• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৬ | এপ্রিল ২০২২ | গল্প
    Share
  • কুণাল-জননী : সূর্যনাথ ভট্টাচার্য



    বিবাহের সময়েই কন্যা জানাইয়াছিলেন, বিবাহে আপত্তি নাই কিন্তু একদিন তিনি বৌদ্ধ হইবেন। ভবিষ্যতে সুযোগ আসিলেও অগ্রমহিষীর ভূমিকাপালন তাঁহার পক্ষে সম্ভব নহে।

    উজ্জয়িনীর মুখ্যায়ুক্তের কন্যা বেদিশা। পরম রূপবতী, সে রূপের উপমায় অগ্নি অপেক্ষা চন্দ্রালোক অধিক প্রযোজ্য। বেদিশার স্নিগ্ধ স্ত্রীময়তায় হৃদয় হারাইয়াছিলেন উজ্জয়িনীর তরুণ শাসক প্রিয়দর্শন। তিনি মৌর্যকুমার, উজ্জয়িনীতে মগধরাজের প্রতিনিধি।

    বেদিশা বোধহয় প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন ভবিতব্য। তাই সম্ভাব্য মগধেশ্বরকে পতিত্বে বরণ করিতে আপত্তি করেন নাই। তবে তাহা বৈভবের অপকর্ষণে নয়। বেদিশা তখনই সঙ্ঘপথিক। অন্তর্দৃষ্টিতে মৌর্যকুমারের কান্তিহীন শ্যামলতায় আবিস্কার করিয়াছিলেন রাজর্ষির তপস্যাকে। পট্টমহিষী হইবার আকাঙ্খা তাঁহার ছিল না।

    তাঁহার শর্তেই বিবাহ হইয়াছিল। বেদিশার শাক্যানুরাগ দাম্পত্যের অন্তরায় হয়নি। আসিয়াছে দুই পুত্র-কন্যা মহীন্দ্র ও সঙ্ঘমিত্রা। কিন্তু মাতৃদীক্ষায় তাহারাও বৈভববিমুখ।

    সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের পরেও রানি মগধের প্রাসাদে আসেন নাই, উজ্জয়িনীর বৌদ্ধবিহারেই রহিয়া গেলেন। সম্রাট বলিলেন, ত্যাগ করবে বলেই কি হাত ধরেছিলে রানি?

    —তোমাকে কখনও ত্যাগ করব না রাজা। আমি তোমার সহধর্মিণী। তাই ছিলাম, তাই আছি, তাই থাকব। তুমি আর আমি একই তীর্থের পথিক। শুধু পথ আলাদা। যখনই স্মরণ করবে, আমাকে তোমার কাছেই পাবে। কিন্তু মহারানির বন্ধনে আমাকে জড়াতে ইচ্ছা কোর না।

    —মগধের রাজপ্রাসাদে বাস করেও কিন্তু ধর্মপালন সম্ভব।

    —বৈভবের মাঝে কি ভিক্ষু হওয়া যায়? মহাভিক্ষু যে আমার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন ত্যাগের আনন্দ। আমাকে সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত কোর না রাজা। ধর্মের পথে আমি সর্বদা তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু আপাতত তোমার সম্মুখে অন্য কাজ। তাই পথ আলাদা। আমি জানি, এ সেই শাক্যমুনিরই ইচ্ছা।

    —সত্য বল রানি, আমাকে কি এখনও স্বজনহত্যার অপরাধী মনে কর?

    মগধেশ্বর বিন্দুসারের তিরোধানপরবর্তী চতুর্বর্ষব্যাপী ক্রান্তিকালে মগধের বুকে নিয়ত বিরাজ করিত কৃতান্তের পদধ্বনি। বহুবার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষে সম্রাটের স্বহস্ত রঞ্জিত হইয়াছে নররক্তে। তাহারা অনেকেই ছিল তাঁহার আত্মীয়। রক্তের সম্বন্ধে তাহারা ছিল স্বজন, আত্মার বিরোধে পরিণত হইয়াছিল শত্রুতে। তাহাদের বিনষ্ট না করিলে মনুষ্যত্বের পরাজয় হইত। জীবনপণ করিয়া সম্রাট সে বিপর্যয় রোধ করিয়াছেন।

    কোন মহৎ প্রণোদনায় সম্রাট খড়্গধারণ করিয়াছিলেন, রানি তাহা জানেন। কোন সৃজনসিদ্ধির লক্ষ্যে নির্মম ধ্বংসলীলায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন রাজর্ষি, তাহাতেও কোনও সংশয় নাই। বড় প্রত্যয়ে রানি উত্তর দিলেন, না সম্রাট। তুমি তো হিংসার নিমিত্ত হত্যা করনি। প্রভুর ইচ্ছাতে তুমি আরব্ধ কর্মই করেছ। মহাভারতে অর্জুন যেমন করেছিল। তুমি আগেও তাই করবে।

    —এ তোমার অভিমান নয় তো রানি? নতুন পট্টমহাদেবীর আগমনে কি তুমি ক্ষুব্ধ?

    —আদৌ নয়। নতুন মহাদেবীকে আমার স্নেহাশির্বাদ জানিও। রাজরানি হবার অভিলাষে তোমাকে বিবাহ করিনি রাজা। তোমার ঋষিসত্তাকে ভালবেসেছিলাম। আজও তাই। তোমার ইহজাগতিক কর্মানুবন্ধে আমার কোনও ভূমিকা নেই। সে কর্মযজ্ঞের হোতা একমাত্র তুমি। তোমারই নিমিত্ত সে অনুবন্ধ। তাই তোমাকে ফিরে যেতে হবে তোমার নির্দিষ্ট কর্মবৃত্তে। কাজ শেষ হলে প্রভু আবার আমাদের পথ এক করে দেবেন। আবার আমরা একসঙ্গে চলব।

    রানিকে মনে মনে শ্রদ্ধা করেন সম্রাট। এককালে অল্পবয়সী কন্যার এই দৃঢ়চিত্তের কাছেই সমর্পণে অবনত হইয়াছিলেন তিনি। এখনও তিনি পত্নীর ইচ্ছা মানিয়া নিলেন। বলিলেন, তাই হোক। আমার কথা ভাবি না। কিন্তু মহী আর সঙ্ঘা'কেও তুমি তাদের পিতার থেকে দূর করতে চাও রানি?

    রানি বলিলেন, রাজনীতি ওদের কর্মক্ষেত্র নয়। পবিত্র সঙ্ঘের তপোভূমিতেই ওদের স্বচ্ছন্দসিদ্ধি। মহীন্দ্রের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। সঙ্ঘমিত্রাও ভ্রাতারই অনুগামিনী হবে। তুমি বাধা দিও না।

    —মহীন্দ্র আমার উত্তরাধিকারী রানি। সে এই মৌর্যকুলের ভবিষ্যৎ।

    —মহীন্দ্র সন্ন্যাসদীক্ষা কামনা করে। তোমার সিংহাসনে তার কোনও আকর্ষণ নাই। সকল পূর্বসংস্কারমুক্ত ধর্মমার্গের উপযুক্ত আধার সে। তাকে তোমার অপত্যবন্ধন থেকে মুক্ত করে দাও।

    এ কথার কোনও উত্তর দিতে পারিলেন না সম্রাট। রানি বেদিশা নববিবাহিতা পট্টমহাদেবীর দুই হাত ধরিয়া গাঢ়স্বরে বলিলেন, তুমিই পট্টমহিষী। নিঃসংকোচে পদ গ্রহণ কর। আমার পূর্ণ সম্মতি রইল। তোমার এখন অনেক দায়িত্ব। আমি তোমার এক ভিখারী দিদি। ভিক্ষা নিয়ে মহারাজকে পুত্রহীন করলাম। তোমার দায়িত্ব তাঁকে পুনরায় পুত্রবান করা। তুমি এসেছ, পুত্রও আসবে। তার নাম রেখো— কুণাল। মৌর্যকুলতিলক কুণাল।

    খ্রিষ্টজন্মের দ্বিশত-সপ্ততিবর্ষ পূর্বে মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন বিন্দুসার-পুত্র প্রিয়দর্শন। ধর্মরাজ্য স্থাপনের সঙ্কল্প লইয়া মৌর্যসম্রাট প্রিয়দর্শন ক্রমে হইলেন অশোক প্রিয়দর্শী। তাঁহার শাসনে সমরশক্তি ও পরাক্রমের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছিল মানবিক প্রয়োগনীতির রাজকীয় মর্যাদা। রাজ্যবিজয় কখন যেন ধর্মবিজয়ে পরিণত হইয়াছে। সম্রাটের সে ধর্মবিজয়ের রথ পার করিয়াছিল আর্যাবর্তের সীমানা। কিন্তু সে পৃথক প্রসঙ্গ।

    মগধের ধর্মরাজ্য স্থাপনায় বহিয়াছিল অগণিত শোণিত-ধারা। কালের প্রভাবে অস্পষ্ট হইয়াছে চিত্র। তবু ক্রান্তিকালের সে রক্তাক্ত অধ্যায় কি মুছিয়া যায়? আলোকিত প্রশস্ত রাজপথের পথিক ফেলিয়া আসা অন্ধকার গলিপথগুলি আর মনে রাখে না। তবু সে সব মিথ্যা হইয়া যায় না। স্মৃতির কল্পপথে থাকিয়া যায় কিছু পুরাতন ছন্নচিত্র।—

    সম্রাট বিন্দুসার মগধের উত্তরাধিকারী চয়ন করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার আকস্মিক প্রয়াণের পরবর্তী প্রথম সভাতেই স্পষ্ট হইয়া গেল ইহার অনভিপ্রেত পরিণাম।

    মহামাত্য রাধাগুপ্ত সে সভাকার্যের সূচনাতে উপস্থিত সদস্যদের সম্বোধিত করিয়া বলিলেন, মগধে আজ এক অভূতপূর্ব স্থিতি। পরিষদের হাতে এ শূন্য সিংহাসন পূর্ণ করার পবিত্র দায়বন্ধন। এ সভায় প্রয়াত সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র উপস্থিত আছেন। মন্ত্রীপরিষদের সম্মতিক্রমে আমি তাঁকেই এ রাজ্যভার গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি জ্যেষ্ঠকুমার সুসীমকে আহ্বান করব তাঁর প্রাসঙ্গিক যুক্তিপ্রস্তাব পেশ করতে।

    মহামাত্যের আহ্বানে উঠিয়া দাঁড়াইলেন কুমার সুসীম। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহে শ্বেত কাষায় উত্তরীয়টি ঠিক করিয়া নিলেন। প্রশস্ত ললাটে রক্তচন্দনের টিকা, কিন্তু দুই গণ্ডের লালিমা নির্দেশ করিতেছে অন্তরে তিনি উত্তপ্ত। তবু প্রথার খাতিরে মন্দ্রকন্ঠে বলিলেন, আমি, স্বর্গীয় মগধেশ্বরপুত্র সুসীম, এতদ্দ্বারা মগধের অধিবাসীদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এ রাজ্যের সুমহান পরম্পরার অনুশাসনে আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত করব। এ বিষয়ে আমি অবশ্যই নিজেকে যোগ্য মনে করি। তদ্ভিন্ন আমি প্রয়াত মগধনরেশের প্রথম পুত্ররূপে এ সিংহাসনের নৈসর্গিক উত্তরাধিকারী। এ সিংহাসনের যোগ্যতর প্রার্থী আর কেউ নেই। আমি সনাতন ব্রহ্মণ্যবাদের প্রবক্তা। মগধের ভাবী নরপতিরূপে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যে বিরোধীতা ও অবমূল্যায়নের প্রবণতা এসেছে, তাকে প্রতিহত করে এই ধারাকে তার পূর্বমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার সংকল্প করি।

    কুমার সুসীম আসন গ্রহণ করিতে না করিতেই ওপর একটি কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হইল, আমার কিছু বলার আছে মহামাত্য।

    বক্তা মহারাজ বিন্দুসারের এক কনিষ্ঠ কুমার প্রিয়দর্শন। বর্তমানে উজ্জয়িনীর ভারপ্রাপ্ত শাসক। মন্ত্রীসভার আমন্ত্রণে সভায় যোগদান করিয়াছেন। রাধাগুপ্ত তাঁহাকে বলিতে অনুমতি দিলেন।

    উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, নাতিদীর্ঘ ব্যক্তিটি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পরনের অধোবাসে রক্তাম্বর, ঊর্ধ্বাঙ্গের কৃষ্ণউত্তরীয় আড়াআড়িভাবে স্কন্ধ বেড় করিয়া কটিতে গ্রন্থিবদ্ধ। ভালের শ্বেতচন্দন টিকা, শান্ত দৃষ্টি ও দৃঢ়বদ্ধ চিবুক মুখশ্রীতে দিয়াছে মাধুর্য ও কাঠিন্যের এক বিপরীত সমাহার। মুখাবয়বে কোথাও যেন কিছু ত্রুটি আছে, কিন্তু সহজে তাহা ধরা যায় না।

    কনিষ্ঠকুমার মগধের স্থায়ী বাসিন্দা নন, অনেকেই তাঁহাকে চেনেন না। সভায় অল্প গুঞ্জন উঠিল, দু'একটি ব্যঙ্গ ও তাচ্ছিল্যের মর্মরধ্বনিও যেন পল্লবিত হইল।

    ততক্ষণে কুমার বলিতে শুরু করিয়াছেন, প্রথাগত ভাষণ দেবার শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। তাই বলি, পিতার ইচ্ছানুসারে—

    তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে বাধা দিয়া কুমার সুসীম দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, মহামন্ত্রী, কুমার রাজকীয় প্রস্তাবে ব্যক্তিগত সম্বোধন করছেন। এই অনুচিত কাজের আমি বিরোধীতা জানাচ্ছি।

    রাধাগুপ্ত তাড়াতাড়ি বলিলেন, সভায় স্বর্গত মহারাজকে ব্যক্তিসম্বোধন করবেন না কুমার। এ রাজকীয় শিষ্টতা অবশ্যই আপনার অজানা নয়।

    কনিষ্ঠকুমার অল্প হাসিয়া বলিলেন, অজানা নয় কিন্তু বহুদিন রাজকীয় শিষ্টতাবহির্ভূত থেকে অভ্যাস চলে গেছে। যাই হোক, আমি বলছিলাম স্বর্গত মহারাজের ইচ্ছাতেই আমি আজ এই সভায় যোগদান করেছি। নতুবা সিংহাসন লাভের নিমিত্ত আমাকে শিষ্টতার অভিনয় করতে হত না। সে জন্য আমি ভিন্নতর পন্থায় বিশ্বাসী।

    কুমার সুসীম প্রদীপ্ত হইয়া কর্কশ স্বরে বলিলেন, কনিষ্ঠ কুমার সিংহাসনের অধিকারী নয়। এ ধরণের বন্য বক্তব্য মগধের রাজসভার মর্যাদাভঙ্গ করছে মহামন্ত্রী।

    রাধাগুপ্ত বিড়ম্বিত স্বরে কনিষ্ঠকুমারকে প্রচ্ছন্ন তিরস্কারে জানাইলেন, আপনি বাক্য সংযত রাখুন কুমার। অবান্তর কথা না বাড়িয়ে মূল বক্তব্য পেশ করুন।

    সুস্মিতমুখে কুমার বলিলেন, তাই করি। শুধু জ্যেষ্ঠের অধিকার ও ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচার মগধেশ্বরের একমাত্র যোগ্যতা হতে পারে না। ব্রহ্মশক্তিতে আমার অনাস্থা নেই। একান্ত ভাবে বিশ্বাস করি, ব্রাহ্মণ আধ্যাত্মিক শক্তির আধার। সেই শক্তিতেই হয় জীবনের প্রকাশ। কিন্তু—

    ইহা শুনিয়াই কুমার সুসীম উত্তেজিত হইয়া কিছু বলিতে যাইতেছিলেন, হাত তুলিয়া তাঁহাকে নিরস্ত করিলেন মহামন্ত্রী। কনিষ্ঠকুমার বলিয়া চলিলেন, বাস্তবিক, এই জীবন কী? একটা চৈতন্য সত্ত্বা। সেই ব্রহ্ম। সেই আপনি মহামন্ত্রী। সেই আমি। সেই আত্মন্‌। একটা শক্তি— যে এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে, একে রক্ষা করে, একে ধারণ করে। আবার একে নতুন রূপে জন্ম দেয় আমাদের নব নব চৈতন্যে। সে চৈতন্যের ক্ষয় নেই, বিনাশ নেই। সে চৈতন্যের উপলব্ধি অহরহ স্মরণ করায়, যখন বহিরঙ্গে সব ধ্বংস হয়, সে অন্তর্শক্তি— আত্মন্‌— অবিনশ্বর থাকে। ব্রাহ্মণ হল সেই আত্মশক্তি।

    কুমার সুসীম আর পারিলেন না। উঠিয়া রুক্ষস্বরে বলিলেন, মহামন্ত্রী, এসব কী হচ্ছে? অনধিকারীর মুখে ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিনব ব্যাখ্যা শুনতে আমরা এখানে আসিনি।

    মহামন্ত্রী রাধাগুপ্ত কিছু বলিবার আগেই কনিষ্ঠকুমার দৃঢ়স্বরে বললেন, আমি প্রসঙ্গেই আছি মহামন্ত্রী। যে দুটি বক্তব্যে আমার অনধিকারের ইঙ্গিত করা হয়েছে, এক এক করে তার উত্তর দেব। প্রথমত, আমি বর্ণাশ্রম মানি না। সমাজবদ্ধ ব্রাহ্মণদের আমি ঘৃণা করি। ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে আমার অনুভবটুকু ব্যক্ত করেছি। এবার বলছি, সেই ব্রহ্মশক্তি আজ ভ্রষ্ট। ব্রাহ্মণ নয়, ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদ আমার বিরোধের বিষয়।

    সভায় প্রবল কোলাহল শুরু হইল। কুমার সুসীমের সমর্থকগণ দণ্ডায়মান হইয়া একযোগে এই বক্তব্যের নিন্দাবাদ করিতে লাগিলেন। রাধাগুপ্ত সভাসদদের শান্ত করিবার চেষ্টায় বারংবার ব্যর্থ হইলেন। অবশেষে ব্রাহ্মণ প্রতিনিধি কুলিষ্ককে উচ্চকন্ঠে বলিতে শুনা গেল, তুমি অনধিকারী কুমার। এ সভায় উপস্থিত ব্রাহ্মণবর্গের পক্ষ হতে তোমার মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

    মৎস্যহট্টে ক্রেতা-বিক্রেতার বাদানুবাদে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, মগধের রাজসভায় প্রায় সেই অবস্থা। মহামন্ত্রী অসহায়ভাবে অবস্থা আয়ত্তে আনিতে প্রায় চিৎকার করিয়াই বলিলেন, কুমার আপনি দয়া করে অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি না করে অতি সংক্ষেপে আপনার আর কিছু বলার থাকলে ব্যক্ত করুন।

    কোলাহল কিঞ্চিৎ স্তিমিত হইয়া আসা পর্যন্ত কুমার নীরব রহিলেন। তারপর বলিলেন, সতীর্থ কুলিষ্কের কটাক্ষ আমি বুঝেছি মহামন্ত্রী। জন্মসূত্রে আমি শূদ্র। তাই ব্রাহ্মণের সমালোচনা আমার অধিকারবহির্ভূত, তাই তো? কিন্তু মহাবীর চন্দ্রগুপ্ত, মৌর্যকুলের অগ্রপুরুষ— তিনিও শূদ্র ছিলেন, তাই না কুলিষ্ক?

    সহসাই সভাস্থল নিশ্চুপ হইয়া গেল। স্তব্ধ বাতাবরণে কনিষ্ঠকুমারের রোষপরুষ কণ্ঠস্বর শুনা গেল, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত— রক্তের হীনতায় বাধা পায়নি তাঁর মহীয়ান উত্তরণের পথ। কৌলীন্যের অভাব তাঁর গরিমাময় পুরুষকারের অন্তরায় হয়নি। আমি তাঁরই পৌত্র। পিতামহের আদর্শ হতে আমি বিচ্যুত নই। অধিকারী না হতে পারি, তবু ব্রহ্মশক্তি আমারও প্রণম্য। কিন্তু আজকের এই কলুষিত ব্রাহ্মণ্যবাদের মাথায় আমি পদাঘাত করি। পরশুরাম ধরাকে নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। সুযোগ এলে আমি এই ঘৃণ্য ব্রাহ্মণগুলোর হাত থেকে ধরাকে মুক্ত করে যাব।

    কয়েক মুহূর্ত লাগিল এ বক্তব্যের অনুধাবনে। তারপর প্রচণ্ড প্রতিবাদে সভাস্থল ফাটিয়া পড়িল। কুলিষ্কের নেতৃত্বে পুরোহিতের একটি দল আসন পরিত্যাগপূর্বক মহামন্ত্রীর নিকটে আসিয়া প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিতে লাগিল। রোষকষায়িত নেত্রে একবার কুমারের দিকে চাহিয়া কুলিষ্ক সভাপতিকে বলিলেন, এ সভায় আর এক মুহূর্ত অবস্থান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় মহামন্ত্রী। অযোগ্য প্রার্থীর দণ্ডবিধান করে এ সভা ভঙ্গ করুন।

    —একটু দাঁড়ান ব্রাহ্মণ, কনিষ্ঠকুমারের আহ্বানে ব্রাহ্মণমণ্ডলীকে ঘুরিয়া দাঁড়াইতে হইল। কুমার তখন বলিলেন, আমার প্রতি নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় কটাক্ষের উত্তরটাও শুনে যান। মগধের সিংহাসনে আমার নৈসর্গিক অধিকার নেই সত্য। কিন্তু এ কথা হয়ত আপনাদের জানা নেই, আমার পিতামহ— মৌর্যসিংহ চন্দ্রগুপ্ত স্বয়ং তাঁর উত্তরাধিকার আমাকে বহন করতে দিয়ে গেছেন। তাঁর মুদ্রাঙ্কিত তলোয়ারখানা। আমি তখন নেহাতই বালক, সেই ভীষণ অস্ত্রচালনার বয়স তখনও আমার হয়নি। তলোয়ারখানা লম্বায় প্রায় আমার সমান ছিল, সেইরকম ভারীও। তবু মহান পূর্বপুরুষের সেই উপহারেই আমি অসিবিদ্যা আয়ত্ত করি। অযোগ্যের হাতে তিনি এ অস্ত্র তুলে দিতেন বলে মনে হয় না। এখন আপনারা স্বচ্ছন্দে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিন্তু আমি জানি, খ্যাতকীর্তি পিতামহের সেই আশীর্বাদই আমার অপরিণত ললাটের রাজটীকা।

    দিগ্বিজয়ী পিতামহ পৌত্রের আপাত উগ্রতার মাঝে সমাহিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে স্বীকৃতি দিয়াছিলেন নিতান্তই কৈশোরে। তাঁহার সকল উত্তরপুরুষের মধ্যে মৌর্যকুলের পরবর্তী পুরুষশ্রেষ্ঠরূপে এই বালককেই উপযুক্ত বিবেচনা করিয়াছিলেন। তাই কুলের সুমহান অগ্রপুরুষ বানপ্রস্থে যাইবার পূর্বে নিজস্ব তরবারিখানা পুরষ্কার দিয়া কিশোরকর্ণে শুনাইয়াছিলেন আপন জীবনদর্শনের আলোকে প্রাপ্ত ক্ষণজীবনে মৃত্যুঞ্জয়ী হইবার বিজয়মন্ত্র।

    কনিষ্ঠকুমারের ঘোষণায় সভা মৌন হইয়া গিয়াছে। সদস্যরা যেন ভাবিয়া পাইতেছে না কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করিবে। বালকের হাতে স্বীয় অস্ত্র প্রদান, সে একরকম উত্তরাধিকারের হস্তান্তরণই বটে। আর এ কথা বলিবার অপেক্ষা রাখে না, মৌর্য বংশাগ্রজ বালক পৌত্রের মাঝে যখন সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তা নিতান্ত স্নেহের বশে নয়। কিন্তু তাই বলিয়া কুমার সুসীমকে অতিক্রম করিয়া একেবারে মগধ সিংহাসনের দাবী!

    নিস্তব্ধ সভাকক্ষে কনিষ্ঠকুমারের অপ্রতিম কণ্ঠ গমগম করিয়া ওঠে, অগ্রপুরুষের সে আশীর্বাদ আজও আমার কাছে আছে। মৌর্যাধীশের নির্দেশ ছিল, একমাত্র ধর্ম সংস্থাপনের জন্যই সে অস্ত্র যেন ব্যবহার হয়। তাঁর সে ইচ্ছার অমর্যাদা হবে না, এই আমার শপথ।

    —ধর্ম সংস্থাপনের পন্থা নিশ্চয় করার ভারও কি তিনি গ্রহীতাকে দিয়ে গেছেন?— কুমার সুসীমের কণ্ঠে রোষকষায় বক্রোক্তি।

    —না। পন্থা সহজ— সাধুর পরিত্রাণ ও দুষ্কৃতীর বিনাশ। এ মহাকালের শাশ্বত নির্দেশ।

    কুমার সুসীমের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য লক্ষিত হইল। কিন্তু সহসা এ ব্যাপারে মতবিরোধ প্রকট করিবার কোনও ভাষা খুঁজিয়া পাইলেন না।

    আর কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই মহামাত্য রাধাগুপ্ত তাড়াতাড়ি সভাসমাপ্তির ঘোষণা করিয়া বলিলেন, প্রয়াত মন্মহারাজের উত্তরাধিকারীরূপে আমি মন্ত্রীপরিষদের পক্ষে দুই কুমারেরই প্রার্থী-আবেদন স্বীকার করছি। এ বিষয়ে পরিষদ স্বতন্ত্র বিচার করবার জন্য পুনরায় মিলিত হবে।

    সভা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল না। বরং একটি অবাঞ্ছিত যুদ্ধরেখা নির্ধারিত হইয়া গেল।

    মহামাত্য রাধাগুপ্ত বড় চিন্তিত হইয়াছেন। মহারাজ বিন্দুসারের প্রয়াণের পর সিংহাসনের উত্তরাধিকার লইয়া প্রয়াত সম্রাটের পুত্রগণ প্রবল বিবাদে লিপ্ত। বিসম্বাদ আর অস্ত্ররহিত নেই, পন্থাও অহিংস নয়। প্রতিপক্ষ চিহ্নিত হইয়া গিয়াছে। জ্যেষ্ঠকুমার সুসীম ও রানি সুভদ্রাঙ্গীর পুত্র প্রিয়দর্শন। অন্যন্য ভ্রাতারা এই দুইএর ছত্রছায়া আশ্রয় করিয়া আপন আপন উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথ খুঁজিতেছেন। গৃহযুদ্ধ শুরু হইয়াছে মগধে।

    রাজপুরুষদের জন্য অতিরিক্ত সুরক্ষাসৈন্য নিয়োগ করা হইয়াছে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি নাই। সেনাদলেও অস্থিরতার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। জনৈক সেনানায়ক মহামন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়াছেন, মগধ আক্রমণ করিয়া মৌর্যবংশ ধ্বংস করিয়া ফেলা যাউক। রাধাগুপ্ত রাজা হউন। অনিশ্চয়তার অবসান হউক। মহামত্যের আজ্ঞা পাইলে তিনি সেইমত সৈন্যদলকে প্রস্তুত করিতে পারেন।

    রাধাগুপ্ত রাজী হন নাই। রাজ্যের সৈন্যদল এখন দুই দলে বিভক্ত। কোনও অজ্ঞাত পথে প্রচুর বহিরাগত যবনসৈনিক কনিষ্ঠকুমারের শক্তিবৃদ্ধি করিয়াছে। তারপর হইতেই ক্রমশ মগধসৈন্যের আনুগত্য দুই রাজপুত্রের মাঝে সমভাবে বন্টিত হইতে থাকে। বর্তমানে কোন দল অধিক শক্তিশালী জানা নাই। সিংহাসন আক্রান্ত হইলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম লাগিবে। ফলাফল যাহাই হউক, অধিগ্রহণ সহজ নয়।

    তাছাড়া রাধাগুপ্ত মৌর্যদের অনুগত শুভচিন্তক। এই বয়সে আর রাজ্যলোভী পরস্বাপহারীর কলঙ্ক মাথায় লইতে চাহেন না। তাঁহার সম্মতির প্রয়োজন ছিল সেনানায়কটির। তাই এ যাত্রা কোনমতে তাহাকে নিরস্ত করা গিয়াছে। কিন্তু প্রবল অরাজকতার মাঝে আরও কত গুপ্ত-ষড়যন্ত্রের জন্ম হইবে তাহা কে জানে। দীর্ঘকাল সৈন্যদলের উত্থান রোধ করা সম্ভব হইবে কি? এ এক বড় উদ্বেগের কারণ।

    সম্পূর্ণ সেনাদল প্রয়োগ সম্ভব নয়, তাহাতেও অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাইবে। অতএব মন্ত্রীপরিষদের বৈঠক আয়োজিত করিয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সম্রাট-নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করানোর আশু প্রয়োজন। প্রথানুসারে এই কাজে ভব্যসংখ্যক সম্মাননীয় সদস্যকে রাজসভায় একত্র করিয়া নিরপেক্ষ নামাঙ্কিত পর্যবেক্ষকদের সম্মুখে মতদান লওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতপ্রাপ্ত প্রার্থী সিংহাসনের অধিকারীরূপে চিহ্নিত হইবেন। অপর প্রার্থীরা সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হইবেন, সে চয়নের আর বিরোধিতা করা যাইবে না।

    যথাশীঘ্র সম্ভব এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যে অরাজকতা শুরু হইয়াছে, তাহাতে সম্রাট-নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় মতদাতাই নির্মূল হইবার উপক্রম! মুশকিল হইল, ন্যূনতম কতজনের মতে রাজা নির্বাচিত হইবেন, পুরাণ অথবা অর্থশাস্ত্রে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নাই। তবে গণরাজ্যের মর্যাদানুসারে সম্পূর্ণ প্রজাবর্গের মতামতের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সদস্যদল গঠন করা আবশ্যক।

    এখানে মহামাত্যের উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণ হইল, মন্ত্রীপরিষদ ও রাজ্যের অন্যান্য গণ্যমান্য নাগরিকদের মধ্যে হইতে ভদ্রস্থসংখ্যক সদস্য বাছিয়া লওয়া। কেহই প্রায় স্বেচ্ছায় রাজী নহে। সকলরই ভয় যে কোনও পক্ষকেই সমর্থন করা হউক, অন্য পক্ষের কোপে পড়িতে হইবে। রাজ্য হইতে নির্বাচনোপরান্ত তাহাদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করা হইবে জানিয়াও বহু সম্মাননীয় ব্যক্তি পিছাইয়া যাইতেছেন। পদোন্নতি, বৃত্তি, সাম্মানিক পুরস্কারের প্রলোভনেও কারোকে উদ্বুদ্ধ করা যাইতেছে না। এমনকি মর্যাদাহানির ভয় প্রদর্শনেও কাজ হইতেছে না। অনেকে রাজ্য ত্যাগ করিয়া পলায়নও করিতেছেন।

    পরিষদপ্রধান রূপে রাধাগুপ্তের ইচ্ছা ছিল অন্তত এক সহস্র মত গ্রহণের। কিন্তু বহু প্রয়াসের পরেও মাত্র শতখানেক সম্মতিপট্ট সংগৃহীত হইয়াছে।

    উপায়ান্তর না দেখিয়া মহামন্ত্রী এই গুপ্তবৈঠকের আয়োজন করিয়াছন। অবিলম্বে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কয়জনের সম্মতি পাওয়া গিয়াছে তাহার দ্বারাই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর চয়ন করিয়া মহামাত্য রাজনীতি হইতে অবসর লইতে চান। ইতিমধ্যে যথেষ্ট বিলম্ব হইয়া গিয়াছে।

    দশজন বরিষ্ঠ সভাসদ, রাজপুরোহিত, সভাজ্যোতিষী ও শাস্ত্রীকে লইয়া মহামাত্য রাধাগুপ্তের সভাপতিত্বে এই গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তবৈঠক আহুত হইল। সর্বসম্মতিক্রমে মগধ রাজসিংহাসনের নিমিত্ত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করিয়া নির্বাচনের দিনস্থির করাই উদ্দেশ্য।

    মহামাত্য রাধাগুপ্ত সভাকার্যের সূচনায় উপস্থিত সদস্যদের সম্বোধিত করিয়া বলিলেন, আপনারা অবগত আছেন, প্রয়াত মন্মহারাজের উত্তরাধিকারীরূপে আমি মন্ত্রীপরিষদের পক্ষে দুই কুমারের প্রার্থী-আবেদন স্বীকার করেছি। এ ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। এবার আমাদের একটি শুভদিন স্থির করতে হবে যখন চিহ্নিত মতদাতাগণ তাঁদের পছন্দের প্রার্থী চয়ন করবেন। এই কাজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদির জন্য কিছু সময়ের আবশ্যক। বিবেচনা করে এখন আপনারা উপযুক্ত দিনটি প্রস্তাব করুন।

    সভার কাজে অবশ্য খুব বেশী সময় লাগিল না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সমিতির গঠন, নির্বাচন কক্ষের প্রয়োজনীয় সংস্কার, নির্বাচন পেটিকা ও অক্ষ নির্মাণ ইত্যাদিতে কমপক্ষে মাস ছয় সময় লাগিবে। সে সময় যতদূর সম্ভব সংক্ষেপ করা হইবে স্থির হইল।

    এইসব বিষয়ে স্বল্প আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পাঁচ মাস পরে শারদ পূর্ণিমায় নির্বাচনের দিনস্থির করা হইল। সেই মর্মে নগরীতে মন্ত্রীসভার ঘোষক প্রেরিত হইয়া গেল। পৃথক ভাবে স্বতন্ত্র স্বরবাহের মুখে বার্তা পাঠাইবারও আয়োজন করা হইল প্রতিটি সদস্যের কাছে।

    সভার কাজ সমাপ্ত করিতে অপরাহ্ণ হইয়া গেল। সদস্যগণ যথাযোগ্য সুরক্ষায় আপন আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

    মধ্যরাত্রে একটি চর আসিয়া মহামাত্য রাধাগুপ্তকে সংবাদ দিল, রাজ্যের প্রান্তিক শুঙ্গতীর্থের জঙ্গলে আচার্য চক্রনাস নিহত হইয়াছেন।

    মহামাত্য নিদ্রায় ছিলেন, চরের আগমনে সদ্য শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া আসিয়াছিলেন। নিদ্রোত্থিত ধূসর মস্তিষ্কের জড়তা অপসারিত হইতে কিঞ্চিৎ সময় লাগিল। অতঃপর সশঙ্কে জিজ্ঞাসা করিলেন, আর সেনানায়ক জাম্ভব? তিনিও তো সঙ্গে ছিলেন!

    আচার্য চক্রনাস বরিষ্ঠ সভাসদ। তাঁর নিজস্ব পালঙ্কী আছে। সভা-সমাপনান্তে তিনি যখন তাঁহার বাহনটির দিকে অগ্রসর হইয়াছেন, সেনানায়ক জাম্ভবদেব তাঁর কাছে প্রস্তাব করিয়াছিলেন, আপনার আপত্তি না হলে আমি আপনার সঙ্গ নিতে পারি আচার্য? অধমের গন্তব্য আপনার আবাস থেকে খুব দূরে নয়।

    আচার্য চক্রনাস কুমার সুসীমের শিক্ষকও বটে। তিনি কুমারের ঘোষিত সমর্থক। তাই তাঁহার সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা। কুমার সুসীম তাঁহাকে দুইজন অতিরিক্ত দেহরক্ষী দিয়াছেন। সেনানায়ক জাম্ভবের লক্ষ্য সেই বিশেষ সুরক্ষার সুযোগটি নেওয়া।

    আচার্য চক্রনাস আপত্তি করেননি। একত্রে যাওয়া তাঁহার পক্ষেও মঙ্গলকারী। উভয়ে পালঙ্কীতে আরোহণ করিয়া চারজন বাহক ব্যতীত আরও আটজন রক্ষীবেষ্টিত হইয়া রওয়ানা হইয়াছিলেন। তবু শেষরক্ষা হয়নি।

    মহামাত্যের প্রশ্নের উত্তরে চর বলিল, সেনানায়ক জাম্ভব কোনমতে পলায়ন করে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন।

    হতাশ ভঙ্গিমায় নিকটস্থ সুখাসনে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন মহামাত্য। চক্রনাসের মৃত্যুতে তাঁহাকে খুব একটা শোকাহত মনে হইল না, জাম্ভব রক্ষা পাওয়ায় বিশেষ হর্ষবোধও করিলেন না। কণ্ঠস্বরে তাঁহার শুধু আক্ষেপ শোনা গেল, যা—হ্‌, আরও একজন কম হয়ে গেল!

    সেই রাত্রির দুঃস্বপ্ন অহরহ সেনানায়ক জাম্ভবের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ফিরিতেছিল। কী কুক্ষণেই না যাচিয়া তিনি চক্রনাসের সঙ্গ লইয়াছিলেন!

    কুটিল ভবিতব্যের ইঙ্গিত অজ্ঞাত ছিল। সভা হইতে নিশ্চিন্তেই আচার্য চক্রনাস ও জাম্ভবদেব বাহির হইয়াছিলেন। দুইজন থাকায় পথের একাকীত্ব ছিল না। উচ্চহাস্য পরিহাসে দিব্য সময় ব্যতীত হইতেছিল। কিন্তু কিছুদূর যাইবার পর তাঁহাদের যাত্রাভঙ্গ হইল।

    কুমার সুসীমের এক সংবাহক আচার্য চক্রনাসের শোভাযাত্রা অনুসরণ করিয়া তাঁহার কাছেই আসিয়াছে। আচার্য পালঙ্কী হইতে নামিলেন। সংবাহক তাঁহাকে কুমার সুসীমের অভিজ্ঞান প্রদর্শনপূর্বক নিবেদন করিল, কুমার তাঁহার আচার্যের দর্শনপ্রার্থী। অতি গোপনীয় বিষয়ে অবিলম্বে চর্চার প্রয়োজন। তিনি তাঁহার উদ্যানবাটিকায় আচার্য চক্রনাসের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছেন।

    আচার্য চক্রনাসেরও প্রয়োজন ছিল কুমারকে। ভাবিলেন, মন্দ নয়, এখনই কাজ সারিয়া লওয়া যাইবে। সঙ্গী জাম্ভবকে বলিলেন, চলুন কুমারের দর্শন করে যাওয়া যাক।

    জাম্ভব অস্বস্তিতে ছিলেন। বিনীত স্বরে বলিলেন, সন্ধ্যা আগতপ্রায়। অন্ধকার গাঢ় হবার আগে গৃহে প্রবিষ্ট হলে হত না? তাছাড়া কুমারের আপনাকে প্রয়োজন। আমি আনহুত হয়ে সেখানে যাওয়া কি ঠিক হবে?

    চক্রনাস বলিলেন, আরে আপনার কোনও ভয় নেই। আমি তো সঙ্গেই আছি। মন্ত্রণায় অধিক সময় লাগলে আমরা রাত্রে কুমারেরই আতিথ্য গ্রহণ করব। আপনাকে সে নিয়ে ভাবতে হবে না। আসুন।

    সংবাহকটির পথনির্দেশে আবার তাঁহাদের শোভাযাত্রা শুরু হইল। ক্রমে সন্ধ্যা নামিল। রক্ষীর দল মশাল জ্বালাইয়া নিল। পথঘাট নির্জন হইয়া আসিল। আচার্য চক্রনাস তাঁহার সঙ্গীর সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে নিমগ্ন ছিলেন। পথের খেয়াল করেননি। খানিক পরে অতি নির্জন পথে ঝিল্লীধ্বনি শুনিয়া তাঁহাদের আলাপ বন্ধ করিতে হইল। পালঙ্কীর দ্বার হইতে গ্রীবা বাড়াইয়া আচার্য চক্রনাস বলিলেন, ও হে, এ কোন পথে চলেছ?

