ইরলকে উঠতে দেখে মা বললেন, “কাল রাতে তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর ভিমাদের বাবা এসেছিল। খবর দিয়ে গেল, মায়ের শরীর হঠাৎ করে খারাপ হয়েছে। আমি তাই আজ মাকে দেখতে যাচ্ছি, সঙ্গে তোর বোনকেও নিয়ে যাব। বিকেলে ফিরে আসব।”
“বাবাও তো আজ বাসনপত্র নিয়ে বাজারে যাবে, তাই না?”
“হ্যাঁ, তুই আজ পুরো একা,” মা বলল খানিক চিন্তার সুরে, “থাকতে পারবি তো? ভয় করবে না তো?”
“না না, ভয় কীসের?” ইরল বলল বেশ বিশ্বাসের সঙ্গে, “আমি তো বড় হয়ে গেছি এখন।”
“তাই বুঝি? বেশ! আজ তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস, নদীর ধারে বসেই রয়ে যাস না যেন!”
ইরলের এতক্ষণে মুখ-হাত ধোয়া হয়ে গেছিল। ও একছুটে রাস্তায় বেরিয়ে চলতে শুরু করল। বাঁধানো, পরিষ্কার, চওড়া রাস্তা। এখনও লোকজন খুব বেশি ওঠেনি। তাই রাস্তা বেশ ফাঁকা। চারপাশে সার দেওয়া ছোটছোট ইটের বাড়ি। ইরলের ঠিক ভালো লাগে না। গাছপালা, পশুপাখি ওর বড়োই পছন্দের। কিন্তু ওদের শহরখানি এতই বাঁধানো, এতই পরিষ্কার যে তাতে গাছপালা জন্মানোর তেমন জায়গাই নেই। এই নিয়ে একদিন কথা হচ্ছিল ওর বন্ধু ভিমাদের সঙ্গে। ভিমাদের কাকু কয়েকবার দূরদেশে গিয়েছেন, বাণিজ্য করতে। তার কাছে ভিমাদ শুনেছে, নাকি পশ্চিমদিকে দুই নদীর মাঝে এক দেশ আছে, সেখানেও আছে এমনই এক বিরাট বড় শহর, আরো পশ্চিমে নাকি আরো বড় এক শহর আছে, সেখানকার লোকেরা আবার মরুভূমির ওপরে বিরাট সব পাথরের সৌধ বানায়, কিন্তু সেখানকার কোন শহরেরই রাস্তাঘাট এমন পরিচ্ছন্ন নয়। ইরল তাই ভাবে, তাও তো কত ভালো ওদের শহর, না হলে ওকে যদি অমন এক শহরে থাকতে হত, যেখানে চারপাশ ঘিঞ্জি, গাছপালা নেই, তায় আবার চতুর্দিকে নোংরা-আবর্জনা, তবে কী দুঃখের ব্যাপারই না হত!
এইসব ভাবতে ভাবতেই ইরল চলে এসেছে নদীর ধারে। সকালের সূর্য তার সুন্দর মুখটা দেখছে নদীর জলে, ইরল মুগ্ধ হয়ে বসে বসে দেখে। ইরলের বাবা যেসব মাটির পাত্র বানান, তাতে তেমন অনেক রকমের ছবি আঁকেন না তিনি। সবচেয়ে বেশি তো বানান শুধু লাল রঙের পাত্র, তাতে কালো বর্ডার দেওয়া। হ্যাঁ, সেগুলো দেখতে ভালো খুবই। কিন্তু কেমন যেন একইরকম। ইরল তার বাবাকে বললে বাবা তখন নকশা করা পাত্রগুলো দেখান। গোল গোল বৃত্ত, চারকোনা, চৌকো সব প্যাটার্ন অনেক যত্ন করে বাবা আঁকেন। আর ইরল বসে বসে দেখে। দেখতে বেশ সোজা মনে হলেও, সোজা নয় মোটেও। ইরল একদিন চেষ্টা করেছিল আঁকবার, কিন্তু গোলমাল করে ফেলেছিল। আসলে, ওর ইচ্ছে গাছপালা, পশুপাখি, মানুষ-–এইসব আঁকা হোক জিনিসপত্রের ওপর। কিন্তু ওর বাবা আবার এসব আঁকতে পছন্দ করেন না। বলেন, সবাই নাকি এই জ্যামিতিক প্যাটার্নের নকশাই পছন্দ করে এখন। “কী জানি?” ইরল ভাবে, “গাছপালা, মানুষ, পশুপাখির চেয়ে ভালো কি আর কিছু হয়?” যাকগে, ইরল আর বেশি মাথা না ঘামিয়ে ওর বাড়ির দেওয়াল, মেঝেতে ভর্তি করে ছবি আঁকে, ওর প্রিয় বিষয়ের ছবি, নদীর ধারে, শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে ওর যা যা ভালো লাগে সেসবের ছবি। আসার সময় সঙ্গে করে বেশ খানিকটা নদীর ধারের কাদামাটি নিয়ে এল ইরল, কী বানাবে ঠিক করেনি যদিও, তবুও…।
