• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১ | জুন ১৯৯৭ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • নামিব-এর মরুভূমিতে : অমিতাভ সেন
    translated from English to Bengali by ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত
    পর্ব ১ | পর্ব ২



    || ১ ||

    এরোপ্লেন চালাবার সময় নিশ্চয় এরকমই মনে হয়—কোন পথচিহ্ন নেই, ভরাট আকাশের নিচে সম্পূর্ণ দিকশূন্যতা। কোথায় আছি তা জানতে গেলে যন্ত্রপাতির কাঁটাই ভরসা যা বলে দেয় কতটা সময় পার হল, কতদূর এলাম, কতটা পথ বাকি। নামিবিয়ার Naukluft পার্কে জনশূন্য প্রান্তরে সূর্যাস্তের পর ড্রাইভ করার অনুভূতি এরকম। যেন আমরা কোন গ্রহান্তরে আছি।

    সকালের ফ্লাইটে Windhoek-এ নেমে আমরা ঠিক করেছিলাম পশ্চিমে Swakopmund পর্যন্ত ৩৫৬ কি.মি. পথ সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাব। ম্যাপ-এ দেখাচ্ছে যে সি ২৮ নামের রাস্তাটাই দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে কম এবং গাইড বইয়ে রাস্তাটিকে “Scenic” বলা হয়েছে। কিন্তু পথে বেরিয়ে যা পেলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। Windhoek থেকে বেরিয়ে ১০ কি.মি. যেতেই পিচ্‌-ঢালা পাহাড়ি রাস্তা হঠাৎ চওড়া খোয়া-ঢালা পাহাড়ি রাস্তা হয়ে গেল এবং আমরা “সি” নামের রাস্তাগুলির চরিত্র বুঝলাম তাদের গুঁতো খেয়ে।

    নামিবিয়া দেশটা জুড়েই রাস্তার জাল পাতা আছে। রাস্তাগুলোর নাম হল বি১, সি২৮, ডি১২৯৫ বা এইরকম কিছু। “বি” দিয়ে শুরু যে রাস্তার নাম, শুধু সে গুলোই পিচ্‌ ঢালা। বাকিগুলো খোয়ার রাস্তা। এখানকার জলবায়ুতে পিচ্‌ ঢালা রাস্তা বাহনযোগ্য করে রাখা খুব একটা সহজ নয় বলে প্রথমে ভেবেছিলাম যে সহজে মেরামত করা যায় এমন খোয়ার রাস্তা পাতার পরিকল্পনাটা কোন সরকারি দপ্তর থেকে ভেবেচিন্তেই ঠিক করা হয়েছে। পরে জানলাম, তা নয়, আসল কারণ হল টাকার অভাব। ট্রাফিক কম বলে ভালো রাস্তা বানাবার পিছনে বিশেষ যুক্তিও নেই।



    এখানে ডোলেরাইট আর মাইকার স্তর থাকার জন্য মাটির রং ধূসর বা কালো এবং তার উপর আগ্নেয় শিলার স্তূপ ছড়ানো...



    পর্যটনের শেষে আমি প্রায় ৩২০০ কি.মি. গাড়ি চালিয়ে খোয়ার রাস্তার বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম। এইসব রাস্তার জন্য ‘ওয়েভ থিওরি’-ও বের করেছিলাম।

    রাস্তাগুলো উঁচুনীচু। কিছু কিছু জায়গায় বৃষ্টির জলে সমতল পথ ক্ষয়ে যাবার ফলে গাড়িটা অনবরত ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলছিল--এ জায়গাগুলোকে নাম দিলাম ‘শর্ট ওয়েভলেংথ্‌’ রাস্তা। যে জায়গাগুলোতে ঝর্ণার জল এসে বড় বড় গর্ত করে রেখেছে এবং গাড়ি একবার নামে তো একবার ওঠে—সে জায়গাগুলোকে বলা যায় ‘লং ওয়েভলেংথ্‌’ রাস্তা। এখানে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা আকাশ-উন্মুখ টিলাগুলো দেখে অনেকটা রশি দিয়ে টেনে রাখা বিরাট গ্যাস বেলুনের কথা মনে হবে।

    কোথাও কোথাও রাস্তা বেশ খাড়া হয়ে নেমে গিয়েছে। নীচে নামার সময় স্পীড্‌ দিয়ে নামাই ভালো, নইলে উপরে উঠবার বেলা নরম বালিতে আটকে যাবার সম্ভাবনা। একবার বেশি জোরে গাড়ি চালাবার ফলে আমাদের ভক্‌স-ওয়াগন্‌ পোলো’র পিছনের ফেন্ডারটা ঢালুর নীচে মাটিতে ধাক্কা লেগে খুলেই গেল। কেবলমাত্র একটা স্যুইস আর্মি নাইফ দিয়ে ওটাকে ফের জুড়ে দিতে পারলাম দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। রাত্রিবেলা Swakopmund-এ ঢোকার মুখে শুধু হেডলাইটের কাছের খানিকটা অংশ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এক সময় আকস্মিকভাবে রাস্তাটা দেয়ালের মত খাড়া হয়ে আমাদের সামনে উঠে যেতে লাগল। সে এক শিহরন জাগানো দৃশ্য, যেন কেউ রাস্তাটাকেই আকশে তুলে দিয়েছে। ওটাই আমাদের দেখা সবচেয়ে বড় ‘ওয়েভ’।

    গাড়ির ট্রিপ মিটার এখে বুঝতে পারছিলাম যে আমরা Swakopmund-এর কাছাকাছি চলে এসেছি কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। প্রায় ২০০ কি. মি. আগে দুটো ক্যারাকাল (Caracal) বেড়াল দেখেছিলাম, তারপর থেকে পথ পুরো ফাঁকা। একসময় সমুদ্রের গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথেই মেঘে ঢোকার মত এক ঘন কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়েছি।

    কুয়াশার পিছনেই Swakopmund, আটলান্টিকের তীরে সুন্দর ছুটি কাটাবার শহর। এ দেশে জার্মানির শিকড় এখান থেকেই গজাতে শুরু করে। ইয়োরোপীয় দেশগুলো যখন পাইকারি হারে পৃথিবীর জমি দখল করে বেড়াচ্ছিল তখনকার দিনে এক জার্মান পথিকৃৎ দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার সমুদ্রতটবর্তী এলাকাগুলি ‘পিতৃভূমি’র অংশ বলে দখল করার জন্যে বিস্‌মার্কের কাছে একটি আবেদন পাঠান। সেটা ছিল ১৮৮৩ সাল। তখন ব্রিটিশদেরও নজর ছিল Swakopmund-এর দক্ষিণে Walvis উপসাগরের ১০০ ফুট উঁচু গুয়ানো বা পাখির মলের স্তরগুলির উপর (যা এই অনুর্বর অঞ্চলে সার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য)। মরুভূমির প্রতি কোন আকর্ষণ না থাকায় (এখানে হীরে, ইউরেনিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থও তখনও পাওয়া যায়নি বলে), বিস্‌মার্ক নাকি বলেছিলেন, “আমার আফ্রিকার মানচিত্র এই ইয়োরোপে। এখানেই রাশিয়া, এখানেই ফ্রান্স এবং আমরা ঠিক তার মাঝখানে। এটাই আমার আফ্রিকার ম্যাপ।” এর পরেও অবশ্য অনেকটা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত ঔপনিবেশিক কোম্পানিগুলির মধ্যে দিয়ে এই দেশে জার্মানদের উপস্থিতি বজায় থাকে এবং ১৮৯০ সালে এই অঞ্চল উত্তরে পর্তুগীজ আঙ্গোলা এবং পূর্বে ব্রিটিশ বেচুয়ানাল্যান্ড-এর সম্মতিক্রমে জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর দেশটা দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে চলে যায়। খুবই সম্প্রতি, ১৯৯০ সালে, নামিবিয়া স্বাধীন হয়েছে।



    Swakopmund, অ্যাটলান্টিকের তীরে সুন্দর ছুটি কাটাবার শহর...



    ডয়েশ্‌ হাউসের সামনে একটা Moon Buggy এসে দাঁড়ায় এবং একটি মিষ্টভাষী লোক বেরিয়ে আমাদের জার্মানে সম্ভাষণ জানায়। Moon Buggy আর কিছুই নয়, আসলে একটু ছাঁটকাট করা একখানা ল্যান্ডরোভার ট্রাক। তার গায়ে লেখা “চার্লি মরুভূমি ভ্রমণ”। তাতে চেপে আমরা নামিব-এর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি পর্যটনে বেরিয়ে পড়লাম।

    মরুভূমি বললেই আমার চোখের সামনে রাজস্থানের বালির ঢেউ বা লরেন্স অব আরেবিয়া-র দৃশ্য ভেসে ওঠে। কিন্তু এই মরুভূমি একেবারেই আলাদা। অনেকটা চাঁদের পিঠের মত। এখানে ডোলেরাইট আর মাইকার স্তর থাকার জন্য মাটির রং ধূসর বা কালো এবং তার উপর আগ্নেয় শিলার স্তূপ ছড়ানো। উঁচু টিলার উপর থেকে আমরা সারি সারি ক্ষুদে পাহাড় দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে দূরত্ব আর আকারের অনুভূতি লোপ পায় এবং মনে হয় যেন পামীর মালভূমির কোন রিলিফ ম্যাপের দিকে তাকিয়ে আছি।

    “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” জীবনদর্শনের একটি স্মৃতিসৌধ পার হয়ে এলাম। মরুভূমির মাঝখানে একটি পুরনো আমলের স্টীম ইঞ্জিন। ১৮৯৬ সালে এক জার্মান ইঞ্জিনিয়ার গরুর গাড়ি তুলে দেবেন ভেবে নিয়ে আসেন, কিন্তু জলের অভাবে স্টীম ইঞ্জিন চালানোই সম্ভব হয়নি। স্মৃতিসৌধের নাম মার্টিন লুথার, তাঁর এই বিখ্যাত উক্তি-কে স্মরণ করে—“এইখানে আমি দাঁড়ালাম। ঈশ্বর আমায় সাহায্য করবেন, কারণ আমার আর কোন গতি নেই।”



    এই মরুভূমি একেবারেই আলাদা, অনেকটা চাঁদের পিঠের মত ...



    মরুভূমির মাঝখানে Swakop নদীর শুকনো অববাহিকা ধরে এক চিলতে সবুজ। নদী কথাটা বেমানান, এখনকার কোন নদীতেই জল থাকে না। তবে নদীর অববাহিকার নীচে কিছু ভূগর্ভস্থ জল বয়ে যায় ও তার দরুন কিছু উদ্ভিদ জীবন সম্ভব। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি হলে খাড়া একটা জলের দেয়াল শুকনো নদীর উপর বিপুল বেগে নেমে এসে কিছুক্ষণের জন্য প্রাণের সঞ্চার করে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মাটি সে জল শুষে নেয়। শুধু Acacia গাছের গায়ে আটকানো ভেসে আসা জিনিসপত্র দেখে বোঝা যায় যে কোন এক সময়ে এখান দিয়ে জল বয়ে গিয়েছিল।

    মরুভূমির আরো ভিতরের দিকে ইতস্তত বালির টিলার গায়ে আগাছা লেগে আছে দেখলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে ঝোপঝাড়গুলো জল পায় সমুদ্রতীরের কুয়াশা থেকে। ভেনেজুয়েলার ঠান্ডা জলের স্রোত আর মরুভূমির উষ্ণতা এক হয়ে যে ঘন কুয়াশার সৃষ্টি করে তা প্রতি রাত্রে ডাঙার ভিতর প্রায় ৫০ কি.মি. চলে এসে সবার অলক্ষ্যে নামিব-এর উদ্ভিদজগৎকে প্রাণের স্পর্শ দিয়ে যায়।

    আগের পর্যটকদের গাড়ির চাকার দাগের উপর দিয়েই আমাদের moon buggy ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলল, যাতে নতুন চাকার দাগে লাইকেনের (Lichen) স্তর নষ্ট না হয়ে যায়। লাইকেন, যাকে অ্যাল্‌গি আর ফাংগাসের যৌথ উদ্যোগ বলা যেতে পারে, ঊষর জমির প্রথম দখল নেয় এবং মরুভূমির প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এর অন্যতম ভূমিকা। গাড়ির চাকায় এই লাইকেনের স্তর নষ্ট করে দিলে তা আবার তৈরি হতে দশ লক্ষ বছর লেগে যাবে।

    প্রকৃতি-সংরক্ষণের ব্যাপারে নামিবিয়া বেশ হুঁশিয়ার। আমি যতদূর জানি নামিবিয়াই একমাত্র দেশ যার সংবিধানে প্রকৃতি সংরক্ষণের কথা লেখা আছে। দেশের কিছু অংশে ট্যুরিস্টদের সাধারণত যেতে দেওয়াও হয় না। যেমন Swakopmund-এর উত্তর পূর্বে মরুভূমির হাতির জন্য বিখ্যাত কংকাল উপকূল (Skeletal Coast). কংকাল উপকূলের নাম এরকম হওয়ার কারণ এখানে প্রচুর জাহাজ কুয়াশায় দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে তীরে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে আছে।

    যাওয়ার পথে কিছু অদ্ভুত গাছ চোখে পড়ল। যেমন !-নারা গাছ (এর “!” অক্ষরটির উচ্চারণ ডামারাস ভাষায় গলা দিয়ে ক্লাক্‌ শব্দ করার মত)। জ্বলজ্বলে নিয়ন-সবুজ রঙের বাঁকানো কাঁটার ঝোপ। কোন পাতা নেই, পাতার কাজ গাছের কাণ্ড দিয়েই হচ্ছে। এতে উটপাখির ডিমের মত বড় বড় যে ফল হয় তা এই মরুভূমিতে যে কয়েকটি মাত্র খাবার পাওয়া যায় তার একটি। মানুষ আর পশু দুই-ই এই খেয়েই বাঁচে।



    প্রতিকূল অবস্থাতেও বেঁচে থাকার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত হল ওয়েলউইট্‌শিয়া মিরাবিলিস ...



    প্রতিকূল অবস্থাতেও বেঁচে থাকার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত হল ওয়েলউইট্‌শিয়া মিরাবিলিস (Welwitschia Mirabilis)—পৃথিবীর একটি দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদ যা কিনা ১৫০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। মরুভূমির ভিতরে এক একটি মঠের মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি দেখবার সংকল্প নিয়ে আমরা এগোলাম। গাছটি মিনিম্যালিস্ট ঢং-য়ে তৈরি। একটা ডাণ্ডার মত কাণ্ড, আর দুটো ডানার মত মেলে দেওয়া প্লাস্টিক-সুলভ শক্ত পাতা যার ধারগুলো মরুভূমির বাতাসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। ব্যাস্‌। সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী গাছটিও অনেক দূরে, যেন প্রতিটি গাছ নিজের ব্যক্তিগত এলাকার জন্য লড়তে প্রস্তুত।

    প্রথম কয়েকদিনের বেড়ানো শেষ হতেই আমরা বুঝতে পেরেছি যে কোন স্বল্পবাক্‌ মানুষের মতই মরুভূমিরও না-বলা অনেক গল্প রয়েছে। নামিব মরুভূমির সাথে আমাদের পরবর্তী (ও আরও দর্শনীয়) সাক্ষাতের জন্য তাই আমরা খুবই উৎসুক হয়ে ফিরেছিলাম।

    দিনের বাকি সময়টাতে আমরা শহরটা ঘুরে দেখলাম। সেখানে জার্মান প্রভাব খুব প্রকট। আমরা কাইজার উইল্‌হেল্‌ম্‌ স্ট্রাস-এর উপর Swakopmund-এর Buchhandlung (অর্থাৎ বইয়ের দোকান) দেখতে পেলাম। পরে বীচে দাঁড়ানো একটি লাইটহাউসের কাছে সূর্যাস্ত হতে দেখলাম। লাইটহাউস যেন কংকাল উপকূল, ঊষরতা এবং একাকীত্বের পরিচয়ে পরিচিত এই দেশের একটি শ্লেষবিধুর উপমা। বলাও হয় নামিবিয়া এমন একটি দেশ যার সৃষ্টি ঈশ্বর তাঁর এক ক্রোধের লগ্নে করে ফেলেছিলেন।







    অলংকরণ (Artwork) : Photo: Sharon Butler
  • পর্ব ১ | পর্ব ২
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments