‘এটা আবার কি ব্যাপার?’ একটু কৌতুহলী হয়ে সুদীপ্ত লেখার টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসল। আর বসতে না বসতেই ল্যাপটপ থেকে একটা যান্ত্রিক স্বর ভেসে এল। ‘গুড ইভনিং মিস্টার ব্যানার্জি! দিস ইস সাইরাস। ইয়োর পারসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট!’ সুদীপ্ত বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ‘আরে! এ আবার কি? আমার নাম জানল কি করে? আর পারসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট –টাই বা কি? এটা কি সেই অ্যাপেল-এর সিরি-র মত কিছু? কিন্তু তার ল্যাপটপে তো সেরকম কিছু ছিল বলে জানতো না। সুচেতনাও কিছু বলে নি কোনদিন।’ কম্প্যুটার মনিটরে সবুজ রঙের জ্বলতে নিবতে থাকা চাকতিটাকে সুদীপ্ত আগে কোনদিন দেখেছে বলেও মনে পড়ল না! সন্ধ্যেবেলা যখন বন্ধুদের সঙ্গে ভার্চুয়াল আড্ডায় ব্যস্ত ছিল তখনো কিছু চোখে পড়ে নি।
এই দ্বি-সাপ্তাহিক ভার্চুয়াল আড্ডাটা সুদীপ্তর এখন প্রায় অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। গত চার বছর ধরে এক নাগাড়ে একটার পর একটা ভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব বিধ্বস্ত হবার পর, সবে মাস ছয়েক সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলেছে। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরী একটি ভ্যাকসিনে সাড়া দিয়ে বিশ্ববাসী ভাইরাসের আক্রমণ রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে! কিন্তু সেই যে গত চারটে বছর দফায় দফায় লকডাউনের ফলে, সুদীপ্তর মত আরো অনেকে ভার্চুয়াল আড্ডায় মজেছে, সে অভ্যেস এখন প্রায় প্রয়োজনীয় মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতি দু-সপ্তাহ অন্তর দেশের আর বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গে একটা সন্ধ্যে ভার্চুয়াল আড্ডা। বদ রসিকতা, মুখ খিস্তি ইত্যাদি করে, নাগরিক ক্লান্তি দূর করার একটা চেষ্টা আরকি! আজকের আড্ডায় নানান কথা বলতে বলতে, কথা উঠেছিল কম্প্যুটার সিকিউরিটি নিয়ে। আজকাল এই যে নিত্যনতুন ম্যাল-ওয়্যার, ফিশিং, স্প্যামিং ইত্যাদি উটকো ঝামেলায় সাধারণ কম্প্যুটার ব্যবহারকারীরা বিধধস্ত সেসব থেকে এক ধাক্কায় মুক্তি পাওয়ার মত কোন সফট্ওয়্যার কেউ তৈরী করতে পারবে কি না। এই নিয়ে হইহই তর্ক। সুদীপ্তর এক বন্ধু অকিঞ্চন ভারতের একটি নামী ইন্স্টিটিউটের কম্প্যুটার সায়েন্সের অধ্যাপক। সে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল যে এই ধরনের সফট্ওয়্যার প্যানাসিয়া বা সর্বরোগহর দাওয়াই তৈরী সম্ভব নয় কারণ কম্প্যুটারের বিভিন্ন ধরণের দুর্বলতাকে লক্ষ করে তৈরী হয় এই সব ম্যালওয়্যার। সুতরাং সব ধরনের ভাইরাসের যেমন একটি ভ্যাকসিন সম্ভব নয়, সব রকম ম্যালওয়্যারেরও প্রতিশেধক এক হবে না। সেই নিয়ে একেবারে হইহই লেগে গেল! আজকের আড্ডা আসলে হওয়ার কথা ছিল এখনকার বাংলা কবিতা নিয়ে। তার বদলে এই সব যান্ত্রিক কিচিরমিচির শুনে সুদীপ্তর মেজাজটাই বিগড়ে গেল! ‘দূর, শালা! এখানেও সেই ভাইরাস আর তার থেকে মুক্তির ভ্যাজভ্যাজানি।‘ সুদীপ্ত এইসব প্রযুক্তির কচকচানি থেকে দূরে থাকে। নেহাত কম্প্যুটার ছাড়া আজকাল চলে না, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা ল্যাপটপ কোন রকমে কিনে ব্যবহার করতে শিখে নিয়েছে। তবে ভার্চুয়াল আড্ডাটা নিঃসন্দেহে একটা উপরি লাভ সেটা সুদীপ্ত মানে।
সুদীপ্ত কলকাতার কাছাকাছি একটি মফঃস্বলের কলেজে ইতিহাস পড়ায়। আর অবসর সময়ে একটু আধটু সাহিত্যচর্চা, তা সে প্রায় কলেজ জীবন থেকেই চলে আসছে। একা মানুষ, ঝাড়া হাত-পা। বন্ধু-বান্ধব নিয়েই থাকে। বান্ধবী আছে, সুচেতনা। রাত একটু বেশি হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও মনটা একটু প্রফুল্ল করার আশায় সুদীপ্ত সুচেতনাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল। ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো গলা ভেসে এল,
- ‘কি ব্যাপার! আজ তোমাদের ভার্চুয়াল আড্ডা ছিল না? এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেল!’