বাড়ি ফিরে ইরল দেখে, মা বেরোনোর জন্য তৈরি, কিন্তু ওর বোন নিশলার মন একটু খারাপ। তার সবচেয়ে প্রিয় মালার পুঁতিগুলো গেছে ছিঁড়ে। দেখে ইরলেরও মন খারাপ হয়ে গেল খানিক। তবে ও কিনা বড়, তাই সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কোনো চিন্তা নেই। তোরা যাবার পরই আমি যাব ভাদিভেলের বাড়ি। ওর কাছ থেকে আরেকটা মালা নিয়ে আসব, আগেরটার চেয়েও বেশি সুন্দর। আর এটাও না হয় আমরা পরে ঠিক করব দুজনে মিলে।” এই শুনে নিশলা খানিক খুশি হয়ে মায়ের হাত ধরে চলে গেল।
মায়ের বানানো যবের রুটি খেয়ে ইরল চলল ভাদিভেলের বাড়ি। কিন্তু পথে বেরোতেই ভিমাদের ডাক, “কী রে, কোথায় চলেছিস? আমি তো এখুনি তোর কাছেই যাচ্ছিলাম,” ভিমাদ বলে, “এই নে, খেজুর খা। আমার কাকু ফিরে এসেছে আজ, আর সঙ্গে নিয়ে এসেছে খুব ভালো খেজুর, সেই যে বলেছিলাম দুই নদীর মাঝের শহর, সেখান থেকে।” সত্যিই কী সুন্দর মিষ্টি খেজুর, দুই বন্ধুতে খেতে খেতে গল্প করতে করতে চলে ।
“জানিস, আমি ভেবেছি বড় হয়ে কাকুর মতো বাণিজ্য করতে যাব, তরী ভাসিয়ে, দূরদেশে। কত নতুন দেশ দেখব,” ভিমাদ বলে, “যাবি তুই আমার সঙ্গে?”
শুনে ইরলেরও বড় ইচ্ছা হয় এমনই ঘুরতে যায়, কিন্তু আবার বোনের, মা-বাবার কথা মনে পড়তে একটু মন খারাপও করে। এই যে আজ ও বাড়িতে একা আছে, তাতেই ওর একটু একটু মন কেমন করছে। ও তাই ঠিক করতে পারে না, শেষমেশ বন্ধুকে বলে, দ্যাখ, যাওয়ার তো আমার বড়োই ইচ্ছা, কিন্তু যদি না যেতে পারি, তবে তুই ফিরে এসে আমায় গল্প বলিস কিন্তু।”
“আচ্ছা ভিমাদ,” ইরল প্রশ্ন করে, “তোর কাকু কী কী জিনিস নিয়ে যায় বাণিজ্যে?”
“রুপো, তামা, দামি পাথর, গয়না, সুন্দর সব মূর্তি, কাঠের জিনিসপত্র, যা আমাদের কারিগরেরা বানায়। আর জানিস, ওখানে ভালো খেজুর তো পাওয়াই যায়, ভালো পশমের জামাও পাওয়া যায়। আমার কাকু নিয়ে এসেছে বেশ কিছু।”
এমন সময় রাস্তায় নীলনের সঙ্গে দেখা। নীলনের বাবা-মা দুজনেই দামি পাথর দিয়ে সুন্দর সব গয়না তৈরি করেন। নীলন ওদের ডেকে নিয়ে গেল ঘরের ভেতরে, “আয় দেখবি, খুব সুন্দর এক পাথর এসেছে আজ, গাঢ় নীল রঙের।” নীলনের বাবা-মা কাজ করছিলেন, ওদের দুজনকে আদর করে বসালেন। নীলনের বাবা বললেন যে ওই সুন্দর পাথরের নাম লাপিস লাজুলি, পশ্চিমদিকের এক দেশ (এখন আমরা যাকে আফগানিস্তান বলি) থেকে আসে এই পাথর। আরো দেখালেন বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন সব পাথর। বললেন, সবুজ রঙের জেড পাথর আসে পশ্চিম থেকে (এখনের পশ্চিম এশিয়া), আর উত্তরের পাহাড়ি দেশ (কাশ্মীর) থেকেও আসে কিছু, এ্যাগেট আসে দক্ষিণ-পূর্ব কোণ (গুজরাট) থেকে। এদিকে নীলনের মা নিজে পাথর দিয়ে শৌখিন সব জিনিসপত্র বানালে কী হবে, তাঁর নিজের পছন্দ সোনার গয়না। অনেক বেশি নেই যদিও তাঁর। কৌতূহলী ইরল জিগ্যেস করে, “আচ্ছা, সোনা আসে কোথা থেকে?” নীলনের বাবা বলেন, “বেশির ভাগটাই আসে দক্ষিণ দিক থেকে (এখনকার কর্ণাটক), তবে সিন্ধুর বালিতেও সোনার রেণু পাওয়া যায় খানিক।
ওখান থেকে বেরিয়ে দুই বন্ধুতে চলতে থাকল। ইরলের বড়োই ভালো লেগেছিল পাথরের কাজকর্ম, ও ভাবছিল, বড়ো হয়ে নীলনের বাবা-মায়ের মতো মণিকার হলে কেমন হয়?
চলতে চলতে ওরা শহরের একেবারে ধারে চলে এসেছিল। জমিতে গমের চাষ হয়েছে, চাষীরা কাজ করছে খেতে। হাল্কা হাল্কা বাতাসের দোলায় ফসলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে, ইরল দাঁড়িয়ে দেখে খানিকক্ষণ, কক্ষনো পুরনো হয় না এই ছবি, ওর আঁকতে ইচ্ছে করে। ভিমাদ তাড়া লাগায়, “কী রে, চল।” রাস্তায় এক জেলেকে আসতে দেখা যায়। কাঁধে দুটো জাল ঝুলিয়ে আসছে সে, ধীর স্থির পদক্ষেপে। এমন এক শান্ত, সুন্দর দিনে জেলের ওই ধীরে হেঁটে আসার ছবিটি বড্ড ভালো লাগে ইরলের। মনের মধ্যে ছবিটা আঁকতে আঁকতে চলতে থাকে বন্ধুর সঙ্গে।
রাস্তার ধারে ইটের কারখানা। কিছু ইট রোদে পোড়ানো হচ্ছে, আবার চুল্লীতেও পোড়ানো হয় কিছু। পথে ওদের বন্ধু মানিয়লের বাড়ি পড়ল। মানিয়লের বাবা সুতো কেটে জামাকাপড় তৈরি করেন। মানিয়লের নিজেও শিখে গেছে সুতো কাটতে। যেতে যেতে ভিমাদ বলে, “জানিস, আমার কাকু সুতোর জামাকাপড়ও নিয়ে যায়, বাইরের দেশগুলোতে নাকি এর বড়োই চাহিদা।” ইরলের অবশ্য সুতো কাটতে মন করে না, কাজটা বড্ড একঘেয়ে মনে হয় ।
আবার ওরা শহরের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। রাস্তার ধারেই ইনাকের বাড়ি। ইনাকের বাড়ি যে কতরকমের পুতুল আর খেলনা দিয়ে ভর্তি, তা গুনে শেষ করা কঠিন। ভিমাদ বলে, “চল না, চল না, দেখে আসি।” ইরলের বাবাও মাটি দিয়ে পুতুল বানিয়ে দেন ওদের। এমনকি ইরল নিজেও নিশলাকে একটা মাটির চুড়ি বানিয়ে দিয়েছে, নিশলার আবার তা বড়োই পছন্দের। তবে ইনাকের বাবার কারখানায় কতো রকমের খেলনা, কত পশু-পাখি, মানুষের মূর্তি, গাড়ি আরো কত কী! ইরল অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে-–বড় হয়ে শুধুই খেলনা আর পুতুল বানালে কেমন হয়? ইনাকের বাবা ওদের কারখানা ঘুরিয়ে দেখান, তারপর ভিমাদকে একটা গাড়ি আর ইরলকে একটা ছোট্ট বানর পুতুল উপহার দেন। দুজনে মহানন্দে আবার চলতে শুরু করে।
“আচ্ছা ইরল,” ভিমাদ জিগ্যেস করে, “বড়ো হয়ে তোর কী হতে ইচ্ছে করে?”
