবলভাবে ভাতের হোটেল আর রান্নাবান্নার অনু্ষঙ্গ থাকলেও সব ছাপিয়ে জেগে উঠেছে এক সংগ্রামী নারীর যাপন। রান্নার গল্পের থেকেও কাহিনির সিংহভাগ অধিকার করেছে ইন্দুবালার মতো এক ব্যতিক্রমী চরিত্রের লড়াই বৃত্তান্ত।
এই কাহিনির শুরু বাংলা বিভাজনের অনেক আগে থেকে। খুলনার এক কিশোরী এই ইন্দুবালা বিয়ের পর চলে আসে উত্তর কলকাতার স্বামীর ভিটেয়। বরটি যাত্রাদলের মাতব্বর, মদ্যপ এবং যথেচ্ছাচারী। ইন্দুবালার শাশুড়ি একাধারে খাস কলকাত্তাইয়া ঘটি এবং দজ্জাল। সুতরাং শাশুড়ির ঝাঁঝালো অস্ত্বিত্বের পাশে ইন্দুবালা জেগে থাকে ম্রিয়মাণ চাঁদের মতো। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী হয় ইন্দুবালা কিন্তু তার জীবনে ক্রমে গাঢ় হয় অমাবস্যার অন্ধকার। একে একে ইন্দুবালার স্বামী ও শাশুড়ির ভবলীলা সাঙ্গ হয়। যাপনের এক পাষাণভার চেপে বসে তিন সন্তানের জননী ইন্দুবালার ওপর। অসহায় ইন্দুবালার সঙ্গে বিবাদ শুরু হয় শরিকদের। সেই বিবাদের গেরো ছিঁড়ে ইন্দুবালা শ্বশুরের ভিটেয় গড়ে তোলে তার ভাতের হোটেল। তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। নানান সাবেকি রান্নার পশরা সাজিয়ে সে জমিয়ে দেয় পাকশালার আবহাওয়া। একালের মানুষরা চেটেপুটে খায় ওকালের চর্বচোষ্য।
কল্লোল লাহিড়ী কিন্তু তাঁর ন্যারেটিভকে কখনোই সরলরেখায় নিয়ে যাননি। বার বার পিছিয়ে গেছে সময়। ইন্দুবালার কাহিনিতে যেমন তার কৃতী ও স্বাবলম্বী সন্তানদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় সেইরকমই এক ঝটকায় সময় পিছিয়ে গিয়ে জেগে ওঠে অন্য ন্যারেটিভ — বলতে শুরু করেন শিশু ইন্দুবালার বৃদ্ধা ঠাকুরমার বৃত্তান্ত। এই যে সময়ের গতায়াত তার যোগসূত্র কিন্তু সবসময়ই কোনো বিশেষ রান্নার পদ। এবং বিশেষ সেই পদটি বেশ অ-সচরাচর — যেমন কুমড়ো ফুলের বড়া, আম তেল, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল বা কচু বাটা। আজকের হোটেল বা বাড়ির মেনুতে এইসমস্ত পদ মোটামুটি ব্রাত্য। পুস্তকটির অভিনবত্ব এইটিই, যে তার চলনপথ একেবারেই অন্যরকম, পুরোপুরি ছকভাঙা। এমনকি আজকের জেনারেশন-দুহাজারিরাও যে এইসব সাবেকি খাওয়াদাওয়ার অনুরাগী সেই আবেগটুকুও ধরা পড়ে কল্লোল লাহিড়ীর ন্যারেটিভে।
যদিও ইন্দুবালার জীবন ও সবরকম বাধাবিপত্তি কাটিয়ে তার সফল হবার কাহিনিই বলা আছে উপাখ্যানে — যে কাহিনি আদ্যোপান্ত সুখদায়ক এবং আনন্দময়, সে কাহিনির পরতে পরতে কিন্তু জড়িয়ে আছে এক বিষন্নতা, ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিমুখর এক মন কেমনের গল্প। কিন্তু কোনো গল্পই তেমন ছাপ ফেলে না কারণ লেখক খুব দ্রুত একটি দৃশ্যে প্রবেশ করেন আবার একইরকম ক্ষিপ্রতায় নিষ্ক্রান্ত হন। অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিল না। মাত্র ১৫৫ পৃষ্ঠার পুস্তকে অনেক খুচরো খুচরো গল্প বুনে দিতে চেয়েছেন রচয়িতা। মনে হয় কল্লোল লাহিড়ী ব্লগ লেখনীতে চোস্ত হওয়ার জন্যই এই ঠাসাঠাসির গাড্ডায় পড়ে গেছেন।
একই কাহিনির পরিসরে এসে পড়েছে নানান সামাজিক সংঘাত ও নির্মাণের আবর্ত। পুরোনো আর নতুন সময়ের সার্বিক দ্বন্দ্ব তো আছেই কিন্তু সেই মূল দ্বন্দ্বের তটরেখা ছুঁয়ে গজিয়ে উঠেছে নানান খুচরো বাইনারি — ঘটি বাঙালের ঠোকাঠুকি, শাশুড়ি বৌয়ের আটপৌরে ঝগড়া, পুরুষতান্ত্রিকতার প্রমত্ত আস্ফালন, বিবাহোত্তর যৌন অত্যাচার, হিন্দু মুসলিম সৌহার্দের ফেলে আসা অতীত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের সরলতা ও বঞ্চনার হা-হুতাশ, দেশবিভাগের পর ও-বাংলার শরণার্থীস্রোতে বিপর্যস্ত এ-বাংলা, সত্তরের নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ — এমনই সব পোলেমিক এবং ঝঞ্ঝাময় সাবটেক্সট। এতসব ভারবহুল বিষয়ের চাপে কাহিনির ওজন বেড়েছে ঠিকই কিন্তু হোটেলের হাঁড়ির ভাত মাঝে মাঝেই শুকিয়ে গেছে।
অবশ্য কল্লোল লাহিড়ীর লেখনীর মরমী স্পর্শে আবারও জেগে উঠেছে ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম। জ্বলে উঠেছে হোটেলের নিভন্ত চুল্লী। পুস্তকটির মূল সুরে আগাগোড়া বেজে চলেছে ভালোলাগার তানপুরা। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসাবাসির গল্প — একসঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বেঁচে থাকার সহজ ছন্দ মাতিয়ে দেয় পাঠককে। যাকে বলে গালগল্প, তেমন বৃত্তাকার কিছু হয় না ঠিকই কিন্তু মানবজমিনের নানান জ্যামিতি জেগে ওঠে সামনে। নানান খাদ্যসুখ আর রন্ধনপ্রণালী ঘিরে এক স্বর্ণপ্রসবিনী অতীতের কালচক্র ফিরে ফিরে আসে।
ইন্দুবালার আর তার কাজের সহকারি ধনঞ্জয় — মূলত এই দুজনকে নিয়েই গড়ে উঠেছে কাহিনির ঘটমান বর্তমান। তার পাশে পাশে কল্লোল বুনেছেন টুকরো গল্প। আছে পাশের মেসবাড়ির ছেলে-মেয়েরা যাদের রসনার ভাণ্ডারে নিত্যনতুন খাদ্যের জোগান দিয়ে পুলকিত করে তুলছে ইন্দুবালা। সেই বালিকাবেলা থেকে একটা অন্যরকম জীবন কাটানো ইন্দুবালা, পর পর অনেকরকম বৈপরীত্য আর নির্মাণ পেরিয়ে আসা ইন্দুবালার জীবনচক্রে কিন্তু কোনো ক্লান্তি নেই, নেই অবসর। এমনকি এই হোটেলের গল্পের মধ্যেও খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে আসে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ের কাহিনি। আমরা শুধু এইটুকুই জানতে পারি যে তারা ভালোভাবেই মানুষ হয়েছে এবং তিন জনই সুপ্রতিষ্ঠিত। যদিও ইন্দুবালাকে আমরা লক্ষ্য করি তার সন্তানদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। জানতে ইচ্ছে করে সবার প্রতি যে স্নেহ ইন্দুবালা অকাতরে বিলিয়ে এসেছে তা তার সন্তানদের ক্ষেত্রে এত অপ্রতুল কেন। এমনকি কখনো কখনো ইন্দুবালার নিরাসক্ত আচরণ নির্মমতার পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ এমন আচরণের কোনো ব্যাখ্যা নেই বলে পাঠকদের অসহায় লাগে।
তবে সব ঘাটতি পুরিয়ে যায় রান্নাবান্নার মন মাতানো আয়োজন আর গন্ধে। সাধারণ রান্না আর তার রসাস্বাদনে এগিয়ে আসা আজকের যুবকযুবতীরা — এমন এক আপাত বৈপরীত্য সামনে এনেছেন কল্লোল। একবার নয়, অনেকবার। ১৪৫ পৃষ্ঠা থেকে দেওয়া যেতে পারে তেমন এক টুকরো গল্প। সামনের মেসের নতুন মেয়েটা চশমার ভেতর থেকে গোল গোল চোখ করে বলে, ‘‘তুমি কচুবাটা কেন আর করো না ঠাম্মা?’’ ইন্দুবালা দুপুরের ঝিমুনি কাটিয়ে উত্তর দেয়, ‘‘কোথায় থাকো? খাওয়া হয়েছে? খিদের পেটে কচু খাবে কেন? ধনাকে বলো ভাত গরম করে দেবে। … চাও যদি বেগুনপোড়াও খেতে পারো। কুলের তেল দিয়ে মেখেছি।” মেয়েটি বলে, ‘‘ধুর তুমি কি সব ভুলে যাও না কি ঠাম্মা! এই তো খেয়ে গেলাম। রুটি না খেলেও বেগুনপোড়া ছাড়ব ভাবলে কী করে? খেয়েছি। কী করে যে সব অদ্ভুত জিনিষ মাথা থেকে বার করো — বেগুন পোড়ায় কুলের তেল। জাস্ট ফাটাফাটি।’’ এমনভাবেই এসে পড়ে মালপোয়া, চন্দ্রপুলি কিংবা মানকচু, মেটে আলু বা চুইঝালের প্রসঙ্গ। প্রতিবারই এইসব অনুষঙ্গ ধরে কাহিনি চলে যায় কাছের বা দূরের অতীতে।
কল্লোল লাহিড়ির ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ পুস্তকটি আসলে কোনো নিছক রান্নার বই নয়। বইটির প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত ঝলসে উঠেছে বাঙালির নস্টালজিয়া। বিশেষ করে যাদের হৃদমাঝারে জমে রয়েছে পুর্ববঙ্গের স্মৃতি — ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এমন এক চিরকালীন আবেগ যাদের প্রাণিত করে তাদের কাছে ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ হয়ে উঠবে একান্ত প্রিয় একটি পুস্তক।
হয়তো ব্লগলেখক বলেই, সোশ্যাল মিডিয়ার আস্থাভাজন হওয়ার জন্যেই মনে হয় কল্লোল লাহিড়ি তাঁর চেনা মাঠে খেলে গিয়েছেন আগাগোড়া। অবশ্য এর মধ্যেও তিনি ইন্দুবালার চারপাশে যেসব চরিত্রের রূপদান করেছেন তারা হয়ে উঠেছে একেবারে জীবন্ত। ধনঞ্জয় বা লছমীকে খুব পরিচিত লাগে আমাদের। ইন্দুবালার শাশুড়ি একটি অন্য ধারার চরিত্র। ইন্দুবালার ওপর শাশুড়ির খবরদারি যেমন আছে তেমনই তার পাশাপাশি লক্ষ্য করা যায় উত্তর কলকাতার বিষবাষ্প থেকে ইন্দুবালাকে রক্ষা করার আন্তরিকতা। আর আছে কিশোরী ইন্দুবালার প্রেমপর্বের উপাখ্যান। তার প্রেমিক মনিরুলের আলোছায়া যেন তার মেয়েজীবনকে দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ কিন্তু মনিরুলকে একান্ত আপন করে পাওয়া হল না ইন্দুবালার কারণ ওপার বাংলার মুক্তিযুদ্ধ আর চিরন্তন ধর্মবিভেদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনিরুল শরণার্থী হিসেবে চলে আসে কলকাতায়। এসে হাজির হয় ইন্দুবালার ভাতের হোটেলে। সত্তরের সেই সংকটের পাশাপাশি ফেলে আসা পূর্ববাংলার নস্টালজিয়া নিয়ে এক বেদনাবিধুর কাহিনি গড়ে তুলেছেন কল্লোল লাহিড়ী। তারসানাইয়ের করুণ সুর যেন বেজে উঠেছে আবার।
অসাধারণ এই কাহিনির চলন সম্পর্কে সামান্য দু-একটি কথা মনে হয়েছে। ন্যারেটিভকে ভাঙতে গিয়ে অনেকবারই কোনো রান্নার বুড়ি ছুঁয়ে এগিয়েছেন কল্লোল কিন্তু সেটা একটু রিপিটেটিভ ইজি ট্রানজিশন হয়ে গেছে। একটা ছোটো পুস্তকে এতরকমের সেন্টিমেন্ট আর নস্টালজিয়া নিয়ে এগোতে গিয়ে সুতো জড়িয়ে গেছে। লেখকের জন্মসাল দেওয়া নেই তবে ছবি দেখে মনে হয় বয়স বেশি নয়। সুতরাং মনে করা যেতে পারে কাহিনির অনেক রসদ তিনি জোগাড় করেছেন তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে। ফলে খাদ্য আন্দোলনের প্রসঙ্গে ৫১ পৃষ্ঠায় কল্লোল উল্লেখ করেন নকশাল আমলের সেই বিখ্যাত স্লোগানটির — ‘পুলিস তুমি যতই মারো/ মাইনে তোমার একশো বারো।’ পঞ্চাশ দশকের খাদ্য আন্দোলনের সময় একশো বারো টাকার দাম অনেক ছিল।
পরিশেষে আলাদা করে বলতেই হয় মেখলা ভট্টাচার্যের অসাধারণ অলংকরণ শৈলীর কথা। একেবারে অন্যরকম তাঁর তুলির চলন, অনেকটা যোগেন চৌধুরির ধাঁচ থাকলেও বেশ স্বতন্ত্র। পুস্তকটিকে আরও উদ্ভাসিত করেছেন মেখলা।