-‘আরে দূর! ঐ শালারা খালি কম্প্যুটারের কচকচি করে গেল। রোগের ভাইরাসের ঝক্কি গেল তো এখন বাবুরা হঠাৎ কম্প্যুটারের ভাইরাস নিয়ে পড়লেন! যেন তাতেই বিশ্ব-ব্রম্ভান্ড রসাতলে যাবে!’
-‘তুমি না মাথা ঘামালেও, সারা দুনিয়া তো কম্প্যুটার আর ইন্টারনেটের দৌলতে চলছে। সুতরাং মাথা ঘামানো স্বাভাবিক। আজকেই আমাদের অফিসে একটা মেমো এসেছে যে, মধ্য-এশিয়ার একটি হ্যাকারের দল নাকি কী একটা ভাইরাস বার করেছে যেটা তোমার হোম নেটওয়ার্কে ঢুকলে সমস্ত স্মার্ট ডিভাইসের ওপর কর্ত্রিত্ব করতে শুরু করবে। তোমার ফ্রিজ থেকে এন্তার আবোলতাবোল খাবারের অর্ডার পাঠাবে সুপার মার্কেটে। তোমার বাড়ীর টেম্পারেচর বাড়িয়ে দেবে, তোমার সিকিউরিটি সিস্টেম থেকে ফল্স্ অ্যালার্ম পাঠাবে। সে একেবারে হুলুস্থুল ব্যাপার করতে পারে! তার আবার নাম নাকি ‘হোম সাওয়ার হোম’! সুতরাং, ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার মত একেবারেই না’
সুদীপ্ত চুপ। তার বাড়ীতে ওসব স্মার্ট ডিভাইস-টাইস একেবারেই নেই। সে মান্ধাতার আমলের ফোন ব্যবহার করে। পাতি দম দেওয়া ঘড়ি। এবং ফ্রিজও সেই আদ্দিকালের, স্মার্টনেসের নাম-গন্ধ নেই। সত্যি কথা বলতে, নেহাত একটা কম্প্যুটার না হলে ভার্চুয়াল ক্লাসগুলো পড়ানো সম্ভব ছিল না বলে বাধ্য হয়েই লক-ডাউনের বাজারে একটা ল্যাপটপ কিনে ছিল। সেটাও সুচেতনা অন-লাইনে অর্ডার দিয়ে কিনে নিজে সেটা পুরো ঠিকঠাক করে সুদীপ্তর হাতে দিয়েছিল। না হলে সেটুকুও হোত না। ভেবেছিল বান্ধবীর সঙ্গে একটু প্রেমালাপ জমাবে! কোথায় কি? এও তো কম্প্যুটার নিয়ে পড়েছে। রকম দেখে সুদীপ্ত বলল, ‘তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে বেশ ঘুম পেয়েছে। তুমি শুয়ে পড়। কালকে বিকেলে আমাদের ইউসুয়াল ঠেক-এ মিট করছি তো?’
-‘হ্যাঁ। ঠিক কাছে। কাল কথা হবে। আজ সত্যিই খুব টায়ার্ড লাগছে। গুড নাইট!’
আর ফোন রেখে শুতে যাবার সময়ই কম্প্যুটর মনিটরে ঐ সবুজ জ্বলন্ত চাকতিটা চোখে পড়ল।
যান্ত্রিক স্বর আবার কথা কয়ে উঠল। এবার বাংলায়!! ‘আপনার কিছু প্রশ্ন থাকলে, প্রশ্নটা মুখে বলে স্ক্রিনের ওপর এই সবুজ গোলকটার ওপর ক্লিক করুন আর উত্তর জেনে যান!’ সুদীপ্ত ভাবল ‘ভারি মজা তো!’ কিছুটা ঝোঁকের বসেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি বিশেষ ঘটনার সাল তারিখ জিজ্ঞেস করে সুদীপ্ত ঐ সবুজ বলটার ওপর ক্লিক করে ফেলল। উত্তরও পেলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এবং বলা বাহুল্য সঠিক উত্তর। আর সেই সঙ্গে উপরি হিসেবে পেল একটা মৃদু তরঙ্গের মত ঝাঁকানি। যেটা সুদীপ্তর আঙুল ছুঁয়ে গেল যেন! হঠাৎ এই অনুভূতিটায় সুদীপ্ত ঘাবড়ে মাউস থেকে হাত সরানোর কথা ভুলে গেছিল! সম্বিত ফিরে পেয়ে সচমকে মাউস থেকে হাত সরিয়ে নিল সুদীপ্ত! তাহলে কি শর্ট-সার্কিট হয়ে গেল নাকি? সুদীপ্ত তাড়াতাড়ি কম্প্যুটারটা সুইচ-অফ করে দিল।
পরের দিন কফি শপে সুচেতনার সঙ্গে নানান কথা বলতে বলতে গত রাতের ঐ সবুজ গোলকের কথা সুদীপ্ত প্রায় ভুলে গেছিল! হঠাৎ মনে পড়ল- ‘তুমি কি আমার কম্প্যুটারে কোন পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট জাতীয় কিছু ইন্সটল করেছিলে?’
-‘না তো! কেন?’
সুদীপ্তর কাছে সংক্ষেপে সব শুনে সুচেতনা বলল যে ওদের অফিসের কম্প্যুটার এঞ্জিনিয়ার বিশ্বকর্মাকে দিয়ে ল্যাপটপটা দেখিয়ে নেবে। ইতিমধ্যে একটা অ্যান্টি ভাইরাস আপডেট করে দেবে ও, যাতে কোন ভাইরাস না ক্ষতি করে। সুদীপ্তর একবার কলেজ স্ট্রীট যাওয়ার ছিল, তাই বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডাটা একটু তাড়াতাড়িই শেষ করতে হল আজ।
সন্ধ্যের ব্যস্ত কলেজ স্ট্রীটে এলেই সুদীপ্তর মন ভাল হয়ে যায়! আজকাল আর কফি হাউসে বসা হয় না। গত কয়েক বছরের লক-ডাউনের পর শহরবাসী এখনো গা ঠেসাঠেসি আড্ডায় ফিরে আসতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। তবে দোকান-পাট আবার আগের মতই জমজমাট! সুদীপ্ত দে’জ-এর কাউন্টারের ভীড় ঠেলে গোটা-দুয়েক দরকারী বই কিনে, রাস্তায় নেমে সংস্কৃত কলেজের লাগোয়া দোকান থেকে এক কাপ লেবু চা খেয়ে নিয়ে পুরনো বইয়ের দোকানে কয়েকটা বইয়ের খোঁজ করল। ওর জানা-শোনা এক দোকানদার ইসমাইল ভাইয়ের সঙ্গে কিছু বইয়ের অর্ডার নিয়ে আলোচনা করে বাড়ী ফিরল যখন, সন্ধ্যে তখন শেষের দিকে। সুদীপ্তর ফ্ল্যাটের দক্ষিণের জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া মৃদু হাওয়া ওর পড়ার ঘরটাকে বেশ মনোরম করে তুলেছিল। অন্যমনস্ক ভাবে ল্যাপটপটা খুলে ‘লো চার্জ’ ইন্ডিকেটর আলোটা জ্বলে গেছে দেখে সুদীপ্ত ল্যাপ্টপটা চার্জে দিয়ে দিয়ে দিল। ইতিহাসের একটা বই আমাজনে পাওয়া যাচ্ছে কি না সেটা দেখা দরকার। স্ক্রিনটা জ্বলে উঠতেই সুদীপ্তর চোখ চলে গেল স্ক্রিনের তলার দিকটা তে! সবটা জুড়ে একটা ফিকে সবুজ ঢেউ যেন খেলে বেড়াচ্ছে সেখানে। মাউসের ওপরে হাত দিয়ে সাবধানে সেই সবুজ ঢেউটা কে এড়িয়ে ব্রাউসারটা চালু করার চেষ্টা করে একবারেই পেরে গেল। এবারে আর কোন শক-টক লাগল না। কিন্তু যতক্ষণ সুদীপ্ত ব্রাউসারের কাজ সারল, ততোক্ষন স্ক্রিনের তলার ঐ সবুজ ঢেউটা আস্তে আস্তে রঙ বদলাতে শুরু করেছে। আরো গাঢ় সবুজ রঙের ঢেউ খেলছে। তারপর যখন সুদীপ্ত কাজ শেষ করে ল্যাপটপ বন্ধ করতে যাবে ঠিক তক্ষুণি সেই স্ক্রিনের মাঝখানটাতে ফুটে উঠল সেই সবুজ গোলক! আর ল্যাপটপের স্পিকারে ভেসে এল সেই কন্ঠস্বর, ‘নমস্কার! সাইরাস বলছি। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে এই সবুজ বলটাতে ক্লিক করুন!’. সুদীপ্ত ল্যাপটপের পাওয়ার সুইচ-টা অফ করেদিল।
পরের দিনটা সুদীপ্তকে সকাল সকাল উঠে চান খাওয়া করে বেরুতে হয়েছিল। কলেজ ছিল। ক্লাস পড়াতে গিয়ে আজ একটা বেশ মজার ব্যাপার ঘটল। এমনিতে ইতিহাসের ছাত্র হলেও, সাল-তারিখ মনে রাখার ব্যাপারে সুদীপ্ত বেশ ভুলো। কিন্তু আজকে, এক ছাত্র ফরাসী বিপ্লবের কয়েকটা ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করায় সুদীপ্ত নিজের অজান্তেই তাদের তারিখগুলো পর পর বলে, সেই সময়কার আরও কয়েকটা ঘটনার কথা ব্যাখ্যা করে ফেলল! ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে সুদীপ্তর হাসি পেলো! শুনেছিল ব্রাম্ভী শাক খেলে নাকি স্মৃতি শক্তি বাড়ে। কিন্তু সে তো বাড়ী থেকে বেরুনোর সময় ভাতের সঙ্গে পালং শাক খেয়ে এসেছে!
তিন-তিনটে ক্লাস পড়িয়ে টিচার্স রুমে বসে সবে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, এমন সময় ঝড়ের বেগে বিশ্বরূপের প্রবেশ! বিশ্বরূপ কলেজের ছোকরা অধ্যাপক। ফিজিকস পড়ায়। বছর দুয়েক হোল, কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছে। সুদীপ্তর সঙ্গে বেশ ভাব! বিশ্বরূপ সুদীপ্তকে দেখেই পাশে বসে পড়ল, ‘দেখেছেন কি কান্ড হচ্ছে?’
- ‘না। কি হয়েছে?’
- ‘ইন্টারনেট টাস্ক ফোর্সের কাছ থেকে সমস্ত দেশে ওয়ার্নিং এসেছে, যে ‘পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামের একটা অজানা সফট্ওয়্যার খুব দ্রুত বিভিন্ন কম্প্যুটারে ছড়িয়ে পড়ছে! কিন্তু এই সফটওয়্যারটি ঠিক কি ধরণের ক্ষতি করতে পারে, সেটা বোঝা যায় নি। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কিছু অল্পবয়সী হ্যাকারদের কাজ এটা! নিছক দুষ্টুমি করার জন্য হয়তো বাজারে ছেড়েছে! কিন্তু অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং এটির দেখা পেলেই, অ্যান্টি-ভাইরাস চালিয়ে এটিকে নিস্ক্রৃয় করে ডিলিট করে দেওয়া উচিত্।‘
বিশ্বরূপের কথা শুনতে শুনতে সুদীপ্ত চমকে উঠল, ‘আরে, তাহলে কি ও’র ল্যাপটপ-টাতে ঐ ভাইরাসটা ঢুকল? তাহলে তো মুশকিল! এ আবার কি গোলমাল করবে?’ কিন্তু এমনই কপাল যে, সুদীপ্ত এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করার আগেই বিশ্বরূপকে প্রায় থাবা দিয়ে থামিয়ে পলিটিকাল সায়েন্সের স্বরাজ বাবু আলোচনার মোড় পে-কমিশনের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। এবারে নাকি ইনক্রিমেন্টের কোন চান্স নেই। ‘ আরে রাখুন আপনার কম্প্যুটার, আর তার ভাইরাস! এই মাগ্গি-গন্ডার বাজারে মাইনে না বাড়লে শিক্ষকদের চলবে কিসে?’ ইত্যাদি…
এর মধ্যে পরের ক্লাসের সময় হয়ে গেল, অগত্যা সুদীপ্তকে উঠতেই হল। কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যে।
আজ কিছু কলেজের পরীক্ষার খাতা দেখতে হবে! হাত মুখ ধুয়ে, ফেরার পথে কিনে আনা রোল আর কফি খেয়ে সুদীপ্ত বসল খাতার দিস্তে নিয়ে। কিন্তু কি মুশকিল! পাশে খুলে রাখা কম্প্যুটারের মনিটরে যে আবার সবুজ গোলকটা জ্বলতে-নিবতে শুরু করেছে! হঠাৎ মনে হল অকিঞ্চনকে ফোন করে দেখবে? ওতো কম্প্যুটর সায়েন্সের অধ্যাপক। হয়তো ও’র সংশয়টা দুর করতে পারবে? অকিঞ্চনকে একবারের চেষ্টায় পাওয়া গেল। সব শুনেটুনে অকিঞ্চন বলল, ‘পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ ভাইরাসের কথা সেও শুনেছে এবং এটা নিয়ে যে কম্প্যুটার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানান আলোচনা চলছে তার খবর সে রাখে। কিন্তু যদ্দুর সে জানে এখনও পর্যন্ত এরকম কোন সফট্ওয়্যার তৈরী হয়নি যা মানুষকে ইলেক্ট্রিক শক দিতে সক্ষম! ওটা নিশ্চই কোন ইলেক্ট্রিকাল গোলমাল। এবং কোন কম্প্যুটার সারাইয়ের দোকানে- দেখিয়ে নিয়ে তারপর ব্যবহার করা উচিত। সুদীপ্ত ঠিক করল, আর দেরী না করে কালকের মধ্যেই পাড়ার কম্প্যুটারের দোকানটায় একবার দেখিয়ে আনবে। আর দরকার হলে, ওদের কাছে রেখে আসবে যাতে ওরা দেখে-টেখে যা ঠিক করার করে দিয়ে ঐ হতচ্ছাড়া পার্সোন্যাল ভাইরাস না কি ছাতা -টা কে ডিলিট করে দেয়!
পরের দিন সকাল থেকেই সুদীপ্তর শরীরটা কিরকম যেন ম্যাজ্-ম্যাজ্ করতে শুরু করল| থেকে থেকেই শরীরের ভেতরে একটা শিরশিরে ভাব। যেন একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ সারা শরীরটায় ছুটে বেড়াচ্ছে! অতএব কলেজ যাওয়া যাবে না আজ! ‘এ আবার কি বেয়াড়া রোগ বাধল রে বাবা!’ ও’র ডাক্তার বন্ধু সন্দীপকে ফোন করে চেম্বারে পেয়ে গেল। সন্দীপ অবশ্য ও’র উপসর্গ শুনে-টুনে সে রকম পাত্তা দিল না; ‘মনে হচ্ছে কোন লো-গ্রেড ভাইরাল ইনফেকশন! তুই জল, ফ্রুট-জুস এইসব একটু বেশি করে করে খা সারাদিন ধরে। আর জ্বর ভাব থাকলে একটা প্যারাসিটামল মেরে শুয়ে থাক!’
অগত্যা বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে জীবনানন্দের গল্প সমগ্রে মন দেওয়াই স্থির করল সুদীপ্ত। তবে ক্যালপলের মহিমায় চোখের পাতা-দুটো লেগে যাচ্ছে দেখে, একটু ঘুমনোর চেষ্টায় মন দিল সুদীপ্ত।
কিন্তু এমন অবেলায় ঘুম আসবে কোত্থেকে? অন্যান্য দিন, এই সময় স্টাফ-রুমে দু-রাউন্ড চা হয়ে গেছে। বাংলা বিভাগের অমূল্যবাবুর সঙ্গে কোন একটা মঙ্গল-কাব্যের রচনাকাল নিয়ে তর্ক জমে উঠেছে! তা – না, ভর সক্কালবেলা বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে! কোন মানে হয়?