“কী জানি, আমার তো অনেক কিছু হতে ইচ্ছে করে…।”
“এক কাজ কর, তুই না বড়ো হয়ে সিলমোহর তৈরি কর। তুই তো খুব ভালো ছবি আঁকিস। বিভিন্ন রকম ছবি খোদাই করবি, আর আমি যখন বাণিজ্যে যাব, তুই আমার জন্য দারুণ সব সিলমোহর বানিয়ে দিবি।” বুদ্ধিটা বেশ লাগে ইরলের। ওর হাসি হাসি মুখ দেখে ভিমাদ আরো উৎসাহী হয়ে বলে, “জানিস, ভাদিভেলের পাশের বাড়িতে যে লোকটার বাড়ি, সে সিলমোহর বানায়। গিয়েছিস তুই কখনো?”
ইরল গেছে। দুজনে তখন কে কেমন আশ্চর্য রকমের সিলমোহর দেখেছে, তারই গল্প করতে লাগল। কতরকমের গাছপালা, পশু-–একসঙ্গে যখন সাজানো থাকে, মনে হয় যেন একটা বন, কেবল গাছপালা, পশু-–সবই খুব ছোট ছোট; সিলমোহরগুলোই খুব ছোট কিনা।
শেষপর্যন্ত ওরা ভাদিভেলের বাড়ি পৌঁছাল। কতরকমের সুন্দর পুঁতির মালা, চুড়ি, ঝিনুকের গয়না-–ঘুরে ঘুরে দেখল দুই বন্ধু। ভাদিভেলের মা দুজনকে বসিয়ে খাওয়ালেন, তারপর নিজে বেছে একখানি খুব ভালো রঙিন পুঁতির মালা দিলেন ইরলকে।
বাড়ি ফিরে ইরল দেখে সূর্য এইমাত্র পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু হয়েছে। মানে এখনও বিকেল হতে অনেক বাকি। কী করা যায়? সকাল বেলা নদীর ধার থেকে যে মাটি নিয়ে এসেছিল, সেদিকে নজর গেল ওর। নিশলা বলেছিল, তার পুতুলদের নিয়ে রান্না রান্না খেলার জন্য একটা মাটির ছোট্ট হাঁড়ি বানিয়ে দিতে। ইরল তাই বানাতে বসল। ওর মনের মধ্যে সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছিল, তাই তো, বড়ো হয়ে ও কী হবে? ভিমাদ যেমন ঠিকই করে নিয়েছে, ও তরী ভাসিয়ে বাণিজ্যে যাবে। কিন্তু ইরল তো এখনও কিছুই ঠিক করতে পারেনি। জল দিয়ে খুব মিহি করে মাটিটা মাখতে মাখতে ইরল ভাবতে রইল। মাটিটা নরম, মিহি করে মাখবার পর ইরল চাক ঘুরিয়ে ছোট্ট হাঁড়ি বানাতে বসল। চাক ঘোরানো, চুল্লীতে পোড়ানো-–এসব কাজই ইরল বাবার সঙ্গে করেছে। একা কক্ষনো করেনি। ভয় করছিল প্রথমটা খানিক, তবে একা একা আর কীই বা করে-–সাহস করে কাজ করে চলল তাই।
প্রথমবার কী যেন গোলমাল হয়ে বেঁকেচুরে গেল হাঁড়িটা। আবার মাটি মেখে ঘোরাতে শুরু করল ইরল। এবার বেরিয়ে এল একটা সত্যিকারের সুন্দর, নিখুঁত ছোট্ট হাঁড়ি। এমনকি ইরল নিজেই অবাক হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ও সাবধানে রোদে রেখে দিল হাঁড়িটাকে। আজ ভালোই রোদ বেরিয়েছে, আশা করা যায় বিকেলের দিকে চুল্লীতে পোড়ানো যাবে। ঠিকমতো পোড়াতে পারবে কি না-–এই চিন্তায় ও বড়োই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শেষমেশ নিশলার ছিঁড়ে যাওয়া মালার পুঁতিগুলো নিয়ে সারাতে বসল।
আর ঠিক এমনি সময়ে নিশলার হাত ধরে মা, আর সঙ্গে বাবাও বাড়ি ফিরে এলেন। ইরলের নিজের হাতে তৈরি ছোট্ট সুন্দর হাঁড়ি দেখে সবাই যেমন অবাক, তেমনি খুশি। বাবা তো আবার খানিক গর্বিতও। গলায় নতুন পুঁতির মালা পরে, হাঁড়িটাকে আদর করে হাতে ধরে ইরলের কোল ঘেঁষে বসে নিশলা বলল, “দাদা, আমায় গল্প বল, আজ সারাদিন কী কী দেখেছিস?”