    কেহ তাঁহার উত্তর দিবার পূর্বেই অন্ধকার ভেদ করিয়া ঝুপঝাপ কয়েকটি অবয়ব উদয় হইয়া তাঁহাদের ঘিরিয়া ফেলিল। হঠাৎ আচার্য চক্রনাসের মাথা পশ্চাতের কাষ্ঠে ঠুকিয়া গেল এবং সেনানায়ক জাম্ভবের কটিদেশ ঝনঝন করিয়া উঠল। পালঙ্কীবাহকেরা ত্বরিতে পালঙ্কী নামাইয়া দৌড়ে পলায়ন করিয়াছে।

    ততক্ষণে বাহির হইতে কিছু সংঘর্ষের শব্দ ও চাপা আর্তনাদ শোনা যাইতেছে। কী যে হইতেছে কিছুই বুঝিতে না পারিয়া পালঙ্কী হইতে উভয়ে অবতরণ করিলেন। তৎক্ষণাৎ পিছন হইতে তিন-চার জন করিয়া তাঁহাদের জাপটাইয়া হাতগুলি শরীরের পিছনে বাঁধিয়া ফেলিল।

    প্রথমটা কিছুই দেখা গেল না। তাঁহাদের দলেরই কয়েকটি রক্ষীর দেহ যেন মাটিতে পড়িয়া আছে মনে হইল। বাকি সব পলাইয়াছে। মশালগুলো সব নিভিয়া গিয়াছে। নীরন্ধ্র অন্ধকারে এবার একটি মশাল জ্বলিয়া উঠিল। সেই মশাল হস্তে একটি লোক আচার্য চক্রনাসের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

    আচার্য প্রায় চিৎকার করিয়া বলিলেন, কুমার তুমি এ কাজ করতে পার না। আমি তোমার আচার্য।

    লোকটা মশাল নিজের মুখের কাছে আনিয়া বলিল, ভাল করে দেখুন আচার্য। আপনি যার অভিজ্ঞান দেখে ভ্রমিত হয়েছেন, আমি সে নয়।

    মশালের উজ্জ্বল আলোয় প্রকট হইয়াছে একটা কঠিন মুখাবয়ব। চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে হিংসার চিহ্ন নাই কিন্তু সে শীতল দৃষ্টি দ্রষ্টার শরীরের শোণিত প্রবাহ বন্ধ করিয়া দেয়। তৈলাক্ত শ্যামল গাত্রবর্ণে মশালের আলোর কম্পমান প্রতিবিম্ব। ঈষৎ বক্র নাসা, আয়ত চিবুকের দৃঢ়তায় ক্রূর প্রত্যয়ের প্রতিচ্ছবি। ওষ্ঠাগ্রের মৃদু হাস্যের আভাষে কিন্তু ভয়াবহ বন্য জিঘাংসার অভিলেপ।

    স্খলিতস্বরে চক্রনাস বলিলেন, তু— তু— ত্তুমি—।

    লোকটা তাঁহার মুখে হাত চাপা দিয়া বলিল, থাক অন্তিম সময়ে আমার নাম আর মুখে আনবেন না। চণ্ড। চণ্ড আমার নাম। রুদ্রের উপাসক। ঈশ্বর স্মরণ করুন। আপনার কাল সমাপ্ত হয়েছে।

    চক্রনাস সম্মুখে যেন স্বয়ং যমরাজকেই প্রত্যক্ষ করিয়া বিকৃত স্বরে বলিলেন, কী চাও তুমি? আমাকে যেতে দাও কু— ক্কুমার—!

    —তোমাকে মৃত্যু প্রদান করতে এসেছি।— অবিচল কণ্ঠে আগন্তুকের উচ্চারণ।

    —আমি ব্রাহ্মণ। তুমি ব্রহ্মহত্যার পাপ করতে পার না কুমার।

    —চণ্ড সব পারে। আমার শপথ— বাহ্মণবেশী চণ্ডালগুলোকে শেষ করে যাব। আপনাকে দিয়েই সেই পুণ্যকর্মের শুরু। মনে করুন, আচার্য বিদ্যেশ, সায়ন, পুস্তাহ— এঁরাও ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে আপনারই ইচ্ছায়।

    —মিথ্যা। আমি কিচ্ছু জানি না। আমাকে যেতে দাও। তুমি দূর হও পাপিষ্ঠ, সরে যাও আমার সম্মুখ হতে—।

    —যেমন আপনার অভিরুচি। এই আমি সরে গেলাম।

    মশালধারী একপাশে সরিয়া যাইতেই কী যেন হইয়া গেল। একটা খড়্গের ঝলকানি ও সঙ্গে সঙ্গে 'ঘপ্‌' করিয়া এক শব্দে আচার্য চক্রনাসের কণ্ঠে উত্থিত আর্তনাদ মধ্যপথেই স্তব্ধ হইল। দেখা গেল তাঁহার খণ্ডিত গ্রীবাদেশ একপাশে ঢলিয়া পড়িয়াছে। মস্তক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়নি, একদিক তখনও কণ্ঠসংলগ্ন হইয়া ঝুলিয়া আছে। উন্মুক্ত কণ্ঠনালী অঝোর ধারায় রক্ত উদ্গিরন করিতেছে। অবিলম্বে তাঁহার দেহ ভূমিগত হইল, একবার প্রবল কম্পনে শিহরিয়া স্থির হইয়া গেল।

    কুমারের পিছনেই ছিল মিশকালো এক ষণ্ডামর্ক। তাহার হাতের খড়্গ হইতে তখনও ঝরিতেছে রক্তবিন্দু। বন্য রাজকুমার মশাল হাতে এবার অগ্রসর হইয়া আসিলেন জাম্ভবের সম্মুখে। রাজকুমারের পিছনে গিয়া দাঁড়াইল সেই কৃষ্ণদানব। কুমার প্রিয়দর্শন বড় মিষ্টস্বরে তাহার পরিচয় প্রদান করিয়া বলিলেন, আমার পিছনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার নাম মুণ্ডা, আর মুণ্ডার হাতে যে খড়্গটা আছে তার ওজন প্রায় আধ মণ। সাধারণ লোকে তুলতেই পারে না। খালি মুণ্ডাই পারে। ও বন্য উপজাতীয় মনুষ্য, সভ্য ভাষা জানে না। ও শুধু জানে আমার সম্মুখে যে দাঁড়িয়ে থাকে তার স্কন্ধে খড়্গখানা বসিয়ে দিতে হয়। ওর সামনে থেকে আমার সরে যাওয়াই হচ্ছে সঙ্কেত। এখন বলুন জাম্ভবদেব, আপনিও কি আচার্য চক্রনাসের মত আমাকে সরে যাবার আদেশ দেবেন?

    রাজকুমারের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার লেশ ছিল না। কিন্তু জাম্ভবদেবের মেরুদণ্ডে শীতল স্রোতের অনুভব হইল।

    —না না কুমার, তুমি সরে যেও না,— আর্ত চিৎকার করিয়া বলিলেন সেনানায়ক, তুমি দাঁড়িয়ে থাক— অ্যাঁ— দাঁড়িয়ে থাক দয়া করে। আ-আমি কী অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও?

    সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখে জাম্ভবের শরীর থরথরে কম্পিত হইতেছিল। কুমার শান্তস্বরেই বলিলেন, আমি আপনাকে হত্যা করতে চাই না। তাই তো আপনার ও মুণ্ডার মাঝে বর্মের মত দণ্ডায়মান আছি। আশা করি মগধের সিংহাসনের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আপনি বিস্মৃত হননি।

    —তা-ত্তার মানে?

    —এক বিকৃতবুদ্ধি কামুকের হাতে এ রাজ্যের ভবিতব্য নির্ধারিত হতে চলেছে। শুনেছি আপনি তার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এ বিষয়ে আপনার বিবেকও কি তাই বলে?

    —আমি কুমার সুসীমের অনুগৃহীত। কিন্তু তোমার প্রশ্ন অনুধাবন করতে পারছি না কুমার।

    —মগধ রাজ্যের আগামী নির্বাচনে আপনি কাকে পছন্দ করবেন সেটা জেনে নিয়েই চলে যাব। মুণ্ডাও আমার সঙ্গে বিদায় নেবে অথবা তার কাজ সপন্ন করবে। এখন আপনার ইচ্ছা।

    —তোমাকে কুমার, আমি তোমাকেই নির্বাচন করব,— ব্যগ্র উত্তরে জাম্ভব জানাইলেন, আমাকে দয়া করে হত্যা কোর না।

    —কী করে জানব আপনার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে না?

    —হবে না কুমার হবে না। তুমি দেখে নিও। এক যোদ্ধার প্রতিজ্ঞা— এর নড়চড় হবে না। এবার আমাকে দয়া করে ছেড়ে দাও।

    —বেশ, আপনাকে বিশ্বাস করলাম। মুণ্ডা, তুমি যাও— গ্রীবা ঘুরাইয়া পিছনের দিকে আদেশ দিলেন কুমার। মুণ্ডা অস্ত্র সংবরণ করিল। তারপর জাম্ভবের পিছনে যাহারা তাঁহার হাত বাঁধিয়া রাখিয়াছিল তাহাদের উদ্দেশ্যে কুমার বলিলেন, সেনানায়কের বন্ধন খুলে দাও। শুনুন নায়ক, পলায়নের প্রচেষ্টা বৃথা। এই জঙ্গলে অনর্থক নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। আমি যেমন আপনার প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাস করলাম, আপনিও আমার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারেন। এরা আপনাকে সকুশল গৃহে পৌঁছে দেবে।

    বন্ধনমুক্ত হইয়া সেনানায়কের কিঞ্চিৎ সাহস হইয়াছিল। আপাতত বিপদ এড়ানো গিয়াছে দেখিয়া গলায়ও স্বর আসিল। কণ্ঠস্বরে খানিক শ্লেষ মিশ্রিত করিয়াই তিনি বলিলেন, আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে প্রভাবিত করলে কুমার? তোমার নীতিবোধের প্রশংসা করি।

    —কী জানেন নায়ক, রুদ্র যখন ভর করেন তখন আমি চণ্ড— কুমার বলিলেন, লক্ষ্যটি রুদ্রদেব নিশ্চিত করে দেন, পথের বাধাগুলো অতিক্রম করি আপন পুরুষকারে। সেখানে আর কোনও নীতি নেই।

    —রাজ্যলিপ্সায় বিরোধীদের হত্যাই কি তোমার রুদ্রদেবের লক্ষ্য?

    —সদ্ধর্মের প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য। তাই এই অধার্মিকের অপসারণ। আমি নিমিত্ত মাত্র।

    —মানলাম তোমাকে নির্বাচিত করলে সদ্ধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু আমার কী লাভ?

    —আপাতত কিছুদিনের জন্যে আপনার আয়ু দীর্ঘায়িত হল, সেটা লাভ নয়?—

    প্রাথমিক বিপদ নিবারিত হইয়াছে। সেনানায়কের চোখের দৃষ্টিতে এবার দুষ্টবুদ্ধি প্রকট হইল। শুষ্ক হাস্যে তিনি বলিলেন, কুমার জীবনদান দিলেন, অধম কৃতার্থ হল। কিন্তু একটা পুরস্কার ভাবী মগধেশ্বরের কাছে চেয়ে নিতে ইচ্ছা করি। আমার একটি সর্বগুণান্বিতা কন্যা আছে। তাকে মগধের সম্রাজ্ঞীরূপে দেখলে পিতৃহৃদয়ের অনেককালের একটি সুপ্ত বাসনার পূর্তি হয়। সে ইচ্ছাপূরণ এখন কুমারের হাতে।

    কুমারের ভ্রূ কুঞ্চিত হইল। তিনি বলিলেন, আশা করি আপনি জানেন আমার এক মহিষী বর্তমান। তিনি আমার পুত্র-কন্যার জননীও বটে। তা জেনেও কি আপনি আমাকে কন্যা সম্প্রদান করতে চান?

    —নিশ্চই। শুনেছি আপনার প্রথমা পত্নী সাধ্বীভাবাপন্ন। আমার কন্যাকে যদি মগধের অগ্রমহিষীর পদে স্বীকার করেন তাহলে নিশ্চই তাঁর আপত্তি হবে না।

    ক্ষণিক ভেবে কুমার উত্তর দিলেন, বেশ তাই হবে। প্রতিজ্ঞা করলাম, আপনার কন্যাই হবেন আমার অগ্রমহিষী। কিন্তু আপনার প্রতিজ্ঞা স্মরণে থাকবে তো?

    —আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবে না। কনিষ্ঠকুমারের জয় হোক।

    —মনে থাকবে তো নায়ক? আবার ভেবে বলুন।

    —না না, থাকবে কুমার। অবশ্য মনে থাকবে। মুণ্ডার খড়্গ অত সহজে কি ভুলতে পারি!

    —বেশ। আমাদের এই সাক্ষাৎকার যেন গোপন থাকে। লোকে জানবে, ডাকাতের হাতে চক্রনাস মারা গেছে আর আপনি অসীম সাহস ও প্রবল বিক্রমে তাদের হাত থেকে অক্ষত ফিরে গেছেন।

    নিগূঢ় হাস্য করিয়া কুমার বিদায় নিলেন।

    মগধের নির্বাচন মহাসভাগার। সেদিন পূর্বাহ্ণে রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট নির্বাচনের নিমিত্ত সভা আয়োজিত হইয়াছিল। উপস্থিত ছিলেন মগধের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মহামাত্যের অনেক প্রচেষ্টার পরেও একশত আশি জনের বেশি মতদাতা একত্র করা সম্ভব হয়নি। মহামাত্য পর্যবেক্ষকমণ্ডলীর অংশ, মতদানে অংশগ্রহণ করিবার কথা নয়। কিন্তু মতদাতা অযুগ্মসংখ্যক হওয়া প্রয়োজন, নতুবা দুই পক্ষের সমান সংখ্যক মতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকিয়া যায়। সে সম্ভাবনা দূর করিতে মহামাত্য রাধাগুপ্তকেও মতদান প্রক্রিয়ায় একশত একাশিতম অংশীদার হইতে হইল।

    সভারম্ভে মহামাত্য রাধাগুপ্ত বলিলেন, আপনারা সকলে আসন গ্রহণ করুন। আশা করি প্রার্থীরূপে দুই কুমারের পাত্রতা ও সমর্থন বিষয়ে সদস্যগণ অবগত আছেন। তাঁদের নিরপেক্ষ মতদানে মগধসম্রাটের চয়ন করবার সময় সমাগত। সুতরাং রাজপুরোহিতের অনুমোদন সাপেক্ষে সদস্যগণের মতদান প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।

    মতদান সভার একদিকে একটি ছোট্ট দ্বারের পরে এক ক্ষুদ্র কক্ষে দুইটি মতদান পেটিকা রাখা ছিল। উচিত চিহ্নদ্বারা তাহা দুই প্রার্থীর জন্য নামাঙ্কিত। প্রত্যেক মতদাতাকে দ্যূতক্রীড়ায় ব্যবহৃত আয়তাকার অক্ষবাটের মত দারুনির্মিত পার্ষ্ট্রি প্রদান করা হইল। মতদাতাগণ আপন বিচার অনুযায়ী পার্ষ্ট্রিগুলি তাহাদের মনোনীত প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট পেটিকায় ফেলিয়া আসিবেন। সকলের মতদান হইয়া গেলে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক সংঘের সম্মুখে মতপেটিকাগুলি খালি করিয়া গণনা করা হইবে। কোন প্রার্থীর স্বপক্ষে কতগুলি মত পাওয়া গেল তাহার গরিষ্ঠতার বিচারে প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হইবে।

    রাজপুরোহিত স্বস্তিবাচন করিলেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হইল। একে একে সদস্যগণ তাঁহাদের কর্তব্য সম্পাদন করিয়া আসিতে লাগিলেন।

    বেশ কিছুক্ষণ যাবত সেনানায়ক জাম্ভব উসখুস করিতেছিলেন। অবশেষে মহামাত্য রাধাগুপ্তকে তিনি অনুরোধ করিলেন, আমি তেমন সুস্থ বোধ করছি না মহামাত্য। রাজসভার কার্যে আমার দায়িত্ব আমি তো পালন করেছি। এখন আমি কি প্রস্থান করতে পারি?