চোখ বুজে মধ্যযুগের ইতিহাসের একটা সময় নিয়ে ভাবতে গিয়ে সুদীপ্তর খেয়াল হল কতকগুলো ওয়েবসাইট ও লিখে রেখেছিল যেখান থেকে কিছু দরকারি গবেষণা পত্র পেতে পারে। আর কি আশ্চর্য, ভাবনাটা মাথায় আসতেই পুরো লিস্টটা চোখের সামনে ভেসে উঠল যেন! প্রথম সাইট টায় যাওয়ার কথা ভাবতে না ভাবতে পুরো সাইটটা আবার ভেসে উঠল! উত্তেজনায় সুদীপ্ত খাটে উঠে বসল। আরেকটু তলিয়ে ভাবতে গিয়ে আরো তাজ্জব হয়ে গেল! ‘আরে! আমি তো একের পর এক ওয়েব পেজ মনে মনে সার্ফ করে চলেছি! সব কটা পাতা, তার সব লেখা জলের মত পরিস্কার চোখের সামনে ভেসে উঠছে!! একি অসম্ভব ব্যাপার!’
অফিসে থাকাকালীন ভয়ঙ্কর খবরটা সুচেতনার কাছে এলো একটি ইমেল মারফত! ইন্টারনেট টাস্ক ফোর্স থেকে রেড অ্যালার্ট এসেছে। বিষয় ‘সাইরাস -পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামের একটি ভাইরাস। সাইরাস কথাটা নাকি সাইবার ভাইরাসের ছোট নাম হিসেবে দিয়েছে হ্যাকাররা। এই ভাইরাস দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। আর প্রাথমিক পর্যায়ের রিপোর্টে জানা যাচ্ছে আপাত নিরীহ এই সফট্ওয়্যারটি নাকি কোন কোন ব্যবহারকারীকে মাউসের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে আক্রমণ করে…” সুচেতনা পুরোটা পড়তে পারল না। ভয়ে হিম হয়ে যাওয়া হাতটা ল্যাপটপ থেকে সরিয়ে কোন রকমে লগ-অফ করে রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে অনেকবার সুদীপ্তকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু ফোন বেজে যাচ্ছে। সুদীপ্ত কি তাহলে ঘুমোচ্ছে? ফোনটা ধরছে না কেন? অসহ্য উৎকণ্ঠায় প্রায় সারাটা রাস্তা ছটফট করতে করতে সুচেতনা এক সময় পৌঙছে গেল সুদীপ্তদের ফ্ল্যাট বাড়ীর কাছে।
সুচেতনা যখন সুদীপ্তর ফ্ল্যাট বাড়ীর সাত তলার লিফটের দরজা খুলে বেরোচ্ছে তখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে একরাশ কালো মেঘ আজ অন্ধকারকে একটু তাড়াতাড়ি ডেকে এনে বসন্তের মনোরম বিকেলকে বিষণ্ণ করে দিয়েছে।
সুদীপ্তর ফ্ল্যাটের দরজা খোলা! সুচেতনা প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে অন্ধকারে প্রথমে কিছু ঠাওর করতে পারল না। তারপর একটু চোখটা সয়ে গেলে দেখতে পেল, সুদীপ্ত বসে আছে জানলার দিকে মুখ করে। অন্ধকারে একটা সিলুয়েটের মত। বাইরের আকাশে তখন গাঢ় নীল মেঘের ওপর বিদ্যুতের চমক খেলছে। সুচেতনা প্রায় ককিয়ে উঠে ডাকল, ‘সুদীপ্ত! সুদীপ্ত! তোমার ভীষণ বিপদ!’ হয়তো সুচেতনার গলা শুনেই হয়তো সুদীপ্তর মাথাটা পেছন দিকে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরে গেল। ভয়ে হিম হয়ে জ্ঞান হারাতে হারাতে সুচেতনা দেখল সুদীপ্তর চোখের জায়গায় দুটো সবুজ আগুনের গুলি! সে দুটো জ্বলছে আর নিবছে! আর সুদীপ্তর মুখ থেকে একটা রক্ত জল করা যান্ত্রিক স্বর বলে উঠল, ‘নমস্কার সুচেতনা! সাইরাস বলছি। আপনার কিছু প্রশ্ন থাকলে আমার হাতটা ছুঁয়ে প্রশ্ন করুন !’