    জাম্ভবের মতদান হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু অন্যান্য অনেকের তখনও বাকি। সেনানায়কের অনুরোধে মহামাত্য রাধাগুপ্ত অনুমতি দিলেন, আপনি যদি সুস্থ বোধ না করেন সেনানায়ক তাহলে সভা সমাপ্ত হবার পূর্বেই আপনাকে প্রস্থান করবার অনুমতি দেওয়া হল। কিন্তু এই মতদান প্রক্রিয়ার ফলাফল না জেনেই চলে যাবেন?

    —আপনি অনুমতি দিলে আমি কিছু আগেই যেতে চাই মহামাত্য, ফলাফল ঘোষিত হলে তা তো জানতেই পারব।

    সেনানায়ক সভাভঙ্গের পূর্বেই রক্ষী পরিবৃত হইয়া আপন আবাসে ফিরিয়া আসেন। তখন বেলা মধ্যাহ্ন। জাম্ভব সভাত্যাগ করিয়াছিলেন অসুস্থতার অজুহাতে। কিন্তু অসুস্থতা তাঁহার কিছু ছিল না। প্রকৃত কথা হইল, তখনও তিনি মুণ্ডা নামক নররূপী দানবটির দুঃস্বপ্ন দেখিতেছিলেন। অনতিঅতীতের সে রাত্রিটা বড় স্পষ্টই মনে আছে তাঁহার। তাই এক আশঙ্কার কণ্টকে কিছু অস্বস্তিতে ছিলেন।

    যুবরাজ সুসীমের কৃপাধন্য তিনি। তাঁহাকে নির্বাচন করা ভিন্ন জাম্ভবের উপায় ছিল না। তাই কোনও কারণে কনিষ্ঠকুমারের বিজয় হইলে যাহাতে পত্রপাঠ পলায়ন করিতে পারেন, সে কারনেই নির্বাচন সভা হইতে শীঘ্র বিদায় লওয়া। প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করাই ছিল।

    কিন্তু তাঁহাকে পলায়ন করিতে হইল না। অপরাহ্ন পার হইবার পূর্বেই নগরীতে প্রচারিত হয় সম্রাট নির্বাচনের ফলাফল। প্রত্যাশামত কুমার সুসীমই নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত হইয়াছেন। তবে জয়ের ব্যবধান ছিল ন্যূনতম। কুমার সুসীম মাত্র একটি মতের ব্যবধানে কনিষ্ঠকুমার প্রিয়দর্শনকে পরাজিত করিয়াছেন!

    সন্ধ্যার পূর্বেই নগরীর পথে আবির-কুঙ্কুমরঞ্জিত কুমার সুসীমের সমর্থকগণ বিজয় শোভাযাত্রায় বাহির হইল। নাগরিকবর্গ জানিতে পারিল মগধের পরবর্তী মহারাজরূপে মন্ত্রী-পরিষদ দ্বারা কুমার সুসীমের চয়নসংবাদ। অভিষেকের তিথিনির্ধারণ ও তৎসংক্রান্ত বাকি কার্যক্রমের বিষয়ে শীঘ্রই নাগরিকবৃন্দকে অবহিত করা হইবে, এই মর্মে ঘোষকের বার্তাও অনতিপরে নগরীর পথে পথে প্রচারিত হইতে লাগিল।

    এদিন ব্যাপক কিছু নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের আশঙ্কায় পাটলিপুত্রে অভাবনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা রচিত হইয়াছিল। কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পরে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা গেল এমন কিছু ঘটিল না। নগরীর কোথাও হইতে হত্যাকাণ্ড অথবা শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনও সংবাদ আসে নাই। সহসাই এই রক্তাক্ত নগরী যেন শান্ত হইয়া গিয়াছে।

    সন্ধ্যার মুখে কুমার সুসীম এক দূত প্রেরণ করিলেন সেনানায়ক জাম্ভবের গৃহে। নির্বাচন ফলাফল ঘোষণার পরে সেনানায়ক জাম্ভবের আশঙ্কা বিদূরিত হইয়াছে। পলায়নেরও আর প্রয়োজন হয় নাই। পরম আহ্লাদে ও মহাসমারোহে তিনি কুমার সুসীমের দূতকে গৃহে আহ্বান করিলেন।

    —আমি মহানাম,— দূত বলিল, যুবরাজ সুসীমের পক্ষে আনন্দসংবাদ নিয়ে আপনাকে কুশলপ্রশ্ন করতে এলাম।

    —অবশ্য অবশ্য।— প্রবল হর্ষজ্ঞাপনপূর্বক জাম্ভব তাঁহাকে আপ্যায়ন করিয়া বলিলেন, জয়োহস্তু কুমার সুসীম। এ ফলাফল একরকম জানাই ছিল। ভাবী মগধেশ্বরকে আমার নমস্কার জানাবেন। এখন বলুন আমার উদ্দেশ্যে কুমারের কী বার্তা।

    আসন গ্রহণ করিয়া মহানাম বলিল, যুবরাজ একটি রটনায় কিঞ্চিৎ আঘাত পেয়েছেন। তিনি শুনেছেন আপনি নাকি শত্রুপক্ষে আপনার মতটি দান করেছেন?

    —আমি কি উন্মাদ!— জাম্ভব ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, কুমার আমার সম্পর্কে এমত অনুচিত চিন্তা করলেন কী করে? আমি তাঁর অনুগ্রহ ভুলে যাব? আপনি দয়া করে তাঁকে আশ্বস্ত করবেন, আমার দ্বারা এ অকৃতজ্ঞতা হয়নি। আমি অবশ্যই কুমার সুসীমের পক্ষে মতদান করেছি। তাঁর বিজয় তো স্বতঃসিদ্ধ ছিল। আমার আবার বিজিত পক্ষে থাকা একেবারেই পছন্দ নয়, হা হা হা—।

    —তা বটে। বিশেষত আপনি কুমারের কাছ থেকে ছয়শত মুদ্রা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন।

    —ছি ছি, একে উৎকোচ বলে অসম্মান করবেন না। যুবরাজের স্নেহের দান আমি মাথা পেতে নিয়েছি। কিন্তু আমার প্রতি কুমারের অনাস্থার কারণ জানতে পারি কি?

    —এমন শোনা গেছে আপনি কনিষ্ঠকুমারকে চয়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

    কী আপদ! এদের চর কি সর্বত্র থাকে? কোনও কথা গোপন রাখা যায় না। জাম্ভব আশঙ্কিত দৃষ্টিতে এদিকওদিক দেখিয়া নিলেন। তারপর সাবধানী নিম্নস্বরে বলিলেন, আর বলেন কেন? প্রাণের ভয়ে দেখিয়ে পাষণ্ড ঐ প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল। সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। না হলে তখনই এক পিশাচকে দিয়ে আমাকে হত্যা করত। যাক গে ওসব কথা, সে প্রতিশ্রুতি আমি তখনই বিস্মৃত হয়েছি। আপনি যুবরাজকে এই অনুগত ভৃত্যের অভিনন্দন অবশ্যই জানাবেন। এখন বলুন, কী পান করবেন। এক চষক করে গৌড়ের মাধ্বী হয়ে যাক—।

    —তুমি একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর মহানাম। আমি নায়কের সঙ্গে কিছু কাজ সমাপ্ত করেই আসছি।

    উক্তিটি মহানামের নয়। সচকিত হইয়া দ্বারের দিকে ফিরিয়া তাকাইলেন জাম্ভব।

    দেখা গেল, নাতিদীর্ঘ সেই পূর্বদৃষ্ট অবয়ব তাঁহারই দ্বারে উদয় হইয়াছে। যাহাকে মশালের স্বল্পালোকে কৃতান্তরূপে একবার দর্শন করিয়াছিলেন তিনি। স্খলিতস্বরে তিনি বলিলেন, এ— একী— এখানে আ-আপনি— মানে ত—ত্তুমি কীভাবে? কুমার সুসীমের দূত—

    —মহানাম আমারই সহকারী নায়ক,— কনিষ্ঠকুমার শান্তভাবে বলিলেন।

    —তাহলে যে ওর হাতে যুবরাজের অভিজ্ঞান দেখলাম?

    —যে ভাবে সে রাত্রে আচার্য চক্রনাস দেখেছিলেন। আপনাদের যুবরাজের অভিজ্ঞান এখন আমাদের দখলে।

    জাম্ভবের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করেন কী করিয়া। সন্দিগ্ধ স্বরে বলিলেন, কী উদ্দেশ্যে তোমার আগমন?

    —একটু আলাপ করতে এলাম। না, গৌড়ীয় মাধ্বীতে আগ্রহ নেই। আপনি তাহলে মিথ্যাচরণ স্বীকার করছেন?

    সে রাত্রে যাহা হইয়াছিল, সেনানায়কের পক্ষে তাহা ভুলিয়া যাওয়া সম্ভব নয়। সে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন! কিন্তু বর্তমানে তিনি আপন আবাসের সুরক্ষিত নিরাপত্তায় আছেন। তাই অনায়াসেই বলিয়া দিলেন, আমি নির্বাচন বিষয়ে কারো কাছে কোনও রকম অঙ্গীকার করিনি।

    —তাহলে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সে রাতে আপনার কন্যার অগ্রমহিষী পদের বিনিময়ে আপনি কিন্তু আমাকে চয়ন করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

    এতদিনে মুন্ডা নামক দৈত্য ও তার খড়্গের ত্রাস জাম্ভবদেবের মনে অনেকাংশেই হ্রাস পাইয়াছে। কুমারের আকস্মিক আবির্ভাবের বিমূঢ়তাও বেশীক্ষণ স্থায়ী হইল না। কুমারের আরোপে সহজ তাচ্ছিল্যেই তিনি বলিলেন, তুমি সম্রাট হলে সে প্রশ্ন ছিল। এখন আর তোমার পক্ষে আমার কন্যাকে অগ্রমহিষী করা সম্ভব নয় কুমার। তাই আমারও ঐ প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনও দায় নাই।

    —মগধের সিংহাসন এখনও শূন্য সেনানায়ক। মন্ত্রীপরিষদের চয়ন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে মাত্র। অভিষেক এখনও দূরে। যাই হোক, তাহলে স্বীকার করছেন, আপনি প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেছেন?

    —না। তুমি সম্রাট নও। তাই ঐ প্রতিশ্রুতি এখন মূল্যহীন।

    —সে আপনার শপথভঙ্গের কারণেই। মনে করে দেখুন, আপনার সমর্থনটি আমার পক্ষে গেলেই কিন্তু এ নির্বাচনের ফলাফল বিপরীত হত।

    —কী হলে কী পরিণাম হত, এখন আর তা বিচার্য নয়।— তাচ্ছিল্যভরে সেনানায়ক বলিলেন। এ তাঁহার গৃহ। তাঁহারই প্রহরী দ্বারা রক্ষিত। এখানে মুণ্ডার আবির্ভাবের কোনও সম্ভাবনা নাই। তাই জাম্ভবের কণ্ঠে এবার উষ্ণ প্রত্যয় ধ্বনিত হইল, যা উচিৎ মনে হয়েছে তাই করেছি। তার জন্য তোমার কাছে কোনও অপসরের দায় আমার নেই। কিন্তু তুমি আমারই গৃহে আমাকে অপদস্থ করার স্পর্ধা দেখাচ্ছ? ওরে, কে আছিস—

    শিয়রে শমনদেব আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। তাই জাম্ভবের আহ্বানে কোনও সহায়তা আসিল না। শুধু গোধূলির আকাশে অসময়ে কিছু জলদ্ভার মেঘ পুঞ্জীভূত হইয়া আসন্ন সন্ধ্যার আগমনকে যেন ত্বরান্বিত করিল। সেই সন্ধ্যার আঁধারে অন্তিম বারের মত রক্ত ঝরিল।

    সেনানায়ক জাম্ভব তাঁহারই নিবাসে অজ্ঞাত আততায়ীর হস্তে নিহত হইলেন।

    গৃহোপরি ত্রিতলের ছাদে বসিয়াছিল কয়েকটি তরুণীর মিলনসভা। সমবয়স্কা সখীবৃন্দ— আসন্ধিমিত্রা, প্রজ্ঞা, কোকিলা, শ্বেতা, বিশাখা—। তাহাদের কেহ বিবাহিতা, কাহারও বিবাহের আয়োজন হইতেছে, কেহ অদ্যাপি অনূঢ়া। সকলেই রাজকর্মচারীদের কন্যা, নিকটস্থ আবাস হইতে আজ সখী আসন্ধিমিত্রার গৃহে জমায়েত হইয়াছে। এরকম এক-এক সন্ধ্যায় এক-এক জনের গৃহপৃষ্ঠে তাহাদের কলকাকলীর আসর বসিয়া থাকে।

    সখী বিশাখার প্রতি সর্বদাই রুষ্ট থাকে আসন্ধিমিত্রা। মুখে কিছু বলেন না। বহিরঙ্গে সখ্য বজায় থাকে, কিন্তু আসন্ধিমিত্রার অন্তরের তীব্র বিবমিষা দুইজনের মাঝে রচনা করিয়াছে এক অদৃশ্য কিন্তু অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান।

    তাহার এ হেন রাগের কারণ কিন্তু বিশাখার কোনও অবগুণ নয়। আসন্ধিমিত্রার অসন্তোষের কারণ বিশাখার অপ্রাকৃত রূপ।

    বিশাখা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। সুগঠিত তনুর সঙ্গে তার অসাধারণ লাবণ্যময় মুখশ্রী বোধহয় দেবতারও মুণ্ড ঘুরিয়ে দিতে পারে। বিশাখার অতুলনীয় কণ্ঠস্বর, কমলনয়নের বিলোল কটাক্ষ, মুক্তাসারির মত অমল দশনচ্ছটা, তার চম্পাকলির মত আঙ্গুলে অনিন্দিত বীণার তান,— আসন্ধিমিত্রা অবাক হইয়া ভাবে, ঈশ্বর অপ্সরা গড়িতে গিয়া ভ্রান্তিবশতই বুঝি বিশাখাকে মর্তে পাঠাইয়াছেন। আর আকণ্ঠ ঈর্ষায় নীল হইয়া যায়।

    আসন্ধিমিত্রার দেহে যে রূপের প্লাবন আসেনি তাহাতে বিশাখার কোনও দোষ নাই। এ দায় সম্পূর্ণত তাহার পিতার। পিতা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, স্থূলকায় দীর্ঘদেহী। তাঁহার চোখদুটি মুখানুপাতে বড় ও বর্তুলাকার। ঈষৎ বক্রোষ্ঠ, মগ্ন নাসিকা ও দৃঢ় চতুষ্কোণ চিবুক তাঁহাকে পৌরুষ দিয়াছিল, সুপুরুষ করিতে পারেনি। আসন্ধিমিত্রার মাতা অবশ্য রূপবতী ও গৌরাঙ্গী ছিলেন, কিন্তু পিতার রূপের অভাব সম্পূর্ণ নিরাকরণে তাহা যথেষ্ট ছিল না। সেই অপরাধবোধেই হয়ত বালিকাবস্থাতেই কন্যাকে পিতার হস্তে সমর্পণ করিয়া জননী ইহকালের মায়া কাটাইয়াছেন।

    আসন্ধিমিত্রার গাত্রবর্ণ পিতা ও মাতার মধ্যবর্তী— বড়জোর গোধূমবর্ণা বলা চলে তাহাকে। মুখশ্রীতে পিতার অবশ্যম্ভাবী অবদান নারীত্বের প্রভাবে রূপহীনা না করিতে পারিলেও তাহাকে অপরূপাও হইতে দেয়নি। যৌবনাগমণে অবাধ রূপচর্চার দ্বারা সে চলনসই রকম আকর্ষণীয়া হইয়াছিল বটে কিন্তু পুরুষ মুগ্ধকরণ সৌন্দর্য তাহার ছিল না।

    বিশাখার প্রতি ইহাই তাহার উষ্মার কারণ। দুজনাই সমবয়সিনী বাল্যসখী, কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে পদার্পণ করিয়াই আসন্ধিমিত্রা জানিয়াছিল রমণীয় দেহসম্পদে সখী তাহাকে ফেলিয়া অনেকটা আগাইয়া গিয়াছে। স্বর্গলোকের শৃঙ্গারেও এখন সে ব্যবধান মিটিবার নয়।

    আর অন্যান্য সখীরাও তেমনই। সামান্য ছুতায় বিশাখার রূপের প্রশংসা করিয়া অনর্থক আসন্ধিমিত্রার অসূয়ানলে ইন্ধন যোগাইতে ছাড়ে না। সেদিন সন্ধ্যায় নিতান্ত অকারণেই বিশাখার চিবুক ধরিয়া কোকিলা বলিল, আহা মরে যাই। কী রূপ ধরেছ সখী! এবার স্বর্গ থেকে দেবরাজ যদি একবার দেখে ফেলেন, শচীদেবীর কপালে দুঃখ আছে।

    বিশাখা হরষিত পুলকে কোকিলাকে হস্তধৃত পদ্মকলি দিয়া একটা আলতো আঘাত করিয়া সহাস্য আঁখি নত করিয়া নিল। শ্বেতা বলিল, শচীদেবীর চিন্তা ছাড় কোকিলা। নিজের ঘর সামলা। দেবরাজের আগে তোর স্বামীর চোখে পড়লে সে দুঃখ তোর কপালে নেমে আসবে।

    —জানি। তাই তো আঁচলবদ্ধ করে রাখি স্বামীকে। তুই যেন আমার ঘর ভাঙ্গিস না ভাই বিশাখা।

    মুখে কপট আশঙ্কার ভাব ফুটাইয়া বিশাখার চিবুক ধরিয়া নাড়িয়া দেয় কোকিলা। সখীগণ উল্লসিত কলহাস্যে এ ওর পরে গড়াইয়া পড়ে।

    আসন্ধিমিত্রা বালিকাদের লঘু চপলতায় যারপরনাই অসন্তুষ্ট হইতেছিল। তাহার সম্পর্কে কেহ কিছু বলে নাই, কিন্তু বিশাখার সৌন্দর্যের প্রসঙ্গটিই বড় অরুচিকর। রাগতস্বরেই আসন্ধিমত্রা কোকিলাকে ধমক দিল, দেবদেবীদের নিয়ে এ সব কী রঙ্গ হচ্ছে কোকি? চুপ কর তোরা, নইলে ভাল হবে না কিন্তু।

    —তুই কেন রেগে যাচ্ছিস আসন্ধি,— কোকিলা বলে, তোর তো এসব চিন্তা নেই। মাথা থাকলে তবে না মাথাব্যথা।

    ইঙ্গিতটা বড্ড স্থূল। আসন্ধিমিত্রা অনূঢ়া। বক্তব্য হয়ত এইটুকুই। কিন্তু তাহার অনুষঙ্গেই আসে, সে অনূঢ়াবস্থা নিরাকরণের আশু সম্ভাবনাও বিশেষ নাই। কেননা আসন্ধিমিত্রা রূপহীনা।

    সখীগণের মাঝে আসন্ধিমিত্রা হীনমন্যতা আবৃত করে বাক্য দ্বারা। আজও সেই পন্থাই নিল। কোকিলার তির্যক বাক্য তাহার মর্মমূলে গিয়া বিঁধিলেও অধরকোণে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি আনিয়া বলিল, আমার চিন্তায় তোকে অত কাতর না হলেও চলবে কোকি। আমার পিতা আছেন। জেনে রাখিস তিনি সমর্থ রাজপুরুষ, কন্যাকে জলে ফেলে দেবেন না।

    কোকিলা কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হাস্যের বক্র অভিনয় করিয়া বলিল, তা তো বটেই। আমরা সামান্য লোক, তাই পিতা আমাকে জলে ফেলে দিয়েছেন।

    এসব কটাক্ষ গায়ে মাখে না আসন্ধিমিত্রা। তাহার পিতা বরিষ্ঠ সেনানায়কদের মধ্যে একজন, কোকিলার পিতা পদাধিকারে ন্যূনতর। বাক্যে প্রচ্ছন্ন এই কাঁটাটুকু কোকিলার অন্তরে প্রবিষ্ট হইয়াছে দেখিয়া বরং খুশী হইল। এই সুযোগে কোকিলাকে জ্ঞান দিতেও ছাড়িল না আসন্ধিমিত্রা, স্বামী হল দেবতা। যা পেয়েছিস তাই নিয়ে সুখী হ' বুঝলি।

    কোকিলাও পিছু হটিবার পাত্রী নহে। কৃত্রিম উদাস মুখভঙ্গী করিয়া বিচিত্র সুরে বলিল, আমি সুখেই আছি ভাই। কিন্তু তোকেও যে সুখী দেখতে চাই আসন্ধি।

    এই বলিয়া সহাস্যে শ্বেতার অঙ্গে ঢলিয়া পড়ে। আসন্ধিমিত্রা গম্ভীর হইয়া গেল। আবার না ঝগড়া হয়, তাই প্রজ্ঞা তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করিয়া বলিল, পিতা আমার বিয়ে সে—ই দক্ষিণ দেশে স্থির করেছেন। দেখ না ভাই, কত দূরে চলে যেতে হবে।

    বিশাখা অতি নম্র লাজুক, বেশী কথা বলে না। কিন্তু এইবার সুমিষ্ট স্বরে বলিল, তোর ভাবী বর তো মস্ত ব্যবসায়ী। ব্যবসার কাজে উত্তরদেশে এলে তুইও সঙ্গে আসতে পারিস।

    —হ্যাঁ, আর বলবি আমাদের মগধের মত রেশম কোথাও পাবে না,— আসন্ধিমিত্রাকে সালিশি মানিয়া শ্বেতা বলিল, না রে আসন্ধি?

    আসন্ধি তবুও গম্ভীর দেখিয়া কোকিলা এবার বলিল, তুই আমার ওপর রাগ করলি ভাই আসন্ধি? আচ্ছা, এই আমার কান মলে দে, আমার গালে থাপ্পড় মার— বলিতে বলিতে আসন্ধিমিত্রার একটা হাত লইয়া নিজের গণ্ডে চপেটাঘাতের মত করিয়া স্পর্শ করালো। আসন্ধিমিত্রার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটিল, হাত টানিয়া লইয়া কোকিলাকে কপট ধমক দিল, দূর হ' মুখপুড়ী।

    আসন্ধিমিত্রা খুশী হইয়াছে দেখিয়া প্রজ্ঞা সাহস করিয়া বলিল, তোরা আসন্ধির পেছনেই পড়ে আছিস আর এই দেখ, বিশাখারও বিয়ে হচ্ছে না। সেই যে বলে না অতি বড় সুন্দরী না পায় বর— হি হি হি—।

    বিশাখার বিবাহ না হইবার কারণ স্বতন্ত্র। তাহার মাতা মন্দিরের সেবাদাসী ছিলেন, কুমারী কালেই বিশাখা গর্ভে আসিয়াছিল। বিশাখার পিতার লাম্পট্যদোষ থাকিলেও তিনি সজ্জন ব্যক্তি। কানীন কন্যার পিতৃত্ব অস্বীকার করেননি। বিশাখার জননীকে বিবাহ করিয়া সমাজে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন।

    বহু পুরাতন এই পারিবারিক কলঙ্কটুকু উচ্চঘরে বিশাখার বিবাহের কিঞ্চিৎ অন্তরায় হইতেছিল। প্রজ্ঞার কথায় কিছু না বলিয়া মৃদুহাস্যে বিশাখা চোখ নামাইয়া নিল। তাহার আনতনয়ন অনিন্দ্যমূর্তি দেখিয়া বিভেদ ভুলিয়া গেল আসন্ধিমিত্রা। তাহাকে নিবিড় বাহুবন্ধনে লইয়া আসন্ধিমিত্রা বলিল, আমরা রাজার ঘরে যাব, তাই না রে বিশাখা? একটু দেরী তো হবেই।

    সখীরা হইহই করিয়া উঠিল, কে— কে— বল না ভাই কে সে—।

    বিশাখা তাহার রূপ লইয়া ইন্দ্রসভাও আলোকিত করিতে পারে। কিন্তু আসন্ধিমিত্রা! সখীরা সাগ্রহে জানিতে চায়, কোন সে রাজকুমার যে আসন্ধিমিত্রার পাণিপ্রার্থী হইতে আগ্রহী।

    উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে যে শ্লেষের হূলটি প্রচ্ছন্ন ছিল, আসন্ধিমিত্রা তাহা বুঝিতেই পারিল না। অথবা বুঝিলেও গ্রাহ্য করিল না। এক রহস্যময় হাস্যাভাষে সরাসরি উত্তর না দিয়া বলিল, পিতাকে আমি তো বলে দিয়েছি, রাজকুমার ছাড়া বিয়েই করব না।

    পিতা কন্যার জন্য রাজকুমার সন্ধান করিয়া আনিবেন, এইরকম একটা আভাষ পিতার কাছেই পাইয়াছিল আসন্ধিমিত্রা। তাহারই ভরসায় এ কথা ঘোষণা করিয়া ফেলিয়াছে। তারপর মনে হইল, হয়ত না বলিলেই চলিত। সখীদের প্রতিক্রিয়া খুব উগ্র হইয়া উঠিলে অবশ্য পিতার বাক্যই তাহাদের শুনাইয়া দিবে। কিন্তু সে সব করিতে হইল না।

    পরিবর্তে আসন্ধিমিত্রা ও তাহার সখীবৃন্দ একযোগে চমকিত হইল। ভূমস্থ-তল হইতে এক মর্মবিদারী চীৎকার ভাসিয়া আসিয়াছে!

    সখীসঙ্গে ত্বরিতে আলিসায় গিয়া আসন্ধিমিত্রা দেখে, নীচে ভূতলস্থ পিতার নির্বাহকক্ষ হইতে নির্গত রশ্মির দীপ্তি অনাবশ্যক কম্পিত হইতেছে। কক্ষের মধ্যে কিছু একটা ঘটিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই কিন্তু বাহিরে কারোকে দেখা গেল না। আসন্ধিমিত্রা সোপানপথে ধাবিত হইয়া নীচে আসিল। সেখানে কক্ষের দৃশ্য তাহাকে মুহূর্তকাল প্রস্তরে পরিণত করিয়া দিল।

    পিতার দেহ অস্বাভাবিকভাবে ভূমিতে পড়িয়া আছে। উদরে এক গভীর ক্ষত, তাহা হইতে তখনও রুধিরধার বাহির হইতেছে। পিতার মুখ অন্যদিকে ফিরানো, শরীর কাষ্ঠবৎ স্থির।

    কয়েক পলের জন্য আসন্ধিমিত্রার মস্তিষ্ক শূন্য হইয়া গিয়াছিল। তারপরেই 'পিতা—' বলিয়া মৃতদেহের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িল। মুখে হাত বুলাইয়া, নাসারন্ধ্রের সম্মুখে হাত লইয়া দেখিল শ্বাস চলিতেছে না। বক্ষে কর্ণস্থাপন করিয়া হৃৎস্পন্দন শুনিতে পাইল না।

    পিতার মৃত্যু হইয়াছে নিশ্চিত হইলে একটা চাপা শীৎকারসহ দণ্ডায়মান হইতে গিয়া কিসে যেন বাধা পাইল সে। পরক্ষণেই একটা বলিষ্ঠ হাত পিছন হইতে তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। আর এক হাতে কটিবেষ্টন করিয়া কেহ তাহাকে লইয়া গেল কক্ষের আলোকউৎসগুলি হইতে দূর প্রান্তের এক কোণে। অভিধাবক যথেষ্ট শক্তিশালী, আসন্ধিমিত্রা তাহাকে কিছুতেই প্রতিহত করিতে পারিল না।

    সেই আলো-আঁধারিতে গিয়া সে শুনিতে পাইল পিছন হইতে কেহ বলিল, চুপ, কোনও শব্দ করবে না। রুদ্রদেবের রোষে তোমার পিতার মৃত্যু হয়েছে। আমি মগধের রাজকুমার। তোমার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজনে দুটো কথা বলে চলে যাব। তারপর যা করার কোর।

    মুখের হস্তবন্ধন ক্রমে শিথিল হইল। আসন্ধিমিত্রা ত্রাসে নিঃস্পন্দ হইয়া গিয়াছে। কণ্ঠ দিয়া কোনও স্বর নির্গত হইল না। দুই বাহু ধরিয়া আততায়ী তাহাকে সম্মুখে লইয়া আসিল। স্বল্পালোকে আসন্ধিমিত্রা দেখিল একজোড়া পুরু অধরোষ্ঠ। ঈষৎ বঙ্কিম নাসা। তাহার উপর দুটি শান্ত কিন্তু অপার গভীর আঁখিতারা। হিংসার লেশ নাই তাহাতে।

    সুপুরুষ নয়, কিন্তু বড় প্রসন্নময় সুরক্ষার আবেশ। এই মগধের রাজকুমার!

    আসন্ধিমিত্রাকে কিছুই বলিতে হইল না। সহসাই সেই অধরোষ্ঠ নামিয়া আসিল তাহার মুখের উপর। চুম্বনাবদ্ধ হইয়া কথা বলিবার উপায় রহিল না। সে দীর্ঘ চুম্বনের যেন শেষ নাই। আসন্ধিমিত্রার শ্বাসরোধ হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু কী এক সুখাভাষে সে মুক্তি পাইতে চাহিল না। বরং শিথিল দেহে কোমল বক্ষ নিষ্পিষ্ট করিয়া দুই হাতে সেই পুরুষ দেহটাকে গাঢ় আলিঙ্গনে জড়াইয়া ধরিল। মনে হইল এত সুখেই যদি মৃত্যু আসে, তবে তাহাই হউক।

    চুম্বন সমাপ্ত করিয়া ধীর প্লুতস্বরে কুমার বলিলেন, তোমার পিতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমাকে বিবাহ করব। সে দায়িত্ব পালন করে গেলাম।

    এই বলিয়া কুমার ত্বরিতে একটি ক্ষুদ্র শঙ্কুলার ধারে নিজের অঙ্গুষ্ঠ চিরিয়া আসন্ধিমিত্রার সীমন্তে শোণিতচিহ্ন অঙ্কিত করিলেন। তারপর বলিলেন, আমি মৌর্যসম্রাট বিন্দুসারপুত্র প্রিয়দর্শন— ইন্দ্র, বরুণ ও রুদ্রদেবকে সাক্ষী রেখে তোমাকে পত্নীরূপে স্বীকার করলাম। আজ থেকে তুমি আমার বিবাহিতা মহিষী। আর কোনও পুরুষে আসক্ত হবে না। আমার জন্য প্রতীক্ষা করে থেকো। যথাসময়ে আমি আসব তোমাকে নিয়ে যেতে।

    তারপর এক ঝটকায় আসন্ধিমিত্রাকে একটু দূরে সরাইয়া নিমেষে সেই মূর্তি দ্বারপথে অদৃশ্য হইল। আসন্ধিমিত্রা কোনমতে কক্ষপরিধিতে পৃষ্ঠ দিয়া থরথর করিয়া কম্পিত হইতে লাগিল।

    ক্ষণপরে অনেক সেবক-ভৃত্যের আগমনে কক্ষ পূর্ণ হইল। এতক্ষণ কেহ ভিতরে আসিতে পারেনি। মুখ্যদ্বারে কয়েকজন অপরিচিত রক্ষী সকলকে প্রতিহত করিয়া রাখিয়াছিল। হঠাৎ দ্বার ছাড়িয়া তাহারা বিদ্যুৎগতিতে অদৃশ্য হইয়াছে।

    প্রজ্জ্বলিত দীপমল্লী ও পীতচম্পকের উজ্জ্বল আলোয় গৃহকর্তার শব দেখিয়া হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। উচ্চ আর্তরবে কক্ষ পূর্ণ হইল। সখীবৃন্দ শঙ্কা ও ত্রাসে সক্রন্দনে আপন আপন গৃহে পলায়ন করিল।

    আসন্ধিমিত্রা একই ভাবে দাঁড়াইয়াছিল। অভিভাবকস্থানীয় জনাকয়েক গৃহরক্ষক তাহার কাছে আসিয়া জানিতে চাহিল, এ কীভাবে হইল। সে কিছু দেখিয়াছে কিনা।

    আসন্ধিমিত্রার চক্ষের জল শুষ্কপ্রায়। শরীরে সকল শক্তি যেন নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। স্থির শূন্যদৃষ্টিতে কুড্যের দিকে সে চাহিয়া ছিল। তাহার বস্ত্রের আপাদমস্তক রক্তরঞ্জিত। সীমন্তের রুধির-চিহ্ন পৃথক ভাবে কাহারো দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না। আসন্ধিমিত্রা কোন বিলাপ করিল না। শুষ্কস্বরে শুধু বলিল, আমি কারোকে দেখতে পাইনি। কিছুই জানতে পারিনি। তোমরা পিতার অন্তিম সৎকারের আয়োজন কর।

    আসন্ধিমিত্রা নিজেও জানিত না মানসিক ভাবে কোথায় সঞ্চিত ছিল এই শক্তি। পিতার রক্তাক্ত পরিণতির চিত্র প্রবল অভিঘাতে ক্ষণিকের জন্য তাহাকে মূহ্যমান করিয়াছিল, কিন্তু দেখা গেল তাহার মস্তিষ্কের চালিকাশক্তি হইয়া আর একজন তাহার পথনির্দেশ করিতেছে। প্রিয়দর্শন! সদ্য পিতৃহারা কন্যার হৃদয়তন্ত্রীতে বারংবার একটিই নাম তখন গুঞ্জরিত হচ্ছে। প্রিয়দর্শন! প্রিয়দর্শন!

    আসন্ধিমিত্রা প্রসাধনীতে গিয়া রক্তাক্ত বস্ত্রগুলি খুলিয়া ফেলিল। পিতৃরক্তে রঞ্জিত বস্ত্র। শুধু সীমন্তের অরুণাভা তাহার পিতার রক্তে নয়। দর্পণের প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখিল সে। আসন্ধিমিত্রা অসুন্দর, কিন্তু সোহাগসিন্দুর বুঝি রূপহীনাকেও রমণীয় করিয়া দেয়। বারিসিঞ্চনে অঙ্গের রক্তচিহ্নগুলি ধুইয়া মুছিয়া নিল আসন্ধিমিত্রা। তারপর পুনরায় দর্পণে নিজেকে দেখিল।

    অঙ্গের সাথে সীমন্তের রক্তরাগও নিশ্চিহ্ন হইয়াছে। কিন্তু একটি রক্তাক্ত অঙ্গুষ্ঠের অনুভব মুছিয়া যায় নাই। অধরোষ্ঠেও লাগিয়া আছে সিক্ত প্রণয়চিহ্ন। দর্পণের পিছন দিকে যেন দু'টি সুগভীর চক্ষু তিরস্কারের ভ্রূকুটি লইয়া তাহাকে দেখিতেছে। সে চোখের দৃষ্টি ভুল হইবার নয়। সেই বক্র নাসা, সেই পুরুষ্ট অধরোষ্ঠ। প্রিয়দর্শন! না, তুমি মোটেই সুশ্রী নও কুমার। তবু তুমি প্রিয়দর্শন। তুমি আসন্ধিমিত্রার প্রিয়দর্শন।

    আপন কক্ষে গিয়া আসন্ধিমিত্রা স্ফটিকের কুঙ্কুম-কোষটি নামাইল। বিবাহিতা রমণীর শূন্য সীমন্ত ভালো দেখায় না।

    ইতিহাসের সাক্ষ্য, মৌর্য সম্রাট বিন্দুসারের দেহাবসানের চতুর্বর্ষ পর অশোকের অভিষেক। সম্রাট বিন্দুসার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী চয়ন করিয়া যাননি। সেক্ষেত্রে সর্বার্থেই তাঁহার অগ্রমহিষীর পুত্র সুসীম সিংহাসনে বসিবার কথা। অশোক বিন্দুসারের কোনও অখ্যাত রানির সুপুত্র। মাতৃকুলে ছিল না রাজরক্তের কৌলীন্য। কোনও মতেই তিনি হইতে পারেন না পিতার রাজ্যের নৈসর্গিক দাবীদার।

    অথচ চার বৎসর পরে অভিষেক হইয়াছে অশোকের। সুসীম নহে।

    হিংসা, বিদ্বেষের কূটনৈতিক দ্যূতক্রীড়ায় কী উত্থানপতন হইয়াছিল ঐ চার বৎসরে, জানা যায় না। ইতিহাস ঐ কালের ঘটনাপঞ্জীর কোনও বিশ্বস্ত বয়ান সঞ্চয় করিয়া রাখে নাই। হিরণ্ময় নৈঃশব্দে মূক হইয়া আছে মহাকালখণ্ডটি। দুইপ্রান্তের আলোকিত সূত্রগুলির ঐতিহাসিক গ্রন্থিটি অদৃশ্য হইয়াছে এক অপার্থিব অন্ধকারে।

    তাই কিছু অনুমান, কিছু কল্পনা। অবশ্যই কিছু রহস্য আছে ঐ চার বৎসরের ক্রান্তিকালে। ঠিক কী হইয়াছিল, তাহা এখন গবেষণার বিষয়। এ ক্ষুদ্র আখ্যায়িকার পরিসর সে গবেষণার স্থান নহে।

    বর্তমান কাহিনীর প্রয়োজনে আমরা পার হইয়া যাইব অভিষেক উপরান্ত সাতটি বৎসর। এই সপ্তবর্ষের অন্তরালে সম্রাটের সে 'দুরন্ত' ভাবমূর্তি আর নাই। মগধনরেশের অন্তরে আসিয়াছে বুদ্ধানুরাগ। অহিংসার আলোকে আলোকিত এক নূতন পথের পথিক অতীতের চণ্ড-নায়ক।—

    সম্রাটের রাজ্যাঙ্কের অষ্টম বর্ষের মধ্যবর্তী এক সন্ধ্যায় পট্টমহিষী আসিয়া গলবস্ত্রে মহারাজের চরণধূলি নিলেন। সম্রাট তাড়াতাড়ি তাঁহাকে তুলিয়া ধরিয়া প্রশ্ন করিলেন, আজ হঠাৎ প্রণামের ঘটা কেন দেবী?

    মহারানির মুখে লজ্জারুণ হাসি। মনে মনেই বলিলেন, তুমি আজও জানো না রাজা, যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি, সেদিন থেকেই আমি তোমার পূজা করি।

    প্রকাশ্যে মহারানি বলিলেন, সান্ধ্য পূজার অন্তে আমি আমার দেবতাকে রোজ প্রণাম করি স্বামী। এ সময়ে আপনাকে তো পাই না। তাই আপনি জানেন না। আজ দাসীর ভাগ্যোদয়, আপনি সময়ের আগেই ফিরে এসেছেন। সেজন্য জানতে পারলেন।

    সত্য বটে, অন্য দিন এসময়ে মহারাজ ভিক্ষু পরাকৃতের আশ্রম পরিদর্শন করেন। ব্রহ্মণ্যধর্মের অপশাসনে পূর্বেই সম্রাট ছিলেন বিরক্ত। বুদ্ধের অনুশাসনে এখন পেয়েছেন নূতন পথের সন্ধান। ধ্যানময় শান্তির পথে মিলেছে অনেক শঙ্কার উত্তর।

    বর্তমানে ভিক্ষু পরাকৃত তাঁহার ধর্মপথের মার্গদর্শক। নিয়মিত তাঁহার কাছে বুদ্ধকথা শুনিতে বড় ভালো লাগে। আজ কোনও কারণে ধর্মপ্রসঙ্গে একাগ্র হইতে পারিতেছিলেন না সম্রাট। তাই ভিক্ষুকে বিদায় জানাইয়া কিছু পূর্বেই প্রাসাদে ফিরিয়াছেন।

    মহারানিকে আজ যেন প্রসন্ন দেখাইতেছে। পত্নীসহ ঝুলনায় উপবেশন করিয়া সম্রাট বলিলেন, আজ আর বুদ্ধকথা নয়। কিন্তু আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছি মহারানি।

    —কেন মহারাজ! আপনার সেবায় কোনও ত্রুটি হল?— মহারানির কণ্ঠে আশঙ্কা ফুটিয়া উঠিল।

    —না না, তা নয়।

    —আমার নিষ্ঠায় কি কোনও শিথিলতা দেখলেন দেব?

    —কিছুমাত্র না।

    —তবে কি আমার অন্য কোনও অপরাধ হল?

    —সেসব কিছুই নয়। কিন্তু কিছুদিন হল মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কিছু বলতে গিয়েও বলছ না। তুমি আমার কাছে কি কিছু গোপন করছ রানি?

    লজ্জানত চক্ষে মহারানি বলিলেন, আপনার কাছে আমার গোপনীয় কিছুই নেই মহারাজ। কিন্তু এতদিন ভেবে এসেছি, স্ত্রীরূপে আমি বোধহয় আপনার যোগ্য হতে আর পারলাম না।

    মহারানি যাহা বলিতে চাহিলেন, তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। পট্টমহাদেবী আজও নিঃসন্তান। তাঁহার এ মর্মব্যথা সম্রাটের অবিদিত নহে। পত্নীকে সান্ত্বনা দিতেই সম্রাট বলিলেন, সুযোগ্য মৌর্যঘরণীরূপে তুমি অসামান্যা হে মহিষী। আমিই বরং তোমার কাছে অপরাধী। তাই বোধহয়—

    —ওকথা বলবেন না মহারাজ, মহারানি সশঙ্কে সম্রাটের মুখে হাত চাপা দিয়া বলিলেন, তাতে যে আমার পাপ হবে। ও আমার ত্রুটি দেব, আমারই নারীত্বের অক্ষমতা। আপনি কেন তার জন্য দায়ী হবেন? আপনার চরণতলে আশ্রয় পেয়ে অভাগী ধন্য হয়েছে।

    —এ তোমার অন্তরের কথা মহিষী? সত্য বলবে, যেদিন তোমার পিতার গৃহ থেকে তোমাকে অর্জন করি, সেদিন আমাকে মার্জনা করেছিলে কি?

    মহারানি কিছু বলিবার পূর্বেই কিন্তু রাজকীয় বিশ্রম্ভালাপে বাধা পড়িল। কনিষ্ঠ অমাত্যদের একজন আসিয়া মহারাজের দর্শন প্রার্থনা করিয়াছে।

    এ সম্রাটেরই আদিষ্ট নিয়ম। রাজ্যের প্রয়োজনীয় সংবাদ সম্রাটকে যে কোনও সময়ে দেওয়া চলিবে। সে তিনি অশনে, বসনে, আহারে, বিহারে, প্রসাধনে, বিশ্রম্ভালাপে কিংবা অন্দরমহলে— যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন। এমনকি বার্তার গুরুত্ব অনুসারে নিদ্রোত্থিত করিয়াও তাহা জ্ঞাপন করিবার নির্দেশ দিয়াছেন তিনি।

    অমাত্যটি জানাইল, আগামী কালকের রাজসভায় কোনও এক বিশেষ কার্যক্রম আলোচনার জন্য আনীত হইয়াছে। সম্রাটের সম্মতির নিমিত্ত প্রস্তাবটি লইয়া মহামাত্য প্রতীক্ষা করিতেছেন।

    দাম্পত্যবিলাস স্থগিদ রাখিতে হইল। সম্রাট আসন পরিত্যাগপূর্বক প্রস্থানোদ্যত হইয়া মহারানির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, রাত্রে তোমার উত্তর শুনব প্রিয়ে। এখন আজ্ঞা দাও।

    মহারানি কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ কণ্ঠে বলিলেন, আজ্ঞা দিলাম।

    মহারাজ সুস্মিতমুখে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার গমনপথের দিকে চাহিয়া একটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অস্ফুটস্বরে সম্রাজ্ঞী স্বগতোক্তি করিলেন, সেইদিনই তোমাকে মার্জনা করেছি প্রিয়দর্শন। এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই।

    সে দিনটি ছিল মগধের রাজনৈতিক ভাগ্যনির্ণয়ের ক্ষণ। রাজপুরুষদের মতদানের কূটপ্রক্রিয়ায় জড়িত সিংহাসনের ভবিষ্যৎ। সেদিন মঞ্চের আলোকবৃত্তে ছিল পরবর্তী শাসনতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষার আয়োজন। আর যবনিকার অন্তরালে সূচিত হইয়াছিল এক নিবিড় সখ্যের। সম্রাটের সঙ্গে বর্তমান পট্টমহাদেবীর প্রথম সাক্ষাৎ সেইদিন। সে সাক্ষাতের পটভূমিকায় ছিল বিশ্বাসঘাত ও প্রবঞ্চনা। অন্ত্যে তার শোণিতলাঞ্ছন।

    রক্তাক্ত বিভীষিকার মাঝে একদিন যে পরিচিতির সূচনা হইয়াছিল, আজ তাহার মর্যাদিত উত্তরণ ঘটিয়াছে রাজকীয় দাম্পত্যে। তিক্ততার অবসান হইয়াছে। পারস্পরিক দ্বৈধ ও অবিশ্বাসের জের আর নাই। পট্টমহাদেবী এখন শুধু সম্রাটের রাজস্বত্ত্বার অঙ্গাঙ্গী অংশই নহেন, রাজপুরীতে তিনিই তাঁহার প্রকৃত বন্ধু।

    জাম্ভবকন্যা আসন্ধিমিত্রা।

    সম্রাট সেই যে গেলেন, রাত্রে আর শয়নকক্ষে আসেননি। শুধু সে রাত্রিই নহে, তাহার পরবর্তী সপ্তাহকাল আর সম্রাটের দর্শন মিলিল না। মহারানি সংবাদ পাইয়াছেন, সম্রাট কোনও বিশিষ্ট রাজকার্যে নিরত আছেন। তেমন বিশেষ কোনও প্রয়োজন পড়িলে সম্রাটের অন্দরমহলে আসিবার সময় থাকে না।

    একাকী শয়নকক্ষে মহাদেবী গবাক্ষপথে আকাশের নক্ষত্র দেখিতেছিলেন। বোধহয় পুরাতন স্মৃতিতেই নিমজ্জিত ছিলেন। অতীতের সেই দিনটি বড় আকস্মিক আঘাতে আসন্ধিমিত্রাকে সঙ্কীর্ণ পরশ্রীকাতরতা ও অসূয়ার প্রকোপ হইতে মুক্ত করিয়া পরিপূর্ণ নারীত্বের সোপানে উত্তীর্ণ করিয়াছিল। বীভৎস অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত শোকের মূল্যে আসে এক অকল্পনীয় চরিতার্থতা।

    পিতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কন্যাকে পর্যাপ্ত সাহচর্য দিতে অক্ষম। বৈভবের অভাব ছিল না, কিন্তু ছিল না নারীজীবনের সঠিক পথনির্দেশ। মাতৃহারা কন্যা পিতৃগৃহেও ছিলেন অতিথির মত। সেদিন যেন দিগ্‌ভ্রষ্ট নাবিক পাইয়াছিল সহসা মেঘমুক্ত ধ্রুবতারার প্রকাশ। যে কল্পপুরুষের আশ্বাসে আসন্ধিমিত্রা নিজেকে প্রবোধ দিত, তাঁহারই দেখা মিলিয়াছিল। সদ্য পিতৃহন্তাকে স্বামীরূপে স্বীকার করিতে কোনও দ্বিধা হয়নি।

    সামান্য শব্দে চমক ভাঙ্গিল মহাদেবীর। দেখেন অবশেষে মহারাজ আসিয়াছেন। কক্ষের দ্বার বন্ধ করিয়া অর্গলিত করিতেছেন।

    রাত্রি অনেক হইয়াছে। মহাদেবীর পরনে শয়নের বেশ। কঞ্চুলী খুলিয়া রাখিয়াছিলেন। মহারাজ আকস্মিক আবির্ভাবে সামান্য বক্ষবন্ধনীও বাঁধিয়া লইবার সময় দিলেন না। ত্বরিতে নিকটস্থ একটি স্বচ্ছপ্রায় সুতীবস্ত্রে ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত করিয়া মহারাজের দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইলেন আসন্ধিমিত্রা।

    নিকটে আসিয়া মহারানির কর্ণসমীপে মুখ লইয়া সম্রাট বলিলেন, মহারানি কি রুষ্ট?

    সপ্তদিবস প্রিয়তমের দেখা না পাইলে যে কোনও প্রেয়সী রুষ্ট হইতে পারেন। কিন্তু আসন্ধিমিত্রা মহারাজকে দোষারোপ করিয়া কটুভাষণের কল্পনাও করেন না। তবে তাঁহার বুকে যথেষ্ট অভিমান জমা হইয়াছিল। সাত দিন ধরিয়া যে তাঁহাদের কথোপকথন অসম্পূর্ণ আছে, তাহা কি মহারাজ জানেন না?

    সম্রাটের স্কন্ধে মস্তক হেলাইয়া ঈষৎ ক্ষিন্ন স্বরেই তিনি বলিলেন, অবশেষে অভাগীর কথা মনে পড়ল স্বামী?

    মহারাজ জানিতেন তিনি প্রেমময়ী পত্নীর প্রতি সুবিচার করেননি। তাই প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছিলেন। কণ্ঠে উদ্বেগ ফুটাইয়া বলিলেন, একটা বড় গুরুত্বপূর্ণ কর্মানুবন্ধ ছিল। কিন্তু মনে মনে সর্বদা আমি মহাদেবীর সঙ্গেই ছিলাম।

    আসন্ধিমিত্রার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তিনি কপট অভিমানের সুরে বলিলেন, আমার সঙ্গে না ছাই। আমি জানি রাজকার্য আপনার প্রিয়তর। আর আমি তো রূপহীনা।

    সম্রাট মহাদেবীর চিবুকে হাত দিয়া তাঁহার মুখমণ্ডল উত্তোলিত করিতে গেলে সলাজ মন্দহাসে আসন্ধিমিত্রার নয়ন অবনত হইল। সম্রাট বলিলেন, অয়ি অপরূপা, তোমার দর্পণ মিথ্যাবাদী। মগধসম্রাজ্ঞীকে সে বলে কিনা রূপহীনা!

    আসন্ধিমিত্রার হৃদয়ে প্রবল হর্ষোচ্ছ্বাস। নারী তার দয়িতের মুখে এমন অসত্য বোধহয় বারংবার শুনিতে চাহে। তিনি কুৎসিত অবশ্যই নন। যৌবনের মধ্যগগনে আসিয়া মহাদেবী এখন এক অভিজাত স্বাতন্ত্রে অতীব আকর্ষণীয়া। তবু তাঁহাকে অনুপমা সুন্দরী বলা চলে না। তাই তাঁহার কণ্ঠে দ্বিধান্বিত অভিমান, কী জানি? আপনি তো কখনও বলেন না। তাই ভয়ে থাকি, সামান্য রমণীকে মগধেশ্বর হয়ত ভুলেই যাবেন।

    সম্রাট দুই হস্তে মহারানির বাহু ধারণ করিয়া গাঢ়স্বরে বলিলেন, তুমি অতুলনীয়া আসন্ধি।

    —আমার অহোভাগ্য। দাসীর কথা মহারাজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হননি তাহলে।

    আসন্ধিমিত্রার কণ্ঠের প্রগলভতার স্পর্শটুকু মহারাজের কর্ণে বড় মধুর লাগিল। ইতিমধ্যে তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে মহারানির স্বল্পবাস লজ্জাবরণের প্রচেষ্টা। পিছন হইতে আবেষ্টনপূর্বক মহারানির স্কন্ধোপরি চিবুক স্থাপন করিয়া ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যে বলিলেন, ভুলে যাব? তোমার বক্ষের পদ্মকোরকদুটির স্মৃতি ভুলতে দেবে কি?

    —মহারাজ, আপনি বড় দুষ্ট।

    —তুমি যতটা ভাবছ, আমি কিন্তু তার চেয়েও বেশী দুষ্ট। তাই এই সামান্য বস্ত্রখানি সরিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে।

    সম্রাট পত্নীর লজ্জাবরণী উত্তরীয় ধরিয়া আকর্ষণ করিলেন। মহারানি কপট ত্রাসে মহারাজের হস্তধারণ করিয়া বলিলেন, না না, এ আপনি কী করছেন মহারাজ?

    —এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে বস্ত্রের ব্যবধান কি এতই বাঞ্ছনীয় প্রিয়ে?

    —অবশ্যই। কক্ষের প্রদীপ এখনও প্রোজ্জ্বল দেব। কেউ দেখতে পাবে।

    —রুদ্ধদ্বার কক্ষে তা সম্ভব নয় রানি। আর দেখলেই বা। বৈধ স্ত্রীতে উপগত হওয়া অপরাধ নয়।

    মহারাজ সবলে আসন্ধিমিত্রার বক্ষাবরণীটি সরিয়ে দিলেন। ত্বরিতে লজ্জানিবারণ প্রয়াসে দুই হাতে বক্ষাবরণ করিয়াও প্রবল সুখের আস্যে মুদ্রিত চক্ষে মহারানি বলিলেন, করেন কী মগধনরেশ, সংযত হোন।

    —মগধনরেশের একটি উত্তরাধিকারী চাই। এখন আমাকে সংযত হতে বোল না রানি।

    মহারানির হস্ত শিথিল হইয়া উদ্ধতকোমল বক্ষস্থল উন্মুক্ত করিয়া দিল। মহারাজ সাগ্রহে সে অঞ্চলের কর্তৃত্ব গ্রহণ করিলেন। মহারানি বাধা দিলেন না। স্খলিতস্বরে শুধু বলিলেন, আপনার উত্তরপুরুষ তো উজ্জয়িনীতে আছে মহারাজ।

    —জানি। আমার সে আত্মজ মৌর্য সিংহাসনের অভিলাষী নয়। মগধরাজের প্রতিভূ নয় সে। আমি কুণালকে চাই মহারানি।

    ক্ষণকাল নীরব রহিলেন মহারানি। সপ্তাহকাল পূর্বেই যে সে কথা বলিবার ছিল। সর্বান্তঃকরণে সম্রাটকে তিনি দেহমন সমর্পণ করিয়াছিলেন, তাঁহার সে নিষ্ঠা কৃত্রিম নহে। বিলম্বে হইলেও বিধাতা অবশেষে তাহার স্বীকৃতি দিয়াছেন।

    —সেও এবার আসছে স্বামী।

    মহারাজ এরকম কোনও প্রত্যুত্তরের আশা করেননি। ঈষৎ বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, মানে? কোথায় সে?

    ধীরভাবে মহারাজের দক্ষিণ হস্তটি আপন অনতিস্ফীত বক্ষোপরি স্থাপন করিয়া আসন্ধিমিত্রা অস্ফুটে উচ্চারণ করিলেন, এইখানে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments